ঝাঁজর বলে চালুনি, তোরই বেশি…

লোকে বলত, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনও সূর্য অস্ত যায় না। মৃত্যু ঘটেছে সেই প্রবাদের। সাম্রাজ্য হারানোর পর ব্রিটিশ শাসকরা সারা পৃথিবীকে দেখাতে থাকে তাদের সংসদীয় গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক আভিজাত্য। বিশ্বের সংসদীয় গণতন্ত্রের মডেল হয়ে ওঠে দেশটি। স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া পুরনো সব উপনিবেশগুলি নিয়ে তারা গড়ে তোলে কমনওয়েলথ। গণতন্ত্রের দীক্ষা নিতে উদগ্রীব কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলি গণতান্ত্রিক হয়ে উঠতে না পারলেও ব্রিটেন ঠিকই হয়ে ওঠে অভিজাত গণতান্ত্রিক পুরোহিত।

কিন্তু এবার সেই আভিজাত্যেও টান পড়েছে। গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ভয়ানক এক কালো ছায়া পড়েছে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট-এর উপরে। প্রথম কয়েক সপ্তাহ জুড়ে ব্রিটেনের দৈনিকগুলির প্রথম পাতা থেকে শুরু করে ভেতরের বেশ কয়েকটি পাতা দখলে ছিল সরকারী ও বেসরকারী সাংসদদের আর্থিক অনিয়মের বিভিন্ন কীর্তিকাণ্ডের খবরে। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের নামও ছিল সেই তালিকায়। অবশ্য আগেভাগেই বিলের অর্থ ফিরিয়ে দিয়ে আর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি নাম কাটান সেই তালিকা থেকে। কিন্তু তালিকা থেকে নাম কাটাতে পারেননি জ্যাক স্ট্র, হ্যাজেল ব্লেয়ার্স, অ্যালিয়েস্টার ডার্লিং, জেফ হুন, মার্গারেট বেকেট, স্পীকার মাইকেল মার্টিন, ইমিগ্রেশান মিনিস্টার ফিল ওলাস, মার্গারেট মোরান, পর্যটন মন্ত্রী বারবারা ফোলেট, ফিল হোপ প্রমুখ। মানুষের চোখ কপালে ওঠে, অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে, যখন জানা যায়, বিচারবিষয়ক মন্ত্রী শাহিদ মালিকও আইনকানুনের ও নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে তাঁর দ্বিতীয় বাসভবনের বিপরীতে গত তিন বছরে ৬৬,০০০ পাউন্ড তুলেছেন! সংসদের আর কারও পক্ষেই না কি সম্ভব হয়নি এত বিশাল অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়া। এ ঘটনার রেশ ধরে মন্ত্রীসভা থেকে শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে হয় শাহিদ মালিককে। অবশ্য শাহিদ মালিককে বিদায় করার আগে প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন আরও একজনকে বিদায় করেন সংসদীয় লেবার পার্টি থেকে। তিনি লেবারের প্রাক্তন পরিবেশ মন্ত্রী এলিয়ট মর্লে। নির্বাচনী এলাকার বাসভবনটির মর্গেজ শোধ করার জন্যে তিনি ১৬,৮০০ পাউন্ড দাবি করেছিলেন, তাও সমস্ত ঋণ শোধ হবার ২০ মাস পরে।

