নূর হোসেন তোমায় লাল সালাম

১৯৮৭ সাল। আমার বয়েস তখন ১৬ এর ঘর পেরিয়েছে। স্বৈর-একনায়ক সামরিক জান্তা এরশাদের পতনের দাবীতে দুর্বার গণআন্দোলনের ডাক দেয়া হয়েছে। চারিদিকে মিটিং-মিছিল-শ্লোগান। ছাত্র মিছিলে পুলিশ বিডিআরের লাঠি পেটা, টিয়ার গ্যাস দিয়ে মিছিল ছত্রভংগ করার ঘটনা তখন নিত্যদিনের বিষয়। বিকেলে স্কুল কলেজ ছুটি হলে, কেউ হেঁটে কেউ বা রিক্সায় বাসায় ফিরতো। এ রকম ফিরতি পথের বহু ছাত্র রাস্তার মিছিলে শামিল হয়েছে, সেই সময়। শ্লোগান ধরেছে, সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে। ইট পাটকেল ছুঁড়ে লাঠিপেটার জবাব দিয়েছে তারা। এই প্রক্রিয়াতেই অনেকে ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে, সেই দিনগুলোতে।

ক্লাসের ভাল ছেলে হিসেবে যারা পরিচিত ছিল, তারাও পিছিয়ে ছিল না। অনেক আগ্রহ নিয়ে তারা শুনতে চাইতো, দেশে কি হচ্ছে। বিশেষ করে মনে পড়ে, যখন আমরা আলোচনা করতাম, একটা দেশের গণতন্ত্রের বিকাশে সামরিক শাসনকে কি কারণে অভিশাপ বলা হয়। স্বৈর-শাসন মানে কি? একটা দেশের নেতৃর্ত্বে কাদের হাতে থাকা উচিত, কেন সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলা হয়, ছাত্ররা কেন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলছে ইত্যাদি। এর বাইরে দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের কথা, কাদের কর্মসূচী কি, কিভাবে এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছে, কেন সে এতদিনও টিকে আছে, কিভাবে তার পতন ঘটানো সম্ভব, কেন এই পতন আমরা চাই ইত্যাদি নানা আলোচনায় আমাদের প্রায়ই সময় কেটে যেতো।  প্রায়ই মিছিল দেখতাম, মিছিলে যেতাম। একা নয়, বন্ধুরাও যেত।  ছাত্র রাজনীতিতে সেই বছরই হাতে খড়ি আমার। যদিও মনে এর বীজ বপন করেছিলাম, তার ও চার বছর আগে। ১৯৮৩ সালের মধ্যফেব্রুয়ারীর ছাত্র আন্দোলনে। সেই দিনের কথা আজ তুলে রাখলাম, অন্য আরেকদিন বলবো বলে।

আমি যে পাড়ায় থাকতাম, সেটা ছিল শহরের প্রানকেন্দ্র। আমার স্কুল কলেজের বন্ধুদের বাইরেও কয়েকজন বড় ভাইয়ের সাথেও রাজনীতির আলোচনায় মেতে উঠতাম। মোল্লার চা’র দোকান, সিরাজ ভাইয়ের চা দোকানের চেয়ারের নিদ্দির্ষ্ট আসনে ঘণ্টা’র পর ঘণ্টা রাজনৈতিক আলোচনায় আমাদের তৃপ্তি হতো না। এলাকার অনেকেই এই আলোচনায় যোগ দিতেন। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা বাজলেই দোকাণে বিবিসি’র সংবাদ চালু করে দিতে ভুলতো না, মোল্লার ছোট ছেলে হোসেন। পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঐ সময় শতো শত মানুষ দেশের সংবাদ শোনার জন্য ভিড় করতো। এই দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। দেখতাম, মানুষ আমাদের দেশে কতটা রাজনীতি সচেতন।  বিবিসির সংবাদ বিশ্লেষন পর্ব শেষ হলেই, আমাদের বিশ্লেষণ শুরু হতো। চলতো রাত পর্যন্ত। কফি হাউজের আড্ডা সাড়ে সাতটায় শেষ হ’তো। কিন্ত আমাদের আড্ডা সাড়ে দশটায় ও শেষ হতে চাইতো না। নিজের বাসায় না থেকে, রাজনীতি করা অন্য কোন বন্ধুর বাসায় রাত কাটানোটা, একটা রেওয়াজে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। রাজনীতির ব্যাপারে মায়ের প্রশ্রয় কিছুটা বেশীই ছিল বাবার তুলনায়, তাই বাসায় বিশেষ অসুবিধা হতো না।

