উদয়ের পথে শুনি কার বানী
ভয় নাই ওরে ভয় নাই
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই…
লরেন্স লিপশুলজের লেখা “Bangladesh: The Unfinished Revolution” পড়ার পর থেকেই মাঝে মাঝে কোন এক উদাত্ত কন্ঠের এই আবৃত্তি যেন আমার কানে ভেসে আসে। মুহুর্তে রোমাঞ্চিত হই, উদ্বেলিত হই সেই কন্ঠের আহ্বানে। একই সাথে বিষাদে ভরে যায় মনটা। অবিশ্রুতের একটি লেখার মন্তব্যে কর্নেল তাহের প্রসঙ্গের অবতারণা করায় তিনি আমাকেই এই গুরু দায়িত্ব দিলেন এই প্রসঙ্গে একটি আলোচনার সূত্রপাত করার। আমার নিজ জ্ঞান বা গবেষনা এই প্রসঙ্গে খুবই সীমিত যার সিংহভাগই এসেছে লিপশুলজের লিখাটি থেকে তাই এই আলোচনায় বক্তার চেয়ে শ্রোতার আসনটিই বরং আমার কাছে বেশি লোভনীয়। তবু আলোচনা সূচনার স্বার্থেই আমার এই প্রয়াশ।
কর্নেল তাহের – কেমন ছিলেন তিনি?
খুবই ছোট বেলা থেকে আমি কর্নেল তাহের নামটির সাথে পরিচিত। তবে এই নামের রহস্য কখনোই আমার কাছে সম্পূর্ণ পরিস্কার হয়নি। আজো যেন তা কিছুটা ধোয়াটে। বালক বয়েসে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার পক্ষে বিপক্ষে এত লেখা পড়েছি যে নামটি আমার কাছে (মাফ করবেন) কর্নেল ফারুক আর কর্নেল রশিদের সমার্থক হয়ে উঠেছিল। পরবর্তিতে সেই ভুল ভাঙ্গে এবং নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত হই। ইতিহাস বিকৃতির এই যুগে এখানে সেখানে পত্রিকায় কারো মন্তব্যে কর্নেল তাহের এর উল্লেখ পাই, তবু যেন পরস্পর বিরোধিতার আজো কোন অন্তঃ নেই। বয়েস বাড়ার সাথে সাথে তার যে আকৃতি আমার কাছে ধীরে ধীরে ফুটে উঠেছে সেই আকৃতি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার। যুদ্ধক্ষেত্রে একটি পা হারানো সত্যেও তার সেই ব্যবচ্ছেদিত আকৃতি আমার চোখে পড়ে না, বরং মনষ্পটে ভেসে উঠে এক বলিষ্ঠ কাঠামো যে কিনা একটি পঙ্গু জাতিকেও টেনে তুলতে সক্ষম। সবুজের মাঝে আমরা আজ যে লাল পেয়েছি সেই লালের কিছুটা যেন তারই রক্ত থেকে নেয়া। তাই প্রশ্ন উঠে তিনি আজো এত বিতর্কিত কেন? এই প্রশ্নের কয়েকটি কারন হয়তো নিম্নরূপ:
১। বামপন্থী রাজনীতির সমর্থক হবার অপরাধে সকল বুর্জোয়া শাসনামলেই তার অবদান উপেক্ষিত হয়েছে।
২। বঙ্গবন্ধুর সরকার পরিচালনা পদ্ধতির সমালোচনা করায় তাকে চাকরিচ্যুত করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ আজো তাকে ক্ষমা করতে পারেনি।
৩। ১৫ই অগাস্টের কাল রাত্রির পর তার রাজনৈতিক অবস্থান অনেকাংশে অস্পষ্ট। উপরন্তু জেনারেল ওসমানিকে সাথে নিয়ে হত্যাকারীদের সাথে তার সমঝোতা বৈঠকের প্রমান মেলে। তবুও তিনি মোস্তাক সরকারকে সমর্থন করেছিলেন এমন প্রমাণও কেউ পেয়েছেন বলে আমার জানা নেই।
৪। ৩রা নভেম্বর খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থানকে অনেকেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষের শক্তির উত্থান বলে মনে করেন এবং সেই প্রয়াসকে দ্রুত স্তব্ধ করে দেয়ার অপরাধে কর্নেল তাহেরকে অভিযুক্ত করেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি খালেদ মোশারফের সত্যিকার আকাঙ্খা কি ছিল তা আজো আমার কাছে ঠিক স্পষ্ট নয়। ৪ঠা নভেম্বরের জেল হত্যা যেন সমীকরণটিকে আরো জটিল করে তুলেছে। প্রায় আড়াই মাস সময় পাওয়া সত্ত্বেও একেবারে শেষ মূহুর্তে পলায়নরত মোস্তাক সরকার বা কর্নেল ফারুক/রশিদ গংদের পক্ষে এরকম একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকান্ড ঘটানোর কারণ বা পদ্ধতি কোনটাই যেন ঠিক হিসেবে মেলেনা। এই প্রসঙ্গে অন্যদের আলোচনায় ঘটনাটি আরো স্পষ্ট হবে আশা রাখি।
৫। অন্যদিকে বিএনপি ৭ই নভেম্বরের বিদ্রোহকে বরাবরই সিপাহী জনতার সংগ্রাম বলে চালিয়ে আসছে যার মহানায়ক হিসেবে তারা জিয়াকে দাড় করাতে সদা সচেষ্ট। তাই ৭ই নভেম্বরে কর্নেল তাহেরের ভুমিকাকে স্বীকার করলে তাদের সব ভাওতাবাজী ধরা পড়ে যাবার ভয় থাকে। তদুপরি কর্নেল তাহেরের কৃতিত্ব স্বীকার করলে তাকে সাজানো মামলায় অবৈধভাবে হত্যার দায়ও কাঁধে নিতে হয়।
৬। অনেকে জিয়ার উত্থানের পেছনে তার পরোক্ষ ভুমিকার কথা স্বরণ করে তাকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং একজন ভিশনারি হিসেবে তার যোগ্য মর্যাদা দিতে কুন্ঠিত বোধ করেন।
৭। আবার কেউ কেউ আছেন যারা জিয়ার স্বৈরাচারী উত্থান সমর্থন না করলেও বিদ্রোহ তথা কর্নেল তাহের দমনের মাধ্যমে আমাদের সবুজ লাল পতাকাটিকে পুরোপুরি লাল হওয়া থেকে বাঁচানো গেছে ভেবে কর্নেল তাহের এর সদিচ্ছা আর দেশপ্রেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন।
