মানুষটা তাঁর যুগ ও বাস্তবতার অনেক আগেই জন্মেছেন। জার্মানির একটি গণিত-প্রেমিক, ইহুদি পরিবারে। আইনস্টাইনের প্রায় সমসাময়িক, এবং জীবন-বাস্তবতা প্রায় বিপরীত। আইনস্টাইন খ্যাতি ও সামাজিক পরিচিতির কড়া আলোয় এসেছেন। আর এই মানুষটি দশজনের চোখের আড়ালে, আঘাত ও অসম্মানের সঙ্গে পেছন থেকেই, তাঁর মত এক শান্ত, নির্লিপ্ত সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। দুজনই জার্মান, ইহুদি, ও বিজ্ঞান-সাধক। আরো মিল তাঁদের গভীরে সমাজ ও মানুষের প্রতি অকুণ্ঠ আগ্রহে ও সহানুভবে, তাঁদের নিঃসীম উদারতায় ও সাদামাঠা জীবনযাপনে, এবং তাঁদের যৌথ বিজ্ঞান-সাধনায়।
জার্মানিকে গণিত-সাধনার পাদ-পীঠ বলা হয়। জার্মানির গণিত-ইতিহাস প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী, এবং সেখানে বহু ইহুদির বলার মত অবদান আছে। জার্মান গণিতের কথা বললে গাউস, রীমান, ডেডিকেন্ট, ওয়ার্সত্রাস, মোবিয়াস, বেসেল, কুরান্ট, ক্রনেকার, হিলবার্ট, এমন অনেক নাম গণিত-ছাত্রের মনে হয়ত ধাক্কা দেবে। আর এই মানুষ তো গণিত নিয়েই তার পুরো জীবন কাটিয়ে গেছেন। তাঁর অভিনব আবিষ্কারে একের পর এক খুলে গেছে বিজ্ঞানের নানা দিকের দরজা। আশ্চর্য জটিল বিষয়ের নির্যাস ছেঁকে, তাদের মৌলিক, সরল ধর্মগুলি তুলে ধরেছেন অদ্ভুত সাবলীলতায়। জন্ম দিয়েছেন গণিতের আধুনিক রূপ, নতুন অবয়ব।
স্থানকালের দিক থেকে নোয়েথার মোটামুটি একটি প্রতিকুল পরিবেশ বেছেই জন্মেছেন। জার্মানির তীব্র পুরুষতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক পরিবেশে, তিনি ম্যাক্স নোয়েথারের কন্যা, এক জন উদার, প্রগতিশীল, সমাজবাদের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাভাবাপন্ন মানুষ হিসেবে বিবর্তিত হয়েছেন। যেমন অনুমান করা যায়, এ সব কটি কারণেই তাঁর জীবনে বিপর্যয় এসেছে; অবমাননা, অসম্মান, জীবন-জোড়া আর্থিক সংকট, সংঘাত, সংগ্রাম। কিন্তু যাঁরা নোয়েথারকে চেনেন, তাঁরা তাঁর অস্তিত্বের প্রবল উজ্জ্বল দিকটিও জানেন। সব সংকুলতাকে প্রায় ধুলোর মত কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে তিনি ঝাঁপ দিয়েছেন জীবনের সব অবশ্য-কর্তব্য ইতিবাচক কাজের সমুদ্রে। সংসার ও সমাজের জটিল, নিষ্ঠুর কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে শান্তির নীড়ের মত সরল বনস্পতি হয়ে উঠেছেন তাঁর আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু ও ছাত্রদের কাছে।
আঠের বছর বয়স্ক এমি তাঁর জীবনের মোড় পাল্টেছেন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে: গতানুগতিক গৃহিণী বা ইস্কুলের শিক্ষক হতে নয়, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো উচ্চশিক্ষা পেতে চান।
