‘যুদ্ধাপরাধী ইস্যুর রাজনীতিকরণ’ বলতে ঠিক কী বোঝায় আসলে?
গত বছর বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর থেকেই এরকম একটি বিষয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে সবাইকে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একটি অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। বিষয়টি নিয়ে নির্বাচনের সময় স্বাধীনতাবিরোধীরা তেমন মাথা ঘামায়নি। কিন্তু নির্বাচনের ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি অন্যতম ইস্যু হয়ে উঠেছে আর তখন থেকেই কেউ কেউ ছবক দিতে শুরু করেছেন, বিষয়টির ‘রাজনীতিকরণ’ ঠিক হবে না।
লক্ষণীয় বিষয়, এ কথা যারা বলছেন, তারা প্রত্যেকেই রাজনৈতিক দলের সদস্য। আর কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী যখন একটি ইস্যু সম্পর্কে মন্তব্য করেন, নিঃসন্দেহে তাতে একটি রাজনৈতিক বার্তা থাকে এবং সেকারণে এর রাজনৈতিক একটি মাত্রাও থাকে। এরকম কথা বলার মধ্যে দিয়ে প্রকারান্তরে জনগণের সবার কাছে একটি রাজনৈতিক বার্তাই পৌঁছে দেয়া হয়। লোকে বলে, ‘জ্ঞানী বোঝে ইশারা পেলে, মুর্খ বোঝে অণ্ডকোষে লাথি পড়লে।’ জ্ঞানী কিংবা মুর্খ, আমাদের যেটাই ভাবা হোক না কেন, যুদ্ধাপরাধের শিকার একটি জনগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে একটা বার্তাই পাই আমরা তাঁদের ওই দাবির মধ্যে থেকে। সে-বার্তাটি হলো : তাদের দলের কাউকে যেন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত না করা হয়, শাস্তি দেয়া না হয়। এ-বার্তার আরেকটি অর্থ হলো, সত্যিকার যুদ্ধাপরাধী কাউকেও যদি অভিযুক্ত করা হয় তা হলে তা ‘যুদ্ধাপরাধের রাজনীতিকরণ’ হবে, কেননা তিনি তাদের দলীয় নেতা, কেননা তিনি তাদের রাজনৈতিক মিত্র।
স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীরা যুদ্ধের সময়েও কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিল অথবা সরকারের আজ্ঞাবহ ছিল। যুদ্ধের পর তাদের অবস্থানগত সংকট প্রকট হয়ে ওঠে এবং নিজেদের গরজেই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তারা আরও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি সরকারি দল আওয়ামী লীগেও এদের অনেক আশ্রয় নিয়েছেন তখন, তারও চেয়ে বেশি আশ্রয় নিয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ও ভাসানী ন্যাপে। কারণ বেঁচে থাকার জন্যে, নিরাপদ থাকার জন্যে একটি অবস্থান দরকার হয় তাদের সবার; আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হয় সেই অবস্থান রাজনৈতিক হলে। মানবতার বিরুদ্ধে যে-অপরাধ করা হয়, তা ঢাকার জন্যে এর চেয়ে বড় বর্ম আর কিইবা হতে পারে! ১৯৭৫ সালের পর এরা রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার পায়। তখন এদের কপাল খুলে যায়।
এখন, যারা বলছেন যে যুদ্ধাপরাধী ইস্যুর রাজনৈতিকীকরণ ঠিক হবে না, তারা নিজেরাই যে ইস্যুটি নিয়ে রাজনীতির জল ঘোলা করছেন, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক দেনদরবারও শুরু করেছেন, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ মেলে তিনটি ঘটনায়।
প্রথম ঘটনাটি হলো, এ ধরনের বিচারপ্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অবস্থান। ফেব্রুয়ারিতে দূত পাঠিয়ে পাকিস্তান এ ব্যাপারে প্রথমে বাংলাদেশকে সতর্ক করার চেষ্টা করে। পাকিস্তানের বিশেষ দূত মির্জা জিয়া ইস্পাহানী তখন সাংবাদিকদের কাছে বলেও যান, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উপযুক্ত সময় এটি নয়। এরপর জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ হোসেন হারুন তাদের সরকারের ‘উদ্বেগের’ কথা জানিয়ে জাতিসংঘের প্রতি লিখিতভাবে আহ্বান জানায় ‘এরকম একটি স্পর্শকাতর’ ইস্যুতে জাতিসংঘকে না জড়ানোর। পাকিস্তানের এ ধরণের জঘন্য আন্তর্জাতিক তৎপরতায় অবশ্য বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলিকে বিমর্ষ মনে হয়নি।
দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো, গত ৫-৭ মে ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আসিফ আলি জারদারি ও আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার এক বৈঠক হয় আল কায়েদাকে পরাস্ত করা ও প্রত্যেক দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে নতুন কৌশল নিয়ে। এই আলোচনার পরেই ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হোসেইন হাক্কানী বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবিরের সঙ্গে বৈঠক করেন, যে বৈঠকের প্রধান আলোচ্য বিষয়সূচি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাংলাদেশের তৎপরতা। এ ব্যাপারে ২০ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব তৌহিদ হাসানের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির লিখেছেন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় তার কাছে মনে হয়েছে যে, এটি একটি পুরানো অধ্যায় এবং এ ধরণের উদ্যোগ পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে শীতল করতে পারে।
তৃতীয় ঘটনাটি হলো, গত ১৫ জুন মাত্র দুইদিনের জন্যে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী রবার্ট ও ব্লেক। ফিরে যাওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের জানিয়ে গেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুটি ‘রাজনীতিকরণ করা’ ঠিক নয়। ‘কষ্টার্জিত গণতন্ত্রকে দুর্বল ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মসূচি সরকারের পক্ষে গ্রহণ করা উচিত হবে না’ বলে মত দেন তিনি। ওই সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাকি জবাবদিহিতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে,- যদিও ইরাক, আফগানিস্তানসহ পৃথিবীর অসংখ্য দেশে গণহত্যার জন্যে তাদের কোনও জবাবদিহির প্রয়োজন পড়ে না বলেই জানি আমরা। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে সরকারের সঙ্গে তার আলোচনার বিষয় নিয়ে তিনি বলেন, তিনি একে রাজনৈতিক ইস্যু না করার জন্য সরকার পক্ষকে আহবান জানিয়েছেন।
কেন যুক্তরাষ্ট্রের এই পাতিমন্ত্রীর মনে হলো যে, বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটিকে রাজনীতিকরণ করা হচ্ছে? কারণ বাংলাদেশের কেউ কেউ তাই মনে করছেন এবং পাকিস্তানও তাই মনে করছে। আর কে না জানে, এই ত্রয়ী অপশক্তির সম্মিলনেই ১৯৭১-এ গড়ে উঠেছিল একটি অক্ষজোট, যারা চায়নি বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
পত্রিকাতে খবর বেরিয়েছে, জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ হোসেন হারুন সেখানকার বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন, যাতে জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে সহায়তা করতে দ্বিধান্বিত হয় অথবা এ-সংক্রান্ত বিচারকাজে এমন ভূমিকা পালন করে, যাতে ‘বেনিফিট অব ডাউট’-এর ফাঁক গলিয়ে উতরে যায় যুদ্ধাপরাধীরা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘ স্থায়ী মিশন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠানো রিপোর্টে পাকিস্তানের এসব কর্মতৎপরতা তুলে ধরা হয়েছে। পাকিস্তান জাতিসংঘের কাছে এরকম যুক্তিও দেখাচ্ছে যে, বাংলাদেশ সেসময় পাকিস্তানের অঙ্গরাষ্ট্র ছিল এবং অঙ্গরাজ্যের নাগরিকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোনও অভিযান যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়ে না। আর এটিকে যদি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনাই করা হয়, তা হলে সোয়াত উপত্যকায় পাকিস্তান যে-জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে, সে অভিযানকেও কেউ ভবিষ্যতে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে।
পাকিস্তানের এই যুক্তি বোধকরি যুক্তরাষ্ট্রেরও মনে ধরেছে। নইলে খবরটি প্রকাশে কয়েকদিন পরেই রবার্ট ও ব্লেক কেন দু’দিনের জন্যে বাংলাদেশে যাবেন এবং ছবক দেবেন, বলুন?