কর্নেল তাহের তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে এদেশের প্রায় সবকটি বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তিকে খেপিয়ে তুলেছিলেন। তাই বিগত ৩৮ বছরেও যে তাঁর সঠিক মূল্যায়ন হয়নি এতে অবাক হবার কিছু নেই। তবে তাঁর করুণ পরিণতি কেন আজো একটি রাষ্ট্রীয় গোপনীয় বিষয় তার কারণ হয়তো কিছুটা ভিন্ন। এর মূল কারণটি সম্ভবত নিহিত আছে আমাদের দেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও শক্তিশালী রাজনৈতিক কাঠামো, অর্থাৎ আমাদের সেনাবাহিনীর মনোভাবের মধ্যে। কর্নেল তাহের তাঁর প্রগতিশীল চেতনার আলোকে আমাদের সেনাবাহিনী নিয়ে যে মহা-পরিকল্পনা করেছিলেন তা আমাদের সেনাবাহিনীর কাছে আজো হুমকি স্বরূপ তাই এর পরিণামে তাকে জীবন দিতে হয় এবং তার বিচারের নামে যে প্রহসনের অবতারণা করা হয়েছিল তার যাবতীয় দলিলপত্র আজো কোন এক গোপন কুঠুরিতে বাক্সবন্দী। সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁর সেসব যুগান্তকারী পরিকল্পনাগুলো নিচে বর্ণনা করা হল-
কর্মশীল সেনাবাহিনী (Working-Army)
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই কর্নেল তাহের কুমিল্লা ব্রিগেডের দায়িত্ব নেন। প্রথমেই তিনি সেনাবাহিনীর সকলের আত্মমর্যাদা বোধ এবং সততার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি তার ব্রিগেডের সবাইকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাদের দ্বারা অবৈধভাবে অর্জিত সব কিছু ফেরত দেয়ার আহবান করেন। তার সেই ডাকে বহু অফিসার ও সিপাহী সাড়া দিয়েছিলেন। পরবর্তিতে তিনি ঘোষণা দেন কুমিল্লা ব্রিগেড সেনানিবাস সংলগ্ন পতিত জমিতে কৃষিকাজের মাধ্যমে নিজেরা খাদ্যে সয়ংসম্পুর্ণ হবার সাথে সাথে আঞ্চলিক কৃষকদের কৃষিকাজে সহায়তা প্রদান করবে। তিনি এই ঘোষনাকে কাজে পরিণত করে দেখিয়েছেন এবং কুমিল্লা ব্রিগেডের প্রতীক হিসেবে তিনিই ‘লাঙ্গল’ প্রস্তাব করেন।
শ্রেনীহীন সেনাবাহিনী (Classless-Army)
৭ই নভেম্বরের বিদ্রোহের মূল উদ্দীপনাই ছিল শ্রেনীহীন সেনাবাহিনীর স্বপ্ন। তিনি সিপাহীদের উদ্বুদ্ধ করেন সনাতন পদ্ধতির সেনাবাহিনীর এলিট অফিসার কাঠামোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে। তিনি আরো অঙ্গীকার করেন যে সেনাবাহিনী পরিচালিত হবে একটি সুপ্রীম কাউন্সিলের মাধ্যমে যেখানে কারো একক কর্তৃত্ব থাকবে না। নিয়তির এক নির্মম পরিহাস এই যে তিনি সেই সুপ্রীম কাউন্সিলের নের্তৃত্ব দেয়ার জন্যে জিয়াকেই সবচেয়ে যোগ্য লোক বলে বিবেচনা করেন। জিয়া পরবর্তিতে সুকৌশলে সিপাহীদের নিরস্ত্র করে ব্যরাকে ফেরত পাঠিয়ে একে একে এই বিদ্রোহের সব পরিকল্পনাকারীদের কারারুদ্ধ করে। সঠিক নের্তৃত্ব নির্বাচনে কর্নেল তাহেরের সেই ভুলের মাশুল শেষ পর্যন্ত তাকে দিতে হয় নিজ জীবন দিয়ে আর জাতিকে দিতে হয় পরবর্তি ১৫ বছরের সামরিক স্বৈরশাসন আর শত শত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের প্রাণের বিনিময়ে।
গণবাহিনী (People’s-Army)
লিপশুলজের মতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই শীর্ষ সামরিক নের্তৃত্বের সাথে সঠিক যুদ্ধপরিকল্পনা বিষয়ে কর্নেল তাহেরের মতভেদ দেখা দেয়। কর্নেল তাহের সনাতন যুদ্ধপদ্ধতির বিপরীতে গেরিলা যুদ্ধের উপর জোর দেন। তিনি ভারতীয় সামরিক সহায়তা নেয়ার বিরোধিতা করেন এবং একই সাথে মুক্তিবাহিনীর হেড কোয়ার্টার বাংলাদেশের ভুখন্ডে সরিয়ে আনার প্রস্তাব করেন। তার কাছে ভারতীয় সহায়তায় একটি দ্রুত সামরিক সমাধানের চেয়ে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের ভেতরেই এক বিপুল গেরিলা বাহিনী তৈরী প্রাধান্য পায়। তার মতে এমন এক লক্ষ লোকের একটি গণবাহিনী প্রশিক্ষণ দিতে চার বছর সময়ের প্রয়োজন, এবং এই বাহিনী স্বাধীনতা পরবর্তিকালে রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষা সহ আনুসঙ্গিক সকল দায়িত্বও পালন করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো বিবেচনায় তিনি স্বাধীনতা পরবর্তি বাংলাদেশে সনাতন (regular) সেনাবাহিনীর ঘোর বিরোধিতা করেন। তার মতে একটি সনাতন সেনাবাহিনী চালানোর খরচ বাংলাদেশের মত একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জন্যে বাহুল্য এবং এমন একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দ্রুত বিদেশি সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল করে তুলবে। সেনাবাহিনীর জন্য বাজেটের একটি বিপুল অংশ ব্যয় হবে যা অন্যথায় উন্নয়ন খাতে ব্যয় করা সম্ভব। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে তার এসব পরিকল্পনা উপেক্ষিত হলেও তিনি গণবাহিনীর আশা ত্যাগ করেননি। ’৭৫ এর নভেম্বরে তিনি তাই সেই স্বপ্নপূরণে পুনরায় সচেষ্ট হন বিদ্রোহে নের্তৃত্ব দিয়ে।
আজ আমরা জানি তার প্রতিটি ভবিষ্যতবাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমানিত হয়েছে, তার প্রতিটি পরিকল্পনা এখন আমাদের কাছে যুগান্তকারি ও দুরদৃষ্টি সম্পন্ন বলে মনে হয়, কিন্তু তবু কেন যেন এই মহান মানুষটিকে তার যথাযোগ্য সম্মান দেখাতে আমরা কুন্ঠা বোধ করি। যে ভুলের ঋণ তিনি তার নিজ জীবন দিয়ে পরিশোধ করলেন সেই ভুলের জন্য কি আজো আমরা তাকে ক্ষমা করতে পারি না?
