১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব
(পূর্ব প্রকাশিতের পর . . .)
কর্নেল তাহের যে সেনাবাহিনীর উচ্চপদ ছেড়ে দিয়ে জনতার কাতারে যোগ দিয়েছিলেন এবং একটি বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় নিজেকে যুক্ত করেছিলেন তা থেকে প্রচলিত সেনা অফিসারদের ভাব-মানস থেকে তাঁর মৌলিক পার্থক্য স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে। এ ক্ষেত্রে জেনারেল জিয়াউর রহমানের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করা যায়। বাংলাদেশের নব প্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনীতে তার বদলে জেনারেল শফিউল্লাহ্কে সেনা প্রধান নিয়োগ করায় জিয়া ছিল অসন্তুষ্ট। বঙ্গবন্ধুও তাঁর এই মনোভাবের কথা জানতেন। তাই ব্যতিক্রম হিসেবে বঙ্গবন্ধু ‘ডেপুটি চীফ অব স্টাফ’ এর নতুন পদ সৃষ্টি করে জিয়াকে সেখানে নিয়োগ দেন। তারপরও জিয়ার নানা তৎপরতার সংবাদ কানে আসায় বঙ্গবন্ধু জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে প্রেষনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের এবং পূর্ব জার্মানীর রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় জিয়া আওয়ামী লীগের নানা স্তরের নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে এই তদবির শুরু করেন, যাতে তাকে সেনাবাহিনীতে রাখা হয়। তার এই মিশনে তিনি সফল হয়েছিলেন। এখন জানা যাচ্ছে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে সেনা ষড়যন্ত্রে পরিবার-পরিজনসহ জাতির জনকের হত্যাকান্ডের সাথে জিয়াও পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, শফিউল্লাহ এবং সমগোত্রীয় অফিসাররা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই ভবিষ্যত বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে নিজেদের ক্ষমতার ভিত পাকা করার জন্য পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আদলে তিনটি ব্রিগেড গঠন করেছিলেন। পরবর্তীতে এই ব্রিগেডগুলোই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গোড়া পত্তন করে। ঐ তিন অফিসারই ১৫ আগস্ট-এর কালরাতে সেনাবাহিনীর তিন শীর্ষ পদে সমাসীন ছিলেন। কিন্তু জাতির জনক এবং দেশের রাষ্ট্রপতিকে রক্ষায় তারা কেউ এগিয়ে আসেননি। এমনকি সেনাবাহিনী থেকে পৃথক যে, রক্ষীবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল তার হেড কোয়ার্টার বঙ্গবন্ধুর বাসগৃহ ৩২নং থেকে খুবই কাছে থাকা সত্বেও মুষ্টিমেয় ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে তারা কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি।
১৯৭২-এর ২২ সেপ্টেম্বর তারিখে তাহের তাঁর পদত্যাগ পত্রে পাকিস্তানী আদলে গড়ে তোলা জনবিচ্ছিন্ন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ষড়যন্ত্র ও ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে সাবধান করেছিলেন। কিন্তু তাহেরকে সেনাবাহিনী ছেড়ে যেতে হয়েছিল আর যারা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারা রয়ে গেলেন সেনাবাহিনীতে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকালে সেনাবাহিনীর ‘চীফ অফ স্টাফ’ ছাড়া বাকি ৮টি গুরুত্বপূর্ণ পদ যেমন, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ এবং এমনকি রক্ষীবাহিনীর কর্তৃত্বে ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত ব্যক্তিবর্গ। আর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শীর্ষ সেনা নায়কদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিরোধী ভাব-মানস-এর কথা উল্লেখ করেছি। যার কারণে ১৫ আগস্ট এত সহজে ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে জাতিকে এক দীর্ঘস্থায়ী সামরিক স্বৈরতন্ত্রের নিগড়ে আবদ্ধ করতে পেরেছিল। সেনাবাহিনীর উচ্চপদে থেকে ষড়যন্ত্র করে ক্যুদেতা ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলে তাহের বিশ্বাসী ছিলেন না বলে, ঐ সেনাবাহিনী ছেড়ে দিয়ে বেসামরিক জীবনে ফেরা এবং জনতার রাজনীতিতে নিজেকে যুক্ত করতে তাঁর বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয়নি।
একথা বেদনাদায়কভাবে সত্য যে তাহেরের মত অগণিত নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিককে বঙ্গবন্ধু সরকারের মুখোমুখি বিরোধীতায় নেমে পড়তে হয়েছিল যেখানে তাদের দেশগঠনের অভিযাত্রায় সামিল থাকার কথা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠনের প্রাথমিক পদক্ষেপও নেয়া হলো না। সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ, প্রশাসন, কারাগার এই নিয়ে যে রাষ্ট্র তার প্রতিটি শক্তিকেন্দ্রে রেখে দেয়া হল পাকিস্তানী রাষ্ট্রের বাঙালী কর্ণধারদের। এ ব্যাপারে আমরা পুনরায় স্মরণ করতে পারি ‘মুক্তিযোদ্ধারা আবার জয়ী হবে’ শীর্ষক তাহের-এর প্রবন্ধ এর বক্তব্য যা ইতোপূর্বে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে কর্নেল তাহের-এর দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থতার প্রমাণ মেলে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে দেয়া পরামর্শে। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়াতে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, “আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। সাহস ও ব্যক্তিত্বে এই মানুষটি হিমালয়সম। তাই তাঁকে দেখে আমার হিমালয় দেখা হয়ে গেছে”। বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুনে নিশ্চয়ই তাঁর কিউবার বিপ্লবী যুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়েছিল। বিপ্লবী আগুনে পোড় খাওয়া ক্যাস্ত্রো বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করা পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে ভেঙ্গে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকলকে নিয়ে তা নতুন করে গড়ে তুলতে।
বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন ক্ষমা ও ঔদার্য দিয়ে শত্র“-মিত্র সকলকে তিনি দেশ গড়ার কাজে লাগাবেন। তাঁর সে মহত্বের দাম দেয়নি মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের সবচাইতে অগ্রবর্তি চিন্তার শক্তিকে বঙ্গবন্ধুর বিরোধীতায় ঠেলে দেয়া হয়েছে অন্যদিকে রাষ্ট্র প্রশাসনের সকল কেন্দ্রে জায়গা করে দিয়েছে স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি। এর ফল হয়েছিল মারাত্মক। যে বিষবৃক্ষ গড়ে উঠছিল মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো থেকেই, তাই মহা অভিশাপ হয়ে দেখা দিল ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট কালরাতে।
তাহের যে আশঙ্কা করেছিলেন ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে তাই নির্মম সত্য হয়ে দেখা দিল। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে জন্ম নেয়া ষড়যন্ত্র যার গোড়া পাওয়া যাবে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে – আঘাত করলো মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ও প্রতিকের উপর। জাতির জনকের উপর। সংখ্যায় মুষ্ঠিমেয় হলেও ষড়যন্ত্রকারীদের জাল বিস্তৃত ছিল সর্বত্র। আওয়ামী লীগের অত্যন্ত গভীরে তা অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল। সে ষড়যন্ত্রের কথা মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতেও আমরা শুনেছি। খোন্দকার মুশতাক-তাহের উদ্দিন ঠাকুর-মাহবুবুল আলম চাষী প্রমুখ রাজনীতিক ও আমলা এই ষড়যন্ত্র করে আসছিলেন। বাংলাদেশের পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরে তাদের সে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত হয়েছিল। এটা এখন অত্যন্ত পরিষ্কার যে, মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষ লগ্নে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা সেনা অফিসার ফারুক-রশিদ ছিল পাকিস্তানেরই চর। মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী খোন্দকার মুশতাক চক্রের সাথে এরা জোটবদ্ধ হয়েছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুই শীর্ষ সেনা নায়ক ‘ডেপুটি চীফ অব স্টাফ’ জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং ‘চীফ অব দি জেনারেল স্টাফ’ জেনারেল খালেদ মোশাররফ পরোক্ষভাবে এই ষড়যন্ত্রের প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন।
এ সকল কারণে কোন প্রতিরোধ ছাড়াই ফারুক-রশিদের নেতৃত্বে মুষ্ঠিমেয় ষড়যন্ত্রকারীরা জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করতে পেরেছিল। জাতির সেই মহা দূর্দিনে তাহের একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিকের ভূমিকায় আবির্ভূত হন। অল্প সময়েই তিনি বুঝে ফেলেন চরম দক্ষিণপন্থী ও মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শক্তি বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকা কালে যে তাহের এবং জাসদ তার বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন করে যাচ্ছিলেন যার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল একটি বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থান সেই তারাই দেশের এই সংকটে রাজনৈতিক কর্তব্য নির্ধারণে ভুল করেননি।
মুশতাক চক্র ভেবেছিল যেহেতু তাহের এবং জাসদ রাজনৈতিক ভাবে বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করছিল, তাই তার নতুন সরকারে তাহের যোগ দেবেন। কিন্তু তাহের মুশতাকের প্রস্তাব দ্বিধাহীন চিত্তেই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাহের এবং জাসদ অবিলম্বে রাজবন্দীদের মুক্তি এবং দ্রুত সাধারণ নির্বাচনের দাবী করেছিলেন। জাসদের এই রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে অতি দ্রুত মুশতাকের সামরিক সরকারের প্রধান আক্রমনের লক্ষবস্তুতে পরিণত হয় তারা। অস্ত্র উদ্ধারের নামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস শুরু হয় জাসদ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর উপর। জাসদের বহু নেতা-কর্মী নিহত হন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে। তাহেরকেও নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। নানা ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। তার মধ্যে একটি ছিল কর্নেল তাহের বঙ্গবন্ধু তনয় শেখ কামালের বিবাহ-পরবর্তী সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন শীতলক্ষা নদীবক্ষে ড্রেজার সংস্থার প্রমোদতরীতে। বলা বাহুল্য এটা ছিল সবৈব মিথ্যা। এই বানোয়াট অভিযোগে তাহের এতই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন যে, তিনি অভিযোগকারী প্রেসিডেন্ট মুশতাকের অত্যন্ত ঘনিষ্ট কর্মকর্তা আসাফউদ্দোলাকে (পরে সচিব হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত) তীব্র ভর্ৎসনা করেন। খন্দকার মুশতাক তাহেরকে বঙ্গভবনে ডেকে পাঠান এবং এতদসংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চান। তাহের এই নির্জলা মিথ্যারই যে শুধু প্রতিবাদ করেন তাই নয়, যখন মুশতাক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে শুধুমাত্র শেখ মুজিব বলে সম্বোধন করছিলেন, তখন তাহের তাঁর হাঁটবার লাঠিটি উচিয়ে উচ্চকণ্ঠে নির্দেশের সুরে মুশতাককে বলেছিলেন, ‘বলুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’। তাহেরের সেই কণ্ঠ শুনে পাশের কক্ষ থেকে পিস্তল হাতে ছুটে এসেছিল মেজর ডালিম। তাহের-এর কড়া ধমকে সে নিশ্চুপ হয়ে যায়। চতুর মুশতাক ডালিমকে পাশের কক্ষে যেতে বলে তাহেরকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর যেখানে বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তি বিশেষ করে চীনা-পন্থী দলসমূহ – এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছিল, সেখানে