উদয়ের পথে শুনি কার বানী
ভয় নাই ওরে ভয় নাই
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই…
লরেন্স লিপশুলজের লেখা “Bangladesh: The Unfinished Revolution” পড়ার পর থেকেই মাঝে মাঝে কোন এক উদাত্ত কন্ঠের এই আবৃত্তি যেন আমার কানে ভেসে আসে। মুহুর্তে রোমাঞ্চিত হই, উদ্বেলিত হই সেই কন্ঠের আহ্বানে। একই সাথে বিষাদে ভরে যায় মনটা। অবিশ্রুতের একটি লেখার মন্তব্যে কর্নেল তাহের প্রসঙ্গের অবতারণা করায় তিনি আমাকেই এই গুরু দায়িত্ব দিলেন এই প্রসঙ্গে একটি আলোচনার সূত্রপাত করার। আমার নিজ জ্ঞান বা গবেষনা এই প্রসঙ্গে খুবই সীমিত যার সিংহভাগই এসেছে লিপশুলজের লিখাটি থেকে তাই এই আলোচনায় বক্তার চেয়ে শ্রোতার আসনটিই বরং আমার কাছে বেশি লোভনীয়। তবু আলোচনা সূচনার স্বার্থেই আমার এই প্রয়াশ।
কর্নেল তাহের – কেমন ছিলেন তিনি?
খুবই ছোট বেলা থেকে আমি কর্নেল তাহের নামটির সাথে পরিচিত। তবে এই নামের রহস্য কখনোই আমার কাছে সম্পূর্ণ পরিস্কার হয়নি। আজো যেন তা কিছুটা ধোয়াটে। বালক বয়েসে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার পক্ষে বিপক্ষে এত লেখা পড়েছি যে নামটি আমার কাছে (মাফ করবেন) কর্নেল ফারুক আর কর্নেল রশিদের সমার্থক হয়ে উঠেছিল। পরবর্তিতে সেই ভুল ভাঙ্গে এবং নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত হই। ইতিহাস বিকৃতির এই যুগে এখানে সেখানে পত্রিকায় কারো মন্তব্যে কর্নেল তাহের এর উল্লেখ পাই, তবু যেন পরস্পর বিরোধিতার আজো কোন অন্তঃ নেই। বয়েস বাড়ার সাথে সাথে তার যে আকৃতি আমার কাছে ধীরে ধীরে ফুটে উঠেছে সেই আকৃতি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার। যুদ্ধক্ষেত্রে একটি পা হারানো সত্যেও তার সেই ব্যবচ্ছেদিত আকৃতি আমার চোখে পড়ে না, বরং মনষ্পটে ভেসে উঠে এক বলিষ্ঠ কাঠামো যে কিনা একটি পঙ্গু জাতিকেও টেনে তুলতে সক্ষম। সবুজের মাঝে আমরা আজ যে লাল পেয়েছি সেই লালের কিছুটা যেন তারই রক্ত থেকে নেয়া। তাই প্রশ্ন উঠে তিনি আজো এত বিতর্কিত কেন? এই প্রশ্নের কয়েকটি কারন হয়তো নিম্নরূপ:
১। বামপন্থী রাজনীতির সমর্থক হবার অপরাধে সকল বুর্জোয়া শাসনামলেই তার অবদান উপেক্ষিত হয়েছে।
২। বঙ্গবন্ধুর সরকার পরিচালনা পদ্ধতির সমালোচনা করায় তাকে চাকরিচ্যুত করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ আজো তাকে ক্ষমা করতে পারেনি।
৩। ১৫ই অগাস্টের কাল রাত্রির পর তার রাজনৈতিক অবস্থান অনেকাংশে অস্পষ্ট। উপরন্তু জেনারেল ওসমানিকে সাথে নিয়ে হত্যাকারীদের সাথে তার সমঝোতা বৈঠকের প্রমান মেলে। তবুও তিনি মোস্তাক সরকারকে সমর্থন করেছিলেন এমন প্রমাণও কেউ পেয়েছেন বলে আমার জানা নেই।
৪। ৩রা নভেম্বর খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থানকে অনেকেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষের শক্তির উত্থান বলে মনে করেন এবং সেই প্রয়াসকে দ্রুত স্তব্ধ করে দেয়ার অপরাধে কর্নেল তাহেরকে অভিযুক্ত করেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি খালেদ মোশারফের সত্যিকার আকাঙ্খা কি ছিল তা আজো আমার কাছে ঠিক স্পষ্ট নয়। ৪ঠা নভেম্বরের জেল হত্যা যেন সমীকরণটিকে আরো জটিল করে তুলেছে। প্রায় আড়াই মাস সময় পাওয়া সত্ত্বেও একেবারে শেষ মূহুর্তে পলায়নরত মোস্তাক সরকার বা কর্নেল ফারুক/রশিদ গংদের পক্ষে এরকম একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকান্ড ঘটানোর কারণ বা পদ্ধতি কোনটাই যেন ঠিক হিসেবে মেলেনা। এই প্রসঙ্গে অন্যদের আলোচনায় ঘটনাটি আরো স্পষ্ট হবে আশা রাখি।
