(লেখাটি একটি ভিন্ন শিরোনামে আমি আমার ব্লগসাইটে পোস্ট করেছি। আশা করব, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনায় এডমিন লেখাটিকে মুক্তাঙ্গনের নীতির পরিপন্থি বলে বিবেচনা করবেন না। সম্প্রতি মুক্তাঙ্গনের পক্ষ থেকে ওয়ার ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ের দলিলাদি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমি মনে করি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস নিয়ে যারা ভবিষ্যতে গবেষণা করবেন, যারা উইকিপিডিয়াতে কিংবা অন্যান্য জায়গায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাসকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে সন্নিবেশিত করতে চান – তাদের কাছে এই দলিলটি একদিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলেই আমার বিশ্বাস)।
বাঙালি বড় বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি। নিজেদের ইতিহাস ভুলে বসে থাকে। কখনো বিকৃতও করে অহর্নিশি। বাঙালি বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে, স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে, শেখ মুজিবের অবদান নিয়ে… এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে বাঙালি বিতর্ক করে না। সেই বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি হিসেবে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করি, উল্লাসে একে অভিহিত করি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে, কিন্তু আমরা সত্যই কি জানি একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হবার ইতিহাসটুকু?
ইন্টারনেটে সার্চ করুন। এ নিয়ে কোন তথ্যই আপনি পাবেন না। এমনকি আন্তজার্তিক ভাবে পালিত ইউনেস্কোর পোষ্টার লিফলেট কিংবা নিউজ লেটারে কোথাও বাংলাদেশের ১৯৫২ সনের এই আত্মত্যাগের সংবাদটি আপনার চোখে পড়বে না। বাহান্নের কথা নাহয় বাদই দিন। এমনকি আপনি জানবেন না কিভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারির এই দিনটি কোন যাদুবলে হঠাৎ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়ে গেল ২০০০ সাল থেকে। জানার কোন উপায় নেই – কারা ছিলো এর পেছনে। ব্যতিক্রম বোধ হয় শুধু এই লেখাটি। হাসান মাহমুদের (ফতেমোল্লার) The Makers of History: International Mother Language Day নামের এই লেখায় ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে কি অক্লান্ত পরিশ্রম করে দু’জন পরবাসী বাঙালি একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরিণত করেছিলেন। ছোট্ট একটা লেখা ইংরেজীতে। কিন্তু অসামান্য দলিল। দলিলটি হারিয়ে যাবার আগেই আমার মনে হল একুশে ফেব্রুয়ারির এই দিনে সেই গৌরবময় উপাখ্যানটুকু বাংলায় বয়ান করা যাক।
বিগত নব্বই দশকের শেষ দিক। সবকিছুর পুরোধা ছিলেন রফিক (রফিকুল ইসলাম) নামের এক ক্যানাডা নিবাসী বাঙালি। চেহারা ছবিতে অসাধারাণ কিছু মনে হবে না দেখলে। চিরায়ত বাঙালি চেহারা, আলাদা কোন বিশেষত্ব চোখে মুখে নেই। কিন্তু যে কেউ একটু কথা বললেই বুঝবেন যে সাধারণ এই লোকটির মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অমিত শক্তির স্ফুরণ। একসময় মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, দেশ-মাতৃকাকে মুক্ত করেছেন না-পাক বাহিনীর হাত থেকে। তো এই লোকটি একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরিণত করার সম্মুখ যোদ্ধা হবেন না তো কে হবেন?