এতো ছিল সরকারি দলের অবস্থা। বিরোধী দলের দশাও খুব ভালো নয়। ডেভিড ক্যামেরুনের জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক ও সংসদীয় উপদেষ্টা ছিলেন এ্যান্ড্রু ম্যাকেই। এক অর্থে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়ে গেছে। ম্যাকির প্রতি ক্যামেরুনের যত টানই থাকুক, দলকে এবং বিরোধী দলীয় প্রধানের পদকে প্রশ্নমুক্ত রাখার প্রয়োজনে ম্যাকিকে তিনি ত্যাগ করেছেন। আর তাই পদত্যাগ করতে হয়েছে অ্যান্ড্রু ম্যাকেইকেও। মাত্র একটি বাসভবনের মালিক হলেও অ্যান্ড্রু দ্বিতীয় বাসভবন দেখিয়ে আর্থিক অনুদান নিয়েছিলেন। ম্যাকেই বলেছিলেন, তাঁর প্রধান বাসভবন হলো ওরচেস্টারশায়ারের ব্রমসগ্রোভে আর দ্বিতীয় বাসভবন লন্ডন শহরে। কিন্তু তাঁর স্ত্রী জুলি কার্কব্রাইড বলেছিলেন ঠিক উল্টো। এইভাবে ধরা খেয়েছেন তাঁরা দু’জন। স্বামী-স্ত্রী মিলে তাঁরা থাকেন লন্ডন শহরে। তাঁর স্ত্রী জুলি কার্কব্রাইড নিজেও সাংসদ একজন। স্বামী-স্ত্রী দু’জন লন্ডনের যে বাসভবনে থাকতেন, সেটির জন্যে অ্যান্ড্রু ম্যাকেই নিয়েছেন ১৪০,৯৫২ পাউন্ড। আর স্ত্রী জুলি লন্ডনের এই বাসাকে তার প্রধান বাসভবন দেখিয়ে ব্রুমসগ্রোভ এলাকায় তাঁর কেনা একটি বাড়ির জন্যে দাবি করেন ১৪১,৭৭৯ পাউন্ড। এই প্রক্রিয়ায় সরকারি তহবিলের ২৮২,৭৩১ পাউন্ড উত্তোলনের দায়ে শেষমেষ পদত্যাগ করতে হয়েছে অ্যান্ড্রু ম্যাকেইকে।
প্রথমে এসব মন্ত্রী ও সাংসদদের সকলেই দাবি করেছিলেন, বাসভবন ও আনুসঙ্গিক বিভিন্ন প্রয়োজনে তারা যেসব খরচ করেছেন, অর্থ নিয়েছেন, তার সবটাই আইনসঙ্গত। কিন’ পাপ চাপা থাকে না। কানাঘুষা শুরু হয় তাদের দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে। এসব মন্ত্রী ও সাংসদরা তখন অর্থ ফেরৎ দিতে শুরু করেন। কিন্তু তারপরও ঘটনা থেমে থাকেনি। মিডিয়ায় এসব খবর ছাপা হতে শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনার ঝড় ওঠে নিঃস্তরঙ্গ ব্রিটনবাসীদের আড্ডাগুলিতে। প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের মন্ত্রিপরিষদ থেকে পরপর নয়জন মন্ত্রী পদত্যাগ করেন, স্থানীয় নির্বাচনে লেবার পার্টির অবস্থান নেমে আসে তৃতীয় স্তরে, ইউরোপিয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টেও ভরাডুবি ঘটে লেবারদের; কিন্তু তারপরও প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন শেষ পর্যন্ত সক্ষম হন পরিস্থিতি সামাল দিতে, কেননা নির্বাচনের মাত্র এক বছর আগে নেতৃত্ব পরিবর্তনের ঝুঁকি নিতে আগ্রহ দেখায়নি লেবার পার্টির সাংসদরা। এখন বরং জোরেশোরে উঠে আসছে রাজনৈতিক সংস্কারের কথা। কেউ কেউ বলছেন, লিখিত সংবিধানের পথে পা বাড়াতে হবে ব্রিটেনকে। গর্ডন ব্রাউনও বলেছেন, ভদ্রলোকদের ক্লাব হিসেবে ওয়েস্টমিনিস্টারকে বিবেচনা করার দিন এখন শেষ। এখন থেকে সাংসদ ও মন্ত্রীদের অর্থনেতিক বিষয়াদি তদারকি করা হবে, এসব থেকে তাদের নিজেদের বক্তব্যকেই আর যথেষ্ট মনে করা হবে না। এর মধ্যে আবার বর্ণবাদী দল বিএনপির নির্বাচনে বিজয় শংকিত করে তুলেছে সবাইকে। সব মিলিয়ে যে সমালোচনার যে ঝড় উঠেছে, তা হয়তো অচিরেই স্তিমিত হয়ে আসবে। কিন্তু তারপরও ব্রিটিশ সংসদীয় গণতন্ত্রের ঐতিহ্যে এসব ঘটনার মধ্যে দিয়ে যে কালো অধ্যায় রচিত হলো, তা বার বার ফিরে আসবে উদাহরণ হিসেবে।
 