জাসদ ও তাহের প্রথম থেকেই ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ও মুশতাক সরকারের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেয়। দলের পক্ষ থেকে এই বক্তব্য দেয়া হয় যে, মুশতাক চক্র জনগণের শত্রু। এরা দেশকে রুশ-ভারত বলয় থেকে মার্কিন-পাকিস্তান বলয়ের নিগড়ে আবদ্ধ করেছে মাত্র। ১৯৭৬ সালে গোপন বিচারকালে সামরিক ট্রাইব্যুনালের সামনে দেয়া জবানবন্দীতে তাহের উল্লেখ করেছিলেন, ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুকে উৎখাত করার অধিকার জনগণ কাউকে দেয়নি। জাসদ-এর এই রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে অতিদ্রুতই তারা মুশতাক সরকারের আক্রমণের লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়। কারাগারে বন্দী জাসদ নেতৃবৃন্দ এবং হাজার হাজার কর্মীদের মুক্তি তো হলোই না বরং সারাদেশে জাসদের উপর নেমে আসে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। অস্ত্র উদ্ধারের নামে হত্যা ও গ্রেপ্তার আরও বেড়ে যায়।
তাহের বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশের বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরে অবস্থানকারী মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে খোদ রাষ্ট্রকেই গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে। রাজনৈতিক পরিভাষায় তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্র এক তরল অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আরও হানাহানি হবে, ষড়যন্ত্র চলতে থাকবে। যে চরম দক্ষিণপন্থী শক্তি বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে তারা দূর্বল বলেই রাষ্ট্রকে অতি সহসা সংহত করতে পারবে না। তিনি এই আশংকাও ব্যক্ত করেছেন, এই মহাসংকটে বিপ্লবী শক্তি অতি দ্রুত সক্ষম হয়ে উঠতে না পারলে এবং সবল প্রত্যাঘাতে ক্ষমতাদখলকারী প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে পরাজিত না করতে পারলে তরল অবস্থায় পতিত বুর্জোয়া রাষ্ট্র তার সংহতি ফিরে পাবে এবং চরম স্বৈরাচারী যন্ত্রে পরিণত হবে। তিনি এ সময় জাসদ নেতৃবৃন্দকে বারবার বলেছেন, প্রতিক্রিয়ার শক্তিকেন্দ্রগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাকে আঘাত করবার মোক্ষম সময় উপস্থিত হবে অতি দ্রুত। জাসদের বিপ্লবী সংগঠনসমূহ যদি সে সুযোগ গ্রহণ না করে তবে ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী এবং উগ্র রাষ্ট্রকে মোকাবেলা করতে হবে। তাহের তাই জাসদের গৃহীত রণনৈতিক লক্ষ্য সাধারণ সশস্ত্র গণ-অভ্যুত্থান সংগঠনের সময়কে এগিয়ে আনার আহবান জানান। ইতোপূর্বে ধারণা ছিল ১৯৭৬-এর শেষে সে লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ হবে।
এখন দেশের বাস্তব পরিস্থিতি এক গুরু দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে জাসদ নেতৃবৃন্দের ওপর। সময়ের সাহসী সিদ্ধান্ত নেবার কঠিন পরীক্ষায় পড়েছেন তারা। ১৯৭৫-এর অক্টোবর থেকেই তাহের গণ অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি জোরদার করার তাগিদ দিতে থাকেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে। তাহেরের অনুমান অনুযায়ী রাষ্ট্রযন্ত্র বিশেষ করে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে প্রতিপক্ষ যুদ্ধমান শক্তিসমূহের মধ্যকার দ্বন্দ ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র দ্রুতলয়ে তীব্র হতে থাকে। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে তখন চরম বিশৃঙ্খলা এবং দ্বিধা বিভক্তি। একদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ফারুক-রশিদের নেতৃত্বাধীন ল্যান্সার ও আর্টিলারীর কিছু অংশ। এরা বঙ্গভবন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং বেতার ভবনে অবস্থান নিয়েছিল। এদের শক্তির উপর নির্ভর করছিল মুশতাক সরকার। পদাতিক বাহিনীর অপর শক্তিকেন্দ্রের অবস্থান ছিল ক্যান্টনমেন্টে। যুদ্ধমান এই উভয় শক্তি তখন মুখোমুখি। তাই সাধারণ সিপাহী এবং অফিসাররা এক শ্বাসরুদ্ধ আতঙ্কের মধ্যে থাকতেন। তাদের দাবী ছিল, ষড়যন্ত্রমূলক ক্যুদেতার হোতাদের সেনাবাহিনীর কমান্ডের অধীনে এনে সেনাবাহিনীতে শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করা হোক। ফারুক-রশিদ চক্র তখন ছিল কেন্দ্রীয় কমান্ডের বাইরে এবং তাদের নির্দেশেই মুশতাক সরকার পরিচালিত হচ্ছিল।
সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনার মূল দায়িত্ব ছিল তখনকার সেনা প্রধান জিয়াউর রহমানের। কিন্তু তিনি তা করতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। তাই ধারণা করা হচ্ছিল তিনি হয়তো খুনী চক্রের সাথেই আছেন। এর কারণও ছিল। বঙ্গবন্ধুর খুনীরা সেনাপ্রধান শফিউল্লাহকে সরিয়ে তাকে সেনাপ্রধান বানিয়েছিল। এছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রাক্তন অফিসার হিসেবে জিয়া নিশ্চয়ই ফারুক-রশিদ-মুশতাক চক্রের ষড়যন্ত্রের সাথে মার্কিন সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে অবগত ছিলেন। তাই এই লবীর সাথে তিনি সুসম্পর্ক রেখে চলছিলেন। এ পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমান তার চিরাচরিত কৌশল ‘দেখ এবং অপেক্ষা কর’ নীতিকেই অনুসরণ করলেন।
সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে জিয়াউর রহমানের ব্যর্থতা বা অনিচ্ছা চীফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের ক্ষমতা দখলের শর্ত তৈরী করে দেয়। আগেই উল্লেখ করেছি আর্মার্ড কোর ও আর্টিলারির সাথে পদাতিক বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুখোমুখী অবস্থান তখন এক বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে খালেদ মোশাররফ ২ নভেম্বর দিবাগত রাত অর্থাৎ ৩ নভেম্বর আর একটি ক্যুদেতা ঘটান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড যেমন অফিসারদের ষড়যন্ত্রে সংঘটিত হয়েছিল, এই ক্যুদেতার পেছনেও ছিল অফিসারদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র।
