অমিতাভ ঘোষের সাক্ষাত্কার শুনছিলাম । সম্প্রতি তাঁর ‘এম্পায়ার ট্রিলজি’ উপন্যাসের প্রথমটি পড়েছি । অমিতাভ ঘোষের সঙ্গে পাঠক হিসেবে আমাদের পরিচয় বেশ কিছু দিনের, আর নির্দ্বিধায় বুঝতে পারি, এই বইটি আমাদের এই লেখককে আবার নতুন করে চিনতে, শ্রদ্ধা করতে শেখায় । এমন কি লেখকের বিপুল প্রতিভার উপযুক্ত আধার যেন এই বই-এর ‘প্যানোরমিক’ ক্যানভাসে পাই। ইতিহাসের পাতা খুলে যায় তাঁর লেখায় | ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি অজানা, অদেখা, অলব্ধ ছবি চোখের সামনে খাপ খুলে উপস্থিত হয় ।
বিষয়টি বেশ ছড়ানো । আইবিস — একটি ব্রিটিশ বেনিয়া জাহাজ ; এর গতিপথ ধরে, বিচিত্র মানুষের জীবনের জঙ্গমতা জড়িয়ে, উত্তুঙ্গ জীবনের তাপে, চাপে, ভঙ্গুরতায়, এক চলমান, বিস্ফারিত চালচিত্র । যার সুতো ধরে রাখে ভারতকে ব্যবহার করে, ব্রিটিশদের ঊনবিংশ শতকের আফিম ও শ্রম ব্যবসা । আইবিস কে কেন্দ্র করে লিখিত এই উপন্যাসে তিনটি ভাগ দেখা যায় – ১) স্থলে ২) নদীপথে এবং ৩) সমুদ্রে ।
মূল বিষয়টি যদিও নাম থেকেই আমরা আগে জেনে নিয়েছি; অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বদৌলতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তার পায় — এবং খুব দ্রুত, চীনে আফিম ব্যবসা শুরু করে। ভারতেই শুরু হয় সেই আফিম চাষ । এই আফিমের মুনাফা তত্কালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ১৫% বা তার বেশি ছিল — উপন্যাসের বাইরেও এই সম্পর্কে যত্সামান্য পড়াশুনো করেই তা বুঝতে পারা যায় ।
বিষয়টি যেহেতু ইতিহাস-পাঠ্যপুস্তকে কখনো উঠে আসেনি, অমিতাভ ঘোষ ব্যাপারটিকে (তাঁর অন্যান্য বই এর মতই) গভীর ও উপর্যুপরি অনুসন্ধান করে তুলে এনেছেন কঠিন বাস্তবের রেখায় । আফিমের এই ব্যবসায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যে লাভ করছিল, তা একক ভাবে আর অন্য কোনো ব্যবসা থেকে করতে পারেনি । বিনিময়ে তারা চীনের রেশম, রুপো, আর চা আমদানী করছিল ।
কিন্তু এই অবাধ মুনাফায় বাধ সাধছিলো চীন – বলা উচিত সাধারণ মানুষ । নেশা হিসেবে এই ভয়ংকর জিনিসটির আমদানী কিন্তু স্বয়ং ব্রিটেনে খুব সন্তর্পনে, খেয়ালের সঙ্গে, সীমাবদ্ধতা রেখে করা হত। কিন্তু উপমহাদেশে আফিমের ব্যবহার ও প্রচার ছিল অবাধ। ওষুধ হিসেবে বা চিকিত্সা শাস্ত্রের বাইরে এর ব্যবহার সাধারণ মানুষের চেতনার ওপর এক ভয়াল থাবার মত এসে পড়েছিল। আফিম শ্রমিকদের জীবন ছিল দুর্বিষহ। গল্পে এক জায়গায় এই কারখানার যুতসই বর্ণনা দেয়া আছে ।