দুই.
আমরা ব্রিটেনের এইসব রাজনীতি থেকে যোজন যোজন দূরের মানুষ। তারপরও ওই স্থান থেকে দুর্নীতি-অনিয়ম যে-দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, মিডিয়ার কল্যাণে তা আমাদের নাকের ওপরে এসেও ঘাই মারছে। কাকতালীয় ঘটনা হলো, বাংলাদেশেও এই মুহূর্তে পূর্ববর্তী সংসদের স্পীকার, ডেপুটি স্পিকার ও চিফ হুইপের দুর্নীতির দুর্গন্ধ ঘাই মারছে। দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন না দেয়ার পরেও চিকিৎসার জন্যে সংসদীয় তহবিল থেকে লাখ লাখ টাকা তুলেছেন সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীনকে নাস্তা করানোর জন্যেই নাকি তিনি ব্যয় করেছেন ৭০ হাজার টাকা। ১২ লাখ টাকার আসবাবপত্রও কিনেছেন তিনি, যদিও সেগুলো এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই তিন সাবেক মিলে চিকিৎসার করার জন্যে চিকিৎসা খাত থেকে তুলেছেন ৩৫ লাখ টাকা। আখতার হামিদ সিদ্দিকী তো রাশিয়ায় ব্যক্তিগত সফরের পেছনে টাকা খরচ করে তা চালিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসা খাতের নামে, এমনই করিৎকর্মা তিনি। একই কাজ করেছেন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। সরকারি ভবনের টিভি পর্যন্তও তিনি সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন বাসা ছাড়ার আগে। দুর্নীতি করতে কোনও লুকোচুরি খেলেননি তারা, কেননা তাদের ধারণা ছিল যুগের পর যুগ তারাই নির্বাচিত হবেন এবং সরকার গড়বেন।
এমনকি সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অব্যাহত ছিল এই তিন সাবেকের দুর্নীতির খেলা। ১১ জানুয়ারিতে ক্ষমতার সিংহাসনে চড়ে বসা সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের শাসনামলেও সংসদ সদস্যদের জন্যে এরা ওষুধ কিনেছেন ৫৪ লাখ টাকার। এসব খরচ অনুমোদন করেছেন সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার। সংসদ না থাকলেও বিদেশে সংসদীয় দল পাঠানোর কাজ অব্যাহত রাখেন সাবেক স্পিকার। এইভাবে একটি সংসদহীন সরকারের সময় সংসদীয় প্রতিনিধি দলের বিদেশ সফরের পেছনে ব্যয় দেখানো হয় প্রায় ৫০ লাখ টাকা। সাবেক স্পীকার এ সময় দেশে দেশে ঘুরে বেরিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে গেছেন। আর এসব সফরকে দেখিয়েছেন সংসদীয় দলের সফর হিসেবে। একই কাজ করেছেন ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকীও। পছন্দের মানুষজন নিয়ে বিদেশ সফর করেছেন তারা।

বাংলাদেশের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সম্প্রতি এসব দুর্নীতি নিয়ে তদন্তের পর সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিনকে তলব করেছেন। আর তিনি এর জবাবে জানিয়েছেন, ‘ডাকার মতো করে ডাকলে’ তিনি যাবেন। আমাদের জানা নেই, ঠিক কেমন করে ডাকলে তিনি সাড়া দেবেন। আমরা জানতাম, ডাকার মতো করে ডাকলে নাকি কেবল দয়ালই সাড়া দেয়, এখন দেখা যাচ্ছে জমিরউদ্দিন সরকারই বাংলাদেশের হাজার বছরের লোকজ সাধকদের সেই মহান দয়াল বাবা! সাবেক ডেপুটি স্পিকার অবশ্য জেলে আছে, তবে খোন্দকার দেলোয়ার মাঠেই আছেন, এসব অভিযোগ তুলে আসলে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে বলে দাবি করে আসছেন তিনি। স্থায়ী কমিটির ডাকে তিনিও সাড়া দেবেন বলে মনে হয় না।

