প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি: আদর্শের নিরিখে হতাশা ও প্রাথমিক শিক্ষায় আশা

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠনের দিকে না গিয়ে একটা কমিটি করে যাদের কাজ হলো নির্দিষ্ট দুটি কমিশন রিপোর্ট ও একটি অকার্যকর শিক্ষানীতিকে কেন্দ্র নতুন শিক্ষানীতি তৈরি করা। কমিটির কাজের ধরন ও প্রকৃতি নিয়ে অনেকের আপত্তি ছিলো প্রথমদিকে। তা কেটে গেলেও সেখানে নতুন কিছু কথার জন্ম হয়েছে [...]

আদর্শের নিরিখে হতাশা
শিক্ষার সংজ্ঞা নিয়ে চিন্তুকদের মধ্যে সবচেয়ে দ্বিধার মধ্যে ছিলেন বোধহয় পাওলো ফ্রেইরি। বিশেষ করে রুশোর শিক্ষাদর্শন প্রথমদিকে তাঁকে বেশ প্রভাবিত করেছিলো। এই দ্বিধার একটা কারণ হতে পারে, বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃতির সাথে শিক্ষাকে পরিপূর্ণ অর্থে মেলানো খুবই কষ্টকর, যদিও রুশো বিশ্বাস করতেন মানুষ চাইলে সব শিক্ষা প্রকৃতির কাছ থেকেই পেতে পারে। আবার সমাজকাঠামো, রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া কিংবা এ ধরনের ফেনোমেননগুলো থাকলে প্রকৃতির কাছ থেকে ঠিক সরলভাবে শিক্ষা আশা করা যায় না। প্রাকৃতিক বিষয়গুলো ঠিক যতোটা সহজ-সরল বলে রুশোর কাছে প্রতিভাত হয়েছিলো, বিষয়গুলো আসলে ততোটা একরৈখিক নয়। তার ওপর মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাভেদে শিক্ষা ও তার পরবর্তী গন্তব্য কখনোই এক হয় না। ফলে ফ্রেইরি একটা সময় পার করে রুশোর শিক্ষাদর্শন-বিশ্বাস থেকে সরে এসেছিলেন।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া)

শিক্ষা নিয়ে এই ডিসকোর্সগুলো খুব আলোচিত হয়েছিলো বিশেষ করে সত্তরের দশকে। এই সময়ে আবার ‘সবার জন্য শিক্ষা’ জাতীয় ধারণাগুলো সবেমাত্র দানা বাধতে শুরু করেছে। সে সময়ই যে প্রশ্নটি নিয়ে শিক্ষাচিন্তুকরা দ্বিধায় পড়েন, সেটি হলো— শিক্ষা কেন? দেখা গেলো, এবং কোথাও কোথাও স্বীকারও করে নেওয়া হলো— এর সরল সংজ্ঞায়ন সম্ভব নয় এবং এর প্রয়োজন নেই। যেহেতু বর্তমান পৃথিবী রাষ্ট্রকাঠামো-নির্ভর, সুতরাং রাষ্ট্রই নিজ অবস্থাভেদে এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করবে। ফ্রেইরি তখন বলেছিলেন— রাষ্ট্র পক্ষপাতমূলক আচরণ করলে শিক্ষার গন্তব্যে পৌঁছানো মানুষের জন্য খুবই কষ্টকর হবে, আর এ ধরনের রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে পক্ষপাত দেখানো। না হলে রাষ্ট্রের পক্ষেও টিকে থাকা সম্ভব নয়।

কথা হলো, রাষ্ট্র কার প্রতি পক্ষপাত দেখায়? স্বাভাবিক উত্তর হচ্ছে— অর্থ যেদিকে, রাষ্ট্র্ও সেদিকেই। তাহলে গরীব, লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত, নিপীড়িত কিংবা প্রান্তিক মানুষের শিক্ষার কী হবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই কিন্তু ফ্রেইরির পেডাগজি অব দ্যা অপ্রেসড

২.
আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে নতুন শিক্ষানীতির কথা ছিলো। ক্ষমতায় আসার পর তারা পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠনের দিকে না গিয়ে একটা কমিটি করে যাদের কাজ হলো নির্দিষ্ট দুটি কমিশন রিপোর্ট ও একটি অকার্যকর শিক্ষানীতিকে কেন্দ্র নতুন শিক্ষানীতি তৈরি করা, বলা ভালো সেটিকে আপডেট করা। কমিটি তাদের কাজ করেছে, যদিও কাজের ধরন ও প্রকৃতি নিয়ে অনেকের আপত্তি ছিলো প্রথমদিকে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া) ওয়েবে প্রকাশের পর অনেকের সে আপত্তি কেটে গেলেও সেখানে আরও নতুন কিছু কথার জন্ম হয়েছে।

৩.
শিক্ষানীতিটি হাতে নিয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম, কোন ধরনের আদর্শমানের নিরিখে রাষ্ট্র শিক্ষাকে কোন দিকে নিয়ে যেতে চায়। এই ভাবনার সাথে আসলে সত্তরের দশকের শিক্ষাভাবনা মিলে যায়। কারণ এই মৌলিক প্রশ্নটির উত্তর পরবর্তী অনেক গন্তব্যকে সহজেই চিনিয়ে দেয়। জীবনের মাঝামাঝি সময়ে পাওলো ফ্রেইরি ঠিক এই বিষয়টি নিয়েই কাজ করছিলেন। তিনি বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর শিক্ষা-ভাবনা পড়ে ওই দেশগুলোর গন্তব্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন। কারণটা জানা— আজকের শিক্ষানীতিই ঠিক করবে আগামী দিনে জাতি হিসেবে আমরা কোথায় থাকতে চাই। সুতরাং এই প্রশ্নটি এবং এরকম আরও কিছু প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের শিক্ষানীতিতে যে মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর থাকার কথা, সেটি না থাকায় আবারও ফ্রেইরিকে উল্টেপাল্টে দেখলাম; ওই সময়ের আন্ডারস্ট্যান্ডিং-এর আলোকে বর্তমান সময়ের শিক্ষাটাকে আবারও ঝালিয়ে নিয়ে দেখলাম— এ সময়ে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এতে যতো দিন যাচ্ছে, শিক্ষার চেয়ে ‘স্কিল’-এর গুরুত্বটা বেশি করে বেড়ে যাচ্ছে। আর শিক্ষার প্রথম আনুষ্ঠানিক ভিত্তি যখন প্রাথমিক শিক্ষা, তখন সেই চ্যাপ্টারটা উল্টিয়ে দেখা গেলো প্রশ্ন আসলে অনেক, কিছু উত্তর আছে, কিছু নেই। ফলে তত্ত্ব, আদর্শ কিংবা সে অনুযায়ী চাহিদার কথা বাদ দিয়ে দেশের নিরেট বর্তমান বাস্তবতাকে পুঁজি করে শিক্ষানীতি পড়তে বসি।

সুতরাং, যেহেতু এই শিক্ষানীতি মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রসম্পর্কিত আদর্শমান নিয়ে কথা বলার চেয়ে এর ব্যবস্থাপনা দিকটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে বেশি, তাই আদর্শের নিরিখে হতাশা নিয়ে ব্যবস্থাপনার নিরিখে নীতিটি উল্টেপাল্টে দেখি। তাই এ বিষয়ে, এই স্কেলে কিংবা এই মানদণ্ডে কথাবার্তা শেষ।

প্রাথমিক শিক্ষায় আশা
প্রাথমিক শিক্ষা কেন?— আপাতদৃষ্টিতে সহজ এ প্রশ্নের উত্তর জটিল হতে পারে। কারণ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা কেন দেওয়া হবে এবং জনগণের পক্ষ থেকেই বা এই শিক্ষা কেন নেওয়া হবে— প্রশ্নদুটোর উত্তর নির্ভর করে রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও মূলনীতি, রাষ্ট্র ও জনগণের চাহিদা, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বৃহত্তর আঙ্গিকে টিকে থাকা, পারিপার্শ্বিকতা, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ গন্তব্য ইত্যাদি নানা প্রপঞ্চের ওপর। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আদর্শের সাথে সাধারণত ‘সামাজিক আদর্শ’কে মেলানো হয় না। তাতে রাষ্ট্রের ঝামেলা বাড়ে যে ঝামেলায় রাষ্ট্র যেতে চায় না। তাছাড়া রাষ্ট্র জনগণকে কতোটা শিক্ষাপ্রদানের ক্ষমতা রাখে তাও একটি বড় ফ্যাক্টর। কোনো রাষ্ট্র প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে মাধ্যমিক শিক্ষার উপযোগী করে তুলতে পারে, কোনো রাষ্ট্র মৌলিক ও প্রাথমিক শিক্ষার দ্বারা জনগণের মধ্যে শিক্ষার ভিত সৃষ্টি ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিকে প্রাধান্য দিতে পারে, আবার কোনো রাষ্ট্র প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে যাতে তারা অন্তত স্বনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ, প্রণোদনা ও দক্ষতা অর্জন করতে পারে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অবস্থান কী?— প্রশ্নটির উত্তর থাকার কথা শিক্ষা বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্র শিক্ষানীতিতে। স্বাধীনতার পর গঠিত প্রতিটি জাতীয় শিক্ষা কমিশন বা কমিটি প্রতিবেদন প্রদান করলেও ক্ষমতার পালাবদল বা অন্য কোনো কারণে শিক্ষানীতি হিসেবে সেগুলো আলোর মুখ দেখে নি, যদিও শিক্ষানীতির ধারণা এদেশে নতুন নয়। আদর্শের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দোদুল্যমানতা, শিক্ষানীতি প্রণয়নে জড়িত ব্যক্তিদের সাথে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের চিন্তাচেতনার পার্থক্য এবং উন্নত শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার বিষয়টি একমাত্র বিষয় না হওয়ায় পূর্বতন শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নের কাজ এগোয় নি। ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুল হকের নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদন প্রদানের পর তৎকালীন সরকার আরেকটি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি শামসুল হক কমিশন প্রণীত রিপোর্টের আলোকে আরেকটি ছোট এবং খণ্ডিত প্রতিবেদন তৈরি করে যা ২০০০ সালে জাতীয় সংসদে আলোচনার পর জাতীয় নীতি হিসেবে গৃহীত হয়। বাংলাদেশে এটিই একমাত্র শিক্ষা বিষয়ক নীতি যা আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত, কিন্তু ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর তা আর বাস্তবায়িত হয় নি। সুতরাং সেগুলো থেকে উপযুক্ত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় নি।

বর্তমান খসড়া শিক্ষানীতিটিই বোধহয় সর্বপ্রথম এ উত্তর দিচ্ছে যে— বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় জনগণকে স্বনির্ভরশীল করার পাশাপাশি পরবর্তী স্তরের উপযোগী করে তোলার সব প্রক্রিয়া বিদ্যমান থাকবে। সুতরাং প্রাথমিক শিক্ষা কেন— খসড়া শিক্ষানীতিতে এ প্রশ্নের উত্তরের আংশিক প্রতিফলন থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।