তা হলে দেখা যাচ্ছে, আমরা চাই বা না-চাই, যুদ্ধাপরাধ বিচারের ইস্যুটি রাজনীতির বাইরে থাকতে পারছে না। দেশ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে এর পরিধি। আর আমরা তীব্রভাবে অনুভব করতে পারছি মাওসেতুং-এর একটি কথার সত্যতা। মাওসেতুং বলেছিলেন,- যুদ্ধ হলো রক্তপাতময় রাজনীতি আর রাজনীতি হলো রক্তপাতহীন যুদ্ধ। ১৯৭১ সালে আমরা একটি রক্তপাতময় রাজনীতি করেছি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হলো সেই রাজনীতির ফসল। অনেকেই আছেন, যারা মনে করেন, এটি ছিল গৃহযুদ্ধ; যে-বিবেচনা থেকে তারা ওই কথাটি বলেন, সেই নিরিখে তা হলে পৃথিবীর কোনও রাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধই আর স্বাধীনতার যুদ্ধের পর্যায়ে পড়ে না। পাকিস্তান এখন বুঝাতে চাইছে, ১৯৭১-এর সময়টি ছিল একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা; কিন্তু কে না জানে ওই অমোঘ সত্যটি,- বস্তুর পরিমাণগত পরিবর্তন থেকেই দেখা দেয় গুণগত পরিবর্তন? ডিম ভাঙলে তো কুসুম আর শাদা পদার্থ ছাড়া আর কিছুই আমাদের চোখে পড়ে না; অথচ সেই ডিমই একটি নির্দিষ্ট তাপে একসময় জীবন্ত ছানা হয়ে বেরিয়ে আসে। আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ছিল ওই জীবন্ত ছানা বেরিয়ে আসার মতো ঘটনা। যারা সেই রাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়ায় বাধা দিতে চেয়েছে, তারা এটিকে গৃহযুদ্ধ বললেই কি তা গৃহযুদ্ধ হয়ে যায়? যে-যুদ্ধের শুরুই হয়েছে নতুন গৃহ প্রতিস্থাপনের উদ্দেশে, সে যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে কেবল তারাই, যারা যুদ্ধের মাধ্যমে চেয়েছিল পুরানো গৃহটিকেই বিদ্রোহীদের ওপর চাপিয়ে দিতে। কিন্তু চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। অতএব ওই যুদ্ধকে আর কোনওভাবেই গৃহযুদ্ধ বলা যায় না, এটি একটি যুদ্ধ, রক্তপাতময় রাজনীতি। এটিকে দুই ভাইয়ের বিবাদও বলা যায় না, এটি পৃথক-পৃথক জাতি-রাষ্ট্রীয়-নাগরিক সত্ত্বার সংঘাত, যার জন্যে প্রাণ দিতে হয়েছে লাখ লাখ মুক্তিকামী বাংলাদেশিকে, হাজার হাজার ভারতীয় সৈনিককে।
যুদ্ধাপরাধ যারা করেছিল, তারা তাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্বাধীনতার পর প্রথমেই দু’টি বিষয় প্রচারণায় নিয়ে আসে। একটি হলো, ভারত তার নিজস্ব স্বার্থ থেকে এই যুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে। তাদের প্রচারণার দ্বিতীয় অংশটি ছিল, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা বাড়িয়ে বলা হয়েছে; এ যুদ্ধে মোটেও ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়নি, যেন ৩০ লাখের বদলে তিন হাজার মানুষ শহীদ হলেই পাকিস্তানীদের ওই গণহত্যা হালাল হয়ে যায়!
