চট্টগ্রাম শহরের সংস্কৃতিচর্চার ঐতিহ্য খুব প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে এর মধ্যে যথাযথ পরিকল্পনা, পেশাদারিত্ব, ধারাবাহিকতা, সর্বোপরি মান-নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি কখনো। পাশাপাশি এটাও প্রবলভাবে সত্য যে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতার চর্চার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের একত্রে মিলবার, ভাব বিনিময় করবার, সাদা বাংলায় স্রেফ ‘আড্ডা’ দেবার অনুকূল কোনো স্বাস্থ্যকর, রুচিশীল পরিসরও এই শহরে গড়ে ওঠেনি তেমন। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ শিল্পকলা একাডেমির মাঠে, কেউ চেরাগির মোড়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে, কেউ বিশদ বাঙলা-য় কেউ-বা বাতিঘরে যার যার মত গল্পগাছা করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান। কিন্তু এভাবে তো আর সৃজনশীল মানুষদের পরস্পরের কাছাকাছি আসা, চেনা-জানা, অভিজ্ঞতা বিনিময় ও গঠনমূলক আলাপ-সংলাপের খুব দরকারি সংস্কৃতিটি গড়ে উঠতে পারে না। ফলে বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমের চর্চাকারী ও তার ভোক্তাদের মধ্যে দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা ক্রমে আরো পরিব্যাপ্ত হয়, আর তার ফাঁক গলে অনুপ্রবেশ করে অহংকার ও অজ্ঞানতা, নিরাশা ও নির্বেদ, হতাশা ও হীনমন্যতার মত নেতিবাচক বিষয়গুলো যাতে প্রকারান্তরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিল্প ও শিল্পী। তার প্রভাব পড়ে আমাদের বৃহত্তর সমাজে ও সংস্কৃতিতে।
আমরা এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এই শহরে এমন একটি স্থাপনা নির্মাণ করতে চাই যেখানে সংবৎসর সুচিন্তিত পরিকল্পনা মাফিক, পেশাদারিত্ব ও উচ্চমান বজায় রেখে নিয়মিত ভিত্তিতে নানাবিধ শৈল্পিক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হবে। সেখানে বছরের প্রতিটি দিন কোনো-না-কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের — হোক সেটা কোনো চিত্র, আলোকচিত্র কিংবা চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নয়তো কোনো গানের আসর কী নৃত্যানুষ্ঠান, শ্রুতিনাটক কী মূকাভিনয়, সাহিত্যপাঠ কী শিল্প-বক্তৃতা — আয়োজন থাকবে। শহরের শিল্পানুরাগী নাগরিকবৃন্দ এবং বেড়াতে বা কাজ করতে আসা পর্যটকদের পাশাপাশি স্থানীয়, দেশি, বিদেশি শিল্পীদের আনাগোনায় আর তাঁদের শৈল্পিক তৎপরতায় সেখানে বছরজুড়ে বিরাজ করবে এক আনন্দঘন শিল্পমুখর পরিবেশ।
পাশাপাশি দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে সন্ধ্যায় সেখানে শিল্পী ও শিল্পরসিকেরা আসবেন শিল্পের সান্নিধ্যে দু’দণ্ড জিরিয়ে নিতে, অন্তরঙ্গ চা-খানায় বসে বন্ধুসান্নিধ্যে গলা ভিজিয়ে নিতে হরেক রকম দেশীয় শরবতে। তাঁরা প্রাণভরা আড্ডায় মেতে উঠবেন শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, প্রেম, পরিণয় ইত্যাকার জগতের তাবৎ বিষয়ে। এরই মাঝে এক ফাঁকে লাগোয়া বইঘর থেকে তারা সংগ্রহ করে নিতে পারবেন সম্প্রতি প্রকাশিত কোনো আলোচিত গ্রন্থ, দুষ্প্রাপ্য সংগীত কিংবা ভুবনবিখ্যাত কোনো চলচ্চিত্র। শৌখিন কলারসিকেরাও পারবেন কেন্দ্রের নিজস্ব উপহার-বিপণি থেকে খুব সহজেই স্থানীয় কোনো শিল্পীর দুর্দান্ত একটি চিত্রকর্ম কিংবা দেশি হস্তশিল্পের কোনো নজরকাড়া নমুনাকে নিজের করে নিতে। এই শিল্পসুভগ স্থাপনাটিকেই আমরা আপাতত চট্টগ্রাম আর্টস্ কমপ্লেক্স নামে অভিহিত করতে চাইছি, যা শুরুতে মূলত একটি ছোট্ট সংস্কৃতিকেন্দ্রর আদলে গড়ে উঠলেও কালক্রমে আরও বিস্তৃত অবয়ব ও পরিসরে, বিশ্বমানের একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্পাঙ্গন বা আর্টস্ কমপ্লেক্স-এ রূপান্তরিত হবে বলে আশা রাখি।
এই লক্ষ্যে আমরা বাংলাদেশে আমাদের জানামতে এই প্রথমবারের মত আন্তর্জালভিত্তিক জনপ্রিয় ও জন-অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি ‘ক্রাউডফান্ডিং’ প্রক্রিয়ায় এই কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে আমাদের এই উদ্যোগে বিপুল সাড়াও মিলেছে।পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ পর্যন্ত পঁয়ষট্টি জন বিভিন্ন পেশা, বয়স, গোত্র ও বর্ণের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন অঙ্কের অর্থসাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে যেমন আমাদের খুব প্রিয় ও পরিচিত মানুষেরা রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন একেবারে অচেনা আগন্তুকেরাও। এঁদের সবার মধ্যে একটিই সাধারণ সূত্র: এঁরা প্রত্যেকে শিল্পকে ভালোবাসেন এবং বিশ্বাস করেন একটি শহর তখনই বাসযোগ্য ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে যখন সেখানে একটি সুস্থ ও সুন্দর শিল্পচর্চার আবহ বিরাজমান থাকে। আসুন আমরা সবাই মিলে আমাদের এই শহরটিকে আরেকটু সুন্দর, আরেকটু স্বাস্থ্যকর ও শিল্পমণ্ডিত করে গড়ে তুলি; যথাসাধ্য হাত লাগাই আমাদের স্বপ্নের শিল্পাঙ্গন তথা চট্টগ্রাম আর্টস্ কমপ্লেক্স নির্মাণের শুভ কর্মযজ্ঞে। নিচের সংযোগটিতে এই বিষয়ে আরও বিশদ ব্যাখ্যা, বিবরণ এবং এতে আপনার অংশগ্রহণের প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে: http://goo.gl/dsAHVH।