প্রায়-অসাধারণ স্ক্রিপ্ট, কিছু কিছু জায়গায় ঝকমকে পরিচালনা, কিছু কঠিণ ও অত্যন্ত তীব্র মুহূর্ত সৃষ্টি করা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি ছবি নদীর নাম মধুমতী | পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল|
বাংলাদেশ নিয়ে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি যতই আর্দ্র ও আশাবাদী হোক না কেন, চলচ্চিত্রে আমরা যে পিছিয়ে আছি, এই দুঃখ আমি কোনো সহজ আপ্ত-বাক্যে ভুলতে পারিনা | পিছিয়ে থাকার কারণ বহুবিধ থাকতে পারে, তবে কিছু আবশ্যক কারণ সম্ভবত শব্দ-কারিগরী ও সঙ্গীত পরিচালনার জায়গায় খামতি, অন্তত, এই ছবি দেখে সেই কথাই মনে হয় |
সত্যজিত রায়র পথের পাঁচালি-র সঙ্গে কোনো ছবির তুলনা করা উচিত হয়ত হবে না, কারণ সম্ভবত তা এক ধরণের বাড়াবাড়ি বলেই গণ্য হবে | কিন্তু তা না করলেও, আমরা মনে রাখতে চাইব, পথের পাঁচালিকেই আমরা আমাদের মানদন্ড মনে করি | কারিগরী শৈলীর অপ্রতুলতার মধ্যেই সেই ছবি আত্ম-প্রকাশ করেছিল প্রায় আধা-শতাব্দী আগে | কারিগরী যে চলচ্চিত্রের মান নির্ধারণ করেনা, এটি বোধহয় সে কথারই প্রমাণ | Charlie Chaplin এর ছবি গুলিও সেই মতন — আজকের দিনে ব্যবহার হয় না এমন অনেক কারিগরী ব্যবহার করে, যে মানের ছবি নির্মণ করেছেন তিনি, তা অনুকরণ করাও কঠিন |
পৃথিবীতে যে চলচ্চিত্র তৈরী হয়, তার মধ্যে সেরা ছবিগুলির সঙ্গে মিলিয়ে দেখার মত ছবি তৈরী হয়েছে বাংলা ভাষায় | যে শিল্পময়তা এসব ছবিতে আমরা লক্ষ্য করি, সেই স্তরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকেও দেখতে চাইব আমরা | তাই সহজে সন্তুষ্ট না হতে পারা, এক অর্থে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সম্পর্কে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও শ্রদ্ধারই নামান্তর |
Material বা কাহিনীর বিষয়বস্তুর দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধ যে কত শক্তিশালী, তা বলাই বাহুল্য | কথক বা narrator হিসেবে পরিচালক বেশ পরিচ্ছন্ন ভাবে, সুনির্দিষ্ট ভাবে, বাড়তি ভাবাবেগ বর্জন করে সংক্ষিপ্ত ও সহজ সংলাপ ব্যবহার করেছেন | এই গুণ সত্যজিত রায়র ছবিতে আমরা বারবার দেখি | বাংলাদেশের নাট্য-জগতে এহেন ভালো সংলাপের কোনো অভাব দেখা যায় না | অথচ, বাংলাদেশের সিনেমায় যার অভাব বলে আমরা জানি |
গল্পের শুরু শেখ মুজিবের ৭ মার্চএর ভাষণের দিকে | শেষ অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে | এক মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের হাতে তার সত-পিতা (মুসলিম লীগ করেন এবং পারে এক হিন্দু শিক্ষাবিদকে খুন করার পর তাঁর কন্যাকে অপহরণ করেন)-র মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে | গল্পের এই irony কি বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস তুলে ধরে?
