গত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে আমাদের এখন মনে হচ্ছে, দেশের ব্লগার-লেখকরা শুধু জঙ্গি-উগ্রপন্থীদের দিক থেকে হত্যার শিকার নয়, সরকারি দলের একাংশ ও সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকেও প্রত্যাখানের শিকার হতে চলেছেন। গত সাড়ে পাঁচ মাসে চারজন ব্লগারকে একের পর এক খুন করা হয়েছে, যে তালিকার সর্বশেষ সংযোজন নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়। এর কোনোটির তদন্তের ক্ষেত্রেই অগ্রগতি হয়নি, বরং নিলয় হত্যাকাণ্ডের পর সংবাদ সম্মেলনে উল্টো ব্লগারদের উদ্দেশ্যে পুলিশের আইজিপি বলেছেন, ‘যাঁরা মুক্তমনা লেখক, তাঁদের কাছে অনুরোধ, আমরা যেন সীমা লঙ্ঘন না করি। এমন কিছু লেখা উচিত নয়, যেখানে কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে, বিশ্বাসে আঘাত হানে।’ পাশাপাশি আওয়ামী ওলামা লীগ নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়েছে, ‘ধর্ম অবমাননাকারীদের’ মৃত্যুদণ্ড প্রদানের বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করতে হবে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা পরিষ্কার বলতে চাই, সরকারের কর্তাব্যক্তিরা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছেন এবং বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে তালগোল পাকানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। প্রথম কথা, ব্লগার নিলয়কে হত্যা করা হয়েছে দিনে দুপুরে বাসায় ঢুকে। অন্যান্য ব্লগারদের বাসায় ঢুকে না হলেও হত্যা করা হয়েছে উন্মুক্ত স্থানে, জনসমক্ষে; এমনকি লেখক-ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে পুলিশ ঘটনাস্থলেই ছিল। নিলয় গত মে মাসে থানায় গিয়ে নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করার চেষ্টা চালিয়েছেন। ব্যর্থ হয়ে তা নিয়ে ফেসবুকে বিস্তর মন্তব্য লিখেছেন। বেশ কয়েকটি ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সরকার অনলাইনের সোশ্যাল মিডিয়াগুলোকে মনিটরিং করে থাকে এবং সরকার কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করা হলে সঙ্গে সঙ্গে তা তাদের নজরদারির আওতায় নেয়। এটি অবিশ্বাস্য যে, নিলয়ের মন্তব্য তাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। অথচ কোনো ধরণের আভ্যন্তরীন বিভাগীয় তদন্ত না করেই আইজিপি বলছেন, ‘জিডি না নেয়ার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি’। বোঝাই যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের ব্যর্থতা ও কর্তব্যে-অবহেলা ঢাকার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
দ্বিতীয় কথা, দেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বিরুদ্ধে যে আইন রয়েছে, সে সম্পর্কে শুধু ব্লগাররাই নন, অনেকেই সচেতন। কেননা ব্লগারদের পূর্বে থেকেই বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন সময়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার অজুহাতে হেনস্তা করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। এটি একটি ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ, যার শিকার হতে হয়েছে একসময় এমনকি আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। যদিও মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি এত ঠুনকো নয় যে, তা খুনোখুনি বাধানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। অতীতে তেমন পরিস্থিতি বরাবরই সৃষ্টি করা হয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এবং রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার কারণেই যদি হত্যাকাণ্ড কিংবা সহিংসতার ঘটনা ঘটতো, তা হলে তা হতো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনার শামিল। কিন্তু ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ উগ্র ধর্মবাদী জঙ্গি দলের সদস্যরাই এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। অতীতের বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রেও এটা প্রমাণিত সত্য যে, তা সংগঠিত হয়েছে ধর্মীয় রাজনৈতিক ইন্ধনে। তাই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার অজুহাত একটি বাহানা মাত্র। এই মৌলবাদীরা আসলে মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছে। আর এর সবচেয়ে সোজা উপায় হলো ধর্মীয় বাহানায় কাউকে হত্যা করা এবং একই সঙ্গে আতঙ্ক ছড়ানো ও সহানুভূতি আদায় করার অপচেষ্টা করা। তারা তা-ই করছে।
