শুনছিলাম সারোয়ার ফারুকী একটা চলচ্চিত্র ‘বানিয়েছেন’ ; সেইটা নাকি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ‘জেলে’ আবদ্ধ এক নারীর বাস্তবতা দেখা। হলে গিয়ে দেখি, প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে দর্শক থেকে থেকে হাসে, শিষ দেয়, হাতে তালি লাগায়। ছবিতে একটা সংলাপ আছে, ‘তুমি জেলে যাবার পর থেকে পুরো পৃথিবীটা আমার কাছে জেলখানা হয়ে গেছে।’ ঢাকার ‘খোলা জেলখানার’ বাস্তবতায় এক নারীর বিপদ দেখে দর্শক সারিতে এতো শিস বাজে কেন, আমোদের হাসি কেন? পুরুষ দর্শক বেশী বলে? নাকি নারীর কষ্ট যেভাবে দেখালে পুরুষ-চোখ-মন মজা পায়, হাততালি দিতে পারে তেমন ছবিই ফারুকী বানিয়েছেন? তিনি তাহলে পুরুষতান্ত্রিক চৈতন্যে শান দিছেন, কাতুকুতু মারছেন — দর্শক তাই হাসে। তাতে তিনি সফল হইছেন। ছবি তো তাইলে সুপার হিট! অস্বীকার করে কে?
একজন নারী দর্শক হিসেবে চলচ্চিত্র শুরুর কিছুক্ষণ পরই আবিস্কার করলাম, প্রেক্ষাগৃহের অন্য দর্শক থেকে তো আমি আলাদা হয়ে পড়ছি। হাসতে পারছি না। বলতে পারছি না যে নির্মাতা নারীর দৃষ্টিরূপ থেকে ছবি বানাইছেন। কেন পারছি না? নারীর দৃষ্টিরূপ থেকে ছবি হলে মূল চরিত্র রুবার যাতনা আমিও নারী হিসেবে বোধ করতাম। কিন্তু তা বোধ হচ্ছে না, আবার নির্মাতা যে হাসি হাসাইতে চাচ্ছেন সেই হাসিও হাসা সম্ভব না। তাহলে কি তিনি রুবার যাতনার উপর এমন মালমসলা ফালাইছেন এমন সিনেমাটিক রং-লেপা দিছেন যে, রুবার বেদনায় পুরুষ দর্শকের মনে সমবেদনার উদয় হতে না হতেই সেটা কৌতুক আর তরুণী নারীকে বিভিন্নভাবে দেখার আমোদে পরিণত হয়! আসেন তাহলে দেখি ফারুকী কি করছেন?
থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার-এ চারটি বিষয় তুলে আনার চেষ্টা আছে:
১. পুরুষতান্ত্রিক-পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর নিরাপত্তার প্রশ্ন।
২. আধুনিক সমাজে নারী-পুরুষ সম্পর্কের গোলযোগ ও টানাপোড়েন।
৩. মধ্যবিত্ত পুরুষ ও নারীর মনস্তাত্ত্বিক-চারিত্রিক পোষ্টমর্টেম।
৪. প্রচলিত মূল্যবোধের সাথে নতুন মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব।
ছবিতে শেষ পর্যন্ত যে তিনজনের সম্পর্ক জট পাকাতে ও বদলে যেতে দেখি, তারা হলো রুবা, মুন্না ও তপু। মুন্নার সঙ্গে রুবার ‘লিভ টুগেদার’ ছিল, কিন্তু সে এখন খুনের দায়ে জেলবাসী। তপু রুবার ছোটো বেলার বন্ধু, বিপদে পড়ে তার সহায়তা চায় রুবা। এই ছবিতে মূল চরিত্র রুবা একজন মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত তরুণী। তাকে ঘিরে ছবির ‘কাহিনী’ একটু একটু করে এগিয়েছে।
