একুশে বক্তৃতা ২০০০-এ সব্যসাচী লেখক ও হালের সব্যসাচী সুন্দরী নির্বাচক গুণী কথাশিল্পী সৈয়দ শামসুল হক ভাষাকে জাতির অন্যতম স্বদেশ হিসেবে দেখেছিলেন। বাক্যটি খুব মনে ধরেছিল। তার এমনতর দৃষ্টিভঙ্গীর পেছনে প্রেরণা কী ছিল এখন আর স্পষ্ট মনে পড়ে না। লেখাটা দীর্ঘদিন ধরে আরো অনেক পত্রিকার সাথে রেখে দিয়েছিলাম। এখনো এসব লেখা আরো অনেক ছেঁড়া পৃষ্ঠার মতো নানা সময়ে হাতে উঠে আসে আর আমাকে মুহূর্ত কয়েকের জন্য ভাবনার জগতে নিয়ে যাবার আয়োজন করে। লেখাটার কথা মনে পড়লো আজ রাতে “বিশদ বাঙলা”র অফহোয়াইট আলোর ওমে বসে হালের তরুণ কবি ও কথাশিল্পী এবাদুর রহমান এর সাথে আলাপচারিতার সময়। একটানা প্রায় দুই ঘন্টা অনর্গল কথা বলে যাওয়ার ক্ষমতা বোধকরি সবার থাকে না। প্রথম অংশটা আমি সম্ভবত ধরতে পারিনি। যে অংশটা আমি পরিষ্কার ধরতে পেরেছিলাম সেটা তার “পূর্ব বাঙলার ভাষা”র সূত্র ধরে। যেসব কথা উনি শোনালেন তার সারমর্ম সঠিকভাবে ধরতে পেরেছি কিনা নিশ্চিত নই। কারণ নানা জায়গা থেকে একটা বিষয়কে ফোকাস করার একটা বাতিক ছিল বক্তার। তার উপর খানিকটা আমলাতান্ত্রিক অ্যাপ্রোচ নিয়ে প্রশ্নের উত্তরগুলা সাজিয়ে শ্রোতাদের সামনে থ্রো করছিল। এটা তর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপ্রোচ হয়ে উঠে অনেক সময়। আর শ্রোতাদের জ্ঞানকাণ্ডের উপর এক ধরণের প্রিঅ্যাজাম্পশান থাকায় তার কোনো কথাই ঠিকঠাক মতো ধরা যাচ্ছিল না। ফলত দুয়েকটা ভাল প্রশ্নের বাইরে তার বলাটাই সার হল। কে কি নিয়ে গেল জানি না। আমি ফিরলাম একরাশ অগ্রহায়ণের পেলব শীত শরীরে নিয়ে। তার ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা’ নিয়ে যা আমি এতদিন ধরে পাঠ করে জমা করেছি তার সাথে বক্তার আজকের বক্তব্য খানিকটা প্যারাডক্স তৈরী করে বলে মনে হল। তার সেই বহিখানার দুইটা প্রোগ্রামের কথা এক সাক্ষাতকারে জেনেছিলাম।
তার ধারণা প্রচলিত ভাষা পুঁজি নির্ধারিত। তার কাজ হচ্ছে, এই পুঁজি নির্ধারিত ভাষার বিপরীতে একটা পাল্টা ন্যারেটিভ তৈরী করা। এই কাজটা করবেন তিনি এক ধরণের প্রতি দর্শন তৈরী করে। কী সেটা? খুব সরল ভাষায় বাকা আঙুলে ঘি না তুলে সেটা করা হবে সোজা আঙুলে। একঘেয়ে রিপোর্টধর্মী ভাষাশৈলীর বাইরে যেযে এমন কিছু করা যাতে যা সরাসরি উপস্থাপিত হবে না। পাঠককে খুব গদো গদো গদ্যে কোনো কিছু দিলে সে আর আর রিঅ্যাক্ট করবে না। তাকে বের করে আনতে হবে ভেতর থেকে। মননের সেই বিশেষ জায়গা গুলোকে জাগাতে হবে যা সচরাচর সুপ্ত থাকে। বক্তব্যের ভেতর থেকে মৌলিক কিছু বক্তব্য সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়ে পাঠককে ছুঁড়ে দেয়া সেই খাদে। সৃষ্টিশীলতার অন্যরকম রূপকে ধরার অসাধারণ এক স্বপ্ন হতে পারে এটি। পাঠকের ভেতর অনেকগুলো সাংকেতিক ইমেজ তৈরী করে তা দিয়ে নিজের মতো করে বক্তব্যকে ব্যাখ্যা করার মতো উপযুক্ত করে তোলা। এই কাজটা অনেকে অনেকভাবে করার চেষ্টা করছেন বিগত দেড় দুই দশক ধরে। এর চূড়ান্ত সাফল্য নির্ভর করছে প্রায় অসহিষ্ণু পাঠকগোষ্ঠীকে কতটুকু প্ররোচিত করতে পারছে তার উপর। যদিও এটা একেবারেই গৌণ হয়ে যায় যখন লেখক পাঠকের অভিজাত রুচির মুখে পিঠ থাক করিয়ে নিজের পথটা নিজে খুজতে থাকেন। এটাই সম্ভবত তরুণ ও সৃষ্টিশীল লেখকের গোড়ার কাজ।
