নির্মল সেনের সাহায্যে এগিয়ে আসুন


প্রথিতযশাঃ সাংবাদিক,রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট এবং মুক্তিযোদ্ধা নির্মল সেন অসুস্থ অবস্থায় ল্যাব এইড হাসপাতালে দিন কাটাচ্ছেন তা বোধ হয় সবাই সম্যকভাবে অবগত। ২০০৩ সালে ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে নির্মল সেন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সিঙ্গাপুরে। সে সময় ঘটনাক্রমে আমি নিজেই সিঙ্গাপুরে অবস্থান করেছিলাম। নিজের সাধ্যমত যতটুকু পারি নির্মল সেনের জন্য করার চেষ্টা করেছিলাম। প্রায় প্রতিদিনই দেখা করতে যেতাম মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। খুব একটা যে কিছু করতে পেরেছিলাম তা নয়। ভেবেছিলাম দেশে ফেরার পর বোধ হয় তার স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে। কিন্তু তা হয়নি। বাংলাদেশে আসার পর নির্মল সেনের অবস্থার ক্রম অবনতিই হয়েছে বলা যায়। বিপ্লব রহমান তার একটি পোস্টে আপডেট দিয়েছেন যে, নির্মল সেন তার দৃষ্টিশক্তি প্রায় হারাতে বসেছেন। তার হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে। কথা অস্পষ্ট ও জড়ানো। ঘনিষ্টজন ছাড়া তার কথার মর্মার্থ উদ্ধার করা কঠিন।

অর্থিক সঙ্গতি না থাকায় নির্মল সেন গত দুই মাস আগে ঢাকার নয়াপল্টনের বাসা ছেড়ে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া তার গ্রামের বাড়ীতে অবস্থান করছিলেন । পরে তাঁর দুর্দশার খবর মিডিয়ায় প্রচারিত হলে চিকিৎসা সহায়তায় এগিয়ে আসে ল্যাব এইড কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তার সার্বিক চিকিৎসা সুসম্পন্ন করার জন্য এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ের অর্থায়নের ব্যাপারটা রয়েই যাচ্ছে। এ ব্যাপারে মুক্তাঙ্গন ব্লগের লেখক এবং পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে।

যারা নির্মল সেনের জন্য অর্থ সাহায্য করতে ইচ্ছুক, তারা নীচের দু্টো লিঙ্কের যে কোন একটির সাহায্য নিতে পারেন –

Please Help Nirmal Sen
আমার বন্ধু নির্মল সেন : স্বস্তিতে নেই

বিনীত,
অভিজিৎ

অভিজিৎ

মূলতঃ বিজ্ঞান এবং দর্শনের প্রান্তিক বিষয় নিয়ে লেখালিখি করি।

৪ comments

  1. kamruzzaman Jahangir - ৩ মে ২০১০ (৯:১৫ অপরাহ্ণ)

    এমন কষ্টের, বেদনার, হাহাকারময় সংবাদও আমরা ক্রমাগত পাঠ করি_এমন এক দ্রোহ চিকিৎসাপ্রণালী থেকে বঞ্চিত!!! এই আমার দেশ, এই আমার রাষ্ট্র?
    নির্মলদা, আপনাকে আমরা ভালোবাসার চেয়েও ভালোবাসি।
    আপনি সুস্থ হয়ে এগোন।

  2. মাসুদ করিম - ৫ মে ২০১০ (৮:৩০ পূর্বাহ্ণ)

    বাংলাদেশ থেকে যারা সরাসরি ব্যাংক ড্রাফট/ ক্রস চেক/ মানিগ্রাম পাঠাতে চান তারা যোগাযোগ করুন –
    অধ্যাপক অজয় রায়
    ২/ এফ, ইস্টার্ন হাউজিং অ্যাপার্টমেন্ট, ১০২-৪ এলিফ্যান্ট রোড,
    বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭
    বাংলাদেশ।
    ফোন: ৯৩৫ ০৯ ০৭/ ০১৭৪ ৭৯ ৭৭ ৩২১

    সাথে কোনো অনলাইন ব্যাংকের কোনো অ্যাকাউন্ট নম্বর দিতে পারলে অর্থ সাহায্য পাঠানো হয়তো আরো সহজ হত।
    আর এসব পড়লে শুনলে মনে হয় ‘সততাই সতত দুঃখের কারণ’। আমাদের দেশে সৎ ও যোগ্য সাংবাদিকতার এটাই প্রতিদান!