২.
খসড়া শিক্ষানীতিটির অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি (positive approach) যা পুরো প্রতিবেদনে নানাভাবে প্রতিফলিত। দেশের বিদ্যমান নানা সমস্যার ওপর আলোকপাত করে সে অনুসারে শিক্ষার গতিপথ নির্দিষ্ট করার পাশাপাশি জনসম্পদের নৈতিক দিক উন্নয়নের প্রচেষ্টার কথা রয়েছে সেখানে। ভূমিকাতে বলা হয়েছে— দেশে দেশে উন্নত তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষ লক্ষ বেকার কিন্তু উদ্যোগী তরুণের সামনে উপার্জনের পথ খুলে দিয়েছে। এ দেশের তরুণদের জন্য শিক্ষা-প্রশিক্ষণের এবং তথ্য, প্রযুক্তি ও পুঁজির ব্যবস্থা জরুরী। এ দেশের তরুণ সমাজের একাংশ আর্থ-সামাজিক কারণে হতাশাচ্ছন্ন হয়ে বিপথগামী হচ্ছে, মাদকাসক্তি ও সন্ত্রাসের পথ ধরছে। তাদের জন্য একটি সুস্থ ও সম্ভাবনাময় পরিবেশ তৈরী করা জরুরী। বাংলাদেশের কর্মক্ষম সাধারণ মানুষের অনেকেই উপার্জনের আশায় বিদেশ যেতে চায়। এদের প্রয়োজন শিক্ষার এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চাহিদা রয়েছে এমন দক্ষতা অর্জনের। এই শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এসবই বিবেচনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি অন্তর্ভুক্তি ও দক্ষতা সৃষ্টির পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি দ্রুত নিরক্ষরতা দূর এবং সকলের জন্য মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার ওপরও আলোকপাত করেছে। তাছাড়া প্রতিবেদন নিজের নীতিতে চিরকাল অবিচল না থেকে সময় ও অবস্থা বিবেচনায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে শিক্ষানীতিকে পর্যালোচনার মাধ্যমে যুগোপযোগী করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেছে, যা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দৃঢ়তার কাঠামোকে (rigidity) প্রত্যাখ্যান করে প্রয়োজনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের পথ উন্মুক্ত রেখেছে। প্রসঙ্গত, দেশে নানা প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় স্থায়ী কমিশন থাকলেও শিক্ষার জন্য স্থায়ী কমিশন নেই (সবকিছু ঠিক থাকলে অবশ্য স্থায়ী কমিশনের প্রয়োজন পড়ে না, কিন্তু সবকিছু কেন, শিক্ষাব্যবস্থায় দেশের অধিকাংশ বিষয়ই ঠিক নেই)। শিক্ষার জন্য স্থায়ী কমিশন গঠন করা হলে এ কাজটি তারাই করতে পারতো।

৩.
খসড়া শিক্ষানীতি প্রাথমিক শিক্ষার ওপর নতুন করে আলোকপাত করেছে। শিক্ষাকে ব্যাপকভিত্তিক করার লক্ষ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে সামনের কাতারে স্থান দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো বিবেচনায় বৃত্তিমূলক শিক্ষা যতোটুকু গুরুত্ব পাওয়ার কথা, ততোটুকু গুরুত্ব কখনোই পায় নি। বরং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে পেছনেই রাখা হয়েছে— সুযোগসুবিধা ও মানসিকতা উভয় দিক দিয়ে। ফলে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী শিক্ষার্থীরা সেখানে গেছে, যারা প্রথম পছন্দ সাধারণ শিক্ষায় কোনো কারণে টিকতে পারে নি। অথচ সাধারণ শিক্ষার সমান্তরালে শক্তিশালী ও দক্ষতামূলক ক্ষেত্র হিসেবে এটিকে গড়ে তোলার দরকার ছিলো। এ প্রতিবেদনে বিষয়টি যথাযথভাবে গুরুত্ব পেয়েছে।

৪.
একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত হলো প্রাথমিক শিক্ষা। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা শুরুর আগে প্রাকপ্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের প্রাথমিক স্তরের জন্য তৈরি করার বিষয়টি বাংলাদেশের শিক্ষায় সাম্প্রতিক সময়ে গুরুত্ব পেয়েছে। এই প্রতিফলন দেখা গেছে খসড়া শিক্ষানীতিতেও। শিশুর বয়স পাঁচ পেরুলেই তাকে এক বছর মেয়াদী প্রাকপ্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দেশের বর্তমান শিক্ষাকাঠামোতে এটির বাস্তবায়ন আপাতকঠিন হলেও প্রতি বছর নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগোলে কয়েক বছরের মধ্যে সব শিশুর জন্য প্রাকপ্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা অসম্ভব কোনো বিষয় নয়। শিশুদের মধ্যে প্রবল বিদ্যালয়ভীতি ও বিদ্যালয়ের প্রতি আকর্ষণহীনতা রয়েছে। অনেক শিশু বিদ্যালয়ভীতি বা বিদ্যালয় অপছন্দ করার কারণে নিয়মিত বিদ্যালয়ে যায় না বা বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে। প্রাকপ্রাথমিক শিক্ষা যেনো এ সমস্যা দূর করতে পারে— সেটিই এর প্রতিপাদ্য হওয়া উচিত। প্রতিবেদনে যেভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রাকপ্রাথমিক শিক্ষার সময় ধর্মীয়জ্ঞান, অক্ষরজ্ঞান ও নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেটিকে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। এ স্তরে খেলাধুলা ও অন্যান্য আনন্দদায়ক কাজের মাধ্যমে শিশুকে পরোক্ষভাবে অক্ষরজ্ঞান দেওয়া ও বিদ্যালয়ের প্রতি আকর্ষণীয় করে তোলার বাইরে অন্য কর্মকাণ্ড শিশুর জন্য বাড়তি চাপ হতে পারে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে অক্ষরজ্ঞান দেওয়ার বিষয়টিও অপ্রয়োজনীয়। শিক্ষার নানা স্তরে শিশুকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া যেখানে সম্ভব, সেখানে প্রাকপ্রাথমিক স্তরে এ শিক্ষা শিশুর মানসিক বয়স, মানসিকতা ও ধারণক্ষমতা অনুসারে কতোটা যুক্তিযুক্ত তা ভাবা দরকার।

৫.
প্রাথমিক শিক্ষার নানা বিষয়ে কমিটি ইতিবাচক অবস্থান নিয়েছে, যা আগেই বলা হয়েছে। এর একটি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যকার বিরাজমান প্রকট বৈষম্য দূর করা। সাধারণভাবে ননরেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এবতেদায়ি মাদ্রাসাসমূহ নানা সুযোগসুবিধার দিক দিয়ে অন্য ধরনের বিদ্যালয়ের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। লেখাপড়ার দিক দিয়েও সেগুলোর মান কিছুটা খারাপ। বিদ্যালয়গুলোর মধ্যকার সুযোগসুবিধার পার্থক্য দূর করতে পারলে বা বহুলাংশে কমিয়ে আনতে পারলে তা সরাসরি মানের ওপরও প্রভাব ফেলবে।

তবে বর্তমানে প্রচলিত দশ ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো থেকে শুরু করে মৌলিক বিষয়গুলোতে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি অভিন্ন করার বিষয়টি বেশ জটিল হতে পারে। কাঠামোগত দিক দিয়ে দেশে বর্তমানে দশ ধরনের বিদ্যালয় চালু থাকলেও শিক্ষাক্রমের দিক দিয়ে বিদ্যালয়গুলোকে মোটাদাগে চার ভাগে ভাগ করা যায়— ১. এনসিটিবির শিক্ষাক্রম অনুসারে পরিচালিত বিদ্যালয়, ২. মাদ্রাসা, ৩. ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয় এবং ৪. উপানুষ্ঠানিক বিদ্যালয়। মাদ্রাসার নিজস্ব শিক্ষাক্রম ও ইংরেজি মাধ্যমের আলাদা পাঠ্যপুস্তক রয়েছে। উপানুষ্ঠানিক বিদ্যালয়গুলো এনসিটিবির শিক্ষাক্রম অনুসরণ করলেও অনেকক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব পাঠ্যপুস্তক রয়েছে। সুতরাং এ চার ধারাকে কীভাবে একত্র করা যায়, সেটি আরও ব্যাপক ভাবনার বিষয়। তবে প্রতিবেদনে যেভাবে তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত নম্বরবিন্যাস করা হয়েছে, তাতে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ৩০০ নম্বর পড়তে হবে। সেক্ষেত্রে কাঠামো অভিন্ন থাকছে কিনা, তাও ভাবা দরকার। অন্যদিকে উপানুষ্ঠানিক বা ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমে কী থাকবে, তা স্পষ্ট নয়।

প্রত্যেক ধরনের বিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত বিষয়ের বাইরেও সংশ্লিষ্ট শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুমতি সাপেক্ষে অতিরিক্ত বিষয় চালুর কথা বলা হলেও প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে শিশুদের বয়স ও ধারণক্ষমতাকে প্রাধান্য দিয়ে সেগুলো চালু করবে তার দিকনির্দেশনা শিক্ষানীতিতে থাকা দরকার।

৬.
প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে দুটি বিষয় রেখেছে— বাংলাদেশ স্টাডিজ ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবেশ। অর্থাৎ বর্তমানের পরিবেশ পরিচিতি (সমাজ বা বিজ্ঞান) বিষয়টি থাকছে না। বাংলাদেশ স্টাডিজের বিষয়টি যোগ করা একটি চমৎকার ব্যাপার, কিন্তু সেখানে পরিবেশ পরিচিতির অন্তর্গত সমাজের নানা বিষয় বাদ পড়বে কিনা তা স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশ স্টাডিজ নামটিও মানানসই মনে হচ্ছে না— বদলে বাংলাদেশ পাঠ বা এরকম কিছু রাখা যেতে পারে। এদিকে তৃতীয় শ্রেণী থেকে জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবেশের বিষয়টি শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত চাপ হয়ে যায় কিনা বা এ বয়সের শিশুর উপযোগী কিনা, তাও নতুন করে ভাবা দরকার। সেক্ষেত্রে বিষয়টি ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে চালু করলেই বোধহয় ভালো হয়।