জিয়াউর রহমানের নিজস্ব বেঙ্গল রেজিমেন্ট ৪৬ ব্রিগেডের কিছু তরুণ অফিসার কর্তৃক জিয়াকে তার বাসভবনে গৃহবন্দী করার মধ্য দিয়ে খালেদের ক্যুদেতা শুরু হয়। ভেঙ্গে পড়া সেনা কমান্ড ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য ঘোষণা করেই অভ্যুত্থানটি পরিচালিত হয়। অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তার সমর্থন থাকায় এই ক্যুদেতা সফল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী ছিল। কিন্তু শুরু থেকেই নানা সিদ্ধান্তহীনতা ও অদূরদর্শিতার কারণে জনমনে এবং সাধারণ সৈন্যদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। নানা সন্দেহের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন খালেদ মোশাররফ।
বঙ্গবন্ধুর খুনী শৃংখলা ভঙ্গকারী অফিসারদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে সেনাপ্রধান জিয়াকে বন্দী করেছেন খালেদ মোশাররফ। তারপর বিমান ও নৌ বাহিনীর প্রধানদেরকে দিয়ে নিজের কাঁধে মেজর জেনারেল এর র্যাংক পরিয়েছেন। এ দৃশ্য দেখে সবাই এই ধারণাই করলো যে, নিছক সেনাপ্রধানের পদটি দখলের জন্য খালেদ অভ্যুত্থান করেছেন।
১৯৯৪-এর নভেম্বর থেকে ১৯৯৫-এর মে পর্যন্ত সময়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘সময়’ পত্রিকায় তাহের-এর জীবন ও কর্মের উপর আমার সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়। তাহেরের নেতৃত্বে এবং জাসদের সহায়তায় সংঘটিত ৭ নভেম্বর সিপাহী অভ্যুত্থানের পটভূমি ও ঘটনাক্রম এবং গোপন বিচার প্রহসনে তাহেরের ফাঁসীর দড়িতে বীরোচিত আত্মদানের কথা সেই সাক্ষাতকার থেকে উদ্ধৃত করবো :
“ক্ষমতা সুসংহত করতে খালেদ মোশাররফ অকল্পনীয় দীর্ঘসূত্রিতায় মূল্যবান সময় নষ্ট করেন। দেশে তখন দৃশ্যমান কোনো সরকার নেই। টিভিতে ঘন্টার পর ঘন্টা রুনা লায়লার গান শুনতে শুনতে জনগণ ভাবতে শুরু করে যে, তাদেরকে এভাবে ব্যস্ত রেখে ক্যান্টনমেন্টে ও বঙ্গভবনে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চলছে। কার্যতঃ তাই চলছিল। খালেদ মোশাররফ চাচ্ছিলেন মুশতাককে ক্ষমতায় রেখেই শান্তিপূর্ণভাবে জিয়াকে সরিয়ে নিজে সেনাপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত হতে। এ নিয়েই ফারুক-রশিদ-ওসমানী-মুশতাক চক্রের সাথে দেনদরবারে সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল। খালেদ-জিয়াসহ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের এসব নায়কদের উচ্চাভিলাষ ছিল প্রবল। আবার এদের সবারই চেষ্টা ছিল রাষ্ট্র কাঠামোর মূল স্তম্ভ সেনাবাহিনীকে যতটা সম্ভব কম বিপদে ফেলে ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করা। তাই আপোস-আলোচনা। বিজয়ীর সাথে বিজিতের। এক পর্যায়ে বন্দী জিয়া সেনাপ্রধানের পদ থেকে স্বহস্তে লেখা পদত্যাগ পত্র পেশ করলেন।
ইতিমধ্যে ঘটে গেছে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বর্বরতম এবং কলংকময় হত্যাকাণ্ড। ২ নভেম্বর দিবাগত রাতে জিয়া ও মুশতাক-বিরোধী অভ্যুত্থানের খবর জানার পরই সচল হয় ফারুক-রশিদের নীল নকশার এই অংশ। মুশতাকের অনুমোদনে ঢাকা কারাগারের অভ্যন্তরে তার ঘাতক বাহিনী হত্যা করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে। মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধু মুজিবের অবর্তমানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের এরাই ছিলেন কেন্দ্রীয় নেতা এবং মুশতাকের প্রতিপক্ষ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এরা মুশতাকের সঙ্গে হাত মেলাননি। জেল হত্যাকাণ্ডের মত মধ্যযুগীয় বর্বরতার পরও খালেদের সঙ্গে ঘাতকদের আপোস রফা হলো। সংঘর্ষ ছাড়াই সেনাপ্রধান হবার বিনিময়ে ঘাতক চক্রকে নির্বিঘেœ দেশত্যাগের সুযোগ করে দিলেন খালেদ মোশাররফ।
কারাগারে চার জাতীয় নেতার হত্যা এবং ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগের শোক মিছিলে খালেদ মোশাররফের মা ও ভাই আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ মোশাররফের অংশগ্রহণ এমন গুজবের জন্ম দিল যে, খালেদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের স্বপক্ষে অভ্যুত্থান ঘটেছে। প্রেসক্লাবে ‘হলিডে’ পত্রিকার এনায়েত উল্ল্যাহ খান ও বিবিসির সংবাদদাতা আতিকুল আলম সে গুজব আরও উসকে দিলেন ভিত্তিহীন এ খবর ছড়িয়ে যে ভারতীয়দের যোগসাজশে খালেদ মোশাররফ এ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। ভারতীয় বেতারে এ অভ্যুত্থানকে সাধুবাদ জানিয়ে সরব প্রচারণাও ভারতীয় যোগাযোগের সন্দেহকে জোরদার করে। এসব কিছু মিলে খালেদ মোশাররফের ক্ষমতার ভিত টলটলায়মান হয়ে পড়ে প্রথম থেকেই।
১৫ আগস্টের মতোই ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান সম্পর্কেও পূর্বাহ্নে আমাদের কাছে কোনো সংবাদ ছিল না। কিন্তু আগস্ট পরবর্তী অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে স্পষ্টই মনে হচ্ছিলো যে, আরেকটি অভ্যুত্থান আসন্ন। তাহের সে সম্পর্কে জাসদ নেতৃবৃন্দকে অবহিত করেছিলেন। সৈনিক সংস্থার সংগঠকদের কাছ থেকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে আর্টিলারী ও ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের দ্বন্দ্বের কথা আমরা নিয়মিতই শুনতাম।