চীনে এই আফিম ব্যবসা বন্ধ করার চেষ্টা যখন করেছে, ব্রিটেইন সেটা মেনে নিতে না পেরে ঘোষণা দিয়েছে, ‘ন্যায় যুদ্ধের’ । ‘জিজাস ক্রাইস্ট ইজ ফ্রি ট্রেইড’ – এই ভয়ঙ্কর মন্ত্র শুনি তখনকার বেনিয়া ব্রিটিশ বেনিয়ার মুখে — কথাটা গাল্পিক নয় শুধু — এরকম উক্তির নজির আছে ইতিহাসে ।
অমিতাভ ঘোষের পরবর্তী এক সাক্ষাতকারে এই গল্পকে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক-হামলার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়েছে । ঘোষ অবশ্য জানান, ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার সময় কিছু সমান্তরাল ঘটনা আসবেই – কাজেই প্রতিতুলনা তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল না ।
আফিম ব্যবসা কিছুটা মার খেয়ে গেলে, ব্রিটিশ বেনিয়া শুরু করে স্বস্তা শ্রম পাচার । ক্রীতদাস পাচার আইন করে বন্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সে সব নিয়মের মুখে ছাই ঢেলেই ভারতের মজুরদের ধরে পাচার করে দেয়া হয় বিভিন্ন জায়গায় ।
আফিমের এই চাষ ভারতীয় উপমহাদেশের কিছু দরিদ্র মানুষের জীবনে কেমন ভাবে রেখাপাত করেছিল? তার ছবি পাই, এই বই-এর নানা চরিত্রের বহুল বিচ্ছুরণে ।
উত্তর বিহারের গাজীপুরের কাছে এক গ্রাম; দীতি এক জন আফিম শ্রমিকের স্ত্রী, ভোজপুরী, স্বামী আফিমেই নিমজ্জিত, তাদের শারীরিক কোনো সম্পর্ক তৈরী হয়না, বরং বংশবিস্তারের নামে বিয়ের রাতেই সেই গৃহের মুরুব্বিদের সাহায্যে স্বামীর ছোট ভাই দীতিকে আফিম-খাওয়ানো, ঘুমন্ত অবস্থায়, ধর্ষণ করে ।
যার জীবনের শুরু এমন, সেই মেয়ে কি ভাবে তার প্রতিবন্ধকতাকে বুদ্ধি আর অসীম সাহস দিয়ে জয় করে? গায়ে কাঁটা দেয়া সে বর্ণনা ।
স্বামী অসুস্থ হয়ে শয্যা নিলে, দীতির ঘরে জোঁকের মত ছেঁকে ধরে তার দেবর — ইচ্ছে, দীতি তার রক্ষিতা হিসেবে বাকি জীবন কাটাবে । উপায়ন্তর না পেয়ে দীতি কন্যাকে তার মামার বাড়ি পাঠিয়ে নিজে মৃত স্বামীর সঙ্গে এক আগুনে পোড়ার সিদ্ধান্ত নেয় । কিন্তু আকস্মিক কিছু পরিবর্তন হয় তার জীবনে, অভিনব, চমকপ্রদ, আবার একই সঙ্গে উত্তাল, বিভীষিকাময় ।
আইবিস জাহাজটি আফিম-বস্তি-ঝেটানো দীতি এবং তাকে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে উদ্ধার করা নিরীহ শ্রমিকসহ বহু পলাতক, ভুঁই-হীন, নিরাপত্তার অভাবে জর্জরিত মানুষকে গ্রহণ করে, মরিশাস বা মরিচদ্বীপে গির্মিটিয়া বা সাদা অর্থে ক্রীতদাস হিসেবে চালান করার জন্য।
আইবিস যখন হুগলিতে নোঙ্গর গাঁড়ে, এই জাহাজ কে দূরে নদীতে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় দীতি। জাহাজের নোঙ্গর ভেড়ানো অবস্থাটা গল্পের চরিত্রদের ভারসাম্য দিতে, বুনে তুলতে সাহায্য করে :