১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে এক রফিক পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়ে একুশে ফেব্রুয়া্রিকে অমর করেছিলেন। তার ৪৬ বছর পরে আরেকজন রফিক সুদূর কানাডায় বসে আরেক দুঃসাহসী কাজ করে ফেললেন ।
১) ১৯৯৮ সালের ৯ই জানুয়ারী রফিক জাতিসংঘের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারী কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে রফিক ১৯৫২ সালে ভাষা শহীদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে কফি আনানকে প্রস্তাব করেন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘মাতৃভাষা দিবস’হিসেবে যেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
২) সে সময় সেক্রেটারী জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসেবে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের (যিনি একজন সাহিত্যিক হিসেবেও পরিচিত) নজরে এ চিঠিটি আসে। তিনি ১৯৯৮ সালের ২০ শে জানুয়ারী রফিককে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন।
৩) সেই উপদেশ মোতাবেক রফিক তার সহযোদ্ধা আব্দুস সালামকে সাথে নিয়ে “এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওর্য়াল্ড” নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান। এতে একজন ইংরেজীভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিজভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন। তারা আবারো কফি আনানকে “মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভারস অফ দ্যা ওর্য়াল্ড”(Mother Language Lovers of the World)-এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন, এবং চিঠির একটি কপি ইউএনওর ক্যানাডিয়ান এম্বাসেডর ডেভিড ফাওলারের কাছেও প্রেরণ করেন।
৪) এর মধ্যে একটি বছর পার হয়ে গেলো। ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে হাসান ফেরদৌস সাহেব রফিক এবং সালামকে উপদেশ দেন ইউনেস্কোর ভাষা বিভাগের জোশেফ পডের সাথে দেখা করতে। তারা জোশেফের সাথে দেখা করার পর জোশেফ তাদের উপদেশ দেন ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সাথে দেখা করতে। এই আনা মারিয়া নামের এই ভদ্রমহিলাকে আমরা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করবো, কারণ এই ভদ্রমহিলাই রফিক-সালামের কাজকে অনেক সহজ করে দেন। আনা মারিয়া রফিক-সালামের কথা মন দিয়ে শোনেন এবং তারপর পরামর্শ দেন তাদের প্রস্তাব ৫ টি সদস্য দেশ – ক্যানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা আনীত হতে হবে।
৫) সে সময় বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী এম এ সাদেক এবং শিক্ষা সচিব কাজী রকিবুদ্দিন, অধ্যাপক কফিলউদ্দিন আহমেদ, মশিউর রহমান (প্রধানমন্ত্রীর সেক্রেটারিয়েটের তৎকালীন ডিরেক্টর), সৈয়দ মোজাম্মেল আলি (ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত), ইকতিয়ার চৌধুরী (কাউন্সিলর), তোজাম্মেল হক (ইউনেস্কোর সেক্রেটারি জেনেরালের শীর্ষ উপদেষ্টা) সহ অন্য অনেকেই জড়িত হয়ে পড়েন।তারা দিন রাত ধরে পরিশ্রম করেন আরো ২৯ টি দেশকে প্রস্তাবটির স্বপক্ষে সমর্থন আদায়ে। অন্যান্য বাংলাদেশী এবং প্রবাসীদের কাছে ব্যাপারটা অগোচরেই ছিল- পর্দার অন্তরালে কি দুঃসাহসিক নাটক চলছিলো সে সময়। এই উচ্চাভিলাসী প্রজেক্টের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা এবং ক্যানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরের জনা কয়েক লোক কেবল ব্যাপারটা জানেন, এবং বুকে আশা নিয়ে তারা সেসময় স্বপ্নের জাল বুনে চলেছেন প্রতিদিন।