এবাদ কথিত চিন্তার জায়গাটি সবসময় সে কথা রাখতে পারেনি। পুঁজি নির্ধারিত যে-ভাষার বিরুদ্ধে যেতে গিয়ে তিনি আরেকটা পাল্টা ন্যারেটিভ তৈরী করার কথা বলছেন তা কতখানি জড়তাবিহীন ও স্পষ্ট এটার আমার গোড়ার প্রশ্ন। যাদের লেখার ভেতর দিয়ে তিনি তার তৎপরতাকে রূপ দিতে চেয়েছেন খোদ তাদেরই তো অনেকে রাষ্ট্রযন্ত্রের সরাসরি কব্জায় থেকে নানাবিধ ফায়দা তুলেছেন বারবার। জীবন আর জীবিকার চিরাচরিত দ্বন্ধের বাইরে গিয়ে যারা সফল হয়েছেন সবাই কি তাদের মধ্যে পড়েন? এই অভাগা দেশে যেকোনো মধ্যবিত্ত তরুণ কৈশোরের কচি যৌবনকে অতিক্রম করার আগেই বিশ্বপুঁজির অংশ হয়ে ওঠা ছোটো ছোটো পুঁজিবলয়ের গোলাম হয়ে উঠে । একজন সৃষ্টিশীল ভাবুকও সরাসরি রাষ্ট্রের গোলাম হয়ে উঠে তার চিন্তাকে খানিকটা পরিপক্ক করার আগেই। এই ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে থেকে তখন তাকে আরেকটি পাল্টা ন্যারেটিভ তৈরী করতে হয়। যারা এটি পারে তারাই শুধু টিকে থাকার ক্ষমতা রাখে। এইসব অনুচিন্তার কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা এবাদুর দেননি।
আর পুঁজির যে ব্যাখ্যা তিনি তার বক্তব্যে সবসময় দেন সেটা আমার কাছে যথোপযুক্ত নয়। সাহিত্যের ক্লাশ আমার কখনো করার সৌভাগ্য হয়নি। তখন হয়ত একটা পাল্টা ডিসকোর্স তৈরী করা যেত। পুঁজির বিকাশ তো বাজারকে কেন্দ্র করেই। আর বাজারের যে-রূপকে আমরা গড়পড়তা তুলে ধরি সেটা বাজারের সত্যিকারের রূপ নয়। অন্তত অমর্ত্য সেনের কথা যদি ধার করি যে কেউ বাজারের আরেকটা পাল্টা ধারণা পেতে পারেন। সমস্যা বাজারের ভেতর থেকে নয়। সমস্যা তৈরী হয় বাজারের বাইরে থেকে। অনেকদিন আগে আতিউর রহমানের একটা লেখায় এমনই ব্যাখ্যা পড়েছিলাম। যৌক্তিকই মনে হয়ে ব্যাখ্যাটা। বাজারকে অমর্ত্য সেন একটা ব্যবস্থাপনা হিসেবে দেখেন। অনেকগুলো সাবজেক্ট নানা জায়গা থেকে সেখানে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন। বাজারকে কাজে লাগিয়ে কল্যানমুখি উন্নয়নের দিকে যেতে হলে প্রয়োজন তথ্যের অবাধ প্রবাহ। আর সেটা সরবরাহ চেইনটা খোলা রাখতে হবে খোদ রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্রের সাথে সংঘাত শুরু সেখান থেকেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কিংবা পুঁজির বিকাশের সাথে জড়িত তথ্যপ্রবাহটা রাষ্ট্র যখন সচল রাখতে ব্যর্থ হয় তখন অসংগতি তৈরী হতে বাধ্য। একজন সৃজনশীল লেখক শুধু নয়, এই চেইনের বিরুদ্ধে যেতে হয় একজন কৃষক থেকে রিকশা শ্রমিক পর্যন্ত সবাইকে। এবাদুরের লেখা ও চিন্তার জায়গায় আরবান