নাফিস অপরাধী নাকি নির্দোষ, তা এই প্রবন্ধের বিষয় নয়, আদালতেই তা নির্ধারিত হবে। আমি একটু ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি। একটা প্রশ্ন বরাবরই আমাকে উদ্বিগ্ন করে। কেন এই সব তরুণ যুবকরা কেন সন্ত্রাসবাদের পথ বেছে নিচ্ছে, কখনোবা হয়ে উঠছে আত্মঘাতী? ঘটনা তো একটা দুটো নয়, সারা বিশ্ব জুড়েই ঘটে চলেছে শত শত। আমেরিকায় ২০০১ সালে ৯/১১ এর তাণ্ডবলীলা শেষ হতে না হতেই ২০০৫ সালে লন্ডনের পাতাল রেলে ঘটেছিল ৭/৭ এর ঘটনা। নাফিসের তরুণ বয়স দেখে অনেকে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। [...]

[ডিসক্লেইমার – নাফিস নামটি প্রবন্ধে বেশ কয়েকবার ব্যবহৃত হলেও তিনি এ প্রবন্ধের মূল বিষয় নন। নাফিসকে অপরাধী ভেবে না নিয়ে পুরো বিষয়টিকে অর্থাৎ উগ্র বিশ্বাসের উৎসের ব্যবচ্ছেদ করাই হবে এই প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য। নাফিস যদি আমেরিকার আদালতে নিজেকে নিরপরাধী প্রমাণ করে বেড়িয়ে আসতে পারেন, তবে তার চেয়ে সুখকর বিষয় আমার জন্য, আমাদের জন্য আর কিছুই হতে পারে না। এটি ঘটলে সবচেয়ে খুশি হব আমিই।  আমেরিকায় অবস্থিত প্রবাসী বাঙালিরাও শঙ্কামুক্ত হতে পারবেন।

নাফিস নয়, বরং নাফিস, করিম, সাবেত, অনিরুদ্ধ যেই হোক না কেন, তরুণদের বিশ্বাস-নির্ভরতা কীভাবে এবং কেন উগ্রবাদী রূপ নিয়ে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা তৈরি করে, কিংবা করতে পারে, সেটা বিশ্লেষণ করাই এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। নাফিসের ঘটনাটি ঘটার পর পরই এ বিষয়ে এ কটি ব্লগ লেখার চিন্তা করলেও পরে বিবিধ কারণে বিলম্ব ঘটে।  নির্মাণ ব্লগে অনেকদিন ধরেই কিছু লেখা হয় না, এ চিন্তা থেকেই লেখাটা এখানে দেয়া।  লেখাটির কিছু উদাহরণঅবিশ্বাসের দর্শনবইটি থেকে নেয়া।]


 

কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস নামে এক একুশ বছরের এক যুবক যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গ্রেফতার হয়েছেন – এটি  গত সপ্তাহগুলোতে পত্র-পত্রিকার আলোচিত খবর ছিল। নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও এফবিআই। অনেক মিডিয়ায় আবার এও বলা হয়েছে যে ২০০১ সালে ৯/১১ এর ঘটনার পর এটাই নাকি আমেরিকায় সবচেয়ে বড় ‘টেরোরিস্ট প্লট’। আমাদের জন্য এটি উদ্বেগের, কারণ এই প্লটের মূল উদ্যোক্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে একজন বাংলাদেশীকে। সন্দেহভাজনের তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠে আসায় নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে আমেরিকায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে।

রেজওয়ানুল আহসান নাফিস

নাফিসের এই ঘটনা অবশ্য বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সারা বিশ্ব জুড়েই নানা ধরনের সন্ত্রাসবাদ, আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং ‘সুইসাইড টেরোরিজম’এর মাধ্যমে নির্বিচারে হত্যা এবং আতংক তৈরি ধর্মীয় উগ্রপন্থী দলগুলোর জন্য খুব জনপ্রিয় একটা পদ্ধতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর  আল-কায়দার ১৯ জন সন্ত্রাসী চারটি যাত্রীবাহী বিমান দখল করে নেয়। তারপর বিমানগুলো কব্জা করে আমেরিকার বৃহৎ দুটি স্থাপনার ওপর ভয়াবহ হামলা চালানো হয়েছিল। নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার এবং ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর বা পেন্টাগনে ঐ হামলা চালানো হয়। প্রায় তিন হাজার মানুষ সেই হামলায় মৃত্যুবরণ করে। আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী হামলা ছিলো এটি। এই হামলার পেছনে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং  অর্থনৈতিক কারণ থাকলেও এটি অনস্বীকার্য যে এর পেছনে সবচেয়ে বড় মদদ আসলে বিশ্বাস নির্ভর ধর্মীয় উগ্রতা।  এতদিন পর্যন্ত এ ধরণের হামলায় আরবিয় কিংবা পাকিস্তানীদের নাম শোনা গেলেও বাংলাদেশী অভিবাসীরা সন্দেহের বাইরেই ছিল। নাফিসের এই ঘটনা সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রে  অবস্থানরত বাংলাদেশীদের হালহকিকত পাল্টে দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নাফিস অপরাধী নাকি নির্দোষ, তা  এই প্রবন্ধের বিষয় নয়,  আদালতেই তা নির্ধারিত হবে।  আমি একটু ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি। একটা প্রশ্ন বরাবরই আমাকে উদ্বিগ্ন করে। কেন  এই সব তরুণ যুবকরা কেন সন্ত্রাসবাদের পথ বেছে নিচ্ছে, কখনোবা হয়ে উঠছে আত্মঘাতী? ঘটনা তো একটা দুটো নয়, সারা বিশ্ব জুড়েই ঘটে চলেছে শত শত। আমেরিকায় ২০০১ সালে ৯/১১ এর তাণ্ডবলীলা শেষ হতে না হতেই  ২০০৫ সালে লন্ডনের পাতাল রেলে ঘটেছিল ৭/৭ এর ঘটনা। নাফিসের তরুণ বয়স দেখে অনেকে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। হ্যা বয়স একটা ফ্যাক্টর, কিন্তু আমরা ভুলে যাই, লন্ডনের পাতাল রেলে বিস্ফোরণের সাথে জড়িত আত্মঘাতী চার তরুণের সবার বয়সই ছিল ত্রিশের কম। সর্বকনিষ্ঠ হাসিব হুসাইন ছিলেন মাত্র ১৮ বছরের তরুণ। আর শুধু আমেরিকা বা লন্ডনই বা বলি কেন, বাংলাদেশেই কি আমরা খালেদা-নিজামী জামানায় বাংলা ভাইয়ের তাণ্ডব দেখিনি? দেখিনি ইসলামের নামে দেশের প্রতিটি জেলায় বোমাবাজি, কিংবা রমনা বটমূলে কিংবা সিনেমা হল গুলোর মত ‘বেশরিয়তী’ জায়গাগুলোর উপর আগ্রাসন? দেখিনি চট্টগ্রাম আদালতে আত্মঘাতী বোমার তাণ্ডবে জগন্নাথ পাঁড়ের মৃত্যু?  দেখিনি পত্রিকার পাতায় ঘাতকাহত হুমায়ুন আজাদের রক্তাক্ত ছবি? এগুলোর ভিত্তি কি? ২০০৫ সালের পর শুধু মুম্বাইয়েই সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে অন্তত: দশটি, যেগুলোর সাথে ইসলামী সন্ত্রাসবাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে বলে মনে করা হয়। এর আগে আমরা রাম-জন্মভূমিকে ইস্যু করে উগ্র হিন্দুত্ব-বাদীদের সন্ত্রাস, বাবরি মসজিদ ধ্বংস কিংবা গুজরাটে দাঙ্গা ও দেখেছি আমরা। এগুলোরই বা কারণ কি? এ ধরণের ঘটনা ঘটলেই খুব জোড়ে সোরে একটি কারণকে সামনে নিয়ে আসা হয় –  বিদ্যমান সামাজিক অনাচার।  ২০০১ সালে সেপ্টেম্বর ১১ এর রক্তাক্ত ঘটনার পর পরই নোম চমস্কি বলেছিলেন, ‘আমেরিকা নিজেই এক সন্ত্রাসী রাষ্ট্র, যার কর্মকাণ্ডই নাইন-ইলেভেনকে নিজের উপর টেনে এনেছে’[1] । তবে সব বিশ্লেষকই যে চমস্কির ঢালাও মন্তব্যের সাথে একমত হয়েছেন তা নয়। যেমন, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের  অধ্যাপক ব্রুস লিঙ্কন  তার ‘Holy Terrors, Thinking About Religion After September 11’ গ্রন্থে পরিষ্কার করেই বলেছেন[2]  –

‘ধর্মের কারণেই আতা এবং তাদের অন্যান্য সহযোগীরা মনে করেছে এ ধরনের আক্রমণ শুধু নৈতিক নয়, সেই সাথে পবিত্র দায়িত্ব’।

আতা নিজেও নিজেও তার সুটকেসে কোরান বহন করছিলো। ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধারকৃত আতার কাছে থেকে পাওয়া তার  শেষ নির্দেশাবলীগুলোও সেই সাক্ষ্যই দেয়, যে তারা পবিত্র আল্লাহ এবং ইসলামের প্রেরণাতেই এই জিহাদে অংশ নিয়েছিলো। সেই নির্দেশাবলীতে আতা খুব গুরুত্ব দিয়েই বলেছিলো –  কিভাবে আল্লাহর নামে যাত্রা শুরু করতে হবে, কিভাবে অস্ত্র তৈরি রাখতে হবে, কিভাবে নিজের দেহকে কোরানের আয়াত দিয়ে আশীর্বাদ-ধন্য করে নিতে হবে, কিভাবে ঘটনা ঘটানোর সময় সুরা পাঠ করে যেতে হবে ইত্যাদি[3]।

‘পবিত্র’ ধর্মগ্রন্থগুলোর প্রভাব সাধারণ মানুষদের কাছে ব্যাপক, এমনকি এই আধুনিক সমাজেও।  সেজন্যই প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোর অমানবিক আয়াত কিংবা শ্লোকগুলো সন্ত্রাস এবং সহিংসতাকে উস্কে দিতে পারে।  সহিংসতার সাথে যে ধর্মের বাণীর অনেক সময়ই সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকে তা ব্যাখ্যা জ্যাক নেলসন প্যালমেয়ার দিয়েছেন তার ‘ইজ রিলিজিয়ন কিলিং আস?’ গ্রন্থে [4]। তিনি বলেন,

সহিংসতা ব্যাপারটা ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য কারণ, পবিত্র বাণীগুলোতে এর অনুমোদন পাওয়া যায়, এবং সহিংস সমাজগুলোতে এগুলোকে যৌক্তিক বলে মনে করা হয়।

একই ধরনের কথা বলেছেন মুক্তচিন্তক স্যাম হ্যারিস তার নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার ‘End of Faith’  গ্রন্থে[5]।  তিনি তার বইয়ে দেখিয়েছেন, অতিমাত্রায় মধ্যযুগীয় বিশ্বাস নির্ভরতার কারণেই সন্ত্রাস আর জিহাদ এখনো করাল গ্রাসের মত থাবা বসিয়ে আছে আমাদের সমাজে।

বিশ্বাস নির্ভর সন্ত্রাসবাদ এত ব্যাপক আকারে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পরার পেছনে কোন নৃতাত্ত্বিক, মনস্তাত্ত্বিক কিংবা জৈববৈজ্ঞানিক কারণ আছে কিনা তা খুঁজে দেখা আসলেই এখন জরুরী মনে করি। আমি একবছর আগে ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ নামে একটা বই লিখেছিলাম সহলেখক রায়হান আবীরের সাথে মিলে[6]।  বইটির ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ অধ্যায়ে সামাজিক জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটি আলোচনা করেছিলাম। আলোচনাটি এখানেও প্রাসঙ্গিক মনে করছি।

এটা অস্বীকার করার জো নেই – ‘বিশ্বাসের’ একটা প্রভাব সবসময়ই সমাজে বিদ্যমান ছিলো।  না হলে এই বিংশ শতাব্দীতে এসেও প্রাচীন ধর্মগুলো স্রেফ মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে এভাবে টিকে থাকে কিভাবে? এখানেই হয়ত সামাজিক বিবর্তনবাদের তত্ত্বগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এটা মনে করা ভুল হবে না যে, ‘বিশ্বাস’ ব্যাপারটা মানব জাতির বেঁচে থাকার পেছনে হয়তো কোন বাড়তি উপাদান যোগ করেছিল একটা সময়।   মানুষ আদিকাল থেকে বহু সংঘাত, মারামারি এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গিয়ে আজ এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। একটা সময় সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করাটা ছিল মানব জাতির টিকে থাকার ক্ষেত্রে অনেক বড় নিয়ামক। যে গোত্রে বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিতে পারা গিয়েছিল যে যোদ্ধারা সাহসের সাথে যুদ্ধ করে মারা গেলে পরলোকে গিয়ে পাবে অফুরন্ত সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, হুর পরী উদ্ভিন্নযৌবনা চিরকুমারী অপ্সরা, (আর বেঁচে থাকলে তো আছেই সাহসী যোদ্ধার বিশাল সম্মান আর পুরস্কার) – তারা হয়ত অনেক সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছে এবং নিজেদের এই ‘যুদ্ধংদেহী জিন’ পরবর্তী প্রজন্মে বিস্তৃত করতে সহায়তা করেছে। সাইটে রিচার্ড ডকিন্সের একটি চমৎকার প্রবন্ধ আছে ‘ধর্মের উপযোগিতা’  নামে । প্রবন্ধটিতে  অধ্যাপক ডকিন্স একজন বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্বাসের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন[7]।