৬) ১৯৯৯ সালের ৯ ই সেপ্টেম্বর। ইউনেস্কোর প্রস্তাব উত্থাপনের শেষ দিন। এখনো প্রস্তাব এসে পৌঁছায়নি। ওদিকে রফিক সালামেরা ব্যাপারটি নিয়ে বিনিদ্র রজনী অতিক্রম করে চলেছেন। টেলিফোনের সামনে বসে আছেন, কখনো চোখ রাখছেন ইমেইলে। আসলে প্রস্তাবটির পেছনে প্রধাণমন্ত্রীর একটি সই বাকি ছিলো। আর প্রধানমন্ত্রী তখন পার্লামেন্টে। পার্লামেন্টের সময়সূচীর পরে সই করতে করতে প্রস্তাব উত্থাপনের সময়সীমা পার হয়ে যাবে। সেটা আর সময় মত ইউনেস্কো পৌঁছুবে না। সব পরিশ্রম জলেই যাবে বোধ হয়।
৭) প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে অনুরোধ করা হলো তিনি যেন প্রস্তাবটি সই করে ফ্যাক্স করে দেন ইউনেস্কোর দপ্তরে। অফিসের সময়সীমা শেষ হবার মাত্র একঘণ্টা আগে ফ্যাক্সবার্তা ইউনেস্কোর অফিসে এসে পৌঁছুলো।
৮) ১৬ই নভেম্বর কোন এক অজ্ঞাত কারণে (সময়াভাবে ?) বহুল প্রতাশিত প্রস্তাবটি ইউনেস্কোর সভায় উত্থাপন করা হলো না। রফিক সালামেরা আরো একটি হতাশ দিন পার করলেন।
৯) পর দিন – ১৭ই নভেম্বর, ১৯৯৯। এক ঐতিহাসিক দিন। প্রস্তাব উত্থাপন করা হলো সভার প্রথমেই। ১৮৮ টি দেশ এতে সাথে সাথেই সমর্থন জানালো। কোন দেশই এর বিরোধিতা করলোনা, এমনকি খোদ পাকিস্তানও নয়। সর্বসম্মতিক্রমে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গৃহীত হলো ইউনেস্কোর সভায়।
এভাবেই একুশে ফেব্রুয়ারি একটি আন্তর্জাতিক দিনে পরিণত হলো। কিন্তু এতো কিছুর পরেও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূল উদ্যোক্তা রফিক এবং সালাম সবার কাছে অচেনাই রয়ে গেলেন। তাদের ত্যাগ তিতিক্ষা আর পরিশ্রম অজ্ঞাতই থেকে গেল। কেউ জানলো না কি নিঃসীম উৎকন্ঠা আর আশায় পার করেছিলেন তারা ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসের শেষ ক’টি বিনিদ্র রজনী। কেউ জানলো না, কিভাবে সমর্থন যুগে চলেছিলেন তাদের স্ত্রী, পরিবার, এবং কাছের বন্ধু বান্ধবেরা। কত অজ্ঞাতকূলশীলেরাই বাংলা একাডেমি পদক, একুশে পদক পেয়ে যান এই অভাগার দেশে আর রফিক সালামেরা উপেক্ষিতই থেকে যান।
আমরা কি সবাই মিলে আগামী বছরের জন্য রফিক সালাম নামে কানাডা নিবাসী দুই ভাষা সৈনিকের নাম একুশে পদকের জন্য প্রস্তাব করতে পারি?
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২০ comments
ব্লাডি সিভিলিয়ান - ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১:২৭ অপরাহ্ণ)
প্রথম আলোর শনিবারের সাময়িকী ‘ছুটির দিন’-এ কানাডাপ্রবাসী সুব্রত মিত্র/নন্দী-র একটি লেখা পড়লাম। পড়ে জানা গেল, তাঁরা এখনো কানাডায় একটি শহিদ মিনার তৈরি করতে পারেন নি। সবচাইতে ভয়াবহ ব্যাপার, তাঁদের এই উদ্যোগের বিরোধিতা করে কিছু বাঙালি মেয়রের কাছে ই-মেল করেছে, চিঠি পাঠিয়েছে…স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
যে একবার মুক্তিযোদ্ধা, সে চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা নয়; যে একবার রাজাকার, সে চিরকাল রাজাকার।
রেজাউল করিম সুমন - ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৫:৪৩ অপরাহ্ণ)
অসংখ্য ধন্যবাদ এই লেখাটির জন্য। উইকিএডুকেটর-এ এই পৃষ্ঠাটি পাওয়া গেল। শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০০৮-এ নেদারল্যান্ডস-এর বাংলাদেশ দূতাবাস এই পত্রাণুটি প্রকাশ করেছিল।
ইরাকের কারবালা, পাকিস্তানের পেশোয়ার, ভারতের মুম্বাই, তামিলনাড়ু এবং আর্মেনিয়া সহ বিশ্বের নানান জায়গায় এই দিবসটি উদ্যাপনের কথা জেনে ভালো লাগল। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, সব দেশেই কি উদ্যাপিত হচ্ছে?