৩ নভেম্বর ভোর রাত ৪টায় খোদ জিয়ার ফোনের মাধ্যমে কর্নেল তাহের অভ্যুত্থান সম্পর্কে অবহিত হন। অসমাপ্ত সে টেলিফোন সংলাপে জিয়া তার প্রাণ বাঁচানোর অনুরোধ জানান তাহেরের কাছে। জিয়ার তরফ থেকে সাহায্য চাওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। তাহেরের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও সেনাবাহিনীতে তাঁর সংগঠন সম্পর্কে জিয়া জানতেন। তাঁদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শৈশবকালে বিভিন্ন নীতিগত প্রশ্নে জিয়া তাহেরের সাথে প্রায়শঃ একমত হয়েছেন। যদিও ক্রান্তিকালে সে অনুযায়ী শক্ত অবস্থান না নিয়ে তিনি আপোস করেছেন বারবার। জিয়া সম্পর্কে তাহের তাই মনে করতেন অভ্যুত্থানের পর শক্ত রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে মেরুদণ্ডহীন জিয়া বিপ্লবের পক্ষে না থাকলেও অন্ততঃ বিরোধী অবস্থান নিতে পারবেন না। দেশের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে জিয়ার সাথে তাহেরের বোঝাপড়ার অনেকখানিই আমাদের অজানা এবং তা আর কোনোদিন জানা সম্ভবও হবে না। তবে জিয়ার প্রতি তাহেরের অনুকুল মনোভাবের কিছু কারণ সনাক্ত করা সম্ভব। প্রথমত জিয়াকে সেনাবাহিনীতে একজন জাতীয়তাবাদী হিসাবে মনে করা হতো। দ্বিতীয়ত বেতারে আপতিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের সবচাইতে পরিচিত সেনানায়কে পরিণত হন তিনি। তৃতীয়ত, সে সময়কার অধিকাংশ সেনা অফিসারের বিপরীতে জিয়া ছিলেন তুলনামূলক ভাবে সৎ। এবং সর্বোপরি তাহের ও জাসদের উদ্যোগ-আয়োজন সম্পর্কে জিয়ার মনোভাব ছিল ইতিবাচক।
যাই হোক, ৩ নভেম্বর বন্দী জিয়ার ফোন পাওয়ার বেশ খানিকটা পর সৈনিক সংস্থার একদল সদস্য নারায়ণগঞ্জে কর্নেল তাহেরের বাসায় আসেন। তারা অভ্যুত্থান সম্পর্কে তাহেরকে বিস্তারিত অবহিত করেন। সেসময়ই জানা যায় যে, খালেদের অভ্যুত্থান সম্পর্কে সেনাবাহিনীতে ব্যাপক ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। সেনা সদস্যরা সন্দেহ করছেন এ ঘটনায় ভারতের সহায়তা আছে। তাছাড়া এসময় খালেদ মোশাররফের অনুগত পক্ষ ও রশীদ-ফারুকদের অনুগত পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে সৃষ্ট উত্তেজনায় সাধারণ সৈন্যরা ছিল সন্ত্রস্ত ও বিক্ষুদ্ধ। তাদের ভাষায় কে চীফ অফ স্টাফ হবে আর কে প্রেসিডেন্ট হবে – সে দ্বন্দ্বে আমরা মারা পড়বো কেন। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সিপাহীরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ত্যাগ করে সিপাহী ও নিম্নপদস্থ অফিসাররা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তির চেতানায় অভিষিক্ত হয়েই। তাই স্বাধীন বাংলাদেশে পুরোনো রাষ্ট্রকাঠামোর সেনাবাহিনীর ধারণাকে তারা মেনে নিতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার ফলে তাদের পরিবারবর্গ অপরিমেয় ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পর চোখের সামনেই উচ্চপদস্থ অফিসারদের অতিদ্রুত আরও উচ্চপদে সমাসীন হতে দেখলেন তারা। শুধু তাই নয়, নিরন্ন নিঃস্ব এই দেশে অবৈধ বিত্ত ও বৈভবের মালিক হলো তারা। অন্যদিক সাধারণ মানুষের মতই সিপাহী, এনসিও ও জেসিওদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে পড়েছিল। এমনি অবস্থায় তাদের ব্যবহার করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা এবং দেশ ও জাতির স্বার্থের কথা চিন্তা না করে সামরিক অধিকর্তাদের ক্ষমতা দখলের লড়াই সাধারণ সিপাহীদের বিদ্রোহী করে তুলবে, তাতে আশ্চর্য কি! তারা বিদ্রোহ করবে। নেতৃত্ব চাইলো তারা তাহেরের কাছে।
কর্নেল তাহের ৩ নভেম্বর ছিলেন খুবই অসুস্থ। কিন্তু পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে ওই অবস্থাতেও ঢাকায় যাবার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বড় স্টেশন ওয়াগনে গাড়ির পেছনে পাতা বিছানায় শুয়ে ঢাকা আসতে হয় তাঁকে। ইতোমধ্যে টেলিফোনে জাসদ নেতৃবৃন্দের সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়েছে। তাহের ভাই ঢাকায় পৌঁছানোর পরই এলিফ্যান্ট রোডস্থ ইউসুফ ভাইয়ের বাসায় জাসদ নেতাদের লাগাতার বৈঠক আরম্ভ হয়। সৈনিক সংস্থার সংগঠকরাও তখন প্রকাশ্যেই সেখানে আসা যাওয়া শুরু করেছেন।
চারদিকে এসময়টায় তুমুল উত্তেজনা। খালেদ সিদ্ধান্তহীনতার মধ্য দিয়ে তাঁর সময় পার করছেন। সীমান্তে ভারতীয় সৈন্য সমাবেশের উড়ো খবর ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। রাজধানীতে সিপিবি-আওয়ামী লীগের বিরাট শোক মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে ভারত বিরোধী আতঙ্ক। এসব কিছু মিলে জাসদ নেতৃত্ব তখন বাস্তবিকই অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন। বন্দী জিয়ার টেলিফোন এবং অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য সাধারণ সৈনিকদের প্রবল চাপ ক্রমশই তাঁদের একটি নির্ধারক সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল।
জাসদের সামনে তখন দু’টি পথ খোলা ছিল। হয় নিষ্ক্রিয় থাকা কিংবা ঘটনা প্রবাহকে দলীয় লক্ষ্যে পরিচালিত করার চেষ্টা করা। ড. আখলাকসহ কয়েকজন প্রথমোক্ত পথ বেছে নিতেই ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু কর্নেল তাহের তাঁদের পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করতে উদ্ব্্ুদ্ধ করেন। তাঁর মতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্যাপক অংশকে কাজে লাগিয়ে সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান সংগঠনের এমন সুবর্ণ সুযোগ অবশ্যই কাজে লাগানো উচিত। তিনি বোঝাতে চাইলেন যে, বঙ্গবন্ধু নিহত হবার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র যন্ত্রে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এরকম অবস্থায় আমাদের ক্ষমতা দখলের সুযোগ হাতছাড়া করা হবে ভুল। যে ভুলের কারণে আমাদের হয়ত ভবিষ্যতে একটি পুনর্গঠিত শক্তিশালী বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। তাহের আরও বলেন যে, জাসদ নিষ্ক্রিয় থাকলেও সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটবেই এবং তার ফলাফল অধিকতর নেতিবাচক বাস্তবতারও জন্ম দিতে পারে।