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১২ comments
রায়হান রশিদ - ২০ এপ্রিল ২০০৯ (১:০২ পূর্বাহ্ণ)
আরমান রশিদকে ধন্যবাদ এই জরুরী আলোচনাটা শুরু করার জন্য। ‘৭১ থেকে ‘৭৪ এর ইতিহাস নিয়ে তথ্যের কমতি নেই। কিন্তু ‘৭৫ থেকে ‘৮১ (মোটা দাগে) এই সময়কালটা সবসময়ই যেন কিছুটা অন্ধকারে রয়ে গেছে। একে নিয়ে আবেগী মতামতের যেমন প্রাচুর্য, তেমনই কমতি বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সম্ভবত সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল এটা। গুরুত্বপূর্ণ এই অর্থে যে, এ সময়কার ঘটনাবলী এবং তাতে পাত্র পাত্রীদের ভূমিকাই (সম্ভবত) ঠিক করে দিয়েছিল পরবর্তী ২৬ বছরের বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ এবং গতি প্রকৃতি। কর্নেল তাহের এই সময়কালের পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকদের একজন। তাঁকে নিয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে আশা করছি সেই সময়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই উঠে আসবে এবং বিশ্লেষিত হবে। এতে এক দিক থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর এবং তাদের নেতৃত্বের পরবর্তী বছরগুলোতে ভূমিকার (কিংবা ভূমিকাহীনতার) কিছু ব্যাখ্যা মিলবে। অন্য দিক থেকে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রে প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিকাশ এবং রাজনীতিতে তাদের ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে ওঠার আখ্যানও কিছুটা হয়তো পাওয়া যাবে। আলোচনাটা তাই জরুরী।
কিন্তু মূল আলোচনার স্বার্থে কিছু বিষয় মনে হয় আগেই প্রতিষ্ঠা করে নেয়াটা জরুরী। সে লক্ষ্যে দু’টি প্রস্তাব:
(১) সেই সময়কালের গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর (কিংবা মাস/বছরগুলোর) একটা সর্বজনগ্রাহ্য কালানুক্রম (timeline) কেউ যদি এখানে মন্তব্যাকারে তুলে ধরেন, তাহলে আলোচনাটা সেটাকে কেন্দ্র করে এগোতে পারে।
(২) আর যেটা প্রয়োজন তা হল সেই সময়কার ঘটনাবলীর আলোকে মূল চরিত্রদের (সকল পক্ষ নির্বিশেষে) একটি তালিকা যদি কেউ এখানে মন্তব্য আকারে তুলে ধরেন তাহলেও আলোচনাটা তাতে উপকৃত হবে।
ধন্যবাদ।
আরমান রশিদ - ২১ এপ্রিল ২০০৯ (১২:১৬ পূর্বাহ্ণ)
কালানুক্রমটি মনে হয় ৭৫ এর ১৫ই অগাস্ট থেকে শুরু করা যায়। কয়েকটি তারিখ দিয়ে শুরু করছি, আশা করি অন্যরা আরো দেবেন-
১৫ই অগাস্ট ৭৫ – বঙ্গবন্ধু হত্যা ও খন্দকার মোস্তাকের সরকার গঠন। একই দিনে সেনাবাহিনীর ভেতর দৈত শাসন শুরু হয়। কর্নেল ফারুক/রশিদ গংরা সেনাবাহিনীর চেইন অফ কমান্ড অগ্রাহ্য করে বঙ্গভবনে অবস্থান নেয়।
৩রা নভেম্বর ৭৫ – খালেদ মোশারফ এর অভ্যুথ্যান এবং জিয়া নজর বন্দি হন।
৪ঠা নভেম্বর ৭৫ – জেল হত্যা, মোস্তাক সরকারের পতন। খালেদ মোশারফ এর সাথে ফারুক/রশিদ গংদের সমঝোতা ও তাদের বিদেশ পলায়ন।
৫ই নভেম্বর ৭৫ – বিচারপতী সায়েমের সরকার গঠন।
৭ই নভেম্বর ৭৫ – কর্নেল তাহেরের নের্তৃত্বে সিপাহীদের বিদ্রোহ, জিয়ার মুক্তিলাভ। বিদ্রোহের প্রতি প্রেসিডেন্ট সায়েমের সমর্থন প্রকাশ। সামরিক আইন ঘোষনা। প্রেসিডেন্ট সায়েমকে চিফ মার্শাল ল এ্যাডমিনিস্ট্রেটর নিয়োগ। জিয়া,তোয়াব ও এম এইচ খানকে ডেপুটি চিফ মার্শাল ল এ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে নিয়োগ।
৮ই নভেম্বর ৭৫ – মেজর জলিল ও আ স ম আব্দুর রব সহ অন্যান্য জাসদ নেতাদের মুক্তিলাভ।
২৩এ নেভেম্বর ৭৫ – জলিল ও আ স ম আব্দুর রব পুনরায় গ্রেপ্তার।
২৪এ নেভেম্বর ৭৫ – কর্নেল তাহের গ্রেপ্তার।
ডিসেম্বর ৭৫ – নৌ বিদ্রোহ দমন।
জানুয়ারি ৭৬ – ১২৫০০ সদস্যের ‘কমব্যাট ব্যাটালিয়ন’ নামে বিশেষ পুলিশ বাহিনী গঠন।
মার্চ ৭৬ – চট্টগ্রামে সেনা বিদ্রোহ দমন।
জুন ৭৬ – কর্নেল তাহের সহ মোট ৩২ জনের বিচারের জন্য গোপন ট্রাইবুনাল পরিচালনা।
২১শে জুলাই ৭৬ – কর্নেল তাহেরের ফাসি।
আপাতত একটিই…
রায়হান রশিদ - ২১ এপ্রিল ২০০৯ (১২:৩৬ পূর্বাহ্ণ)
একটু অস্পষ্ট রয়ে গেল। কিছু তথ্য সূত্র এবং উদ্ধৃতি পাওয়া গেলে ভাল হয়।
আরমান রশিদ - ২২ এপ্রিল ২০০৯ (১১:৩৮ অপরাহ্ণ)
যতদুর মনে পড়ে লিপশুলজের বইটিতে এভাবেই ঘটনা প্রবাহের বিবরণ দেয়া হয়েছে। কোথায় যেন বইটির একটি ইলেক্ট্রনিক কপি দেখেছিলাম- খুজে পেলে উদ্ধৃতি আকারে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
রায়হান রশিদ - ২৪ এপ্রিল ২০০৯ (২:১১ পূর্বাহ্ণ)
ক.