৭.
অত্যন্ত চমৎকার একটি বাক্য এসছে শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে— …প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং রাষ্ট্রকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার ব্যবস্থা রাষ্ট্র যেহেতু মোটামুটি করতে পেরেছে, বাজেটে বরাদ্দ কিছুটা বাড়িয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শিক্ষার দায়িত্ব বহনে রাষ্ট্র সক্ষম হওয়ার কথা। তবে প্রচলিত শিক্ষাখরচের বাইরেও শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের শিক্ষার পেছনে নানা ধরনের খরচ করতে হয়, যার একটি প্রাইভেট টিউশনির পেছনে। বিদ্যালয় থেকে যথাযথভাবে শিক্ষা না পাওয়ার কারণেই শিক্ষার্থীদের গৃহশিক্ষকের কাছে যেতে হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যথাযথ ব্যবস্থাপনার দ্বারা রাষ্ট্র এ ধরনের খরচ বন্ধ করতে পারলেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন যথাযথভাবে হবে বলে ধরা যায়। অন্যথায় কাগজকলমের হিসাবের বাইরেও নানা ধরনের খরচ শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও কাঙ্ক্ষিত আউটপুটকে ব্যাহত করতে পারে। তবে নানা কারণে রাষ্ট্র এখনও হতদরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত সব শিশুকে শিক্ষার মূল ধারায় প্রবেশ করাতে সক্ষম হয় নি। যতোদিন পর্যন্ত রাষ্ট্র এ সক্ষমতা অর্জন না করবে, ততোদিন রাষ্ট্রের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষাপ্রদান প্রক্রিয়াও চলমান থাকবে বা থাকা উচিত। এক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছর ভর্তিকৃত শিশুর নয় শতাংশ ভর্তি হয় এনজিও-পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোতে। রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান পালন করেই যথাযথ প্রক্রিয়ায় এসব বিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। সুতরাং শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারি অংশীদারিত্ব এখনও গুরুত্বপূর্ণ। এ অংশীদারিত্ব রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করছে না।

৮.
প্রতিবেদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বর্ধিত করা। পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ বাড়ানো জরুরি। কীভাবে তা করা হবে— সে সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট সুপারিশ রয়েছে প্রতিবেদনে। দেখা যাচ্ছে, আগামী নয় বছরে ধাপে ধাপে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। এক্ষেত্রে অবকাঠামোগত ও পর্যাপ্ত দক্ষ শিক্ষকের বিষয়টিই মুখ্য। এটি করতে হলে বর্তমানে থাকা মাদ্রাসাসহ প্রায় এক লাখ প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রচুর শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। সব মিলিয়ে পুরো বিষয়টি হবে এক এলাহী কাণ্ড। সেক্ষেত্রে তাড়াহুড়া না করে পরিকল্পিতভাবে ও গুণগত মান বজায় রেখে কাজ করা হয়, সেদিকে জোর দেওয়া দরকার। বাস্তবায়নের ধাপগুলো এমনভাবে সম্পন্ন করতে হবে যেন একটি ধাপের কাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ার পরই পরবর্তী ধাপের কাজ শুরু করা হয়। তাছাড়া শুধু অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা দিলেই হবে না, সেটির গুণগত মান নিশ্চিত করাও জরুরি— বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলোর কথা মনে রাখা দরকার।

৯.
প্রতিবেদনে মানসম্পন্ন ইংরেজি লিখন-কথনের লক্ষ্যে যথাযথ কার্যক্রম শুরু থেকেই গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে প্রথম শ্রেণী থেকেই ইংরেজি বাধ্যতামূলক। কিন্তু যে পদ্ধতিতে ইংরেজি শেখানো হচ্ছে, সেটি কতোটুকু কার্যকর— তা ইতোমধ্যে সবার জানা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের পরও অনেকে ঠিকমতো ইংরেজি লিখতে বা বলতে পারে না। সে অবস্থায় আবারও শুরু থেকে ইংরেজি শেখানোর বিষয়টি পর্যালোচনার দাবি রাখে। প্রাথমিক স্তরে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখা আদৌ প্রয়োজনীয় কিনা, বা এভাবে আদৌ কার্যকর ইংরেজি শেখা যায় কিনা— বিষয়টি গবেষণার মাধ্যমে যাচাই করে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। প্রতিবেদনে আদিবাসিদের নিজস্ব ভাষায় পড়ালেখার কথা বলা হয়েছে। সেখানে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শিক্ষার্থীরা বাংলা পড়বে নাকি ইংরেজি, তা স্পষ্ট নয়। বাস্তবতার কারণে যদি বাংলা পড়তে হয়, তাহলে প্রাথমিক স্তরে আদিবাসি শিশুদের তিন-তিনটি ভাষার মোকাবিলা করতে হবে— প্রতিবেদন প্রণেতারা এ বিষয়টি আশা করি গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন। বলা দরকার, এখানে ইংরেজিকে শুধু একটি ভাষা হিসেবেই দেখা হয় না, বিদ্যালয়ে এটি একটি সাবজেক্ট বা বিষয়ও বটে। যদি ইংরেজিকে শুধু আলাদা একটি ভাষা হিসেবে দেখা হতো, তাহলে সম্ভবত ইংরেজি ভাষা শেখার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসতো। সাবজেক্ট বা বিষয় হিসেবে দেখার ফলে ভাষার অংশটুকু অনেকাংশেই গুরুত্ব কম পাচ্ছে।

১০.
শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে কোনো আনুষ্ঠানিক মূল্যায়ন না থাকা এবং তৃতীয় শ্রেণী থেকে অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষা চালুর সুপারিশ প্রশংসনীয়। সেক্ষেত্রে বিদ্যালয়ে যদি শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে অর্ধেক নম্বর দেয়া হয় এবং বার্ষিক পরীক্ষায় বাকি অর্ধেকের ওপর পরীক্ষা নেওয়া হয়, তাহলে শিক্ষার্থীকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। পাশাপাশি পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু ছাড়াও শিক্ষার্থীর নানা কর্মকাণ্ড যেমন— বিদ্যালয়ে উপস্থিতি, সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম, নেতৃত্বের দক্ষতা কিংবা চারিত্রিক দৃঢ়তার বিষয়গুলোও ধারাবাহিক মূল্যায়নে আসা উচিত। সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বর্তমান মূল্যায়ন পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করা না হলে এ থেকে যথাযথ ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

১১.
বাংলাদেশে এতো কম সময়ে, মাত্র চার মাসে শিক্ষানীতি প্রণয়নে এটাই রেকর্ড। এ সময়ে কমিটি পূর্ববর্তী প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনার পাশাপাশি শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ৫৬টি সংস্থা বা সংগঠনের প্রতিনিধি ও ছয় বিভাগে সব স্তরের ব্যক্তিদের সাথে মতবিনিময় করে। স্বল্পসময়ে এতো কাজের প্রতিফলন দেখা গেছে শিক্ষানীতির খসড়ায়। নানা জায়গায় বানান ভুলসহ বাক্যবিন্যাসেও অসঙ্গতি দেখা গেছে। বিশেষ করে যে দুটি কমিশন রিপোর্টকে ‘বিশেষভাবে বিবেচনায়’ নেওয়া হয়েছে, তার একটি কমিশনের নাম পুরো প্রতিবেদনে এসেছে ভুলভাবে। খসড়াতে বারবার কুদরত-ই-খুদা কমিশন শব্দটির উল্লেখ রয়েছে যা প্রকৃতপক্ষে কুদরাত-এ-খুদা কমিশন হবে। কমিটির কাছ থেকে এ ধরনের ভুল আশা করা যায় না।

১২.
সংক্ষিপ্ত পরিসরে অনেক কিছুই আলোচনা করা যায় না। কিন্তু জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ অনেক ইতিবাচক স্বপ্ন দেখিয়েছে যা বাস্তবায়িত হলে দেশের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘ— উভয় মেয়াদে কার্যকরী ফল বয়ে আনবে বলে বিশ্বাস। তবে পরিকল্পনা করা ও পরিকল্পনাকে যথাযথ ও সুচারুভাবে কাজে রূপান্তরিত করা— দুটো ভিন্ন বিষয়। আন্তরিকতা দিয়ে কমিটি শিক্ষানীতি প্রতিবেদন তৈরি করে দিলেও সেটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। এই বাস্তবায়নের কাজে কোথাও যেনো গুণগতমানের প্রশ্নে আপোষ না করা হয়, লেখার শেষে সে আহ্বান থাকবে।

গৌতম

সমাজতন্ত্র সম্পর্কে মোহ আছে, তবে সমাজের তান্ত্রিকদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চাই। শিক্ষা নিয়ে কাজ করি। আর মাঝে মাঝে ভাবি- আমরা 'শিক্ষিত' মানুষরা কতোই না 'কু-শিক্ষিত।'

২১ comments

  1. রায়হান রশিদ - ৮ নভেম্বর ২০০৯ (৯:৩৫ অপরাহ্ণ)

    মুক্তাঙ্গনে স্বাগতম।
    আপনার পোস্ট, গতকাল ছাপানো ইমতিয়ার শামীম ভাইয়ের পোস্ট আর শিক্ষানীতির চূড়ান্ত খসড়াটি আরেকটু ভালভাবে পড়ে নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণের আশা রাখি।

    • গৌতম - ৯ নভেম্বর ২০০৯ (৯:১৬ পূর্বাহ্ণ)

      ১.
      মুক্তাঙ্গনে স্বাগত জানানোর জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। আমি এখানে নতুন এবং এটিই প্রথম পোস্ট। এখনো এর অনেককিছু বুঝে উঠতে পারি নি। কোনো ভুলচুক হলে আশা করি শুধরে দেবেন।

      ২.
      খুবই ভালো হতো যদি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে আপনারা আপনাদের মতামত এই শিক্ষানীতি কমিটিকে জানাতে পারতেন। মুক্তাঙ্গনের মতো সাইটে এ বিষয়ে আগে কোনো লেখা আসে নি দেখে আমি বিস্মিত। যা হোক, এখনও যে মতামত আসবে বা নিজেদের মধ্যে যে উপলব্ধিগুলো তৈরি হবে, তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আর কমিটি তো বলেছেই, আপাতত সময় শেষ হলেও যেহেতু সময়ে সময়ে শিক্ষানীতি আপডেট হবে, সুতরাং এই মতামতগুলো তখনও দেওয়া যাবে।

      ৩.
      শিক্ষানীতি পড়ার পর আপনার মন্তব্য জানার অপেক্ষায় থাকলাম।

      ৪.
      ওয়েবে শিক্ষানীতির ওপর তেমন কোনো আলোচনা আমার চোখে পড়ে নি। এ সম্পর্কিত কোনো লিংক থাকলে কেউ শেয়ার করলে খুশি হবো। আমি যে কয়টি আলোচনা দেখেছি, তার তিনটিই ইংরেজিতে লেখা। লিংকগুলো নিচে দিয়ে দিলাম- যদি কারও কাজে লাগে।

      ক. শিক্ষানীতির নানা দিক নিয়ে আলোচনা
      খ. জেন্ডার দৃষ্টিভঙ্গিতে শিক্ষানীতি
      গ. বয়স্ক শিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষানীতি

  2. মোহাম্মদ মুনিম - ১০ নভেম্বর ২০০৯ (৬:০০ পূর্বাহ্ণ)