১৯০৮ পর্যন্ত চালচিত্রটা এরকম: জার্মানিতে মহিলারা রাজনৈতিক জীবনে বা সভা-সমিতিতে যোগ দিতে পারেন না। চোদ্দ বা পনের বছর পর্যন্ত কথা বলার মত কিছু ইংরিজি বা ফরাসী, ধর্মশিক্ষা, গার্হস্থ্য-বিজ্ঞান ও শিশু-শিক্ষা, বড় জোর ইস্কুল শিক্ষক হবার তালিম ছাড়া কিছু পান না তারা। জার্মানির দ্রুত শিল্পায়ন এবং তার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকায়নের উল্টো স্রোতে গোঁড়া, রক্ষণশীল অধ্যাপকরা নারী-শিক্ষা সম্পূর্ণ বন্ধ করে রেখেছেন। মহিলারা — তাঁদের মতে, শিক্ষার পরিবেশ ‘কলুষিত’ করে থাকেন। খুব বেশি হলে মহিলারা ক্লাস চলাকালীন পেছনে বসে অধ্যাপকদের কথা শুনতে পারেন।
দুই হাজার পুরুষের সঙ্গে এই ভাবে দুই জন মহিলা ক্লাস করেছেন। তাঁদের একজন এমি নোয়েথার।
দু বছরের মধ্যে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে এমি গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন। ফেলিক্স ক্লাইন সেখানকার ধুমকেতুর মত উজ্জ্বল ও বিশিষ্ট গণিতবিদ, তখন প্রশাসক, তিনি মহিলাদের পড়াশুনোর জন্য অগ্রসর ভূমিকা রাখেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে এমিকে তার বাবার কাছে এর্লেঙ্গেনে ফিরে যেতে হয়। আট বছর পিতা-কন্যা সেখানে একের পর এক যৌথ গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে থাকেন। এমির ডক্টরাল থিসিস শেষ হয় গর্ডানের কাছে। গর্ডানকে গণিতের একটি বিশেষ দিক, ইন্ভেরিয়েন্ট বা অব্যয় গণিতের রাজা বলা হত।
গণিত একটি প্রমাণ-নির্ভর বিজ্ঞান। প্রমাণ দেবার দর্শন ও শৈলীর ওপর নির্ভর করে গণিতবিদরা সাধারণত দুই ভাগে ভাগ হয়ে যান। এক ভাগ নির্মাণ-ভিত্তিক প্রমাণ হাজির করেন। আরেক দল, এক ভাবে অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। গর্ডান প্রথম ধারার লোক। তাঁরই ছাত্রী এমি পরবর্তিতে দ্বিতীয় ধারাকে বিখ্যাত ও অগ্রসর করেছেন।
প্রথম ধারাটি সাধারণত জটিল। এমি নোয়েথার এই জটিল গণিতকে তাঁর বাহ্য, অদরকারী উপাদান থেকে খালাস করে, সুঠাম ও সরল করে ফেলেছেন, এবং তাঁর অগ্রপথিক, হিলবার্ট ও ফিশারের পথ ধরে তৈরী করেছেন নতুন, বিমূর্ত গণিতের ধারা।
বাবা ম্যাক্স নোয়েথার অসুস্থ হবার পর, এমি তাঁর প্রকাশনার দায়িত্বও কাঁধে নেন। ত্রিশের কোঠায় পা দেবার সময় থেকে তাঁর কাছে গবেষণার করার জন্য ছাত্র আসতে থাকে। `ম্যাক্স নোয়েথারের মেয়ে’ এই পরিচয় ছাপিয়ে তাঁর একটি স্বাধীন, স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক পরিচিতি তৈরী হচ্ছে। তখনও তিনি এরলেঙ্গেনে বিনা পদ, বিনা মাইনেতে, ছাত্র পড়ান।
১৯১৬ সালে পিতা-কন্যা নোয়েথার গোটিঙ্গেনে হিলবার্ট ও ক্লাইনের সঙ্গে দেখা করতে যান। গোটিঙ্গেন — অর্থাৎ তত্কালীন বিশ্বে গণিতের একটি প্রাণকেন্দ্র। এবং হিলবার্ট, তথা গণিতের উজ্জ্বলতম দিশারী নক্ষত্রের একজন। কিছু দিনের মধ্যে হিলবার্ট ও ক্লাইন এমিকে তাঁদের দলে যোগ দেবার আমন্ত্রণ জানান। ৩৪ বছর বয়স্ক এমি গোটিঙ্গেনে আসেন। এখানে তাঁর জীবনের সব চেয়ে সৃষ্টিশীল ১৮টি বছর কাটবে।
