একুশে বক্তৃতা ২০০০-এ সব্যসাচী লেখক ও হালের সব্যসাচী সুন্দরী নির্বাচক গুণী কথাশিল্পী সৈয়দ শামসুল হক ভাষাকে জাতির অন্যতম স্বদেশ হিসেবে দেখেছিলেন। বাক্যটি খুব মনে ধরেছিল। তার এমনতর দৃষ্টিভঙ্গীর পেছনে প্রেরণা কী ছিল এখন আর স্পষ্ট মনে পড়ে না। লেখাটা দীর্ঘদিন ধরে আরো অনেক পত্রিকার সাথে রেখে দিয়েছিলাম। এখনো এসব লেখা আরো অনেক ছেঁড়া পৃষ্ঠার মতো নানা সময়ে হাতে উঠে আসে আর আমাকে মুহূর্ত কয়েকের জন্য ভাবনার জগতে নিয়ে যাবার আয়োজন করে। লেখাটার কথা মনে পড়লো আজ রাতে “বিশদ বাঙলা”র অফহোয়াইট আলোর ওমে বসে হালের তরুণ কবি ও কথাশিল্পী এবাদুর রহমান এর সাথে আলাপচারিতার সময়। একটানা প্রায় দুই ঘন্টা অনর্গল কথা বলে যাওয়ার ক্ষমতা বোধকরি সবার থাকে না। প্রথম অংশটা আমি সম্ভবত ধরতে পারিনি। যে অংশটা আমি পরিষ্কার ধরতে পেরেছিলাম সেটা তার “পূর্ব বাঙলার ভাষা”র সূত্র ধরে। যেসব কথা উনি শোনালেন তার সারমর্ম সঠিকভাবে ধরতে পেরেছি কিনা নিশ্চিত নই। কারণ নানা জায়গা থেকে একটা বিষয়কে ফোকাস করার একটা বাতিক ছিল বক্তার। তার উপর খানিকটা আমলাতান্ত্রিক অ্যাপ্রোচ নিয়ে প্রশ্নের উত্তরগুলা সাজিয়ে শ্রোতাদের সামনে থ্রো করছিল। এটা তর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপ্রোচ হয়ে উঠে অনেক সময়। আর শ্রোতাদের জ্ঞানকাণ্ডের উপর এক ধরণের প্রিঅ্যাজাম্পশান থাকায় তার কোনো কথাই ঠিকঠাক মতো ধরা যাচ্ছিল না। ফলত দুয়েকটা ভাল প্রশ্নের বাইরে তার বলাটাই সার হল। কে কি নিয়ে গেল জানি না। আমি ফিরলাম একরাশ অগ্রহায়ণের পেলব শীত শরীরে নিয়ে। তার ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা’ নিয়ে যা আমি এতদিন ধরে পাঠ করে জমা করেছি তার সাথে বক্তার আজকের বক্তব্য খানিকটা প্যারাডক্স তৈরী করে বলে মনে হল। তার সেই বহিখানার দুইটা প্রোগ্রামের কথা এক সাক্ষাতকারে জেনেছিলাম।
তার ধারণা প্রচলিত ভাষা পুঁজি নির্ধারিত। তার কাজ হচ্ছে, এই পুঁজি নির্ধারিত ভাষার বিপরীতে একটা পাল্টা ন্যারেটিভ তৈরী করা। এই কাজটা করবেন তিনি এক ধরণের প্রতি দর্শন তৈরী করে। কী সেটা? খুব সরল ভাষায় বাকা আঙুলে ঘি না তুলে সেটা করা হবে সোজা আঙুলে। একঘেয়ে রিপোর্টধর্মী ভাষাশৈলীর বাইরে যেযে এমন কিছু করা যাতে যা সরাসরি উপস্থাপিত হবে না। পাঠককে খুব গদো গদো গদ্যে কোনো কিছু দিলে সে আর আর রিঅ্যাক্ট করবে না। তাকে বের করে আনতে হবে ভেতর থেকে। মননের সেই বিশেষ জায়গা গুলোকে জাগাতে হবে যা সচরাচর সুপ্ত থাকে। বক্তব্যের ভেতর থেকে মৌলিক কিছু বক্তব্য সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়ে পাঠককে ছুঁড়ে দেয়া সেই খাদে। সৃষ্টিশীলতার অন্যরকম রূপকে ধরার অসাধারণ এক স্বপ্ন হতে পারে এটি। পাঠকের ভেতর অনেকগুলো সাংকেতিক ইমেজ তৈরী করে তা দিয়ে নিজের মতো করে বক্তব্যকে ব্যাখ্যা করার মতো উপযুক্ত করে তোলা। এই কাজটা অনেকে অনেকভাবে করার চেষ্টা করছেন বিগত দেড় দুই দশক ধরে। এর চূড়ান্ত সাফল্য নির্ভর করছে প্রায় অসহিষ্ণু পাঠকগোষ্ঠীকে কতটুকু প্ররোচিত করতে পারছে তার উপর। যদিও এটা একেবারেই গৌণ হয়ে যায় যখন লেখক পাঠকের অভিজাত রুচির মুখে পিঠ থাক করিয়ে নিজের পথটা নিজে খুজতে থাকেন। এটাই সম্ভবত তরুণ ও সৃষ্টিশীল লেখকের গোড়ার কাজ।