    কিছুদিন আগে একটি ওয়েবসাইটে দেখলাম ভারতে প্রতিবছর প্রায় ৫ লক্ষ প্রকৌশলী তৈরি হয় এবং এদের শতকরা ৬০ ভাগই কম্পিউটার প্রকৌশলী, এদের কেউই হয়ত বিল গেটস নয়, কিন্ত ভারতবর্ষে যে সুবিশাল সফটওয়্যার শিল্প গড়ে উঠেছে তাতে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে। আমাদের দেশে সম্ভবত বছরে ৩ হাজার প্রকৌশলীও তৈরী হয় না, সে সংখ্যাটিকে হাজার বিশেকে উন্নীত করতে পারলে তারা দেশের অনেক বেকার তরুনই খানিকটা আশার আলো দেখবে। প্রকৌশল শিক্ষা সাধারনত (যেমন পুরকৌশল বা যন্ত্রকৌশল) একটি ব্যয়বহুল ব্যাপার হলেও কম্পুকৌশল শিক্ষার অবকাঠামোগত ব্যয় খুব একটা বেশী হবার কথা নয়। বর্তমানে সারা দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে প্রচুর সংখ্যক সরকারী কলেজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সেগুলোতে সহজেই কিছু কম্প্যুটার আর আনুষঙ্গিক ল্যাবরেটরীর ব্যবস্থা করে কম্প্যুকৌশল বিভাগ খোলা যায়। বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় লাখ পাঁচেক ছাত্র ছাত্রী উচ্চমাধ্যমিকে পাশ করে, তাদের একটি বড় অংশই এর মাধ্যমে উপকৃত হতে পারে।

    • গৌতম - ১০ নভেম্বর ২০০৯ (১১:৩৬ পূর্বাহ্ণ)

      এটা একটা ভালো পয়েন্ট। এই শিক্ষানীতির একটি বড় দুর্বলতা হলো ‘Need Assessment’ না করা— অবশ্য অতীতের কোনো কমিশনও তা করে নি। দেশে কোন সেক্টরে কী পরিমাণ জনবল দরকার, তার কোনো উপাত্ত নেই। বর্তমানে সারা দেশে যে পরিমাণ পেশাজীবি প্রতিবছর তৈরি হচ্ছে, সেই সংখ্যাটি কোথায় কম বা কোথায় বেশি, সে সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। আর সেটা না জানা থাকলে এ সম্পর্কিত কোনো পরিকল্পনা করা সম্ভব না। বোধের উপর দিয়ে কাজ চালাতে হয়। এখন দেশে কতো কম্পিউটার-পেশাজীবি দরকার, কতোজনকে বিদেশে পাঠানো যাবে, সংখ্যাটা সব মিলিয়ে বিশ হাজার হবে, নাকি এক হাজার হবে নাকি দুই লাখ হবে— তা বোধহয় কারোরই জানা নেই।

      শিক্ষানীতি কমিটি গঠিত হওয়ার পর এ সম্পর্কিত একটি আহ্বান জানিয়েছিলাম। নানা সূত্রে শুনেছিলাম কমিটি নাকি এ নিয়ে চিন্তাভাবনাও করেছিলো। কিন্তু সময় স্বল্পতা ও অন্যান্য কারণে প্রয়োজনীয় জনবল-পরিমাণ যাচাইয়ের কাজটি করা হয় নি।

  3. মোহাম্মদ মুনিম - ১১ নভেম্বর ২০০৯ (৬:২৬ পূর্বাহ্ণ)

    ভি এস নাইপল তাঁর beyond belief বইটিতে পাকিস্তানী পাঠ্যপুস্তকে প্রাক্‌ বৃটিশ যুগের ইসলামী শাসনের যে বর্ণনা আছে তার উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তানী পাঠ্যপুস্তকে নাকি লেখা আছে যে ইসলামী যুগে কোন কৃষকের নালিশ থাকলে সে নবাবের কাছে গিয়ে সুবিচার চাইলেই নবাব তার ব্যবস্থা করতেন। নাইপলের বক্তব্য হচ্ছে ইসলামী যুগে পাকিস্তান অঞ্চলে কোন সমন্বিত বিচারব্যবস্থা ছিল না, কোন এক বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটা legend দাঁড়িয়ে গেছে আর সেটাই পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস হিসাবে ঢুকে গেছে। বাংলাদেশেও আমরা পাঠ্যপুস্তকে বখতিয়ার খলজি এক ধরনের নায়ক হিসাবেই স্থান পেয়েছেন। মুসলিম শাসনের নানা legend (যেমন কাজির বিচার, মোগল আমলের দরবার, সম্রাট আকবরের সুশাসন ইত্যাদি) আমাদের পাঠ্যপুস্তকেও ইতিহাস হিসাবে আছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের ইসলামী শাসন সম্পর্কে যে একটা স্বপ্নিল ধারণা আছে (একবিংশ শতকের বাংলাদেশ ছেড়ে সতের শতকের মোগল আমলে বা বার শতকের স্পেনে যেতে পারলেই যেন তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে), সেটার জন্য ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকও কম দায়ী নয়। ভারতীয় উপমহাদেশের অংশ হলেও আমাদের ইতিহাস শুরু হয়েছে ষষ্ঠ শতকের আরবে, সেখান থেকে ‘আমাদের পূর্বপুরুষেরা’ দিগ্বিজয় করে ভারতে এসে স্থান নিলেন। নতুন শিক্ষানীতিতে ধর্মীয় শিক্ষা কমানো হলেও আমাদের শিশুরা যে ইতিহাসের বইয়ের মাধ্যমে একটি উদ্ভট ‘বিশ্ববিক্ষা’ নিয়ে বেড়ে উঠেছে এবং উঠছে সে ব্যাপারে কি কিছু আছে?

    • রায়হান রশিদ - ১১ নভেম্বর ২০০৯ (৯:০৩ অপরাহ্ণ)

      @ মোহাম্মদ মুনিম,

      ভি এস নাইপল তাঁর beyond belief বইটিতে পাকিস্তানী পাঠ্যপুস্তকে প্রাক্‌ বৃটিশ যুগের ইসলামী শাসনের যে বর্ণনা আছে তার উল্লেখ করেছেন। …. নাইপলের বক্তব্য হচ্ছে ইসলামী যুগে পাকিস্তান অঞ্চলে কোন সমন্বিত বিচারব্যবস্থা ছিল না, কোন এক বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটা legend দাঁড়িয়ে গেছে আর সেটাই পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস হিসাবে ঢুকে গেছে।

      নাইপলের এই বইটি পড়া নেই (পড়ে নেবো)। কিন্তু তিনি যদি এটাই বলে থাকেন তবে ঠিক বলেননি। কেন, সে ব্যাখ্যায় আসছি একটু পরে। এই দৃষ্টিভঙ্গীটি মূলতঃ তাদেরই যারা সুক্ষভাবে প্রচারের চেষ্টা করেন বৃটিশ উপনিবেশবাদ কিভাবে ভারতবর্ষকে সর্ব অর্থে উদ্ধার করেছে। যেমনটা আছে এডওয়ার্ডস এবং গ্যারেটস এর Mughal Rule in India তে:

      এডওয়ার্ডস-গ্যারেটস আধুনিক বিচার এবং প্রশাসন ব্যবস্থার আলোকে ভারতবর্ষের মুসলিম (প্রাক-‌মু‌ঘল + মুঘল) আমলের মতো প্রাচীন ব্যবস্থাকে বিচার করেছেন। এই ব্যাপারটাই তো ভীষণ গোলমেলে। কারণ, সেই একই সময়ে বৃটেনের বিচার ব্যবস্থা কেমন ছিল তাকে আধুনিক বিচারব্যবস্থার আলোকে বিচার করতে গেলে কি অবস্থা হতো। সময়ের বিচারে (পূর্ণ) মুঘল আমলের চেয়েও সাম্প্রতিক ১৭০০ সালোত্তর বৃটেনের বিচারব্যবস্থার ভয়ংকর কিছু কিছু চিত্র তো আমরা চার্লস ডিকেন্সের লেখাতেও উঠে আসতে দেখেছি (দ্রষ্টব্য: অলিভার টুইস্ট, প্রিন্স এন্ড দ্য পপার)! সে সময়কার বৃটেনে ভয়ংকর Debtor’s Prison ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল (উইকি তে দেখুন; স্যামুয়েল জনসন এর উদ্ধৃতিমালাতেও সে চিত্র খানিকটা পাওয়া যাবে)।

      এ কারণেই পাকিস্তানী পাঠ্য পুস্তকে কি আছে না আছে তা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোন কারণ দেখি না। কারণ, ভারতবর্ষের আইন এবং বিচার কাঠামোর ইতিহাস নিয়ে গবেষণা কিছু কম হয়নি। প্রথমত: নাইপল যদি বলে থাকেন “ইসলামী আমল” তাহলে তিনি অত্যন্ত বিস্তৃত একটি সময়কে বুঝিয়েছেন। এই সময়টি হল একাদশ শতাব্দী থেকে মধ্য-অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত। এরই মধ্যে ঘটেছে মুঘলদের ক্ষমতা দখল, আবার মুঘল থেকে বৃটিশদের কাছেও ক্ষমতা বদল। এতো বিস্তৃত সময়ের এমন সরলীকৃত বয়ান সম্ভব না, যেমনটি নাইপল করার চেষ্টা করেছেন। দ্বিতীয়ত: ‘প্রাক-বৃটিশ মুঘল আমলে সমন্বিত বিচারব্যবস্থা ছিলো না’, নাইপলের এই কথাটাও ঠিক না। এ নিয়ে M P Jain এর চমৎকার একটা আইনী-ইতিহাসের বই আছে। হাতের কাছে বইটি না থাকায় উদ্ধৃত করতে পারছি না। তবে সে সময়কার বিচার ব্যবস্থার স্তরবিন্যাসের বিস্তারিত পাওয়া যাবে রাজ কুমার এর এই নিবন্ধটিতে যা নাইপলকে ভুল প্রমাণ করে:

      মুঘল আমলের বিচারব্যবস্থা ভাল কি মন্দ ছিল, কার্যকর কি অকার্যকর ছিল সে এক ভিন্ন বিতর্ক। সেই সময়ে খোদ বৃটেনের বিচার ব্যবস্থাকেও ‘আদর্শ’ বলে মেনে নেয়া কঠিন। আমাদের যেটা মনে রাখা দরকার তা হল: মুঘল আমলের বিচার এবং প্রশাসন ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করতে হয়েছিল বৃটিশদের। আর তা করা হয়েছিল মুঘল বিচার ব্যবস্থাকে উন্নীতকরণের উদ্দেশ্যে নয়, ঔপনিবেশিক শাসনকে সহজতর করার জন্য, একীভূত harmonised আইনী এবং প্রশাসনিক পরিমন্ডল তৈরীর স্বার্থে।

