১. আজকের বিশ্বে ধর্মবিশ্বাস আর আইডেন্টিটি আবার একাকার হওয়া শুরু করেছে মনে হয়। সনাতন সব নীতি ও মূল্যবোধ যখন বিশ্বায়িত পুঁজি, প্রযুক্তি আর জীবিকার সংগ্রামের কাছে পরাজিত হয়ে ভেসে যাচ্ছে, তখন ধর্মকেও এর আদলে বদলে যেতে হয়। পশ্চিমা দুনিয়ায় খ্রীস্টধর্ম অনেক আগেই এই চাপে বদলে গেছে। রিফর্মেশন-এনলাইটেনমেন্ট-এর যুগে। ট্রিনিটি-তে ঈমান থাক বা না থাক, শ্বেতবরণ নীলচক্ষু যীশু এবং তার পিতা ঈশ্বরকে তারা ছাড়ে নাই আত্মপরিচয়ের ঠেকা আছে বলে। ধর্মবোধ এখানে আত্মপরিচয়ের মধ্যে দ্বান্দিকভাবে মিলে গেছে। ঊনিশ শতকের শেষ দিকে বিকশিত হওয়া ভারতীয় জাতীয়তাবাদগুলোর সমস্যাও ছিল এটা। এখনো কম্যুনিটি বা জাত আর জাতীয়তা আমাদর চোখে একাকার।
২. ভারতে বিজেপি বা জার্মান নাৎসিরাও কিন্তু ক্যাথলিসিজম ও আর্যবাদের মিশ্রণে ফ্যাসিবাদের আদর্শিক ভিত্তি নির্মাণ করছিল। শিল্পায়ন ও তার ভিতের ওপর দাঁড়ানো সামরিক সক্ষমতা তাদের অভিলাষী করেছিল। আমেরিকায় বা ইউরোপের বাকি অংশে এটা এখনো কঠিন। তিনশ বছরের মানবতাবাদী সংগ্রাম, শ্রেণী সংগ্রাম ও পুরুষতন্ত্র ও বর্ণবাদবিরোধী ঐতিহ্য। ভারতেও একইসঙ্গে উপমহাদেশের সবচে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক চেতনা আছে, আবার এই ভারতই এখন ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণার শক্ত আশ্রয়। ইসলাম বাংলাদেশে মেইনস্ট্রিমে নাই, ভারত-পাকিস্তানে আছে।
৩. পশ্চিমা এলিট এমনকি গরিবদেরও আত্মপরিচয় নিয়ে সংকট এখনো জাগে নাই। সেখানকার গরিব ও কালো মানুষটিও সভ্য দুনিয়ার অহংকার আর ক্রাইস্টের ছত্রছায়া অনুভব করে জাতগর্ব উপভোগ করে। এই মনের জোর বাদবাকি বিশ্বে নাই তাদের মাজার জোর কম থাকার জন্য। । ফলে তাদের হয় জাতি বা ধর্মের কাছে ফিরতে হয় অথবা এসব ছেড়ে কাল্পনিক বিশ্বজনীনতার নামে সাদা-জুডিও-খ্রিস্টান-সাম্রাজ্যের মাস্তুলে লটকে থাকার নিয়তি নিতে হয়। তারা ইতিহাস-ভূগোল ও সংস্কৃতি থেকে বিতারিত বা পরিত্যক্ত হয়। আমাদের সুশীল সেকুলারদের বড় অংশই এই পথ ধরেছেন। মধ্যবিত্তের ‘আধুনিক’ অংশ কর্পোরেট পুঁজি ও তার বাজারের মধ্যে এতই আত্তীকৃত হয়ে গেছে যে, এদের কোনো প্রতিবাদ করার মতাই নাই। এরা বরং দেশ ছেড়ে যাবে অথবা দেশে মার্কিন বাহিনীকে স্বাগত জানাবে। এ অংশটির সুবিধাবাদীতাই তাদের ধর্মীয় বা সেকুলার পথে সংগ্রামী হতে বাধা দেবে।
৪. অন্যদিকে জামাতি ইসলাম বা ব্রাদারহুডের মতো যারা তারাও এক প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া ইসলামকে বিকশিত করছে। এদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ভিশন এটা প্রমাণ করে। এরা মোটাদাগে পরাশক্তি ও দেশীয় শাসকদের সঙ্গে কোলাবরেশন করে ক্ষমতা বাড়ায়। এমনকি আমিনী গংও কিন্তু এখানকার বিত্তবানদের মধ্যেই পড়ে। আর অন্য একদল আছে রাজনীতিতে যারা কৃষক-সামন্ত ইসলামের প্রতিভূ। এরা অবক্ষয়শীল আবার চরম শোষিত। প্রায়শই এরা কোনো গোপন বা প্রকাশ্য খুঁটি এমনকি আইএসআই-র-সিআইএ-মোসাদ এদের হাতিয়ার হয়, জেনে না জেনে। আবার এদের শ্রেণী থেকেই কিন্তু ভারতে মাওবাদীরা আসছে। বাংলাদেশে শ্রেণীসংগ্রাম তীব্র হলে এই শ্রেণীর একটা লড়াকু ভূমিকা পাওয়া যাবে। জেএমবি যারা গঠন করে তারা এদের এই প্রবণতাকেই এক্সপ্লয়েট করে এবং ধ্বংস করে।