এবাদ কথিত চিন্তার জায়গাটি সবসময় সে কথা রাখতে পারেনি। পুঁজি নির্ধারিত যে-ভাষার বিরুদ্ধে যেতে গিয়ে তিনি আরেকটা পাল্টা ন্যারেটিভ তৈরী করার কথা বলছেন তা কতখানি জড়তাবিহীন ও স্পষ্ট এটার আমার গোড়ার প্রশ্ন। যাদের লেখার ভেতর দিয়ে তিনি তার তৎপরতাকে রূপ দিতে চেয়েছেন খোদ তাদেরই তো অনেকে রাষ্ট্রযন্ত্রের সরাসরি কব্জায় থেকে নানাবিধ ফায়দা তুলেছেন বারবার। জীবন আর জীবিকার চিরাচরিত দ্বন্ধের বাইরে গিয়ে যারা সফল হয়েছেন সবাই কি তাদের মধ্যে পড়েন? এই অভাগা দেশে যেকোনো মধ্যবিত্ত তরুণ কৈশোরের কচি যৌবনকে অতিক্রম করার আগেই বিশ্বপুঁজির অংশ হয়ে ওঠা ছোটো ছোটো পুঁজিবলয়ের গোলাম হয়ে উঠে । একজন সৃষ্টিশীল ভাবুকও সরাসরি রাষ্ট্রের গোলাম হয়ে উঠে তার চিন্তাকে খানিকটা পরিপক্ক করার আগেই। এই ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে থেকে তখন তাকে আরেকটি পাল্টা ন্যারেটিভ তৈরী করতে হয়। যারা এটি পারে তারাই শুধু টিকে থাকার ক্ষমতা রাখে। এইসব অনুচিন্তার কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা এবাদুর দেননি।
আর পুঁজির যে ব্যাখ্যা তিনি তার বক্তব্যে সবসময় দেন সেটা আমার কাছে যথোপযুক্ত নয়। সাহিত্যের ক্লাশ আমার কখনো করার সৌভাগ্য হয়নি। তখন হয়ত একটা পাল্টা ডিসকোর্স তৈরী করা যেত। পুঁজির বিকাশ তো বাজারকে কেন্দ্র করেই। আর বাজারের যে-রূপকে আমরা গড়পড়তা তুলে ধরি সেটা বাজারের সত্যিকারের রূপ নয়। অন্তত অমর্ত্য সেনের কথা যদি ধার করি যে কেউ বাজারের আরেকটা পাল্টা ধারণা পেতে পারেন। সমস্যা বাজারের ভেতর থেকে নয়। সমস্যা তৈরী হয় বাজারের বাইরে থেকে। অনেকদিন আগে আতিউর রহমানের একটা লেখায় এমনই ব্যাখ্যা পড়েছিলাম। যৌক্তিকই মনে হয়ে ব্যাখ্যাটা। বাজারকে অমর্ত্য সেন একটা ব্যবস্থাপনা হিসেবে দেখেন। অনেকগুলো সাবজেক্ট নানা জায়গা থেকে সেখানে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন। বাজারকে কাজে লাগিয়ে কল্যানমুখি উন্নয়নের দিকে যেতে হলে প্রয়োজন তথ্যের অবাধ প্রবাহ। আর সেটা সরবরাহ চেইনটা খোলা রাখতে হবে খোদ রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্রের সাথে সংঘাত শুরু সেখান থেকেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কিংবা পুঁজির বিকাশের সাথে জড়িত তথ্যপ্রবাহটা রাষ্ট্র যখন সচল রাখতে ব্যর্থ হয় তখন অসংগতি তৈরী হতে বাধ্য। একজন সৃজনশীল লেখক শুধু নয়, এই চেইনের বিরুদ্ধে যেতে হয় একজন কৃষক থেকে রিকশা শ্রমিক পর্যন্ত সবাইকে। এবাদুরের লেখা ও চিন্তার জায়গায় আরবান চরিত্রগুলো যখন কথা বলে, আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির বীরদের প্রতিবাদের ভাষা আপনি খুঁজতে ব্যর্থ হবেন। আপনার মনে পড়বে সেসব কৃষকের কথা যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন চেইনটা সচল রেখে যাচ্ছে প্রায় কোনোরকম প্রতিদান ছাড়াই। আপনার মনে পড়বে সেই আধুনিক কুমারদের কথা যারা সিরামিকের বাসনকোসন তৈরীর কারখানার মেঝে ভিজিয়ে চলেছে ফোটা ফোটা রক্ত ও ঘামে। নাহ্, নিস্বার্থ জেলেদের দীর্ঘশ্বাসও আপনার কানে ভেসে আসবে। আপনি কেবল ঘেমে উঠবেন না। রক্ত, অশ্রু আর ক্ষোভের ভেতর জারিত হয়ে আপনি নিজেও আরেকটি পাল্টা ন্যারেটিভ তৈরী করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে উঠবেন।
১০/১২/২০০৯, রাত ২টা।
(লেখাটি একটানা নেটে বসেই লেখা। একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বয়ান ছাড়া আর কিছু নয়। বানান ও অন্যান্য জড়াতাগুলো বিনয়ের সাথে নেয়া হবে আশা করি )।
গল্প শুনতে ভালবাসি। লিখতেও। যারা শোনায় তাদের গুরু মান্য করি। যা শুনি তার কিছু হজম করি স্মৃতির পাকস্থলিতে। তারই কিছু অনুবাদ করি সুযোগ পেলে। কমপ্লেক্সিটির সারাৎসার আমার চিন্তা। হায়! শীতের কোনো এক সকালে দূর্বা ঘাসের আগায় জমে থাকা শিশিরের দানায় চোখ রেখে একদিন হয়ত ভেবেছিলাম কবি হবো। কবি তো না, হয়েছি এক আজন্ম অভিমানি।