রুবার সংকটের শুরু মুন্নার জেলে যাওয়া থেকে। এর আগে রুবাকে শ্বশুরবাড়ীর রক্ষণশীলতার মাঝে ‘লিভ টুগেদার’ করা নিয়ে সমস্যাগ্রস্থ হতে হয়, মায়ের দ্বিতীয় বিবাহজাত দাম্পত্যকে সে মানতে পারে না, অথচ সে নিজে ‘লিভ টুগেদার’ করবার মতো সংস্কারহীন (তার এ স্ববিরোধের কথা মনে রাখা জরুরি।)। একাকী নারী হিসেবে প্রতিকূল পুরুষ-পরিবেষ্টিত জীবনে রুবা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। রুবা কোন ভয় পাওয়া, পুতুপুতু নারী নয়। ছবির শুরু থেকে আমরা তাকে দেখি একজন সাহসী ও চৌকষ নারী হিসেবে।
রাতে একা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া, থানায় পুলিশের জেরাকে বুদ্ধিমত্তা ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মোকাবেলা করা, চাকরির প্রয়োজনে কোন এক চাকুরীদাতা বিত্তশালীর বাগানবাড়িতে একাই চলে যাওয়া এবং তাকে মোকাবেলা করে পালিয়ে আসা; এসব তার সাহস ও শক্তির প্রমাণ। ছবির একটি বড় অংশ জুড়েই রুবাকে ক্রমাগত পুরুষের সুযোগসন্ধানী ফাঁদের সঙ্গে লড়াই চালাতে দেখা যায়। এবং সর্বত্রই অনায়াসে সে রক্ষা পায়। কিন্তু কীভাবে সে আত্মরক্ষা করে, তার ব্যাখ্যা মেলে না। এক কথায় তাকে চূড়ান্ত যৌন নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা হয়।
কেন রুবা বারবার বেঁচে যায়, কীসের গুণে কীসের জোরে?
পুলিশ-মাস্তান-বস-নারী লোভী কোটিপতি থেকে শুরু করে এই ছবির সব পুরুষই মোলায়েম ধরনের সুযোগসন্ধানী। রাতের পুরুষরা দলবেধে বা কখনো একা রুবার হাত ধরে টানাটানি করে, ধাওয়া করে। কিন্তু পরের শটে আকস্মিকভাবেই তারা কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। বাগানবাড়ী থেকে কোন কৌশলে রুবা পালায়, তা-ও এক রহস্য। এরকম অবস্থায়ই সীমা চৌধুরী বা ইয়াসমিনরা বাঁচেনি, বাঁধন লাঞ্ছিত হয়েছে, শিশু তানিয়া কিংবা সিমি-দের ‘আÍহত্যা’ করতে হয়েছে। এসবের ইঙ্গিত ছবিতেই আছে। তাহলে বিরাট ঝুঁকি নিয়েও রুবা কেন পার পাচ্ছে? কে তাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে? কেন বাঁচিয়ে দিচ্ছে? নাকি জীবনটা একটা গেম, যেখানে হার আছে কিন্তু সত্যিকার আঘাত নেই?
নাকি চলচ্চিত্র নির্মাতা দেখাতে চাইছেন যে, বাস্তবে নিপীড়ক পুরুষরা অতটা নিপীড়ক নয়Ñ অন্তত সব নারীর কাছে নয়। নাকি পুরুষরাই শেষ পর্যন্ত নারীদের বাঁচিয়ে দেয়? একদিকে চলচ্চিত্রকার দেখাচ্ছেন, পুরুষমাত্রই নারীলোভী ও সুযোগসন্ধানী হলেও কার্যত ‘অক্ষম’। এফডিসির ফিল্মে নায়ক নাজিল হয়ে নায়িকাকে বাঁচায়। এই ছবির সেই অদৃশ্য নায়ক কে? পরিচালক স্বয়ং এবং ‘জীবন নাটকের নাট্যকার’ স্ক্রিপ্ট লেখক সাহিত্যিক আনিসুল হক?
