মেইল বক্স থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ছেলেবেলার ভেতর হামাগুঁড়ি দিয়ে সোজা খাটের নীচে। অন্ধকার হাতড়ে টেনে বের করি টিনের বাক্সে রাখা পুতুলের সংসার, এলোমেলো করে দিতে দিতে ভাবি বাবা বুঝি 'ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী' হাতে নিয়ে পড়তে ডাকবে। বাবার দিকে ছুটে যেতে যেতে দেখি বুড়ো জেলের মুখটা বাবার। [. . .]

আমাদের পুরোনো বাড়ির উঠোনের লম্বা ঢ্যাঙা একমাথা ঝাঁকড়া সবুজ চুলের কামিনী গাছটা, আমার প্রথম প্রেমিক। প্রতিবারের বর্ষায় মাথায় সাদা টুপি পরে সে যখন প্রলুব্ধ করতে আসত, চারপাশে তখন সুগন্ধে ম'ম'। রানী সমেত মৌমাছির দল সারাদিন গুনগুন গানে ওর চারপাশটা ভরে তুলতো। একটু জোরে হাওয়া দিলে পালকের মতো ঝরে পড়ত সাদা পাপড়ি। পড়ার টেবিল থেকে মুখ তুলে ওর হাতছানির ভেতর হেঁটে হেঁটে কলঘরে গিয়ে অপেক্ষা করতাম আর একটা ঝড়ো হাওয়ার, অথবা ঝুমবৃষ্টির। স্কুলের জন্যে তাড়া দিতে থাকা বন্ধুদের শত্রু মনে হত। ‘আসছি... যাই’ করে করে আরও খানিকটা সময় গাছটার নীচের ছাদখোলা কলঘরে দাঁড়িয়ে থাকতো বালিকা। বর্ষাশেষে নরম সবুজ নতুন পাতার ভেতর থেকে কয়েকটা সাদা পাপড়ি কুড়িয়ে বইয়ের ভাঁজে গুঁজে দিতে দিতে ভাবত, বারোমাস — সে কত দীর্ঘ! আঙুলের করে গুনে শেষ হয় না। অপেক্ষা মৃত মীনের চোখ, উল্টে পড়ে থাকে পড়ার টেবিলে কিছুদিন। তারপর বাসার সামনের ছাতিম গাছটা বুনো গন্ধের ফুল ফোটাতে শুরু করলে ছাতিম গাছটাকে মনে হত সবচাইতে প্রিয়। জানালার বাইরে মুগ্ধ চোখজোড়া ফেলে এসে অঙ্কের খাতা ভরে যেত ভুলে। আর সন্ধ্যায় স্যারের কাছে শাস্তি নিতে নিতে মনে হত আমি অবুঝের মতো এ কী করেছি। এই এই করে কখনো দোলনচাঁপা কখনো শিউলি কখনো চন্দ্রমল্লিকার চারপাশে ঘুরঘুর। ভূগোল বইয়ের পাতা থেকে উঠে গিয়ে, পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ফিরে আসতে আসতে আমার কামিনী গাছে বর্ষা নামে। ‘বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান’ শুনতে শুনতে বালিকা তার কলঘরের সময়কে প্রলম্বিত করে। কামিনীর সেই সুগন্ধি সাদা টুপির জন্যে, ঝড়-জল-কাদায় মোড়া বর্ষাকে মনে হত প্রিয় ঋতু। তারও অনেক পরে কোনো এক এপ্রিলের রাতে পৃথিবী কেমন বন্ বন্ করে ঘুরতে থাকে, বাতাসের গায়ে চাবুক পেটাতে থাকে নারকেলের পাতা। রাতভর শিব তার প্রলয়নাচন নেচে সব কেমন গুঁড়িয়ে দিতে থাকে! একসময় সব চুপকথা হয়ে গেলে ঘষা কাচের ভেতর দিয়ে আলো আসার মতো করেই ভোর আসে। ঘর থেকে বাইরে আসে কেবল বড়রা। ছোটদের কাজ কেবল জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা। একটু পর বাসার বারান্দায় আসার অনুমতি পেলে ছোটরা সব অবাক চোখে দেখতে এল বাসার উঠোনে মস্ত একটা আকাশ! এতকাল আকাশটা কেবল গাছেদের ছিল; আজ সকাল থেকে সেটা বাসার সবার হয়ে গেল।…

সেই কোন্ ছেলেবেলায় সকাল হতো ‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’ শুনতে শুনতে। একই গানের ভিতর রোজ সকাল গড়িয়ে ইস্কুলের মাঠে। সেখানেও আসতেন তিনি [. . .]