অধ্যাপক ডকিন্সের লেখাটি থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা যাক। মানব সভ্যতাকে অনেকে শিশুদের মানসজগতের সাথে তুলনা করেন। শিশুদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই একটা সময় পর্যন্ত অভিভাবকদের সমস্ত কথা নির্দ্বিধায় মেনে চলতে হয় -এ আমরা জানি। ধরা যাক একটা শিশু চুলায় হাত দিতে গেল, ওমনি তার মা বলে উঠল – চুলায় হাত দেয় না – ওটা গরম! শিশুটা সেটা শুনে আর হাত দিল না, বরং সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিলো। মার কথা শুনতে হবে – এই বিশ্বাস পরম্পরায় আমরা বহন করি – নইলে যে আমরা টিকে থাকতে পারবো না, পারতাম না। এখন কথা হচ্ছে – সেই ভাল মা-ই যখন অসংখ্য ভাল উপদেশের পাশাপাশি আবার কিছু মন্দ বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন উপদেশও দেয় – ‘শনিবার ছাগল বলি না দিলে অমঙ্গল হবে’, কিংবা ‘রসগোল্লা খেয়ে অংক পরীক্ষা দিতে যেও না’ গেলে ‘গোল্লা পাবে’ জাতীয় – তখন শিশুর পক্ষে সম্ভব হয় না সেই মন্দ বিশ্বাসকে অন্য দশটা বিশ্বাস কিংবা ভাল উপদেশ থেকে আলাদা করার। সেই মন্দ-বিশ্বাসও বংশপরম্পরায় সে বহন করতে থাকে অবলীলায়। সব বিশ্বাস খারাপ নয়, কিন্তু অসংখ্য মন্দ বিশ্বাস হয়ত অনেক সময় জন্ম দেয় ‘বিশ্বাসের ভাইরাসের’। এগুলো একটা সময় প্রগতিকে থামাতে চায়, সভ্যতাকে ধ্বংস করে। যেমন, ডাইনী পোড়ানো, সতীদাহ, বিধর্মী এবং কাফেরদের প্রতি ঘৃণা,  মুরতাদদের হত্যা এগুলোর কথা বলা যায়।

বিশ্বাসের ভাইরাস

‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ ব্যাপারটা এই সুযোগে আর একটু পরিষ্কার করে নেয়া যাক। একটা মজার উদাহরণ দেই ড্যানিয়েল ডেনেটের সাম্প্রতিক ‘ব্রেকিং দ্য স্পেল’  বইটি থেকে[8]। আপনি নিশ্চয়ই ঘাসের ঝোপে কিংবা পাথরের উপরে কোন কোন পিপড়াকে দেখেছেন – সারাদিন ধরে ঘাসের নীচ থেকে ঘাসের গা বেয়ে কিংবা পাথরের গা বেয়ে উপরে উঠে যায়, তারপর আবার ঝুপ করে পড়ে যায় নিচে, তারপর আবারো গা বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে – এই বেআক্কেলে কলুর বলদের মত পণ্ডশ্রম করে পিপড়াটি কি এমন বাড়তি উপযোগিতা পাচ্ছে, যে এই অভ্যাসটা টিকে আছে? কোন বাড়তি উপযোগিতা না পেলে সারাদিন ধরে সে এই অর্থহীন কাজ করে সময় এবং শক্তি ব্যয় করার তো কোন মানে হয় না।  আসলে সত্যি বলতে কি – এই কাজের মাধ্যমে পিপড়াটি বাড়তি কোন উপযোগিতা তো পাচ্ছেই না, বরং ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উলটো। গবেষণায় দেখা গেছে পিপড়ার মগজে  থাকা ল্যাংসেট ফ্লুক নামে এক ধরনের প্যারাসাইট এর জন্য দায়ী। এই প্যারাসাইট বংশবৃদ্ধি করতে পারে শুধুমাত্র তখনই যখন কোন গরু বা ছাগল একে ঘাসের সাথে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। ফলে প্যারাসাইট টা নিরাপদে সেই গরুর পেটে গিয়ে বংশবৃদ্ধি করতে পারে। পুরো ব্যাপারটাই এখন জলের মত পরিষ্কার – যাতে পিপড়াটা কোন ভাবে গরুর পেটে ঢুকতে পারে সেই দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ঘাস বেয়ে তার উঠা নামা। আসলে ঘাস বেয়ে উঠা নামা পিঁপড়ের জন্য কোন উপকার করছে না বরং ল্যাংসেট ফ্লুক কাজ করছে এক ধরনের ভাইরাস হিসবে – যার ফলশ্রুতিতে পিঁপড়ে বুঝে হোক, না বুঝে তার দ্বারা অজান্তেই চালিত হচ্ছে।

ল্যাংসেট ফ্লুক
চিত্র: ল্যাংসেট ফ্লুক  নামের প্যারাসাইটের কারণে পিঁপড়ের মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়ে পড়ে, তখন পিঁপড়ে কেবল চোখ বন্ধ করে পাথরের গা বেয়ে উঠা নামা করে। ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোও কি মানুষের জন্য একেকটি প্যারাসাইট?

এ ধরণের আরো কিছু উদাহরণ জীববিজ্ঞান থেকে হাজির করা যায়। নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম  (বৈজ্ঞানিক নাম Spinochordodes tellinii) নামে এক ফিতাকৃমি সদৃশ প্যারাসাইট আছে যা ঘাস ফড়িং-এর মস্তিষ্ককে সংক্রমিত করে ফেললে ঘাস ফড়িং পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। এর ফলশ্রুতিতে নেমাটোমর্ফ হেয়ার-ওয়ার্মের প্রজননে সুবিধা হয়। অর্থাৎ নিজের প্রজননগত সুবিধা  পেতে নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম  বেচারা ঘাস ফড়িংকে আত্মহত্যায় পরিচালিত করে[9]। এ ছাড়া জলাতঙ্ক রোগের সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। পাগলা কুকুর কামড়ালে আর উপযুক্ত চিকিৎসা না পেলে জলাতঙ্ক রোগের জীবাণু মস্তিষ্ক অধিকার করে ফেলে। ফলে আক্রান্ত মস্তিষ্কের আচরণও পাগলা কুকুরের মতোই হয়ে উঠে। আক্রান্ত ব্যক্তি অপরকেও কামড়াতে যায়।  অর্থাৎ, ভাইরাসের সংক্রমণে মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।

আমাদের দীর্ঘদিনের জমে থাকা প্রথাগত বিশ্বাসের ‘ভাইরাসগুলোও‘ কি আমাদের সময় সময় এভাবে আমাদের অজান্তেই বিপথে চালিত করে না কি? আমরা আমাদের বিশ্বাস রক্ষার জন্য প্রাণ দেই, বিধর্মীদের হত্যা করি, টুইন টাওয়ারের উপর হামলে পড়ি, সতী নারীদের পুড়িয়ে আত্মতৃপ্তি পাই, বেগানা মেয়েদের পাত্থর মারি …।  মনোবিজ্ঞানী ডেরেল রে তার   ‘The God Virus: How religion infects our lives and culture’ বইয়ে বলেন, জলাতঙ্কের জীবাণু দেহের ভিতরে ঢুকলে যেমন মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বিকল হয়ে যায়, ঠিক তেমনি ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোও মানুষের চিন্তা চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তৈরি হয় ভাইরাস আক্রান্ত মননের।

নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম  যেমনি ভাবে ঘাস ফড়িংকে আত্মহত্যায় পরিচালিত করে, ঠিক তেমনি আমরা মনে করি ধর্মের বিভিন্ন বাণী এবং জিহাদি শিক্ষা মানব সমাজে অনেকসময়ই ভাইরাস কিংবা প্যারাসাইটের মত সংক্রমণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী করে তুলে। ফলে আক্রান্ত সন্ত্রাসী মনন বিমান নিয়ে আছড়ে পড়ে টুইন টাওয়ারের উপর।  নাইন ইলেভেনের বিমান হামলায় উনিশ জন ভাইরাস আক্রান্ত মনন ‘ঈশ্বরের কাজ করছি ‘ এই প্যারাসাইটিক ধারণা মাথায় নিয়ে হত্যা করেছিলো প্রায় তিন হাজার জন সাধারণ মানুষকে। ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর অধ্যাপক ব্রুস লিংকন, তার বই “হলি টেররস: থিংকিং এবাউট রিলিজিয়ন আফটার সেপ্টেম্বর ইলেভেন” বইয়ে বিষয়টির উপর আলোকপাত করে বলেন, “ধর্মই, মুহাম্মদ আত্তা সহ আঠারজনকে প্ররোচিত করেছিল এই বলে যে, সংগঠিত বিশাল হত্যাযজ্ঞ শুধুমাত্র তাদের কর্তব্য নয়, বরং স্বর্গ থেকে আগত পবিত্র দায়িত্ব”[10]। হিন্দু মৌলবাবাদীরাও একসময় ভারতে  রাম-জন্মভূমি অতিকথনের ভাইরাস বুকে লালন করে ধ্বংস করেছে শতাব্দী প্রাচীন বাবরি মসজিদ। বিগত শতকের আশির দশকে মাইকেল ব্রে নামের কুখ্যাত এক খ্রিস্টান সন্ত্রাসী ওয়াশিংটন ডিসি, মেরিল্যান্ড এবং ভার্জিনিয়ার গর্ভপাত ক্লিনিকগুলোতে উপর বোমা হামলার পর বাইবেলের বানীকে রক্ষাকবচ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন আদালতে। এধরণের অসংখ্য দৃষ্টান্ত ইতিহাস থেকে হাজির করা যাবে, ভাইরাস আক্রান্ত মনন কিভাবে কারণ হয়েছিল সভ্যতা ধ্বংসের।

নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম - সুইসাইদ বোম্বার অফ নাইন ইলেভেন
চিত্র: বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম  নামে এক প্যারাসাইটের সংক্রমণে ঘাস ফড়িং পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে (বামে), ঠিক একইভাবে বিশ্বাসের ভাইরাসের সংক্রমণে আক্রান্ত আল-কায়দার ১৯ জন সন্ত্রাসী যাত্রীবাহী বিমান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো টুইন টাওয়ারের উপর ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর (ডানে)। বিশ্বাসের ভাইরাসের বাস্তব উদাহরণ।

১১ই সেপ্টেম্বরের সেই ঐতিহাসিক ঘটনার পরে অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স ফ্রি এনকোয়েরি পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘Design for a Faith-Based Missile’ নামে। তিনি সেই প্রবন্ধে আত্মঘাতী সন্ত্রাসীদের বিশ্বাস নির্ভর (ভাইরাসাক্রান্ত) মিসাইল  হিসেবে অভিহিত করে লেখেন[11] –

কোন সন্দেহ নেই যে, পরকাল-আবিষ্ট আত্মঘাতী মস্তিষ্ক আসলেই একটি বিপজ্জনক অস্ত্র এবং সমূহ বিপদের কারণ। এটি তীক্ষ মিসাইলের সাথে তুলনীয়, এবং বহু ক্ষেত্রে এর পথনির্দেশ-ব্যবস্থা  সেই সব পরিশীলিত অত্যাধুনিক এবং ব্যয়বহুল ইলেকট্রনিক ব্রেনের চেয়েও প্রকৃষ্ট। তারপরেও নৈরাশ্যবাদী সরকার, সংগঠন, এবং মোল্লাতন্ত্রের জন্য খুবই খুবই সস্তা।

সাম্প্রতিক সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে আবারো ফিরে তাকাই। অনেকেই বলেন, ইসলামী সন্ত্রাসবাদ লালন পালনে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার বিশাল অবদান আছে। এ কথা নিঃসন্দেহে সত্য। যেমন, বুশের রাজত্বকালে আমেরিকার ইরাক আক্রমণের ব্যাপারটা কেউ ভুলে যায়নি। জনবিধ্বংসী যুদ্ধাস্ত্র না পাওয়া কিংবা সাদ্দামের সাথে আল-কায়েদার কোন সম্পর্ক না খুঁজে পাওয়া কিংবা জৈব-যুদ্ধাস্ত্র না পাওয়া সত্ত্বেও নির্লজ্জ ভাবে ইরাকের উপর যে আগ্রাসন চালিয়েছে তা শুধু যে আমেরিকার চীরচেনা সাম্রাজ্যবাদী চেহারাটাকেই স্পষ্ট করে তুলেছিল তা নয়, ইসলামী বিশ্ব এই আগ্রাসনকে যে কোন কারণেই হোক ‘ইসলামের উপর আঘাত’ হিসেবে নিয়েছে। সেজন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সে সমস্ত দেশেই ইসলামী আত্মঘাতী বোমা হামলার মাত্রাটা বেশী ছিল যে দেশের সরকার ইরাক যুদ্ধে বুশ-ব্লেয়ারকে নগ্ন-ভাবে সমর্থন করেছে সেসময়। প্যালেস্টাইনীদের বঞ্চিত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলকে নগ্নভাবে সমর্থন করেছে তাও মুসলিম সমাজকে সংঘাতের পথে ঠেলে দিয়েছে। এই রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া আর প্রতিহিংসার ব্যাপারগুলো ভুলে গেলে কোন আলোচনাই কখনও সম্পূর্ণ হতে পারে না। কিন্তু তারপরেও কেবল আমেরিকার দিকে অঙ্গুলি তুলে ধর্মগ্রন্থগুলোকে কখনোই ‘ধোয়া তুলসীপাতা’ বানানো যায় না। ধর্মগ্রন্থের যে অংশগুলোতে জিহাদের কথা আছে, উদ্ভিন্নযৌবনা হুরীদের কথা আছে, ‘মুক্তা সদৃশ’ গেলমান দের কথা আছে সে সমস্ত ‘পবিত্র বাণী’গুলো ছোটবেলা থেকে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে কিংবা বছরের পর বছর সৌদি পেট্রোডলারে গড়ে ওঠা মাদ্রাসা নামক আগাছার চাষ করে  বিভিন্ন দেশে তরুণ সমাজের কিছু অংশের মধ্যে এক ধরণের ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ তৈরি  করা হয়েছে; ফলে এই ভাইরাস আক্রান্ত জিহাদিরা স্বর্গের ৭২ টা হুর-পরীর আশায় নিজের বুকে বোমা বেঁধে আত্মাহুতি দিতেও আজ দ্বিধা-বোধ করে না; ইহুদি, কাফের নাসারাদের  হত্যা করে ‘শহীদ’ হতে তারা কার্পণ্যবোধ করে না।  ল্যাংসেট ফ্লুক  প্যারাসাইটের মত তাদের মনও কেবল একটি বিশ্বাস দিয়ে চালিত –  অমুসলিম কাফেরদের হত্যা করে সারা পৃথিবীতে ইসলাম কায়েম করতে হবে, আর পরকালে পেতে হবে আল্লাহর কাছ থেকে উদ্ভিন্নযৌবনা আয়তলোচনা হুর-পরীর লোভনীয় পুরস্কার। তারা ওই ভাইরাস আক্রান্ত পিঁপড়ে কিংবা ঘাস ফড়িং-এর মত  হামলে পড়ছে  কখনো টুইন টাওয়ারে, কখনো  রমনার বটমূলে, ভারতের তাজ হোটেলে, লন্ডনের পাতাল রেলস্টেশনে, কিংবা নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ভবনে।

