আমরা চেয়েছিলাম এই বাংলার আকাশে চাঁদতারা নয়; বরং লাল-সবুজের একটি পতাকা মাথা উঁচু করে উড়বে। এই পতাকাটির জন্য আমরা বছরের পর বছর ধরে সংগ্রাম করেছি। অবশেষে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ৪ লাখ মা-বোনের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে লাল-সবুজের এই পতাকাটি আমাদের হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে একটি পতাকার জন্য এমন চরম মূল্য দেয়ার নজির দ্বিতীয়টি নেই।
আমাদের মুক্তির যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি। কিন্তু আমাদের পতাকা, আমাদের জাতীয় পরিচয়, আমাদের অস্তিত্বের বিপরীতে অবস্থান নেয়া একাত্তরের পরাজিত শক্তি বসে নেই, তারা এখনো সক্রিয়। এই ২০১০-এও মুক্তিযোদ্ধার নামে ঢাকার রাস্তার নামকরণ করা হলে পাকিস্তান তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায় (১)। এই ২০১৩তেও বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি দিলে সেটার বিরুদ্ধে নিন্দাপ্রস্তাব ওঠে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে! (২) তাদের এদেশীয় এজেন্টরা এখনো কুষ্টিয়া-পাবনায় শহীদ মিনার ভাঙে, তারা এখনো চাঁদপুরে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় আগুন দেয়। চাঁদতারা মার্কা যে-পতাকাটিকে আমরা ৩০ লাখ জীবনের বিনিময়ে প্রতিস্থাপন করেছি লাল-সবুজের পরিচয় দিয়ে, এই স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বসে এখনো তারা সেই পরাজিত পাকিস্তানের পতাকা উঁচিয়ে উল্লাস প্রকাশের কোনো সুযোগই হাতছাড়া করে না।
চাইলেই কি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পোড়ানো যায়? চাইলেই কি ভিনদেশের, বিশেষ করে যে-পতাকার বিরুদ্ধে আমাদের রক্ত ঝরেছে, সে-পতাকা নিয়ে উল্লাস করা যায়? বাংলাদেশের পতাকা আইন (৩) অনুসারে এটা করা অপরাধ। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা কীভাবে, কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে, তা স্পষ্টভাবে বলা আছে পতাকা আইনে। এই ক্ষেত্রগুলো ছাড়া পতাকা যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা যাবে না। আর অন্যান্য সব দেশের মতোই বাংলাদেশের মাটিতেও খুবই সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্র ছাড়া বিদেশের পতাকা ব্যবহার করা যাবে না।
বাংলাদেশের মাটিতে বিদেশের পতাকা ওড়ানোর এই ক্ষেত্রগুলো সেসব দেশের দূতাবাস ভবন, তাদের রাষ্ট্রপ্রধান ও মন্ত্রীদের গাড়িতে বাংলাদেশে সফরকালে ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে কোথাও বিদেশি জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে হলে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ অনুমতির দরকার হবে। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আইন অনুসারে,
“Except as stated in the above Rules, the flag of a Foreign State shall not be flown on any car or building in Bangladesh without the specific permission of the Government of the People’s Republic of Bangladesh.”