মোহাম্মদ মুনিম - ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৫:২৪ পূর্বাহ্ণ)
গুগল সার্চ দিয়ে আরও দুএকটি জায়গাতে উদযাপনের খবর দেখলাম। খুব বেশি জায়গাতে পালন করা হয়নি বোঝাই যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে মাতৃভাষা দিবস তাদের নিজের গরজেই পালন করা উচিত। প্রতি বছরই পত্র পত্রিকায় বাংলাদেশের বিভিন্ন দুতাবাসের এই নিয়ে উদাসিনতার অভিযোগ উঠে। দিবসটি যেহেতু জাতিসংঘ স্বীকৃত, তাদেরই উচিত এই দিবস নিয়ে প্রচার প্রচারণা চালানো।
মাতৃভাষার ব্যাপারটা যুক্ত্ররাষ্ট্রেও একটা ইস্যু হয়ে উঠছে,যুক্ত্ররাষ্ট্রে জনসংখ্যার প্রায় পনের ভাগই হিস্প্যানিক, যাদের মাতৃভাষা স্প্যানিশ। হিস্পানিকদের জন্মহার অধিক হওয়াতে আর অভিবাসিদের বড় অংশও হিস্পানিক হওয়াতে অচিরেই তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠবে, আর সেই সাথে সরকারি কাজকর্ম স্প্যানিশ ভাষায় করার দাবি উঠবে। এক দেশে দুই রাষ্ট্রিয় ভাষার এই ব্যাপারটি যুক্তরাষ্ট্রের সংহতি নষ্ট করতে পারে। তাই বছর তিনেক আগে টেক্সাসের একটি ছোট শহর (ফারমার’স ব্রাঞ্চ) ইংরেজীকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষনা করে। তাদের ঘোষনাটির লিঙ্ক এখানে।
ইমতিয়ার - ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (২:৪৩ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ অভিজিৎ, আপনার উপসংহারের সঙ্গে নিশ্চয়ই কেউই দ্বিমত করবেন না যে রফিক ও সালামকে এই উদ্যোগের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া উচিত।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অর্জনের কিছু বিষয় নিয়ে ইতিমধ্যেই আপনার লেখায় উল্লেখিত ইকতিয়ার চৌধুরী একটি বই লিখেছেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বাকি ইতিহাস নামে। ভূমিকায় তিনি উল্লেখ করেছেন, এ নিয়ে বই লেখার কোনও ইচ্ছে তার ছিল না। কিন্তু ইতিমধ্যেই তথ্যবিকৃতি শুরু হয়েছে (তিনি এর কয়েকটি জোরালো উদাহরণও দিয়েছিলেন) বিধায় তিনি বইটি লিখেছেন। বইটি বেরিয়েছে আগামী প্রকাশনী থেকে।
ওই বইয়ের সূত্রে কয়েকটি জরুরি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি :
১. ইউনেস্কোতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রস্তাব কেবল বাংলাদেশ তোলেনি। প্রস্তাবটি যৌথভাবে উত্থাপন করে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব। শুধুমাত্র বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে তার পরিণতি অন্যরকম হওয়ার আশংকা ছিল। সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূতের নৈকট্য যৌথ উত্থাপনের বিষয়টিকে ত্বরান্বিত করে।
২. পাকিস্তানের সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে ইউনেস্কোতে পাকিস্তানের স্থায়ী ডেলিগেশনের তৎকালীন প্রথম সচিব রিফাত মাসুদের সঙ্গে কাউন্সিলর ইকতিয়ার চৌধুরীর পারস্পারিক পরিচিতি। তাদের ছেলেমেয়েরা তখন প্যারিসে একই স্কুলের একই শ্রেণিতে লেখাপড়া করতেন। রিফাত নিজে থেকেই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসেন। কিন্তু অনেকেরই জানা নেই, ইউনেস্কো থেকে ১৭ নভেম্বর সর্বসম্মতক্রমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রস্তাব অনুমোদনের দুদিন পর ১৯ নভেম্বর পাকিস্তান থেকে প্যারিসের বাংলাদেশ দূতাবাসে টেলিফোন করে পাকিস্তান যে খসড়া রেজ্যুলুশানে স্বাক্ষর করেছিল তার একটি ছায়ালিপি চেয়ে পাঠানো হয়। সেটি পাঠানোর পর পাকিস্তান তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। যতদূর মনে পড়ছে, রিফাত মাসুদ পাকিস্তানের খুব প্রভাবশালী কোনও পরিবারের সদস্য বলে তার ওপর দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনও ঝড় বয়ে যায়নি।
