(গত পর্বের পর)
পদত্যাগের কারণ সংসদীয় কমিটিতে তলব?
সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তলবের কারণেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানের পদ থেকে লেফট্যানেন্ট জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধূরী পদত্যাগ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন বলে মনে করা হচ্ছে। এই স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান হচ্ছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. মহীউদ্দিন খান আলমগীর।
সূত্র জানায়, গত এক এপ্রিল অনুষ্ঠিত সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ে আলোচনার জন্য পরবর্তী বৈঠকে হাসান মশহুদ চৌধূরীকে তলব করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁকে নোটিস দিয়ে তলবের কথা বলা হয়। এ খবর জানার পর এবং সরকারের সঙ্গে চলমান টানাপোড়েনসহ একাধিক কারণে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন হাসান মশহুদ।
অসহযোগিতাও অন্যতম কারণ?
সরকারের চাপ ও অসহযোগিতার কারণেই চলে যেতে হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরীকে। দুদক-এর দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, ইদানীং সরকারের পক্ষ থেকে কোন সহযোগিতাই করা হচ্ছিল না তাকে।
জানা গেছে, এই অসহযোগিতার অংশ হিসেবে দুদক-এর মতামতের তোয়াক্কা না করেই দু’ কর্মকর্তার নিয়োগ আদেশ বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার অন্য দু’জনকে দুদক-এর ঊর্ধ্বতন দু’টি পদে নিয়োগ দেয়। এ কারণে এক কর্মকর্তাকে কোন দায়িত্বও দেয়নি দুদক। এছাড়াও দুদক-এর মতামত না নিয়ে পরিচালক পদে আরও কয়েকটি নিয়োগ দেয় সরকার। সর্বশেষ দুদক-এর সহকারী পরিচালক, উপ-পরিচালক ও পরিচালক পর্যায়ে পদোন্নতি দেয়ার বিষয়ে গঠিত কমিটির বৈঠক নিয়ে সরকারের সঙ্গে হাসান মশহুদ চৌধুরীর সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে।
দুদক-এর সচিবের সভাপতিত্বে পদোন্নতি বিষয়ক কমিটির এ বৈঠক হওয়ার কথা ছিল গত ২৯ মার্চ। পদোন্নতি কমিটির পাঁচ সদস্যের মধ্যে ওই দিন সরকারি এক সদস্য বৈঠকে উপস্থিত না হওয়ায় তা স্থগিত করে পরদিন ৩০ মার্চ করার সিদ্ধান্ত হয়। পরের দিনও ওই সদস্যকে পাঠানো হয়নি বৈঠকে। পরে চেয়ারম্যান খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ইঙ্গিতেই তাকে বৈঠকে যেতে বারণ করা হয়। এরপরই পদত্যাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন হাসান মশহুদ চৌধুরী। এর একদিন পরই তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান।
এছাড়া আরও কিছু বিষয়েও কেবিনেট থেকে দুদককে অসহযোগিতা করা হয়। যেমন, দুদকের জনবল কাঠামো অনুমোদন করেনি সরকার। মামলা পরিচালনায় এটর্নি জেনারেলের অফিস থেকেও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়া হচ্ছিল না। রাজনৈতিক মামলা হিসেবে দুদকের মামলা প্রত্যাহার নিয়েও টানাপড়েন চলে। সরকারের এ উদ্যোগের মধ্যেও ২২ মার্চ একটি গোলটেবিল বৈঠকে দুদক চেয়ারম্যান ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, মামলার বিষয়ে দুদক তার আগের অবস্থানেই থাকবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অঙ্গীকার ছাড়া দুর্নীতি দমন সহজ নয় জানিয়ে তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক ইচ্ছা দৃশ্যমান হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানো মুশকিল হয়ে পড়বে।
