দ্য ট্রায়াল অব দ্য বার্থ অব আ নেশন -- সোজা বাংলায় বলতে গেলে একটি রাষ্ট্রের জন্মবিচার; লন্ডন থেকে প্রকাশিত ইকোনমিস্ট-এর একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল এটি। ইকোনমিস্ট কি তাদের এই শিরোনাম বুঝেশুনে দিয়েছে? জানা নেই আমাদের। তবে বুঝে হোক আর না-বুঝে হোক, ইকোনমিস্ট একটি নির্মম সত্যই বলে বসেছে, বাংলাদেশে এখন চূড়ান্ত অর্থে এই রাষ্ট্রের জন্মের বিচারকাজ চলছে। [...]

যুদ্ধাপরাধী বিচারের রাজনীতি ৪

দ্য ট্রায়াল অব দ্য বার্থ অব আ নেশন — সোজা বাংলায় বলতে গেলে একটি রাষ্ট্রের জন্মবিচার; লন্ডন থেকে প্রকাশিত ইকোনমিস্ট-এর একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল এটি। ইকোনমিস্ট কি তাদের এই শিরোনাম বুঝেশুনে দিয়েছে? জানা নেই আমাদের। তবে বুঝে হোক আর না-বুঝে হোক, ইকোনমিস্ট একটি নির্মম সত্যই বলে বসেছে, বাংলাদেশে এখন চূড়ান্ত অর্থে এই রাষ্ট্রের জন্মের বিচারকাজ চলছে। এই জনপদের মানুষ তখন চেয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক শাসন ও দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক রাষ্ট্রের বাইরে এসে গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। অন্যদিকে, এরকম রাষ্ট্র যাতে মুক্তিকামীরা প্রতিষ্ঠা করতে না পারে সেজন্যে বিরোধীরা সবরকম সহিংস পথ বেছে নিয়েছিল। ইকোনমিস্টের শিরোনাম তাই পুরোপুরি ইঙ্গিতময় : এই রাষ্ট্রে কি তারা আইনের উর্ধ্বে থাকবে, যারা একদিন এই রাষ্ট্রের জন্ম ঠেকানোর জন্যে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ থেকে শুরু করে সব কিছু করেছে? ওরাই করবে রাষ্ট্র পরিচালনা যারা একাত্তরে গলা টিপে হত্যা করার চেষ্টা করেছে একটি রাষ্ট্রের জন্মযন্ত্রণা? আর এর বিপরীতে তাদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবে ন্যায় বিচার, যারা একদিন এই রাষ্ট্রের জন্যে স্বজন হারিয়েছে, ধর্ষণের শিকার হয়েছে আর পালিয়ে থেকে জীবন বাঁচিয়েছে? না কি বাংলাদেশ একাত্তরের সেইসব পরিবারের জন্যে ন্যায় বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে প্রমাণ করবে, যারা ম্যাসাকারের শিকার হওয়ার মধ্যে দিয়ে খুব সরল সিধা এই সত্য তুলে ধরেছিল যে, তাদের আকাঙ্ক্ষিত নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্মের জন্যে যে কোনও পরিণতি বরণ করতে রাজি তারা? যেমনটি বলেছিলেন খান সারওয়ার মুরশিদ একাত্তরের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথবাণীর একটি বাক্য হিসেবে : ‘আমরা অঙ্গীকার করছি স্বাধীনতার জন্য জীবন সম্পদ সব দেব।’

আজ হয়তো অনেকে কথাটি মানতে রাজি হবেন না, কিন্তু ভবিষ্যত প্রমাণ করবে, এই প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্যে দিয়ে ইকোনমিস্ট পৃথিবীর সাংবাদিকতার ইতিহাসে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে জঘন্য কালো একটি অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যে মিশন নিয়ে ইকোনমিস্ট এখন মাঠে নেমেছে সে মিশনকে বৈধতা দিতে তারা মীমাংসিত বিষয়কেও অমীমাংসিত করে তোলার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। যেমন, প্রতিবেদনের প্রথম পরিচ্ছেদেই তারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা উল্লেখ করতে গিয়ে জানিয়েছে, মৃতের সংখ্যা তিন লাখ থেকে বর্তমান সরকারের দাবি অনুযায়ী ত্রিশ লাখের মধ্যে একটা কিছু হবে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে বাংলাদেশে স্থাপিত ট্রাইব্যুনালের নাম ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল রাখা কি অপরাধ হয়েছে? ইকোনমিস্ট-এর প্রতিবেদনের দ্বিতীয় প্যারা পড়লে সেরকমই মনে হতে পারে। বলা হয়েছে, এটাকে অভিহিত করা হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল, যদিও আন্তর্জাতিক আইনের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি একটি আন্তর্জাতিক আদালত নয়। বরং এটি ১৯৭৩ সালে অনুমোদিত (এবং ২০০৯ ও ২০১২ সালে সংশোধিত) বাংলাদেশি অধ্যাদেশভিত্তিক একটি অভ্যন্তরীন আদালত।