হিন্দু মৌলবাবাদীদের বাবরি মসজিদ ধ্বংস
চিত্র: হিন্দু মৌলবাবাদীরা একসময় ভারতে  রাম-জন্মভূমি মিথ ভাইরাস বুকে লালন করে ধ্বংস করেছে শতাব্দী প্রাচীন বাবরি মসজিদ।

কিভাবে বিশ্বাসের ক্ষতিকর ভাইরাসগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চালিত হয়, তা বৈজ্ঞানিকভাবে বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে আধুনিক মিম তত্ত্বকে। মিম নামের পরিভাষাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স ১৯৭৬ সালে, তার বিখ্যাত বই ‘দ্য সেলফিশ জিন’-এ[12]-।  আমরা তো জিন-এর কথা ইদানীং অহরহ শুনি।  জিন হচ্ছে মিউটেশন, পুনর্বিন্যাস ও শরীরবৃত্তিক কাজের জন্য আমাদের ক্রোমোজোমের ক্ষুদ্রতম অবিভাজ্য একক।  সহজ কথায়,  জিন জিনিসটা হচ্ছে শারীরবৃত্তীয় তথ্যের অখণ্ড একক  যা বংশগতিয় তথ্যকে এক প্রজন্ম  থেকে পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দেয়।  জিন যেমন আমাদের শরীরবৃত্তীয় তথ্য বংশ পরম্পরায় বহন করে, ঠিক তেমনি সাংস্কৃতিক তথ্য বংশপরম্পরায় বহন করে নিয়ে যায় ‘মিম’।  কাজেই ‘মিম’ হচ্ছে আমাদের ‘সাংস্কৃতিক তথ্যের একক’, যা ক্রমিক অনুকরণ বা প্রতিলিপির মধ্যমে একজনের মন থেকে মনান্তরে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক যেভাবে শারীরবৃত্তীয় তথ্যের একক জিন  ছড়িয়ে পড়ে এক শরীর থেকে অন্য শরীরে। যে ব্যক্তি মিমটি বহন করে তাদের মিমটির ‘হোস্ট’ বা বাহক বলা যায়। ‘মেমেপ্লেক্স’ হল একসাথে বাহকের মনে অবস্থানকারী পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত একদল ‘মিম’ । কোন বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাস,  রীতি-নীতি, কোন দেশীয় সাংস্কৃতিক বা কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ -এগুলো সবই মেমেপ্লেক্সের উদাহরণ।  সুসান ব্ল্যাকমোর তার ‘মিম মেশিন’  বইয়ে মেমেপ্লেক্সের অনেক আকর্ষণীয় উদাহরণ হাজির করেছেন।  সুসান ব্ল্যাকমোর মনে করেন জিন এবং মিমের সুগ্রন্থিত সংশ্লেষই মানুষের আচার ব্যবহার, পরার্থপরায়ণতা, যুদ্ধংদেহী মনোভাব, রীতি-নীতি কিংবা কুসংস্কারের অস্তিত্বকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে।

ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে ভাইরাস এবং মেমপ্লেক্স এর সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া বই
চিত্র: সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু গবেষক, বিজ্ঞানী এবং লেখক উগ্র ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে ‘ভাইরাস’ এবং ‘মেমপ্লেক্স’ এর সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছেন।

কোন সাংস্কৃতিক উপাদান  কিংবা কোন বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাস কিভাবে মিমের মাধ্যমে জনপুঞ্জে  ছড়িয়ে পড়ে? মানুষের মস্তিষ্ক এক্ষেত্রে আসলে কাজ করে কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার যেভাবে কাজ করে অনেকটা সেরকমভাবে।  আর মিমগুলো হচ্ছে  কম্পিউটারের হার্ডওয়্যারের মধ্যে ইন্সটল সফটওয়্যার যেন।  যতক্ষণ পর্যন্ত এই সফটওয়্যার গুলো ভালমতো চলতে থাকে  ততক্ষণ তা নিয়ে আমাদের কোন চিন্তা থাকে না। কিন্তু কখনো কখনো  কোন কোন সফটওয়্যার  ভাল মানুষের (নাকি ‘ভাল মিমের’ বলা উচিৎ) ছদ্মবেশ নিয়ে  ‘ট্রোজান হর্স’ হয়ে ঢুকে পড়ে। এরাই আসলে বিশ্বাসের ক্ষতিকর ভাইরাসগুলো। এরা সূচ হয়ে ঢুকে, আর শেষ পর্যন্ত যেন ফাল হয়ে বেরোয়। যতক্ষণে এই ভাইরাসগুলোকে সনাক্ত করে নির্মূল করার ব্যবস্থা নেয়া হয় – ততক্ষণে  আমাদের হার্ডওয়্যারের দফা রফা সাড়া।  এই বিশ্বাসের ভাইরাসের বলি হয়ে প্রাণ হারায় শত সহস্র মানুষ – কখনো নাইন-ইলেভেনে, কখনো বা বাবরি মসজিদ ধ্বংসে কখনো বা তাজ হোটেলে গোলাগুলিতে। Viruses of the Mind  শীর্ষক  একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স দেখিয়েছেন কিভাবে কম্পিউটার ভাইরাসগুলোর মতই  আপাতঃ মধুর ধর্মীয় শিক্ষাগুলো কিভাবে সমাজের জন্য ট্রোজান হর্স কিংবা ওয়ার্ম ভাইরাস হিসেবে কাজ করে তিলে তিলে এর কাঠামোকে ধ্বংস করে ফেলতে চায়। আরও বিস্তৃতভাবে  জানবার জন্য পাঠকেরা পড়তে পারেন সাম্প্রতিক সময়ে রিচার্ড ব্রডির লেখা ‘ভাইরাস অব মাইন্ড’ কিংবা ডেরেক রে’র ‘দ্য গড ভাইরাস’ কিংবা ক্রেগ জেমসের ‘দ্য রিলিজিয়ন ভাইরাস’ শিরোনামের বইগুলো[13]।    এ বইগুলো থেকে বোঝা যায় ভাইরাস আক্রান্ত মস্তিষ্ক কি শান্তভাবে রবোটের মত ধর্মের আচার আচরণগুলো নির্দ্বিধায় পালন করে যায় দিনের পর দিন, আর কখনো সখনো বিধর্মী নিধনে উন্মত্ত হয়ে উঠে; একসময় দেখা দেয় আত্মঘাতী হামলা, জিহাদ  কিংবা ক্রুসেডের মহামারী।

ভাইরাস আক্রান্ত মনন

অনেকেই বলছেন আলোচিত কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস নিঃসন্দেহে ভাইরাস আক্রান্ত মননের  বাস্তব উদাহরণ। ব্রুকলিন ফেডারেল কোর্টে নাফিসের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে[14], চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে শিক্ষা ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে আসেন নাফিস। আল কায়েদা নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই যুবক সন্ত্রাসী হামলা চালানোর জন্য বিশ্বস্ত লোক খোঁজা শুরু করার পর গত জুলাইয়ে এফবিআইয়ের নজরে পড়েন তিনি। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, নাফিস এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি তছনছ হয়ে যায়। প্রথমে তিনি চেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করতে। এরপর তিনি রিজার্ভ ব্যাংক, নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ ও বাল্টিমোরে সামরিক স্থাপনায় বোমা হামলার পরিকল্পনা করেন।
তার সন্দেহজনক কাজকর্ম এবং গতিবিধি দেখে তিনি এফবিআইয়ের নজরে পড়েন। ২০১২ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে নাফিস, তার এক সহযোগী ও এফবিআইয়ের ওই সোর্সের (CHS) মধ্যে ফেসবুকে যোগাযোগ হয়। ফেসবুকের ওই কথোপকথন এফবিআইয়ের সোর্স রেকর্ড করেন। অভিযোগে দেখা যায়,  ৫ ই জুলাই নাফিস ঐ সোর্সকে বলে যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে জিহাদ সংঘটিত করতে এসেছেন এবং তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে তার একজন সহযোগী এবং বাংলাদেশে একজন ‘ভাই’ রয়েছে।

পরের দিনও তাদের মধ্যে ইসলামের কয়েকটি নীতি নিয়ে আলোচনা হয় এবং বলা হয়, কোনো ব্যক্তির অন্য কোনো দেশে গিয়ে জিহাদি কার্যক্রম চালানো বৈধ নয়। তখন নাফিস বলেন, তিনি বাংলাদেশের একজনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন এবং তিনি পরামর্শ দিয়েছেন যে, ওই সব নীতি অনুসরণের বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ১১ জুলাই নাফিস জানান, যুক্তরাষ্ট্রের একজন ‘হাই র‌্যাংকিং অফিসিয়া”কে সে হত্যা করতে চান।

ফেসবুকের কথোপকথনে নাফিস পরিষ্কার ইঙ্গিত দেন, যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর ক্ষেত্রে ধর্মীয় কোনো বাধা নেই বলেই তিনি মনে করেন। এতে বলা হয়, নাফিসের পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে সহযোগী সেজে এফবিআই কর্মকর্তারাই তাকে ২০ ব্যাগ ‘নকল’ বিস্ফোরক সরবরাহ করেন, যাতে তাকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা যায়। ম্যানহাটনে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সামনে ‘বিস্ফোরক ভর্তি’ ভ্যান দাঁড় করিয়ে নাফিস পাশের মিলেনিয়াম হিল্টন হোটেলে যান। সেখান থেকে তিনি ভ্যানে রেখে আসা সেলফোনে বার বার কল দিতে থাকেন এক হাজার পাউন্ড (৪৫৪ কোজি) বিস্ফোরকে বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য। কিন্তু ভ্যানে সত্যিকারের বিস্ফোরক না থাকায় সেটি আর ফাটেনি। বুধবার নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ভবনের সামনে থেকে নাফিসকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ও এফবিআই।

কিন্তু যেভাবে ‘আলকায়দার চর’ সেজে নাফিসের কর্মকাণ্ড দিনের পর দিন পর্যবেক্ষণ করেছে এফবিআই, যেভাবে তার আস্থা অর্জন করে তার কর্মকাণ্ডে ইন্ধন যুগিয়ে শেষ মেষ ধরা হয়েছে, তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় ভাবে একে ‘স্টিং অপারেশন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যে ভাবে টোপ ফেলে নাফিসকে ধরা হয়েছে তা বৈধ কিনা তা নিয়ে নানা জায়গায় বিতর্ক  হতে পারে, এবং শুরু হয়েছেও। অনেকেই মনে করছেন নাফিসকে ‘ফাঁদে ফেলা’ হয়েছে। বাংলাদেশে নাফিসের অভিভাবকেরও একই অভিমত। এ নিয়ে সামান্য আলোচনা করা প্রয়োজন। বেশ ক বছর আগে আমেরিকার এমএসএনবিসি চ্যানেলে একটা প্রোগ্রাম হত ‘To Catch a Predator’ নামে। যারা অনলাইনে বসে বসে নাবালিকা মেয়েদের সাথে যৌনসম্পর্ক করার জন্য লালায়িত থাকত, তাদের ট্র্যাপে ফেলে জেলে ভরা হত। এমন নয় যে কোন ভাল মানুষকে ‘ফাঁদে ফেলে’ ব্যাপারগুলো করা হত। বরং অনলাইন চ্যাট ফ্যাট বহু স্তর পার হয়ে (প্রতিটি স্তরেই কিন্তু ইঙ্গিত দেয়া হত যে সম্পর্ক করতে ইচ্ছুক মেয়েটা কিন্তু আণ্ডারএজড) যারা খালি বাসায় মেয়ের সাথে দেখা করার লোভনীয় প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে চলে আসত তাদের গলাতেই দড়ি পড়তো। নাফিসের ব্যাপারটাও আমার সেরকমই মনে হয়। এটা এমন নয় যে নিরপরাধ নিষ্পাপ এক হাবা গোবা ছেলেকে ‘কায়দা করে’ ফাঁসানো হয়েছে। বরং এধরণের কেসে যথেষ্ট আলামত পেলেই তারা এগোয়। যে লোক সারাদিন পর্নোসাইটে গিয়ে কেবল ‘আণ্ডারএজড মেয়ে’ খুঁজে ফেরে, কিংবা যে ছেলে ফেসবুকে বা অন্যত্র আমেরিকাকে ধ্বংসের জন্য জিহাদের ডাক দেয়, কিভাবে বোমা যোগাড় করা যায় তার খোঁজ খবর নেয়, একে ওকে ইমেইল করে, তার ধরার পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। নাফিসের ক্ষেত্রে সম্ভবত তাই হয়েছে।  যারা মনে করেন একুশ বছরের শান্ত-শিষ্ট বিভ্রান্ত ছেলেকে ফাঁদে ফেলে সন্ত্রাসবাদী বানানো হয়েছে, তাদেরকে ইন্টারনেট থেকে পুরো অভিযোগনামাটি (Complaint United States of America vs. Quazi Mohammad Rezwanul Ahsan Nafis) পড়ে দেখতে বলব।  অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে কিভাবে তিনি আমেরিকায় জিহাদ করাকে নিজের ‘কর্তব্য’ মনে  করেছেন, আমেরিকাকে ‘দার আল-হারব’[15] হিসেবে অভিহিত করেছেন, এবং আমেরিকার মুসলিমদের বলেছেন ‘তালাফি’। বিন লাদেনও তাই মনে করতেন। ৯/১১ ঘটার অনেক আগেই – ১১ই জানুয়ারি ১৯৯৯ এর নিউজ উইকের একটি সংখ্যায় ওসামা বিন লাদেনের একটা সাক্ষাতকার ছাপা হয়েছিল। সেই সাক্ষাতকারে লাদেন সাহেব পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন কেন তিনি সকল আমেরিকানদের মেরে ফেলাকে ‘জায়েজ’ মনে করেন, কারণ আমেরিকার অমুসলিমেরা সব কাফের, আর মুসলিমেরা সব ‘তালাফি’ (অর্থাৎ সত্যিকার মুসলিম নন)। এর যেহেতু আমেরিকায় ট্যাক্স দিচ্ছে, এবং আমেরিকাকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করছে, তাই সব আমেরিকান, সেটা নারী পুরুষ শিশু যেই হোক না কেন – মেরে ফেললে ধর্মসিদ্ধই হবে। জিহাদীরা মনে করেন যতদিন পর্যন্ত আমেরিকার মত কাফির রাষ্ট্রগুলো ইসলামের পতাকা-তলে না আসছে ততদিন এ সমস্ত দেশগুলোকে  ‘দার আল-হারব’ বা ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ হিসেবে দেখতে হবে। শুধু মুসলিমদের নয়, ইসলামে ধর্মান্তরিত কাফিরদের জন্যও এ কথা প্রযোজ্য। এপ্রসঙ্গে বিখ্যাত ইসলামী গবেষক আনোয়ার সাইখ লিখেছেন,