খালেদ মোশাররফ এর পাল্টা অভ্যুত্থানের তোড়জোড় শুরু হয় ২ নভেম্বর ১৯৭৫ থেকে। (এখানে প্রফেসর অজয় রায়ের লেখায় বিস্তারিত)। জেলে জাতীয় চার নেতার হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় ৩ নভেম্বর, এমনকি লিপসুলজের ভাষ্য অনুযায়ীও। লিপসুলজের লেখাটির একটি কপি মুক্তাঙ্গনেই আপলোড করা রয়েছে।
তিনি লিখেছেন:
আর সব বিষয়ে আবেগ নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বর্ণনা করতে যে লিপস্যুলজের জুড়ি মেলা ভার, তিনিই যেন ঘটনাক্রমের “চাবিকাঠি” অংশটি কেমন এক বাক্যে শেষ করে দিয়েছেন। বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই অতি-পরিমিতিবোধ (!) কিছুটা অবাক করার মতই। বয়ানটি বিভ্রান্তিকরও। এটি পড়ে এমন বিভ্রম হতেই পারে যে খালেদ মোশাররফ নিজেও বুঝি জেল হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত!
খ.
তুমি লিখেছো:
চার নেতা হত্যার ‘কারণ’ বা ‘পদ্ধতি’ বিষয়ে ঠিক কোন্ হিসেবটি মিলছেনা?
গ.
লিপস্যুলজের লেখা এবং আদালতে দেয়া কর্নেল তাহেরের জবানবন্দিটি আবারও পড়লাম। পড়ে ভীষণ খটকা লাগলো। ৭ নভেম্বর এর আগের ঘটনাকাল বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার কর্নেল তাহের এর ভাষ্যে জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং তার পাল্টা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে যে পরিমাণ বিষোদগার লক্ষনীয়, সে তুলনায় ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের বিষয়ে তিনি যেন ঠিক ততটাই প্রশ্রয়ী, ততটাই নিমরাজী; অন্তত পাল্টা অভ্যুত্থান করার জন্য তাঁর মধ্যে ‘যথেষ্ট বিরোধী’ মনভাবের অভাব লক্ষ্য করেছি মোশতাকের সরকারের বিরুদ্ধে। তাহের-লিপস্যুলজের ভাষায় - মোশতাকদের অভ্যুত্থান যদি আমেরিকা-পাকিস্তান-ইসলামপন্থীদের ষড়যন্ত্রের ফসল হয়ে থাকে, তাহলে খালেদ মোশাররফদের অভ্যুত্থান হল রুশ-ভারত ষড়যন্ত্রের ফসল। প্রথমটিকে তিনি ‘বিপ্লব’ বলছেন, আর পরেরটিকে অবশ্য-প্রতিরোধ্য ‘প্রতিবিপ্লব’ বলছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য প্রথম অভ্যুত্থানটিকে তিনি দ্বিতীয়টির চেয়ে কম প্রতিক্রিয়াশীল মনে করলেন কোন্ যুক্তিতে? আর, জবানবন্দিতে অনেকের বিষয়েই বলেছেন তিনি, কিন্তু চার নেতার হত্যাকান্ড বিষয়ে তাহেরকে কিছুটা নিরবই মনে হল (আবারও খুঁজে দেখবো, কিছু পাই কিনা)। আর যে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করতে কর্নেল তাহেরের এত তৎপরতা, সেই জিয়াই কি ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থান পরবর্তী মোশতাক সরকারের মনোনীত সেনা প্রধান হিসেবে নিয়োগ পাননি? আমার খটকা এখানেই।
এগুলোকে কর্নেল তাহেরের স্রেফ বিবেচনার ভুল বলতে পারলে আমিও স্বস্তি পাই। আমাদের সামনে কোনো ‘হিরো’ নেই, অনুসরণ করার মত role model-ও খুব বেশী নেই। তাই ‘হিরো’ খোঁজার চেষ্টার মধ্যে দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু এখন মনে হয় সময় এসেছে সমস্ত rhetoric এবং romanticism এর প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে প্রকৃত ঘটনার মূল্যায়নের। সেটা তাহেরের জন্য যতটা জরুরী, খালেদ মোশাররফের জন্যও ততোটাই জরুরী। আর, বলাই বাহুল্য, সেটা দেশের জন্যও জরুরী। কিছু দিন আগের পিলখানা ঘটনায় আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি – এই দেশে কতই না সহজ একটি ‘৭৫!