শুধু বিএনপি নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রও যিনি একসময় অন্তরালে থেকে পরিচালনা করতেন, সেই তারেক রহমান অবশ্য এখন লন্ডনেই আছেন। আর হয়তো ব্রিটেনের রাজনীতিকদের এইসব কীর্তিকলাপ দেখতে দেখতে চিন্তা করছেন, তা হলে তাঁরা দোষ করেছিলেন কোথায়। হয়তো তাঁর কিছুটা রোষও জাগছে, এটি চিন্তা করে যে, ব্রিটেনের এইসব রাজনীতিকদের অনেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশে গিয়ে দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে সমর্থন দিয়েছিলেন, রাজনীতিকদের ছবক দিয়েছিলেন সুশাসনের নানা রাস্তাঘাট নিয়ে। আমাদের মনে আছে, বাংলাদেশের ২০০১ সালের নির্বাচন ও নির্বাচনপরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে যখন মার্কিন রাষ্ট্রের কর্ণধাররা কিছু বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন, তখন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান উল্টো বলেছিলেন, ‘আমাদেরও জানা আছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কীভাবে জর্জ বুশ নির্বাচনে জিতেছিলেন’। হয়তো তারেক রহমানও একসময় বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন। হয়তো তখন আবারও ব্রিটিশ রাজনীতিকদের কেউ ছবক দিতে যাবে। জানি না তখন তিনি কী বলবেন। মাসতুতো ভাই হওয়ার একটি সূত্র আছে বাংলার প্রচলিত প্রবাদ অনুসারে। জানি না সেরকম আবার হবে কি না। তবে অভিযুক্ত সাবেক সংসদীয় নেতারা যেভাবে আওয়াজ দিচ্ছেন আর আওয়ামী লীগ সরকারও গদ গদ হয়ে যেভাবে ‘রাজনৈতিক মামলা’ প্রত্যাহারের সময় বাড়াচ্ছেন, তাতে আমাদের জন্যে তেমন কোনও সুসংবাদ নেই বলেই মনে হচ্ছে। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই হবে আর চেলাগুলো গামছা ধরবে, এটিই চিরাচরিত নীতি যে!