তৃতীয় কথা, এ কথাও সঠিক নয় যে, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে ব্লগাররা ঢালাওভাবে আঘাত করে যাচ্ছেন। কোনো কোনো ব্লগার তাঁদের মুক্তচিন্তা চর্চার অংশ হিসেবে কখনো কখনো হয়তো ধর্মের (সেটা সব ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য) কোনো কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলে থাকেন, কিন্তু তা তাঁরা নির্দিষ্ট স্থানে এবং সামগ্রিক আলোচনার ধারাবাহিক অংশ হিসেবেই করে থাকেন। প্রকাশ্যে জনসমক্ষে হট্টগোল তুলে তাঁরা কিছুই করেন না, যার ফলে মানুষ উত্ত্যক্ত বোধ করবে কিংবা আহত ও ক্রুদ্ধ হবে। সেখানেও লেখকদের মধ্যে প্রকাশভঙ্গীর ভিন্নতা রয়েছে, যা থাকাটাই স্বাভাবিক। তেমনি পাঠকের অনুভূতির বিষয়টিও এমনই বায়বীয় যে সেখানে কে যে কিসে আহত হবেন সেটার মানদন্ডও কারও পক্ষে যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব না। এই বাস্তব প্রতিবন্ধকতার আলোকে কোনো আলোচনাকে ‘গ্রহণযোগ্য’ কিংবা ‘বর্জনীয়’ এ জাতীয় অলীক বিভাজনের বিষয়টিই অবান্তর এবং অবাস্তব। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে সে ধরণের বিভাজনের চেষ্টাটিই মূলত উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আর এখানে আমরা এই মৌলিকতম ধারণাটি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে – মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মূল কথাই হল অপ্রিয় মতামত অপ্রিয় ভঙ্গিতে প্রকাশেরও পূর্ণ স্বাধীনতা, যতক্ষণ না তা কোনো সুষ্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত নিরপেক্ষভাবে বিচারযোগ্য প্রচলিত আইনের কোনো বিধানের নিষেধের মধ্যে না পড়ে। তাই, যারা তাদের রাজনৈতিক বা অন্য কোনো হীন উদ্দেশ্যে ব্লগারদের উম্মুক্ত আলোচনা ও বক্তব্যকে খণ্ডিতভাবে যেখানে-সেখানে উপস্থাপনের মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করে – সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বরং উচিত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া। এখানে উল্লেখ প্রয়োজন – প্রতিটি ব্লগারের ব্লগেই মতবিনিময়ের জন্যে মন্তব্য আদান-প্রদানের সুনির্দিষ্ট স্থান রয়েছে, যেখানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আলোচনাকে প্রাণবন্ত রাখা যায়, যুক্তি আদানপ্রদানের মাধ্যমে সঠিক চিন্তায় উপনীত হওয়া যায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিয়ে প্রচলনের পক্ষে মত দিয়েছিলেন এবং সে-ধারণা প্রচারের লক্ষ্যে নিবেদিত হয়েছিলেন, তখন অনেকের ধর্মীয় অনুভূতিতেই আঘাত লেগেছিল। কিন্তু কেবল ধর্মব্যবসায়ীদেরই তা উন্মত্ত ও ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল। সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের সময় যখন ইসলামি পারিবারিক আইনে পরিবর্তন আনা হয় এবং এ-সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হয়, তাও অনেকের ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করে তুলেছিল। কিন্তু হিংস্র ও সহিংস করে তুলেছিল কেবল ধর্ম ব্যবসায়ীদের। এখনো উদাহরণস্বরূপ বর্তমান সরকারের শিক্ষানীতিতেও অনেকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে বলে শোনা যায়। কিন্তু সত্যিই কি বর্তমান শিক্ষানীতির মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা হয়েছে? যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ বসবাস করেন, কয়েক মাস আগে সেখানে সমকামীদের অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই বলে কি সেখানকার বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা পারবেন সরকারের নীতিনির্ধারকদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার দায়ে শাস্তি দিতে, বলতে পারবেন মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত থাকতে? আমাদের পাশের দেশ ভারতের উচ্চ আদালতেও একসময় সমকামীদের অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছিল, শুধু তাই নয়, সম্প্রতি সেখানে আদালত থেকে রায় দেয়া হয়েছে, জনকের পরিচয় ছাড়াই জননী তাঁর নিজের পরিচয়ে সন্তানকে প্রতিপালন করতে পারবেন এবং কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো অজুহাতেই ওই জননী ও তার সন্তানের মৌলিক অধিকারসমূহের চর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারবে না। ধর্মীয় অনুভূতি কি তাতে ধুলোয় মিশে গেছে? স্টিফেন হকিং যে বললেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই, সে কথা তো এ দেশের সংবাদপত্রগুলোতেও ছাপা হয়েছে, সে সংবাদ কি আমাদের ধর্মীয় অনুভূতির সীমাকে লঙ্ঘন করেছে? বাস্তবতা হলো, সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির ক্ষতকে শুভ বুদ্ধির স্পর্শ ও মুক্তচিন্তার চেতনা অচিরেই দূর করে, কিন্তু রাজনৈতিক ধার্মিকদের ধর্মানুভূতির ক্ষত কোনোদিনই সারে না, বরং তা উত্তরোত্তর অবনতির দিকেই যেতে থাকে। এই রাজনৈতিক ধার্মিকরা এত হিংস্র যে কখনো কখনো তারা নিজেরাই বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালিয়ে ব্লগারদের ওপর চাপিয়ে দেয়। অথচ এখন পুলিশের মধ্যেও ব্লগারদের ওপর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে! এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে? এর পরেও কি আমরা প্রত্যাশা করতে পারি যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্ত নিরপেক্ষ হবে? সেটা কি এখন আর আদৌ সম্ভব?