অথবা তাঁরা কি মাথায় রাখছিলেন যে রুবাকে ‘অক্ষত’ রাখা (সতী?) দরকার। যাতে অন্তত সব ধরনের দর্শকের কাছে ‘সতী’ হিসেবে রুবার গ্রহণযোগ্যতা অটুট থাকে। যাতে সব পুরুষই তাকে প্রেমিকার জায়গায় বসিয়ে ভাবতে পারে। রুবাকে সীমা বা ইয়াসমিন বা অন্য কোনো নারীর বাস্তবতায় নিয়ে গিয়ে ফেললে ছবিটি আর নিটোল থাকে না। তাতে করে কাহিনী যে সিরিয়াস দিকে মোড় নিতে পারে, তাতে মজা দেওয়ার উদ্দেশ্য একেবারে মাঠে মরবার কথা। চলচ্চিত্রে নির্মিত পুরুষ চরিত্রের পোষ্টমর্টেম শেষবিচারে পুরুষের ‘ইমেজ’কে রক্ষা করতে এবং নতুন গজিয়ে উঠা কর্পোরেট মধ্যবিত্তের নৈতিকতার ফাঁকিকে ঢাকতে সমর্থ হয়।
দুই জগতের টানাপড়েন: পুরান ঢাকা বনাম বসুন্ধরা সিটি
ছবির দুই জগতের একটি হলো পুরান ঢাকা থেকে মীরপুরের নিুমধ্যবিত্ত বসতি অন্যদিকে বসুন্ধরা সিটির মতো উচ্চমধ্যবিত্ত থেকে বিত্তবানদের আবাস। পুরান ঢাকার পরিবেশে সেখানকার পুরুষদের দমবন্ধ করা বাস্তবতার পাহারাদার করা হয়েছে। বিপরীতে ঢাকার গুলশান-বনানী-বসুন্ধরার জগতকে করা হয়েছে উদার, রোমান্টিক, সংগীতময় এবং বিলাসী এক ফ্যান্টাসিওয়ার্ল্ড। ফলত একই স্থান-কালে পৌঢ় বাড়ীওয়ালার (আবুল হায়াত) মতো নৈতিকতার টানাপোড়েন বিবর্জিত কামুক, মুন্নার মতো নৈতিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগা যুবক, মুন্নার বাবার মতো সামন্তীয় মেজাজের দাপুটে পুরুষদের আমরা প্রদর্শিত হতে দেখি। এসব থেকে ধারণা দেওয়া হয় যে, পুরনো ঢাকার সমাজ পিছিয়ে পড়া এবং এলাকাটি অরুচিকর ও ঘিঞ্জি।
একই বাস্তবতা থেকে উঠে আসা রুবাকে এই সমাজের কোন কিছুই যেন টানে না। ফলে ওই সমাজের সব কিছু থেকে বেরিয়ে আসাই যেন গোটা চলচ্চিত্রে রুবার ‘যুদ্ধ’_এমন ধারনা দর্শকের সামনে হাজির করা হয়। কিন্তু রুবা বা মুন্না নিজেদের মনের বা পকেটের জোরে পারে না। তাদের ধরতে হয় তপুর হাত, যে তপু উদার, ধনী, সৌখীন ও সরল। সে রাজধানীর আধুনিক উদীয়মান অংশের সদস্য। তারকা গায়ক তপু ও তার ঝলমল দুনিয়া দিয়ে এভাবে পুরান ঢাকা+রুবার পুরাতন প্রেমিক মুন্নার বিপরীতে চলে আসে নতুন ঢাকার নতুন প্রেমিক মুন্না। মুন্না অস্থির, কিন্তু তপু শান্ত। দামী গাড়ি, ল্যাপটপ, আইপড, স্টুডিও, দামী অ্যাপার্টমেন্ট, দামী ফার্নিচারসমেত তাকে আমরা চলচ্চিত্রে ‘হিরো’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে দেখি। কেবল টাকার জোরেই সে সব সমস্যা সমাধান করতে জানে। বাজার অর্থনীতির নিরিখে উত্তীর্ণ এক কর্পোরেট জগতের সফল পুরুষ সে। এমনকি রুবার প্রেমও তার টাকার জোরের কাছে ‘কৃতজ্ঞ’। শেষ পর্যন্ত তপুর মূল্যবোধই ছবিতে জয়ী হয় — যে জয় ‘আধুনিকতার, বিত্তের উদারতার, কর্পোরেট নৈতিকতার এবং দায়হীন বহুগামী যৌন সম্পর্কের। তপু পুরোনো মূল্যবোধের টানাপড়েন বিবর্জিত, অন্যের মূল্যবোধকে সে যেমন প্রশ্ন করে