আমার এক প্রিয় বন্ধু ম্যান বুকার পাওয়া বইগুলি কে খুব আমল দেননা । আমার হাল হলো, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই । এবারের ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়া বই, ইলিনর ক্যাটনের ‘The Luminaries’ সম্বন্ধে জানলাম এটি একটি বিশালকায়, প্রাসাদোপম উপন্যাস, পরম লোভনীয় বর্ণনা, আর শুরু করে বুঝলাম পড়া শেষ করা ইস্তক আরাম নেই । লেখিকার বয়েস ২৮, এই পুরস্কারের হিসেবে সর্ব-কনিষ্ঠ পুরস্কৃত ব্যক্তি। বইটির ব্যাপ্তি ৮০০ পৃষ্ঠা জুড়ে ।
যারা চা-খোর তারা জানেন এক পেয়ালা গরম চা-এর সকাল বেলার আয়েশী বিলাসিতা কী জিনিস । এই বই পড়ার সময়টাও খানিকটা সেই নিবিষ্ট ধীরগতি স্বাদ-সেবনের বিলাসিতা বটে ।
ইলিনর এই গল্পে নিউজিল্যান্ডের গোল্ড-রাশের সময় – অর্থাত ঊনবিংশ শতাব্দীতে গড়ে তুলেছেন একটি ঘন দুর্গম রহস্যের প্লট । প্রথমেই একটি ঝঞ্ঝা-ক্ষুব্ধ জাহাজ থেকে নামা একজন ব্যক্তি আশ্রয় নেয় একটি সরাইখানায় — সেখানে জমায়েত হয়ে আছে বারোজন অপরিচিত ব্যক্তি – তার মধ্যে দুজন চীনা । আপাত ভাবে বোঝা না গেলেও, পরে বোঝা যায়, এই বারোজন ব্যক্তি মিলেই তৈরী হবে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র — এরাই যেন ঘটে যাওয়া নানা অঘটনের, অপরাধের, বিচারের ক্ষেত্রে একান্নবর্তী একটি জুরি-র রূপ নেবে ।
তিনটি আপাত ভাবে বিচ্ছিন্ন, অদ্ভুত, রহস্যময়, কিছুটা-যেন-অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেছে গত কয়েক দিন । এই ঘটনাগুলির সঙ্গে দেখা যায়, কোনো না কোনো ভাবে কিছুটা বেসামাল পজিশনে রয়েছে এই ১২ জন ব্যক্তি — নৈতিক ভাবে এরা যেন কিছুটা জড়িত, যদিও ইচ্ছাকৃত ভাবে নয়, তাই রহস্যের কিনারা করতে তারা একটি গোপন আলোচনায় অংশ নিচ্ছে, এবং এতে ১৩ তম ব্যক্তিরও তথ্য সংযোজনে কিছুটা ভূমিকা থাকে । এদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা গুলো জুড়ে উপন্যাসের প্রথম অর্ধেক তৈরী হয় । সে রস অনুপম ।
দ্বিতীয় অর্ধেকে পাই আরো কিছু রহস্যের কিনারা । শেষ পর্যন্ত একটি প্রায়-সম্পূর্ণ ছবি তৈরী হয়, কিন্তু শেষের দিকে লেখক যেন একটু নির্জীব, একটু থিতিয়ে পড়েছেন, যেন তাড়াতাড়ি শেষ করার ইচ্ছেতে ভাঙ্গা টুকরোগুলো জোড়া দিচ্ছেন, দালানের সৌন্দর্য রক্ষার কথা ততটা মনে না রেখেই । হতেই পারে, লেখক নাকি বইটি ২ বছর ধরে লিখেছেন!