কার্যত অধিকাংশ মাদ্রাসা ছাত্র মানবতের জীবন-যাপন করে। সবকিছু থেকে বঞ্চনার পর ধর্ম ছাড়া তাদের আর কিছু থাকে না। তারওপর তাদের একটা গহ্বরের মধ্যে আমরাই তো আটকে থাকতে দিয়েছি। তাদের সুপ্ত শ্রেণীক্রোধ বিকৃতপথে জেহাদের মধ্যে ভাষা খুঁজে পায়। এইটুকু না থাকলে তারা নিজেকে মানুষই বলে গণ্য করতে পারতো না। মানুষ হওয়ার পর তারা দেখে কিছুই তাদের নয়। তখন যা কিছু তাদের নয়, তাকে তারা ঘৃণা করতে শেখে। তাই তাদের বিপক্ষে চালনা করা কারো কারো জন্য সম্ভব হয়।
৫. বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইসলামের প্রধান ধারাটি মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত নির্ভর। জামাতের বেশিরভাগও অ-মাদ্রাসায় শিক্ষিত। এরা সুবিধাবাদী ও সংস্কারবাদী। তাদের মধ্যপন্থায় নিজেদের মতো মডার্নিটি সৃষ্টি করতে চায়। বিশ্বায়ন পরবর্তী আত্মপরিচয় সংকটও এদের ইসলামের দিকে ঝুঁকিয়েছে। ধর্মের বৈষয়িক ভিত সরে যাওয়ায় রাজনীতির মাধ্যমেই সে আবার নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। রাজনীতি ছাড়া তা সম্ভবও নয়। এটা সকল ধর্মের বেলাতেই কমবেশি সত্য।
৬.এদেশের লোককে ধর্মভীরু বলে আসলে কী বোঝানো হয়? তাহলে তো শরিয়াই কায়েম হতো। এই বলাটাও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার। ধর্মভীরু জনগণ কার্টুন বা ভাস্কর্য নিয়ে মাতে নাই। এটা যারা বলে তারা একদিকে মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে তোয়াজ করে ধর্মের ভয় দেখিয়ে নিজেদের কোনো কার্যসিদ্ধি চায়। বরং নিম্নবর্গের ধর্মচর্চা অপ্রাতিষ্ঠানিক ও খোলামেলা হওয়ায় তা মানবিক সংস্কৃতিতে বাধ সাধে না। উচ্চবর্গ জ্ঞান, বিত্ত, অবস্থান সবকিছুকেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক পুঁজি বানিয়ে নিজেদের ক্ষমতায়ন ঘটায়। ধর্ম তাদের বাহন। উভয়ের ধর্মবোধ আপাতভাবে মিললেও বাস্তব মতাদর্শিক সংগ্রাম জারি থাকলে তার মধ্যে ভেদ আনা সম্ভব।
৭. সত্তর আর আশির দশকে ইসলামের দুটো সংস্করণ হয় : মৌলবাদী আর লোকায়ত। আবার তাদের প্রয়োজনেই আজকে তা ইসলামো-ফ্যাসিস্ট আর মডারেট ধারায় বিভাজিত। সবই তাদের লীলা। অথচ বিশ্বের একমাত্র আত্মস্বীকৃত ধর্মরাষ্ট্র ইসরাইলকে বর্ণবাদী ও ফ্যাসিস্ট বলা যাবে না। তাকে রার বুশীয় দাপট, তার প্রতি পাশ্চাত্য সিভিল সমাজের বড় অংশের সমর্থন কোনো সাম্প্রদায়িকতা নয়? হলিউডি সিনেমায় অজস্র ক্রুশের ব্যবহার থেকে শুরু করে মার্কিন সমাজে পাদ্রীদের প্রাধান্য কখনোও বিবেচিত হবে না রক্ষণশীলতা বলে। বুশ বা গোর বা ওবামার মুখে ‘দুনিয়ায় ঈশ্বরের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব’ কথা এলেও তাদের সেকুলারিজমের সতীত্ব যায় না। বৈশ্বিক পোপতন্ত্রকে বলা যাবে না প্রতিক্রিয়াশীলতার দুর্গ। (ভাগ্যিস মুসলিমরা এরকম কোনো বৈশ্বিক ধর্মতাত্ত্বিক ঘাঁটি এখনও বানাতে সম হয়নি। তাহলে তাদের যাত্রা আরো দূর অস্তই হতো কেবল) আর হিজবুল্লাহর মতো জাতীয়তাবাদী, দেশপ্রেমিক দলকে বলা হবে ধর্মীয় সন্ত্রাসী। আমাদের বিবেক হিজবুল্লাহ বা হামাসের প্রতিরোধে সামিল হতে চায়, কিন্তু চিন্তা বলে, ‘ও তো মৌলবাদী’। ঔপনিবেশিক ঠুলি পড়া চোখে আমরা কেবল তাদের দাড়ি বা টুপিই দেখি। যে সেক্যুলার বাস্তব জাতীয় সংগ্রামের মাটিতে তাদের পা পোঁতা সে জমিনে আমাদের নজর পড়ে না। লেবাননি প্রতিরোধ ধর্মীয় জেহাদ নয়, তা জাতীয় প্রতিরোধ। যদিও এ ফেকড়া তুলেই পশ্চিমা মিডিয়া ঔপনিবেশিক শিয়া শিতিদের প্রতিবাদস্পৃহাকে আধুনিকতার আংটা দিয়ে লটকে রাখে শূণ্যে। জনগণের ফরিয়াদকে যদি আমরা ধর্মের জিম্মায় রেখেই খুশি থাকি, তবে জনগণ ‘মৌলবাদের’ দলে গেলে আমাদের আপত্তি থাকবে কেন? জনগণের দায়িত্ব কী চেতনায় আর কী আমলে আমরা নিচ্ছি?
৮. বৈশ্বিক মিডিয়া-এনজিও ও ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরায়েলি-ভারতীয় মিডিয়া মিলে ইসলাম> নিরাময় অযোগ্য অসুখ> জঙ্গও> জনসংখ্যা সমস্যা> প্রগতি ও গণতন্ত্রের বাধা = বিশ্বসমস্যা; এরকম এক সমীকরণ প্রচারের মাধ্যমে অনেকটুকু প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। সেই কার্য যেভাবে কারণ জন্ম দেয় সেভাবে এদের ইন্ধনে যেমন আল কায়েদা-তালেবান তৈরি হয়েছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে হুজি-জেমমবি-লস্কর ইত্যাদি। এভাবে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোকে অস্থির, হীনম্মন্য, আত্মদ্বন্দ্বে দীর্ণ এবং কাবু রাখার ফাঁদ সক্রিয় আছে। এর বিপরীতে আরেক জিঘাংসার রস চোঁয়াতে দেখি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। আরবের প্রতিরোধ দেখিয়ে বঙ্গীয় প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম, তথা শরিয়াবাদীদের উত্থানকে মজলুমের উত্থান বলে চালাবার চেষ্টাও দেখি। বুঝি যে, একাত্তরের প্রত্যাঘাতের জমিন তৈরি চলছে।
৯. ইসলাম নামক জুজুর ভয় যে প্রায়শই তা ইহুদী-বিদ্বেষের মতো জায়গায় চলে যায়, তা নিয়ে হুশিয়ার হওয়া দরকার। বুশের ডকট্রিন বা ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন তত্ত্বের দিন শেষ হয়নি। সেকারণেই ইরাক-আফগানিস্তান-সোমালিয়া-গুয়ানতানামো প্রভৃতির মধ্যে মুসলিম হলোকস্টের পদধ্বনি কিন্তু শোনা যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে এখনই সচেতন না হলে রমা রঁল্যারা যে ফাঁদে পড়েছিলেন সেই ফাঁদে আমাদেরও পড়তে হবে।