শাহীন ইসলাম - ২০ এপ্রিল ২০০৯ (৭:৫৩ অপরাহ্ণ)
আরমান রশীদকে ধন্যবাদ লেখাটির জন্য। এ মূহুর্তে ইতিহাসের সঠিক মূল্যায়নের কাজে সহায়ক না হয়ে আমি ইতিহাস থেকে কিংবা ইতিহাসবিদের প্রচেষ্টা থেকে কিছু শিক্ষা নিতে আগ্রহী। রায়হান “বস্তুনিষ্ঠ” বা “বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের” কথা বলছে। সে প্রসঙ্গে লরেন্জ লিফশুল্জের (সম্ভবত সঙ্গে আর একজন সহ-লেখক আছেন: “কাই বার্ড”) ঐ বইটির ভূমিকাতে বস্তুনিষ্ঠতা বনাম নিরপেক্ষতা’র ( objectivity versus neutrality) মধ্যে একটি পার্থক্য টেনেছেন মনে পরে। পার্থক্যটি আমি আর বিশদ ভাবে মনে করতে পারছিনা, কিন্তু মনে হচ্ছে তা একটু মাথায় রাখা উচিৎ। আরমান রশীদ কি ঐ অংশটুকু একটু কোট করতে পারবেন, প্লীজ?
আরমান রশীদ লেখেছেন,
কর্ণেল তাহের যদি তা বলে থাকেন তা হলে বলব তিনি বেশ বিচক্ষন ছিলেন, কথাটি যে কত সত্যি তা আমরা বর্তমান পাকিস্তানের দিকে তাকালে হারে হারে টের পাই। বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি বিড়াট অংশ সামরিক বাহিনীর প্রভাব দেখা যায়, সেটি মনে হয় আমরা পাকিস্তান থেকে inherit করেছি; আমরা পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়েছি বটে কিন্তু তার বাজে প্রভাব থেকে মুক্ত হইনি।
এই প্রসঙ্গে আমার একটি তাত্ত্বিক সমস্যা — সমস্যাটি আমি এ ভাবে দেখি: কত বড় বনাম কত ছোট। বাংলাদেশের মত একটি ছোট দেশে যদি রেগুলার আর্মি থাকতে হয় তা হলে তা একেবারে unfeasible, দেশের সিংহভাগ আয় ওদিকটায় চলে যাবে, আবার কর্ণেল তাহের যে বিকল্প চিন্তা করছিলেন তাও feasible মনে হয় না। বাংলাদেশের পরিবর্তে আরো ছোট অঞ্চল চিন্তা করতে পারেন। সমস্যাটি আমার মনে হয় জাতি-রাষ্ট্র নিয়ে বর্তমান বিশ্বচিত্রের মধ্যে নিহিত। [ এখানেই অসাপ্ত রাখলাম]
আরমান রশিদ - ২০ এপ্রিল ২০০৯ (৯:৩৭ অপরাহ্ণ)
@শাহীন
দুক্ষিত, বইটি সাথে নেই। তবে একটি ব্যাপারে একটু খটকা লাগলো। যতদূর মনে পড়ে বইটির কোন ‘co-author’ ছিল না। আপনি কাই বার্ড ও লরেন্স লিপশুলজের ‘Hiroshima’s Shadow’ বইটির কথা বলতে চাননি তো?
আলোচনার সুবিধার্থে আপনার যুক্তিগুলি জানতে পারলে খুব ভাল হত।
শাহীন ইসলাম - ২১ এপ্রিল ২০০৯ (৪:৩০ পূর্বাহ্ণ)
@আর্মান রশীদ
না “Hiroshima’s Shadow” নামটি আমি এই প্রথম শুনলাম।
feasibility নিয়ে … :
সার্বভৌমত্বকে একটি দেশের (বর্তমান বিশ্ব ব্যাবস্থায়) অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ধরে নেওয়া হয় । সে সার্বভৌমত্বের দোহায় দিয়ে রেগুলার আর্মি গঠিত হ্য়; বড় দেশ হলে সে আর্মি হয় শোষকের অস্ত্র, আর ছোট দেশ হলে আর্মি নিজেই হয় শোষক । আমার কেন জানি মনে হয় রেগুলার আর্মি ছাড়া সার্বভোমত্ব চিন্তা করা যায় না। (সুইৎটসারল্যান্ড ব্যাতিক্রম, সেরকম ভৌগলিক অবস্থান আমাদের নেই; অবশ্য বর্তমান লাতিন আমেরিকার চিত্রটি আমার কাছে পষ্ট নয়)। ব্যাপারটিকে আমি এ ভাবে দেকছি:
জাতি-দেশ ——-> সার্বভৌমত্ব ——-> রেগুলার আর্মি
irregular army দিয়ে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা যাবে — তথা একটি জাতি-দেশ গঠিত হবে … ! কর্ণেল তাহেরের মডেলটা কি? তা ছাড়া অবিশ্রুত যেটি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন : ঐ সিপাহী দিয়ে, যারা আগে থেকে dehumanized (এবং মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোন থেকে যারা উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে বিযুক্ত), তাদেরকে দিয়ে কি ভাবে আপনি নতুন কিছু আশা করতে পারেন?