বড় ভাইদেরই কয়েকজন ছিলেন পবন, বিকাশ, কিশোর ও হাশেম।  নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহতেই শুনলাম, এরা ঢাকা যাবেন ৯ নভেম্বর রাতে। কর্নফুলী এক্সপ্রেসে করে। ১০-৩০ মিনিটের মেইল ট্রেইনে। আরো জানলাম, নভেম্বরের ১০ তারিখ আন্দোলনরত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে ঢাকা শহর ও সচিবালয় অবরোধের ডাক দেয়া হয়েছে। কি হবে এই অবরোধে? এখানে কি পুলিশী দমন চালানো হবে? শুনে আমারও যেতে ইচ্ছে হল। তারা নিতে চাইলেন না আমাকে। কারন ছিল, আমি বয়সে অনেক ছোট ছিলাম, তাদের তুলনায়। পরিস্থিতি জটিল রুপ নিতে পারে এবং এ বিষয়ে নেতাদের বারণ আছে, এই কথা বলে তারা আমাকে নিবৃত্ত করলেন। মন মানতে চাইলো না। মনে আছে, রাতে হেঁটে হেঁটে মেইল ট্রেনে তাদের এগিয়ে দিয়ে এসেছিলাম। যেতে না পারায়, সে রাতে খুব মন খারাপ করে রইলাম। পরে পত্রিকায় দেখেছিলাম, এভাবে সেদিন সারা দেশ থেকে অসংখ্য যুবক-তরুন ঢাকায় এসে জড়ো হয়েছিলো। সেই আগুন ঝরা তারিখ ১০ নভেম্বরে।

সেদিন রেডিও শুনেছি, সারাদিন। টেলিভিশনকে তখন আমরা বলতাম সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স। টেলিভিশনের খবর কেউই শুনতো না। ঢাকার খবর নেয়ার জন্য দেশের মধ্যে একমাত্র ব্যক্তিগত পর্যায়ে টেলিফোন যোগাযোগ ছাড়া, নির্ভরযোগ্য কোন মাধ্যম ছিল না। আর একমাত্র ভরসা ছিল, বিবিসি বাংলা প্রোগ্রাম। সন্ধ্যার খবরে, নিশ্চিত হলাম ঢাকায় নূর হোসেন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। অনেক রাজনৈতিক কর্মী আহত হয়েছেন, গুলি খেয়েছেন অনেকেই এবং আহত মানুষের আহাজারিতে ঢাকার বাতাস সেদিন ভারী হয়েছিল। মেডিকেল কলেজগুলোতে উদ্বিগ্ন নেতা কর্মী এবং আত্মীয় স্বজনের ভিড় কেবলই বাড়ছিলো সেদিন।

‘৬৯ এর আসাদই যেন, ‘৯০’তে নূর হোসেন হয়ে এসেছিলেন। আর আমার পাড়ার সেই বড় ভাইয়েরা পবন, কিশোর, বিকাশ ও হাশেমরাই নূর হোসেনের মত তেজ নিয়ে ঢাকায় ছুটে গিয়েছিলেন, সেদিন রাতে। মেইল ট্রেনে করে। এভাবেই সারা দেশ থেকে হাজার হাজার নূর হোসেন গনতন্ত্র মুক্তি পাক/স্বৈরাচার নিপাত যাক, এই শ্লোগাণকে হৃদয়ে-কন্ঠে ধারন করেছিল। ছুটে গিয়েছিল ঢাকায়। মিছিলের শব্দে ম্লাণ করে দিয়েছিল, সামরিক বুটের অশুভ আওয়াজ। সারা দেশের মানুষের আকুতিকে নূর হোসেনের চাইতে আর কে বেশী পেরেছে, মাত্র একটি লাইনে তুলে ধরতে? তাইতো শামসুর রাহমান নূর হোসেনের চেতনাকে ধরতে চেয়েছেন, তাঁর কবিতায়। তুলনা করেছিলেন, নূর হোসেনের বুকের আকুতিকে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের আর্তির সাথে।

নূর হোসেন এখনও রক্তাক্ত হয়ে আছে, এই বাংলাদেশে। গণতন্ত্রের চেতনার সাথে নূর হোসেনের চেতনার কোন প্রভেদ নেই। গণতন্ত্রের চেতনার কথা বলা সেদিনের সেই দুই বড় দলের একটি আল বদর বাহিনীর সাথে গাঁঠছড়া বেঁধেছে, আর একটি দল নূর হোসেনের হত্যাকারীর সাথে জোট বেঁধে ক্ষমতার মসনদে বসার স্বপ্নে বিভোর আছে। বিকল্প কোন গণতান্ত্রিক প্লাটফর্ম সহসা দাঁড়াচ্ছে বলে ভরসা হচ্ছে না। তবে নিশ্চয়ই দাঁড়াবে একদিন । আজ, কাল কিংবা পরশু।

প্রতি বছরই ঘুরে ঘুরে নূর হোসেন দিবস আসবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সময়ের প্রয়োজনে, আবারো এই দেশে নূর হোসেনরা দেখা দেবে। তাদের পদধ্বনি শোনা যাবে। আইন মানবে না সে, কারফিউ মানবে না, বাঁধভাঙ্গা পানির মত কলকল করে সে দেখা দেবে প্লাবন হয়ে, এই বাংলাদেশে আবারো। ভেসে নিয়ে যাবে, স্বৈর সামরিকতন্ত্রের আবর্জনা, কারন এই জরুরী আইনের শাসনে মানুষের বিবেক এখন বন্দী। গণতন্ত্র বন্দী। আত্মার স্বাধীনতা শেকল বন্দী। এই জরুরী সময়ে, তার আসার প্রতিক্ষায় আছি আমরা। নিশ্চয়ই আসবে সেই নূর হোসেন, আবার ইতিহাস হতে। এই জাতিকে উদ্ধার করতে, এই চরম দুঃসময়ে।

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

7 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
7
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.