জাতীয় জীবনের এক তাৎপর্যপূর্ণ সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছিল বলে জাসদ নেতৃবৃন্দের মধ্যে সেদিন দ্বিধাদ্বন্দ্বের কমতি ছিল না। যথেষ্ট বিতর্কের পর মুখ্য নেতা সিরাজুল আলম খান একটি বিপ্লবী উদ্যোগ গ্রহণের পক্ষেই মতামত দেন এবং সে ভিত্তিতে সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের পক্ষে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়। তিনি এবং কর্নেল তাহের ছাড়াও সে সময় জাসদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন ড. আখলাকুর রহমান, হাসানুল হক ইনু, মার্শাল মণি, কাজী আরেফ আহমেদ, হারুন-অর-রশীদ, আ ফ ম মাহবুবুল হক, মাহমুদুর রহমান মান্না, খায়ের এজাজ মাসুদ প্রমুখ। সশস্ত্র গণ অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নিলেও সে অভ্যুত্থান ঘটানোর মতো বেসামরিক প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল জাসদের। ন্যূন্যতম প্রস্তুতির জন্যেও অন্ততঃ আরও ছয় মাস দরকার ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি জাসদকে ঠেলে দিয়েছে অসাধ্য সাধনের জন্য।
৪ নভেম্বর জাসদ নেতৃবৃন্দ অভ্যুত্থানের যে প্রাথমিক পরিকল্পনা করেন তাতে ৭ নভেম্বরকে অভ্যুত্থানের দিন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়নি। সৈনিক সংস্থার সদস্যরা দ্রুতই কাজে নেমে পড়তে চাচ্ছিলেন। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের রাজনৈতিক মহাযজ্ঞে ছাত্র-শ্রমিক-জনতাকে সামিল করার বিষয়টি ছিল সময় সাপেক্ষ। সে লক্ষ্যে ৯ নভেম্বর হরতাল আহ্বান করা হয়। নেতৃবৃন্দের পরিকল্পনা ছিল ওই হরতালের মধ্য দিয়ে তাঁরা ছাত্র ও শ্রমিক ফ্রন্টকে রাজপথে সংগঠিত করতে পারবেন। ৫ নভেম্বর সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে একটি লিফলেট বিতরণেরও সিদ্ধান্ত হয়। ঠিক হয় এই লিফলেটের মাধ্যমে আসন্ন উদ্যোগ সম্পর্কে সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া যাচাই করা হবে। অভ্যুত্থানে নেমে পড়ার জন্যে সৈনিক সংস্থার প্রচণ্ড তাগিদকে কিছুটা প্রলম্বিত করার জন্যও লিফলেট বিতরণের পরিকল্পনা নেয়া হয়।
পরিস্থিতি তখন দ্রুতলয়েই এগোচ্ছিল। যদিও তত দ্রুততার সাথে জাসদ তার ছাত্র ও শ্রমিক ফ্রন্টকে মাঠে নামাতে পারছিলনা। এটা অস্বাভাবিক ছিল না। কারণ দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় জনতার সাথে সংগঠকদের যোগাযোগ বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। অতিদ্রুত সেসব যোগাযোগ সচল করা ছিল অসম্ভব। তারপরও নেতৃত্ব ভেবেছিলেন হয়ত ৯ তারিখের হরতালের মাধ্যমে তাঁরা অভ্যুত্থানের বেসামরিক শক্তিকে একধাপ সামনে নিয়ে আসতে পারবেন। কিন্তু ৫ নভেম্বরের সে লিফলেট অভ্যুত্থানের সামগ্রিক ছকই পাল্টে দেয়। ট্যাংক রেজিমেন্টের হাবিলদার বারী ওই লিফলেটের খসড়া তৈরি করেন। জাসদ তাতে খুব সামান্যই সম্পাদনা করেছে। শুধুমাত্র নেতৃত্ব পরিবর্তন নয় – সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার জন্য সিপাহী অভ্যুত্থান – এই লক্ষ্য ঘোষিত হয় লিফলেটের বক্তব্যে। বলা হয় ঔপনিবেশিক আমলের রীতিনীতি বদলে ফেলে সশস্ত্র বাহিনীকে জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী বাহিনীতে পরিণত করা হবে। ধনিক শ্রেণীর হাতিয়ার হিসেবে আর ব্যবহৃত না হওয়ার প্রত্যয় ঘোষিত হয় লিফলেটে। রাজবন্দীদের মুক্তি, দুর্নীতিবাজদের অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, জনগণের স্বার্থরক্ষা এবং শ্রমিক-কৃষক, ছাত্রদের সাথে সৈনিকদের মিলিত প্রয়াসে সমাজ বিপ্লব ত্বরান্বিত করার দীপ্ত শপথ উচ্চারিত হয় তাতে। ঢাকা সেনানিবাসের প্রতিটি ইউনিটে লিফলেটটি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। জওয়ানদের মাঝে লিফলেটের প্রতিক্রয়া হল ব্যাপক এবং তাৎক্ষণিক। যা নেতৃবৃন্দকেও হতচকিত করে দেয়। ৬ নভেম্বর এসে সৈনিকরা দাবী জানায়, আজ রাতেই অভ্যুত্থান সংগঠিত করতে হবে।
আগেই বলেছি, অভ্যুত্থানের সামগ্রিক প্রস্তুতি জাসদ তখনও সম্পন্ন করতে পারে নি। গণবাহিনী, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগের অনেক কর্মী-সংগঠক নেতৃত্বের পরিকল্পনা সম্পর্কেও অবহিত নয়। কিন্তু তারপরও চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিয়ে ফেলে জাসদ। স্থির হয় সৈন্যরা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার আহবানে সাড়া দিয়ে সশস্ত্র হয়ে সেনানিবাসের ভেতরে-বাইরে কিছু লক্ষ্য অর্জন করবে। যার মধ্যে রয়েছে জিয়াকে মুক্ত করা, বেতার-টেলিভিশন এবং টেলিফোন-টেলিগ্রাফ অফিসের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ, কারাগারগুলো খুলে দিয়ে রাজবন্দীদের মুক্ত করা ও বঙ্গভবন দখল। এর পাশাপাশি সৈনিকরা সেনানিবাসের বাইরে এসে অপেক্ষমান বিপ্লবী গণবাহিনীকে সশস্ত্র করবে এবং ছাত্র-শ্রমিক জনতার সাথে একাতœ হয়ে সকল পর্যায়ের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব গ্রহণ করবে। সমগ্র পরিকল্পনাটি কর্নেল তাহেরেরই করা। সার্বক্ষণিক ভাবে তাঁর সাথে ছিলেন হাসানুল হক ইনু।
৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় আমাদের অপর বড় ভাই আবু ইউসুফ বীর বিক্রম-এর বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ার সিদ্দিকের শুলশানের বাড়িতে সিপাহী-জনতার বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের অপারেশনাল পরিকল্পনা চুড়ান্ত হয়। সৈনিক সংস্থার সংগঠকরা ছাড়াও বিপুল সংখ্যক সাধারণ সৈনিক, এনসিও ও জেসিও সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। অনেকে ইউনিফর্মের উপর লুঙ্গি পরে চলে এসেছেন। সৈনিকরা ভীষণ উত্তেজিত অবস্থায় ছিল। তাদের একটাই কথা – অফিসাররাই আমাদের সমস্ত দুর্গতির কারণ। দেশটাকেও শেষ করেছে এরা। এদের শেষ করে দিতে হবে। জিয়াকেও হত্যা করার দাবী জানাচ্ছিল তারা। তাহের অনেক কষ্টে তাদের শান্ত করেন। হত্যা আর বিপ্লব যে সমার্থক নয়, সৈনিকদের তা বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল কর্নেল তাহেরকে। তিনি তাদের বলেন – আমরা বিপ্লব