‘ইসলামে ধর্মান্তরিত সকলেরই এটা কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় যে, তাদেরকে অবশ্যই আরব সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে গ্রহণ করতে হবে, অর্থাৎ তাদের সমস্ত জাতীয় প্রতিষ্ঠান হবে আরবিয় প্রতিষ্ঠানসমূহের অধীন: যেমন মোহম্মদকে আচরণের আদর্শ রূপে দেখা, ইসলামী আইন প্রবর্তন, আরবি ভাষা, সংস্কৃতি শিক্ষা ইত্যাদি কার্যকর করতে হবে। এর চেয়েও খারাপ কথা হল, তাদের অবশ্যই নিজস্ব সংস্কৃতি ও জন্মভূমিকে (অর্থাৎ কাফির রাষ্ট্রকে) এতোটাই ঘৃণা করতে হবে যে, এটা’ ‘দার উল হারব’ না জীবন্ত-যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়’।

উদ্ধৃতি দেয়া যায়  মুসলিম পণ্ডিত এবং ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুনের ‘মুকাদ্দিমা’ থেকেও[16] –

‘শক্তি প্রয়োগ অথবা বুঝিয়ে সুঝিয়ে প্রত্যেককে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা ও মুসলিম মিশনে সর্বজনীনতার কারণে (এর প্রসারের জন্য) যুদ্ধে যাওয়া মুসলিমদের ধর্মীয় দায়িত্ব’।

নাফিস সত্যই সেই আদর্শে বিশ্বাসী একথা এখনই ভেবে নেয়ার কোন কারণ নেই। তবে এই সমস্ত ধারনা দিয়ে কিছুটা হলেও যে তরুণরা সম্মোহিত হচ্ছে, সেটাই সেটাই আশঙ্কার কথা। তার অভিযোগনামায় পরিষ্কার করেই বলা হয়েছে প্রয়াত ওসামা বিন লাদেন নাফিসের প্রাণপ্রিয় নেতা, ইয়েমেনে নিহত আলকায়েদা নেতা আনোয়ার আল আওলাকির ভিডিও লেকচারগুলো তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে, আর আলকায়দার  মুখপত্র ‘ইন্সপায়ার’ রয়েছে তার প্রিয় পত্রিকার তালিকায়।  নাফিস তার সেলফোনে  বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য সেলফোনে কল দেয়ার আগে যে স্টেটমেন্টগুলো লিখেছিলেন তা আলকায়দার ‘ইন্সপায়ার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হবে বলেই ধরে নিয়েছিলেন।  তিনি আত্মঘাতী হয়ে শহীদ হবার ইচ্ছের কথাও বার কয়েক উল্লেখ করেছেন।

নাফিসের ক্ষেত্রে না হয় এফবিআই এর কারসাজিতে  কিংবা সতর্কতায় ফেডারেল রিজার্ভ ভবন উড়িয়ে দেয়া আটকানো গেছে, কিন্তু ভাইরাস আক্রান্ত মননের  সফল উদাহরণগুলো হাজির করলে বোঝা যাবে কিভাবে ধরণের মানসিকতাগুলো সমাজকে পঙ্গু করে দেয়, কিংবা কিভাবে সমাজের প্রগতিকে থামিয়ে দেয়।  এর অজস্র উদাহরণ সাড়া পৃথিবী জুড়ে পাওয়া যাবে। কিছু প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস থেকে জানা যায়, যখন কোন নতুন প্রাসাদ কিংবা ইমারত তৈরি করা হত, তার আগে সেই জায়গায় শিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়া হত – এই ধারণা থেকে যে, এটি প্রাসদের ভিত্তি মজবুত করবে। অনেক আদিম সমাজেই বন্যা কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কুমারী উৎসর্গ করার বিধান ছিল; কেউ কেউ সদ্য জন্মলাভ করা শিশুদের হত্যা করত, এমনকি খেয়েও ফেলত। প্রাচীন মায়া সভ্যতায় নরবলি প্রথা প্রচলিত ছিলো।  অদৃশ্য ঈশ্বরকে তুষ্ট করতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষকে মাথা কেটে ফেলে, হৃৎপিণ্ড উপরে ফেলে, অন্ধকূপে ঠেলে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হত।  ১৪৪৭ সালে গ্রেট পিরামিড অব টেনোখটিটলান তৈরির সময় চার দিনে প্রায় ৮০,৪০০ বন্দিকে ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করা হয়েছিলো। কোন কোন সংস্কৃতিতে কোন বিখ্যাত মানুষ মারা গেলে অন্য মহিলা এবং পুরুষদেরও তার সাথে জীবন্ত কবর দেওয়া হত, যাতে তারা পরকালে গিয়ে পুরুষটির কাজে আসতে পারে। ফিজিতে ‘ভাকাতোকা’ নামে এক ধরনের বীভৎস রীতি প্রচলিত ছিল যেখানে একজনের হাত-পা কেটে ফেলে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে সেই কর্তিত অঙ্গগুলো খাওয়া হত। আফ্রিকার বহু জাতিতে হত্যার রীতি চালু আছে মৃত-পূর্বপুরুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্য। ভারতে সতীদাহের নামে হাজার হাজার মহিলাদের হত্যা করার কথা তো  সবারই জানা। এগুলো সবই মানুষ করেছে ধর্মীয় রীতি-নীতিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে, অদৃশ্য ঈশ্বরকে তুষ্ট করতে গিয়ে। এধরনের ‘ধর্মীয় হত্যা’ সম্বন্ধে আরো বিস্তৃতভাবে জানবার জন্য ডেভিড নিগেলের ‘Human Sacrifice: In History And Today’ বইটি পড়া যেতে পারে[17]।  এগুলো সবই সমাজে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ নামক আগাছার চাষ ছাড়া আর কিছু নয়।

ইতিহাসের পরতে পরতে অজস্র উদাহরণ লুকিয়ে আছে – কিভাবে বিশ্বাসের ভাইরাসগুলো আণবিক বোমার মতই মরণাস্ত্র হিসেবে কাজ করে লক্ষ কোটি মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ধর্মযুদ্ধগুলোই তো এর বাস্তব প্রমাণ। ১০৯৫ সালে সংগঠিত প্রথম ক্রুসেড  এর কথাই ধরা যাক। সে সময় ‘Deus Vult’ (ঈশ্বরের ইচ্ছা) ধ্বনি দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে জার্মানির রাইন ভ্যালিতে হত্যা করা হয় এবং বাস্তুচ্যুত করা হয়। জেরুজালেমের প্রায় প্রতিটি অধিবাসীকে হত্যা করা হয় শহর ‘পবিত্র’ করার নামে। তৃতীয় ক্রুসেডে রিচার্ডের আদেশে তিন হাজার বন্দিকে – যাদের অধিকাংশই ছিলেন নারী এবং শিশু – জবাই করে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় ক্রুসেডের সময় সেন্ট বার্ণাড ফতোয়া দিয়েছিলেন – ‘প্যাগানদের হত্যার মাধ্যমেই খ্রিষ্টানদের মাহাত্ম্য সূচিত হবে। আর যিশুখ্রিস্ট নিজেও এতে মহিমান্বিত হবেন’। এই ক্রুসেডগুলো কি ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ এর উদাহরণ নয়?  ১২০৯ সালে পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট উত্তর ফ্রান্সের আলবীজেনসীয় খ্রিষ্টানদের  উপর আক্ষরিক অর্থেই ধর্মীয় গণহত্যা চালিয়েছিলেন।  স্রেফ চেহারা দেখে বিশ্বাসী এবং অধার্মিকদের মধ্যে পার্থক্য করতে অসমর্থ হয়ে পোপ তখন আদেশ দিয়েছিলেন – ‘সবাইকে হত্যা কর।’  পোপের আদেশে প্রায় বিশ হাজার বন্দিকে চোখ বন্ধ করে ঘোড়ার পেছনে  দড়ি দিয়ে বেঁধে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। তারপর  বার শতকের দিকে সাড়া ইউরোপ জুড়ে আলবেজেনসীয় ধর্মদ্রোহীদের খুঁজে খুঁজে হত্যার রীতি চালু হয়।  ধর্মদ্রোহীদের কখনো পুড়িয়ে, কখনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে কখনো বা শিরোচ্ছেদ করে হত্যা করা হয়। পোপ চতুর্থ ইনোসেন্ট এই সমস্ত হত্যায় প্রত্যক্ষ ইন্ধন যুগিয়েছিলেন।  কথিত আছে ধর্মবিচরণ সভার সংবীক্ষক (Inquisitor) রবার্ট লী বোর্জে এক সপ্তাহে ১৮৩ জন ধর্মদ্রোহীকে হত্যার জন্য পাঠিয়েছিলেন। ইতিহাস কুখ্যাত ‘ব্ল্যাক ডেথ’ এর সময়(১৩৪৮- ১৩৪৯) বহু ইহুদীকে সময় সন্দেহের বশে জবাই করে হত্যা করা হয়। জার্মানিতে পোড়ানো দেহগুলোকে স্তূপ করে মদের বড় বড় বাক্সে ভরে ফেলা হয় এবং রাইন নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।  উত্তর জার্মানিতে ইহুদীদের ছোট্ট কুঠুরিতে গাদাগাদি করে রাখা হয় যেন তারা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়, কখনোবা তাদের পিঠে চাবুক কষা হয়।  থারিঞ্জিয়ার যুবরাজ জনসমক্ষে ঘোষণা করেন যে, তিনি তার ইহুদী ভৃত্যকে ঈশ্বরের নামে হত্যা করেছেন; অন্যদেরকেও তিনি একই কাজে উৎসাহিত করেন। তারপর ধরুন মধ্যযুগে ডাইনি হত্যার নামে নারীদের হত্যার অমানবিক দৃষ্টান্তগুলো। সে সময় (১৪০০ সালের দিকে) চার্চের নির্দেশে হাজার হাজার রমণীকে ‘ডাইনী’ সাব্যস্ত করে পুড়িয়ে মারা শুরু হয়।  এই ডাইনী পোড়ানোর রীতি এক ডজনেরও বেশি দেশে একেবারে গণহিস্টেরিয়ায় রূপ নেয়।  সে সময় কতজনকে এরকম ডাইনী বানিয়ে পোড়ানো হয়েছে? সংখ্যাটা এক লক্ষ থেকে শুরু করে ২০ লক্ষ ছড়িয়ে যেতে পারে। ‘ঠগ বাছতে গা উজাড়ের’ মতই ডাইনী বাছতে গিয়ে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে দেয়া হয়েছে।  সতের শতকের প্রথমার্ধে অ্যালজাস (Alsace) নামের ফরাসি প্রদেশেই প্রায়  ৫০০০ জন ‘ডাইনী’কে হত্যা করা হয়, ব্যাম্বার্গের ব্যাভারিয়ান নগরীতে ৯০০ জনকে পুড়িয়ে মারা হয়। ডাইনী পোড়ানোকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ধর্মীয় উন্মত্ততা সে সময় অতীতের সমস্ত রেকর্ডকে ম্লান করে দিয়েছিল। শুধু নারীরা নয়, খ্যাতিমান  বিজ্ঞানী দার্শনিকেরাও রেহাই পাননি রক্তলোলুপ চার্চের কোপানল থেকে। জিওর্দানো ব্রুনোর মত দার্শনিককে বাইবেল-বিরোধী কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব সমর্থন করার অপরাধে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয় সে সময়, গ্যালিলিওকে করা হয় অন্তরিন। আমার আমাদের উপমহাদেশে তো ধর্মীয় কুসংস্কার ছিল রীতিমত ভয়াবহ। পনর শতকে ভারতে কালীভক্ত কাপালিকের দল মা কালীকে তুষ্ট করতে গিয়ে অন্যদের শ্বাসরোধ আর জবাই করে হত্যা করত।  এই কুৎসিত রীতির বলি হয়ে প্রাণ হারায় প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ। সেখানে কেবল ১৮১৫ থেকে ১৮২৮ সালের মধ্যে ৮১৩৫ নারীকে সতীদাহের নামে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় (প্রতিবছর হত্যা করা হয় গড়পড়তা ৫০৭ থেকে ৫৬৭ জনকে)।  মৌলবাদী খ্রিষ্টানরা ইদানিংকালে ডাইনী পোড়ানো বাদ দিলেও অ্যাবরশন ক্লিনিকগুলোর উপর রাগ যায়নি এখনো। ১৯৯৩ থেকে আজ পর্যন্ত ‘আর্মি অব গড’ সহ অন্যান্য  গর্ভপাত বিরোধী  খ্রিস্টান  মৌলবাদীরা আট জন ডাক্তারকে হত্যা করেছে। এই তো সেদিনও (২০০৯ সালে) নৃশংসতার সর্বশেষ নিদর্শন হিসেবে খ্রিস্টান মৌলবাদী স্কট রোডার কর্তৃক ডঃ জর্জ ট্রিলারকে হত্যার ব্যাপারটি মিডিয়ায় তুমুল আলোচিত হয়। ন্যাশনাল এবরশন ফেডারেশনের সরবরাহকৃত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৭৭ সালের পর থেকে আমেরিকা এবং ক্যানাডায় গর্ভপাতের সাথে জড়িত চিকিৎসকদের মধ্যে ১৭ জনকে হত্যার প্রচেষ্টা চলানো হয়, ৩৮৩ জনকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়, ১৫৩ জনের উপর চড়াও হওয়ার এবং ৩ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটে।  এগুলো সবই  ‘বিশ্বাসের ভাইরাসের’ প্রত্যক্ষ উদাহরণ।