  3. মাসুদ করিম - ৮ জানুয়ারি ২০১৩ (৭:২১ অপরাহ্ণ)

    আজ ০৮ ডিসেম্বর ২০১২, তিনি আমাদের বিদায় জানালেন। নির্মল সেন আর নেই

  4. মাসুদ করিম - ১৩ জানুয়ারি ২০১৩ (১:৫৪ পূর্বাহ্ণ)

    নির্মল সেনের মৃত্যুতে আবদুল গাফফার চৌধুরীর শোকলেখন।

    নির্মলদা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চেয়েছিলেন

    নির্মল সেন, আমাদের সর্বজনীন নির্মলদাও চলে গেলেন। ৮২ বছর বয়সে মৃত্যু হলো। কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যু হলো কি? দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন সন্ত্রাস, হত্যার রাজনীতির শুরু, তখন তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চেয়ে একটি বিখ্যাত কলাম লিখেছিলেন। এই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি তিনি চেয়েছিলেন দেশের সকল মানুষের জন্য। কেবল নিজের জন্য নয়। দেশের কোনো সরকার আজ পর্যন্ত তার এই দাবি পূরণ করতে পারেনি। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড তার সাম্প্রতিক প্রমাণ।
    ৮২ বছর বয়সে নির্মলদার মৃত্যুকে পরিণত বয়সের স্বাভাবিক মৃত্যু বলতাম, যদি মৃত্যুর দীর্ঘকাল আগেই রোগ জর্জরিত দেহে তাকে স্বাভাবিক জীবন থেকে অবসর নিতে না হতো। গত নভেম্বর মাসের শেষ দিকেই সম্ভবত তাকে ঢাকার হাসপাতালে এনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে (ওঈট) রাখা হয়। তখন আমিও ঢাকায়। তার শুভাকাঙ্ক্ষী ও চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপ করে বুঝেছিলাম, তিনি তখনই জীবন্মৃত। লাইফ সাপোর্ট মেশিনে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। বেঁচে ওঠার আশা নেই।
    এই আশঙ্কাটাই সত্য করে ৮ জানুয়ারি (২০১৩) মঙ্গলবার তিনি চলে গেলেন। তার আগে ১৮ ডিসেম্বর মঙ্গলবার আমার স্ত্রী সেলিমা আফরোজ চৌধুরীও লন্ডনের হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। আমি যখন শোক জর্জরিত তখন নির্মলদার মৃত্যুর খবর পাই। মনে হলো, ডিসেম্বর (২০১২) এবং জানুয়ারির (২০১৩) দুটি মঙ্গলবার আমার হৃদয়ের শিকড় উৎপাটন করেছে। নির্মলদা আমার কৈশোরকাল থেকে শুধু অগ্রজ, বন্ধু ও সমপেশাজীবী ছিলেন না, ছিলেন আমার পরিবারের একজন নিকটাত্মীয়। নির্মলদা যখন রোগ জর্জরিত দেহে কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে নিজের গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়ে বাস করছেন, তখন ঢাকা থেকে পরিচিত কেউ আমাদের লন্ডনের বাসাতে এলেই আমার স্ত্রী জিজ্ঞাসা করতেন, নির্মলদা কেমন আছেন?