১০. মুসলিম দেশগুলো আসলে সাবেক উপনিবেশিত এবং বর্তমানে নয়া উপনিবেশবাদের প্রত্যক্ষ শিকার বা দখলাধীন দেশ। এদের শাসকরা দুনিয়ার নিকৃষ্ট গোছের (জাতীয়তাবাদী তুরস্ক-ইরান বা মিসরের নাসের এরকম কিছু ব্যতিক্রম বাদে)। এদেও সমাজে শিল্পায়ন ও ভূমিসংস্কার এবং সার্বজনীন সেকুলার শিক্ষা না আসার সব কুফলই প্রায় পেকে গেছে। এখানে বাইরে থেকে আঘাত করলে সংগ্রামের রক্ত বরং পুঁজ হয়ে বেরুবে। একদিকে ভেতরের সাংস্কৃতিক সামাজিক সংগ্রাম অন্যদিকে রাজনীতিতে কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্ত-আদিবাসী-নারী জনসমষ্ঠির জাতীয় সংগ্রাম প্রয়োজন। দরকার বিউপনিবেশন আর রাজনীতিতে বিকেন্দ্রীকৃত সংগ্রামী ক্ষমতার গঠন।
*** কোনো ধর্মই তার নিজের গুণে বা গ্রন্থের জোরে বলবান এই বিশ্বাসও একধরনের অলৌকিকতায় বিশ্বাস। বরং তা সমাজ-ইতিহাস-স্বার্থ ও মনোজগতের জটিল বিন্যাসে সক্রিয় থাকে। বাস্তবের ভাল-মন্দ প্রয়োজনই তা মেটায়। তাই ধর্মীয় জগতের সমালোচনাকে শেষপর্যন্ত বাস্তবজগতের সমালোচনা হিসেবে দাঁড় করাবার প্রয়োজন থেকেই যায়। এবং ঐ বাস্তবের মধ্যেই খুঁজতে হয় তার শেকড়বাকর; বেদ-কোরান-পুরান-টেস্টামেন্টের পাতায় বা কোনো বিশ্বাসীর মনের জটিল গুহায় অভিযান চালাবার পথ অনেকসময়ই সর্পকে রজ্জু আর রজ্জুকে সর্প ভ্রমে গিয়ে দাঁড়ায় কিংবা আপন লেজ গিলবার মতো বিপদে গিয়ে শেষ হয়।
*লিখতে গিয়েছিলাম মন্তব্য হয়ে গেল এই জিনিস।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৫ comments
সুদীপ্ত শর্মা - ২৩ অক্টোবর ২০০৯ (১:৩৪ অপরাহ্ণ)
অসাধারণ বিশ্লেষণ। মানুষের প্রতিটি আচরণের পিছনেই আসলে তার পারিপার্শ্বিক সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অবস্থাগুলো খুব শক্তিশালীভাবে কাজ করে। এগুলার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু দুঃখজনক হলো আমরা প্রায় সময়ই তাৎক্ষণিক আচরণের ভিত্তিতে মানুষকে বিচার করি; কষ্ট পাই, উত্তেজিত হই। কিন্তু পিছনের কারণগুলা জানা থাকলে এসব থেকে মুক্তি পাওয়ার পাশাপাশি নিজের কর্মপন্থা নির্ধারণ করাও সহজ হয়ে যায়।
আপনাকে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
মিলন দত্ত - ২৫ অক্টোবর ২০০৯ (৭:০৫ অপরাহ্ণ)
সবই তো বোঝা গেল। কিন্তু গণ্ডগোলটা ইসলামের ভিতরেই রয়েছে কিনা একবার খতিয়ে দেখা দরকার নয় কি? বিশ্বের আধুনিকতম ধর্মের মানুষ যে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সে দেশের অধিকাংশেই চরম পশ্চাদপদতা। প্রায় কোনও মুসলিম দেশে গণতন্ত্র নেই। যেখানে আছে, সেখানেও গণতন্ত্র বারবার বিপন্ন হয়ে পড়ে। ধর্মের বাঁধন এতই কঠোর যে নারী-পুরুষ নিবির্শেষে বহিরঙ্গের আবরণে-আভরণে তাকে ইসলাম লটকে নিয়ে বেড়াতে হয়। কেন মানুষ ধর্মের চিহ্ন শরীরে নিয়ে ঘুরবে? প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বা কেন ধর্মাচারণের প্রাতিষ্ঠানিক ঠাঁই গড়া হবে? এত সব প্রশ্ন এড়িয়ে মুসলমানের মন, সমাজ, অবস্থান বিশ্লেষণ করা যাবে না। আধুনিক মনে ইসলামের নির্দেশগুলোর মূল্যায়ণ ছাড়া এ আলোচনা চলবে কি করে?