করতে যাচ্ছি, হত্যাকাণ্ড নয়। যারা আমাদের বিরোধিতা করবে তাদের আমরা গ্রেফতার করবো। প্রয়োজনে ভবিষ্যতে বিচার হবে তাদের। কিন্তু হত্যা নয়। এমনকি খালেদ মোশাররফকেও নয়। তাহের অনেক বুঝিয়ে সৈনিকদের শান্ত করেন। এরপর তিনি তাদের জাসদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বিস্তারিত জানান এবং বিভিন্ন গ্র“পের মধ্যে অপারেশনাল দায়িত্ব বন্টন করেন। সেনানিবাসের অভ্যন্তরে অভ্যুত্থানের প্রধান দায়িত্ব ছিল নায়েব সুবেদার মাহবুবের উপর। মাহবুব অস্ত্রাগার খুলে দিলে সৈনিকদের বিভিন্ন গ্র“প সশস্ত্র হয়ে বিভিন্ন লক্ষ্যস্থলের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করবে। কেউ কারাগারের উদ্দেশ্য, কেউ বঙ্গভবনে, কেউ জিয়াকে উদ্ধার করবে, কেউবা বেতার-টিভি কেন্দ্রে। আমাদের এ পরিকল্পনায় অন্যতম দুর্বলতা ছিল অফিসারদের অনুপস্থিতি। মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবনে যিনি কিংবদন্তি নেতা হয়ে উঠেছিলেন, সেই মেজর জিয়াউদ্দিন অফিসারদের মধ্যে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কাজ করছিলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ খালেদের অভ্যুত্থানের কয়েকদিন আগে তাকে ঢাকা ছেড়ে খুলনায় যেতে হয়েছিল সরকারী কাজে। তাই তাঁর সঙ্গে যুক্ত অফিসারদের পাওয়া গেলনা অভ্যুত্থানের সময়। তা না হলে বিভিন্ন টাস্ক ফোর্সের সঙ্গে একজন করে অফিসার যুক্ত করে দেয়া যেতো।
গুলশানের বৈঠক শেষে সৈনিক সংস্থার নেতৃস্থানীয় সংগঠকদের নিয়ে কর্নেল তাহের এলিফ্যান্ট রোডে ইউসুফ ভাইয়ের বাসায় আসেন। সেখানে জাসদ নেতাদের সম্মিলিত বৈঠক বসে। এ বৈঠকে অভ্যুত্থানের সামরিক ও বেসামরিক পক্ষ পরস্পরের পরিকল্পনা, দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে শেষবারের মতো অবহিত হন। এ সময় সিদ্ধান্ত হয় যে, অভ্যুত্থানকালে কর্নেল তাহের সেনানিবাসের বাইরেই অবস্থান করবেন।
৬ নভেম্বর কর্নেল তাহের বিল্পবী সৈনিক সংস্থাকে নিয়ে যখন অভ্যুত্থানের সামরিক প্রস্তুতি চূড়ান্ত করে ফেলেছেন তখনও জাসদ নেতৃবৃন্দ ছাত্রলীগ-শ্রমিক লীগ ও গণবাহিনীকে রাস্তায় নামাবার প্রাথমিক প্রস্তুতিও নেননি। ঢাকা শহর গণবাহিনীর অধিনায়ক আমি। সরাসরি হাসানুল হক ইনু’র অধীনে। তার কাছ থেকেই দলীয় নির্দেশ পেতাম। সে সময় ঢাকায় আমার নেতৃত্বে গণবাহিনীর প্রায় ছয়শত নিয়মিত সদস্য। হাসানুল হক ইনু-র কাছ থেকে নির্দেশ চাচ্ছিলাম গণবাহিনীকে সক্রিয় করার। তিনি জানালেন আপাতত তাদের অভ্যুত্থান সম্পর্কে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। শুধু আঞ্চলিক কমাণ্ডারদের সতর্ক রাখতে বললেন। তার এ সিদ্ধান্তের কারণে শহর গণবাহিনীর আঞ্চলিক কমাণ্ডারদের পর্যন্ত অভ্যুত্থান সম্পর্কে কিছুই জানানো গেল না। আজ এটা অনেককে অবাক করবে। তারা বলবেন, আমার অগ্রজ কর্নেল তাহের যেখানে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তখন আমি শহর গণবাহিনীকে সক্রিয় করার জন্য হাসানুল হক ইনু-র নির্দেশের জন্য অপেক্ষা কেন করলাম। এ প্রসঙ্গে বলি, কঠোর সাংগঠনিক নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যেই আমরা কাজ করতাম। দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি ছিল সবার উপরে। সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী কমিটিতে অভ্যুত্থানের ওপর সেই ৩ নভেম্বর থেকে আলোচনা চলছে। আমি সে কমিটির সদস্য নই। তাই সে অলোচনার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। যদিও শহর গণবাহিনীর অধিনায়ক আমি। যেখানে সেনা ছাউনি থেকে সৈন্যরা উর্দি পরেই বাইরে এসে রাজনীতিবিদদের সাথে মিটিং করছে; সেখানে রাজনীতিবিদরা কেন এমন কঠোর গোপনীয়তার বাতাবরণে নিজেদের এবং অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্তকে ঢেকে রাখলেন তা বিস্ময়কর বৈকি।
এ ব্যাপারে বলি, গোপন রাজনীতি আমাদের স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত, সাবলীল ছন্দময়তাকে বাধাগ্রস্ত করে। আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে সাধারণ মানুষ থেকে। দেয়ালে আবদ্ধ হয়ে পড়ি আমরা। গোপন রাজনীতির বলয়ে থেকেও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়ার দুরূহ কাজটি যথাযথভাবে সম্পাদন করতেন পেরেছিলেন বলশেভিকরা। তাই ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বরের রুশ বিপ্লব জয়যুক্ত হয়েছিল। ৫৮ বছর পর ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরে বাংলাদেশে সিপাহী অভ্যুত্থানে আমরা পরাজিত হলাম নিজেদের বলয় ভেঙ্গে সাধারণের মধ্যে প্রকাশিত হতে না পেরে। আরও স্পষ্ট কথায় অভ্যুত্থানী সৈনিকদের সাথে সংগঠিত জনতাকে সম্পৃক্ত করতে না পারার ফলে।
সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান সংগঠনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাসদ। তাহের সামনে এগিয়ে গেছেন। তাকে বলা হয়েছে জাসদ ও তার প্রতিটি অঙ্গ সংগঠনের সম্ভাব্য সকল শক্তিকে পুরো মাত্রায় সচল করা হবে। তেজগাঁও ও পোস্তাগোলা শিল্প এলাকায় শ্রমিকদের মধ্যে আমাদের ভাল সাংগঠনিক অবস্থা। প্রয়োজনে স্বল্প নোটিশে আদমজী থেকে হাজার হাজার শ্রমিককে ঢাকার রাস্তার নামাবার ব্যাপারে সিরাজুল আলম খানের আত্মপ্রত্যয়। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছাত্রলীগের শক্ত অবস্থান। ঢাকায় গণবাহিনীর প্রায় ছয়শত সক্রিয় প্রশিক্ষিত সদস্য। উন্মুক্ত রাজনীতির অনুপস্থিতিতে সে হিসাবে ঢাকায় জাসদের সম্মিলিত শক্তি নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর ছিল না। সেনা অভ্যুত্থানে আপন দায়িত্ব বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে তাই তাহেরের কোনো দ্বিধা ছিল না। তাহেরকে অভ্যুত্থানে এগিয়ে দিয়ে গণ-সংগঠনগুলোকে কেন পেছনে টেনে রাখা হলো, সেটা আজও একটা বড় প্রশ্ন। এটা কি শুধুমাত্র গণ্ডিবদ্ধ ভাবনার ফলে ঘটেছিল?