এই একই প্রশ্ন শুনতে শুনতে এবং এর উত্তর দিতে দিতে আমরা এখন ক্লান্ত। আমাদের উত্তর এখন হয়তো রুঢ় শোনাবে, তবুও বলি, ইকোনমিস্ট এতদিন কোথায় ছিল? বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদেছে, উদ্ধত যুদ্ধাপরাধী-যারা আবার বড় বড় রাজনীতিক বলে সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী শয়তানগুলোর সামনে নিগৃহীত মানুষগুলো চলাফেরা করেছে অবনত মস্তকে-তখন ইকোনমিস্ট কোথায় ছিল? তখন কি তাদের কোনও প্রতিবেদককে লিখতে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বছরের পর বছর পেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ সেখানকার কোনও সরকারই ১৯৭১-এর সংঘটিত আন্তর্জাতিক অপরাধগুলোর অপরাধীদের বিচার করছে না, অতএব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠনের ব্যাপারে এগিয়ে যাওয়া? আজ যখন আন্তর্জাতিক অপরাধের সংজ্ঞায় যেসব অপরাধ অন্তর্ভুক্ত, সেই সব অপরাধগুলির বিচার আন্তর্জাতিক আইন অনুসারেই করার জন্যে বাংলাদেশ উদ্যোগ নিয়েছে, রাষ্ট্রের মেধাবী আইনজ্ঞদের নিয়ে দেশের অভ্যন্তরেই ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে, তখন ইকোনমিস্টের জ্বলুনি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের আইনজ্ঞরা তো কখনোই বলেন নি, এটি আন্তর্জাতিক আদালত, শুরু থেকেই বলা হয়েছে এটি হলো আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের ট্রাইব্যুনাল, আন্তর্জাতিক অপরাধের সংজ্ঞায় যেসব অপরাধ অন্তর্ভুক্ত সেগুলি বিচারের ট্রাইব্যুনাল এবং এসব অপরাধ যেহেতু এ দেশেই সংঘটিত হয়েছে, সেহেতু এ দেশে গঠিত ট্রাইব্যুনালই সেসবের বিচারকাজ করবে। কিন্তু শুধু ইকোনমিস্ট না, আরও অনেকের বুক তাতে কখনও পুড়ে যাচ্ছে, কখনও বা জলে ভেসে যাচ্ছে।

আর এখন পরিষ্কার, কেন তাদের বুক পুড়ছে, বুক জলে ভেসে যাচ্ছে। ইনিয়েবিনিয়ে নিজেদের যত স্বচ্ছই দেখানোর চেষ্টা করুক না, তারা আসলে চায় এই বিচারকে ঝুলিয়ে রাখতে এবং প্রকারান্তরে যুদ্ধাপরাধীদেরই রক্ষা করতে। এবং তারা তা বলতে দ্বিধাও করেনি :

The 1973 act says that ‘‘if, in the course of the trial, any one of the members of the Tribunal is, for any reason, unable to attend to any sitting thereof, the trial may continue before the other members. ’’ The evidence we have seen, though suggests that a full reconsideration of proceedings may now be required.