যেমন, ভারতীয় সমাজের জাতপাত ভিত্তিক বিভাজন কিংবা নারীর অবস্থা হিন্দু ধর্মকে এড়িয়ে বোঝা সম্ভব নয়। হিন্দু ধর্ম তথা মনুর নির্দেশাবলীর পরতে পরতে যে অন্ধকার, তাকে জানতেই হবে। এবং মানতেও হবে।
আসুন ফারুকভাই! আমরা আরও একটু খোলামেলো হই।
ফারুক ওয়াসিফ - ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৬:৫৫ অপরাহ্ণ)
ভূত যখন থাকে তখন তো তা শর্ষের ভেতরেই ঢুকে বসে থাকে।:)
প্রতিটি ধর্মতন্ত্র ইতিহাস, দর্শন আর বিধিনিষেধের সমষ্ঠি। একই কথা আধুনিক সব রাষ্ট্রদর্শনের বেলায় বা সব কিছুর বেলায়ই প্রযোজ্য। সে হিসেবে গণ্ডগোল তো খ্রীষ্টীয়, হিন্দু, ইহুদী সব ধর্মেই রয়েছে। বিশ্বের অনেক রাজনৈতিক চরমপনা, গণহত্যা, নির্যাতনের দাগ প্রধান পাচটি ধর্মের গায়ে লেগে থাকলেও একটিকে আলাদা করে অভিযুক্ত করাটাই তো একধরনের অজ্ঞানতা ও বিদ্বেষ। একই কথা প্রায় সব রাজনৈতিক মতবাদেই রয়েছে।
মুসলিম দেশগুলোতে মধ্যযুগে আরব-পারস্য-স্পেনের মুসলিম সাম্রাজ্য তো অনেক উতকর্ষ দেখিয়েছে, রুশদ সেকুলারিজমের কথা বলতেন, মোঘল সাম্রাজ্য সেকুলার ছিল। তাহলে আপনার যুক্তিমতে ইসলামকে মহান করে দেখাব? মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে গণতন্ত্র নাই, ইসলামতন্ত্রও নাই। এসব দেশ যারা শাসন করছে তারা কারা? সৌদি, পাকিস্তানী বা কুয়েত-কাতারের শাসকরা কতটা ইসলামী আর কতটা রাজতন্ত্রী লুটেরা? এরা চলে সাম্রাজ্যবাদের হাতে গড়া দেশীয় এলিট, যারা চালিত হয় দূতাবাসের মাধ্যমে, বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থে। উপনেবিশক শাসন-লুন্ঠনে এসব দেশে মাথা তুলতে পারেনি, যেমনটা পারেনি বেশিরভাগ আফ্রিকান ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো। তাহলে কি বলবো, ঐসব কালো ও বাদামী মানুষগুলোর ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে গণ্ডগোল আছে?