চরিত্রগুলো যখন কথা বলে, আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির বীরদের প্রতিবাদের ভাষা আপনি খুঁজতে ব্যর্থ হবেন। আপনার মনে পড়বে সেসব কৃষকের কথা যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন চেইনটা সচল রেখে যাচ্ছে প্রায় কোনোরকম প্রতিদান ছাড়াই। আপনার মনে পড়বে সেই আধুনিক কুমারদের কথা যারা সিরামিকের বাসনকোসন তৈরীর কারখানার মেঝে ভিজিয়ে চলেছে ফোটা ফোটা রক্ত ও ঘামে। নাহ্, নিস্বার্থ জেলেদের দীর্ঘশ্বাসও আপনার কানে ভেসে আসবে। আপনি কেবল ঘেমে উঠবেন না। রক্ত, অশ্রু আর ক্ষোভের ভেতর জারিত হয়ে আপনি নিজেও আরেকটি পাল্টা ন্যারেটিভ তৈরী করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে উঠবেন।
১০/১২/২০০৯, রাত ২টা।
(লেখাটি একটানা নেটে বসেই লেখা। একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বয়ান ছাড়া আর কিছু নয়। বানান ও অন্যান্য জড়াতাগুলো বিনয়ের সাথে নেয়া হবে আশা করি )।
ফজলুল কবিরী
গল্প শুনতে ভালবাসি। লিখতেও। যারা শোনায় তাদের গুরু মান্য করি। যা শুনি তার কিছু হজম করি স্মৃতির পাকস্থলিতে। তারই কিছু অনুবাদ করি সুযোগ পেলে। কমপ্লেক্সিটির সারাৎসার আমার চিন্তা। হায়! শীতের কোনো এক সকালে দূর্বা ঘাসের আগায় জমে থাকা শিশিরের দানায় চোখ রেখে একদিন হয়ত ভেবেছিলাম কবি হবো। কবি তো না, হয়েছি এক আজন্ম অভিমানি।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১৫ comments
ডোবারব্যাং - ১২ ডিসেম্বর ২০০৯ (১২:৫৬ অপরাহ্ণ)
ময়মুরুব্বিদের ধমকতুল্য ‘পরামর্শে’ এই টাকমাথা স্ট্রাইকারের আগাপাছাতলার হাতামাথা ঠিক না থাকা কোষ্ঠ্যকাঠিণ্যগ্রস্ত ঢাস্কেপিটাল আর কৌতুক্ময় পূর্ববঙ্গের ভাষা নামক মুটকা দুইখান থান ইটের আগা থেকে পাছা পর্যন্ত পুরোটা পড়তে বাধ্য হইছিলাম…হুদাই সময়টুকু নষ্ট…বাপমার ঠিক না থাকা (ভদ্রোলোকদের ভাষায় আইডেনটিটির ক্রাইসিসে থাকা) শহুরে শিকখ্যাত মধ্যবিত্তদের মধ্যে জিনিসটাকে নিয়ে দাপাদাপি দেখে হাসি চাপানোই মুশকিল…
ফজলুল কবিরী - ১২ ডিসেম্বর ২০০৯ (৬:০৮ অপরাহ্ণ)
বিষয়টার অতটা সরলীকরণ করে প্রত্যাখ্যান করার ভয় আছে বলে ধারণা করি। তার সক্রিয়তা নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। আমি মজা পেয়েছি এত এত পাঠপ্রস্তুতি আর জানাশুনার বরাত দিয়ে বক্তব্যের আগাগোড়াই কেবল বিদেশী সাপের মাংস খেয়ে যাওয়া এবং এই টেকনিকে শ্রোতাদের খানিকটা ঠান্ডা করতে দেখে। নিজের বিপ্লবী পথ পরিহার করার পথ হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেন, তিনি স্বার্থপর। বিপ্লব পর্যন্ত অপেক্ষা করার সময় নেই। সময়ের মধু পান করার করার বড় তাড়া আছে। কতটা ভোগী মানসিকতা আর দেখলেপনা সাহিত্যিক হলে এমনতর চটুল মন্তব্য করে বসে একটু আগেই হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উপন্যাসই তার প্রিয় উপন্যাস বলে স্বীকৃতি দেয়া লোকটি!