    পরিণত বয়সে মৃত্যু হলেই তা স্বাভাবিক মৃত্যু হবে এমন কোনো কথা নেই। নির্মলদারও স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। এ কথা সত্য, তিনি সন্ত্রাস বা রাজনৈতিক হত্যার বলি হননি। কিন্তু রাজনৈতিক উপেক্ষার বলি হয়েছেন। যে দেশের স্বাধীনতা ও শান্তির জন্য তিনি আজীবন লড়াই করেছেন, সেদেশের বিভিন্ন সরকারের কাছ থেকে তিনি প্রাপ্য সম্মান, সাহায্য ও সহযোগিতা পাননি। যে যৎসামান্য সাহায্য ও সহযোগিতা পেয়েছেন, তা তার সুচিকিৎসা, নিশ্চিত জীবনযাপনের কোনো নিশ্চয়তা দেয়নি। গত ৮ জানুয়ারি ৮২ বছর বয়সে তিনি শুধু দেহত্যাগ করেছেন। কিন্তু তার দেহটি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে জীবন্মৃত অবস্থায় ছিল বহুকাল আগে থেকেই। তার সুচিকিৎসা হয়নি। অর্থাভাবে তাকে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে হয়েছে। তারপরও নিদারুণ অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছে। শেষ জীবনে যখন তিনি লিখতে পারেন না, তখনও তাকে অন্যকে ডিকটেশন দিয়ে কলাম লিখতে হয়েছে শুধু অর্থকষ্ট ঘোচাবার জন্য। মৃত্যুকালেও তার চিকিৎসায় অর্থ সংকট ছিল।
    এই চিরকুমার, বোহেমিয়ান প্রকৃতির আত্মভোলা মানুষটির চরিত্র ছিল তার অভাব ও অর্থকষ্টের একটি কারণ। দৈনিক বাংলা (সাবেক দৈনিক পাকিস্তান) বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি তার চাকরিহারা সাংবাদিক হিসেবে যে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন, তার পরিমাণ মোটামুটি খারাপ ছিল না। কিন্তু তিনি তা অকৃপণ হাতে ব্যয় করেছেন তার শ্রমিক কৃষকের রাজনীতিতে এবং নারী শিক্ষায় সাহায্যদানে। এক সময় দেখা গেল তার নিজের চিকিৎসায় অর্থ নেই, তার নিশ্চিত জীবনযাপনেরও অর্থ নেই।
    সরকার তার চিকিৎসায় মাঝে মধ্যে সাহায্য দিয়েছে, তা প্রতুল ছিল না এবং দীর্ঘকালীন প্রয়োজনীয় চিকিৎসা চালানোর মতো যথেষ্টও ছিল না। শেষ জীবনে তাকে আত্মীয়-স্বজনের ওপর নির্ভর করে শুধু বেঁচে থাকার জন্য গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে হয়। দীর্ঘকাল রোগশোক ও অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত অন্তিমকালে দাতব্য চিকিৎসার জন্য মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো শহরের হাসপাতালে কিছুকাল জীবন্মৃত অবস্থায় থেকেছেন। তারপর মৃত্যুবরণ। এটাকে কি আমি তার স্বাভাবিক মৃত্যু বলে স্বীকার করে নেব?