চতুর্থ কথা, এ-ও ঘোরতর উদ্বেগের বিষয় যে, সরকারি দল আওয়ামী লীগের মধ্যে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার প্রবণতা বাড়ছে এবং তাদের একটি অংশের ধর্মীয় অনুভূতি অকারণেই আহত হতে শুরু করেছে। ফলে সরকার-দলীয় কারো কারো মধ্য থেকেও ব্লগারদের অভিযুক্ত করার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। আওয়ামী ওলামা লীগ — এই একই নাম ধারণ করে সাংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছে দুটি সংগঠন; মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক ধারণা ছড়াচ্ছে খোদ আওয়ামী লীগের ভেতরেই। এই সংগঠনগুলোর সঙ্গে কয়েকজন মন্ত্রী ও দলের কেন্দ্রীয় নেতাও যুক্ত রয়েছেন। সংগঠনটি তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়কে নিজেদের সংগঠনের কার্যালয় হিসেবেও প্রচার করছে। যদিও তাদের কোনো গঠনতন্ত্র নেই এবং আওয়ামী লীগ তাদের সহযোগী সংগঠন হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় কি না তাও পরিষ্কার নয়। এদের একটি অংশ কয়েকদিন আগে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন করেছে এবং বর্তমান শিক্ষানীতিকে ইসলামবিরোধী বলেছে। তাদের মতে, পাঠ্যপুস্তকে ইসলামবিরোধী রচনা ও পাঠ্যক্রম রয়েছে, যা বাদ দিতে হবে। এরা মেয়েদের বিয়ের বয়স নির্ধারণের বিরোধিতা করছে, ‘ধর্ম অবমাননা’র জন্যে মৃত্যুদণ্ডের আইন প্রণয়নের দাবি করছে, পহেলা বৈশাখ উদযাপনের বিরোধিতা করছে। তা হলে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে, হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে কিংবা যারা ব্লগারদের হত্যা করছে বলে নিজেরাই দাবি করছে, তাদের সঙ্গে এদের পার্থক্য কোথায়? আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ‘লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, মূলনীতি ও উন্নয়ন দর্শন’ অংশে দাবি করা হয়েছে, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, ও সমাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সকল ধর্মের সমান অধিকার নিশ্চিতকরণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অভীষ্ট লক্ষ্য।’ তাই যদি হয়, তা হলে আওয়ামী ওলামা লীগ নামের একটি সংগঠন কী করে আওয়ামী লীগের কার্যালয় ‘২৩, বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউ’-তে বসে দলীয় কার্যক্রম চালায়, একই নামের আরেকটি সংগঠন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমণ্ডির কার্যালয়ে বসে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে? সেদিন কি আর খুব বেশি দূরে, যেদিন এরাই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার অজুহাতে খোদ আওয়ামী লীগের ওপরেই চড়াও হবে?