হিলবার্ট ও ক্লাইন তখন আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের গাণিতিক কাঠামো নিয়ে জোর ভাবছেন। অচিরে এমি এই দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হন। আইনস্টাইন এক সময় হিলবার্টকে লেখেন, ‘আপনি জানেন, শ্রীমতি নোয়েথার আমাকে সার্বক্ষণিক পথ দেখাচ্ছেন, এবং তাঁর মাধ্যমে আমি এ ব্যাপারে পোক্ত হতে পেরেছি।’ আইনস্টাইনের গণিত-গুরুর ভূমিকায় নোয়েথারকে দেখে চমত্কৃত হতে হয়, সন্দেহ নেই, কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের দুইটি দিকের গাণিতিক প্রমাণ নোয়েথারই দিতে পেরেছেন।
জার্মান সমাজে তখনও মহিলা-শিক্ষক নিয়োগের পরিপন্থী আইন জারি রয়েছে। বিশ্বযুদ্ধ-বিধ্বস্ত জার্মানির উগ্র রক্ষণশীল শিক্ষকরা বলছেন, সৈনিক উত্পাদন করাই মহিলাদের কর্তব্য, আর যুদ্ধ-ফেরত সৈনিকরা মহিলাদের পায়ের নীচে স্থান না পায়, তা দেখা তাদের কর্তব্য। হিলবার্টও একথার ত্বরিত জবাব দেন এই মর্মে, যে শিক্ষাঙ্গন কোনো গণহামাম নয় যে সেখানে মহিলা-পুরুষ নিয়ে বিচার করতে হবে।
নোয়েথারকে গোটিঙ্গেনে নিজের নামে অধ্যাপনা করা থেকে আইনই বিরত রাখে। স্বাধীন ভাবে অধ্যাপনা করলেও কাগজে-কলমে তিনি থেকে যান হিলবার্টের সহযোগী।
শিক্ষকতার দিক থেকে নোয়েথারের মূল্যায়ন এইরকম: তিনি তাঁর অসমাপ্ত গবেষণার বিষয়গুলি ক্লাসে পড়ান, ছাত্র-শিক্ষক যুক্ত হয়ে যান অভিনব ক্লাসরুম গবেষণায়, অনেক ক্ষেত্রে যৌথ চিন্তায় সমাধান বেরোয় সেখানেই। এতে অবশ্য সকলে খুশি নন। নোয়েথারের তুমুল উত্সাহ ও উদ্দীপ্ত গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেউ চলতে পারেন, কেউ বা পারেন না। তবে যাঁরা পারেন, তাঁরা নোয়েথারের ক্লাসে গবেষণায় হাতেখড়ি নিয়েছেন; স্রষ্টা হয়েছেন। তত্কালীন গোটিঙ্গেনের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল কেন্দ্র হিসেবে নোয়েথারের দলটিকে তাঁর সহকর্মী বন্ধুরা স্মরণ করেছেন।
নোয়েথারকে গোটিঙ্গেনের বিনা বেতনের সবচেয়ে নীচু পদ অধিকার করতে হিলবার্ট-আইনস্টাইনদের নিরবিচ্ছিন্ন লড়াই, একটি বিশ্বযুদ্ধ ও চারটি বছর লাগে।
১৯১৯ সালে জার্মানি বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাবার পর সমাজতান্ত্রিক শক্তি ইউরোপে বরাবর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের কারণে এমি তখনও বিনা মাইনে, বিনা সম্মান ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছাত্র পড়াচ্ছেন। নোয়েথারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি দেবার ব্যাপারটি স্থির করতে পারে প্রুশান আদালত, এবং সেখানে অধ্যাপকদের নিরংকুশ সম্মতি দরকার। বহুবার আপীলের পর একটি আপোষ রফা হয়। নোয়েথার অধ্যাপকদের মধ্যে সবচেয়ে নীচু পদ, ‘প্রাইভেত-দোজেন’ পাবেন। পদটিতে মাইনে হয়না। প্রুশান আদালত ও অধ্যাপকদের মনে হয়েছে, এতেই নোয়েথারের খুশি থাকা উচিত। পি.এচ.ডি শেষ হবার তের বছর পর ৩৯ বছর বয়স্ক এমি নোয়েথার তখন গণিতের মিছিলে পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