(People’s Republic of Bangladesh Flag Rules, article 9.IV)
সুতরাং কারো ইচ্ছা হলেই বিদেশি পতাকা গায়ে জড়িয়ে বাংলাদেশের স্টেডিয়ামে, বাংলাদেশের রাজপথে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ কিংবা ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান দেবে, এটা আইনত অপরাধ।
বাংলাদেশের মাটিতে আমরা ৩০ লাখ বাঙালির খুনিদের পতাকা হাতে ‘নামে বাংলাদেশের নাগরিক, কামে মনেপ্রাণে পাকিস্তানি’ এজেন্টদের উল্লাস দেখতে চাই না। আমরা ফেলানি হত্যার ন্যায়বিচার পাইনি। ফেলানির রক্তে ভেজা বাংলাদেশের মাটিতে আমরা ভারতের পতাকা হাতে ভারতপ্রেমীর উল্লাস দেখতে চাই না।
আমরা এমন দেশে বাস করি যেখানে চাঁদে সাইদীকে দেখার বিভ্রমে ভোগে শত শত মানুষ, জামায়াতে ইসলাম আর ইসলামকে গুলিয়ে প্রোপাগান্ডা চলে হরদম। ’খেলায় রাজনীতি মেশাবেন না’ তত্ত্বকে প্রচার প্রসারে খেলার পাতার দুই-তৃতীয়াংশ পাকি বন্দনায় মত্ত হয় সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক প্রথম আলো। খুব সূক্ষ্মভাবে ‘রিকনসিলিয়েশন থিওরি’র আড়ালে পাকিপ্রোপাগান্ডা চালায়, ভাষা আন্দোলন নিয়ে দুনিয়া কাঁপানো ত্রিশ মিনিটের কর্পোরেট ভণ্ডামি করে, উর্দু শিরোনামে সংবাদ ছাপে, “সব ম্যাচ কা বাপ” (৪)! স্বাধীনতার মাসে, বাঙালি জাতির গণহত্যার মাসে মিরপুর স্টেডিয়ামে পাকি পতাকা হাতে বাংলাদেশের শত্রুর উল্লাসের বিষবাষ্প ভেসে যায় মিরপুর বধ্যভূমির বাতাসে।
আমরা আশা করি, বাংলাদেশের আলো-হাওয়ায় বড়ো হওয়া এই কুলাঙ্গারদের অনেকেই একদিন ভুল বুঝতে পারবে, তারাও পাকিস্তানি কিংবা ভারতীয় না হয়ে বাঙালি ও বাংলাদেশি হওয়াকেই গৌরবের মনে করবে। কিন্তু কবে তাদের সেই চেতনার জন্ম হবে, সেজন্য অপেক্ষা করে করে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও দেশের সার্বভৌমত্বকে পদদলিত হতে দেয়ার কোনো যুক্তি নেই। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো ছাড় নেই। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা এ ছাগুপনা প্রতিরোধের এখনই সময়।
এক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বাংলা কমিউনিটি ব্লগ অ্যালায়েন্স-এর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারকে অবশ্যই অন্তত নীচের যৌক্তিক কাজগুলো করতে হবে:
১। জাতীয় পতাকা আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে এবং এ আইন লঙ্ঘনকারীদেরকে আইন অনুযায়ী শাস্তি দিতে হবে।
২। বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে বাংলাদেশের মাটিতে অন্য দেশের পতাকা নিয়ে উল্লাস করাকে পতাকা আইনের পাশাপাশি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ববিরোধী কার্যকলাপ হিসেবে চিহ্নিত করে স্পষ্ট আইন প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন করতে হবে।
৩। পতাকার এই উন্মাদনা প্রধানত দেখা যায় বাংলাদেশের ক্রিকেট স্টেডিয়ামগুলোতে। বর্তমানে আইসিসি-র নির্দেশ অনুযায়ী দর্শক সাথে করে অস্ত্র ও ঝুঁকিপূর্ণ দ্রব্যের পাশাপাশি ব্যাঙ্গাত্মক পোস্টার বা ব্যানার নিতে পারে না। বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিনদেশের জাতীয় পতাকাকেও এই তালিকায় যোগ করা হোক।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৩ comments
shorgorom - ৬ মার্চ ২০১৪ (৫:২৬ অপরাহ্ণ)
আসন্ন ফুটবল বিশ্বকাপ বিষয়ে ব্লগ অ্যালায়েন্স-এর কি মতামত? এই বিষয়ে কোন পরিষ্কার কথা নেই এখানে। অন্তত ১৯৯০ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলার মানুষ ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার ফ্ল্যাগ উড়াচ্ছে – এটা স্রেফ তাদের আবেগ উদ্দীপনার প্রকাশ। এতে তাদের দেশপ্রেমের কোন ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে বলে মনে হয় না। আর যদি ছাদের উপরে ব্রাজিলের ফ্ল্যাগ উড়ানো ব্লগ অ্যালায়েন্স-এর কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়, তাহলে তাদের মতামতকেও অনেকের কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হতে বাধ্য। এটা দেশপ্রেমের কোন মানদন্ড হতে পারে না।
ইস্যুগুলো এখানে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। মূল সমস্যাটা ছিল ম্যারি মি আফ্রিদি মার্কা পাকি ফ্ল্যাগ উড়ানো বেইমানদের নিয়ে। মূল ইস্যু সেই গাদ্দারী। সেটা রুখতে গিয়ে এই রকম ঢালাও নীতিমালা কোন সমধান নয়। ম্যারি মি-দের প্রতিরোধ করতে সুনির্দিষ্ট নিয়মের কথা চিন্তা করা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক খেলার একটা ভেন্যু। ধরেন, অস্ট্রেলিয়া সাউথ আফ্রিকার কোন ওয়ান-ডে ম্যাচ মিরপুরে হলো। সে দেশের সাপোর্টাররা যদি মাঠে ফ্ল্যাগ নিয়ে আসে, তখন কি হবে? তাদের থেকে ফ্ল্যাগ কেড়ে নিয়ে বলা হবে, এখন ভেতরে যেতে পারো?