আছে এক অবস্থাপন্ন বলে পরিচিত কিন্তু আসলে পড়ন্ত, শিক্ষিত বাঙালী জমিদার নীলরতন হালদার, তখনকার সমাজের আয়েশী জমিদারের মত তার এক নৃত্য-পটিয়সী রক্ষিতা আছে | ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্ণধার বেনজামিন বার্নহাম তারই জমি নিয়ে সেখানে আফিম চাষ করছে বহু বছর ধরে ।
নীলের অপরিপক্বতা ও অবিবেচনার সুযোগ নিয়ে বার্নহাম ও তার বাঙালি সহযোগী গোমস্তা নবকৃষ্ণবাবু , কৌশলে তাকে আইনগত জটিলতায় ফেলে তাকে আলিপুর জেলে পাঠায়, এবং অতঃপর তাকে ও আরেকজন কয়েদীকে ৭ বছরের নির্বাসনে মরিশাস পাঠানো হয় – একই আইবিস জাহাজে ।
নবকৃষ্ণ বাবু, ওরফে বাবু নব কিসীন, একজন অতি ধুরন্ধর ব্রিটিশ ভৃত্য – কিন্তু এই গল্পে তার কিছু অভিনব অবদান আছে যা ঘটনা পরম্পরাকে বেশি হাস্যরস এবং চমক জোগায় ।
আরো আছে পাওলেট – বা পাগলী । এই মেয়েটি শ্বেতাঙ্গিনী, কিন্তু তার ধাইমা, জন্ম থেকে শুরু করে যার কোলেপিঠে সে মানুষ হয়েছে, একজন বাঙালি । পাওলেট বড় হয়েছে নানা ভাষা শিখে, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের নানা দিকে পড়াশুনো করে। তার বাবা এক মুক্তমনা বৈজ্ঞানিক । তিনি সম্পূর্ণ নিবেদিত সত্যের কাছে। তিনি নাস্তিক । কন্যাকে তিনি সেই ভাবেই মানুষ করেছেন । স্বভাবত এঁদের সন্দেহের ও ইষত অনুকম্পার চোখেই দেখে ভারতে বসবাসরত ব্রিটিশ উন্নাসিক, ‘ভদ্র’ সমাজ ।
বাবার মৃত্যুর পর সপ্তদশী পাওলেট, ছেলেদের সঙ্গে সহজে পাল্লা-দিয়ে-ডানপিটেমি-করতে-পারা এই খাপছাড়া, বুদ্ধিমতী মেয়েটির স্থান হয় অবশেষে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্ণধার বেনজামিন বার্নহাম-এর গৃহে। পাগলী যে সময়টা এদের চালচলন রপ্ত করার চেষ্টা করছে গৃহকর্ত্রী কে খুশি করার জন্য, ঠিক সেই সময় মিঃ বার্নহাম তাকে দিচ্ছেন ভয়াবহ বাইবেল শিক্ষা – যেটা এক ধরনের যৌন অভিযানে পরিণত করেন তিনি ।
পাঠক কৌতুক ভরে লক্ষ্য করবেন, এই একই প্রতাপশালী বার্নহাম যখন চীন-ভারত-ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সর্বত্র তার ছড়ি ঘোরাচ্ছেন, এমন একটি অকাট্য ধার্মিক, পাঁড় ক্যাথোলিক অবস্থান থেকে যখন তিনি বলছেন তিনি বাইজিদের নাচ দেখেন না, সেই লোকটি-ই একটি সপ্তদশী সম্পূর্ণ নিষ্পাপ তরুণীর সাহায্য নিয়ে (পাওলেটকে তাকে জুতো দিয়ে মারতে বলে), বাইবেল শিক্ষার ‘শাস্তি’ শেখানোর নাম করে, যৌন আবেদনে মাথা নীচু করে মাটিতে সারমেয়র মত উবুড়, নূব্জ হয়ে পড়ছেন ।