না, তেমনি জোর করা বা চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতাও তার নেই। সম্পর্ক নিয়ে সে ভাবনা-দুর্ভাবনার উর্দ্ধে। ‘ব্যাপার না, ব্যাপার না’ বলে হালকা চালে সব কিছু উড়িয়ে দেয়া, কোন ‘ইন্টারেস্ট’ নেই বলে যৌনাকাংখাকে চাপা রাখা, আবার খুবই হিসাব কষে পা ফেলা এবং যোগাযোগ ও টাকার জোরে সব ধরনের পরিস্থিতি সামাল দেয়া তার ‘যোগ্যতা’। মুন্নার যেমন এক মন আছে, আছে মূল্যবোধের কামড়ানি, আছে রাগ-ক্ষোভ-ভালবাসা ও ক্ষুদ্রতা, তেমন কোনো মনের খোঁজ তপুর বেলায় মেলে না। রুবা ক্রমাগত মুন্নার কাছ থেকে সরে যেতে যেতে মনে-দেহে হয়ে উঠে তপুর দুনিয়ার বাসিন্দা, তপুর দয়া/বন্ধুত্বের প্রশ্রয়েই। সেটাই ধরা পড়ে কক্সবাজার যাওয়া প্রসঙ্গে চলচ্চিত্রের শেষ দিকে রুবার সংলাপে, ‘আমি কি যাচ্ছি, তপু আমাকে নিয়ে যাচ্ছে’।
এভাবে ‘তপু’ চরিত্রের জয়গান করে তাকে, তার শ্রেণীটিকে সহজ-সুন্দর-সৌখীন জীবনের প্রতীক হিসেবে হাজির করার মাধ্যমে আসলে তপুর মতো কর্পোরেট দুনিয়ার ‘বীর’দের প্রতিষ্ঠা করা, যুব সমাজের মডেল হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টাই ‘থার্ড পারসন…’ করে। এতে করে নির্মাতা নিজে কোন সমাজ ও জীবনদর্শনের প্রতিনিধি ও মুখপাত্র তা প্রমাণ হয়।
নারী ছলনাময়ী আর তার প্রেম কেবল দেওয়া-নেওয়ার লীলা?
পুরুষের হাত থেকে বাঁচার জন্য পুরুষের কাছেই যেতে হয় নারীকে এটাই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বাস্তবতা। রুবাও সেই নিয়মে পা বাড়ায় কিন্তু চলচ্চিত্রের জোড়া দেওয়া একটা একটা সিক্যুয়েন্স দেখতে পাই: দিনে দিনে পুরুষকে ব্যবহার করাই রুবার চরিত্রের প্রধান দিক হয়ে উঠে। বাধ্য হয়ে একে-ওকে-তাকে কৌশলে কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত — একজন তারকা তরুণকে ব্যবহার করা এবং কৃতজ্ঞতা কিংবা অন্য কোনা অস্পষ্ট কারণে তার প্রতি এক ধরনের ভালবাসার বোধ তৈরী হয় রুবার। মোবাইল কোম্পানির তৈরি করা ফ্যান্টাসি ‘ডিজ্যুস’ দুনিয়ার পুরুষের প্রতিনিধি ‘তপু’র দেওয়া ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করে রুবা। আবার জেল ফেরত মুন্না যখন রুবার সথে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যাবার কথা বলে তখন রুবা জানায়, তাকে তাহলে এই ফ্লাট ছাড়তে হবে, একা পুরো ভাড়া দিতে পারবে না সে। মুন্নাও একটা পর্যায়ে প্রেমহীন নতুন সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে রুবাকে একসাথে থাকার প্রস্তাব দেয়, ভাড়া ভাগ করতে চায়। রুবা তাতে রাজি হয় ও মুন্নার ঘাড়ে মাথা রেখে কাঁদে ? এই কান্নার অর্থ কী? রুবা কি নতুন করে মুন্নাকে ফিরে পেল, নাকি তার নিরাপত্তার সমাধানে এটাও একটা ‘ডিল’? এইভাবে রুবার প্রেম-ভালোবাসার পুরাটাকেই কি দেনা-পাওনার ঝুড়িতে তুলে দেয়া হলো না?