প্রথম প্রচারণাটি খেয়াল করুন,- এই প্রচারণার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত-যে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, আমাদের বন্ধু হিসেবে সহায়তা করেছিল সেটি ভুলে যাওয়ার ও ইতিহাসগত দিক থেকে অকৃতজ্ঞ হওয়ার মনস্তত্ব তৈরির অপচেষ্টা করা হয়েছে। ভারত একটি আলাদা রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য করার পেছনে নিশ্চয়ই তাদের একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, বাংলাদেশের মানুষই চেয়েছিল বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র হোক; বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধে না নামলে কি ভারতের পক্ষে কখনো সম্ভব হতো বাংলাদেশকে যুদ্ধের জন্যে সহযোগিতা করা? কোটি শরণার্থী মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে ভারত, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছে, এর জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পরেও কি শেখ মুজিবুর রহমান ফিরিয়ে দেননি ভারতীয় সৈনিকদের বাংলাদেশের মাটি থেকে? ‘বাংলাদেশ আলাদা হলে পাকিস্তান দুর্বল হয়ে পড়বে বলেই ভারত যুদ্ধে সাহায্য করেছে’ বলে কি প্রকারান্তরে বাংলাদেশের মানুষদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকেই ছোট করে দেখা হয় না? প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ওয়ারসিমেট্রিগুলিতে গেলে হাজার হাজার নিহত যোদ্ধার ভিড়ে আমরা ভারতীয় যোদ্ধারও নাম পাই, ওই নামগুলি রাখতে ইংরেজরা তো কুণ্ঠিত হয় না, অথচ আমাদের লাখ লাখ শহীদের ভিড়ে আমাদেরই জন্যে শহীদ ভারতীয়দের স্বীকৃতি দিতে গিয়ে এরকম একটি বাক্যের প্রয়োগ যারা করতে পারেন, তারা আসলে কোন জাতের মানুষ, আপনারাই বলুন!
এবার দ্বিতীয় প্রচারণাটি খেয়াল করুন। এর আরেক অর্থ শহীদদের নিছক সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে উপহাস করা। তা ছাড়া প্রকৃত সত্যও গোপন করা। বিষয়গুলি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন তরুণ গবেষণার ভিত্তিতে আলোচনা করেছেন। আমি সেসব লেখা থেকেই কিছু তথ্য নিয়ে কয়েকটি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করব। সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীতে একদল বুদ্ধিজীবীর প্রকাশ ঘটেছে, যাদের কাজই হলো বিশ্বে সংগঠিত গণহত্যা বা হলোকস্টগুলিকে হেয় করে দেখা। বিভিন্ন গণহত্যাকে যারা অতীতে সমর্থন করেছেন, যারা সেসবের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা এবং তাদের উত্তরাধিকাররা অলিখিত এক সমঝোতার ভিত্তিতে, কেউ আবার নতুন রাজনৈতিক স্বার্থে এই গবেষণাগুলি করে চলেছেন। এই বুদ্ধিজীবীদের দলে রয়েছেন ইরানের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমেদিনেজাদ, ডেভিন হগান, ভেডিভ আরভিং, বার্নার্ড লুইস, গুন্টার লিউই, জাসটিন ম্যাককার্থি, সিমোন পেরেস, ব্যাডলি স্মিথ থেকে শুরু করে ভারতের শর্মিলা বোস পর্যন্ত বিভিন্নজন। রাষ্ট্রপতি আহমেদিনেজাদ কয়েক বছর আগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, সময় এসেছে ইহুদি হলোকস্টকে ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার। কী সেই ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি? না, ঘটনাটি যে অতিরঞ্জন, সেটিই এখন তুলে ধরতে হবে। প্রশ্ন হলো, প্যালেস্টাইন, ইরান, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে যে গণহত্যা চলছে সেটিকে বড় করে দেখার জন্যে কি আদৌ ইহুদি হলোকস্টকে ছোট করে দেখার প্রয়োজন রয়েছে? কিন্তু সত্য উদ্ঘাটনের নামে সেটিই করছেন আহমেদিনেজাদ। কেননা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে তেমন ইহুদি মারা যায়নি এটি দেখানোর মধ্যে দিয়ে কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ইসরাইলকেই ঘায়েল করা যায় না, সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগও তুলে ধরা যায় যে তারা ইতিহাস ও তথ্য বিকৃত করছেন!