অন্য ধর্মে যেমন ‘বিশ্বাসের আগাছা’র চাষ আছে, আছে ইসলামেও। ইতিহাসবিদেরাই কিন্তু স্বীকার করেন নবী মুহম্মদের জীবনের বছরগুলো অত্যন্ত সংঘাতময় ছিল[18]। তার জীবনের শেষ ১০ বছরে তিনি নাখলার যুদ্ধ, বদরের যুদ্ধ, বানু কাইনুকা, বানু নাদির, বানু মুস্তালাক, আহজাব, বানু কোরাইজা, খাইবারের যুদ্ধ সহ প্রায় ৭০ টি থেকে ১০০টি আক্রমণ, লুণ্ঠন অভিযান এবং যুদ্ধের সাথে জড়িত ছিলেন বলে উল্লেখ আছে[19]। এর মধ্যে ১৭টি থেকে ২৯টিতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অধিকাংশ যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষার্থে নয়, বরং আক্রমণাত্মক[20]। নৃশংস ঘটনা এবং গণহত্যার আলামতও আছে  ঢের। বানু কাইনুকার ইহুদীদের সাতশ জনকে এক সকালের মধ্যে হত্যা করতে সচেষ্ট হন[21] , আর বানু কোরাইজার প্রায় আটশ থেকে নয়শ লোককে হত্যা করেন, এমনকি তারা আত্মসমর্পণ করার পরও[22]। হত্যার ভয়াবহতা এতোই বেশি ছিলো যে, ক্যারেন আর্মস্ট্রং-এর মতো লেখিকা, যিনি মুসলিম সমাজের পছন্দের তালিকায় শীর্ষস্থানীয় হিসবে গণ্য হন, তিনি পর্যন্ত মুহম্মদের কর্মকাণ্ডকে নাৎসি বর্বরতার সাথে তুলনা করেছেন[23]। বহু যুদ্ধক্ষেত্র হতে সাফিয়া, রায়হানা, জুয়াইরিয়ার মতো নারীকে যুদ্ধবন্দি এবং ‘মালে গণিমত’ হিসেবে মহানবীর জন্য অধিগ্রহণও করা হয়েছিল, ভাগ বাটোয়ারা করা হয়েছিল মুহম্মদের সৈনিকদের মাঝে। এমনকি মহানবীর মৃত্যুর পরও সহিংসতা অব্যাহত ছিল। হজরত আলী আর প্রয়াত নবীর স্ত্রী আয়েশার মধ্যে সংগঠিত ‘জামালের যুদ্ধ’ কিংবা আলি আর মুয়াবিয়ার মধ্যে সংঘটিত ‘সিফিনের যুদ্ধ’ই এর প্রমাণ। জামালের প্রায় দশ হাজার মুসলিম নিহত হয়েছিল। ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয় যে, চারজন খলিফার মধ্যে তিনজনই ক্ষমতা দ্বন্দ্বে মুসলিম প্রতিপক্ষের হাতে মারা যান। তবে মারা যাবার আগে তারা ইসলামী ঝাণ্ডা সমুন্নত রাখতে বহু দেশ আক্রমণ করে সেগুলো অধিগ্রহণ করেন। যেমন খলিফা আবু বকরের সময় (৬৩৩ – ৬৩৪) ওমান, ইয়েমেন, ইয়ামাহ, সিরিয়া, পারশিয়া, বাসরা, দামাস্কাস এবং আজনাদিনের যুদ্ধ,  খলিফা ওমরের সময়  (৬৩৪ – ৬৪৪) নামারাক, সাকাটিয়া, ব্রিজ, বুয়াইব, দামাস্কাস এবং ফাহ্‌ল, ইয়ারমুক, কাদিসিয়া এবং  মাদাইন, জালুলা, জেরুজালেম, জাজিরা, খাজিস্তান এবং মিশর, আজারবাইজান, ফারস এবং খারান বিজয়, খলিফা ওসমানের সময় (৬৪৭ – ৬৫৬) সাইপ্রাস, বাইজেন্টাইন এবং উত্তর আফ্রিকা আক্রমণ, খলিফা আলির সময় নাহরোয়ানের যুদ্ধ এবং মিশরের যুদ্ধ ইত্যাদি উল্লেখ্য। হজরত আলী ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে বিষাক্ত ছুরিকাঘাতে নিহত হলে,খালিফায়ে রাশেদীনের যুগের সমাপ্তি ঘটে এবং এ সময় একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হন মুয়াবিয়া। তার শাসনামলে বহু যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল, তার জিহাদি সৈনিকদের দ্বারা বহু রাজ্য হয়েছিল অধিকৃত। এর মধ্যে মিশর বিজয় (৬৬২ খ্রিস্টাব্দ), সিসিলি আক্রমণ (৬৬৬ খ্রিস্টাব্দ), কনস্টানটিপোল আক্রমণ (৬৬৭ খ্রিস্টাব্দ), কুফার যুদ্ধ (৬৮৭ খ্রিস্টাব্দ), দের-উল-জালিকের যুদ্ধ (৬৯১ খ্রিস্টাব্দ), উত্তর আফ্রিকা আক্রমণ (৭০০ খ্রিস্টাব্দ),  দের-উল-জামিলার যুদ্ধ (৭০২ খ্রিস্টাব্দ), সিন্ধুর লড়াই (৭১২ খ্রিস্টাব্দ), ফ্রান্সের যুদ্ধ (৭৩২ খ্রিস্টাব্দ), আইন আল জারের যুদ্ধ (৭৪৪ খ্রিস্টাব্দ), রেয়’র যুদ্ধ (৭৪৮ খ্রিস্টাব্দ), ইশফাহান এবং নিহাওয়ান্দের যুদ্ধ (৭৪৯ খ্রিস্টাব্দ)  প্রভৃতির কথা বলা যায়। এর মধ্যে ৭১১ সালে ইসলামের স্পেন বিজয়ের পর যেন বিশৃঙ্খলা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মূলতঃ স্পেন বিজয়ের পর থেকেই ইসলামী সাম্রাজ্যবাদী শাসন বৈশ্বিক অবস্থায় চলে যায় বললে অত্যুক্তি হয় না[24]।   শুধু স্পেন বিজয়ই বা বলি কেন,  স্পেন বিজয়ের পর নবম শতকের গোঁড়ার দিকে ভূমধ্যসাগরীয়  উপকূলীয় শহর এবং ইতালির বাইরের দ্বীপগুলো দখল, ৮১৩ সালে সেন্টুমসেলি, ইশ্চিয়া, ল্যাম্পেডুসা দখল, ৮৪৮ সালে আনকোনাইয় ধ্বংসযজ্ঞ, ৮৭৬ সালে ল্যাটিয়াম ও আম্ব্রিয়া আক্রমণ, ৬২৫-৭২৫ সাল নাগাদ ক্রমাগতভাবে সিসিলি আক্রমণ, ৮২৭ সালে মাযারা ডেল ভ্যালো  আক্রমণ, ৮৩১ সালে পালের্মো, ৯৩৫ সালে প্যান্টেলেরিয়া এবং ৮৪৩ সালে মেসিনার পতন, ৮৭৮ সালে সিরাকুসের আদিবাসীদের হত্যা, ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিপোলের উপর আগ্রাসন প্রমাণ করে সাম্রাজ্যবাদ কেবল পশ্চিমাদেরই একচেটিয়া ছিল না। কনস্টান্টিপোলের  বিখ্যাত বিজয়ের পর মুসলিম জিহাদি সৈনিকেরা তিনদিন ধরে সেখানকার নাগরিকদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল এবং অবশিষ্টদের ক্রীতদাসে পরিণত করেছিল। ১০১০ থেকে ১০১৩ সালের মধ্যে কর্ডোভার নিকটবর্তী অঞ্চল এবং এবং স্পেনের অন্যান্য অঞ্চলে হাজার হাজার ইহুদিকে হত্যা করা হয়। অমুসলিমদের সরকারী চাকুরীতে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে ১০৬৬ সালে ব্যাপক দাঙ্গা হয়, এবং গ্রানাডার ইহুদিদের একটা গোটা সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়।  ইতিহাস থেকেই জানা যায়, ইসলামের জিহাদের নামে গত বার শতক ধরে সাড়া পৃথিবীতে মিলিয়নের ওপর মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।  প্রথম বছরগুলোতে মুসলিম বাহিনী খুব দ্রুতগতিতে পূর্ব ভারত থেকে পশ্চিম মরক্কো পর্যন্ত আগ্রাসন চালায়। শুধু বিধর্মীদের হত্যা করেনি, নিজেদের মধ্যেও কোন্দল করে নানা দল উপদল তৈরি করেছিল। কারিজিরা যুদ্ধ শুরু করেছিলো সুন্নিদের বিরুদ্ধে। আজারিকিরা অন্য সকল ‘পাপীদের’ মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলো। ১৮০৪ সালে উসমান দান ফোডিও, সুদানের পবিত্র সত্ত্বা, গোবির সুলতানের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ শুরু করে। ১৮৫০ সালে আরেক সুদানীয় সুফি উমর-আল হজ্জ প্যাগান আফ্রিকান গোত্রের  উপরে নৃশংস বর্বরতা চালায় – গণহত্যা এবং শিরোচ্ছেদ করে ৩০০ জন বন্দির উপর। ১৯৮০ সালে তৃতীয় সুদানীয়  ‘হলি ম্যান’ মুহাম্মদ আহমেদ জিহাদ চালিয়ে ১০,০০০ মিশরীয় লোকজন হত্যা করে। এধরণের বহু ঘটনাই অতীতে ঘটেছে এখনো ঘটছে।

ইসলামের শরিয়া আইন যে মেয়েদের ব্যাপারে অনেক কঠোর সেটা সবারই জানা। এর শিকার শুধু সাধারণ নারীরা হয়নি, হয়েছে সম্ভ্রান্ত বংশের নারীরাও। সৌদি আরবে ১৯৭৭ সালে কিশোরী প্রিন্সেসকে ‘ব্যভিচারের’ অপরাধে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানে ১৯৮৭ সালে এক কাঠুরিয়ার মেয়েকে ‘জেনা’ করার অপরাধে পাথর ছুড়ে হত্যার ফতোয়া দেয়া হয়। ১৯৮৪ সালে আরব আমিরাতে একটি বাড়ির গৃহভৃত্য এবং দাসীকে পাথর ছুঁড়ে হত্যার ফতোয়া দেয়া হয়, অবৈধ মেলামেশার অপরাধে। এ ধরণের বহু ঘটনা এখনো পৃথিবীতে ঘটে চলেছে।  পাশাপাশি আছে ‘অনর কিলিং’ এর উপদ্রব। সাড়া বিশ্বে প্রতি বছর পাঁচ হাজার নারী মারা যায় ‘অনর কিলিং’-এর শিকার হয়ে। খোদ পাকিস্তানেই সরকারী হিসেবে বছরে ১,২০০ মত অনার কিলিং এর ঘটনা ঘটে, আর বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা আসলে ১০ হাজারেরও উপরে।পশ্চিমেও সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিম পরিবারগুলোতে ‘অনর কিলিং’ এর সংখ্যা আশঙ্কাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নুর আলমালাকি, তুলায় গোরেন, খাতেরা সাদিকি, ইয়ামিন, সাবরিনা লারবি, আয়মান উদাস, আয়শা হাসান, আমিনা সারাহ সহ বহু নারীকে পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা করা হয়েছে ‘অতিরিক্ত’ পশ্চিমা ধাঁচে চলে ধর্মকে অপমানিত করার জন্য। এমনকি হ্যারি পটারের ছবিতে পদ্মা পাতিলের ভূমিকায় অভিনয় করা  অভিনেত্রী আফসান আজাদ এক হিন্দু ছেলের সাথে সম্পর্ক করায় পরিবার থেকে নিগ্রহের শিকার হয়ে কিছুদিন আগেও সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন।