তাহলে রুবা নামক এমন এক চরিত্রের নির্মাণ পরিচালক ফারুকি আর লেখক আনিসুল হকের হাতে হলো, যে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আগে থেকেই নির্মিত হয়ে ছিল — ‘সুবিধাবাদী নারী, পুরুষকে ছলনায় ভোলানো নারী’ আদম-হাওয়ার মিথের গন্ধম খাওয়ানো নারী। সারওয়ার ফারুকী সেই ধারনায় চটুল ভাবে সুড়সুড়ি দিলেন আবার নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল ‘হার্ট ফিল্ম’ বানিয়ে পুরস্কারও জিতলেন।
রুবা বা তপুদের কি মন নেই?
রুবার ‘লিভ টুগেদারের’ পার্টনার মুন্না জেল থেকে ছাড়া পাবার আগেই তার প্রতি রুবার প্রেম শুকিয়ে আসে। এর কারণ কি তপুর প্রতি ভালোবাসা, নাকি মুন্নার অবিশ্বাস, তা বোঝা যায় না। আবার দুজনকেও ভালবাসতে পারে না সে। তার তপুকে ভাল লাগার উৎস কি প্রেম না নির্ভরতা, নাকি নিছকই একাকী নারীর যৌনাকাঙ্খা? রাতে রুবা, তপু উভয়ই যখন দুজন দুজনার কাছে যেতে চায় তখন রুবার সামনে বাধা হয়ে আসে তার তের বছরের মন, যে মন তাকে নৈতিকভাবে বার বার বাধাগ্রস্থ করে, স্বামীর প্রতি সৎ থাকবার পরামর্শ দেয় এবং তাতে সে পিছিয়ে যায়। রুবা কি বহুগামী? এমন কোন ইঙ্গিত তো ছবিতে নেই বরং যা আছে তা হলো ‘কন্টিনিউ মনোগোমাস রিলেসনশিপে’ যেতে পারে অর্থাৎ একজনকে ছেড়ে অন্য এক জনের সাথে তার সম্পর্ক হতে পারে। তার নৈতিকতা তাকে অতোটুকুই অনুমোদন করছে বলে সে মুন্নাকেও আর নিতে পারছে না। কারণ সেটা প্রতারণা মনে হচ্ছে, আবার তপুকে গ্রহণ করবে করবে করেও করে না। তবু শেষ পর্যন্ত দুটো সম্পর্ককেই একসাথে জারি রাখে সে। সেটাও সেই নির্ভরতার যুক্তিতেই। রুবার যৌনতার আকাঙ্খার কথা আমরা জানি, তার নিরাপত্তার অভাবের কথা জানি, সৌখিনতায় গা ভাসানো দেখি। এই-ই কি রুবা? তার মনের অন্য কোনো দিক কি থাকতে নেই? কেবল মায়ের মৃত্যুর পর তার স্বপ্নে মা-কে নিয়ে তার হাহাকারে একজন সত্যিকার মানুষ হিসেবে তাকে পাওয়া যায়, এর বাইরে রুবা কোথায়?
নৈতিকতার টানাপড়েন থেকে কি সে বেরুতে পারলো? বেরুতে পারলো পুরুষের তৈরি করা ‘জেল’ থেকে? বরং শেষ পর্যন্তসম্পর্কের এমন স্তরে তাকে পৌছাতে দেখি, যেখানে মুন্না-তপু কারো সাথেই সে সম্পূর্ণ একাত্ম নয়। শেষ দৃশ্যে রুবা রয়ে যায় নিঃস্বঙ্গ। লেখার শুরুর দিকে রুবার যে ‘স্ববিরোধী চরিত্রে’র কথা বলছিলাম চলচ্চিত্রের শেষেও কিন্তু সেই একই স্ববিরোধে তাকে রাখা হলো।
‘অবৈধ’ প্রেমের আবহে ক্যামেরার চোখ-কান কোন পুরুষের?