৫। অন্যদিকে বিএনপি ৭ই নভেম্বরের বিদ্রোহকে বরাবরই সিপাহী জনতার সংগ্রাম বলে চালিয়ে আসছে যার মহানায়ক হিসেবে তারা জিয়াকে দাড় করাতে সদা সচেষ্ট। তাই ৭ই নভেম্বরে কর্নেল তাহেরের ভুমিকাকে স্বীকার করলে তাদের সব ভাওতাবাজী ধরা পড়ে যাবার ভয় থাকে। তদুপরি কর্নেল তাহেরের কৃতিত্ব স্বীকার করলে তাকে সাজানো মামলায় অবৈধভাবে হত্যার দায়ও কাঁধে নিতে হয়।
৬। অনেকে জিয়ার উত্থানের পেছনে তার পরোক্ষ ভুমিকার কথা স্বরণ করে তাকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং একজন ভিশনারি হিসেবে তার যোগ্য মর্যাদা দিতে কুন্ঠিত বোধ করেন।
৭। আবার কেউ কেউ আছেন যারা জিয়ার স্বৈরাচারী উত্থান সমর্থন না করলেও বিদ্রোহ তথা কর্নেল তাহের দমনের মাধ্যমে আমাদের সবুজ লাল পতাকাটিকে পুরোপুরি লাল হওয়া থেকে বাঁচানো গেছে ভেবে কর্নেল তাহের এর সদিচ্ছা আর দেশপ্রেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন।
কর্নেল তাহের তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে এদেশের প্রায় সবকটি বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তিকে খেপিয়ে তুলেছিলেন। তাই বিগত ৩৮ বছরেও যে তাঁর সঠিক মূল্যায়ন হয়নি এতে অবাক হবার কিছু নেই। তবে তাঁর করুণ পরিণতি কেন আজো একটি রাষ্ট্রীয় গোপনীয় বিষয় তার কারণ হয়তো কিছুটা ভিন্ন। এর মূল কারণটি সম্ভবত নিহিত আছে আমাদের দেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও শক্তিশালী রাজনৈতিক কাঠামো, অর্থাৎ আমাদের সেনাবাহিনীর মনোভাবের মধ্যে। কর্নেল তাহের তাঁর প্রগতিশীল চেতনার আলোকে আমাদের সেনাবাহিনী নিয়ে যে মহা-পরিকল্পনা করেছিলেন তা আমাদের সেনাবাহিনীর কাছে আজো হুমকি স্বরূপ তাই এর পরিণামে তাকে জীবন দিতে হয় এবং তার বিচারের নামে যে প্রহসনের অবতারণা করা হয়েছিল তার যাবতীয় দলিলপত্র আজো কোন এক গোপন কুঠুরিতে বাক্সবন্দী। সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁর সেসব যুগান্তকারী পরিকল্পনাগুলো নিচে বর্ণনা করা হল-
কর্মশীল সেনাবাহিনী (Working-Army)
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই কর্নেল তাহের কুমিল্লা ব্রিগেডের দায়িত্ব নেন। প্রথমেই তিনি সেনাবাহিনীর সকলের আত্মমর্যাদা বোধ এবং সততার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি তার ব্রিগেডের সবাইকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাদের দ্বারা অবৈধভাবে অর্জিত সব কিছু ফেরত দেয়ার আহবান করেন। তার সেই ডাকে বহু অফিসার ও সিপাহী সাড়া দিয়েছিলেন। পরবর্তিতে তিনি ঘোষণা দেন কুমিল্লা ব্রিগেড সেনানিবাস সংলগ্ন পতিত জমিতে কৃষিকাজের মাধ্যমে নিজেরা খাদ্যে সয়ংসম্পুর্ণ হবার সাথে সাথে আঞ্চলিক কৃষকদের কৃষিকাজে সহায়তা প্রদান করবে। তিনি এই ঘোষনাকে কাজে পরিণত করে দেখিয়েছেন এবং কুমিল্লা ব্রিগেডের প্রতীক হিসেবে তিনিই ‘লাঙ্গল’ প্রস্তাব করেন।