অভিনয়ে যাঁরা আছেন, তাঁরা বাংলাদেশের টিভি এবং থিয়েটার-এর হাড়পাকা অভিনেতা | তৌকির আহমেদ, রাইসুল ইসলাম আসাদ, আলী জাকের, আবুল খায়ের, রামেন্দু মজুমদার, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, সারা জাকের ইত্যাদি প্রায় পুরো অভিনয়ের দলটি আন্তর্জাতিক মানের অভিনয় নিয়ে হাজির | যদিও খুলনার আঞ্চলিক কথোপকথনে অতটা পারদর্শী মনে হয়না সকলকে | তবু কোথাও-কোথাও সংলাপের সংক্ষিপ্ততা ও ব্যঞ্জনার তীক্ষ্ণ ধার দর্শককে বিশেষ নাড়ায়, এতে সন্দেহ নেই |
সঙ্গীত পরিচালনায় পথের পাঁচালীর কোনো তুলনায় হয়না | তবে সকলে মানবেন, রবি শঙ্কর যা করতে পারেন, সেটা আর কজন পারেন? তবে বাংলাদেশের সিনেমায় তারেক মাসুদ তাঁর মুক্তির গান এ যথেষ্ট শক্তিশালী শব্দ-কারিগরী ও background music এর অবতারণা করেছেন |
তানভীর মোকাম্মেল কিন্তু পরিচালনার দিক থেকে অনেক উঁচু মেধার পরিচয় দিয়েও সেই শব্দ আর সংগীতের দিককে ওতটা গুরুত্ব দেননি | সমস্ত দেশাত্মবোধক গানই আছে এখানে, ও আমার দেশের মাটি থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলা বেতার এর রক্ত-উস্কে দেয়া গানগুলি — পূর্ব দিগন্তে, একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে, জয় বাংলা, তীরহারা এই ঢেউ-এর সাগর, ইত্যাদি | অথচ একটি গ্রামীণ বাউল গান ছাড়া, ছবিটির বাদবাকি অংশে এর background music যেন ছবিটির সর্বনাশ ঘটায় | অর্থাত বাদ্যশিল্পী এবং বাদ্যযন্ত্রের বাছাই যেন যুতসই হয়না, সুর এবং প্রয়োগে খামখেয়ালিপনা দেখা যায়, শব্দের কোনো সঠিক নিয়ন্ত্রণ দেখা যায়না, এবং সুর প্রায়শ ছবির তত্কালীন আধারের সঙ্গে মেলেনা | যেমন সেতারের ওপর যে সুর উত্তেজনা ও আনন্দের একটি অভিব্যক্তি আনে, সেই সুর প্রয়োগ করা হয় একটি বিপদ বা উত্কন্ঠার পরিস্থিতিতে | অভিনয়শিল্পী এবং পরিচালকের সুযোগ্য দক্ষতার ওপর এটি জল ঢেলে দেয়ারই শামিল | পরিস্থিতির অভিব্যক্তির সঙ্গে শব্দ প্রয়োগের যে অঙ্গাঙ্গী ব্যবহার, এই বিষয়ে সচেতনতার অভাব দর্শককে আশাহত করে |
আলোক-সম্পাতের জায়গায়ও বোধ করি খামতি দেখা যায় | Mood কে ফুটিয়ে তলার জন্য যে ধরনের আলোর প্রয়োজন, তা যেন ছবিটি দেখাতে পারেনা | এই ক্ষেত্রে বেশির ভাগই outdoor shooting — তাই সময় এবং নিসর্গের বৈচিত্র আছে. ভোর, সন্ধ্যেবেলা, বর্ষা, ইত্যাদি বিভিন্ন পটভূমি আসলেও সেই পটভূমি জীবন্ত হয়ে ওঠে না | অথচ যে গল্পটি বলা হচ্ছে, তা প্রায় সম্পূর্ণই প্রকৃতিনির্ভর এবং অবশ্যই বিশেষ ভাবে নদীকেন্দ্রিক | এই ছবিই আরো দক্ষ কেমেরা ম্যান এবং শিল্পপরিচালোকের হাতে cinematography তে বিশেষ অবদান রাখতে পারত — তার সুযোগ যে ছিল এটা বোধহয় বলা যায় | আকাশে মেঘ, বহমান নদী, ধানক্ষেত, নদীর বুকে নৌকো, সুর্যাস্ত, বাঁশবন, আকাশে পাখি, সবই আছে, অথচ বাংলাদেশের প্রকৃতির মায়াবী আবেদন, কাব্য, বর্ণাঢ্যতা যেন পাওয়া যায়না | যদি যেত, তবে ছবিটির এই নামকরণ সার্থক মনে হত |
এই প্রসঙ্গেই মনে হয়, “দেশ” কাকে বলে, এই প্রশ্ন যখন গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধা আরেকজন কে করে, তার উত্তর হয়ত আরেকটু অর্থবহ, আরেকটু গভীর ও অনুভূতিময় করার সুযোগ — যেন হেলায় হারানো হয় |
সিনেমাটোগ্রাফির ক্ষেত্রে খামতি থাকলেও, ফটোগ্রাফিতে বাংলাদেশ যে সত্যি পিছিয়ে আছে, এমন মনে হয়না. বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানের still photography র জন্ম দিচ্ছে | তারেক মাসুদের মাটির ময়নাতে সিনেমাটোগ্রাফি খুবই উঁচু মানের | তাই শেষ পর্যন্ত আমার জন্য এটি বিশ্বাসযোগ্য নয় যে মুন্সিয়ানার দিক থেকে আন্তর্জাতিক মানের একটি team জড়ো করে দর্শকদের বিচারে উতরে-যাওয়া ছবি বাংলাদেশে তৈরী করা অসম্ভব | আর মুক্তিযুদ্ধ যদি ছবির বিষয়বস্তু বা আধার হয়, তবে সত্যি বলতে কি, সেই রকম ফিল্মিক সত্যি গল্পের এবং স্মৃতিচারনের কোনো অভাব নেই | এর জন্যে fiction এর প্রয়োজন হয়না |