রুবাকে প্রথম থেকেই হাজির করা হয় ‘শিকার’ ও ‘ভোগ্য’ হিসেবে। তার বিপন্নতা, তার একাকীত্ব, তার ভয়ের দৌড় ইত্যাদিকে ছাপিয়ে ওঠে তার তরুণী শরীরের আকর্ষণ। যাতে দর্শক তার বিপন্নতার মধ্যেও তার যৌনাবেদন এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে না পারে। এতেই শেষ হয় না; মধ্যরাতে ফ্লাইওভারের ওপর একা দাঁড় করিয়ে রাখা যাতে তাকে ‘পতিতার মতো’ ভাবা যায়, মধ্যরাতে থানায় পুলিশের ওসির কাছে তার যৌনজীবন নিয়ে কথা বলানোর মাঝখানে হঠাৎ ঘরে অন্ধকার নামিয়ে আনা, বাগানবাড়ীতে মাতাল পুরুষের সামনে বসানো, পুরান ঢাকার বাড়ীওয়ালার ‘রক্ষিতা’ হওয়ার প্রস্তাবে সাড়া দেওয়ার কৌশল করানো, নির্জন কাশবনের উঁচু ঘাসের মধ্যে দিয়ে তপুর সঙ্গে আরো ভেতরে চলে যাওয়া, তপুর অ্যাপার্টমেন্টে কিংবা ঢাকার বাইরে গেস্ট হাউসে থাকার পরিস্থিতি তৈরি করা। ছবির আহ্বান মানলে তখন দর্শককেও চলচ্চিত্রটির প্রতিটি পুরুষ চরিত্রের মতো হয়ে উঠতে হয় শিকারী-ভোক্তা। খেয়াল করুন; সব কিছু দিয়ে দর্শকের মনে উসকে দেয়া হচ্ছে এই কল্পনা: রুবার সম্ভাব্য যৌন নিপিড়িত হওয়া অথবা তার ও তপুর অচরিতার্থ কামকে তৃপ্ত করা। একটি ভায়োলেন্স অথবা একটি যৌনপ্রেমের আবহকে ঝুলিয়ে রেখে দর্শকের চিন্তা ও কল্পনার নাকে লাগাম লাগিয়ে ঘোরাতে পারাই এই ছবির বাণিজ্যিক সফলতার উৎস।
রুবা তপু-মুন্না দুজনকেই আশাহত করে বারবার। তাই তপু মুন্না উভয়ের প্রতি পক্ষপাত তৈরী হয় দর্শকের। কিন্তু রুবার প্রতি কি দর্শকের আদতে কোন বেদনার বোধ হয়? হয় না। রুবার পুতুল শরীরে মুন্নার তড়পানোতেও দর্শক হাসে। যে সব মুহূর্তে মনে হতে থাকে রুবা নিশ্চিতভাবেই একটি কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছে, তেমন অবস্থায়ও দর্শককে কষ্টের কান ঘেষে আমোদের হল্লা করার সুযোগ দেওয়া হয়। তপুকে বাসায় আসতে বলে রুবার উক্তি, ‘ঋণ পরিশোধ করতে চাই’। এই সময় হলের প্রায় সব দর্শক এক যোগে হাতে তালি দেয়, উত্তেজনায় শিষও দিতে থাকে। বার বার ‘ঋণ’ পরিশোধের কোন পথের ইঙ্গিত আনা হয় ছবিতে? ‘ঋণ পরিশোধ করতে চাই’-এর জবাবে তপু বলে, ‘আমি তো তোর কাছে কিছুই চাই না, কিন্তু ভালোবেসে যদি কিছু পাই’; কথার সঙ্গে তপুর খুশিতে ডগমগ আদন্তবিকশিত হাসি। এর পরপরই অনেকক্ষণ ধরে অহেতুক ঘুরে ঘুরে তপুকে কনডম কিনতে দেখা যায়, সেটা কিনে ছুটতে দেখা যায়। ব্যাকগ্রাউন্ডে চলে কুচকাওয়াজের বাজনা — তাহলে শরীরের দখল পাওয়ার যুদ্ধ এটা?