সেই কোন্ ছেলেবেলায় সকাল হতো ‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’ শুনতে শুনতে। একই গানের ভিতর রোজ সকাল গড়িয়ে ইস্কুলের মাঠে। সেখানেও আসতেন তিনি — ‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি’। রোজ সকাল থেকে রাত অবধি মাকে নানা ভাবে জ্বালিয়ে, কাঁদিয়ে, নির্বিঘ্নে যখন ঘুমিয়েছি, জানিনি মলিন মুখের মায়ের জন্যে ব্যথা হয়। জানিনি আমার চেনা মায়ের বাইরে আর যাকে মাতৃ রূপেন সংস্থিতা জেনে ভালবাসতে গিয়ে এই দূরের দেশে চোখ ভেসে যাবে জলে। রোজ এমন করেই জীবনের নানান অনুভবকে রাঙিয়ে দিয়ে, বাজিয়ে দিয়ে তিনি যখন আমার নিত্যদিনের ভিতর জুড়ে বসেন তখন বুঝি আর কেউ নয়, গানের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আর কেউ নন, তিনি নিজেই। সমস্ত দিন বৃষ্টিতে ভিজে এই শহরটা যখন একটা মনখারাপের চাদর জড়িয়ে ঘুরছে, তখন সন্ধ্যা নামার মুখে দূরের আকাশে মেঘ সরে গিয়ে একটুকরো সাদা মেঘে জড়িয়ে সূর্যটা উঁকি দিলে, আমি তাঁকেই যেন হাসতে দেখলাম আমার এই মেঘলা দিনের ভিতর। আর মনের ভিতর থেকে তিনিই গাইলেন ‘নূতন আলোয় নূতন অন্ধকারে/ লও যদি বা নূতন সিন্ধুপারে/ তবু তুমি সেই তো আমার তুমি,/ আবার তোমায় চিনব নূতন করে।’ এমন নিত্যজানার ভিতর দিয়ে আমার চিরকালের ভিতর যখন তিনি সত্যি হয়ে ওঠেন, আর সব কিছুকে ছাপিয়ে তাঁর উপস্থিতিই জীবন উপভোগের ইচ্ছেকে জাগায়। মনের ভিতর যে অসম্পূর্ণতা সারাক্ষণ অস্থির তাকে স্থিতি দিতেই গীতবিতানের পাতা উল্টে দেন। স্বরবিতানের সাথে পরিচয় ঘটেনি তখনও, গীতবিতানই কেবল উল্টেপাল্টে দেখতাম। সেইসব দিনগুলোতে মা কেমন উদাস গলায় গাইত ‘ভালোবেসে যদি সুখ নাহি’। কিসের অসুখ মায়ের সেটা জানবার অবকাশ ছিল না ওই বয়েসে। কেবল মায়ের রিনরিনে গলার ভিতর গানটাকে পেতে চাইতাম সে সময়ে। আরো কত পরে নিজের উপলব্ধিকে শাণিয়ে নিয়ে বুঝেছি ভালবেসেও অসুখী হবার ব্যথার ভিতর আমার মা আর রবি ঠাকুর মিলতেন। কিংবা তিনি হয়তো এমনি করেই নানান বয়েসের ভিতর নানান জনের নানান রূপের ঈশ্বর হয়ে ওঠেন। কোনো কোনো রুক্ষ রোদের দিনে উঠোনে কাপড় নাড়তে গিয়ে মায়ের সাথে গলা মিলিয়ে গেয়েছি ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে’। সমস্ত সংসারের চারদিকে রুক্ষ তাপ দুঃখ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যখন, সেই রকমের একটা সময়ে এই গান গাইবার মন মাকে রবি ঠাকুর পাইয়ে দিয়েছিলেন।…

সিঁড়ির শেষপ্রান্তে এসে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি মায়ের চোখে আষাঢ় মাসের বৃষ্টি বান ডাকছে। ছুটে নেমে আসতে চাইলে মা হাত নেড়ে বারণ করল। আমি আবার এগিয়ে গেলাম। পিছনে মায়ের চোখের জল আর সামনে আকাশ ফুঁড়ে উড়ে যাবার রথ। [...]