৩. ইউনেস্কোর অধিবেশনে এ প্রস্তাবটি উত্থাপনের সময় ইউনেস্কোর আরেকটি কমিশনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নেতিবাচক ও উত্তেজক বক্তব্য উত্থাপন করছিলেন তসলিমা নাসরিন। এই বক্তব্যের কারণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রস্তাব অনুমোদনও প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে। কিন্তু ইরানের কূটনীতিক মোহাম্মদ আর কাসানী তসলিমা নাসরিনের বক্তব্য উপস্থাপনের সময়েই বিষয়টি বাংলাদেশ মিশনের ইকতিয়ার চৌধুরীকে জানান। ফলে বাংলাদেশ মিশনের পক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়, যাতে এ বক্তব্য প্রস্তাবটি অনুমোদনের আলোচনায় কোনও নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে।
৪. ইউনেস্কোর সদর দফতরের সদা হাস্যময় আনা মারিয়ার কথা কিছুতেই ভুলে যাওয়া উচিত হবে না বাংলাদেশের। তার নিজের দেশ সুইডেন। কিন্তু সুইডেনে তার নিজের মাতৃভাষা ইংরেজি বিলুপ্ত হওয়ার পথে। কিন্তু তিনি চান সুইডিশ ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিও সেখানে বেঁচে থাকুক। তাই তিনি এমন একটি দিবসের জন্যে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। অফিসের সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও আনা মারিয়া ওইদিন বসে ছিলেন বাংলাদেশ মিশন থেকে রেজ্যুলেশানটি পাবার আশায়। কেননা ফাইলে রেজ্যুলুশান রাখার ওটিই ছিল শেষ দিবস। এদিকে ঢাকায় ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কোর ফ্যাক্স মেশিন ছিল একেবারেই পুরানো। তাই সেখান থেকে বার বার ফ্যাক্স পাঠালেও দূতাবাসের কর্মীরা তার পাঠোদ্ধার করতে পারছিলেন না। অফিস সময় পেরিয়ে গেলেও দূতাবাসের অফিস কর্মী আবদুল আউয়ালও তাই অনেক রাত পর্যন্ত অফিসেই ছিলেন। শেষ পর্যন্ত কয়েকজন মিলে সেটির পাঠোদ্ধার করে নতুনভাবে টাইপ করে মারিয়ার অফিসে পাঠানো হয় এবং মারিয়ার অপেক্ষারও অবসান ঘটে। প্রস্তাবটি ইউনেস্কোর সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠিয়ে দিয়ে তবে তিনি বাসায় ফেরেন।
এরা সবাই আমাদের এই অর্জনের অংশীদার। বিনম্র চিত্তে তাদেরও আমরা যেন মনে রাখি।
অভিজিৎ - ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৫:২০ পূর্বাহ্ণ)
ইমতিয়ার,
অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ কিছু সন্নিবেশিত করলেন। আমার অভিবাদন রইলো। ইকতিয়ার চৌধুরীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বাকি ইতিহাস বইটি পড়া হয়নি। কোন সালে বেরিয়েছে? এ বছর? আমার অবশ্যই বইটি আনিয়ে নিতে হবে।
আবারো ধন্যবাদ চমৎকার মন্তব্যটির জন্য।
রেজাউল করিম সুমন - ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১২:৩৯ অপরাহ্ণ)
@ ইমতিয়ার শামীম
অনেক ধন্যবাদ গুরুত্বপূর্ণ আরো কিছু তথ্য আমাদের গোচরে আনার জন্য।
বিনয়ভূষণ ধর - ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৫:০৩ অপরাহ্ণ)
@অভিজিৎ!