      আজকের বৃটিশ আইন এবং প্রশাসন ব্যবস্থা দু’শো বছর আগের তুলনায় অনেক বেশী উন্নত এবং সফিসটিকেটেড। কিন্তু এর পেছনে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার ইতিহাস আছে, আইন-প্রশাসন-বিচারব্যবস্থা ‌- সব কিছু নিয়েই। আমার এক শিক্ষকের মতে, ভারতবর্ষের মতো এই উপনিবেশগুলো ছিল সে সবেরই ল্যাবরেটরী যেখানে শাসকেরা নতুন নতুন আইন এবং ব্যবস্থা প্রণয়ন করে সেগুলোর কার্যকারীতা পরীক্ষা করেছে এবং সেই শিক্ষা প্রয়োগ করেছে নিজেদের দেশে। নাহলে দেখুন: শতাধিক বছরের ফৌজদারী এবং দেওয়ানী আইন আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি এখনো, বৃটিশদেরই করা। অথচ, বৃটেনে কিন্তু এসব বহু আগেই পাল্টে গেছে যুগের সাথে তাল মেলাতে। ভাবা যায় যে ১৬০০ সালের রানী এলিজাবেথ-১ এর সনদ বলে ভারতবর্ষে আইন প্রণয়ন করতো কি না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মতো একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান? এটাই ইতিহাস।
      আর “ইসলামী আমল” “মুঘল আমল” থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত পাকিস্তানী আইন এবং বিচারব্যবস্থার একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা পাওয়া যাবে এই লিন্কে
      ধন্যবাদ।

      [দুঃখিত গৌতম, মূল আলোচনা থেকে একটু সরতে হল। মূল আলোচনাতেও আসছি]

      • মোহাম্মদ মুনিম - ১২ নভেম্বর ২০০৯ (১২:৪৪ পূর্বাহ্ণ)

        নাইপলের বইটা আমি পড়েছি প্রায় আট বছর আগে, আশা করি তাঁকে misquote করিনি, আজ বাড়িতে গিয়ে বইটা খুঁজে পাকিস্তান বিষয়ক লেখাটি verbatim quote করবো। এই বইটিতে নাইপল অনারব মুসলিম দেশগুলোতে যে আরব সাংস্কৃতিক উপনিবেশীকরন হচ্ছে তার কথাই মুলত বলেছেন। যদিও নাইপলের বইতে বাংলাদেশ নিয়ে কিছু নেই, তবে এই সাংস্কৃতিক উপনিবেশীকরন যে বাংলাদেশেও খানিকটা হয়েছে বলে আমার ধারণা।

      • গৌতম - ১২ নভেম্বর ২০০৯ (৯:০৩ পূর্বাহ্ণ)

        @রায়হান রশীদ, মোটেও দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। বরং শিক্ষাব্যবস্থাকে বুঝতে হলে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হলে এই বিষয়গুলো আলোচনা হওয়া দরকার। না হলে হয়তো পুরনো জিনিসই মাথায় থেকে যাবে, সেখান থেকে বেরুনো সম্ভব হবে না।

        আমি অবশ্য আইন বা এসব বিষয়ে তেমন কিছু বুঝি না। তবে একটা জিনিস কিন্তু সত্য যে, এদেশে আধুনিক শিক্ষার ধারাটা ব্রিটিশরাই প্রবর্তন করেছে, যদিও সেটা তারা করেছে তাদের নিজেদের স্বার্থে। ব্রিটিশভারতে এই বিষয়গুলো নিয়ে সর্বপ্রথম কথা বলে ১৭৯১ সালে চার্লস গ্র্যান্ট শিক্ষা কমিশন। তারা নানা জরিপ ও গবেষণার মাধ্যমে দেখায় যে, ঠিক কীভাবে শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করলে তাদের স্বার্থ রক্ষিত হবে। এর দ্বারা ভারতীয় উপমহাদেশের মূল যে উপকারটা হলো, সেটা হচ্ছে- পড়ালেখা যে আয়উপার্জনের হাতিয়ার হতে পারে, সেই ধারণাটা অনেকের মধ্যে জন্ম নিলো। এর আগ পর্যন্ত পড়ালেখাটা মূলত ছিলো নিজের বোধ জাগানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

        তবে ব্রিটিশরা না থাকলেও কি এই কাজটা হতো না? হতো অবশ্যই। কিন্তু সেটা কতো বছর পরে? আর ব্রিটিশরা এই শিক্ষাব্যবস্থা চালু না করলে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষরা এর চেয়ে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে পারতো নাকি পারতো না- এই চিন্তায় কোনো কূলকিনারা পাই না।

      • মোহাম্মদ মুনিম - ১২ নভেম্বর ২০০৯ (১২:৫১ অপরাহ্ণ)

        নাইপল সাহেবের Beyond Belief (pp 256) বইটিতে পাকিস্তানী পাঠ্যপুস্তক আর আইনের ব্যাপারটা যেভাবে বলা হয়েছেঃ

        The courts were always busy. But, with all their apparatus, they didn’t deliver, the lawyers said. There was too much political interference, too much litigation; there were too many false witnesses; the judges were overworked. But there was no earlier local system that could be restored. There was a peasant story of justice under the Mogul emperors. Night and day, in this story, a rope hung outside the palace wall. The poor man who wanted justice only had to run to this rope and (if there wasn’t too much of a crush, or if he wasn’t stopped or cut down) pull on it. The rope rang a bell; the emperor appeared at his window, and gave the peasant justice. This story – really a serf fantasy about the mercy of the master – had got into Pakistani schoolbooks as fact, and was used to make a point about the grandeur of the Muslim rulers. But according to Walid Iqbal, a lecturer in law (and a grandson of the poet who proposed the idea of Pakistan), the law here before the British, in the days of the Sikhs, was “vague”; and going back further, to the times of the Mogul (the times of the rope and the bell) the law was simply dictatorial. The British-given courts, and the British procedural laws of 1898 and 1908, were still all that the country had. They met a need; that was why they had lasted.

        • রায়হান রশিদ - ১২ নভেম্বর ২০০৯ (৬:৪১ অপরাহ্ণ)

          অনেক ধন্যবাদ, মুনিম। উদ্ধৃতিটা থেকে নাইপল এর অবস্থান স্পষ্ট হল।
          যে সমস্যাগুলো নাইপল চিহ্নিত করেছেন (‘But, with all their apparatus, they didn’t deliver, the lawyers said. There was too much political interference, too much litigation; there were too many false witnesses; the judges were overworked.’) সেগুলো নিয়ে আধুনিক বিচার ব্যবস্থাগুলোকেও কিন্তু নিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। কিন্তু ‘there was no earlier local system that could be restored’ কথাটা মনে হয় ঠিক না। কারণ, মুঘল বিচারব্যবস্থা পূর্বতন হিন্দু রাজাদের আমলকার তৃণমূল পর্যায়ের অনেক পরীক্ষিত ব্যবস্থাকেই (যেমন: পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, যেখানে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক বিরোধ নিষ্পত্তি হতো) কিন্তু অপরিবর্তিত রেখে নিজের মধ্যে আত্তীকরণ করে নিয়েছিল। এছাড়াও, এই বিচারব্যবস্থায় প্রযুক্ত আইনের উৎসের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় প্রথাগুলো ছিল অন্যতম, যেখানে ‘সতীদাহ’ কিংবা ‘যজ্ঞ-বিচার’ এর বাইরেও ভাল অনেক প্রথাও ছিল যেগুলো এই ভূখন্ডে কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত ছিল। ঠিক এভাবেই কিন্তু আমরাও আমাদের নিজস্ব আইন, বিরোধ-নিষ্পত্তি ব্যবস্থা এবং ভূমি ব্যবস্থাকে চাপিয়ে দিয়েছি পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল অধিবাসীদের ওপর। তাই নাইপলের বইয়ের এই অংশে (বিনীত মত) প্রাসঙ্গিক তথ্যের ঘাটতি ছাড়াও ব্যবহৃত তথ্যের মান নিয়ে কিছুটা সংশয় আছে আমার, সে সবের ব্যাখ্যা নিয়েও প্রশ্ন তো রয়েছেই। নাইপল এর লেখার সাথে অধিক পরিচিতরা কেউ লিখলে ভাল হতো। তাহলে আমরা আরও জানতে পারতাম এই লেখককে।

          শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনাটা যে কারণে মুঘল বিচারব্যবস্থার দিকে চলে গেল সে প্রসঙ্গে ফিরে আসি এবার। বৃটিশরা যে কাজটি করেছিল তা হল প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যবস্থাকে নিজেদের রফতানীকৃত নতুন আইন ও বিচার ব্যবস্থা দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছিল। এই চর্চাটাই সাম্রাজ্যবাদী, কিছুটা বর্ণবাদী তো বটেই। এডওয়ার্ড সাঈদ হয়তো ভিন্ন কোন অভিধা ব্যবহার করবেন। তুলনামূলক আইনবিজ্ঞান কিংবা সমাজতত্তের ছাত্র মাত্রই জানেন এভাবে একটি ব্যবস্থাকে আরেকটি ব্যবস্থা (তা সে যত উন্নতই হোক) দিয়ে রাতারাতি প্রতিস্থাপন করা যায় না; করলে তার ফলাফল ভাল হয় না। ঔপনিবেশবাদ চলে গেলেও পশ্চিম থেকে চিন্তা এবং ব্যবস্থার এই (সরাসরি) আমদানীটুকু কিন্তু এখনো বিভিন্ন চেহারায় ঘটে থাকে। উদাহরণ: ওয়ার্লড ব্যান্ক আইএমএফ এর চাপিয়ে দেয়া অর্থনীতি, এনজিও-গুলোর বিদেশী ভাবধারাকে আপ্তবাক্য ধরে নিয়ে সে সব হুবহু প্রচার-প্রয়োগের প্রবণতা। হালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যু নিয়েও ‘আন্তর্জাতিক মান’ অভিধার আড়ালে এমনই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের মধ্যে, যা এমনকি বিভাজন পর্যন্ত গড়িয়েছে কোন কোন ক্ষেত্রে। (১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ বিচারের আইনটি সংশোধন করতে গিয়ে অনেকেই বিস্মৃত হয়েছেন – আইনী পদ্ধতিগত যে সমাধান Hague এর পশ্চিমা আদালতব্যবস্থায় কার্যকর, তা বাংলাদেশের মাটিতে তেমনভাবে কার্যকর নয়)। সে এক ভিন্ন বিতর্ক। মূল কথা হল, এ ধরণের প্রতিস্থাপনের প্রবণতাটাই ভীষণ গোলমেলে। প্রতিস্থাপিত ব্যবস্থার সমর্থনকারীদেরও কিন্তু আমাদের একটু মাইক্রোস্কোপের নীচে রেখে বিচার করা দরকার। কারণ, তারা যা বলেন, হয়তো বিশ্বাস করেই বলেন, কিন্তু মনে হয় না সবসময় ঠিক বলেন।

          বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে থাকার কথা বলছি না। পূব-পশ্চিমের দুয়ার যখন খোলা, সেখানে দেয়া নেয়ার পালা তো থাকবেই; থাকা উচিতও। বহু বছর আগে রবীন্দ্রনাথই সেটা বলে গেছেন। কিন্তু যুক্তি, তথ্য আর তথ্যের interpretation কিভাবে করা হচ্ছে এবং কেন করা হচ্ছে সেই দিকটাতেও আমাদের সচেতনতা জরুরী। এই একই methodology আমরা শিক্ষানীতি বিচারেও ব্যবহার করতে পারি।

          বিষয়টির ওপর আলোকপাতের সুযোগ করে দেয়ায় মুনিমকে আবারও ধন্যবাদ।

  4. অনুপম শহীদ - ১১ নভেম্বর ২০০৯ (৩:৩৫ অপরাহ্ণ)

    গত দুদিন ধরেই ভাবছি কিছু একটু লিখব কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা হয়ে উঠছিল না! প্রথমেই বলে রাখি, আপনার লেখাটা ভাল লাগলো এবং আপনার মোটামোটি সব মতের সাথেই মেলে আমার মত।

    এবার এই শিক্ষানীতি বিষয়ে আমার কিছু মতামত জানাই। অনেক অংশেই এই শিক্ষানীতি পূর্বের অন্য অনেক শিক্ষানীতির চেয়ে ভাল। কিন্তু সম্পূর্ণ না্। এটা শিক্ষানীতিতেও স্বীকার করা হয়েছে, এজন্য অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু সরকার কিভাবে প্রতিনিয়ত এর উন্নয়ন করবে এ বিষয়টা স্পষ্ট না। যেহেতু আপনি লিখছেন বাস্তবতাকে ভিত্তি করে, তাই এই প্রশ্নটা এসে যাচ্ছে।

    আরও একটা বিষয় যেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় সেটা হল, সরকারের শিক্ষা বিষয়ক নীতি কি? বাংলাদেশের বিগত সরকারগুলোর কর্মকান্ড আমাকে বারবার হীরক রাজার সেই উক্তিটাই মনে করিয়ে দেয় – ‘এরা যত বেশী পড়ে, তত বেশী জানে, তত কম মানে।‘ আমাদের বিগত সরকারগুলো এরকম চিন্তা মাথায় রেখেই দেশের শিক্ষা পরিচালিত করেছে! এখন এই সরকার যে সেই নীতি থেকে সরে আসবে বা এসেছে তার কোন জোরাল নিদর্শন আমি এখনও পাইনি। সরকার একটা শিক্ষা কমিশন করেছে, তাদের রিপোর্টও এসেছে কিন্তু সরকার কিভাবে এটাকে গ্রহণ করবে এবং বাস্তবায়ন করবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন।

    প্রথমেই ‘উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ অংশে শিক্ষাকে ঠিক কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে তা আমার কাছে স্পষ্ট হলো না। শিক্ষার মানে আমার মনে হয় ‘জ্ঞান’ (knowledge) এবং তা ‘প্রয়োগের দক্ষতা’ (skill)-র সমন্বয় হওয়া উচিত। সেদিক দিয়ে এবারের রিপোর্টে কারিগরি শিক্ষার উপরে জোর দেওয়াটা ভাল বিষয়। কিন্তু আবার উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শুধু ‘প্রায়গিক দক্ষতা’ সমাজে রাষ্ট্রে একটা ‘জ্ঞান’-এর ক্ষেত্রে শূন্যতা তৈরি করবে। নতুন কোন মৌলিক চিন্তাশীল মানুষ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করতে পারবে না। এ বিষয়টাতেও আমার মতে সাবধানতার সাথে প্রয়োগের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে।

    আর যে বিষয়টা আপনি হতাশার সাথে আলোচনা করেননি সেই জায়গা আমাদের দেশের শিক্ষার সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটা – যারা শিক্ষা রিপোর্ট তৈরি করছেন তাদেরও ‘শিক্ষার দর্শনে’র জায়গাটা খুবই নড়বড়ে! সে জন্যই এই বিষয়টা সবসময়ই উপেক্ষিত থাকে বলে মনে হয় আমার। যাক! এ বিষয়ে আপনার কাছ থেকে একটা লেখার আশা করছি।

    এবারে একটু চোখ দেই শিক্ষানীতির ‘উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য’ অংশে – প্রথম যে বিষয়টা পয়েন্ট করে লিখছে সেটা এরকম – ‘শিক্ষার সর্বস্তরে সাংবিধানিক নিশ্চয়তার প্রতিফলন ঘটানো এবং …..’। এখন আমাদের সংবিধান কি বলছে – ‘রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য….. কার্যকর ব্যবস্থা গহণ করিবে।‘ তারমানে শিক্ষাকে হতে হবে ‘একমুখী’ (এখন যে ভাষা ব্যবহার হচ্ছে), ‘সার্বজনীন’। ‘একমুখী’ শব্দটা দিয়ে দুটো জিনিস বোঝায় আমার মনে হয়, ‘বৈষম্যহীন’ এবং ‘একই ধারার শিক্ষা’। আর ‘সার্বজনীন’ বিষয়টা হতে হবে শুধু আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে না বরং আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রেও তার গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। এখন এই শিক্ষানীতি তো তাদের এই প্রথম যে ‘উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য’ তাই সঠিকভাবে পূরণ করতে পারেনা। বরং এখানে বিভিন্ন ধারার পাশাপাশি অবস্থানকে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে। অবাক হইনা! বাস্তবতা এটাই। কিন্তু যদি রিপোর্টে একটা শক্ত অবস্থান নেওয়া হত তাহলে আমাদের দাবিগুলো একটু জোরাল হত, এই আর কি! সরকারের পক্ষে এখন যে অবস্থায় আছে সেটা গ্রহণ করাই সম্ভব হবেনা এটা জানা কথা। যারা কমিটিতে ছিলেন তারাও জানেন। দরদামের শুরুতেই যে ছাড় দেওয়া হয়েছে তাতে শেষে কি বা কতটুকু থাকবে এটার বিষয়ে আমি সন্দিহান।

    আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবিক বিষয় আপনি লিখেছেন – ইংরেজি শিক্ষা এবং অন্যান্য জাতিসত্তার নিজস্ব ভাষা শ্ক্ষিার ব্যপারে। আর একটা বিষয় দেখেন একজন মাদ্রাসা ছাত্রকে ‘বাধ্যতামূলক বাংলা, ইংরেজি’-র পাশাপাশি ‘আরবি’ পড়তে হচ্ছে প্রথম শ্রেণী থেকেই!

    এবার আপনার ৭ নং এর বিষয়ে একটু লিখব –
    ‘প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং রাষ্ট্রকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে।‘ এই কথাটা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা আছে তাদেরকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়াটা আমার মনে হয় প্রয়োজন আছে। কারণ গত সামরিক-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সরকার ‘ব্রাক’কে শিক্ষক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে দিয়ে দিতে চেয়েছিল। এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতেই বোধহয় এই বিষয়টা উল্লেখ করা হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে তা যে সরকারের প্রস্তাবনা, পরিকল্পনা মাফিক হয়। কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বেশী ক্ষমতা দিয়ে দিলে তার ফলাফল এই মুহুর্তে ভাল মনে হলেও, দীর্ঘমেয়াদে ভাল নাও হতে পারে। পুরো বিষয়টার ওপরে সরকারের নিয়ন্ত্রণ খুবই প্রয়োজন।

    বেশ লম্বা মন্তব্য হয়ে গেল! শেষ করি এখানেই….

    শিক্ষা বিষয়ে আপনার আরও লেখা আশা করছি।

    ভাল থাকবেন।

  5. arafat - ১৩ নভেম্বর ২০০৯ (১১:৪৬ পূর্বাহ্ণ)

    স্বাগতম!

    • গৌতম - ২২ নভেম্বর ২০০৯ (১:৩৬ অপরাহ্ণ)

      ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

  6. রায়হান রশিদ - ১৯ নভেম্বর ২০০৯ (৮:৫৫ পূর্বাহ্ণ)

    @ গৌতম রায়,

    এই শিক্ষানীতির একটি বড় দুর্বলতা হলো ‘Need Assessment’ না করা— অবশ্য অতীতের কোনো কমিশনও তা করে নি। দেশে কোন সেক্টরে কী পরিমাণ জনবল দরকার, তার কোনো উপাত্ত নেই। বর্তমানে সারা দেশে যে পরিমাণ পেশাজীবি প্রতিবছর তৈরি হচ্ছে, সেই সংখ্যাটি কোথায় কম বা কোথায় বেশি, সে সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। আর সেটা না জানা থাকলে এ সম্পর্কিত কোনো পরিকল্পনা করা সম্ভব না।

    আপনার সাথে পুরোপুরি একমত। সেই সাথে আরও কয়েকটি বিষয় যোগ করতে চাই। এ ধরণের যে কোন নীতি প্রণয়নে দু’টো বিষয় বাধ্যতামূলক বলে মনে করি, আর তা হল:

    (১) যে নীতিটি গ্রহণ করা হচ্ছে তার পক্ষে পর্যাপ্ত evidence base রয়েছে কিনা। অর্থাৎ, নীতি ‘ক’ এর পথ কেন নীতি ‘খ’ এর চেয়ে বেশী গ্রহণযোগ্য তার সপক্ষে সিরিয়াস ধরণের গবেষণা উপাত্ত দরকার এখানে। এই উপাত্তটি দেশীয় পরিপ্রেক্ষিতে করা কোন তথ্যনির্ভর (empirical) গবেষণা থেকে প্রাপ্ত হতে পারে। সেটা না পাওয়া গেলে একই ধরনের (কিংবা কাছাকাছি) আর্থ‌-সামাজিক সূচকের অন্য কোন দেশের পরিপ্রেক্ষিতে করা গবেষণা উপাত্তও হতে পারে। এমনকি পুরোপুরি ভিন্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থার কোন দেশে (যেমন: উন্নত বিশ্বের) অনুসৃত best practice ও হতে পারে এর ভিত্তি। এটা না করা হলে, পুরো বিষয়টা অনেকটাই subjective কিংবা ব্যক্তির খেয়াল খুশী ধারণা নির্ভর হয়ে যায়। কিছু ভাল মানুষ ভাবলো এবার কিছু ভাল কথা ঢোকানো হোক এই শিক্ষানীতিতে; ব্যস, তাতেই হয়ে গেল!