শ্রেনীহীন সেনাবাহিনী (Classless-Army)
৭ই নভেম্বরের বিদ্রোহের মূল উদ্দীপনাই ছিল শ্রেনীহীন সেনাবাহিনীর স্বপ্ন। তিনি সিপাহীদের উদ্বুদ্ধ করেন সনাতন পদ্ধতির সেনাবাহিনীর এলিট অফিসার কাঠামোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে। তিনি আরো অঙ্গীকার করেন যে সেনাবাহিনী পরিচালিত হবে একটি সুপ্রীম কাউন্সিলের মাধ্যমে যেখানে কারো একক কর্তৃত্ব থাকবে না। নিয়তির এক নির্মম পরিহাস এই যে তিনি সেই সুপ্রীম কাউন্সিলের নের্তৃত্ব দেয়ার জন্যে জিয়াকেই সবচেয়ে যোগ্য লোক বলে বিবেচনা করেন। জিয়া পরবর্তিতে সুকৌশলে সিপাহীদের নিরস্ত্র করে ব্যরাকে ফেরত পাঠিয়ে একে একে এই বিদ্রোহের সব পরিকল্পনাকারীদের কারারুদ্ধ করে। সঠিক নের্তৃত্ব নির্বাচনে কর্নেল তাহেরের সেই ভুলের মাশুল শেষ পর্যন্ত তাকে দিতে হয় নিজ জীবন দিয়ে আর জাতিকে দিতে হয় পরবর্তি ১৫ বছরের সামরিক স্বৈরশাসন আর শত শত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের প্রাণের বিনিময়ে।
গণবাহিনী (People’s-Army)
লিপশুলজের মতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই শীর্ষ সামরিক নের্তৃত্বের সাথে সঠিক যুদ্ধপরিকল্পনা বিষয়ে কর্নেল তাহেরের মতভেদ দেখা দেয়। কর্নেল তাহের সনাতন যুদ্ধপদ্ধতির বিপরীতে গেরিলা যুদ্ধের উপর জোর দেন। তিনি ভারতীয় সামরিক সহায়তা নেয়ার বিরোধিতা করেন এবং একই সাথে মুক্তিবাহিনীর হেড কোয়ার্টার বাংলাদেশের ভুখন্ডে সরিয়ে আনার প্রস্তাব করেন। তার কাছে ভারতীয় সহায়তায় একটি দ্রুত সামরিক সমাধানের চেয়ে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের ভেতরেই এক বিপুল গেরিলা বাহিনী তৈরী প্রাধান্য পায়। তার মতে এমন এক লক্ষ লোকের একটি গণবাহিনী প্রশিক্ষণ দিতে চার বছর সময়ের প্রয়োজন, এবং এই বাহিনী স্বাধীনতা পরবর্তিকালে রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষা সহ আনুসঙ্গিক সকল দায়িত্বও পালন করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো বিবেচনায় তিনি স্বাধীনতা পরবর্তি বাংলাদেশে সনাতন (regular) সেনাবাহিনীর ঘোর বিরোধিতা করেন। তার মতে একটি সনাতন সেনাবাহিনী চালানোর খরচ বাংলাদেশের মত একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জন্যে বাহুল্য এবং এমন একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দ্রুত বিদেশি সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল করে তুলবে। সেনাবাহিনীর জন্য বাজেটের একটি বিপুল অংশ ব্যয় হবে যা অন্যথায় উন্নয়ন খাতে ব্যয় করা সম্ভব। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে তার এসব পরিকল্পনা উপেক্ষিত হলেও তিনি গণবাহিনীর আশা ত্যাগ করেননি। ’৭৫ এর নভেম্বরে তিনি তাই সেই স্বপ্নপূরণে পুনরায় সচেষ্ট হন বিদ্রোহে নের্তৃত্ব দিয়ে।
আজ আমরা জানি তার প্রতিটি ভবিষ্যতবাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমানিত হয়েছে, তার প্রতিটি পরিকল্পনা এখন আমাদের কাছে যুগান্তকারি ও দুরদৃষ্টি সম্পন্ন বলে মনে হয়, কিন্তু তবু কেন যেন এই মহান মানুষটিকে তার যথাযোগ্য সম্মান দেখাতে আমরা কুন্ঠা বোধ করি। যে ভুলের ঋণ তিনি তার নিজ জীবন দিয়ে পরিশোধ করলেন সেই ভুলের জন্য কি আজো আমরা তাকে ক্ষমা করতে পারি না?