নিরুপায় পাওলেট ত্রাসে বাড়ি ছাড়ে — সেও এক অভাবনীয় উপায়ে মিশে যায় আইবিসের ‘গির্মিটিয়া’ বা ক্রীতদাসের দলে, কাউকে না জানিয়ে।
এই দলে ভেড়ে আরো নানা রঙের ও কলেবরের মানুষ । সব কিছুর মধ্যে গির্মিটিয়াদের জীবনের উদ্বেগ, অস্থিরতা, মানবেতর জীবনযাপনের মধ্যে আত্মীতার, মানবিকতার ঢেউ । আছে জাহাজের পাইলট, ফার্স্ট মেট, সেকেন্ড মেট, আর জাহাজের সেপাইরা ।
এক লেখায় অমিতাভ ঘোষের এই উপন্যাসে ঘটনা প্রবাহর নাটকীয়, সুপরিচালিত মোড় ফেরাকে আলেকজান্ডার দুমার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, তার গভীরে যাওয়ার ক্ষমতা, তলস্তয়ের সঙ্গে, আর এই লেখকের পক্ষে দুর্লভ, কিছু আর্দ্র, দ্রব, আবেগ-ঘন চিত্রায়ন, ডিকেন্সের সঙ্গে ।
নারী চরিত্র গুলির বিকাশের দিকে অমিতাভ যেভাবে মন দিয়েছেন, তা হয়ত তাঁর অন্যান্য বেশির ভাগ উপন্যাসে ততটা দেন নি । সব স্তরের মানুষ আছে এই উপন্যাসে, আর তারা আশ্চর্য ভাবে কাছে আসে, মিশ খেয়ে যায় । সহজ ভারসাম্যগুলি ভেঙ্গে পড়ে, মানুষের জীবন ছিটকে যেতে থাকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপে, বেঁচে থাকার দায়ে । আশ্চর্য, একে পুরনো বিষয় মনে হয় না । যেন সাম্প্রতিক কালের একটি খন্ড চিত্র ।
এছাড়া শিহরণ জাগে আরেকটি বিষয় – প্রত্যেক চরিত্রের বাচন, কথাবার্তা, হুবহু যেন সেই সময়ের সেই শ্রেণীকে, সেই চরিত্রটিকে মোক্ষম ভাবে ধারণ করে । ভোজপুরি গান অনেক আছে, মূল এবং অনুদিত । জাহাজের খালাসীদের কথাবার্তা একরকম, শিক্ষিত পাওলেটের আরেক রকম, আবার নীলরতন হালদার, যিনি কিনা পুঁথিগত বিদ্যায় খুবই পারদর্শী, তাঁর কথ্য ভাষাও খুব অভিজাত ও ভিন্ন স্বাদের । কথ্য ভাষার হেরফেরগুলি চরিত্রে প্রাণ আনে – আর যেমন লেখক জানান, চরিত্রই উপন্যাস কে এগিয়ে নিয়ে যায় ।
নারী চরিত্রগুলি এখানে সমুন্নত, পথ দেখায় এরাই, ভয় ভাঙ্গায় এরাই, দীতির দ্বিতীয় স্বামী, ভালবাসার মানুষ, মাটির মত শান্ত, বীর কালুয়া ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো পুরুষ চরিত্র দেখা যায় না, যারা এইরকম নিষ্কম্প, স্বচ্ছ বীর্যের অবস্থান নিতে পারে ।
বইটির তৃতীয় অংশ অর্থাত ‘সমুদ্র’-এ নানা ধরনের ঘাতপ্রতিঘাতে একটি ক্লাইম্যাক্স তৈরী হয় । মজা নষ্ট করা উচিত না ভেবে, উহ্য রাখা গেল । আর সমাপ্তি — আরো অভিনব । প্রাণভয়ে পালানো দীতি ও কালুয়া কি শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাবে? সমুদ্র, মৃত্যু কি ছোঁবল মারবে ? হঠাত করেই যেন পর্দা পড়ে যায় – স্বভাবতই পাঠকের মনে কৌতুহলী প্রশ্ন জাগে, এর পর, কি?!