    কৈশোর জীবন থেকে তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং পাকিস্তান আমলে স্বাধীনতার আন্দোলনে জড়িত। ১৯৪৮ সালেই তিনি ভাষা আন্দোলনে জড়িত হন। একদিকে বামপন্থি রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন, অন্যদিকে জীবিকার জন্য সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভাষা ও গণরাজনীতি সংক্রান্ত এমন কোনো আন্দোলন নেই, যার সঙ্গে নির্মল সেনের যোগ ছিল না। তিনি এক সময় ভারতের রেভল্যুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টির (আরএসপি) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল নামে নিজেই একটি বামপন্থি রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
    তার রাজনৈতিক দল ও রাজনীতির সঙ্গে অনেকেই সহমত পোষণ করতে না পারেন, কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে তার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম এবং একজন জাতীয় নেতা হিসেবে বহু আগে তার স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল। তিনি তা পাননি। শুধু একজন জাতীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়া নয়, ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা আন্দোলনেও তার দীর্ঘকালের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও পুরস্কার পাননি। অথচ এ স্বীকৃতি পাওয়া ছিল তার স্বাভাবিক অধিকার।
    ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি জড়িত ছিলেন। অথচ একুশে পদক তিনি পাননি। তিনি পাকিস্তান আমলে যখন কলেজের ছাত্র, তখন বরিশালে একটি খাদ্য আন্দোলনে যোগ দিতে গিয়ে দীর্ঘ সাত বছর কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে তার স্বীকৃতি নেই কোথাও। সাংবাদিক হিসেবে তার অবদান, কলামিস্ট হিসেবে তার খ্যাতি অনস্বীকার্য। সাহিত্য চর্চাও করেছেন। তার সাহিত্যিক পেন নেম এক সময় ছিল আমিন। অথচ বাংলা একাডেমী ভুলেও তাকে সাহিত্যে বা সাংবাদিকতায় একাডেমী পুরস্কার দেওয়ার কথা ভাবেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি উল্কার মতো মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ফ্রন্টে ঘুরে বেরিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতা পুরস্কার তার কপালে জোটেনি। কত রাম রহিম যদুমধু এই পুরস্কার পেয়েছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীরাও পেয়েছেন।
    সম্ভবত এই কারণেই প্রচণ্ড অভিমান থেকে তিনি তার পরিবারের সদস্যদের নির্দেশ দিয়ে গেছেন, তাকে রাষ্ট্র বা সরকার কোনো মরণোত্তর পুরস্কার দিলে তা যেন গ্রহণ করা না হয়। নির্মল সেন এই একটি নাম শুধু বাংলাদেশে নয়, পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজনীতিক মহলেও এমন সুপরিচিত এবং প্রায় কিংবদন্তিতুল্য যে, রাষ্ট্রীয় বা সরকারি স্বীকৃতি ও পুরস্কার লাভ তার প্রয়োজন আর নেই। বাংলাদেশে সকল দলীয় পার্থক্যের ঊধর্ে্ব তিনি সকল দল ও মতের মানুষের কাছে ‘নির্মলদা’ হয়ে উঠেছিলেন। গণরাজনীতির বন্ধু ও পথিকৃৎ বলে পরিচিতি ও স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। তার কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও পরিচিতির প্রয়োজন নেই।
    নির্মলদার সঙ্গে আমার পরিচয় বরিশালে আমার স্কুলজীবনে। তিনি তখন বরিশালে ব্রজমোহন কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্সের ছাত্র। তিনি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার সন্তান। কিন্তু কলেজের লেখাপড়া করেছেন বরিশালে। অবিভক্ত বাংলায় নিখিল বঙ্গ ছাত্র কংগ্রেস তখন দু’ভাগে বিভক্ত। একটি পরিচিত ছিল কলকাতার মির্জাপুর স্ট্রিট ছাত্র কংগ্রেস এবং অন্যটি পরিচিত ছিল কর্নওয়ালিস স্ট্রিট ছাত্র কংগ্রেস নামে। এই মির্জাপুর ছাত্র কংগ্রেস ছিল প্রধানত বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল বা আরএসপির নিয়ন্ত্রণে। নির্মলদা বরিশালে এই মির্জাপুর স্ট্রিট ছাত্র কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
    বরিশালে তখন আরএসপি দলের প্রচণ্ড দাপট। আমিও ছাত্রজীবনেই আরএসপি রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হই এবং এই দলের ছাত্রফ্রন্টের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ি। ফলে নির্মলদার সঙ্গে বয়সের পার্থক্য এবং আমি স্কুলছাত্র এবং তিনি কলেজছাত্র হওয়া সত্ত্বেও দু’জনের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বরিশালে সেই আমলে নির্মলদার সঙ্গে আমি বহুদিন আরএসপির সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘গণবার্তা’ (কলকাতা থেকে প্রকাশিত) বিক্রি করার জন্য বরিশালের স্টিমার ঘাটে সন্ধ্যার পর ঘুরে বেরিয়েছি।
