অতি সাধারণ মা আমাদের এই অসাধারণ জীবনে। মা গল্পের নায়িকা হতে পারেন এমন নন। তাঁকে নিয়ে গান কবিতা কিছুই হয়তো হতে পারে না। হুট করে টক অফ দ্য টাউন হয়ে উঠতে পারেন এমন ক্ষমতা তাঁর নেই। তবু যখন ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’ গানটা গুনগুন করি তখন সমস্ত মুখ ছাপিয়ে আমার মায়ের মুখটি ভেসে ওঠে, মনে হয় এ গান আমার মাকে নিয়ে লেখা। যখন এই দূর প্রবাসে সন্ধ্যা নামার সময় হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরি আর মনে মনে আউড়ে যাই ‘মাকে আমার পড়ে না মনে’ অথবা ‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে/ মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে’, তখন মনে হয় এই যে এই তো আমার মাকে নিয়ে লেখা। মায়ের অনুভব হয়তো সবার জীবনেই এমন সর্বগ্রাসী। তবু দেশ থেকে অনেক দূরে সন্ধ্যা নামার আগে মায়ের কথা মনে হতেই ভাবলাম আমি তো লিখতে পারি মাকে নিয়ে। সে-লেখা সাহিত্য হবে না হয়তো; কী এসে যায়!
মোটামুটি একটা উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আমাদের একেবারে মধ্যবিত্ত জীবনের ভেতর হুট করে ঢুকে, বিশাল জাহাজের মতো যৌথ পরিবারের অর্ধেক কাণ্ডারী হয়ে ওঠা মানুষটি আমাদের মা। আর আমাদের এখনকার ছোট্ট সংসারের একমাত্র বাতিঘর। সমস্ত দিনমান আমাদের পথ দেখাতে দেখাতে কখন যে মা মধ্যবয়স পার করেছেন আমাদের চোখের সামনে দিয়ে আমাদেরই অসর্তকতায়! আজ যখন মাকে নিয়ে লিখছি তখন আমার এই জীবন জুড়ে মা’র নানা মুহূর্তের ছবি। ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না।
একদম ছেলেবেলায় আমাদের কেবল বুলি ফুটতে শুরু করেছে, বাবা তখনও ঢাকায়। মাকে যেসব চিঠি লিখতেন তার সাথে তাঁর সদ্য-পড়া কোনো ছড়াও লিখে পাঠাতেন। মায়ের ছুটি মানে আমাদের ছড়া শেখানোর, শোনানোর সময়। বৃষ্টির দিনে কাগজের নৌকো বানিয়ে সেগুলো ভাসাতে ভাসাতে মা শোনাতেন, ‘কাগজ দিয়ে বানিয়ে ছোট্ট নাও/ নালার জলে ভাসিয়ে বলি — যাও’।এসব চমৎকার ছড়া মা আমাদের জন্যে মুখস্থ করতেন। একটা আপেল ৯ ভাগ করে খেতে দিয়ে বোধহয় পরিবারের ভেতর সাম্যের চর্চা করতেন আমাদের কঠিন মন খারাপ করিয়ে দিয়ে। এই আমাদের ছেলেবেলার মা।
বড় হতে হতে বুঝেছি, রবীন্দ্রনাথ মা’র ছোট্ট পলেস্তরা-খসা আধো অন্ধকার ঘরটির জানালা গলিয়ে পড়া একটুকরো আলো। সেই আলো মা নিষ্ঠার সাথে পুরে দিয়েছেন তাঁর সন্তানদের ভেতর। সকালের নাস্তা তৈরি করতে করতে মা গুনগুন করছেন, ‘আনন্দলোকে মঙ্গল আলোকে বিরাজ’, অথবা দুপুরে কাপড় নাড়তে নাড়তে গাইছেন ‘মধুর বসন্ত এসেছে’। মা বলেন, বাণী না বুঝে গাইলে রবীন্দ্রসঙ্গীত নাকি কেবল গাওয়া হয়, ঠিকমতো গান হয়ে ওঠে না। কোনো কোনো লোডশেডিং-এর রাতে মা আমাদের সাথে গলা মিলিয়ে গান ধরেন – ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে…’। এই আমাদের রোজকার জীবনের তেল-নুন-মরিচের গন্ধ মাখানো মা।