গোটিঙ্গেনের লাল ফিতে এ সময় যখন জট ছাড়াতে ব্যস্ত, নোয়েথার তখন তাঁর দুইটি প্রধান বক্তৃতা উপস্থাপন করছেন। শহরের এমন কোনো চাকুরিজীবি শিক্ষাজীবি মানুষ নেই, যিনি সেখানে ওই সময় উপস্থিত হননি। নোয়েথার তাঁর দ্বিতীয় বক্তৃতায় নোয়েথার উপপাদ্য প্রমাণ করেন। গণিতের ছাত্র না শুনে থাকলেও, পদার্থবিদ্যার ছাত্র এই উপপাদ্যের নাম হয়ত শুনেছেন। বিংশ শতাব্দীর একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার কোয়ান্টাম ফিজিক্স। পরমাণু, নিউক্লিয়াস, ও উপ-নিউক্লিয়াস কণার আচরণ বর্ণনা করে এই উপপাদ্য; জানা যায়, শক্তি, ভর-বেগ, কৌণিক ভর-বেগ, এগুলির সঙ্গে প্রতিসাম্য (symmetry)-র যোগ আছে। সুতরাং পদার্থ-বিদ্যার নিয়মগুলি স্থান-কাল নিরপেক্ষ; যা আজ সত্য, তা কালও সত্য, এবং হাজার বছর পরেও তাই থাকবে। কোয়ান্টাম ফিজিক্স এ যুগের বিজ্ঞান-সাধনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।
১৯২১ সালে আইনস্টাইন নোবেল পুরস্কার পান। আর সারা বিশ্বে তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ অসামান্য ঝড় তোলে। গণিতে কোনো নোবেল পুরস্কার হয়না। কোয়ান্টাম ফিজিক্সে নোয়েথারের ভূমিকা, এবং সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে হিলবার্ট ও নোয়েথারের ভূমিকা কান পর্যন্ত ছাপিয়ে ওঠেনা।
১৯২২ সালে গোটিঙ্গেনে নোয়েথারকে কাগজ-কলম-বহির্ভূত ভাবে ‘অসাধারণ শিক্ষক’-এর খেতাবের নামে একটি ঠাট্টার খোরাক চালু করে। এতে তার সম্মান বা বেতন, কিছুই বাড়েনা। তখনও সেখানে তিনি সবার কম মাইনে পান। তাঁর বেতনকে তাঁর বন্ধুরা প্রায় ভিক্ষার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
তবে এমির নিটোল জীবনে কোনো অভাব-বোধ নেই। একাকীত্ব তো নয়ই। তাঁর ছাত্ররা তাঁকে পঙ্গপালের মত ঘিরে রাখে। তিনি মা-হাঁসের মত তাদের রক্ষা করেন। তাঁদের প্রতি বিন্দুমাত্র অন্যায় তিনি সহ্য করেননা। তাঁর ছোট ঘর, তাঁর আসবাবপত্র যা কিছু আছে, তা তিনি তাদের সঙ্গে ভাগ করে নেন। তাঁর ছাত্রদের বলা হয় ‘নোয়েথার পুত্র’। এদের সবাইকে প্রায়শ ঝড়ের মত সশব্দে ঘুরতে দেখা যায়!
এমি নোয়েথার তাঁর জীবনে ৪৪টি গবেষণাপত্র লিখেছেন। আরো অনেক গবেষণার সূত্র মুখেমুখে বলেছেন – তাঁর একটিমাত্র আলোচনা থেকে তাঁর সহকর্মী ও ছাত্ররা গবেষণাপত্রের মৌলিক রসদ পেয়েছেন। এদিক থেকে বলা যায়, তার বেশির ভাগ গবেষণাই তিনি নিজে লেখেননি, অন্য কেউ লিপিবদ্ধ করেছে। গবেষণার কাজকে এভাবে ভাগ করে নিতে ও অকাতরে বিলিয়ে দিতে দেখা যায় আইনস্টাইনের আরেক সুহৃদ ও সহকর্মী — বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন বোসকে।
এক এক জনকে নিয়ে কখনো কখনো কিংবদন্তী দাঁড়ায়। নোয়েথারের ধোপদুরস্ততার অভাব, হালের যা ফ্যাশন, তার উল্টোটা করার স্বভাব তাঁকে বিভিন্ন মহলে সমালোচিত করেছে। ব্যক্তিগতভাবে এমি যা-কিছু অদরকারী ও শুধুমাত্র বাহ্যিক, তাকে তাঁর জীবনে ও গবেষণায় অগ্রাহ্য করেছেন। যেভাবে স্বস্তিতে থাকতে পারেন, থেকেছেন; দশজনের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করেননি। তাঁর সীমিত চাহিদা ও প্রায় বিনা-মাইনের চাকরিতে ভাইপোর পড়াশুনোর জন্য নিয়মিত টাকা পাঠিয়েছেন। স্থানীয় সুইমিঙ পুলে ‘শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য’ নোটিশটি অগ্রাহ্য করে রোদে-বর্ষায় সারা বছর সাঁতার কেটেছেন। আর বাড়িতে তাঁর ছাত্রদের বৈঠকে তাদের দেদার খাইয়েছেন।