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১২ ডিসেম্বর ২০০৯ (৯:৩৩ অপরাহ্ণ)
কবিরী, তোমার উপরের লাইনটি বুঝলাম না। আর আমার মনে হয়, তার বক্তব্যের সমস্তকিছু আত্মস্থ করে মন্তব্য করা উচিৎ। আমি য্দ্দূর শুনেছি, তিনি শৈল্পিক আনন্দলাভের কথাই বলেছেন। তিনি এও বলেছেন যে, ইচ্ছা করলেই তিনি দুই-তিন লাখ টাকার বেতনে চাকরি করতে পারতেন। শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা থেকেই তা করেননি। এমনকি মোটা মাসোহারার একটা চাকুরিও শুধুমাত্র মানসিক প্রশান্তির অভাবে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমি যদ্দূর জানি, বিদেশে অবস্থানকালে প্রয়োজনে রুটিও বানান তিনি। কাজেই একজনকে আংশিক জেনে বা উদ্ধৃত করে যা-তা বলা যায় না। আমি যেইটুকু বুঝতে পেরেছি, তিনি ক্লাসিক্যাল এনার্কিজমকে লালন করতে চান। যার জন্যই হয়ত বেয়াদব-পুজির একচেটিয়া লালসার স্স্থানটিতে তিনি তার মতো করে ব্যক্তিগত বা গোস্ষ্টিভিত্তিক সাংস্কৃতিক আবহ কামনা করেন।
তার চর্চাকৃত ভাষা, বক্তব্যের ধরন, প্রশ্নকারীর প্রতি উদাসীন আচরণ, তার ফিলসফি ইত্যাদি নিয়ে দ্বিমত থাকার অবকাশ আছে। কিন্তু তাকে এভাবে (লোকটি/ কতটা ভোগী মানসিকতা/ মধু পান করা) বলা কি সঠিক আচরণ হতে পারে?
ফজলুল কবিরী - ১৩ ডিসেম্বর ২০০৯ (১২:৩৫ পূর্বাহ্ণ)
জাহাঙ্গীর ভাই আপনার সুনির্দিষ্ট মন্তব্য আমলে নেয়ার মতো। আপনার উদ্ধৃত আমার লিখিত বাক্যটিতে রিপিটেশন দেখলাম। চোখে পড়েনি। অসতর্কতাবশত হয়েছে। ’দুই তিন লাখ টাকার’ চাকরি কিংবা ’মেটা মাসোহারা’ উপেক্ষা করার মতো চিন্তার জায়গা সম্ভবত উনার তৈরী হয়েছে। ’চাকরি না করলে আরো বেশি’ আয়ের সুযোগ আছে বলেও জানিয়েছিলেন। রুটিরুজির জন্য রুটি বানিয়ে দুবেলা খেয়ে ক্লাসিক্যাল এনার্কিজমকে লালন করার সুযোগ তিনি মিস করছেন না জেনে আমার মতো নাদান পাঠকের সাহস পাবার কথা।
‘কাজেই একজনকে আংশিক জেনে বা উদ্ধৃত করে যা-তা বলা যায় না।’- আপনার এই বক্তব্যে আমার আপত্তি থাকার কথা। এই আংশিক জানা বলতে আপনি বিশদ বাঙলা আংশিক আলাপের কথা বুঝাতে চাইছেন? আমার বক্তব্য কেবল সেই আংশিককে ধারণ করেছে মনে হওয়াতে আমি খানিকটা লজ্জিত। তার লেখার ইতোপূর্বের পাঠকে আমি ধরতে ব্যর্থ হয়েছি সন্দেহ নেই। আর এবাদুর রহমানের উপর আমার আরোপ করা যেসব বিশেষনের কথা আপনি উল্লেখ করলেন তা বোধকরি আমার হীনতা ও নীচতাকে প্রমাণ করে। বলা ছিল যদিও, একটানা নেটে বসে লেখা এটি। কোনোরকম এডিট না করেই ছাপানো। ভবিষ্যতে এই বিষয়ে সতর্ক থাকব। আপনার বক্তব্যকে সাধুবাদ জানাই।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১৩ ডিসেম্বর ২০০৯ (৭:০৮ পূর্বাহ্ণ)
কবিরী, তোমাকে ভালোবাসা।
বিশদ বাঙলায় দেয়া এবাদুরের বক্তব্য যে তুমি পুরোটা শুননি তা তো নিজেই জানালে। এবাদুর কথিত আবার পূর্ব বাঙলার ভাষা বিষয়টাও তার গ্রন্থ পাঠযোগে তোমার কাছে ক্লিয়ার হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। কারণ তার নাজেলকৃত ওই ভাষা তার সম্পাদিত গ্রন্থ এবং তারই দাস ক্যাপিটাল-এ জানানো আছে। তুমি যে পুজির কথা বললে, তা কি বিকশিত, বিকাশমান নাকি সামাজিক পুজি?