পঞ্চম কথা, আমাদের দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর নিস্পৃহ ও নির্লিপ্ত অবস্থানও দেশের মানুষের মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে স্থবির করে ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবসায়ীদের সুবিধা করে দিচ্ছে। গত সাড়ে চার মাসে পরিকল্পিতভাবে মধ্যযুগীয় কায়দায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে চারজন ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। ব্লগার হত্যার সূচনা হয়েছে ২০১৩ সালে গণজাগরণের সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে ভিন্নমুখী করার হীন উদ্দেশ্যে, আন্দোলনকারীদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার অপপ্রয়াসে। এই অপপ্রয়াস চলতি বছরে তুঙ্গে উঠেছে। অথচ রাজনৈতিক দলগুলো এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিচ্ছে না। কোনো আলোচনা তুললেই তারা তাদের স্বর্ণোজ্জ্বল অতীত দেখান, ষাট ও সত্তর দশকের আন্দোলনের ইতিহাস বলতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও মুক্তচিন্তার চর্চায় বর্তমানে যে জাড্য দেখা দিয়েছে, তা তাদের চোখ এড়িয়ে যায়। ছাত্র রাজনীতি নেই বললেই চলে, সামরিক শাসনামলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদের নির্বাচন হতো, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চলত, অথচ নির্বাচিত সরকারসমূহের এতগুলো বছর অতিক্রম হওয়ার পরও কোনো নির্বাচন নেই, সংগঠন ও নেতৃত্ব গড়ে ওঠার সুস্থ প্রক্রিয়া নেই, যে কারণে শিক্ষাঙ্গনে মুক্তচিন্তা ও গণতন্ত্র চর্চাও প্রায় অনুপস্থিত। অনলাইনে ব্লগারদের কারণে অসাংগঠনিকভাবে হলেও সেই চর্চার খানিকটা উন্মেষ ঘটেছে, এখন তারও টুঁটি চেপে ধরা হচ্ছে। অথচ রাজনৈতিক দলগুলো তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
মানুষের অনুভূতি কোনো খণ্ডিত বিষয় নয় এবং চূড়ান্ত অর্থে তা তাড়িত হয় শুভবোধে নাহয় অশুভবোধে। আলাদাভাবে ধর্মীয় অনুভূতির প্রসঙ্গ টেনে এনে আসলে শুভ আর অশুভের এই দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামকেই আড়াল করা হচ্ছে। ব্লগার হত্যাকারীদের ধরার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একের পর এক যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন, নিলয় হত্যার পর তা আরো নগ্ন হয়ে ফুটে উঠেছে। নিলয়ের জিডি না নেয়ায় এবং তাকে বিদেশ চলে যেতে বলায় এরকম ধারণা করা অমূলক হবে না যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও পরোক্ষে ব্লগারদের নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। আর আমাদের সরকার-প্রতিনিধিদের বক্তব্য শুনে তো মনে হচ্ছে যে, ব্লগারদের হত্যায় তাঁরা মোটেও উদ্বিগ্ন নন; তাঁদের উদ্বেগ এখানেই যে, হত্যা করার মধ্যে দিয়ে শান্তির ধর্মকে কলুষিত করা হচ্ছে। তার মানে কি এই হত্যার দায়ে নয়, হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কদাচ কোনো ব্যবস্থা নিলেও তা নেয়া হবে শান্তির ধর্মকে কলুষিত করার দায়ে? আমাদের স্বল্প জ্ঞানবুদ্ধিতে আমরা যতটুকু জানি বা বুঝি, তা হলো এই যে, বিশেষ কোনো ধর্ম নয়, প্রতিটি ধর্মই শান্তির কথা বলে, হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলে। তাই হত্যার বিরুদ্ধে ও শান্তির পক্ষে দাঁড়ানোই সবচেয়ে জরুরি। আর কোনো নতুন হত্যাকাণ্ড দেখতে চাই না আমরা, কিন্তু নিশ্চয়ই তা মুক্তচিন্তার শ্বাস রুদ্ধ করে নয়। হত্যা যারা করে, হত্যা যারা করতে চায়, ধর্মীয় অনুভূতি তাদের কাছে উপলক্ষ মাত্র। সক্রেটিসেরও ধর্মের ওপর পূর্ণ আস্থা ছিল, কিন্তু তাঁর সংশয় ও প্রশ্নের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে এবং হত্যার অজুহাত তৈরির জন্যে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল এই বলে যে, তিনি তরুণদের অবিশ্বাসী করে তুলছেন। আমাদের আশঙ্কা, বাংলাদেশের ব্লগারদের ক্ষেত্রেও তা-ই করা হচ্ছে। ধর্মীয় অনুভূতি নয়, মূল লক্ষ্য হলো মুক্তচিন্তার শ্বাস রুদ্ধ করা, মূল লক্ষ্য হল ব্লগারদের জন্যে গণ্ডি নির্ধারণ করে দেয়া। তাই সরকারের পক্ষ থেকেও নির্লিপ্ততা দেখানো হচ্ছে, গত দুই বছরে একের পর এক পাঁচজন ব্লগার জীবন দিয়েছেন, কুপিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই, উল্টো বলা হচ্ছে সীমা লঙ্ঘন না করতে। যারা খুন করেছে, তারা সীমা লঙ্ঘন করেনি, যারা কি-বোর্ডে টাইপ করে তাদের কথা বলেছে তারা সীমা লঙ্ঘন করেছে! এর চেয়ে নিষ্ঠুর পরিহাস আর কী হতে পারে!
আমরা অবিলম্বে ব্লগারদের হত্যাকারীদের গ্রেফতারের ও সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানাচ্ছি, সেই সঙ্গে ‘ধর্মীয় অনুভূতি’র নামে যে-কোনো ধরণের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আমরা আমাদের মুক্তচিন্তার চর্চা থেকে একটুও পিছু হটব না, মুক্তচিন্তার চর্চা অব্যাহত থাকবে, নিরন্তর চলবে।