দুদক থেকে হাসান মশহুদ চৌধুরীর প্রস্থানের বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায় জাতীয় সংসদে যখন তার বিরুদ্ধে এমপিরা নানা সমালোচনা করছিলেন। তার কথাবার্তাতেও কিছুটা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে তিনি সরকারের তরফে চাপের মধ্যে রয়েছেন। তবে সবসময়ই তিনি সরকারের চাপের বিষয়টি গোপন রাখতে চেয়েছিলেন। বৃৃহস্পতিবারও পদত্যাগের খোলামেলা কোন কারণ জানাননি তিনি। কেবল বলেছেন বর্তমানে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেক্ষেত্রে দুদক-এ গতি আনতে হলে নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজন। পরিস্থিতিটা কি তার কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে তিনি বলেন, সেটা সবাই জানেন। এদিকে তার কমিশনের আরও দুই কমিশনার সাবেক জেলা জজ মো. হাবিবুর রহমান ও সাবেক এনবিআর সদস্য আবুল হাসান মনজুর মান্নানের পদত্যাগের বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছে। তবে তাদের কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি।
পদত্যাগে সরকারের চাপ ছিল না ॥ আইনমন্ত্রী
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করার জন্য লে, জেনারেল (অব,) হাসান মশহুদের ওপর সরকারের তরফ থেকে কোনো চাপ ছিল না। গত শুক্রবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা জানিয়ে বলেন, বরং এখন এই প্রশ্ন তোলা যায় বিগত দুই বছরে কোনো চাপের মুখে পড়ে তিনি রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন কীনা। এ প্রসঙ্গে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা ভাসমান বিদ্যুৎ কেন্দ্র মামলার উল্লেখ করে বলেন, এই মামলাটির মতো আরো অনেক মামলা দায়ের করা হয়েছিল রাজনৈতিক উদ্দেশে।
নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ ও দুদক পুনর্গঠন সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেন, দুদক আইনে বলা আছে বাছাই কমিটি চেয়ারম্যান নিয়োগের বিষয়ে সুপারিশ করবে। সেই অনুযায়ীই চেয়ারম্যান নিয়োগ হবে। এখানে সরকারের নিয়োগ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রয়োজনে দুদক বিধিমালার পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, আমরা যদি দেখি যে বিধিমালার কোথাও ত্রুটি আছে তাহলে সেটা পরিবর্তন করা হবে। তবে আইনে পরিবর্তন করা হবে না, আইন ঠিক আছে।
চেয়ারম্যানের পদত্যাগের ফলে দুদকের কাজকর্মে ভাটা পড়বে না উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, সরকার দুদককে শক্তিশালী করতে সবরকম সহায়তা দেবে।
পদত্যাগ করলেও তাকে বৈঠকে উপস্থিত হতেই হবে ॥ আলমগীর
সংসদীয় কমিটিতে দুদক চেয়ারম্যান হাসান মশহুদকে তলবের বিষয়ে মহীউদ্দিন খান আলমগীরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে তিনি জানান, হাসান মশহুদের কাছে কমিটির চিঠি ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে, না গেলে শিগগিরই পৌঁছে যাবে। পদত্যাগ করলেও হাসান মশহুদকে বৈঠকে উপস্থিত হতেই হবে।
প্রসঙ্গত, সাংসদ ড. মহীউদ্দিন খান ১/১১ এর পর দুদকের তালিকাভুক্ত অভিযুক্ত হয়ে নিম্ন আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি সংসদের ভেতর-বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে হাসান মশহুদের কড়া সমালোচনা করেন।
সূত্রমতে, এক এপ্রিল সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়, কমিটির আগামী বৈঠকের পরের বৈঠকে দুদক সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। ওই বৈঠকে হাসান মশহুদকে উপস্থিত থাকার জন্য নোটিস জারিরও সিদ্ধান্ত হয়।
এদিকে, দুদক সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত কমিটির অধীন না হলেও এর চেয়ারম্যানকে কমিটি তলব করতে পারে কি-না, এ ব্যাপারে কমিটি প্রধান ড. মহীউদ্দিন আলমগীরকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, দুদক এই কমিটির অধীন প্রতিষ্ঠান না হলেও সম্পর্কিত কোনো বিষয়ে আলোচনার জন্য কমিটি সংশ্লিষ্ট যে কাউকে বৈঠকে ডাকতে পারে। আমরা কমিটির পক্ষ থেকে হাসান মশহুদ চৌধূরীকে ডেকেছি। কমিটি দুদক সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং আলোচনা হবে।