‘অসাধারণ’ শব্দটি মনের মধ্যে যে চমক জাগানো ছবিটি তৈরি করে তেমন কিছুর সাথে মা’র একদম মিল ছিল না। তবু এক সন্ধ্যায় ঘোর অন্ধকার দুঃসময় আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনকে গ্রাস করতে এল। আমাদের বিষয়বুদ্ধিহীন বাবা — আমাদের ‘honesty is the best policy’ শেখানো বাবা কপর্দকশূন্য অবস্থায় আমাদের একমাত্র আয়ের উৎস তাঁর চাকরিটি থেকে সরে দাঁড়ালেন। সেদিন সন্ধ্যায় বাবা আমাদের পড়ে শোনালেন, ‘যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে…’। মন্দ মন্থরে নয়, একেবারে হুড়মুড় করে নেমে এসেছিল দুঃসময় আমাদের ছোট টিনের চালার ঘরে। সেদিন যে মাকে দেখেছি তিনি আমাদের জীবনের অসাধারণ গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। বাবা রবীন্দ্রনাথের ‘দুঃসময়’ পড়ছিলেন আর মা সেই দুঃসসময়ের ভেতর একা একা হেঁটে বহুদূরে চলে যাচ্ছিলেন। মা’র সেদিনের সেই মুখ আমাদের একদম অচেনা। বাবা পড়া শেষ করলে মা ফিরে এলেন দুঃসসময়ের বাস্তবতায়। মা তাঁর অবৈষয়িক স্বামী আর তিন সন্তানকে বুকের ভেতর জাপটে ধরে হিংস্র বাঘিনী একলা নেমেছেন দুঃসময়ের মুখোমুখি। সেদিনের মা বুঝি সহস্র তুফানকে নিমিষে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারতেন।
সময় ফিরলে আবার সাধারণের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন অসাধারণ মা। কিন্তু তাঁর তিন সন্তানের জীবন জুড়ে আঁকা হয়ে গেল তাঁর অসাধারণ মাতৃমূর্তি। সব সন্তানের জীবনেই হয়তো এমন কিছু ঘটনা থাকে যখন চেনা মাকেও অন্যরকম দেখায়। ব্যক্তিগত জীবনে মা ভীষণ ধার্মিক, অথচ আমি আমার মায়ের মতো এত অসাম্প্রদায়িক মানুষ খুব বেশি দেখিনি। ব্যক্তিগত দুঃসময়ে তো বটেই, দেশের নানা দুঃসময়েই মাকে দেখেছি আকুল প্রার্থনা করছেন। মা বুঝি মনে মনে পড়ে চলেন, ‘এ দুর্ভাগা দেশ হতে হে মঙ্গলময়…’। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হলে মা সবার আগে জায়নামাজে। ওদের রক্ষা করতে মা অসহায়ের মতো প্রার্থনা করতেন, কেননা মা নিজেই জানেন তাঁর মতো নিপীড়িত আত্মার প্রার্থনাই সম্বল। আমাদের পাড়ায় এক অর্থে আমরাই সংখ্যালঘু, মাত্র তিন ঘর মুসলিম পুরো পাড়ায়। তবু পাড়া থেকে কেউ কলকাতায় পাড়ি জমালে মা’র মন খুব খারাপ হতো। বিসর্জনের দিন প্রতিমা বিদায়ের সময় মা-ও এসে দাঁড়ান দরজার মুখে, পাড়ার মেয়েরা আমার মাকেও সিঁদুরের রঙ মাখিয়ে দেয়। মাকে কখনও আপত্তি করতে দেখিনি, কারণ মা’র ধর্মবোধে সিঁদুরের লাল কোনো অস্বস্তির অনুরণন তৈরি করেনি, বরং ওদের সাথে প্রীতির সম্পর্কটি তাঁর জোরালো হয়েছে। বিশ্বজিৎ হত্যার খবর পড়ে পরে কেঁদেকেটে একসা হয়ে মাকে ফোন করেছি। ওপাশে মা’র গলায় একই আর্তনাদ শুনে বুঝেছি, ভেতরে ভেতরে মা-ও ভেঙে পড়েছেন। এই আমাদের অতি অসাধারণ অসাম্প্রদায়িক মা।