আমি যেখানে থাকি তার পাশেই আছে বিরাট বার্নস এন্ড নোবেল’ এর বিরাট বড় বইয়ের দোকান। লেখালেখির ছুতায় প্রায়ই যাওয়া পড়ে সেখানে। তাদের শেলফে ‘হিউমার’ নামে একটি সেকশন আছে। সেখানে উঁকি দিলেই দেখতে পাওয়া যায় যীশুকে ব্যঙ্গ করা একগাদা বই। এমনি একটি বই আমি পড়ছিলাম – ‘The Year of Living Biblically: One Man’s Humble Quest to Follow the Bible as Literally as Possible’ নামে। এ ধরণের অনেক বইই শেলফে আছে। কেউ কিন্তু লেখকের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিচ্ছে না, দিচ্ছে না কেউ গলা কাটার হুমকি। কিন্তু  মুসলিম বিশ্বে ধর্মের সমালোচনা কিংবা যে কোন হাস্যরসকেই যেন নেওয়া হয় গুরুতর অপরাধ হিসেবে।  ১৯৮৯ সালে ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নামের উপন্যাস লেখার দায়ে সালমান রুশদিকে ফতোয়া দেয়া হয় ইরানের ধর্মগুরু আয়াতোল্লা খোমেনীর পক্ষ থেকে। মুসলিম বিশ্বে রাতারাতি শুরু হয় জ্বালাও পোড়াও তাণ্ডব। ইসলামকে অবমাননা করে লেখার দায়ে এর আগেও মনসুর আল হাল্লাজ, আলী দাস্তি, আজিজ নেসিন, উইলিয়াম নেগার্ড, নাগিব মাহফুজ,তসলিমা নাসরিণ,ইউনুস শায়িখ, রবার্ট হুসেইন, হুমায়ুন আজাদ, ভ্যানগগ, আয়ান আরসি আলী সহ অনেকেই মৃত্যু পরোয়ানা পেয়েছেন। এদের মধ্যে অনেককেই মেরে ফেলা হয়েছে, কেউ বা হয়েছেন পলাতক।     ২০০৫ সালের ৩০ শে সেপ্টেম্বর জেলেণ্ডস পোস্টেন  নামের একটি ডেনিশ পত্রিকা মহানবী হযরত মুহম্মদকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক ১২টি কার্টুন প্রকাশ করলে সাড়া মুসলিম বিশ্বে এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ জ্বালাও-পোড়াও তাণ্ডব শুরু হয়। পাকিস্তানের এক ইমাম কার্টুনিস্টের মাথার দাম ধার্য করে এক মিলিয়ন ডলার। সিরিয়া, লেবানন, ইরান, পাকিস্তান, বাংলাদশ সহ সারা পৃথিবীতে সহিংসতায় মারা যায় শতাধিক লোক। ব্রিটেনের  মুসলিমেরা  ব্যানার নিয়ে মিছিল করে – ‘Slay those who insult Islam’, ‘Butcher those who mock islam’ এবং  ‘Behead those who say Islam is a violent religion’  ইত্যাদি। বাংলাদেশে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সামান্য ‘মোহাম্মদ বিড়াল’ নিয়ে কৌতুকের জের হিসেবে ২১ বছর বয়সী কার্টুনিস্ট আরিফকে জেলে ঢোকানো হয়, বায়তুল মোকারমের খতিবের কাছে গিয়ে প্রথম আলোর সম্পাদকের ক্ষমা প্রার্থনার নাটক প্রদর্শিত হয়। এগুলো তো চোখের সামনেই দেখা।

ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থের  এটা একটা বড় সমস্যা। এর ভাল ভাল বানীগুলো থেকে ভালমানুষ হবার অনুপ্রেরণা পায় কেউ, আবার সন্ত্রাসবাদীরা একই ধর্মগ্রন্থের  ভায়োলেন্ট ভার্সগুলো থেকে অনুপ্রেরণা পায় সন্ত্রাসী হবার।  সেজন্যই তো ধর্মগ্রন্থগুলো –একেকটি ট্রোজান হর্স – ছদ্মবেশী ভাইরাস!  এই জন্যই একই ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে ইহুদী নাসারাদের সাথে যুদ্ধ করার লক্ষ্যে ‘বিন লাদেন’ হয়ে যায়, আবার কেউ বা পরিণত হয় সুফী সাধকে। নাফিসের ক্ষেত্রেও যে প্রথমটা হয়নি তা হলফ করে বলা যায় না[25]।  কি করে হলফ করে বলা যাবে যে ধর্মগ্রন্থ থেকে পাওয়া ‘তোমাদের উপর যুদ্ধ ফরয করা হয়েছে’ কিংবা  ভাইরাস রূপী যুদ্ধাংদেহী আয়াতগুলো (২:২২১৬, ৪:৮৪, ৫:৫১, ৩:৮৫, ৮:৩৯, ৯:২৯, ৪৭:৪   ৪:৮৯, ২:১৯১, ২:১৯৩, ৯:৫, ৯:৩৯ ইত্যাদি)সত্যই নাফিসের মতো ছেলেদের সন্ত্রাসবাদে উৎসাহিত করছে না ? ইসলাম ধর্মবিশ্বাসীরা জোর গলায় বলেন,  কোরান কখনো সন্ত্রাসবাদে কাউকে উৎসাহিত করে না, কাউকে আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্ররোচিত করে না, ইত্যাদি। এটা সত্যি সরাসরি হয়ত কোরানে বুকে পেটে বোমা বেধে কারো উপরে হামলে পড়ার কথা নেই;  কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, কোরানে পাওয়া যায় যে – যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়, আল্লাহ্‌ কখনই তাদের কর্ম বিনষ্ট করবেন না (৪৭:৪), কোরানে বলা হয়েছে  – আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করো না (৩:১৬৯); কিংবা বলা হয়েছে – যদি আল্লাহর পথে কেউ যুদ্ধ করে মারা যায় তবে তার জন্য রয়েছে জান্নাত (৯:১১১)।

আর আল্লাহর পথে শহীদদের জন্য জান্নাতের পুরস্কার  কেমন হবে?  এ প্রসঙ্গে নির্দেশ – তথায় থাকবে আয়তলোচনা রমনীগন(৫৫:৫৬), সুশুভ্র (wine) (৩৭: ৪৬), উদ্যান, আঙ্গুর, পূর্ণযৌবনা (full-breasted) তরুণী  এবং পূর্ণ পানপাত্র (৭৮: ৩৩-৩৪), আবরণে রক্ষিত মোতির ন্যায় (৫৬: ২২-২৩) চিরকুমারী (৫৬:৩৫-৩) হুরীরা।  ব্যবস্থা রেখেছেন গেলমানদেরও, সেই যে সুরক্ষিত মোতিসদৃশ কিশোররা তাদের খেদমতে ঘুরাফেরা করবে (৫২:২৪), ইত্যাদি।

বেহেস্তে সুরা-সাকী-হুর-পরীর এমন অফুরন্ত ভাণ্ডারের গ্রাফিক বর্ণনা দেখে নাফিসের মতো অনেকেরই হয়তো শহীদ হতে মন চাবে! অনেক বিবর্তনবাদী মনোবিজ্ঞানীই মনেই করেন ইসলামী সমাজে বহুগামীত্ব এবং পাশাপাশি মৃত্যুর পরে উদ্ভিন্নযৌবনা এবং চিরকুমারী হুরীদের অফুরন্ত ভাণ্ডারের নিশ্চয়তার কারণেই মুসলিমদের মধ্যে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের এতো আধিক্য চোখে পড়ে[26]।এ  যদি বিশ্বাসের ভাইরাসের সার্থক উদাহরণ না হয়, তবে আর ‘ভাইরাস’ বলব কাকে, বলুন?

কেবল ইসলামের জিহাদি সৈনিকেরাই ভাইরাস আক্রান্ত মননের উদাহরণ ভাবলে ভুল হবে।  ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ নিয়ে আমি ব্লগে একটি আলোচনা করেছিলাম একসময়। সেটি  মুক্তমনায় প্রকাশের পর দিগন্ত সরকার ‘বিশ্বাসের ভাইরাস এবং আনুষঙ্গিক’  নামের একটি সম্পূরক প্রবন্ধে ভারতের আর এস এস পরিচালিত স্কুলগুলোর পাঠ্যসূচীর নানা উদাহরণ হাজির করে দেখিয়েছেন কিভাবে ছেলেপিলেদের মধ্যে শৈশবেই ভাইরাসের বীজ বপন করা হয়[27] । বিদ্যা ভারতী নামের এই স্কুল সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে – সংখ্যায় প্রায় ২০,০০০। প্রায় ২৫ লাখ শিক্ষার্থী এতে পড়াশোনা করে – যাদের অধিকাংশই গরিব বা নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের। পড়াশোনা চলে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী অবধি। তিস্তা সেতালবাদের প্রবন্ধ In the Name of History Examples from Hindutva-inspired school textbooks in India থেকে[28] অসংখ্য দৃষ্টান্ত হাজির করে দিগন্ত দেখিয়েছেন কিভাবে সত্য-মিথ্যের মিশেল দেওয়া ইতিহাস পড়িয়ে এদের মগজ ধোলাই করা হয় –

* ‘‘হোমার বাল্মীকির রামায়ণের একটা ভাবানুবাদ করেছিলেন – যার নাম ইলিয়াড।’’
* ‘‘প্লেটো ও হেরোডোটাসের মতে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা ভারতীয় ভাবধারার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।’‘
* ‘‘গরু আমাদের সকলের মাতৃস্থানীয়, গরুর শরীরে ভগবান বিরাজ করেন।’’
একই স্কুলের ভারতের ম্যাপে ভারতকে দেখানো হয় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, তিব্বত এমনকি মায়ানমারের কিছু অংশ নিয়ে। বলা হয় অশোকের অহিংস নীতির ফলে তার সেনাবাহিনী যুদ্ধে উৎসাহ হারিয়েছিল। অ্যালেক্সান্ডার নাকি পুরুর কাছে যুদ্ধে হেরে গিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন।

মধ্যযুগের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িকতার উদগ্র রূপ আর বেশি প্রকটিত। সমগ্র ইতিহাস শিক্ষায় মুসলিমদের বিদেশী শক্তি হিসাবে দেখানো হয়েছে।
* ‘‘ভারতে বিদেশী মুসলিম শাসন’’
* ‘‘ভারতে তলোয়ার ধরে ইসলামের প্রচার হয়েছিল। মুসলিমেরা এক হাতে কোরান আরেক হাতে তরবারি নিয়েই এসেছিল এদেশে … আমরা তাদের পরে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি, কিন্তু আমাদের যে ভাইয়েরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল, তাদের হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করতে ব্যর্থ হয়েছি।’’
* ‘‘হিন্দুরা চরম অপমানের সাথে তুর্কী শাসন মেনে নিয়েছিল।’’
* ‘‘বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, পর্দাপ্রথা সহ আরো অনেক কুসংস্কার মুসলিম রাজত্বের প্রতিক্রিয়া হিসাবে হিন্দুসমাজে স্থান করে নিয়েছে।’’
* ‘‘শিবাজী আর রাণা প্রতাপ ছিলেন প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামী। তারা মুসলিমদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্যই লড়াই করেছিলেন।’’

ভারতের স্কুলের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে বিন কাসিম, ঘৌরী বা গজনীর মামুদ বা তৈমুর লঙ্গ কিভাবে হিন্দুদের হত্যা করেছিলেন তার বিস্তারিত বর্ণনা হাজির করে বাচ্চাদের মাথায় অঙ্কুরেই ‘মুসলিম বিদ্বেষ’ প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়।  দেশ বিভাগের জন্য একতরফা ভাবে মুসলিমদের দায়ী করে ইতিহাস লেখা হয়। আর.এস এস-এর মত সন্ত্রাসবাদী সাম্প্রদায়িক দলকে প্রকৃত স্বাধীনতাকামী একটি সংগঠন হিসাবে তুলে ধরা হয়। সবথেকে মজার কথা, মহাত্মা গান্ধী যে এই সংগঠনের একজনের হাতেই মারা গিয়েছিলেন, সেকথাও বেমালুম চেপে যাওয়া হয়। সামগ্রিকভাবে, পাঠক্রম এমনভাবে সাজানো যাতে সবার মধ্যে ভাব সৃষ্টি হয় যে তাদের পূর্বপুরুষেরা মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের হাতে অত্যাচারিত। তাদের ঘাড়ে দায়িত্ব বর্তায় তার প্রতিশোধ নেবার। এ সবকিছুই দিগন্ত তার প্রবন্ধে খুব পরিষ্কারভাবেই উল্লেখ করেছেন।

২০০৮ সালের ২৬ এ নভেম্বর সেইদিন প্রায় ১০ জন ফিদাইন জঙ্গি মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে সন্ত্রাসবাদের যে তুঘলকি কাণ্ড শুরু করেছিলো  সেদিন এই ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ নিয়ে আমরা  মুক্তমনায় দীর্ঘ আলোচনা করেছিলাম। বিশ্বাসের বাইরেও রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ইস্যু সহ নানা ধরণের আকর্ষণীয় প্রসঙ্গ উঠে এসেছিলো বিস্তৃত পরিসরে। উঠে এসেছিলো কাশ্মীর প্রসঙ্গ, উঠে এসেছিলো ভারতে মুসলিম মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যের নানা উদাহরণ। এটা ঠিক যে,  কাশ্মীরী জনগণের উপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর লাগাতার অত্যাচার, বাবরি মসজিদ ধ্বংস কিংবা গুজরাটে সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিমদের উপর যে ধরণের অত্যাচারের স্টিম রোলার চালানো হয়েছে তা ভুলে যাবার মত বিষয় নয়। মুসলিমরা ভারতের জনগণের প্রায় ১৪ শতাংশ। অথচ তারাই ভারতে সবচেয়ে নিপীড়িত, অত্যাচারিত এবং আর্থসামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া এক জনগোষ্ঠী। এ সমস্ত অনেক কারণ মুসলিমদের ক্ষুব্ধ করেছে বছরের পর বছর ধরে।  কিন্তু এটাও ঠিক, পৃথিবীতে সামাজিক অবিচার যেমন আছে, তেমন আছে সামাজিক অবিচারের নামে অন্ধবিশ্বাসের চাষ এবং তার প্রচার।  ধর্মগ্রন্থের জিহাদি বানীগুলো কিংবা সুচতুর উপায়ে বিকৃত ইতিহাস তুলে ধরে পরবর্তী প্রজন্মকে মগজ ধোলাইয়ের উদাহরণগুলো এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।  মুক্তমনা সদস্য অপার্থিব জামান প্রবন্ধটি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে যা বলেছেন তা হয়ত অনেকের মনেই চিন্তার খোরাক যোগাবে। তিনি বলেন,