জানা গেছে, স্থায়ী কমিটি গঠিত হওয়ার পর দুদক নিয়ে আলোচনা করতে এবং হাসান মশহুদকে তলব করার জন্য শুরু থেকেই উৎসাহী ছিলেন ড. মহীউদ্দিন। দুদক একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, বিষয়টি বিবেচনার জন্য কমিটির কয়েক জন সদস্য অনুরোধ জানানোর কারণে এতদিন তা সম্ভব হয়নি। গত ১ এপ্রিলের বৈঠকে ড. মহীউদ্দিন চেয়েছিলেন পরবর্তী বৈঠকেই দুদক নিয়ে আলোচনা করতে এবং সেখানে হাসান মশহুদকে ডাকতে। কয়েকজন সদস্যের আপত্তির কারণে পরে সিদ্ধান্ত হয়, আগামী বৈঠকের পরবর্তী বৈঠকে দুদক নিয়ে আলোচনা হবে।
দুদক-এর দুই বছরের কার্যক্রম খতিয়ে দেখবে সরকার
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদকের) গত দুই বছরের কার্যক্রম খতিয়ে দেখবে সরকার। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব). ফারুক খান গত শুক্রবার একথা জানিয়েছেন। ওদিকে বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব আবদুল্লাহ আল নোমান দুদক চেয়ারম্যান হাসান মশহুদ চৌধুরীর পদত্যাগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিদায়ী চেয়ারম্যান দুর্নীতি দমনের নামে যা করেছেন তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
গত শুক্রবার আইনমন্ত্রী তার বাসায় সাংবাদিকদের বলেছেন, দুদক দুই বছরে রাজনৈতিক উদ্দেশে কোন মামলা করেছে কিনা অথবা যেন রাজনীতিবিদরা কোন কথা না বলার সাহস পান এমন উদ্দেশে কোন কাজ করেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। দুদক-এর বিদায়ী চেয়ারম্যান লে. জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরীর পদত্যাগে সরকারের চাপের বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, তিনি হয়তো চাপের কারণেই মামলা দায়েরে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন হয়তো তা বুঝতে পেরেই পদত্যাগ করেছেন। আইনজীবীদের পেছনে দুদকের ১৩ কোটি টাকা ব্যয় সঠিক ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে বলেও জানিয়েছেন ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ।
ওদিকে, গত শুক্রবার রাজধানীর কাঁটাবনে আইসিএমএবি মিলনায়তনে এডমিশন প্লাস কোচিং সেন্টারে কৃতী ছাত্রদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের এক ফাঁকেলে. কর্নেল (অব). ফারুক খান বলেছেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে দুদক-এর পুনর্গঠনের গঠনের চিন্তা করছে সরকার। দুদক গত দুই বছরে রাজনীতি দমন করতে গিয়ে আসল লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, দুদক-এর গত দুই বছরের কর্মকাণ্ডে শুধু সরকারি দলের এমপি নয়, বিরোধী দলীয় এমপি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন রয়েছে। আমরা আশা করছি, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তাকে ইহকাল ও পরকালে জবাবদিহি করতে হবে ॥ মির্জা আব্বাস
বিএনপির যুগ্মমহাসচিব মির্জা আব্বাস বলেছেন, এসময় তিনি বলেন, দুদকের পদত্যাগকারী চেয়ারম্যান লে. জে. (অব.) হাসান মশহুদ চৌধূরীকে ইহকাল ও পরকালণ্ডদু’কালেই জবাবদিহি করতে হবে। মানুষের প্রতি অবিচার করলে কী হয় তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ তার পদত্যাগ।