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার তথ্যবহুল ও সুলিখিত চমৎকার এই লেখাটির জন্য। এতোদিন ধরে আমরা মোটাদাগে আমাদের মহান একুশে ফেব্রুয়ারী’কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে সারা পৃথিবীতে পালনের জন্যে দু’জন অসাধারন দেশপ্রমিকের অবদানের কথা জানতাম। একজন হচ্ছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম এবং আরেকজন হচ্ছেন তাঁর এই কার্যক্রমের সহযোদ্ধা আব্দুস সালাম। বর্তমানে এই দু’জন জীবিকার তাগিদে কানাডার ভ্যাংকুবারে বসবাস করছেন। কিন্তু ঘটনার পিছনে যে আরও কত ঘটনা ছিল তা আমরা এই লেখাটির মাধ্যমে জানতে পারলাম। কারও অবদানই আমরা কোনভাবেই ছোট করে দেখতে পারিনা। কতো এলেবেলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদকে ভূষিত হন শুধুমাত্র পার্টিজান মনোবৃত্তির কারণে অথচ আমাদের দেশকে আমাদের মহান একুশে ফেব্রুয়ারী’কে যারাঁ বিশ্বের দরবারে সম্মানিত করলো তাঁদের খোঁজই হয়তো আমরা এখন আর নিচ্ছি না। জাতি হিসাবে আমরা এতোটাই অকৃতজ্ঞ!
আমিও আপনার মতো সবার কাছে একই প্রশ্ন রাখছি।
@ইমতিয়ার ভাই!
আপনাকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি আপনার সতথ্য মন্তব্যটির জন্যে। আপনার কাছ থেকেও অনেক কিছু জানা গেলো।
অভিজিৎ - ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১১:৪১ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ আপনাকেও, বিনয়ভূষণ!
বিপ্লব রহমান - ২৪ মার্চ ২০১০ (৭:২২ অপরাহ্ণ)
আমাদের মহান গৌরবগাঁথাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য সবিশেষ কৃতজ্ঞতা। চলুক।
রায়হান রশিদ - ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১১ (১১:১৭ পূর্বাহ্ণ)
@অভিজিৎদা,
আবারও পড়লাম লেখাটি। উল্লেখিত সংগঠনটির নাম নিয়ে ছোট্ট একটা ভাবনা। “গ্রুপ অব” (Group of), নাকি “গ্রুপ ফর” (Group for) হবে? “ল্যাংগুয়েজ” (Language) নাকি “ল্যাংগুয়েজেস” (Languages) হবে? হাসান মাহমুদ ভাইয়ের মূল ইংরেজী লেখাটিতেও দেখছি একইভাবে নামটি উল্লেখিত। তিনিও হয়তো বিষয়টির ওপর আলোকপাত করতে পারবেন।
অত্যন্ত দরকারী এই লেখাটির জন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ।
রায়হান রশিদ - ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১১ (১২:০৬ অপরাহ্ণ)
আপডেট:
উপরের মন্তব্যটির (#৬) পরপরই অভিজিৎ রায়, হাসান মাহমুদ (ফতেমোল্লা), এবং উল্লেখিত সময়কালে জাতিসংঘে কর্মরত হাসান ফেরদৌসকে ইমেইল পাঠানো হয়েছিল মুক্তাঙ্গন এর পক্ষ থেকে বিষয়টি জানতে চেয়ে। হাসান মাহমুদ ভাইয়ের তড়িৎ উত্তর এসে পৌঁছেছে ইতোমধ্যে, তিনি জানিয়েছেন সংগঠনটির নাম: “Mother Language Lovers of the World”। বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য হাসান মাহমুদ ভাই এর প্রতি কৃতজ্ঞতা।
@ হাসান ভাই,
এই সুযোগে এবারের বইমেলায় আপনার শরিয়া কি বলে, আমরা কি করি বইটির ৪র্থ সংস্করণ প্রকাশের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে রাখছি। সেইসাথে সাফল্য কামনা করছি আগামী ১৮ মার্চ ক্যালিফোর্নিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভেল এ আপনার প্রথম শরিয়া ডকু-মুভির।