আরমান রশিদ - ২২ এপ্রিল ২০০৯ (১০:০৭ অপরাহ্ণ)
আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে কিছু অনুমানের উপর নির্ভর করতে হয়। যতদুর জানতে পেরেছি ৭ই নভেম্বরের বিদ্রোহে কর্নেল তাহের দু’টি সংগঠনের উপর নির্ভর করেছিলেন। যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত জাসদের ক্যাডারদের একটি বেসামরিক অংগসংগঠন ‘বিপ্লবি গণবাহিনী’ ছিল এর মধ্যে একটি। আজ আমরা ‘সিপাহী জনতা’-র কথা শুনি, আমার ধারনা ‘জনতা’ বলতে এই বিশেষ সংগঠনটিকেই বোঝানো হয়। অপর অংশটি ছিল সেনাবাহিনীর ভেতর বিরাজমান মুলত মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের নিয়ে গঠিত একটি গোপন সংগঠন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে যুদ্ধচলাকালীন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুদ্ধে অংশ নেয়া সেনা সদস্যদের মধ্যে এক বিপুল গুণগত ও চরিত্রগত পরিবর্তন এসেছিল যা পাকিস্তানে আটকে পড়া(?) সেনা সদস্যদের মধ্যে ছিল অনুপস্থিত। যুদ্ধের ৯টি মাসে তারা মাটি ও মানুষের খুব কাছাকাছি পৌছাতে পেরেছিলেন যে অভিজ্ঞতা সাধারনত কোন regular সেনাবাহিনীর হয় না। যতদুর মনে পড়ে লিপশুলজ তার বইটিতে লেনিনের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন যে কোন দেশে সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বশর্তই হল সে দেশের সেনাবাহিনীর অর্ধেকের বেশী অংশের সমর্থন আদায়। আমার ধারনা কর্নেল তাহের এই তত্ত্বে বিশ্বাসি ছিলেন তাই সেনাবাহিনীর যুদ্ধফেরত এই বিশেষ অংশটির উপর নির্ভর করেছিলেন বিপ্লব সূচনার অনুঘটক হিসেবে। ৭ই নভেম্বরে কর্নেল তাহের শতভাগ সাফল্যের সাথে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন ঠিকই কিন্তু পরবর্তী কয়েকটি দিনে তিনি বিপ্লবের বেসামরিক অংশটিকে তার সাথে পাননি। তারাপুরের মত দেশের প্রত্তন্ত অঞ্চলে কিছু বিচ্ছিন্ন বিপ্লবী ঘটনা ঘটলেও ততকালীন জাসদ দেশব্যাপি বিপ্লব ছড়িয়ে দেয়ার পরিবর্তে বরং অনেকটা নমনীয় অবস্থান নেয়। সামগ্রিক বিপ্লবের বদলে সেদিন জাসদের দলীয় সিদ্ধান্তে প্রাধান্য পায় দলীয় নেতাদের মুক্তি এবং একটি তত্তাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্রুত সাধারণ নির্বাচনের ব্যাবস্থা করা। অবিশ্রুত তার মন্তব্যে সেই ইঙ্গিতই দিয়েছেন।
এবার আসি ‘গণবাহিনী’ প্রসঙ্গে। আমার মূল লিখায় আমি ‘কর্মশীল সেনাবাহিনীর’ উল্লেখ করেছি তবে এখন মনে হচ্ছে কর্মশীল এর পরিবর্তে ‘উৎপাদনশীল’ শব্দটি অধিক প্রাসঙ্গিক। কর্নেল তাহেরের চেতনায় সেনাবাহিনীর মডেলটি কিরকম ছিল সে সম্পর্কে আমার স্পষ্ট কোন ধারনা নেই। তবে মনে হয় তিনি সেনাবাহিনীর একটি উৎপাদনশীল রূপ দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি এমন একটি সেনাবাহিনী চেয়েছিলেন যা কিনা দেশের অর্থনীতিতে সরাসরি ভূমিকা রাখবে। অন্তত পক্ষে অর্থনীতির উপর সেনাবাহিনীর কুপ্রভাব যতটুকু সম্ভব কমিয়ে আনবে। সেই সেনাবাহিনীর কর্মপদ্ধতির কি রূপরেখা তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন তা আমার জানা নেই।
একটি সুসংগঠিত রেগুলার আর্মির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্ক করা কঠিন। তবে সেই সেনাবাহিনী প্রকৃতি ও আকার কি হবে তা নিয়ে বিতর্ক চলে। যে সব দেশে people’s army আছে সেখানেও তাদের নের্তৃত্ব দেয় রেগুলার আর্মির একটি সুপ্রশিক্ষিত অংশ। লিবিয়া ও দক্ষিন কোরিয়ার মত দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল ছাত্র-ছাত্রির জন্য সামরিক শিক্ষা বাদ্ধ্যতামূলক করার মাধ্যমে তারা তাদের রেগুলার আর্মির আকার অনেকটা লাঘব করতে পেরেছে। সেই সাথে কমিয়ে আনতে পেরেছে দেশের অর্থনীতিতে সামরিক বাহিনীর কুপ্রভাবগুলি। একবার সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন একজন জুনিয়র অফিসারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ভারত যদি কখনো আমাদের আক্রমণ করে তবে আমাদের সেনাবাহিনীর রণনীতি কি হবে। তিনি বলেছিলেন এরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সম্ভবত আমরা ভারতকে সামরিক ভাবে ৮ ঘন্টা ঠেকিয়ে রাখতে পারব, এই সময়টুকু ব্যয় হবে হালকা অস্ত্রসস্ত্র সরিয়ে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী গেরিলাযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে গেরিলা যুদ্ধই যদি শেষ ভরসা হয় তবে প্রতি বছর এত হাজার-কোটি টাকা এই খাতে ব্যয় করা কেন? এর আর কি কি বিকল্প আমরা খতিয়ে দেখতে পারি?