ছাত্রজীবনে মা’র হাত ধরেই বাম ছাত্র সংগঠনে যোগ দিই। অথচ মা বাম রাজনীতি বহুদূর, ঘরোয়া রাজনীতিতেও অংশ নিতেন না। জাতীয় জীবনের যে-কোনো দুর্যোগের সময় একমুঠো যুক্তি, এক চিমটি তর্ক, আধা সের আবেগ মিশিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করেছি মায়ের সাথে। নিজের অজান্তে সাম্যবাদের চর্চা-করা এই সাধারণ মানুষটি আমাদের মা। তেল-গ্যাস রক্ষার লংমার্চের সময় মা-ও আমাদের সাথে ছিলেন আর সে মাকেও আমি দেখেছি ক্লান্তিহীন হেঁটে যেতে। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশে হাজির হওয়া মাকে আমি দেখিনি। লাখো মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে দাঁড়ানো মায়ের ছবি দেখেছি কেবল। ছোটবেলায় পরীক্ষা পাশের জন্য বিদ্রোহী কবির একটা ছড়া মুখস্থ করেছিলাম; এই সময়ে এসে একে খুব অর্থবহ মনে হয়। সে ছড়ার একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ পঙক্তি – ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?’ আমাদের মাকে এ প্রশ্ন করার সুযোগ নেই, কারণ দেশের এই এত বড় দুর্যোগের সময় এই ঘোর অন্ধকারে আমাদের মা জেগে আছেন তাঁর সন্তানদের জাগিয়ে রাখতে। এই মা’র সাথেই আমরা গলা মিলিয়ে গেয়েছি –
যদিও মা তোর দিব্য আলোকে ঘিরে আছে আজ আঁধার ঘোর,
কেটে যাবে মেঘ নবীন গরিমা মাতিবে আবার ললাটে তোর।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৫ comments
সুমিমা ইয়াসমিন - ১০ জুন ২০১৩ (১১:১১ পূর্বাহ্ণ)
এই আমাদের মা! লেখাটি পড়তে পড়তে চোখ ভিজে উঠলো।
মাসুদ করিম - ১০ জুন ২০১৩ (৬:৫৮ অপরাহ্ণ)
পৃথিবীতে সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত বাস্তব বিপর্যয় সামলানোর এশক্তি মায়েরা কোথায় পান আমি আজো জানি না। গৃহকোণের প্রতিদিনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ‘ডিজাস্টার ম্যানেজম্যান্ট’ই হয়ত কৃষ্ণবিবর প্রতিম দুঃসময়ের ঘনঘটায় ‘আমাদের মা’দেরকে এমন প্রবল শক্তিময়তা দেয়, তাদের অভিজ্ঞতার দ্বারারই তারা
‘ডিজাস্টার ম্যানেজম্যান্ট’এর সবচেয়ে বড় পাঠ এমন মায়েদের কাছ থেকেই নিতে হয়।
kibria - ১১ জুন ২০১৩ (২:০১ অপরাহ্ণ)
অসম্ভব সরল ও সুন্দর আমাদের মা
ron - ১১ জুন ২০১৩ (৮:৫৫ অপরাহ্ণ)
খুব ভাল হয়েছে।
মাহতাব - ২০ জুন ২০১৩ (৬:৩৯ অপরাহ্ণ)
অতি অসাধারন একটা লেখা। মা মানে মা। মায়ের হাত হল সতবরশি বট গাছের ছায়া/