গত শুক্রবার তিনি তার শাহজাহানপুরের বাসায় বলেন, আমার জানতে ইচ্ছে করে ১৩ কোটি টাকা তিনি কীভাবে খরচ করেছেন? আমেরিকা ও লন্ডনে দুর্নীতি দমনের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু তিনি হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছেন। দুর্নীতি দমন করতে গিয়ে তিনি রাজনীতিবিদদের দমনের চেষ্টা করেছেন। ভবিষ্যতে যারা তার মতো আচরণ করবেন তাদেরও একই পরিণতি হবে। তিনি বলেন, একই ধরনের মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা ও আমাদের সাজা হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা একটির পর একটিতে মামলা থেকে খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। অথচ আমাদের মামলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
তার মতো সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাব রয়েছে ॥ নাজমুল হুদা
বিবিসি বাংলা সার্ভিস আয়োজিত বাংলাদেশ সংলাপে গত শনিবার নির্ধারিত বক্তা বিএনপির সহসভাপতি নাজমুল হুদা বলেন, হাসান মশহুদের পদত্যাগ দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কেননা তাঁর মতো যোগ্য ব্যক্তির গতিশীল নেতৃত্বে দুদকের কাজ অনেকটা এগিয়েছিল। তাঁর মতো সক্রিয় লোক পাওয়া কঠিন। সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্নীতি প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরি করতে পেরেছিলেন তিনি।
নাজমুল হুদা বলেন, ‘দুদকের কারণে আমি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কিন্তু এর জন্য এককভাবে তিনি (হাসান মশহুদ) দায়ী নন। এ ক্ষেত্রে অনেক বিষয় কাজ করেছে। মানুষের ভুল হতে পারে। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারেননি তিনি।’
এ প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজানো দরকার ॥ নোমান
বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব আবদুল্লাহ আল নোমান বলেছেন, গত দু’বছরে দেশের বরেণ্য ব্যক্তি ও রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে দুদক মিথ্যা মামলা দেয়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের তহবিল তছরুপ করেছে। গতকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপি’র এই নেতা বলেন, সরকার আসবে সরকার যাবে। তবে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন থাকবে। তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা তাদের সহযোগিতা দিতে চাই। তবে বিদায়ী চেয়ারম্যান দুর্নীতি দমনের নামে যা করেছেন তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সম্মানিত ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক ব্যক্তিদের চরিত্র হনন করা, সামাজিক মর্যাদা নষ্ট করার দায়িত্ব তাদের কেউ দেয়নি। তাই এই প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার।
উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই ॥ এবিএম মূসা
গত দুই এপ্রিল চ্যানেল আইতে এক টক শো-তে প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা বলেছেন, মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়ন, নেতা-নেত্রীদের জেলে পাঠানো, রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার বা সাবজেল করার ক্ষমতা হাসান মশহুদ চৌধূরীর ছিল না। নূর আলী বা আজম জে চৌধুরীকেও তিনি আবিষ্কার করেননি। পুরো খেলাটা যারা খেলেছেন তারা তাকে দিয়ে খেলিয়েছেন। আমি বলবো ‘বেচারা বোকা’। গত দুই বছরে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে যত অভিযান হয়েছে তার জন্য এই বেচারাকে অযথাই দোষারোপ করা হচ্ছে।
অবিশ্রুত
সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে... কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
নীড় সন্ধানী - ১৫ এপ্রিল ২০০৯ (৭:৪৫ পূর্বাহ্ণ)