আমাদের আজকের বিশ্বের বর্তমান বাস্তবতায় সামরিক আগ্রাসনের চেয়ে অর্থনৈতিক আগ্রাসনই আমাদের মত দেশের সার্বভৌমত্বের উপর সবচেয়ে বড় হুমকি বলে মনে করি। তাই আপনি সার্বভৌমত্বের সাথে রেগুলার আর্মির অপরিহার্যতার যে সমীকরণটি দিয়েছেন তার সাথে শতভাগ একাত্বতা প্রকাশ করতে পারলাম না।
অবিশ্রুত - ২০ এপ্রিল ২০০৯ (১১:৫৮ অপরাহ্ণ)
আরমান রশিদকে ধন্যবাদ সংক্ষেপে কর্নেল তাহেরের প্রতিরক্ষা-ভাবনার সঙ্গে মিলিয়ে সাতই নভেম্বরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং তাহেরকে নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার ধরণগুলি তুলে আনার জন্যে।
সাতই নভেম্বর আমাদের ইতিহাসের একটি অস্বচ্ছ অধ্যায়। এবং একে স্বচ্ছ চোখে দেখার জন্যে বোধকরি আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও অনেক বছর। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলি তাদের তথ্য অবমুক্ত করলে হয়তো আমরা এ ব্যাপারে আলোচনার পরিসর বাড়াতে পারব।
আমি জানি না কেন, তবে সব সময়েই মনে হয়েছে, সামরিক বাহিনী নিয়ে অভ্যুত্থানের ব্যাপারে কর্নেল তাহেরের বেশ অবসেসন ছিল। এবং এই অবসেসনের সূত্র ধরেই হয়তো তিনি সামরিক বাহিনীতে শ্রেণীসংগঠন গড়ে তোলার পথ ধরে এগিয়ে গিয়েছিলেন। সাধারণ মার্কসীয় ধারণা বলে, একটি শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি তার মিত্র শক্তি খুঁজবে দেশের শ্রমিক শ্রেণীর ভেতর, শোষিত কৃষক শ্রেণীর ভেতর; কিন্তু কর্নেল তাহের এই মিত্র শক্তি খুঁজেছেন সামরিক বাহিনীর সাধারণ সিপাহীদের মধ্যে। সমাজ পরিবর্তনের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ কোনও রাজনৈতিক দল একটি বিশেষ বাহিনীতে নিজেদের সংগঠন গড়ে তুলতেই পারে, কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে, সমাজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে বিপ্লবের মূল শক্তি আসলে কে ও কারা। আমার মনে হয়, তাহের এই ক্ষেত্রে বড় একটি ধাক্কা খেয়েছেন, এমনকি তার সহযোগীদের কাছ থেকেই। যেমন, যতদূর শুনেছি, সাতই নভেম্বর-এর আগে তাহেরকে দলের পক্ষ থেকে ধারণা দেয়া হয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে জাসদের অন্যান্য গণসংগঠনগুলিও মাঠে নামবে। এমনকি মফস্বল শহরের দু’চারজন জাসদ নেতার কাছ থেকেও শুনেছি, তারা সাত নভেম্বর ঢাকা বেতারের প্রথম ঘোষণা শোনার পর অপেক্ষা করেছেন নেতাদের কাছ থেকে থানা দখলের বার্তা পাওয়ার আশায়। সত্য-মিথ্যা জানি না, একজন জাসদ নেতা একবার কথপোকথনে জানিয়েছিলেন, এমনকি সিপিবি নেতারাও নাকি ওই সময় চেষ্টা করেছিলেন জাসদ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করার। কিন্তু কেন্দ্রীয় জাসদ নেতারা যেন হঠাৎ করেই নির্দেশ দেয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। জাসদের গণসংগঠনগুলো কেন সেসময় মাঠে নামেনি, কেন তাদের মাঠে নামানো হয়নি, সেটি এখনও একটি বড় প্রশ্ন।
প্রশ্ন আরও আছে। খালেদ মোশাররফের বিপরীতে জিয়াউর রহমানের দেশপ্রেম বা বিপ্লবী সত্ত্বা সম্পর্কে তাহেরের এত উচ্চ ধারণা পোষণের কারণ আমি এখনও বুঝতে অক্ষম। এইখানে একটি বিষয় জানিয়ে রাখি, সম্ভবত ছিয়াত্তর সালের দিকে কিংবা সাতাত্তর সালের দিকে আমি একটি পুস্তিকা পেয়েছিলাম। পুস্তিকাটির বিষয় ছিল কর্নেল তাহের বন্দি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জাসদের বিভিন্ন সংগঠনের সম্মিলিত বক্তব্য। বয়স আমার কম ছিল, ওটি পড়তে ভালো লাগলেও শেষ পর্যন্ত আর সংরক্ষণ করতে পারিনি এবং এখনও মাঝেমধ্যে মনে হয়, একটি মহামূল্যবান সম্পদ হারিয়েছি। এই পুস্তিকা পরে আরও অনেকের কাছে খুঁজেছি আমি, কিন্তু এখনও পাইনি। এ ধরণের যত পুস্তিকা বা লিফলেট আছে, তার সবই এখন জরুরি, ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি বুঝবার স্বার্থে। ওই পুস্তিকায় কয়েকটি লাইন ছিল, দুর্বল স্মৃতিশক্তি থেকে বলতে পারি, সামরিক বাহিনীর শৃঙ্ক্ষলা প্রসঙ্গে,- আজ যারা সামরিক বাহিনীর শৃঙক্ষলার কথা বলছেন, তাদের কাছে প্রশ্ন, সেদিন সামরিক বাহিনীর শৃঙ্ক্ষলা কোথায় ছিল যেদিন অমুক অমুক খালেদ মোশাররফকে অমুক ব্যাজ পরিয়ে সেনাপ্রধান হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন?
তাহেরের ফাঁসির পর-পর দু’টি পুস্তিকা বের হয়, একটি সম্ভবত সাঈদ তারেকের লেখা। আরেকটি জাসদ থেকেই প্রকাশিত, নাম সমগ্র জনতার মাঝে আমি প্রকাশিত। সাঈদ তারেক কে জানি না, তবে তাঁর বইটিতে লেখা হয়েছিল, তাহেরের সঙ্গে জিয়াউর রহমান প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা করেন মুক্তিযুদ্ধের সময়েই। কথা ছিল, ওসমানীর সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতর মুক্তাঞ্চলেই রাখার কথা বলা হবে এবং জিয়াউর রহমান এ প্রস্তাব তোলা হলে সমর্থন জানাবেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান রহস্যজনকভাবে প্রস্তাবটি তোলার পর নীরব ছিলেন। শুধু তাই নয় কামালপুরের যুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান জেড ফোর্সের সৈনিকদের সরিয়ে নিয়ে তাহেরকে বিপদগ্রস্থ করেন। অন্যদিকে, সকলেই জানেন, খালেদের কে ফোর্স-ই ছিল একমাত্র বাহিনী, যেখানে আওয়ামী লীগ বাদে অন্যান্য সংগঠনের সদস্যদেরও রিক্রুট করা হতো এবং এ কারণে এটি কি সোভিয়েত কি চৈনিক সকল বামপন্থী মুক্তিআকাঙ্ক্ষী তরুণদের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছিল। এরকম ঘটনা জানা থাকার পরও কেন তাহেরের কাছে জিয়াউর রহমান বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিলেন? সাত নভেম্বরের আগে তাহেরকে নাকি প্রশ্ন করা হয়েছিল, জিয়া কি সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করে যে তাকে আমরা মুক্ত করতে যাব? জবাবে তিনি বলেছিলেন, তার ছোটদের রাজনীতি ছোটদের অর্থনীতি পড়া আছে!