অনেকে তাঁর ঢোলা পোশাক, তাঁর ‘কাজের লোকের মত’ চেহারা, তাঁর বাঁজখাই কন্ঠস্বর নিয়ে সমালোচনা করেছেন। যদি কোনো পুরুষ অধ্যাপকের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যগুলি থাকত, তবে তাঁরা নিশ্চয়ই অসাধারণ দীপ্তিমান অধ্যাপকের অন্যমনস্কতার বৈশিষ্ট্য হিসেবে এগুলিকে চালিয়ে নিতে পারতেন।
নোয়েথার প্রথমে একটি বোর্ডিঙে ভাড়া থেকেছেন। অন্যান্য মহিলাদের সম্ভবত একজন মার্কসবাদী, ইহুদি মহিলার সঙ্গে একই জায়গায় বসবাসে আপত্তি ছিল, তাই তাঁকে ঘর ছাড়া হতে হয়েছে। পরে তিনি একটি ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন।
এমি এবং তাঁর দেশী বিদেশী ছাত্রদের হাতে তখন সবচেয়ে সৃষ্টিশীল, দিব্য গাণিতিক মুহূর্তগুলি রোজ ভরে উঠছে আশ্চর্য ফসলে। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে গ্রেট হারমান, হেনরিক গ্রেল, ওয়ার্নার ওয়েবার, ইয়াকব লেভিতস্কি, ম্যাক্স দুরিং, হ্যান্স ফিটিং, অটো শিলিং, ভ্যান দার ওয়ার্দেন, প্রভৃতিরা আছেন।
নোয়েথার তাঁর জীবনে যা হতে পারেননি, তাঁর ছাত্ররা গোটিঙ্গেনের সেই পূর্ণ প্রফেসর হয়েছেন। নোয়েথারেরই গবেষণার ফসল, ভ্যান দার ওয়ার্দেনের ‘মডার্ন আলজেব্রা’ বা ‘আধুনিক বীজগণিত’ বইটি পাঠ্য-কেতাব হিসেবে বহু জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। ম্যাক্স দুরিঙের বই সম্পর্কেও একই কথা খাটে। কিছু আশ্চর্য সুন্দর গবেষণা-পত্র প্রকাশ করে তাঁর ছাত্র হেলমুট হাস নোয়েথারকে তা ‘তাঁরই সৃষ্টি’ বলে উত্সর্গ করেছেন।
১৯৫০ সালে রাশা যখন আগেভাগে চাঁদে স্পুটনিক পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে ঝড় তোলে, তখন হঠাৎ-গণিত-সচেতনতার প্রভাবে নোয়েথারের আধুনিক গণিত সেখানকার ইস্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে জায়গা করে নেয়।
গণিত ছাড়াও নোয়েথার দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গন সম্পর্কে উত্কর্ণ ও উত্সুক ছিলেন। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সেখানকার জীবন সম্পর্কে। ১৯২৪-২৫ সালে তিনি মস্কোতে একটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর সুযোগ পান। মস্কোর গণিত-সমিতির সভাপতি আলেক্সান্দ্রভ তাঁর ঋণের কথা স্বীকার করেছেন।
১৯৩২ সালে নোয়েথার আন্তর্জাতিক গণিত কংগ্রেসে যোগ দেন। সমস্ত কংগ্রেসে তিনিই একমাত্র আমন্ত্রিত মহিলা। কিন্তু তাঁর স্বদেশে গণিত, শিক্ষার জগৎ, তখন খল রাজনীতির প্রভাবে পর্যদুস্ত, বিধ্বস্ত। নোয়েথারের ছাত্রদের মধ্যে নাত্সী ছাত্র আছে। তারা তাদের ইহুদি শিক্ষকদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ অসহযোগিতা করছে।