Hasan Mahmud - ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১১ (১২:২৩ অপরাহ্ণ)
Ami Office-e tai Banglay lekha gelo na. Dhonyobad Rayhan. Ami amar Agamee boi BANGLAR KOTHA KOI (Banglar hajar bochhorer itihaser opore)-er jonyo ei bisoye-r day to day development likhechhi, basay giye ekhane post korbo. Imtiaz onek tothyo diyechhen ja amar jana chhilo na – Rafiq / Salam Bhai aaj Ottawa theke Vancouver-e fire gelen- unader kachhe et`a pathiye debo:-
ইউনেস্কো থেকে ১৭ নভেম্বর সর্বসম্মতক্রমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রস্তাব অনুমোদনের দুদিন পর ১৯ নভেম্বর পাকিস্তান থেকে প্যারিসের বাংলাদেশ দূতাবাসে টেলিফোন করে পাকিস্তান যে খসড়া রেজ্যুলুশানে স্বাক্ষর করেছিল তার একটি ছায়ালিপি চেয়ে পাঠানো হয়। সেটি পাঠানোর পর পাকিস্তান তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়।
Interesting !
Hasan Mahmud - ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১১ (২:১৮ অপরাহ্ণ)
Few points.
1. Vancouver-e Shoheed Minar banano hoyechhe.
2. Toronto-te City office amader IMLD (Int’l Mother Language Day) committee-r deya Artwork officially accpet korechheke O ekta Park-e jayga alot korechhe. Ekhon Mayor-er letter pele-i amra fundraising-e neme porbo.
3. BD Govt Rafiq bhai-ke Ekushe Podok offer korechhilo – Tini ta decline kore “Mother Language Lovers of the World”-ke dite onurodh koren. BD-govt pore tai korechhe bole shunechhi – Rafiq/Salam Bhai-ke jiges kore janabo.
মাসুদ করিম - ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১ (৩:৫৮ অপরাহ্ণ)
লন্ডনে একুশের আলোচনায় ব্যারিস্টার নোরা শরিফ বলছিলেন
বিস্তারিত পড়ুন : মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় জিতেছে বাঙালি, হেরেছি আমরা।
মাসুদ করিম - ২৬ মার্চ ২০১১ (৮:৪৪ পূর্বাহ্ণ)
২৩ মার্চ ভ্যানকুভার জেনারেল হাসপাতালে (ভিজিএইচ) মুমূর্ষু অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রূপকার রফিকুল ইসলামকে। গত ২২ মার্চ রফিকুল ইসলামের লিউকেমিয়া ধরা পড়ে।
খবরের লিন্ক এখানে।
মাসুদ করিম - ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ (৪:৫১ অপরাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ২১ নভেম্বর ২০১৩ (১২:০৮ অপরাহ্ণ)
রাজ মোঃ মেরাজ রহমান - ২০ মে ২০১৪ (১১:৩২ অপরাহ্ণ)
যে কাজটি রফিকুল ইসলাম করে গেছেন বাঙালি জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে তা স্মরণে রাখবে … রফিকুল ইসলামের অন্তিম ইচ্ছা ছিল তাঁর শেষ আশ্রয় হবে এই দেশের মাটিতে অর্থাৎ বাংলার মাটিতে … কিন্তু আমরা কি তা পেরেছি … বিবেকের কাছে চিরদিন আমরা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবো …
Pingback: তসলিমা নাসরিন সম্বন্ধে একথাগুলোও জেনে রাখা দরকার | প্রাত্যহিক পাঠ
Pingback: একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি-মর্যাদা এনে দেওয়া রফিকুল-সালামের গল্প! | Egiye Cholo | এগিয়ে চল