    ফলে আমার কৈশোরকাল থেকেই তার রাজনীতি অত্যন্ত কাছ থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়েছিল। নির্মলদা প্রথম জীবনে ছিলেন ঘোরতর বিপ্লবী বামপন্থি, সশস্ত্র শ্রেণীযুদ্ধ ছাড়া যে গণমানুষের মুক্তি নেই এবং শ্রেণীযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী এই তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন। সে সময় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (অবিভক্ত) এবং বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের (আরএসপি) মধ্যে ছিল ঘোরতর তাত্তি্বক যুদ্ধ। ‘৪২-এর আগস্ট আন্দোলনের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা গ্রহণ এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতাকে আরএসপি তীব্র সমালোচনা করত। পরবর্তীকালে ভারত-ভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থনদানের তীব্র ও কঠোর সমালোচনায় ভর্তি থাকত গণবার্তার প্রতিটি পৃষ্ঠা।
    ১৯৪৭ সালে যখন ভারত-ভাগ হয় এবং পাকিস্তানের জন্ম হয়, তখন বরিশালে কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে পাকিস্তান পতাকা উত্তোলন করা হয়। কিন্তু আরএসপি অফিসে করা হয়নি। কমিউনিস্ট পার্টি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম দিকে কোনো প্রকার আন্দোলনে না নামার সিদ্ধান্ত নেয়। আরএসপি গোড়া থেকেই আন্দোলন গড়ে তোলার দিকে এগোয়। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে বরিশালে আরএসপি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় এবং খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে শহরে একটি মিছিল বের করার আয়োজন করে। আরএসপির এই মিছিল থেকেই দলটির তখনকার নেতা মোজাম্মেল হক (১৯৬৫ সালে কায়রো বিমান দুর্ঘটনায় নিহত) ও আবদুল খালেক খানসহ কলেজ-ছাত্র নির্মল সেনও গ্রেফতার হন। দীর্ঘ সাত বছর তাকে জেলে কাটাতে হয়।
    ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বিজয়ের ফলে অন্য রাজবন্দিসহ নির্মল সেন মুক্তি পান। তখন তিনি আর সাত বছর আগে সুদর্শন তরুণ নন। দীর্ঘ জেলভোগের ফলে সারাদেহে অসুস্থতার চিহ্ন। আমি দীর্ঘকাল পর তাকে দেখে বিস্মিত হয়েছি।
    ঢাকায় বসবাস শুরু করে তিনি গৃহশিক্ষকতার কাজ নেন। তিনি কমিউনিস্ট দলের ছাত্রফ্রন্ট ছাত্র ইউনিয়নে যোগ না দিয়ে সদ্য অসাম্প্রদায়িক হওয়া ছাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুনর্গঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে যোগ দেন। ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ব্যাপারে নির্মলদার অবদান প্রচুর।
    এরপর কেন তিনি আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে যোগ না দিয়ে নিজস্ব শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল গঠন করলেন তা আমার জানা নেই। সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ও সমাজ বিপ্লবে তার অবিচল আস্থা ছিল। কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জনে বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মঞ্চ আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে এবং গণরাজনীতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে একটি ছোট বাম দলের নেতা হয়ে বাকি সারাটা জীবন কেন কাটালেন তা নিয়ে তার সঙ্গে বহুবার আমার কথা হয়েছে। তার যুক্তি আমি মেনে নিতে পারিনি। আইয়ুব জমানার প্রেস ট্রাস্টের কাগজে তিনি সাংবাদিকতা করেছেন তা আমার কাছে বিসদৃশ মনে হয়নি। কিন্তু এরশাদ আমলে তিনি যখন প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার উদ্যোগ নেন, তখন তার কার্যকারণ আমি বুঝতে পারিনি। আমি তার সমালোচনাও করেছিলাম।
    মতান্তর সত্ত্বেও তার সঙ্গে আমার কখনও মনান্তর হয়নি। আমি তাকে কৈশোরকাল থেকে শ্রদ্ধা করেছি এবং তারও অকৃপণ ও আন্তরিক স্নেহ সবসময় ভোগ করেছি। লন্ডনে বসে তার মৃত্যুসংবাদ শুনে পরম আত্মীয়-বিয়োগ ব্যথা অনুভব করেছি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন একটি একক দেবদারু বৃক্ষ। এই বৃক্ষের পতনের শূন্যতা বহুদিন পূরণ হবে না। তার সঙ্গে আমার জীবনের বহু স্মৃতি। তা নিয়ে একটি আলাদা প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছা রইল।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.