গণ্ডগোল ভেতর বাহির দুদিক থেকেই আসছে, এবঙ তার উতস ধর্ম নয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবঙ তার চরিত্র ধর্মীয় নয় পুজিবাদী।
ভারত আমেরিকা ও ইসরায়েলের কথাও মাথায় রাখতে হবে। তিনটি দেশেই রাজনীতিতে ধর্ম ও বর্ণবাদ প্রবল। ভারতে ধর্মস্থানের সংখ্যা পচিশ লক্ষ আর স্কুলের সংখ্যা ১৫ লাখ। ভারতের চল্লিশ কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমা তলায় বাস করে, বিরাট অঞ্চলে জাতিগত শোষণ রয়েছে, ভারতে বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রেকর্ড বিশ্বের মধ্যে বেশি। পরিবারতন্ত্র আছে, আছে সেনাখাতে সেরা ব্যয়, আছে প্রতিবেশীদের ওপর দাদাগিরি-হস্তক্ষেপের দীর্ঘ ইতিহাস সমৃদ্ধ ভোটের গণতন্ত্র। পুজিবাদের মাধ্যমে এখানে সাবেকি বর্ণপ্রথা নবায়িত হয়েছে। আমেরিকা ও ইসরায়েল তো স্বনামধন্য। কেবল ইহুদীদের রাষ্ট্র হয়েও ইসরায়েলকে কেন বর্ণবাদী মৌলবাদী বলা হবে না?
ধর্মগুলো যেহেতু আলাদা আলাদা স্থান-কাল-পাত্রে হাজির হয়েছে এবং আলাদা আলাদা সংস্কৃতির অঙ্গ সেহেতু তুলনা করায় নতুন গণ্ডগোলই কেবল সৃষ্টি হবে। ধর্মকে শিখণ্ডী করে দাড়ানো রাজনৈতিক শক্তি আর গণতন্ত্র-সেকুলারিজম-আধুনিকতার ধ্বজা ধারণ করা সাম্রাজ্যিক শক্তি উভয়ই সেটা করে দেখাচ্ছে।
রাস্তা-ঘাটে তো চলেন, কতজনকে আপনি দেখেন ইসলাম লটকে নিয়ে চলতে? গত নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয়, তাহলে তো ইসলাম লটকে বেড়ানো-গোষ্ঠীই তো শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়েছে? ধর্মের বাড়াবাড়ি যারা করে তারা এখনো মুষ্ঠিমেয়। পাকিস্তান আমলে তারা আরো কম ছিল। আজ তাহলে এই বাড়াবাড়ি কার মদদে বাড়লো? এসব প্রশ্নের উত্তর না করে ঢালাও মন্তব্য করায় সত্য মিলবে না।
পৃথিবীতে বিশ্বায়ন ও সাম্রাজ্য বিস্তারের সমান্তরালে সকল ধর্মই আবার জনজীবনে প্রভাব বাড়াচ্ছে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানী খ্রীষ্টান পরিচয়কে রাজনীতিতে সংস্কৃতিতে পাবলিক স্পেসে বেশি করে ঢোকানো হচ্ছে। ভারত-পাকিস্তান নিয়ে সম্প্রতি উইলিয়াম ডালরিম্পল দারুণ একটি নিবন্ধ লিখেছেন, তাতে তিনি বলছেন,
As India is liberalising and globalising its economy, the country is experiencing a rising tide of popular Hinduism which is leaving no social segment and no public institution untouched. There is a surge in popular religiosity among the burgeoning and largely Hindu middle classes, as is evident from a boom in pilgrimage and the invention of new, more ostentatious rituals. This religiosity is being cultivated by the emerging state-temple-corporate complex that is replacing the more secular public institutions of the Nehruvian era . . . a new Hindu religiosity is getting more deeply embedded in everyday life, in both the private and public spheres.
India now has 2.5 million places of worship, but only 1.5 million schools and barely 75,000 hospitals. Pilgrimages account for more than 50 per cent of all package tours, the bigger pilgrimage sites now vying with the Taj Mahal for the most visited sites in the country: the Balaji Temple in Tirupati had 23 million visitors in 2008, while over 17 million trekked to the mountain shrine of Vaishno Devi.
In a 2007 survey jointly conducted by the Hindustan Times and the CNN-IBN news channel, 30 per cent of Indians said they had become more religious in the past five years. Such is the appetite for rituals in this newly religious middle class that there has recently been a severe shortfall of English- and Sanskrit-speaking priests with the qualifications to perform Vedic and Agamic rites. When it comes to rituals in the new India, demand has completely outstripped supply….dramatic increase in state funding for yagnas (fire sacrifices), yoga camps and temple tourism, as well as the sharp increase in state donation of land for temples, ashrams and training schools for temple priests. In Rajasthan, the government annually spends 260 million rupees on temple renovations and training for Hindu priests. Mass pujas (prayers) and public yagnas have become an important part of political campaigning for all parties, not just the overtly Hindu Bharatiya Janata Party (BJP).