এইসব বিষয় নিয়ে তেমন ভাবনা-চিন্তা না করে এমন একটা স্টেটমেন্ট দেয়া অপরিপক্কতার পরিচায়ক। এই বিষয়গুলো পরিষ্কার করে খোলাসা করা প্রয়োজন।
রায়হান রশিদ - ৭ মার্চ ২০১৪ (৫:৪৮ অপরাহ্ণ)
@Shorgorom,
একটু সরলীকরণ হয়ে গেল মনে হয়। ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার ক্ষেত্রে কি বাংলাদেশের মাটিতে কোন গণহত্যা আর ধর্ষণের ইতিহাস জড়িত? সাম্প্রতিক ঘটনাবলির দিকে নজর রাখছেন এমন সবার কাছে বিবৃতিটির উদ্দেশ্য যথেষ্ট স্পষ্টই হওয়ার কথা। ব্লগ এলায়েন্সের বিবৃতিটি আসলে কাদের উদ্দেশ্যে, কিংবা এর অন্তর্নিহিত বক্তব্য বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা না। অল্প কয়েক শব্দে লেখা এটা একটা সাধারণ বিবৃতিমাত্র; ‘অথচ, কিন্তু, ব্যতিক্রম’ ইত্যাদি ধারণাসম্বলিত বিস্তারিত কোন অভিসন্দর্ভ নয়। আশা করছি আইন প্রণেতারা (যদি তারা এ ধরণের দাবীকে আমলে নেন) নিশ্চয়ই নিজেদের বিবেচনা এবং প্রজ্ঞা ব্যবহার করে সঠিকভাবেই দাবীটিকে বুঝে নেবেন, সাধারণ ‘নির্দোষ সমর্থকদের’ কথা মাথায় রেখেই।
অফটপিক:
প্রতীক পতাকা মানুষ নিজ নিজ পছন্দমতো ব্যবহার করবে, তাতে কার কি বলার আছে – আপাত দৃষ্টিতে এই উদারবাদী অবস্থানের গোলমালের জায়গাটাও আমরা ধরতে পারি। হাজার উদারবাদী হয়েও ইউরোপের মানুষ এখনো কোথাও নাজিদের সস্তিকাচিহ্ন বা তার সাথে জড়িত কোন ধরণের প্রতীক-পতাকা ব্যবহার সহ্য করে না। বোধ করি তারা এখনো বাঙালীর মতো উদার আর আন্তর্জাতিকতাবাদী হয়ে উঠতে পারেনি!
[পূনশ্চ: বেনামী কারো সাথে আলাপচারিতায় অস্বস্তি বোধ করি আজকাল। আশা করি নিজের পরিচয় গোপন করবার পেছনে আপনার গুরুতর কোন কারণ ঘটেছে]
অদিতি কবির - ৮ মার্চ ২০১৪ (১০:২২ পূর্বাহ্ণ)
Use of Foreign Flags in Bangladesh.
I. ‘National Flags’ of foreign
countries can be flown on the Chancery
building (s) of Diplomatic Missions as well as on Consular Offices
in Bangladesh, Heads of Diplomatic Mission may, in addition, fly
their ‘National Flags’ on their official residence as well as on their
cars.
II. Foreign dignitaries of the following categories can fly their personal standards or the National Flags of their respective
countries, in case they have no personal standards, on the place of their residence and on their cars, on State visit to Bangladesh:
(a) Heads of States.
(b) Visiting Prime Ministers.
(c) Ministers of Foreign Governments.
III. In case, on occasions such as the National days a Foreign Mission
in Bangladesh holds as social f
unction in a place other than the
Chancery or the residence of the
Heads of the Mission, it may fly
its National Flag there, provided that the ‘Bangladesh Flag’ is
flown alongside and is accorded the place of honour.
Note
-The privileges cited in Rules above will apply only in case of those
countries which offer similar concessions to the People’s Republic of
Bangladesh on reciprocal basis.
IV. Except as stated in the above Rules, the flag of a Foreign State
shall not be flown on any car or building in Bangladesh without the
specific permission of the Government of the People’s Republic of
Bangladesh.