হাসান মশহুদ পদত্যাগ করেছেন এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। না করলেই বরং অবাক হতাম। যাদের বিরুদ্ধে হাসান মশহুদ দুর্নীতির জিহাদ ঘোষনা করেছিলেন তাদের অনেকেই ক্ষমতার মসনদ আলোকিত করে বসে আছেন এখন। আরো অনেক প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতিবাজ মুক্ত জীবন উপভোগ করছেন। কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি বা করা হয়নি। সেই অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজদের হাত এখন আরো অনেক শক্ত। বসুন্ধরার আকবর সাহেব সেনাপ্রধানের সাথে গলাগলি করেন।
দুদকের এসব অসমাপ্ত কর্ম কিছু মানুষকে বিপদে ফেলে দিয়েছে। যদিও এজন্য ঠিক দুদককে একা দায়ী করা ঠিক হবে না। কারন যত মামলা মোকদ্দমা করা হয়েছে তার সবগুলোর ভিত্তি ছিল- সেনা সরকার। ধারনা করা হয়েছিল গনতন্ত্র আগামী দশ বছরেও ফিরে আসবে না। সুতরাং প্রান খুলে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জিহাদ করো সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায়।
দুবছর জিহাদ করলাম। নির্বাচনের মাধ্যমে গনতন্ত্র ফিরে এসেছে। সেনারা চলে গেছে ব্যারাকে। তারপর? সাকা চৌধুরীদের বিরুদ্ধে যারা মামলা করেছিল, তাদের জীবন কী অবস্থা এখন? সাকারা মুক্ত, বাদীরা পলাতক।
বাস্তবতা হলো অরাজকতা করার গনতান্ত্রিক দিন ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছে যেমন খুশী তেমন খেলার দিন। চোরের মায়ের এখন ষ্টেরিও গলা।
তুষার - ১৬ এপ্রিল ২০০৯ (৬:৫৭ পূর্বাহ্ণ)
বুঝলাম বাংলাদেশ থেকে দু্র্নীতি সহজে যাচ্ছে না। সেই দিন আবার আসছে যখন দু্র্নীতিবাজেরা সংসদে বসে দু্র্নীতিবিরোধী বতৃতা দেবে। তবে যাই বলেন এদের তো আমরাই ভোট দিই। আমাদের সমস্যা আমরা দুইজনের বেশি ভোটের সময় দেখি না।
রায়হান রশিদ - ২৮ এপ্রিল ২০০৯ (১১:৪৫ অপরাহ্ণ)
১.
সাম্প্রতিক কালে দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক প্রধান জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরীকে সংসদীয় কমিটির সামনে তলব করা নিয়ে বেশ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। দুদক প্রধান দাবী করছেন একটি স্বাধীন কমিশনের প্রধান হিসেবে তাঁকে সংসদীয় কমিটির তলব পাঠানোর কোন এখতিয়ার নেই। অন্য দিকে সংসদীয় কমিটি দুদক প্রধানের এই আচরণকে সংসদের অবমাননা বলে অভিহিত করছে। দুদক প্রধানের অবস্থান অকুন্ঠ সমর্থন লাভ করছে সুশীল সমাজের একটি অন্যতম অংশের। কাকতালীয়ভাবে এটি ঠিক সেই অংশ যাঁরা গত দু’বছরের অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিভিন্ন ধরণের কর্মকান্ডকে (যেমন: মাইনাস টু, কিংস পার্টি গঠন, due process এবং rule of law এর অবমাননা, তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের হেফাজতে নির্যাতন ইত্যাদি) প্রত্যক্ষ এবং মৌন সমর্থন দিয়ে এসেছিল। আবার, দুদক প্রধানের অবস্থানকে যারা সমালোচনা করছেন তাদের অন্যতম হচ্ছে রাজনৈতিক মহলের সেই অংশটি যাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতিবিরোধী কর্মকান্ডের কারণে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা নাজেহাল হয়েছিলেন, ন্যায্য কিংবা অন্যায্য যেভাবেই হয়ে থাকুন না কেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই সংসদীয় কমিটির এই তলবকে অনেকে প্রতিহিংসাপ্রসূত পদক্ষেপ বলে মনে করছেন। অন্যদিকে দুদক প্রধান এবং তার সমর্থনকারীদের একাংশ সংসদীয় কমিটির তলব এড়াতে শুরু থেকেই আইনের বিভিন্ন ধারা উদ্ধৃত করে আসছেন। আমরা যারা সাধারণ জনগণ, তারা স্বাভাবিকভাবেই এসব দেখে বিভ্রান্ত। এ বিষয়ে তাই কিছু বিচ্ছিন্ন ভাবনা তুলে ধরছি নিচে। [সংসদীয় কমিটি বিষয়ে বেশ কিছু দিন আগের একটি পোস্টে (“সরকারের জবাবদিহিতা নিয়ে কিছু ভাবনা (২): সংসদীয় কমিটি”) কিছু আলোচনা করা হয়েছিল, সেটিও পড়ে নেয়া যেতে পারে এই প্রসঙ্গে]।
২.