Spiritual awakening
বিজেপি-আরএসএস-এর সদস্যদের মধ্যে মধ্যবিত্ত বেশি এবঙ তাদের সংখ্যা কোটি কোটি, জনসংখ্যার অনুপাতেও তা বাংলাদেশের ইসলামওয়ালাদের তুলনায় আনুপাতিক হিসেবে অনেক বেশি। সেখানে একদিকে জাকির নায়েক আরেকদিকে শ্রী রবিশঙ্কর পাল্রা দিয়ে বকে যাচ্ছেন। তার ভক্ত সংখ্যা দুই কোটি। এমনকি মওদুদীবাদ যেমন নতুন ইসলাম সৃষ্টি করতে চায়, বিজেপিরাও বহুকেন্দ্রিক হিন্দু সংস্কৃতিকে ইসলামের আদলে এক গ্রন্থ (রামায়ন), এক দেবতা (রাম), অভিন্ন রেজিমেন্টেড হিন্দু সংস্কৃতি নির্মাণ করছে যা হবে পুজিবাদ মুক্তবাজারের সঙ্গে মানানসই।
যাহোক, আমি বলতে চেয়েছি, আজকের ধর্মান্দোলন অতীতের মতোই সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণের ফল। তাই আবারো উপসংহারটা উধ্ধৃত করি,
তাই ইসলাম বা হিন্দু ধর্মের গোড়ায় গণ্ডগোল না খুজে যে বাস্তব গন্ডগোলের সঙক্রমণ এসব ধর্মের মধ্যে দিয়ে ঘটছে সেদিকে দৃষ্টি ফেলা তাই জরুরি। তাহলেও কেবল উল্টো করে দেখা বাস্তবতাকে সোজা করা সম্ভব।
তানবীরা - ৪ নভেম্বর ২০০৯ (৫:৫০ পূর্বাহ্ণ)
মাঝে মাঝে এরকম মন্তব্য লিখতে যেও ফারুক। তাহলে আমরা যারা বিশ্লেষনধর্মী লেখা পড়তে ভালোবাসি তাদের জন্য আরাম হবে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইসলামের প্রধান ধারাটি মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত নির্ভর। এটা বোধ হয় শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়েই। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির (অপ) ব্যবহার কিংবা প্রায়োগিক ব্যবহার শুধু দরিদ্র দেশগুলোতেই বিরাজ করে। যার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরন ভারত হতে পারে। ধনী আর দরিদ্রের ব্যবধানটা এতো বেশি যে সাম্প্রদায়িক শক্তি ফুয়েল পেলেই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
অবিশ্রুত - ৪ নভেম্বর ২০০৯ (৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ)
ঠিক ধরতে পারলাম না। রাজনৈতিক অর্থে নেই, না কি সাংস্কৃতিক অর্থে নেই? সে ক্ষেত্রে ভারত বা পাকিস্তানে কোন অর্থে আছে? বাংলাদেশের সংবিধানে বিসমিল্লাহ থাকবে কি থাকবে না, এত বড় ইস্যু মাথাচাড়া দেয়ার পরও কী করে সায় দেই যে, ইসলাম বাংলাদেশে মেইনস্ট্রিমে নেই!
এ ব্যাপারটিও ঠিক স্পষ্ট বুঝতে পারছি না।
বেশ কয়েক বছর ধরে সেখানে যে-হারে খ্রিস্টানের সংখ্যা কমছে, তাতে দেখা দরকার, কেন খ্রিস্টানরা অভিবাসনের পথ বেছে নিচ্ছে এবং এই অভিবাসনের রাজনৈতিক প্রকৃতি কি। বাংলাদেশেও হিন্দু অভিবাসনের প্রক্রিয়াকে ধামাচাপা দিয়ে রেখে আমরা ‘হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই’ আত্মতৃপ্তিতে ভুগতাম, এখনও ভুগি। হয়তো লেবাননের মতো দূর থেকেও কেউ কেউ চিন্তা করে, বাংলাদেশের জামায়াত ও হিযবুত তাহরীরের প্রতিরোধ ধর্মীয় রাজনীতি নয়, জেহাদ নয়, জাতীয় প্রতিরোধ!