এখন প্রশ্ন এই বইগুলি পড়া বা না-পড়াই কি শ্রেণীচ্যুতির জন্যে যথেষ্ট?
এতো যে বিশ্বাসযোগ্য হলেন জিয়া, তার কারণ হয়তো একটিই হতে পারে : জিয়াউর রহমান সম্পর্কে যে-অভিযোগ তোলা হয়, অর্থাৎ তিনি আসলে গুপ্তচর মানুষ, হয়তো সেটিই সঠিক। সে কারণেই সম্ভব হয়েছিল, তার পক্ষে নিজেকে আড়াল করা এবং তাহেরের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। তাহের সম্পর্কে জিয়াউর রহমান যে অনেক আগেই একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন, (এবং সেটি সাতই নভেম্বরেরও আগেই), সেটি বোঝা যায় দ্রুত তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করার ও তাহেরকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে ঠেলে দেয়ার মধ্যে দিয়ে।
আমাকে ভুল বুঝবেন না আরমান রশিদ, আমাদের এই অসৎ মানুষের রাজ্যে, ভীতু মানুষের রাজ্যে তাহের সত্যিই বড় মানের এক মানুষ। কিন্তু খুব বড় মানের মানুষও ইতিহাসের গতি পালটাতে পারেন না, যদি না তার আশপাশের মানুষগুলো অন্তত একটি ন্যুনতম মান অর্জন না করেন, যদি না সবাই মিলে একটি সত্যিকারের সংগঠন গঠনের পথে এগিয়ে না যান। শেষ সত্য হলো, সত্যিকারের সংগঠন। আর একটি সত্যিকারের সংগঠন কখনও কেবল সশস্ত্র শাখার ওপর নির্ভর করে অভ্যুত্থান ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেয় না। কিন্তু তাহের সেই ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তটিই নিয়েছিলেন, মনে হয়।
তবে, আপনি যে ক্ষমার প্রশ্ন তুলেছেন,- এমন কোনও ভুল কি তিনি সত্যিই করেছেন, যে জন্যে তাকে ক্ষমা করতে হবে? যে ভুল তিনি করে গেছেন, তা আসলে তার সংগঠনেরই ভুল, বরং তিনি সেই ভুলের মাশুল দিয়েছেন নিজের জীবন দিয়ে। এখানে এসেই তাহের সত্যিকারের নেতায় পরিণত হয়েছেন, যিনি সংগঠনের দেয়া সকল দায়দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এগিয়ে গেছেন মৃত্যুর মঞ্চের দিকে, যাতে আর কেউই ভীত না হয়, বরং অনুপ্রেরণা পেতে পারে।
প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, লেনিনের ভাই ছিলেন অ্যানার্কিস্ট। তাঁরও ফাঁসি হয়, জারকে হত্যার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালানোর পর। লেনিন ভাইয়ের মৃত্যু থেকেও শিক্ষা নিয়েছিলেন। কিন্তু জাসদ বছরের পর বছর ধরে সাতই নভেম্বরকে কেবল গৌরবময় করে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে, সাতই নভেম্বরের ভুলগুলিকে বুঝবার চেষ্টাও করেনি। এতে তাহেরের জনপ্রিয়তা বেড়েছে, কিন্তু তাহেরদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ কেবলই পিছিয়ে গেছে।
আমার মনে হয়, বিষয়টিকে এভাবেও পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে : সাতই নভেম্বরের প্রত্যক্ষ ফলাফল হলো, ধর্মজ রাজনীতি ও সামরিকতন্ত্র সুসংহত হওয়া। এবং এরকম এক সাত নভেম্বরই কি না আমাদের শ্রদ্ধেয় শাহাদত চৌধুরীর সম্পাদনায় তৎকালীন বিচিত্রায় প্রচ্ছদ কাহিনী হয়ে উঠেছিল জাতীয় সংহতি হিসেবে! এই জাতীয় সংহতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, সামরিক বাহিনীর সনাতন চেহারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফিরে আসা এবং পাকিস্তানের মতোই সামরিকতন্ত্র রাষ্ট্রক্ষমতার সহগ হওয়া। একাত্তর বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে সশস্ত্র বাহিনীর চারিত্র ও ভূমিকা নিয়ে যে দোলাচল তৈরি করেছিল, তাহেরের অপসারণ অথবা পদত্যাগের পরও যা অব্যাহত ছিল, সাত নভেম্বর সেই দোলাচল দূর করে সনাতনী রূপটিকে অনিবার্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় এবং ফলে সামরিকতন্ত্রও ক্ষণবিশেষে ইতিবাচক হয়ে ওঠে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিকদের কাছে। আর এর ফলে বাংলাদেশ-রাষ্ট্র নিকটবর্তী হয় পাকিস্তান-রাষ্ট্র চরিত্রের।
যারা মনে করেন যে, আমাদের প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয় আরও বাড়াতে হবে, তারা যে এই তাহেরকে মনে রাখবেন না, তা তো খুবই স্পষ্ট আরমান রশিদ। আবার যাদের মনে রাখার কথা, সেই হেল কমান্ডো বইটির কথাই মনে করুন না,- কী এক অপূর্ব তাহের, সহসেনাদের বলছেন, ভালো করে প্রশিক্ষণ নিতে, কেননা একদিন দেশের জন্যে যুদ্ধ করতে হবে,- তারা ঠিকই মনে রাখবে তাঁকে।
আর আমরা তো বলাই বাহুল্য…
আরমান রশিদ - ২১ এপ্রিল ২০০৯ (১২:৩৭ পূর্বাহ্ণ)
আপনার তরফ থেকে একটি তথ্যবহুল মন্তব্যের অপেক্ষায় ছিলাম। আমাকে হতাশ করেননি ঠিকই তবে ক্ষুধাটা আরো বাড়িয়ে দিলেন যে!!
মুক্তাঙ্গন - ২০ নভেম্বর ২০১০ (৩:৫৭ পূর্বাহ্ণ)
ড মোঃ আনোয়ার হোসেনের পাঁচ পর্বের এই সিরিজটিতে সে সময়কার প্রাসঙ্গিক কিছু বিশ্লেষণ রয়েছে: তাহেরের স্বপ্ন।