    (২) দ্বিতীয় বিষয়টি হল, প্রতিটি নীতিগত অবস্থানের economic impact analysis। অর্থাৎ, এসব নীতি নির্ধারণের সময় প্রতিটি অপশন এর অর্থনৈতিক দিকগুলো (সম্ভাব্য) টাকা-আনা-পাই ধরে হিসেব করা হয়েছে কিনা; এবং, সে সব হিসেবের সুনির্দিষ্ট তথ্যগত কোন ভিত্তি রয়েছে কিনা। কাল্পনিক কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি: বিদ্যালয় অবকাঠামোতে শ্লেট-পেন্সিল ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হলে এক ধরণের অর্থনৈতিক হিসেব, আবার ল্যাপটপ সহযোগে মাল্টিমিডিয়া প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষাদানের সিদ্ধান্ত নিলে তার হিসেব অন্য ধরণের; আবার কিছু বিষয়ে অবকাঠামোর পেছনে এখন ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিলে তা এখনকার জন্য কঠিন হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা দ্বিগুণ বা তিন গুণ সুফল বয়ে আনতে পারে ইত্যাদি ধরণের বিবেচনা।

    উপরের ১ নম্বরের বিষয়টা শিক্ষানীতির খসড়া প্রণয়নে অনুসরণ করা হয়েছিল কিনা আমার জানা নেই। এই গবেষণার কাজগুলো যোগ্য গবেষকদের মাধ্যমে করিয়ে নেয়া একটা উপায় হতে পারে, যাঁরা কমিটি সদস্যদের সাথে এই বিষয়ে মাসে দু’মাসে একবার মিলিত হয়ে তাদের প্রাপ্ত গবেষণা উপাত্ত তুলে ধরতে পারেন। জানা নেই তা করা হয়েছিল কিনা। আমাদের দেশে একটা সাধারণ চর্চা দাঁড়িয়ে গেছে এমন – এধরণের কমিটি বা কমিশনগুলোর সদস্যপদ কিছু বিখ্যাত মানুষদের দিয়ে ভরিয়ে তোলা হয়। সমস্যা হল, এঁরা নিজেরাই খুব ব্যস্ত মানুষ; যাঁদের একেবারেই সময় নেই পূর্ণ মাত্রার কোন গবেষণায় সময় দেয়ার। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতেও এমন যে করা হয় না তা কিন্তু না। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে জানি, সে সব আলন্কারিক বিখ্যাত মানুষদের বৈঠকগুলোকে সহায়তা করার জন্য থাকে নিযুক্ত রিসার্চ-ফেলোদের সক্রিয় উপস্থিতি এবং তাঁদের সরবরাহকৃত টাটকা গবেষণা উপাত্ত। বিখ্যাত মানুষদের সংশ্লিষ্ট করতে পারলে চূড়ান্ত দলিলটির “ওজন” হয়তো কিছু বাড়ে, সেটা মানি। কিন্তু সেক্ষেত্রে এই সব বিখ্যাত মানুষদের একইসাথে বিষয়বস্তুর সাথেও সরাসরি সংশ্লিষ্ট হওয়াটা জরুরী বলে মনে করি। শিক্ষানীতির প্রণয়নে নিযুক্ত কমিটি সদস্যদের মধ্যে সবার কি শিক্ষা বিষয়ে (নীতিগত বিষয়সমূহ, অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক বিষয়গুলো ইত্যাদি) বিশেষজ্ঞ জ্ঞান বা দক্ষতা ছিল কিনা সেটা জানার চেষ্টা করছি। ব্যারিস্টার নিহাদ কবির (যিনি মূলত একজন কর্পোরেট আইনজীবি) এর নামও দেখছি সেখানে। এই কমিটিতে মনোনীত হবার মতো তাঁর ভূমিকা বা এই সেক্টরে আগের অবদানের বিষয়টা আমার অবশ্য জানা নেই। আপনার জানা আছে? চূড়ান্ত খসড়াটির ভূমিকাতে বলা হয়েছে – ৫৬ টি বিভিন্ন ধরণের সংগঠন এর সাথে ‘আলাদা আলাদা বিস্তারিত মতবিনিময় করা হয়’। এই ৫৬ টি সংগঠন কারা? রিপোর্টে তাদের নামের তালিকা খুঁজছিলাম। পাইনি। এই তালিকাটি থাকলে এটাও বোঝা যেতো স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে অবশ্য অবশ্যই থাকা দরকার ছিল এমন কোন সংগঠন বাদ পড়েছে কি না মতপ্রদানের সুযোগ থেকে। অনুমান করছি কমিটি সদস্যরা একধরণের Focus Group Methodology ব্যবহার করেছেন মতামত/তথ্য সংগ্রহে; এ কারণেই গ্রুপগুলোর নাম জানা থাকা দরকার। আপনাকে বরং খোলাখুলিভাবেই বলি। চূড়ান্ত খসড়াটির শুরুতে বা শেষে কোথাও আরেকটু বিস্তারিতভাবে পুরো নীতিটি প্রণয়নের বিস্তারিত methodology পাবো আশা করেছিলাম। শুরুর ভূমিকায় উল্লেখ করা কয়েকটি অনুচ্ছেদ ছাড়া আর কিছুই পেলাম না সে বিষয়ে। কাজী খলিকুজ্জামান, মুহম্মদ জাফর ইকবালদের মতো একাডেমিক/গবেষণা ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষদের কাছ থেকে আরেকটু উন্নততর ড্রাফটিং পাবো – মনের কোনো কোণে হয়তো সেই প্রত্যাশা ছিল।

    এবার আসা যাক উপরের ২ নম্বর বিষয়টিতে। প্রণীত দলিলটির বিভিন্ন স্থানে বারবার সম্ভাব্য ব্যয়, রাষ্ট্রের রিসোর্স ইত্যাদি বিষয়গুলোর কথা বলা হয়েছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাগত বিষয়গুলোর ওপর বিস্তারিত তথ্যের অনুপস্থিতিতে বুঝতে পারছি না এগুলো কি কমিটি সদস্যরা “স্রেফ ভেবে” কিংবা “পূর্ব-ধারণা” থেকেই চট করে লিখে দিলেন নাকি এর সপক্ষে গভীর এবং বিস্তৃত কোন নিরীক্ষা রয়েছে। আমাদের গরীব রাষ্ট্রের “যথেষ্ট অর্থবল নেই এবং যা আছে তা বুঝে শুনে খরচ করতে হবে”, এটা যে কোন স্কুলের শিশুরও জানা আছে। কিন্তু ঠিক কতটুকু আমাদের আছে আর কতটুকু নেই, সে সব সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর বিশেষজ্ঞ ছাড়া আর কারও কাছ থেকে গ্রহণ করা উচিত কিনা ঠিক বুঝতে পারছি না। যতদূর জানি, “শিক্ষা-অর্থনীতি”র মতো একটা বিশেষায়িত ডিসিপ্লিনই রয়েছে এখন। আমার জানা নেই কমিটির পুরো কার্যক্রমের সাথে তেমন কেউ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন কি না। আমার এক বন্ধুর কাজ “শিক্ষা অর্থনীতি” নিয়েই। এই প্রশ্নটা তাকেও করেছিলাম। মজার একটি উত্তর দিয়েছেন তিনি: “বাংলাদেশে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদমাত্রই সকল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ; তাঁরা যেমন উন্নয়ন নীতি নিয়ে মতামত দেয়ার ক্ষমতা রাখেন, তেমনি আইএমএফ ওয়ার্লড ব্যাংক এবং মুদ্রানীতি নিয়েও ব্যাপক জ্ঞান রাখেন, টিপাইমুখ থেকে শুরু করে তেল গ্যাস এবং বঙ্গোপসাগরে প্রযোজ্য আন্তর্জাতিক আইন বিষয়েও অনেক জানেন; আর কেউ কেউ তো ডব্লিউটিও এবং আরবিট্রেশন বিষয়েও সবজান্তা, হালে একাধিক অর্থনীতিবিদ তো জাতিসংঘে কূটনৈতিক পদও অলন্কৃত করেছেন!” সেদিন দুই বন্ধু মিলে অনেক হেসেছি। ব্যাপারটা কি আসলেই হাসির?

    আপনি তো এই সেক্টরেই কাজ করছেন। আপনার ভাবনাগুলো জানার ইচ্ছে করছে। তাতে নিজের বোঝায় কোন ভুল থাকলে সে সবও শুধরে নিতে পারি।

    • গৌতম - ৭ ডিসেম্বর ২০০৯ (৯:২৬ পূর্বাহ্ণ)

      @রায়হান রশীদ,

      ১. আপনি একইসাথে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। প্রথমে যা বলেছেন, অর্থাৎ গবেষণাভিত্তিক উপাত্তের কথা— সাক্ষরতা পরিস্থিতি ও প্রাথমিক শিক্ষার কয়েকটি নির্দিষ্ট সূচক ছাড়া বাংলাদেশে এ বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণাভিত্তিক উপাত্ত তেমন একটা নেই। এখানে বেশিরভাগ গবেষণা হয় খণ্ডিত আকারে— আকারগত দিক দিয়ে যেমন, দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়েও। সুতরাং, ‘ক’ না ‘খ’— কোনটি আমাদের জন্য প্রযোজ্য, সেটি জানার কোনো মেকানিজম এখনও গড়ে উঠে নি। শিক্ষাসেক্টরে যারা কাজ করেন, তাঁরা নিজেদের বোধবুদ্ধি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।

      ২. বর্তমান শিক্ষানীতি আপনার দুটি পয়েন্টের ধারেকাছেও যায় নি। প্রথমেই বলা হয়েছে, তারা নতুন কোনো শিক্ষানীতি প্রণয়ন করছে না; বরং বিদ্যমান প্রতিবেদনসমূহ ও শিক্ষানীতিকে কেন্দ্র করে সেগুলোকে বর্তমান সময়ের উপযোগী করছেন মাত্র। আগের কোনো শিক্ষা কমিশনও নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে গবেষণার সাহায্য নেয় নি। বর্তমান কমিটি সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে মাত্র।

      ৩. আমার জানামতে এই কমিটিতে যারা আছেন, তাঁদের মাত্র তিন-চারজনের শিক্ষাসম্পর্কিত তাত্ত্বিক জ্ঞান রয়েছে। বাকিরা অভিজ্ঞতা, শিক্ষকতা, শিক্ষাব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সেক্টরে কাজ করার সুবাদে যতোটুকু জানেন, ততোটুকুই তাদের সম্বল। শিক্ষক মানেই যে শিক্ষাবিদ না— এ কথা বাংলাদেশে কাউকে বোঝানে যায় না। সুতরাং আপনি যার কথা বলছেন, তাঁর নাম তো বটেই, কমিটির অনেকের নামই শিক্ষাসেক্টরে কর্মরত মানুষজন আগে শুনেছে বলে মনে হয় না।

      ৪. ৫৬টি সংগঠনের নাম আমারও জানা নেই। তবে কয়েকটি এনজিও ও গবেষণা সংস্থার সাথে তারা কথা বলেছে, সেটা জানি। আর এখানে মেথডলজি নিয়ে কারও কোনো চিন্তা ছিলো বলে মনে হয় না। মেথডলিজ আবার কী! পত্রিকায় ভালো কলাম লিখতে জানা, গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা আর নীতিনির্ধারণে কোনো পার্থক্য আছে নাকি?