দুদক প্রধান বনাম সংসদীয় কমিটির এই পুরো বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে যেটি উদ্বেগজনক মনে হয়েছে আমার কাছে তা হল দুই পক্ষই (এবং তাদের সমর্থকগণ) আইনের ধারা নিয়ে এক ধরণের ইঁদুর বেড়াল খেলে চলেছেন। এই সব নন্দী-ভৃঙ্গি লড়াইয়ে মূল যে বিষয়গুলো ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে সেগুলো হল: জবাবদিহিতার প্রয়োজনীয়তা, জবাবদিহিতার সংস্কৃতি এবং জনগণের জানবার অধিকার। দুদক এর মত এতখানি জনগুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উঠেছে, সত্য হোক মিথ্যা হোক, সেগুলো অত্যন্ত গুরুতর। এ ধরণের প্রশ্ন যখন উঠে তখন তার জবাব তো কাউকে না কাউকে দিতেই হবে। কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব নিতেই হবে এবং জনগণকে সঠিক উত্তর দিয়ে সন্তুষ্ট করতে হবে। যে কারণে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যখন কোন রেল দুর্ঘটনা ঘটে তখন আমরা আশা করি যোগাযোগ মন্ত্রী পদত্যাগ করে তার দায়িত্ব স্বীকার করবেন। সেখানে দুর্ঘটনার জন্য মন্ত্রী আদৌ দায়ী ছিলেন কিনা কিংবা ঠিক কতটা দায়ী ছিলেন, সে সব সুক্ষাতিসুক্ষ আইনগত প্রশ্ন অবান্তর। প্রজাতন্ত্রের কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হতে হলে দায় স্বীকারের এই সব সাধারণ মানদন্ডের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে প্রশ্নের সম্মূখীন হয়ে উত্তর প্রদানের মাধ্যমে, খুঁটিনাটি আইনের ধারার পেছনে লুকোনোর চেষ্টা করে নয়। দুদক এর মত এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা সংস্কৃতির প্রতি এই সাধারণ শ্রদ্ধাবোধটুকু আমরা আশা করি। যদি ধরেও নিই, সংসদীয় কমিটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাকে হয়রানী করার চেষ্টা করছে আজ, তবুও আমরা আশা করি তিনি সৎসাহসের সাথে সে সব মোকাবিলা করবেন; এবং জনগণের কাছে তাঁর ভূমিকা স্পষ্ট করবেন। এটি এখন আর তাঁর “ব্যক্তিগত” বিষয়ের মধ্যে পড়েনা; এটি এখন একটি পুরো প্রতিষ্ঠানের integrity এবং গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই দুদক প্রধানের উচিত হবে না সেখান থেকে হাত গুটিয়ে নেয়া। কারণ, শেষ বিচারে তাঁর দায় কোন আদালত, কমিটি, প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীর কাছে নয়; তাঁর দায় দেশের আপামর জনগণের কাছে। এখানে তিনি জর্জ গ্যালাওয়ের দৃষ্টান্ত থেকেও শিক্ষা নিতে পারেন চাইলে। মার্কিন সিনেট কমিটি যখন বৃটিশ সাংসদ গ্যালাওয়েকে তলব পাঠিয়েছিল (বানোয়াট বলে কথিত) বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে, গ্যালাওয়ে কিন্তু সেই কমিটির মুখোমুখিই হয়েছিলেন কোন ভনিতা না করে। তিনি কোন ধরণের আইনের ধারার পেছনে লুকোনোর চেষ্টা করেননি। এখানে উল্লেখ্য, একজন বৃটিশ নাগরিক হিসেবে গ্যালাওয়ের কিন্তু মার্কিন সিনেটের মুখোমুখি হবার কোন আইনগত বাধ্যবাধকতা ছিল না, তবুও তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন। সেটি করে এক দিক থেকে তিনি যেমন নিজের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো খন্ডন করে অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন জনগণের সামনে, অন্য দিকে অভিযোগকারী মার্কিন সিনেট কমিটির অযোগ্যতা এবং অসদুদ্দেশ্যও উম্মোচন করেছিলেন বিশ্বের সামনে। নীচের ভিডিওটি দেখুন:
[উপরের ভিডিও ক্লিপটি কাজ না করলে এখানে অথবা এখানে দেখুন। মার্কিন সিনেট শুনানীর ট্রান্সক্রিপ্ট পড়তে হলে এখানে অথবা এখানে দেখুন]।
৩.
দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলছেন সবাই। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর যে ধারাগুলো বারবার উদ্ধৃত হচ্ছে, এবার সেগুলোর দিকে নজর ফেরানো যাক একে একে। আইনটির ধারা-২৪ এ সাধারণভাবে বলা রয়েছে:
পত্র পত্রিকায় সুশীল সমাজের কুশীলবদের লেখা পড়ে মনে হচ্ছে কোথাও যেন আমাদের বোঝার কিছু ভুল রয়ে যাচ্ছে এই ধারাটির মর্মার্থ অনুধাবনে। দুদক-কে যে Freedom/Independence দেয়া হয়েছে আইন দ্বারা, তাকে কোনো বিচারেই absolute বলা যায় না; ‘যা ইচ্ছে তাই করবার” স্বাধীনতা এটা নয়। আর, Absolute independence বলে আসলেই কি কিছু আছে? উল্টো, এই ধারাটির ভেতরেই দুদকের স্বাধীনতার বিপরীতে অন্তত দু’টো সীমারেখা টেনে দেয়া হয়েছে। ব্যাখ্যা করছি:
প্রথমত: বলা হয়েছে, দুদক কমিশনাররা শুধু তাদের ততটুকু কর্মকান্ডের জন্যই স্বাধীনতা ভোগ করবেন, যতটুকু তাদের দায়িত্ব (“discharging their duties under this Act”) পালনের সাথে সরাসরি জড়িত। আজকে দুদকের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উঠেছে, তাতে এই ইঙ্গিত স্পষ্ট যে – দুর্নীতি দমন ছাড়াও অন্যান্য উদ্দেশ্য জড়িত ছিল দুদকের কর্মকান্ডের পেছনে। এই সব “অন্যান্য উদ্দেশ্য”কে কি আইন সংক্রান্ত দায়িত্বপালন বলা যায় নাকি বলা উচিত? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুদক এর কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে নানা ধরণের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পরায়নতার অভিযোগ উঠেছে, এবং সে সব নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বিভিন্ন ব্লগে লেখাও হয়েছে গত দু’বছর। বিবেকবান মানুষদের মধ্যে এমন কে আছেন যিনি এই সব অভিযোগকে উড়িয়ে দিতে পারেন? আর যে মুহুর্তে দুদকের পদক্ষেপের পেছনে আইন সংক্রান্ত দায়িত্বপালন ছাড়াও ‘অন্য’ উদ্দেশ্য মূর্ত হয়, আমার বিবেচনায় সে মুহুর্তেই দুদক কর্মকর্তারা তাদের আইনলব্ধ স্বাধীনতা হারান; কারণ কোন বিচারেই এটি অনাদি অনন্ত absolute স্বাধীনতা নয়। এটি দুদক এর legitimacy’রও প্রশ্ন।
দ্বিতীয়ত: যে মুহুর্তে আইন দ্বারা নির্দিষ্টকৃত “subject to its terms” এর বাইরে গিয়ে দুদক কর্মকর্তারা কাজ করবেন, সে মুহুর্তেই তারা আসলে আইন ভঙ্গ করেন। যে আইনটি ভঙ্গ করা হয় সেই একই আইনের সুরক্ষা কি আইন-ভঙ্গকারী দাবী করতে পারে? আমার তো মনে হয়না। এখানে দ্রষ্টব্য: দুদকের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আমি এখনো “অভিযোগ” শব্দটি ব্যবহার করছি। প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সব অভিযোগই কেবল অভিযোগ। কিন্তু সেটি প্রমাণিত কিংবা তদন্তকৃত হবে কোন্ প্রক্রিয়ায়? নাকি কোনকালেই এই সব অভিযোগের তদন্ত হবার দরকার নেই? নিচে ধারা-১০(৩) এর আলোচনায় সে সীমাবদ্ধতার কথা বিস্তারিত বিধৃত হয়েছে। সেই আলোকে এখন কেউ কি দয়া করে জানাতে পারেন কোন্ প্রক্রিয়ায় সে সব অভিযোগগুলো জনগণ খতিয়ে দেখবে? সুশীল কুশীলবরা অনেক কিছুই বলছেন, কিন্তু এই বিষয়ে কেন যেন তারা কিছুই বলছেন না স্পষ্ট করে।
৪.