নারীকে বধ করার এই যৌন-ডামাডোল পর্দা ছাপিয়ে হলের আলো-অন্ধকারকেও মাতিয়ে তোলে। দর্শক তখন (অবশ্যই পুরুষ) আবারো শিস দেয়। হয়তো কেউ কেউ পরের দৃশ্য কল্পনা করতে শুরু করে। যে রুবার শরীরের নড়াচড়াকে এতক্ষণ ক্যামেরার চোখ লোভাতুর ভাবে দেখিয়েছে, সেই শরীরকে কল্পনা করার জন্য দর্শককে উস্কানো হয়। ঝিলের সামনে বসে তপুর অস্থিরতা, এর আগে রুবার উচাটন, তপুকে বাসায় ডাকার অর্থ দর্শকের কাছে ‘ইশারায় কাছে ডাকা’ ছাড়া আর কী হতে পারে? এই পুরো সিকোয়েন্সে রুবার প্রতি তপুর মনোভাবের রগরগে যৌনরসাত্মক দৃশ্যায়ন কিন্তু কী সুন্দর ‘স্লীলতার’ মোড়কে মোড়া!
ক্যামেরার এঙ্গেল গুলো মনে হয় বহিরাগত পর্যবেক্ষকের: হাই, ভীষন লো, ফলো শট, ভিষণ টেলি ইত্যাদি। যে রুবা ফিল্মের প্রথম অর্ধেকে এমন এক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যায় সেখানে তার মনের অবস্থা বোঝানোয় তেমন কোন পয়েন্ট অফ ভিউ শট আমরা দেখি না। প্রথম অর্ধেকের পর রুবাকে (একজন প্রায় নিম্নবিত্ত্ব নারীকে) নিয়ে ফেলা হয় কর্পোরেট চাকুরী, ঝকমকে ফ্লাটের চার দেয়ালের মাঝে। তার প্রথম জীবন যদি রিয়েল হয় এটা তবে আনরিয়েল। কিংবা যেন এক ‘রিয়েল’ জীবন থেকে ‘আনরিয়েল’ ফ্যান্টাসির জীবনে এসে পড়ে সে। কিন্তু এই অবাস্তব জীবনকে বাস্তব মনে করাতে-বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সিনেমাটোগ্রাফিতে ‘পর্যবেক্ষক’ সুলভ দৃশ্যায়নের ভঙ্গি খুবই কার্যকর হয়। ‘ভিস্যুয়াল প্রেজেন্টেশন’, শট নির্বাচন, ছবির ন্যারেটিভ-মিউজিক প্রতি মূহুর্তে টের পাইয়ে দেয় একটা পুরুষ মন-মস্তিস্ক-চোখ রুবাকে দেখছে _দেখাচ্ছে। ঘটনা যেভাবে ঘটে, তাতে রুবা পুরুষকে বাইরের প্রাপ্তি-অপ্রাাপ্তি দিয়ে হিসাব করে মুচকি হাসে, নপুংসক বলে এবং আমরা ‘ভিস্যুয়ালি’ তাকে ওভাবেই প্রদর্শিত হতে দেখি। পুরুষের কামোত্তজিত দশা বেঝাতে মিউজিকের ব্যাবহার দর্শককেও রুবার প্রতি যৌনভাবে উদ্দীপ্ত করে। যে দর্শক এই ছবি দেখে হাসে, শিষ দেয়, বাংলা ছবির সেই দর্শকের প্রতি অনেকের বিরাগ রয়েছে। সুশীল দর্শক ও সংবাদপত্রের মানদণ্ডে যে দর্শক রুচিহীন, বিকারগ্রস্থ ও অস্লীলতার পূজারি, সেই দর্শকের এহেন অবস্থার কারণ কি শুধুমাত্র দর্শক নিজে? সারওয়ার ফারুকীর মতো মধ্যবিত্তীয় নির্মাতারা বড় গলায় রুচিশীল ছবির কথা বলে আসলে কর্পোরেট রুচির জীবন ও পুরুষতান্ত্রিক যৌনতা নির্ভর চলচ্চিত্রই নির্মান করছেন। ‘হার্ট’ ফিল্মের নামে আসলে হৃদয়হীন-সমাজহীন এক জীবনকে মহিমান্বিত করে ‘হৃদয়হীন’ দর্শক সৃষ্টির কারখানা বসিয়েছেন। তাঁর ছবিগুলো তাই ‘পুরুষের ফ্যান্টাসি’ হয়ে ধরা দেয়।