আন্তর্জাতিক গণিত কংগ্রেসের কয়েক মাস পরেই হিটলার ক্ষমতায় আসে। ইহুদিদের ‘অশুভ শক্তি’র বিরুদ্ধে তত্পর হয় নাত্সী বাহিনী। কিছু দিনের মধ্যে শুরু হয় ইহুদি শিক্ষক ছাঁটাই। গোটিঙ্গেনের মূল ভিতই যেখানে ইহুদি শিক্ষক-জনতার, সেখানে সমাজতান্ত্রিক, প্রগতিবাদী, যুদ্ধবিরোধী নোয়েথার-সহ বহু শিক্ষক ছাঁটাই হলে যে সেই ভিত ভেঙে পড়বে, এতে আর সন্দেহ কি! ইহুদি-মুক্ত (নোয়েথার-মুক্ত বলাই সমীচীন) হবার পর গোটিঙ্গেনের গণিত-চর্চা কেমন চলছে, একজন নাত্সী মন্ত্রীর এই প্রশ্নের উত্তরে হিলবার্ট, তখন বৃদ্ধ, একটু ভেবে বলেছিলেন, ‘গণিত চর্চা? এখন তো সেখানে কোনো গণিত-চর্চা হয়না!’
অথচ নোয়েথার বিচলিত হননা। অথবা হলেও দেখান না। তিনি নিজেকে নিয়ে কখনো মাথা ব্যথা করেছেন বলে মনে হয়না। তাঁর চারিদিকে তখন বহু ইহুদি মানুষ, যারা বিপন্ন, যাদের ক্ষণভঙ্গুর অস্তিত্ব দুলছে নাত্সী ঘাতকের হাতের সুতোয়। এ সময় তাঁর কাজ বা অধ্যাপনাও থেমে থাকেনা। তাঁর ছোট ঘরটিতে ক্লাস করতে আসে একাধারে নাত্সী ও ইহুদি পোশাক-পরা ছাত্র!
নোয়েথারকে একটি অস্থায়ী চাকরি জোগাড় করার প্রানান্ত লড়াই করেন তাঁর সহকর্মী হের্মান ওয়াইল ও অন্যান্যরা। নোয়েথার মস্কোর কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু কার্যত সেখানকার আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাঁর চাকরির ব্যবস্থাটি তেমন ভাবে অগ্রসর হতে পারেনা। শেষ পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার ব্রন মোর কলেজের অস্থায়ী চাকরিতে যোগ দেন। প্রিন্সটনে আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর এ সময় নিয়মিত সাক্ষাত হয়। নোয়েথার লক্ষ করেন, প্রিন্সটন তখনও নারী-বহির্ভূত একটি প্রতিষ্ঠান। তবে সে বছরই প্রিন্সটনের ‘ইন্সটিটিউট অফ এডভানস্ড স্টাডিজ’-এ তিনি বক্তৃতা দেবার আমন্ত্রণ পান। বলাবাহুল্য, এখানেও তিনি বহু আগ্রহী পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ছাত্র পেয়ে যান। তাঁদের জন্য তাঁর স্নেহশীল ব্যগ্রতা, তাঁর অনুপ্রেরণা ছাড়াও তাঁদের অর্থনৈতিক সমস্যার দিকে তাঁর নিরন্তর খেয়াল থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের মান অনুপাতে তিনি একজন দরিদ্র শিক্ষক। কিন্তু তিনি নিজেকে যথেষ্ট ধনী মনে করেন। অর্ধেক বেতন জমান ভাইপোর পড়াশুনোর জন্য। ১৯৩৪ সালে এমি তাঁর পরিবার ও বন্ধুদের বিদায় জানানোর উদ্দেশ্যে গটিঙ্গেন ফেরেন। তাঁর গণিতবিদ ভাই ফ্রিত্জ নোয়েথারকে তখন সাইবেরিয়ার একটি চাকরিতে প্রায়-নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে নাত্সী সরকার। তাঁর বেশির ভাগ পুরোনো বন্ধুরা তাঁকে এড়িয়ে চলেন। তিনি বোঝেন, সহসা তিনি দেশে ফিরতে পারছেননা। তবে যাবার সময়, এই জটিল, ঘোলাটে বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এমি তাঁর জন্মভূমির ওপর কোনো ক্ষোভ বা অভিমান রাখেননা, কোনো বন্ধুত্বের সেতু ভাঙেননা।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রন মরে এক বছর অস্থায়ী চাকরির পর নোয়েথারকে নতুন করে চাকরি খুঁজতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের গণিতবিদরা তাঁকে এক ‘অসাধারণ বিজ্ঞানী এবং গণিতের প্রথম সারির গবেষক’ হিসেবে চিনে থাকলেও তাঁর পক্ষে সেখানে একটি সুরক্ষিত চাকরি পাওয়া সহজ হয়না। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে তাঁর ব্রন মরে শিক্ষকতার জন্য টাকা জোগাড় করা হয়।