‘মানুষের কোন কোন স্বভাব যেমন উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়ায় বিশেষ কোন বংশাণুর পরিস্ফুটনের কারণে সৃষ্ট হয়, তেমনি মৌলবাদী সন্ত্রাসও ঘটতে পারে কোন কোন ধর্মীয় আদেশাবলীর উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়ায় পরিস্ফুটিত হবার কারণে। এই উপযুক্ত পরিবেশ প্রদান করতে পারে অনেক কারণ, যার মধ্যে সামাজিক অনাচার অবশ্যই অন্যতম। কিন্তু ‘শুধু’ সামাজিক অনাচার থাকলেই যে মৌলবাদী সন্ত্রাস ঘটবে এটা নিশ্চিত না। বংশাণুর মত একটা মূল কারণও থাকতে হবে (মৌলবাদী সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে যা হতে ধর্মগ্রন্থের কোন কোন শ্লোক, কিংবা জাতিবিদ্বেষী বিকৃত ইতিহাস চর্চা)। আর এই ধর্মীয় বংশাণু কেবল সামাজিক অনাচারেই পরিস্ফুটিত হয় – তাও হলফ করে বলা যাবে না। কোন কোন ধর্মের আদেশাবলী এতই শক্তিশালী যে বিভিন্ন পরিস্ফুটক পরিবেশ অতি সহজেই সৃষ্ট হয় আদেশাবলীর জোরাল তাগিদেই। আর ধর্মীয় মূল কারণ না থাকলে সামাজিক অনাচার অন্যরকম সন্ত্রাসের জন্ম দিতে পারে। আবার নাও দিতে পারে। থাইল্যান্ডে অতি গরীব বৌদ্ধরা ভিক্ষা করবে কিন্তু কখন ও হিংসায় লিপ্ত হবে না। অনেক গরীব লোক চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও সততা বিসর্জন দেয় না। তিব্বতিদের ওপর অত্যাচার হয়েছে অনেক বেশী। কিন্তু তিব্বতের লোকেরা হিংসার আশ্রয় নিয়ে সন্ত্রাসবাদী হয় নি। কাজেই এটা কখনই বলা যায় না যে সামাজিক অনাচারই ধর্মীয় সন্ত্রাসের মূল কারণ, বরং বলা যায় অনুঘটক মাত্র’।

কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিসের আচরণ প্রত্যক্ষ করলে অপার্থিবের এই অভিমতের সত্যতা হয়তো খুঁজে পাবেন অনেকে।  চিন্তা করে দেখুন, নাফিস আমাদের আর দশটা ছেলের মতই মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। তার পিতা নিজেও ব্যাংকার। তাই ভিনদেশে পাড়ি দিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের মত একটি প্রতিষ্ঠান তার ছেলেকে উড়িয়ে দেবার শিক্ষা তিনি দেননি এটা ধরেই নেয়া যায়। এমন কোন আলামত পাওয়া যায়নি যে পারিবারিক পরিবেশ থেকে নাফিস সন্ত্রাসী হয়ে উঠেছিল। বরং বাবা মা সারা জীবন ধরে সন্তানকে যেভাবে আগলে রাখে সেভাবেই রেখেছিলেন নাফিসকে। আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০০৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া এ ছেলেকে একটা সময়   দেশের পাঠ চুকিয়ে বিদেশেও পাঠিয়েছিলেন তারা, ছেলের সুশিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষার কথা ভেবে। তাহলে কে বা কারা এমন একটি ‘সোনার টুকরা’ ছেলেকে রাতারাতি সন্ত্রাসবাদীতে পরিণত করে ফেলল? হ্যাঁ, এ কথা এখন পরিষ্কার করেই বলার সময় এসেছে যে, তার মা –বাবা, পরিবার কেউই নাফিসকে ধর্মান্ধ বানায়নি, তার মিউটেশন ঘটেছিল ধর্মের ভাইরাসের মাধ্যমে। জিহাদি প্যারাসাইটিক ধারণায় আক্রান্ত  নাফিসের ভাইরাস-আক্রান্ত মনন ভেবে নিয়েছিল জিহাদ করে এবং বোমা মেরে ফেডারেল ভবন কিংবা স্টক এক্সচেঞ্জ ভবন উড়িয়ে দিলেই আমেরিকার টনক নড়বে,  চাইকি হয়তো এবারের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনও বানচাল হয়ে যেতে পারে, এবং শেষ পর্যন্ত ‘মুসলিমদের প্রতি’ আমেরিকার দীর্ঘদিনের  বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান ঘটবে। কিন্তু নাফিস (যদি সত্যই তিনি অপরাধী হয়ে থাকেন) যেটা বোঝেননি তা হল, এধরণের প্রতিটি ঘটনাই তৈরি করে আরো দীর্ঘস্থায়ী বৈষম্যের, এবং পরিস্থিতি হয়ে উঠে মুসলিমদের জন্যই আরো নাজুক।

ভাইরাস এবং তার প্রতিষেধক

ধর্মীয় ধ্যান ধারণাগুলো যে অনেকটা ভাইরাসের মতোই কাজ করে, সেটা আমরা স্বীকার করি আর নাই করি। অধ্যাপক ভিক্টর স্টেঙ্গর তার সাম্প্রতিক ‘গড – দ্য ফলি অব ফেইথ’ বইয়ে ডেরেল রে’র গবেষণা থেকে ধর্মের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করেছেন[29] –

১) এটা মানুষকে সংক্রমিত করে
২) অন্য ধারণার (ভাইরাসের)  প্রতি প্রতিরোধ এবং এন্টিবডি তৈরি করে
৩) কিছু বিশেষ মানসিক এবং শারীরিক ফাংশনকে অধিকার করে ফেলে, এবং সেই ব্যক্তির মধ্যে এমনভাবে লুকিয়ে থাকে যে সেই ব্যক্তির পক্ষে তাকে সনাক্ত করা সম্ভব হয় না।
৪) বিশেষ কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করে ভাইরাসের বিস্তারে।
৫) বাহককে অনেকটা  ‘প্রোগ্রাম’ করে ফেলে ভাইরাসের বিস্তারে সহায়তা করতে।

আরো একটি মজার ব্যাপার হচ্ছে,  আমাদের অনেকেই শৈশবে সর্দি কাশি গলা ব্যথা সহ অনেক উপসর্গের সম্মুখীন হতাম। শিশুরা ভাইরাসাক্রান্ত হয় বেশি, কারণ পূর্ণবয়স্ক মানুষের চেয়ে অরক্ষিত শিশুকে কাবু করা সহজ।  তাই শৈশবেই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে বেশীমাত্রায়। ঠিক একইভাবে ধর্মগুলোও ‘অরক্ষিত শৈশব’কে বেছে নেয় ভাইরাসের প্রসারে। সম্প্রতি আদিল মাহমুদ   ‘ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার সরল পাঠ’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ লিখছেন[30]।  সিরিজটির প্রথম পর্বে তিনি দেখিয়েছেন ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় শিক্ষার নামে কিভাবে শিশু-কিশোরদের ‘ব্রেন-ওয়াশ’ করা হয়। তিনি বাংলাদেশের সরকারী শিক্ষা বোর্ডের নবম-দশম শ্রেণীর ইসলাম-শিক্ষা বইটির কিছু স্ক্যান করা পৃষ্ঠা উদ্ধৃত করেছেন, যা রীতিমত আতঙ্কজনক। বইটিতে ‘কুফ্‌র’ কী, ‘কাফির কারা’ এ সংক্রান্ত আলোচনা আছে, যা রীতিমত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপ্রসূত।  অবিশ্বাসীরা হল কাফের; তারা অকৃতজ্ঞ, যাদের দুনিয়ায় কোন মর্যাদা নাই, তারা অবাধ্য ও বিরোধী, জঘন্য জুলুমকারি, হতাশ/নাফরমান। একই বইয়ের ৫৩ পাতায় বেশ গুরুত্ব সহকারে জিহাদ সম্পর্কিত শিক্ষা বর্নিত হয়েছে। শুধু জিহাদের সংজ্ঞা নয়, কিভাবে এবং কাদের বিরুদ্ধে জিহাদ চালিয়ে আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হবে তা স্পষ্ট ভাষাতেই বর্ণনা করা হয়েছে রেফারেন্স সহকারে –

ইসলাম ধর্ম শিক্ষা বইয়ে জিহাদ

ইসলাম-শিক্ষা বইটির এই অংশটুকু পড়লে কিন্তু অনেকেরই মনে হবে বিন লাদেন, বাংলা ভাই, শায়খ রহমানদের সন্ত্রাসী বলা এই ধর্মশিক্ষার আলোকে মোটেই যুক্তিসংগত নয়। বইটি পড়লে আরো মনে হবে ইসলাম শিক্ষা বইটি যেন ইমাম আল গাজ্জালীর উগ্র আদর্শের আলোকে লেখা হয়েছে যিনি ইসলামের মধ্যে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী মোতাজিলাদের মুক্তবুদ্ধিকে এক সময় ধ্বংস সাধন করেন নির্মমভাবে। জিহাদ সম্বন্ধে গাজ্জালীর বাণী  ছিল এরকমের –

‘প্রত্যেক মুসলিমকে বছরে অন্তত একবার অবশ্যই জিহাদে যেতে হবে… দুর্গের ভিতরে যদি নারী এবং শিশুরাও থাকে, তবু তাদের বিরুদ্ধে ভারী পাথর বা তীর নিক্ষেপের যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে কিংবা ডুবিয়ে মারা যেতে পারে’

গাজ্জালী, মওদুদীদের উগ্র ভাবধারা শিশু-কিশোরদের সংক্রমিত করার মাধ্যমে কীভাবে ভাইরাস আক্রান্ত মনন কীভাবে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে সেটা  বোধ হয় না বললেও চলবে। পাকিস্তানে নাকি শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হয়, ‘এ ফর আলিফ, বি ফর বন্দুক’[31] । সে দেশের ভাইরাস –আক্রান্ত সেনাবাহিনী পরিণত বয়সে সুযোগ পেয়ে নয় মাসে ত্রিশ লক্ষ মানুষ মারবে আর দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি করবে, এ আর বিচিত্র কি!  মর্নিং শোজ দ্য ডে!

এ ফর আলিফ, বি ফর বন্দুক
চিত্র: পাকিস্তানে শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হয়, ‘এ ফর আলিফ, বি ফর বন্দুক’

ভাইরাসের এই মহামারী ঠেকাতে তাহলে করনীয় কি?  এখানে স্টিং অপারেশনের কথা আবারো প্রাসঙ্গিক। যারা স্বাস্থ্য-সচেতন, তারা বলেন, ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর’। রোগে পড়ে চিকিৎসা করার চেয়ে  রোগ-প্রতিরোধটাই জরুরী।  সে হিসেবে চিন্তা করলে এ জাতীয় স্টিং অপারেশনের একটা গুরুত্ব সব সময়ই থেকে যায়। ঘটনা ঘটার পরে সন্ত্রাসীদের পেছনে দৌড়ানোর চেয়ে সম্ভাব্য সন্ত্রাসীদের পর্যবেক্ষণ করে গারদে ভরাটাই অনেকে সমীচীন মনে করেন। এতে অসংখ্য মৃত্যুঘাত এড়ানো যায়, এড়ানো যায়, এড়ানো যায় শারীরিক, মানসিক এবং অর্থনৈতিক  ব্যাপক ক্ষতি।  আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা দাবী করে সতর্ক থাকার ফলেই ৯/১১ এর ঘটনার পর অন্ততঃ ৫৩টি ‘টেরর প্লট’ তারা নস্যাৎ করে দিতে সমর্থ হয়েছেন[32]।

কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, স্টিং অপারেশনের মাধ্যমে যেভাবে নাফিসকে কব্জা করা হয়েছে তা বিভিন্ন মহলেই জন্ম দিয়েছে নানা বিতর্কের। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি স্টিং অপারেশন কোন সমাধান নয়। এর কারণ অনেক। একে তো স্টিং অপারেশন করে মামলায় জয়লাভ সহজ নয়, তার উপর এ ধরণের অপারেশনে নেতৃত্ব দানকারী অফিসার যদি আদালতে তার কেস জিততে ব্যর্থ হন, তিনিও ক্যারিয়ার নিয়ে ভাল সমস্যায় পড়বেন, এবং পড়েনও। আমেরিকার আইন বাংলাদেশের র‍্যাবের মত কাউকে ‘ক্রস ফায়ার’-এ মেরে ফেলে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলার মতোন নয়।  এটা বাদী-বিবাদী সবাইকেই নিজেকে ডিফেন্ড করার শক্তিশালী ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। যখন একটা স্টিং অপারেশনের মামলায় গোয়েন্দা অফিসার  যদি আদালতে জয়লাভ করতে ব্যর্থ হয়, তখন তার কাজকে অভিহিত করা হয় ‘এনট্রাপমেন্ট’ বা ‘ফাঁদে ফেলা’ হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘এনট্রাপমেন্ট’ বা ‘ফাঁদে ফেলা’ একটা ফেডারেল অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়। চাকরী নিয়েই তার টানাটানি পড়ে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের আইনে আছে [33]–

সরকারী কর্মকর্তা কোন অপরাধ সংঘটনে পরিকল্পনাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে না, কোন নিষ্পাপ ব্যক্তির মননে এমন কিছু প্রোথিত করবেন না, যাতে ঐ ব্যক্তি অপরাধে উদ্যোগী হয়ে উঠে, এবং পরে সেই অপরাধের জন্য সরকার ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন [Jacobson v. United States, 503 U.S. 540, 548 (1992)]।