এবার দেখা যাক, কী সব খোড়া যুক্তির জোরে ইকোনমিস্ট এইসব বলছে। তাদের কাছে মনে হয়েছে, বাংলাদেশ বিচারবিভাগের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়ার কথা বললেও তাদের কাছে যেসব দলিলপ্রমাণ রয়েছে, তা থেকে দেখা যাচ্ছে ট্রাইব্যুনাল রাজনৈতিক চাপে পড়েছে। নিশ্চয়ই ট্রাইব্যুনাল রাজনৈতিক চাপের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু ইকোনমিস্ট সুচতুরতার সঙ্গে যে ব্যাপারটি এড়িয়ে যাচ্ছে সেটি হলো এই চাপ কেবল একপাক্ষিক নয়। এই সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে, নির্বাচনি অঙ্গীকার করার মধ্যে দিয়েই ক্ষমতায় এসেছে। এবং সে প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার পূরণের লক্ষ্যেই তারা ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। তাই তাদের পক্ষে থেকে এই বিচার দ্রুত করার ব্যাপারে একটি চাপ থাকা ও চাপ দেয়া অস্বাভাবিক নয়। তা ছাড়া ট্রাইব্যুনালের অ্যাক্টেই লেখা আছে যে : 3(b): take measures to prevent any action which may cause unreasonable delay, and rule out irrelevant issues and statements. একটি কথা মনে রাখতে হবে, এসব মামলায় বাদীপক্ষ হলো রাষ্ট্রপক্ষ; কাজেই রাষ্ট্রের পরিচালনকাঠামোর অংশ হিসেবে সরকারের বা রাষ্ট্রপক্ষের দিক থেকে অযৌক্তিক দীর্ঘসূত্রতা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে চাপ দেয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু ইকোনমিস্ট যা বলছে না, তা হলো, বিরোধী পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে একটি চাপ রয়েছে এবং মূলত সেই চাপই ট্রাইব্যুনালের জন্যে, ন্যায় বিচারের জন্যে ক্ষতিকর। সে চাপটি হলো বিচার না করার, বিচার নানা অপকৌশলে দীর্ঘমেয়াদী করার। ইকোনমিস্ট বলছে না, বিচার যাতে না হয় সেজন্যে যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠিত রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের রাজনৈতিক মিত্র দল (যে দলেও যুদ্ধাপরাধী রয়েছে) বিএনপির পক্ষ থেকে হরতাল, অবরোধসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার ও ট্রাইব্যুনালের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, যাতে এ বিচার করা না হয়, যাতে ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দেয়া হয়। সশস্ত্র-সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে জামাত-বিএনপি যখন যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দাবি করে, ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দেয়ার কথা বলে তখন কি তা রাজনৈতিক চাপ হয় না? সেই চাপ কি ট্রাইব্যুনালের গায়ে গিয়ে পড়ে না? কিন্তু ইকোনমিস্ট এ ব্যাপারে কথা বলতে নারাজ।তাদের লক্ষ্য হলো,যেনতেনভাবে এটাই প্রমাণ করা যে, ট্রাইব্যুনাল সরকারের চাপের মধ্যে রয়েছে এবং বিচারক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ বিশেষজ্ঞর আলাপচারিতায় তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ওই আলাপচারিতায় এটি স্পষ্ট, কোনও চাপের কাছে বিচারক নতি স্বীকার করতে রাজি নন।কিন্তু ইকোনমিস্ট না কি তাদের প্রামাণ্যদলিলপত্রে নিজামুল হকের স্বাধীনতাকে প্রশ্নের মধ্যে পড়তে দেখেছে।

ইকোনমিস্ট বিচারকের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞকেও ব্যবচ্ছেদ করার চেষ্টা চালিয়েছে। ইকোনমিস্ট-এর গোস্বা হলো,যে নিজামুল হক বলেছেন যে ট্রাইব্যুনাল নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা এমনকি তাদের স্ত্রীদের সঙ্গেও কথা বলেন না, সেই নিজামুল হক কী করে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেন! প্রশ্ন হলো, ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিচারকরা স্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না, কিন্তু তার মানে কি এই যে তারা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও কথা বলার অধিকার রাখেন না? ইকোনমিস্ট নিজেই স্বীকার করেছে, হ্যাঁ, ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার রয়েছে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমের জন্যে কাউকে নিযুক্ত করার (এবং আমরা ধরে নিতে পারি, এই নিযুক্তি যে আনুষ্ঠানিক হবে এমন না-ও হতে পারে)। কিন্তু তাদের বিবেচনায়, ‘Mr. Ziauddin does not seem to meet these requirements’ কারণ প্রসিকিউশন ও ডিফেন্স অবগত রয়েছে এমন কোনও অফিসিয়াল ভূমিকা ছিল না তার। তা ছাড়া সাধারণ শর্ত অনুযায়ী, উপদেষ্টারা তাদের সুনির্দিষ্ট বিশেষজ্ঞ-মত দেয়ার ক্ষেত্রটিতেই শুধু বিচরণ করবেন।