যাহোক, দেশ ও কালের সীমানায় এরকম আশ্চর্য ব্যবধানের ও বিস্তৃতির পেশা ও চরিত্রের মিশেলে, চরিত্রগুলির পূর্ণাঙ্গ গঠনে, বিশ্লেষণে, লেখকের তারুণ্যের ছাপের চেয়ে পরিপক্বতা অনেক বেশি চোখে পড়ে ।
এই কাহিনীর মধ্যেই আছে বেশ কিছু সামাজিক ভাবে বিদ্ধ করা ঘটনা । দুইটি চীনাম্যান, স্বদেশ থেকে নানা প্রতিঘাতে যারা পাড়ি দিয়ে এসেছে এই দেশে, তাদের ওপর অনেক শ্বেতাঙ্গের অত্যাচার, বর্ণবাদী ঘৃণা ও প্রতিহিংসা — এর মধ্যে ঘুরে ফিরে আসে চীনে বৃটিশের চাপিয়ে দেওয়া আফিমের নেশা, এবং তার ফলশ্রুতিতে বাঁধা পরবর্তী ইতিহাস ।
এই উপন্যাসের আরো কেন্দ্রীয় চরিত্রের মধ্যে আছে একজন গণিকা আনা ওয়েদারয়েল । আনার প্রতি এই বারোজনের টান বা টানাপোড়েন নানা ভাবে বর্তমান । কখনো মানবিক, কখনো স্বার্থকেন্দ্রিক । আনার দিক থেকে তার কথা শোনার অবকাশ হয় অনেক পরে, সুতরাং তার অবয়ব অস্ফুট থেকে পরিষ্কার হতে থাকে, চাঁদের মত কলার মত, অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমায় । বই-এর মলাটে চন্দ্রকলার সঙ্গে তুলনীয় আনার একটি ছবি আমরা পাই ।
উপন্যাসটি লেখক আরো একটি বিশেষ থীম মেনে করেছেন — সেটি জ্যোতিষ-শাস্ত্রের । ব্যক্তিগত ভাবে জ্যোতিষ-শাস্ত্রের সঙ্গে তার কোনো বিশ্বাসের সম্পর্ক না থাকলেও এই থীম ব্যবহার করে হয়ত তার অন্য একটি চরিত্র, লিডিয়া ওয়েলসকে রক্তমাংসে উপস্থাপন করতে অনেকটা সহজ হয়েছে, কারণ লিডিয়া পরলোকগত আত্মার সঙ্গে ‘কথা বলে’, এবং বহু ভাগ্যান্বেষীর ভাগ্য গণনা করে – পেশাগত ভাবে, তার মধ্যে কত সত্য কতটা খাদ তার বিচার করার ভার পাঠকের ওপর ।
ঠিক এই কারণেই হয়ত বা ওই বারোজন চরিত্রকে এক একটি রাশিচক্রের সঙ্গে এবং বই এর আর পাঁচটি চরিত্র কে গ্রহের/উপগ্রহের সঙ্গে তুলনা করা হয় । এই ব্যাপারটি রূপক অর্থে এসেছে । কেন্দ্রীয় বারোজন চরিত্রের মানচিত্র গতিশীল – দেশ- মহাদেশ-সময় পরিক্রম করা, তাদের উপন্যাসের আকাশে সদাসর্বদা উজ্জ্বল ভাবে দেখা যায়। আর ভেতরের পাঁচ চরিত্র তারই ভেতর স্বল্প মাত্রায় সচল, অপেক্ষাকৃত অন্ধকার তাদের দিকটা । ‘মার্স ইন ক্যাপ্রিকর্ন’ বা ‘স্যাটার্ন ইন পিসেস’ এই জাতীয় নামকরণ দেখি আমরা অধ্যায় এবং উপ-অধ্যায়গুলির ।
প্রত্যেকই অধ্যায়ের আগেই দুই-তিন লাইনে লিখে দেয়া হয় কি ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু সেই ব্যাখ্যা পাঠকের আগ্রহ শীতল না করে দিয়ে বরং আরেকটু উজিয়ে তুলতেই সাহায্য করে।
শেষের দিকে বেশ কিছু সমীকরণ মেলে না । আমি আবেগী পাঠক, কিন্তু আমার না দেখে উপায় থাকেনা, যে প্রশ্ন গুলি আকাশে ছায়া ফেলেছিল, তাদের অনেক গুলির মীমাংসা হলো না। লেখকের লেখার হাত , তার জট পাকানোর ও ধীরে ধীরে সেই গ্রন্থি-ছেদনের ক্ষমতা অসাধারণ, প্রায় অবিস্মরণীয়, সে কথা মেনে নিয়েও এই জায়গাটা কষ্ট দেয় । শেষ পর্যন্ত এসে শেষ-রক্ষা করা, বা ফিনিশিং টাচটাই তো সৃজনশীল লেখকের সর্বৈব গুন, তাই না?