অন্য যে বিষয়ে আমার খটকা লেগেছিল, তাহলো, তাহেরকে অভ্যুত্থানের নেতা হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, কিন্তু রেডিও-টিভি দখলের পর দেশবাসীর উদ্দেশ্যে প্রচারের জন্য তার কোনো বক্তব্য রেকর্ড করে রাখা হলো না। উপরোক্ত দু’টো বিষয়ের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে এই যে, জাসদ নেতৃত্ব সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান সংগঠনের সিদ্ধান্ত নিলেও বাস্তবে বিষয়টিকে তারা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেননি। তারা হয়তো বিশ্বাসও করতে পারেননি, সত্যি সত্যি সিপাহীরা বিদ্রোহ করে বিপ্লবী জনতার কাতারে যুক্ত হতে আসবেন। কিংবা এমনও হতে পারে যে, জাসদ নেতৃত্ব আদৌ আস্থা রাখতে পারছিলেন না যে কর্নেল তাহের এ রকম একটি অভ্যুত্থান ঘটাতে পারবেন। তাদের হয়তো হিসাব ছিল তাহের যদি একান্তই সফল হয়ে যান তবে তার থেকে সুবিধাটুকু নেবেন তারা। এ সমস্ত কারণে জাসদ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোকে অভ্যুত্থানে সামিল করতে তারা হয়তো দ্বিধান্বিত ছিলেন। তাদের হয়তো ভাবনা ছিল অনিশ্চিত অভিযাত্রায় সামিল হয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া হলে রাজনৈতিক শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার পর এমন সব দোদুল্যমানতা যে কি ভয়াবহ বিপদের কারণ হতে পারে তা যখন বোঝা গেল তখন পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে।
কর্নেল তাহের সামগ্রিক পরিকল্পনার বেসামরিক অংশের এসব ঘাটতির কথা মোটেই অবগত ছিলেন না। মুখ্য নেতা সিরাজুল আলম খান এবং জাসদের তরুণ নেতাদের ওপর তার তখন গভীর আস্থা। তাহেরকে বলা হয়েছিল – ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ ও গণবাহিনী পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি সহকারে ময়দানে থাকবে। সৈন্যরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এসে গণবাহিনীর সদস্যদের সশস্ত্র করবে। ছাত্ররা থাকবে প্রচারের দায়িত্বে এবং শ্রমিকরা নিয়ন্ত্রণ করবে রাজপথ। এসব আমি জেনেছি পরে। গোপন বিচার চলাকালে। নেতৃত্ব চাইলে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মতো শক্তি তখন জাসদের র্র্ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নেতৃত্ব কিছুই করলেন না। কিংবা এমনও হতে পারে যে, তারা শুধু পরিকল্পনার সামরিক অংশটুকু বাস্তবায়নকেই যথেষ্ট মনে করেছেন।
(চলবে)
১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব
মো. আনোয়ার হোসেন
অধ্যাপক, প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অনুজ, শহীদ কর্নেল আবু তাহের (বীর উত্তম)।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
Pingback: মুক্তাঙ্গন | তাহেরের স্বপ্ন (প্রথম পর্ব) | মো: আনোয়ার হোসেন
Pingback: মুক্তাঙ্গন | তাহেরের স্বপ্ন (দ্বিতীয় পর্ব) | মো: আনোয়ার হোসেন
Pingback: মুক্তাঙ্গন | তাহেরের স্বপ্ন (চতুর্থ পর্ব) | মো: আনোয়ার হোসেন
Pingback: মুক্তাঙ্গন | তাহেরের স্বপ্ন (পঞ্চম ও শেষ পর্ব) | মো: আনোয়ার হোসেন
মাসুদ করিম - ২০ নভেম্বর ২০১০ (১:২৭ অপরাহ্ণ)
নেতা হওয়া, নেতা পাওয়া – কী কঠিন!
অবিশ্রুত - ৩ জানুয়ারি ২০১১ (৫:৩৯ পূর্বাহ্ণ)
আনোয়ার হোসেন লিখেছেন :
একটু পর লিখেছেন :
আবার লিখেছেন :
এই কথাগুলি পরস্পরবিরোধী। কেননা বেসামরিক অংশের বিভিন্ন ঘাটতি ছিল বলেই অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেতারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একজন নেতার কাছে শুনেছি, আখলাকুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন দুর্বল দিকগুলি তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু তাহের বার বার জোর দিয়ে যা বলছিলেন তার অর্থ ছিল, বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের সফল মডেলগুলি দিয়ে অন্য একটি বিপ্লব-পরিকল্পনার দুর্বলতা ব্যাখ্যার প্রচেষ্টা সঠিক নয় এবং সফল হলে সম্পন্ন-এই-বিপ্লবই হবে তৃতীয় বিশ্বের জন্যে একটি মডেল-যেমন রাশিয়া কিংবা চীন বিপ্লবের মডেল হয়ে উঠেছে।
ওই সময় জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমানকে ছোটদের রাজনীতি ও ছোটদের অর্থনীতি (ড. নীহারের লেখা প্রাথমিক পর্যায়ের বই) পড়ানো হয়েছে বলে জানানো হয়েছিল। এই পর্যায়ে, পার্টির একজন প্রাথমিক সদস্য বা শুভানুধ্যায়ীও নন এমন একজনকে (জিয়া) কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে অভ্যুত্থানপরিকল্পনার ব্যাপারে একজন তীব্র বিরোধিতা করলে ‘…(একটি অশ্লীল গালি) ইউর থিওরি’ বলে তাকে থামিয়ে দেয়া হয়েছিল।
যারা ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তারা যদি সেদিন কে কোন অবস্থান নিয়েছিলেন, তা প্রকাশ করেন, তা হলে অনেক তথ্যই বেরিয়ে আসবে। ওই বৈঠকের প্রায় সবাই এখনো জীবিত আছেন।
তাহেরের বিপ্লবী-আন্তরিকতা, একনিষ্ঠতা, দৃঢ়তার ওপর পূর্ণ আস্থা রেখেও বলা যায়, বিপ্লবের একটি নতুন মডেলের মোহ সেদিন রাতে তাকেও পেয়ে বসেছিল। তাই তিনিও বিরোধিতাকারীদের তত্ব ও তথ্যগুলিকে আমলে নেননি।