শর্মিলা বোসের মিশনও একই রকম। তিনি বলছেন, বাংলাদেশের যুদ্ধে শহীদ ও ধর্ষিতার সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। অথচ জনসংখ্যাতাত্ত্বিকরা অনেক আগেই ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের ভোটারের সংখ্যার পার্থক্য থেকে, মুক্তিযুদ্ধের আগের ও পরের আদমশুমারী ও জনসংখ্যার হারবৃদ্ধির প্রবণতা পর্যালোচনা করে প্রমাণ করেছেন, ৩০ লাখ মানুষ-যে গণহত্যার শিকার হয়েছে, বাংলাদেশের এই দাবি মোটেও অমূলক নয়। একইভাবে ইতিহাসবিদরা এ-ও বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের যুদ্ধকালীন সময়ের নিরিখে পাকিস্তানের ৯০ হাজার সদস্যের সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে বাংলাদেশে ওই নারীধর্ষণ ঘটানোর তথ্য সঠিক। উল্লেখ্য, পৃথিবীতে নারী ধর্ষণের সাম্প্রতিক ভয়াবহ ঘটনাগুলি ঘটে রুয়ান্ডাতে। সেখানে মাত্র ১০০ দিনে আড়াই লাখ থেকে পাঁচ লাখ নারী ধর্ষিতা হন। কিন্তু শর্মিলা বোস তার গবেষণায় প্রথমেই যে কাজটি করেছেন, তা হলো, যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনা সদস্যের সংখ্যা কমিয়ে দেখিয়েছেন!
তা হলে নেতাজি সুভাষ বোসের আত্মীয়া শর্মিলা বোস এরকম দাবি করছেন কেন? এর জন্যে আরেকটি তথ্য জানা জরুরি : শর্মিলা বোস যখন ওই গবেষণাকর্ম করছিলেন, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল জোট সরকার আর শিল্পমন্ত্রী ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। এই শিল্পমন্ত্রীর পিছনে একটি বিনিয়োগ চুক্তির জন্যে ঘুর ঘুর করছিল টাটা কোম্পানী। আর ওই টাটা কোম্পানির ব্রিটিশম্যান, টাটা সনস-এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, টাটা গ্রুপ সেন্টারের অন্যতম সদস্য ডিরেক্টর ছিলেন অ্যানাল রোসলিং,- যিনি শর্মিলা বোসের স্বামী।
এ প্রসঙ্গে একটি বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘‘শর্মিলা বোসের একাডেমিক জ্ঞানচর্চা ও সাংবাদিকতার অনেকটাই নাকি হয়ে থাকে তাঁর স্বামী অ্যানাল’এর কোম্পানি স্বার্থে। জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী নিজামী কেন টাটার বিনিয়োগপ্রস্তাবকে সমর্থন করবেন না, যদি মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা ও ধর্ষণকে প্রশ্নবিদ্ধ করার নিশ্চয়তা দেয়া হয় টাটার পক্ষ থেকে?’’
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
এখন, আপনারাই বলুন, ‘যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটির রাজনীতিকরণ’ আসলে কী? আর কারাই বা সেটা করছে? ১৯৭১ সালে আমরা রক্তপাতময় রাজনীতি করেছি, এখনও কি সময় আসেনি রক্তপাতহীন যুদ্ধ করার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার?
সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে… কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!