কোনো এক আষাঢ়-সন্ধ্যায় মা এসেছিল আমাকে এগিয়ে দিতে। এয়ারপোর্টের কোলাহল শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা সব কিছুর মধ্যে আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম। মা তখন ভীষণ ধীর স্থির, পাশে বসে কেবল আমার দীর্ঘ যাত্রাপথের ভাবনায় অন্যমনস্ক। মাকে পেছনে রেখে আমি যখন সিঁড়ি ভাঙছি মা আমার তরতর করে উঠে যাবার দিকে তাকিয়ে ছিল। সিঁড়ির শেষপ্রান্তে এসে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি মায়ের চোখে আষাঢ় মাসের বৃষ্টি বান ডাকছে। ছুটে নেমে আসতে চাইলে মা হাত নেড়ে বারণ করল। আমি আবার এগিয়ে গেলাম। পিছনে মায়ের চোখের জল আর সামনে আকাশ ফুঁড়ে উড়ে যাবার রথ। চার বছর আগের সেই আষাঢ় মাসের বর্ষণহীন সন্ধ্যা আজও মাঝে মাঝে ভিজিয়ে দেয়। দেশে যখন মাস জুড়ে বৃষ্টির উৎসব এখানে তখন কনকনে ঠাণ্ডা। এদেশে গ্রীষ্মে বৃষ্টি হয় না। পুরো শীতকাল এখানে বৃষ্টি মাখানো। বরফের কণার মতো কনকনে ঠাণ্ডা বৃষ্টিতে এখানে কেউ ভেজে না। বর্ষাতি ভুলে গেলে যদি-বা ভিজতে হয় মাঝেসাঝে, সে-ভেজায় আনন্দের বালাই থাকে না, বরং শরীর খারাপ করার উৎকণ্ঠা মাথা চাড়া দিতে থাকে। এদেশে আবহাওয়ার খবরে বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয় না। এরা বরং শতকরার হিসেবে জানিয়ে দেয় বৃষ্টির সম্ভাবনা। তবু বৃষ্টি হলেই পুরনো দিন, বৃষ্টি হলেই সমস্ত নিষেধাজ্ঞা গুঁড়িয়ে দিয়ে ভেজার উল্লাস। মনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গান – ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়/ ও সেই...’ বর্ষণহীন খটখটে রোদের দিনেও ভিজিয়ে দেয়। যেমন করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর আর সমস্ত গানের ভিতর দিয়ে ভিজিয়ে দিতে চান। বর্ষার গান নয়, তবু কোনো কোনো মেঘলাদিনে ট্রামের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে গুনগুন করি – ‘এ মোর হৃদয়ের বিজন আকাশে/ তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে,/ গভীর কী আশায় নিবিড় পুলকে/ তাহার পানে চাই দু বাহু বাড়ায়ে/ জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে...।’ আপনা থেকেই চোখের পাতা ভারী, বুকের ভিতর বৃষ্টি। ট্রামের ভিতর একটা পুরো সিটের দখল নিয়ে বসি। হেলেদুলে ট্রামটা আমায় পৌঁছে দেয় সমুদ্রের কাছে। সামনের বিশাল বিক্ষিপ্ত জলারাশি, মাথার উপর অসীম আকাশ, তার নীচে দাঁড়িয়ে ক্ষুদ্র আমি, দীন আমি নিজের না হয়ে-ওঠাকে উল্টেপাল্টে দেখি। রবীন্দ্রনাথ তখনও পিছু ছাড়েন না, মনের ভিতরটা, চোখের কোলটা ভিজিয়ে দিয়ে আমাকে দিয়েই গাইয়ে নিতে চান – ‘বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে...’। এই রকমের অজস্র…