      ৫. অবিশ্বস্ত (!) সূত্রে যেটা জেনেছি— শিক্ষানীতি প্রণয়নে কমিটির মাত্র দু-তিনজন সদস্য কাজ করেছেন। তাঁরা মাঝে মাঝে বসে আগের শিক্ষা কমিশন রিপোর্টগুলো বের করে সেখানে প্রদত্ত নানা বাক্য ঠিকঠাক করে, কিছু নিয়ে কিছু বাদ দিয়ে একেকটা চ্যাপ্টারের খসড়া তৈরি করতেন। বাকিরা মিটিঙে এসে হা হু করে ঠিক আছে ঠিক আছে বলে টিএ/ডিএটা নিয়ে যেতেন। মোটামুটি এভাবেই নাকি শিক্ষানীতি তৈরি হয়েছে।

      ৫. মন্তব্যে আপনি যা যা বলেছেন, সবগুলোই ঠিক। শুধরে নেবার কিছু নেই। আমি এই সেক্টরে পড়াশুনা করেছি, এখন কাজ করছি, চেষ্টা করি সক্রিয় থাকতে। এই সেক্টরে এতো অরাজকতা— মাঝে মাঝে সবকিছু ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে। আজকে একেকজন স্ট্যাটিসটিশিয়ান, যাদের রিপোর্টে মূলত ডেটা প্রেজেন্টেশন ছাড়া আর কিছুই থাকে না, তারা হয়ে যাচ্ছেন বড় গবেষক। যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকদিন ক্লাশ নিয়েছেন, তিনি হয়ে যাচ্ছেন শিক্ষাবিদ— এমনতর হাজারও অনাচারে ভরা আমাদের শিক্ষাসেক্টর। মোটামুটি পরিচিত প্রায় সবাই কনসালটেন্সির জন্য যেভাবে হাভাতে হয়ে থাকেন, তাতে লোভের সংজ্ঞাটা মাঝে মাঝে নতুন করে লিখতে ইচ্ছে করে।

      ৬. আমি খুব ছোট মানুষ। শিক্ষা নিয়ে নানান বিষয় পত্রপত্রিকা-ব্লগে লিখি। আগবাড়িয়ে কারও কারও সাথে কথা বলি। বক্তব্যের চেয়ে নাম ও বয়স একটা বড় ফ্যাক্টর— আমাদের মতো তরুণদের কথায় কেউ কানও দিবে কেন? সেমিনার, সভায় দেখা হলে অবশ্য অনেকে পিঠ চাপড়ে দেন, “ঠিকই বলেছ, করা দরকার” বলে জ্ঞানী ভঙ্গিতে মাথাও নাড়ান। সেমিনার রুম থেকে বের হয়েই ছুটেন নতুন কোনো টেন্ডার জমা দিতে।

      আমরা যারা তরুণ, তাদের মোটামুটি প্রতিটা পদেই ব্লক করে রাখা হয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি (হিসেব করলে ৩৫-৪০ হবে, এদেরকেই আমি প্রতিটা সেমিনারে দেখি, নীতিনির্ধারনী পর্যায়ে দেখি, এমনকি আজকে কে কী বলতে পারেন, তাও আগেভাগেই আন্দাজ করে নিতে পারি) শিক্ষাসেক্টরের সব কাজ ভাগাভাগি করে নিয়ে যান, সেখানে অন্য কারও মতামত দেবার অধিকার নেই। বিনামূল্যে, স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার অফারও সেখানে পাত্তা পায় না। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, আমাদের দেশের শিক্ষাবিশেষজ্ঞদের কী অবস্থা!

      ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, তবে ব্যতিক্রমরা যতোদিন পর্যন্ত মূলধারার মানুষ হয়ে উঠতে না পারবেন, ততোদিন এদেশের শিক্ষা থেকে বড় কিছু আশা করা উচিত হবে না। অন্তত আমি করি না।

  7. রায়হান রশিদ - ২১ নভেম্বর ২০০৯ (৮:১৩ অপরাহ্ণ)

    @ গৌতম,

    প্রতিবেদনে যেভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রাকপ্রাথমিক শিক্ষার সময় ধর্মীয়জ্ঞান, অক্ষরজ্ঞান ও নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেটিকে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে।

    এই প্রসঙ্গে রিচার্ড ডকিন্স এর একটা মন্তব্য মনে পড়ছে। তাঁর মূল বক্তব্য এরকম: অপরিণত-মস্তিষ্ক impressionable শিশুদেরকে কোমল বয়সে যে কোন ধরণের ধর্মশিক্ষা দেয়াটাই “child abuse” এর পর্যায়ে পড়ে। কারণ, সেই বয়সের শিশুর পক্ষে বিভিন্ন ধর্মের বক্তব্য ভালভাবে জেনে, অনুধাবন করে, সে সবের মধ্যে তুলনা করে নিজ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া একরকম অসম্ভব। বিশ্বাস এবং আস্থার অবস্থানে থাকা বাবা‌-মা তাদের যা বোঝাবেন (ঠিক হোক বেঠিক হোক) তাই তাদের গ্রহণ করার (এবং বাকি জীবন তার দ্বারা চালিত হওয়ার) সম্ভাবনা থাকে বেশী।
    ডকিন্সের দৃষ্টিভঙ্গী আপনি কিভাবে দেখেন?

  8. গৌতম - ২২ নভেম্বর ২০০৯ (২:০৩ অপরাহ্ণ)

    ডকিন্সের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখি। তবে শুধু ধর্ম নয়, সামাজিক আচার ও অন্যান্য অনেক বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। শিশুদেরকে ছোটবেলা থেকে ধর্ম ছাড়াও অনেক বিষয়ে বাবা-মা যা বুঝান, শিশুরা পরবর্তী সময়ে সেটাকেই আঁকড়ে থাকে এবং সেটাই স্বাভাবিক।

    ধর্মে সমস্যাটা হচ্ছে, সামাজিক নর্মগুলোতে পরবর্তী সময়ে যেভাবে চাপিয়ে দেয়া বিশ্বাসটা কাটিয়ে উঠা যায়, ধর্মের ক্ষেত্রে তা যায় না। ধর্ম জিনিসটাই মূলত জন্মের ওপর নির্ভর করে, উত্তরাধিকারসূত্রে আসা একটা বিশ্বাস বহন করতে হয়। মানুষের ধর্মটা জন্মসূত্রে নির্ধারণ না করা হলে এই সমস্যাটা হতো না। ডকিন্স যেটা বলছেন, সেটা খুবই খাঁটি কথা- কিন্তু ধর্মটাকে যে বিচার-বিশ্লেষণ করে গ্রহণ করতে হয়, সেটাই বা কয়জনে বিশ্বাস করে? সেই দিক দিয়ে বিচার করলে এটা চাইল্ড অ্যাবিউজের মধ্যে পড়ে না। আমাদের পৃথিবীটা যদি আদর্শ সোসাইটি হতো, তাহলে সেটা অ্যাবিউজের মধ্যে পড়তো। ডকিন্স খুব তাড়াতাড়ি কথাটা বলে ফেলেছেন।

    অফটপিক: আপনার, অনুপম শহীদ এবং আরও কয়েকজনের মন্তব্য রয়েছে যেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা বলার আছে, কিন্তু প্রচণ্ড ব্যস্ততার কারণে মনোযোগ দিয়ে কিছু বলাটা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আশা করি ঈদের পর সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত কিছু কথা বলতে পারবো। তবে এই ফাঁকে আপনাকে অনুরোধ করতে চাই- শিক্ষানীতিটা পড়ার পর আপনার অনুভূতিগুলো জানিয়ে একটা লেখা দিন। ইমতিয়ার ভাইয়ের পোস্টে কিন্তু আপনি সেটা করবেন বলে জানিয়েছিলেন। সুতরাং, অপেক্ষায় থাকলাম।

  9. মাসুদ করিম - ২৫ ডিসেম্বর ২০০৯ (২:৩৬ অপরাহ্ণ)

    কয়েক দিন আগে অমর্ত্য সেনের একটি লেখা পড়েছি, পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষা, যদিও লেখার প্রেক্ষাপট পশ্চিমবাংলা, কিন্তু আলোচনাটা প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষা নিয়ে, কাজেই প্রাসঙ্গিকভাবে আমরাও পড়তে পারি : প্রথম অংশ এখানে এবং দ্বিতীয় অংশ এখানে। আমার কাছে দুটি বিষয়ে আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে : প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সমস্যা আর প্রাইভেট টিউশন ও পাঠক্রমের বোঝা।

  10. রায়হান রশিদ - ২৫ ডিসেম্বর ২০০৯ (৮:০৬ অপরাহ্ণ)

    প্রিয় গৌতম, আপনাদের তৈরী করা শিক্ষাবিষয়ক পোর্টালটি ব্রাউজ করলাম। মুগ্ধ হওয়ার মতো। সাইটটি শিক্ষা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ভান্ডার হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে, সন্দেহ নেই। আপনাদের অভিনন্দন। মুক্তাঙ্গন কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করবো এই সাইটটির লিন্ক আনবাড়ি’তে যুক্ত করার ব্যাপারটি বিবেচনার জন্য। তাহলে আমাদের পাঠকরাও চট করে সাইটটি হাতের নাগালে পেতেন এই বিষয়ে সাম্প্রতিক খবরাখবর-অগ্রগতিগুলো জানার উদ্দেশ্যে।
    ধন্যবাদ।

    • গৌতম - ২৮ ডিসেম্বর ২০০৯ (১২:১৯ পূর্বাহ্ণ)

      অনেক ধন্যবাদ রায়হান ভাই। আমাদের সাইটের লিঙ্ক ইতোমধ্যে আনবাড়িতে যুক্ত হয়েছে দেখতে পাচ্ছি। চেষ্টা করছি বাংলাদেশের শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন, তাঁদের ভাবনাগুলো তুলে আনতে। পাশাপাশি এর একটি বাংলা সংস্করণ তৈরির কাজও চলছে। মোটামুটি দাড়িয়ে গেলে তখন জানিয়ে দিবো। শিক্ষা-বিষয়ক বাংলা লেখাগুলোও ওখানে যুক্ত করা হবে- যাতে বাংলাদেশের পাঠক শিক্ষা নিয়ে কিছু জানতে চাইলে একজায়গাতে পেয়ে যান।

  11. মাসুদ করিম - ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১১ (৮:৫৩ অপরাহ্ণ)

    আমাদের নাগরিক ও গ্রামীণ জীবনে ঋণ ও বিনিয়োগ খুবই সাধারণ ঘটনা হয়ে পড়েছে এখন। তাই ‘ঋণ ও বিনিয়োগ’ বিষয়ক জ্ঞান বিতরণ বাড়াতে হবে — সবচেয়ে ভাল হয় ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ‘অর্থসংস্থান বিদ্যা’ বা ‘Financial Studies’ সাধারণ পাঠ্য করা এবং এর জন্য দ্রুত সময়ে বই প্রণয়ন করে আগামী শিক্ষাবৎসর থেকে এই বিষয়টি বোর্ড শিক্ষাক্রমে অর্ন্তভুক্ত করা।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.