স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন
সম্পর্ক নিয়ে টানাপড়েন এখানে প্রায় সকল শ্রেণীর মধ্যে তৈরী হয়ে গেছে। প্রেমে, দাম্পত্যে, যৌনতায় আরো স্বাধীনতা আরো মুক্ততার চাপা দাবি তৈরি হয়েছে। বহুগামিতা কোনো নতুন বিষয় না, একগামী সম্পর্কের অনুশীলন বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ও বাইরে জারি রয়েছে। বিয়ের বাইরে একসাথে থাকা_যাকে পাশ্চাত্যের মধ্যবিত্ত কেতায় নাম দিয়েছি, ‘লিভ টুগেদার’_ বলা বাহুল্য সেরকম সম্পর্ক উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। শ্রেণীগত অবস্থানের ওপর তার প্রকাশ বা লুকিয়ে-ছাপিয়ে রাখা অনেকটুকু নির্ভর করে। তবে সামাজিক ভাবে সবাই স্বীকৃতি দাবি করতে বা আদায়ে সক্ষম হয়নি বলে বিষয়গুলো নিয়ে খোলসা করে বলার চাপ সমাজে বিদ্যমান। সারওয়ার ফারুকী এ ব্যাপারে গুমোট ভাব কাটানোয় ভুমিকা নিয়েছেন, তাতে তাঁকে বাহবা দিতেই হয়। তবে এই বলতে গিয়ে তিনি যে নারী চরিত্র দাঁড় করিয়েছেন ‘থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার’-এ তাতে আপাতভাবে একটি প্রগতিশীল সমাধানে পৌছাচ্ছি মনে হলেও শেষ পর্যন্ত কর্পোরেট নৈতিকতায়, সতীত্বের নিগড়ে, প্রেমহীন-ভাবনাহীন দেনা-পাওনার সম্পর্কে, ‘ভোগ্যা’ হিসেবেই রুবার রূপান্তর ঘটেছে। এই রূপান্তরই মার্কিন কায়দার ‘যৌন-বিপ্লব’, নারীকে পণ্য করার বাজার এবং কালচার-ব্যবসা চায়। যৌনতাকে নারীর সামগ্রিক অস্তিত্বের অংশ না করে, কেবলই মোহ বা ভোগ আকারে দেখা ও দেখানোর যে ডিজুস দুনিয়া, সেই দুনিয়ায় সাধারণ নিম্নবিত্ত রুবার উত্তরণ (নাকি পতন?) ঘটে এই ছবিতে। এই স্বপ্নই আজকের মধ্যবিত্ত ঘরের তরুণ-তরুণীকে দেখানো হচ্ছে। এটা হয়তো সারওয়ার ফারুকী ও তাঁর ভাই-বেরাদরদেরও স্বপ্ন। তারই সার্থক রূপায়ন ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’। নারী এই ছবিতে আর ‘আমি’ হয়ে ওঠে না, হয়ে থাকে ‘সে’ — থার্ড পারসন এবং সিঙ্গুলার নাম্বার।
আমরা এসেছিলাম দলে দলে,
অযুত অযুত মাইল দুর থেকে।
এসেছিলাম ল্যাম্পপোষ্টের ঝুলন্ত আলোয়,
ইতিহাস আর পূর্বনারী-পুরুষের আত্মার খোঁজে।