অতি সাধারণ মা আমাদের এই অসাধারণ জীবনে। মা গল্পের নায়িকা হতে পারেন এমন নন। তাঁকে নিয়ে গান কবিতা কিছুই হয়তো হতে পারে না। হুট করে টক অফ দ্য টাউন হয়ে উঠতে পারেন এমন ক্ষমতা তাঁর নেই। তবু যখন ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’ গানটা গুনগুন করি তখন সমস্ত মুখ ছাপিয়ে আমার মায়ের মুখটি ভেসে ওঠে, মনে হয় এ গান আমার মাকে নিয়ে লেখা। [...]

অতি সাধারণ মা আমাদের এই অসাধারণ জীবনে। মা গল্পের নায়িকা হতে পারেন এমন নন। তাঁকে নিয়ে গান কবিতা কিছুই হয়তো হতে পারে না। হুট করে টক অফ দ্য টাউন হয়ে উঠতে পারেন এমন ক্ষমতা তাঁর নেই। তবু যখন ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’ গানটা গুনগুন করি তখন সমস্ত মুখ ছাপিয়ে আমার মায়ের মুখটি ভেসে ওঠে, মনে হয় এ গান আমার মাকে নিয়ে লেখা। যখন এই দূর প্রবাসে সন্ধ্যা নামার সময় হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরি আর মনে মনে আউড়ে যাই ‘মাকে আমার পড়ে না মনে’ অথবা ‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে/ মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে’, তখন মনে হয় এই যে এই তো আমার মাকে নিয়ে লেখা। মায়ের অনুভব হয়তো সবার জীবনেই এমন সর্বগ্রাসী। তবু দেশ থেকে অনেক দূরে সন্ধ্যা নামার আগে মায়ের কথা মনে হতেই ভাবলাম আমি তো লিখতে পারি মাকে নিয়ে। সে-লেখা সাহিত্য হবে না হয়তো; কী এসে যায়! মোটামুটি একটা উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আমাদের একেবারে মধ্যবিত্ত জীবনের ভেতর হুট করে ঢুকে, বিশাল জাহাজের মতো যৌথ পরিবারের অর্ধেক কাণ্ডারী হয়ে ওঠা মানুষটি আমাদের মা। আর আমাদের এখনকার ছোট্ট সংসারের একমাত্র বাতিঘর। সমস্ত দিনমান আমাদের পথ দেখাতে দেখাতে কখন যে মা মধ্যবয়স পার করেছেন আমাদের চোখের সামনে দিয়ে আমাদেরই অসর্তকতায়! আজ যখন মাকে নিয়ে লিখছি তখন আমার এই জীবন জুড়ে মা’র নানা মুহূর্তের ছবি। ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। একদম ছেলেবেলায় আমাদের কেবল বুলি ফুটতে শুরু করেছে, বাবা তখনও ঢাকায়। মাকে যেসব চিঠি লিখতেন তার সাথে তাঁর সদ্য-পড়া কোনো ছড়াও লিখে পাঠাতেন। মায়ের ছুটি মানে আমাদের ছড়া শেখানোর, শোনানোর সময়। বৃষ্টির দিনে কাগজের নৌকো বানিয়ে সেগুলো ভাসাতে ভাসাতে মা শোনাতেন, ‘কাগজ দিয়ে বানিয়ে ছোট্ট নাও/ নালার জলে ভাসিয়ে বলি — যাও’।এসব চমৎকার ছড়া মা আমাদের জন্যে মুখস্থ করতেন। একটা আপেল ৯ ভাগ করে খেতে দিয়ে বোধহয় পরিবারের ভেতর সাম্যের চর্চা করতেন আমাদের কঠিন মন খারাপ করিয়ে দিয়ে। এই আমাদের ছেলেবেলার মা। বড় হতে হতে বুঝেছি, রবীন্দ্রনাথ মা’র ছোট্ট পলেস্তরা-খসা আধো অন্ধকার ঘরটির জানালা গলিয়ে পড়া একটুকরো আলো। সেই আলো মা নিষ্ঠার সাথে পুরে দিয়েছেন তাঁর সন্তানদের ভেতর।…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.