যাই হোক, এবাদুরের সাথে ভিন্নমত যে কারও থাকতেই পারে। তবে তোমার লেখায় যে তাৎক্ষণিক-অসহিষ্ণুতার ছাপ পড়েছে, এর সাথে আমি দ্বিমত করছি।
মুয়িন পার্ভেজ - ১৩ ডিসেম্বর ২০০৯ (১:৪০ পূর্বাহ্ণ)
অনেকদিন থেকেই ‘মুক্তাঙ্গন’-এ আপনার লেখার আশায় ছিলাম, আজ, সে-কারণেই আমার আনন্দদিন। ‘বিশদ বাঙলা’র অনুষ্ঠানে আমার যাওয়া হয়নি, তাই এবাদুর রহমানের বক্তৃতা অনাস্বাদিত রয়ে গেল। তাঁর প্রবন্ধ বা গদ্যভাষার সঙ্গে আমার পরিচয় থাকলেও দাস ক্যাপিটাল পড়া হয়নি, ফলে এ-বিষয়ে কথা বলা আমার পক্ষে কুয়োর ব্যাঙের আকাশদর্শনের মতো ব্যাপার। তবে মাঝেমধ্যে ভাবনার একটু বুদ্বুদ তৈরি হয়েই যায় — যে-ভাষায় আমি কথা বলি, তা কতখানি আমার প্রাণের ভাষা? যে-প্রমিত বা মান্য ভাষায় চিঠি লিখি, সে কি ধ’রে রাখে ঠিকঠাক আমার সত্তার সমূহ উত্তাপ? স্বরাগম, স্বরসঙ্গতি ইত্যাদি ধ্বনিতত্ত্বের প্রতাপও কি অভিন্ন এপার-ওপার বাঙলার লোকমুখে? পদ্মায় ‘নৌকা’ ভাসে, গঙ্গায় ‘নৌকো’। তেষ্টা পেলে ‘পানি’ই চাই, কিন্তু ‘জল’ না থাকলে অন্তত কবিতা ডাঙার মাছের মতো তড়পায়; ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, রক্তে জল ছলছল করে’ — শঙ্খ ঘোষের এ-পঙ্ক্তি নির্বিকল্প ধ’রে নিয়েও ‘পানি’কে পুনর্বাসন করা সহজ হবে, কবিতায়?