এর পরপরই এমি একটি বিশাল টিউমার অপারেশনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হন। তার ধকলটা তিনি সহ্য করেন। কিন্তু পরবর্তিতে ইনফেকশন তাঁকে আচম্বিত আক্রমন করলে তা সহ্য করতে পারেননা। সবচেয়ে সৃষ্টিশীল অধ্যায়ে, স্বদেশ, আত্মীয়পরিজন, বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন, তাঁর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান থেকে বহু, বহু দূরে, বহু পরিকল্পনার বাস্তবায়ন অসমাপ্ত রেখে, কর্মপ্রবাহের গর্জন ও উদ্দামতার মাঝখান থেকে তাঁকে বিদায় নিতে হয়।
একাল যাবত যে জার্মান গণিত পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করে গেছেন, কিন্তু যেখানে কখনো সম্পাদক হিসেবে তাঁর নাম ছাপা হয়নি, সেই পত্রিকাটি তাঁর মৃত্যুর পরে একটি সাহসী শোকবার্তা প্রকাশ করে। ১৯৮২ সালে, তাঁর জন্ম শতবর্ষে, তাঁর দেহের ছাই ব্রন মরের গ্রন্থাগারের ইঁটের পাঁজরে রেখে দেওয়া হয়। এর পরের বছর বের হয় তাঁর সম্পূর্ণ লিখিত কাজ।
জার্মান গণিত জ্যোতিষ্ক হের্মান ওয়াইল ১৯৩৫ সালে তাঁর এক স্মরণ-সভার বক্তৃতায় বলেন, তিনি নিঃসন্দেহে বিংশ শতাব্দীর একজন অসামান্যতম গণিতবিদ, এবং মহিলা গণিতবিদদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম গবেষক।
১৯৮২ সালে, তাঁর জন্মস্থান এরলেঙ্গেনে, তাঁর নামে একটি সহশিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানের সূচনা হয়। নোয়েথার, যিনি সহশিক্ষার মুক্ত পরিবেশ পাননি, এ ঘটনায় নিশ্চয়ই খুশি হতেন!
আলবার্ট আইনস্টাইনের উক্তি দিয়ে এই নাতিদীর্ঘ আলোচনার ইতি টানছি। নোয়েথারের মৃত্যুর পর নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় তিনি বিশ্বকে জানান, ‘আজ যে কজন জীবিত, সক্রিয় ও সক্ষম গণিতবিদ আছেন, তাঁদের বিচারের নিরিখে বলা যায়, মহিলাদের উচ্চশিক্ষা শুরু হবার পর, শ্রীমতি নোয়েথার ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সৃষ্টিশীল গণিত-প্রতিভা।’
* * *
সূত্র:
১) Nobel Prize Women in Science – Sharon Bertsch Mcgrayne, Citadel Press
২) Emmy Noether – Herman Weyl
৩) http://www.emmynoether.com
৪) http://www.math.unl.edu/~awm/awm_folder/NoetherBrochure/AboutNoether.html
৫) http://faculty.evansville.edu/ck6/bstud/noether.html
কৃতজ্ঞতা:
প্রফেসর সুব্রত মজুমদার, অবসরপ্রাপ্ত, গণিত বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২ comments
মানিক - ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ (৪:৩৩ অপরাহ্ণ)
এমি নোয়েথার-এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আনন্দময়ী মজুমদার - ১১ ডিসেম্বর ২০১৪ (৭:১১ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ মানিক, আপনাকে। লেখাটি পড়েছেন জেনে ভালো লাগছে।