আবারও বলি, এটি ইকোনমিস্ট-এর অভিমত। এবং ইকোনমিস্ট মনে করছে, পৃথিবীব্যাপী অজস্র পাঠককে সহজেই এ কথা লিখে বোকা বানানো যাবে, কেননা তাদের তো আর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩ পড়া নেই, বেশির ভাগ পাঠকই তা কষ্ট করে পড়ে দেখতে যাবেন না। অতএব চামে চামে এই পাঠকদের অন্তত এইটুকু বার্তায় বিশ্বাসী করে তোলা যাবে যে সেখানে ট্রাইব্যুনালের কাজ যথাযথভাবে মানসম্মতভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না। আর একবার কাউকে কোনও কিছুতে বিশ্বাসী করে তুলতে পারলে, তা থেকে বেরিয়ে আসাটা তার পক্ষে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অসম্ভব।

এর বিপরীতে দেখা যাক, অ্যাক্ট কী বলছে। সেখানে সেকশন ১১ (১) (ডি)তে বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে, ‘to appoint persons for carrying out any task designated by the Tribunal.’

বোধকরি, এর পর আর কিছু বলার থাকে না। কিন্তু তারপরও ইকোনমিস্ট বলেছে। বলেছে, তাদের কাছে যেসব ম্যাটেরিয়াল রয়েছে তা থেকে তিনটি বিষয় দেখা যাচ্ছে। একটি হলো, কিভাবে প্রসিকিউশন তার মামলা গঠন করবে এবং কীভাবে কোর্ট এর ইনডিক্টমেন্ট গঠন করবে সেসবের ওপর জিয়াউদ্দিনের একটি প্রভাব ছিল। দ্বিতীয়টি হলো, ডিসেম্বরে ২০১১ সালের ই-মেইলে জিয়াউদ্দিন বিচারককে বলেছেন, কীভাবে প্রসিকিউটররা তাদের মামলা উন্নত করতে পারেন।সবশেষে, প্রসিকিউটররা তাদের চার্জসমূহ লেইড করার পর বিচারক আনুষ্ঠানিক অভিযোগ সম্পর্কে আহমেদ জিয়াউদ্দিনের কাছ থেকে নির্দেশনা গ্রহণ করেছে।এ ছাড়াও ইকোনমিস্ট বিভিন্ন ই-মেইলে কী লেখা হয়েছে তা উদ্ধৃত করেছে, যদিও পাঠক হিসেবে আমাদের জানার বা বোঝার উপায় নেই, সেসব খণ্ডিতভাবে উদ্ধৃত হয়েছে কি না। এত সব ধুম্রজাল সৃষ্টি করেও শেষাবধি ইকোনমিস্টকে বলতে হয়েছে যে, ‘We do not belive he has broken any laws and cannot be held responsible for the actions of others. In addition, our investigations have not covered any aspect of the defence’s approach to this tribunal.’

মজার ব্যাপার হলো, ইকোনমিস্ট আহমেদ জিয়াউদ্দিন কোনও আইন ভেঙেছেন বলে মনে না করলেও বিচারক নিজামুল হক নাসিম সম্পর্কে সেরকম মনে করে না। নিজামুল হক নাসিমের পদত্যাগের আলোকে তারা বরং আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বলেছেন ট্রাইব্যুনালের কাজকর্মে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে কি না। কেননা তারা এটাই ধরতে চাইছেন না, বিচারপ্রক্রিয়া যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সে সদিচ্ছা থেকেই বিচারক নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করেছেন। ইকোনমিস্ট এইভাবে অপচেষ্টা চালিয়েছে বিচারক ও বিশেষজ্ঞ দু জনের মধ্যে এমন একজন সম্পর্কে প্রশ্নবিদ্ধ করতে, যিনি সরাসরি বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কেননা এর ফলে ইকোনমিস্টের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সুবিধা হয়, একদিকে তারা সক্ষম হয় একজন সম্পর্কে সন্দেহের বীজ পুঁতে দিতে, অন্যদিকে সেই সন্দেহের জের হিসেবে পুরো ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে সাধারণ্যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে।

আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার নিয়ে, ট্রাইব্যুনাল নিয়ে ইকোনমিস্টের নেতিবাচক অবস্থান সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা আমাদের আগে থেকেই ছিল-এই প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্যে দিয়ে ইকোনমিস্ট সেই ধারণাকে এবার প্রত্যক্ষ করে তুললো মাত্র। এবং বলাই বাহুল্য, এই প্রতিবেদন হয়তো সাময়িকভাবে কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে, কিন্তু সত্য খুব তাড়াতাড়িই প্রকাশিত হবে। খুব তাড়াতাড়িই বিভ্রান্তির কুয়াশা কেটে যাবে ওই সব মানুষের। কিন্তু আমাদের বিস্মিত করেছে এ ব্যাপারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইছেন এমন কারও কারও ভূমিকা। যেমন, এ ঘটনার পর একটি অনলাইন বার্তা সংস্থায় শাহরিয়ার কবীর এমন একটি নিবন্ধ লিখেছেন, যা অনেককেই বিস্মিত ও দুঃখিত করেছে। শাহরিয়ার কবীর শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধী বিচারের আন্দোলনের একজন নিরলস সংগ্রামী, অন্যান্য যারা বা যে সব সংগঠন এ বিচার চাইছেন তাদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি নিশ্চয়ই এটি বেশ ভালো করেই বোঝেন, বিচারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এক ব্যাপার, আর বিচারের জন্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে কর্মযজ্ঞে সহায়তা করা আরেক ব্যাপার। সঙ্গতকারণেই যারা মাঠের আন্দোলন করছেন বা করেছেন, বিচার-তদন্ত ইত্যাদি আইনসংক্রান্ত কাজে তাদের ভূমিকা থাকবে না। আর সে কারণেই শাহরিয়ার কবীর যখন আহমেদ জিয়াউদ্দিন সম্পর্কে ঢালাও মন্তব্য করেন তখন তা কেবল অনৈক্যের পথকেই তৈরি করে — যা কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-বিরোধীদেরই শক্তিশালী করবে। বোধ করি শাহরিয়ার কবীরকে তাঁর আশেপাশে থাকা মানুষদের কেউ কেউ বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন, নইলে তিনি এমন সব কথা লিখতে যাবেন কেন যা বছরের পর বছর ধরে ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্যে তিনি যে-সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন সেই সংগ্রামকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে? এটি এমন একটি সময় যখন স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষ থেকে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়ার জন্যে, আইনের ফাঁক গলিয়ে বের করে নিয়ে আসার জন্যে নানা ফাঁদ পাতা হচ্ছে। এরকম সময়ে ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এমন ইস্যুগুলিকে শুরুতেই নিরসন করতে হবে।

ইকোনমিস্ট তাদের শিরোনামের মধ্য দিয়ে স্পষ্টভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে, এ কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয় — এ হলো একটি রাষ্ট্রের জন্মবিচার। আমরা যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শেষ করতে না পারি, আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহের বিচার করতে না পারি, এ রাষ্ট্রের জন্মই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।

ইকোনমিস্ট তা-ই চায়, কিন্তু শাহরিয়ার কবীরও কি তা-ই চান?

অবিশ্রুত

সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে... কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!

৩ comments

  1. Hasan - ৩০ ডিসেম্বর ২০১২ (৬:৩৪ অপরাহ্ণ)

    আমরা বাঙালী জাতী হিসাবে নিজেদের জাহির করতে চহিলে এই বিচারের বিকল্প নাই!!!!

  2. বাসুদেব - ৫ জানুয়ারি ২০১৩ (৫:২৯ অপরাহ্ণ)

    আমার মনে হয় দেশ বিরোধী শক্তিগুলো আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোকে কিনে ফেলেছে। এর একটা অনুসন্ধান করা উচিত।

  3. Pingback: যুদ্ধাপরাধ বিচারের রাজনীতি ৪: রাষ্ট্রের জন্মবিচার বনাম ইকোনমিস্ট » International Crimes Strategy Forums

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.