এহসানুল কবির - ১৩ ডিসেম্বর ২০০৯ (২:৪৭ পূর্বাহ্ণ)
[মুয়িন পার্ভেজের ‘প্রতিক্রিয়া’/’প্রত্যুত্তর’টা পড়ার পর পর উনার কাছে করা আমার বৈডাকের ঈষৎ পরিমার্জিত নকল এটা]
মুয়িন ভাই,
এইমাত্র মুক্তাঙ্গন-এ কবিরীর লেখার ‘প্রতিক্রিয়া’য় লিখা আপনার লেখাটা পড়লাম। মনে হল, আমিই বোধ হয় আপনার প্রতিক্রিয়াটার প্রথম পাঠক, কেননা আমার চোখের সামনেই এটা এসে নামলো। উঠানোর কাজে কারো মধ্যস্থতা না থাকলে আমিই প্রথম পাঠক। আহা, এমন সুখ বহুদিন পাই নি! মানে, অন্য কারো লেখার প্রথম পাঠক হওয়ার সুখটা।
প্রথম যেদিন আপনার লেখা পড়েছিলাম সেদিন থেকেই আপনার প্রতি যে-শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমবোধ (ভালোবাসাও কি?) আমার জন্মেছিল, সেটা যে আজ পর্যন্ত এতটুকু কমে নি—এও এক বিরল ও অনির্বচনীয় সুখ আমার জন্য।
যে-বিষয়ে কথাবাত্রা হচ্ছে সে-বিষয়ে দায়িত্ব নিয়ে যে-টুকু বলতে পারব সে-টুকু বলার পর কথা বাড়তে থাকলে সেটার দায় নেওয়ার মতো যোগ্যতা ও সময় এক্ষুণি আমার নেই বলে এবাদ নিয়ে আপাতত বিবাদে যাচ্ছি না।
এবাদুর রহমানের বইটার নাম কিন্তু ডাস ক্যাপিটাল না; দাস ক্যাপিটাল।
ভালো থাকবেন। শিগগির দেখা হবে, আশা করি।
এহসান
মুয়িন পার্ভেজ - ১৩ ডিসেম্বর ২০০৯ (১০:২৪ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ, এহসানুল কবির। ‘ভালোবাসা’র এ-সারল্য আমাকে উজ্জীবিত রাখবে আগামী দিনেও। কাল রাতে ডাস ক্যাপিটাল লিখেছিলাম ঠিকই, কিন্তু ঘুমোতে যাওয়ার সময় (০৪ : ৫০) হঠাৎ মনে পড়তেই এসে শুধরে নিয়েছিলাম। ভাষাতত্ত্বে আপনার অশেষ আগ্রহের কথা আমি জানি, তাই ফজলুল কবিরীর লেখার সূত্রে আপনার উপস্থিতি আমাকে আশান্বিত করেছে ভীষণভাবে। সময়-সুযোগ পেলে লিখবেন নিশ্চয়ই। ভালো থাকবেন।
মাসুদ করিম - ২০ ডিসেম্বর ২০০৯ (৪:০৫ অপরাহ্ণ)
দাস ক্যাপিটাল মানে কি CAPITAL OF SLAVE ? বইটি পড়া নেই তাই জানতে চাইছি।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ২১ ডিসেম্বর ২০০৯ (১২:২১ পূর্বাহ্ণ)
এভাবেও আপনি ধরতে পারেন। অথবা, দাস ক্যাপিটাল-এ পুজির খেলাও হতে পারে। আমার মনে হয়েছে এখানে একধরনের কল্পপ্রতিমা নির্মিত হয়েছে, যেখানে বড়োলোকিপনা অনেককিছুকেই দাসানুদাস বানিয়ে রাখতে জানে। বইটির নামকরণের স্পষ্ট ব্যাখ্যা লেখক দিয়েছেন বলে আমি বলতে পারছি না। শব্দের বাক্যের ইতিহাসের নানান রকম হেয়ালিপনা এটাতে আছে।
আমি শুধু এটুকু বলেই আমার কথা শেষ করতে চাই, নানান কোণ থেকে এটির পাঠজনিত প্রুতিক্রিয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
মাসুদ করিম - ২১ ডিসেম্বর ২০০৯ (৬:২৪ অপরাহ্ণ)
আপনার মন্তব্য পড়ে মনে হচ্ছে এর মানে হবে SLAVE OF CAPITAL (যেখানে বড়োলোকিপনা অনেককিছুকেই দাসানুদাস বানিয়ে রাখতে জানে)। তার মানে ‘পুঁজির দাস’ এবং আমি আগে বলতে চেয়েছিলাম ‘দাসের পুঁজি’ — তার মানে ‘দাস’ শব্দটি লেখক SLAVE অর্থে ব্যবহার করেছেন, মার্কসের বই DAS KAPITAL-এর জার্মান নির্দেশক DAS অর্থে নয়। এ ব্যাপারটিই আমার কাছে স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।