অর্থাৎ, আমেরিকায় সরকারী কর্মকর্তারা একজন নিরপরাধ ব্যক্তির মনের মনে অপরাধের প্রবণতার বীজ বপন করে এবং তাকে দিয়ে অপরাধ সংঘটিত করিয়ে নিয়ে আবার তাকে আদালতের হাতে সোপর্দ করতে পারে না।  নাফিসের ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই করা হয়েছে কিনা প্রশ্ন সাপেক্ষ। এটা নিঃসন্দেহে ঠিক যে, এফবি আই কর্মকর্তারা আলকায়দা চরের ছদ্মবেশে নাফিসের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন, নাফিসও সে ফাঁদে পা দিয়েছিলেন, কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হচ্ছে ‘অপরাধ সংঘটনে পরিকল্পনাকারীর ভূমিকা’র ব্যাপারটি। এখানে কি পরিকল্পনাটি নাফিসের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল, এবং এফবিআই এর কর্মকর্তারা স্রেফ ইন্ধন যুগিয়েছিল, নাকি  এফবিআই এর পরিকল্পনা মতোই ‘কলের পুতুলের মত’ নাফিস কাজ করেছিল, সেটাই হবে আদালতের বিবেচ্য বিষয়। যদি প্রথমটি সত্য হয়, নাফিস অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হবে, আর ২য়টি হলে নাফিস তো মুক্তি পাবেনই, গোয়েন্দা অফিসারটি বরং তার ক্যারিয়ার নিয়ে ভাল সমস্যায় পড়বেন। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এ ধরণের মামলা করেও এখানে সরকার জিততে পারেনি। আবার উলটো দিকও আছে। বহু দুঁদে অপরাধী স্টিং মামলায় ধরাশায়ী হয়ে জেলের ঘানি টানছে। ঘাগু উকিল ধরেও সুবিধা করতে পারেনি। তারপরেও বহু বিদগ্ধজনের মতেই গড়পড়তা স্টিং অপারেশনের মামলায় জেতার হার অনেক কম[34]।

ফেসবুকের যে কথোপকথন এফবিআইয়ের সোর্স রেকর্ড করেছেন বলে পত্রিকায় এসেছে তা থেকে দেখা যায় গোয়েন্দা অফিসারটি নাফিসকে একটা পর্যায়ে নিরুৎসাহিত করেছিলেন এই বলে যে, ‘কোনো ব্যক্তির অন্য কোনো দেশে গিয়ে জিহাদি কার্যক্রম চালানো বৈধ নয়’।  এর উত্তরে নাফিস বলেছিলেন, যে তিনি ‘বাংলাদেশের একজনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন এবং তিনি পরামর্শ দিয়েছেন যে, ওই সব নীতি অনুসরণের বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই’। শুধু তাই নয়, অভিযোগনামাতে এও আছে যে, নাফিস বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর ক্ষেত্রে ধর্মীয় কোনো বাধা নেই’। এই অভিযোগ সত্য হলে নাফিসই উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছিল হামলাতে, যদিও আদালতে ‘এভিডেন্স এ্যাক্টের’ আওতায় ফেসবুকের কথোপকথন কিংবা অডিও ভিজ্যুয়াল এভিডেন্সের কোন মূল্য আদৌ আছে কিনা, কিংবা থাকলে কতটুকু, তা আদালতেই নির্ধারিত হবে।

নাফিসের মামলাটি যেহেতু এ মুহূর্তে আদালতে বিচারাধীন, কাজেই তিনি অপরাধী কিনা সে তর্কে না নেমে বরং আমরা বরং দেখি এই সন্ত্রাসের ভাইরাস প্রতিরোধ করা যায় কি করে।  ভাইরাস যে প্রতিরোধ করতেই হবে – এ নিয়ে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। এ ভাইরাস প্রতিরোধ না করতে পারলে এ ‘সভ্যতার ক্যান্সারে’ রূপ নিয়ে আমাদের সমস্ত অর্জনকে ধ্বংস করবে।  অর্থাৎ, এ ভাইরাসকে না থামিয়ে বাড়তে দিলে একসময় সারা দেহটাকেই সে অধিকার করে ফেলবে। এ প্রবন্ধের প্রথম দিকে দেয়া ল্যাংসেট ফ্লুক  প্যারাসাইট আক্রান্ত পিঁপড়ের উদাহরণের মত মানবজাতিও একসময় করে তুলবে নিজেদের আত্মঘাতী, মড়ক লেগে যাবে পুরো সমাজে।  তাই কি আমরা চাই?

না, কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষই তা চাইতে পারেন না। তাহলে এই সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কি? এই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য গড়ে তোলা দরকার ‘এন্টিবডি’, সহজ কথায় তৈরি করা দরকার ভাইরাস প্রতিষেধকের।  আর এই সাংস্কৃতিক ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে পারে আমার–আপনার মত বিবেকসম্পন্ন প্রগতিশীল মানুষেরাই। আমি কিন্তু আসলেই মনে করি – ‘স্টিং অপারেশন’ নয়, এই এন্টিবডি তৈরি করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সামাজিক সচেতনতা, এক্ষেত্রে বিজ্ঞান মনস্ক, যুক্তিবাদী সাইটগুলো; ভূমিকা রাখতে পারে বিশ্বাসের নিগড় থেকে বেরুনো মানবতাবাদী গ্রুপগুলো এবং  মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী ব্যক্তিবর্গের ভূমিকা হয়ে উঠবে অগ্রগন্য। দরকার সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার, দরকার খোলস ছেড়ে বেরুনোর মত সৎ সাহসের, দরকার আমার-আপনার সকলের সামগ্রিক সদিচ্ছার।  আপনার আমার এবং সকলের আলোকিত প্রচেষ্টাতেই হয়ত আমারা একদিন সক্ষম হব সমস্ত বিশ্বাস-নির্ভর ‘প্যারাসাইটিক’ ধ্যান ধারণাগুলোকে তাড়াতে, এগিয়ে যেতে সক্ষম হব বিশ্বাসের ভাইরাস-মুক্ত নীরোগ সমাজের অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে।

ড.ডেরেল রে যে কথাগুলো বলে তার ‘গড ভাইরাস’ বইটি শেষ করেছেন[35], সে কথাগুলো উচ্চারণ করে আমিও সমাপ্তি টানবো এই লেখাটির –

ভাইরাস মুক্ত জীবনের আস্বাদন কোন সুনির্দিষ্ট গন্তব্য নয়, বরং একটি চলমান যাত্রাপথের নাম।  আমরা সবাই এই ভাইরাস দিয়ে কোন না কোন ভাবে আক্রান্ত, এবং আমরা নিজেদের অজান্তেই বয়ে নিয়ে যাই অসুস্থ বিশ্বাস, মতামত কিংবা ধারণা। আমাদের অনেকের মাথাই  আক্রান্ত করে ফেলা হয়েছে আমাদের শিশু বয়সেই আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের পানপাত্র  হাতে তুলে দিয়ে।  আক্রান্ত মননকে প্রতিষেধক দিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ করে ফেলাই হবে আমাদের যাত্রাপথের লক্ষ্য। আমরা যদি ঈশ্বর-ভাইরাসের কুফলগুলো সম্বন্ধে সর্বদা সচেতন থাকতে পারি, তবেই আমরা ভাইরাস মুক্ত সমাজ প্রত্যাশা করতে পারি।

 

 


তথ্যসূত্র
[1] 9-11,  Noam Chomsky ,  Open Media/Seven Stories Press, 1 edition, October 2001
[2] Bruce Lincoln, Holy Terrors, : Thinking About Religion After September 11, University Of Chicago Press; 2 edition , 2006
[3] Last words of a terrorist, Guardian UK,  http://www.guardian.co.uk/world/2001/sep/30/terrorism.september113
[4] Is Religion Killing Us?: Violence in the Bible and the Quran, Jack Nelson-Pallmeyer, Trinity Press International, 2003
[5] The End of Faith: Religion, Terror, and the Future of Reason, Sam Harris, W. W. Norton,  2005
[6] অভিজিৎ রায় এবং রায়হান আবীর, অবিশ্বাসের দর্শন, শুদ্ধস্বর, ২০১১
[7] Richard Dawkins, What Use is Religion?, Free Inquiry magazine, Volume 24, Number 5. বাংলা – ধর্মের উপযোগিতা, মুক্তমনা
[8] Breaking the Spell: Religion as a Natural Phenomenon, Daniel C. Dennett, Viking Adult, 2006
[9] Shaoni Bhattacharya, Parasites brainwash grasshoppers into death dive, New Scientists, August 2005
[10] Bruce Lincoln, Holy Terrors: Thinking about Religion after September 11, University Of Chicago Press; 1 edition, 2003
[11] Richard Dawkins, Design for a Faith-Based Missile, Volume 22, Number 1.
[12] The Selfish Gene, Richard Dawkins, Oxford University Press, 1976
[13]  I) Richard Brodie, Virus of the Mind: The New Science of the Meme, Hay House, 2009;
II) Darrel W. Ray, The God Virus: How religion infects our lives and culture, IPC Press; First edition, December 5, 2009;
III) Craig A. James, The Religion Virus: Why We Believe in God: An Evolutionist Explains Religion’s Incredible Hold on Humanity, John Hunt Publishing, 2010
[14] United States District Court, Eastern District of New York, complaint United States of America vs. Quazi Mohammad Rezwanul Ahsan Nafis, October 17, 2012, http://cbsnewyork.files.wordpress.com/2012/10/nafis-complaint.pdf (accessed October 17, 2012)
[15] জিহাদীরা সারা বিশ্বকে দুভাগে ভাগ করে ফেলেন –‘দার আল হারব’ (non-Islamic nations) এবং ‘দার আল ইসলাম’ (Land of Peace)।  এবং তারা মনে করেন ইসলামে  ‘দার আল ইসলাম’ এর অধিবাসীদের অনুপ্রাণিত করা হয় যুদ্ধ করে যেতে যতক্ষণ না  পুরো  দার আল হারবের অধিবাসীরা আত্মসমর্পন করে সবাই ইসলামের অধীনস্থ হয়।
[16] Ibn Khaldun, The Muqaddimah: an Introduction to History, Princeton U. Press, 1969
[17] Nigel Davies, Human Sacrifice–In History and Today, William Morrow & Co; 1981
[18] Ali Dashti, Twenty Three Years: A Study of the Prophetic Career of Mohammad, Mazda Pub, 1994
[19] এম এ খান, জিহাদ : জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার, বদ্বীপ প্রকাশন, ২০১০।
[20] ইবনে সাদের প্রথম দিককার জীবনী-সঙ্কলন কিতাব আত তাবাকাত (Kitaab at Tabaqaat al Kabeer) থেকে জানা যায়, মহানবী তার শেষ দশ বছরে অন্ততঃ ৭৪ টি ‘হামলা যুদ্ধ’ (আরবীতে গাজওয়া) সম্পন্ন করেছিলেন। আল তাবারি নবী মুহাম্মদ (দঃ) তাঁর জীবনে ঘটা যে ষাটটি যুদ্ধের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন তার ‘তারিক আল রসুল ওয়া আল মুল্লুক’ গ্রন্থে, এর মধ্যে উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধ ছাড়া সবগুলোই ছিল আক্রমণাত্মক।
[21] Ibn Ishaq, The Life of Muhammad, trs. A Guillaume, Oxford University Press, Karachi, 2004 imprint, p545
[22] Tabari, Abu Ja’far Muhammad b. Jarir, “The Victory of Islam”, vol viii, pp.35-36
[23] K. Armstrong Muhammad: A Western Attempt to Understand Islam, Gollanz, 1991, London, p. 207.
[24] এম এ খান, জিহাদ, পূর্বোক্ত।
[25] ভবঘুরে, নাফিস কি একজন বিভ্রান্ত মৌলবাদি সন্ত্রাসী নাকি সাচ্চা মুসলমান?, মুক্তমনা
[26] অবিশ্বাসের দর্শন, প্রাগুক্ত।
[27] বিশ্বাসের ভাইরাস এবং আনুষঙ্গিক, দিগন্ত সরকার, মুক্তমনা, http://mukto-mona.com/banga_blog/?p=325
[28]  In the Name of History Examples from Hindutva-inspired school textbooks in India, Online: http://www.sacw.net/HateEducation/Teesta.html
[29] Victor J. Stenger, God and the Folly of Faith: The Incompatibility of Science and Religion, Prometheus Books, 2012
[30] আদিল মাহমুদ, ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার সরল পাঠ-১, মুক্তমনা।
[31] Kayes Ahmed, alif for Allah, bay for Bondook!, Opinion bdnews24.com; http://opinion.bdnews24.com/2012/06/02/alif-for-allah-bay-for-bondook/
[32] JESSICA ZUCKERMAN, Fifty-Third Terror Plot Foiled Since 9/11; http://www.themoralliberal.com/2012/10/19/fifty-third-terror-plot-foiled-since-911/
[33] Entrapment is a complete defense to a criminal charge, on the theory that “Government agents may not originate a criminal design, implant in an innocent person’s mind the disposition to commit a criminal act, and then induce commission of the crime so that the Government may prosecute.” Jacobson v. United States, 503 U.S. 540, 548 (1992); http://www.justice.gov/usao/eousa/foia_reading_room/usam/title9/crm00645.htm
[34] এ প্রসঙ্গে মুক্তমনায় প্রকাশিত কাজী রহমানের ‘নাফিস সন্ত্রাস আমেরিকা’ লেখাটিতে সংশপ্তক-এর মন্তব্যগুলো এবং এ সংক্রান্ত আলোচনাগুলো দ্রষ্টব্য; http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=30788#comment-98809
[35] Darrel W. Ray, The God Virus: How religion infects our lives and culture, IPC Press; First edition, December 5, 2009

* ইউটিউবে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস সংক্রান্ত কিছু আলোচনা:
Dan Dennett: Dangerous memes
Richard Dawkins : The Virus of Faith
Darrell Ray : The God Virus: The Concept Of Memes

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

31 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
31
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.