তিন.
তবে দেখার ব্যাপার, দুর্নীতির অভিযোগ ফাঁস হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটেনের সরকারি ও বেসরকারি দলের প্রধান নেতারা এক হয়ে গেছেন, এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিচ্ছেন, তা যতই লোক দেখানো হোক না কেন। খবর ফাঁস না হলে যে তারা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেন না, তা বলাই বাহুল্য। এর বিপরীতে বাংলাদেশে যা ঘটে, দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার সংবাদ প্রকাশ পেলে তা যেন রাজনীতিকদের অলঙ্কার হয়ে ওঠে। তাদের চেলারা বলেন, ‘সোনাতেও খাঁদ থাকে, সোনার আংটি বাকাও ভালো’। এমনই অবস্থা দেশটির। ব্রিটেনের একটি ঘটনা আছে, এই ব্লগেই সেটি কিছুদিন আগে একজন তুলে ধরেছিলেন,- মার্কিন সিনেট কমিটি নিকট অতীতে একবার বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ব্রিটিশ রাজনীতিক জর্জ গ্যালাওয়েকে তলব করেছিল। গ্যালাওয়ে তাদের সেই আহ্বানকে উপেক্ষা করতে পারতেন, আইনগতভাবে কিংবা অন্য কোনওভাবেই গ্যালাওয়েকে আটকাতে পারত না মার্কিন সিনেট কমিটি। কিন্তু জর্জ গ্যালাওয়ে সেই আহ্বানকে উপেক্ষা করেননি, বরং সিনেট কমিটির সামনে হাজির হয়ে প্রশ্নের জবাব দেয়ার পাশাপাশি পাল্টা প্রশ্ন করে তাদেরই বিপর্যস্ত করে তুলেছিলেন। বিএনপির এই তিন সাবেক সংসদীয় নেতা যদি নিজেদের সাচ্চা মনে করেন, তা হলে একই পথ বেছে নিতে পারেন; উল্টো সংসদীয় কমিটিকে বলতে পারেন, হ্যাঁ, আমরা সংসদীয় কমিটির মুখোমুখি হবো, তবে তা সরাসরি দূরদর্শনে সম্প্রচার করতে হবে। কিন্তু, সে-গুড়ে বালি, তারা যে সে পথে যাবেন না, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়,- সে কথা জানা আছে আমাদের। কিন্তু তাই বলে কি ঠগ বাছা বাদ দেব আমরা? যে গ্রাম ঠগের গ্রাম, সে গ্রামে হয়তো ঠগ বেছে শেষ করা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশ কি ঠগের গ্রাম? এটি এমন এক দেশ যেখানে কোটি কোটি কৃষক রোজা রেখেও কঠোর রোদবৃষ্টিতে মাঠে কাজ করে, রিকশাওয়ালা-ঠেলাগাড়িওয়ালারা রিকশা-ঠেলা চালায়, অথচ মুষ্ঠিমেয় ধনীদের আরামের গাড়িবাড়ির দরকার হয়, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের রোজার সময়ে ছুটির কিংবা সংক্ষিপ্ত অফিস সময়ের দরকার হয় (এটি কেবল একটি উদাহরণ, এরকম আরও অনেক উদাহরণ আছে)। দুর্নীতিবাজ বলুন আর অনিয়মকারী বলুন, তারা আসলে এরকম সুবিধাভোগী বৃত্তের মানুষ এবং এদের সংখ্যা খুবই কম। তাই ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হওয়ার প্রশ্নই আসে না বাংলাদেশে। যা কিছু সত্যিই নষ্ট হয়, তার শুরু না কি হয় মসিত্মষ্ক দিয়ে। অতএব কি ব্রিটেনে কি বাংলাদেশে সুশাসন যদি আনতেই হয়, তবে দুর্নীতি-অনিয়মের বিচার করতে গিয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে সর্বোচ্চ পর্যায়কে, দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে বিশেষত রাজনীতিবিদদের, সামরিক কর্মকর্তাদের, ব্যবসায়ীদের এবং আমলাদের দুর্নীতি-অনিয়ম-সন্ত্রাসকে। তা না হলে ঝাঁজর চালুনিকে দেখাবে, চালুনি আবার ঝাঁজরকে দেখাবে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না।

অবিশ্রুত

সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে... কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!

৩ comments

  1. আরমান রশিদ - ১৬ জুন ২০০৯ (১:২৬ পূর্বাহ্ণ)

    অগ্রাধিকার দিতে হবে সর্বোচ্চ পর্যায়কে, দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে বিশেষত রাজনীতিবিদদের, সামরিক কর্মকর্তাদের, ব্যবসায়ীদের এবং আমলাদের দুর্নীতি-অনিয়ম-সন্ত্রাসকে।

    আপনি আমলাদের কথা বলায় হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল। কদিন আগে মনে হয় পত্রিকায় দেখেছিলাম দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরো কার্যকর করতে সরকার তাদের এখতিয়ার সীমিত করে দিয়েছে। সরকারি চাকুরেরা আর কমিশনের আওতাভুক্ত নয়। আশা করি কমিশনকে আরো গতিশীল করতে শিগগিরি তাদের এখতিয়ার আরো কমিয়ে শুধুমাত্র গরুচোর আর পকেটমারদের জন্য সীমাবদ্ধ করা হবে।

    • অবিশ্রুত - ১৭ জুন ২০০৯ (১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ)

      মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব। নিশ্চয়ই দেখেছেন আপনি, এই ভদ্রলোক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কী করেছে! কেউ যদি মন্ত্রী বা সাংসদ থাকা অবস্থায় এরকম করত, তা হলে বিক্ষুব্ধ জনগণ হয়তো সুযোগসুবিধামতো তাদের মিছিলে শ্লোগান দিতো, ‘…এর দুই গালে/ জুতা মারো তালে তালে’। কিন্তু উনি সৌভাগ্যবান, তাই এরকম শ্লোগান দিয়ে ক্ষোভ উপশমেরও সুযোগ নেই জনসাধারণের।
      ঠিকই বলেছেন, আরমান রশিদ, এখতিয়ার কেবল গরুচোর আর পকেটমারদের জন্যেই থাকবে। তবে সেক্ষেত্রেও জটিলতা দেখা দিতে পারে। এই সংবাদটিও নিশ্চয় আপনার চোখে পড়েছে। রাষ্ট্র এসব করে আসলে কী মেসেজ দিতে চায়? চাঁদাবাজদের ভীত করতে চায়, নাকি সাধারণ জনগণকেই ভীত করতে চায়?
      তাজপুত্র সোহেল তাজের ভাবেসাবে অবশ্য মনে হচ্ছে, এভাবে মানুষ মারাটাই সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি দূর করার পথ! তাই বলছেন, তাদের আমলে কোনও ক্রসফায়ার এখনও হয়নি (তা ঠিক, ক্রসফায়ার তো নয়, ওগুলো আসলে ফায়ার)! আওয়ামী লীগ নিজেই চায় তাজউদ্দীনকে তার প্রাপ্য অবস্থান থেকে দূরে রাখতে, আর তার সুপুত্রের ভাবসাবে মনে হচ্ছে নিজের দুর্মতি দেখিয়ে সে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দিয়েই বলাতে বাধ্য করবে যে, এমন ভালো বাপের পোলা এমন সব কথাবার্তা আর কাজকর্ম করে কেন!

  2. সৈকত আচার্য - ২১ জুন ২০০৯ (৫:৫৮ অপরাহ্ণ)

    @অবিশ্রুতঃ
    জমির সরকার গং’রা সব সময় সরকারেই থাকতে চান। পৈত্রিক জমিদারি হারালে মনের যে মরণদশা হয়, এখন তাদের সেই অবস্থা! এখন বেশ গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে চেচাচ্ছেন। আইনের শাসনের কথা বলে আমাদের আবারো বেয়াকূপ বানাচ্ছেন প্রতিদিন। এই সেদিনও যখন সামরিক তত্ত্বাবধায়করা ক্ষমতায় ছিলেন, এই জমির উ সরকারকে সাংবাদিকরা যখন প্রশ্ন করলেন, স্যার বলেন, এটা কি সাংবিধানিক সরকার না অবৈধ সরকার? জমির সরকার কিছুক্ষন চিন্তা করে (আসলে আব্দুল জলিল-সেলিম সাহেবদের সে সময়ের কথা ভেবে) বেশ বিজ্ঞের মতো করে বলেছিলেন, আসলে এটাকে আমি অবৈধ সরকার বলতে চাই না……এটা আসলে একটা ইররেগুলার সরকার (অনিয়মিত সরকার)।
    আইনের ছাত্র হিসেবে ইররেগুলার ম্যারেজের (যেমন, মুসলিম- খ্রিষ্টান) কথা জানতাম। কিন্ত এ ধরনের একটা সরকারের কথা তার মুখ থেকে সেই প্রথম শুনলাম। সুবিধাবাদী এবং তথাকথিত এই আইনজ্ঞ স্পীকার মহোদয় পরিস্কার করে বলেননি, সংবিধানের কোথায় এই ইররেগুলার সরকার ব্যবস্থার প্রেসক্রিপশন দেয়া আছে। নৈতিক এবং রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের চরম শিকার এই ব্যক্তিগণের কাছে সংসদীয় কমিটির সামনে হাজির হওয়ার মনোবল থাকার কথা নয়।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.