ফজলুল কবিরী - ১৩ ডিসেম্বর ২০০৯ (১০:১৭ অপরাহ্ণ)
মুয়িন ভাই
আপনার আন্তরিক মন্তব্য আমাকে খুবই স্বস্থি দিল। আর খানিকটা অস্বস্থিও আমাকে ভর করল বটে। আপনার সাথে আমার সম্পর্ক বিনয়ের নয়। যে বিষয়টি নিয়ে আপনার সংশয় তা নিয়ে বলবার যোগ্য লোক আমি নই। ২০০৩ এর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় বিদ্যাসাগর সোসাইটি আয়োজিত সেমিনারে হায়াৱ মামুদ দুই বাংলার সাহিত্যের পৃথক ভাষাবৈশিষ্ট্যকে আগ্রাহ্যই করেছিলেন। তিনি গল্প-উপন্যাসকে বিবেচনায় আনার পক্ষে মত দেননি। কারণ “ভাষা সেখানে ঘটনা, চরিত্র, সমাজপরিবেশ, কুশীলবের উন্মার্গতা (eccentricity) ইত্যাদি অনেক কিছুর অধীন।”
আর “কবিতা বাদ পড়বে তার নিজস্ব শিল্পভাষা বা পোয়েটিক ডিকশনের কারণে, যে ভাষার নির্ভরতা হলো প্রতীকধর্মীতা ও সংকেতময়তায়”। উনার বিবেচনায় “তথ্যনির্ভর কিংবা তত্ত্বাশ্রয়ী” গদ্যে সাহিত্যভাষার গতিপ্রকৃতি ধরা পড়বে। কথার সারসংক্ষেপ হল এই দুই অংশের সাহিত্যের আলাদা ভাষাবৈশিষ্ট্য আছে বলে যারা মনে করেন তাদের ভেতর তিনি এক ধরণের গোপন চাতুরি দেখেন। এটাকে তিনি অবশ্য কল্পিত দায়িত্ব হিসেবে দেখেন এবং স্পষ্ট করেই জানিয়ে দেন, “ভাষাপার্থক্য নিরূপণ অপেক্ষা সাহিত্যসৃজন অনেক বেশি প্রয়োজনীয় ও জরুরী।” আর প্রমিত ভাষায় অন্তরের ক্ষরণ প্রশমন না হলে একজন নিষ্টাবান কবির যে কাজ করা উচিত বলে মনে করেন, তা করা থেকে বিরত থাকবেন কেন? প্রাণের ভাষাটার হদিশ নিশ্চয় আপনি পেয়ে যাবেন। অন্তরের কেথাও হয়ত খেলা করছে অহর্নিশ। সেই ভাষাটাই যেন হয়ে উঠে আপনার সম্ভাবনার অন্য এক দিগন্ত।
জাহাঙ্গীর ভাই,
যে অসহিষ্ণুতার দিকে আপনি নজরপাত করলেন তা মাথা পেতে নেয়াই হবে আমার ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতার যোগ্য পুরস্কার। আর বিকশিত, বিকাশমান কিংবা সামাজিক পুজির প্রেক্ষাপটে এবাদুরকে বিশ্লেষনে আপনার বক্তব্যই হতে পারে আমার জন্য পাথেয়। এবাদুর রহমান নিয়ে আপনার মতৈক্যের জায়গাগুলো স্পষ্ট হল খানিকটা। মতানৈক্যের বিষয়গুলো নিয়ে আমার অতৃপ্তিটা আশা করি একটা দীর্ঘ পোস্টে পরবর্তীতে মেটাবেন।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১৩ ডিসেম্বর ২০০৯ (১১:১৯ অপরাহ্ণ)
পরস্পর মতবিনিময়ে আমরা আলোকিত হবো, এটাই আমরা চাইতে পারি।
ফজলুল কবিরী - ১৩ ডিসেম্বর ২০০৯ (১১:৫১ অপরাহ্ণ)
যথার্থই বলেছেন জাহাঙ্গীর ভাই। প্রিয় বন্ধু এহসানকে তার গীতল অনুভূতি আমাদের সাথে ভাগাভাগি করার জন্য কৃতজ্ঞতা।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ২১ ডিসেম্বর ২০০৯ (১১:০৭ অপরাহ্ণ)
মাসুদ করিম,
দাস ক্যাপিটাল-এর নামকরণের ব্যাপারে আমার ধারণার কথা আমি অলরেডি বলেছি। এরপরও আপনার জানার তৃষ্ণা নিবারণের জন্য হয় আপনাকে মূল গ্রন্থটি পাঠ করতে হবে, নতুবা লেখকের মতামত নিতে হবে।