দুদক কমিশনারদের অপসারণ সংক্রান্ত (দুদক আইন ২০০৪ এর) যে বিশেষ ধারাটি সবাই উদ্ধৃত করছেন কমিশনারদের স্বাধীনতার বিষয়টিকে বোঝাতে গিয়ে, সেটি হল ধারা ১০(৩)। সেখানে বলা হয়েছে:
অর্থাৎ, দুদক আইনের ধারা ১০(৩) অনুযায়ী দুদক কমিশনারদের অপসারণের জন্য সে ধরণের পদ্ধতিই অনুসরণ করতে হবে, যা সুপ্রীম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষেত্রে অনুসৃত হয়ে থাকে। এই বিধানটি অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর। এডিবি’র টেকনিক্যাল এসিসট্যান্স টীম এই বিধানটির বিষয়ে শুরু থেকেই তাদের সংশয় এবং দ্বিমত প্রকাশ করে আসছিল [সূত্র: ADB TA – BAN 37017]। তাঁরা মত দিয়েছিল - এই ধারাটির ফলে জবাবদিহিত/অপসারণমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়নে আরও বেশী সমস্যার সৃষ্টি হবে (যার প্রমাণ বর্তমানের এত সব বিতর্ক)। এডিবি’র কারিগরি সহায়তা টীমের বক্তব্য থেকে সরাসরি উদ্ধৃত করছি:
এডিবি’র কারিগরি সহায়তা টীম দুদক সৃষ্টিকারী আইনটির বিষয়ে আরও সুপারিশ করেছিল:
এডিবি’র মতামতের সাথে আমি একমত পোষণ করি। যাঁরাই দুদক প্রধানের অপসারণের পদ্ধতিকে সুপ্রীম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের সাথে তুলনা করতে আগ্রহী, মনে হয় না তাঁরা বিষয়টা যথেষ্ট গভীরভাবে বিবেচনা করছেন। কারণ, ত্রুটিপূর্ণ আইন দ্বারা সৃষ্ট পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে ধারা ১০(৩) এর বিধানটি বাস্তবায়ন বা প্রয়োগের সহজ কোন উপায় আমার অন্তত চোখে পড়ছে না। তার মানে কি দুদক কমিশনারগণ সব ধরণের জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত থাকবেন? এটা কোন্ ধরণের বিধান বা তার ব্যাখ্যা? দুদক কি আইনের উর্দ্ধে? কিংবা দুদক সৃষ্টিকারী আইন কি দেশে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যের চেয়েও বেশী অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবী রাখে? আমার মনে হয় না।
৫.
দুদকের স্বাধীনতার আরেকটি অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হল আর্থিক স্বাধীনতা। দুদক আইনের ধারা-২৫ এ বলা হয়েছে:
এটা ঠিক যে দুদকের ব্যয় সংক্রান্ত বিষয়ে কোন পূর্ব অনুমোদন লাভের দরকার নেই। কিন্তু কোন বিচারেই এটিও কিন্তু কোন absolute freedom না। এই স্বাধীনতাটুকু দেয়া হয়েছে কেবল দুদক এর কর্মকান্ডকে সহজতর করার লক্ষ্যেই। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে এটি দুদকের পক্ষে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় করার লাগামহীন লাইসেন্স। সে ধরণের লাইসেন্স দুদক প্রধান কেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির কোন পদধারীরই নেই বলে জানি, যদি আমার জানায় কোন ভুল না থাকে। জনগণের অর্থ অপচয়ের অভিযোগ যদি কারও বিরুদ্ধে ওঠে, সেখানে আইনের কোন ধারাই তাকে জবাবদিহিতার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয় না। কারণ, দুদক কর্মকর্তাদের জন্য এটি এক দিক থেকে যেমন বড় মাপের স্বাধীনতা, আরেক দিক থেকে গুরুতর দায়ভারও বটে; এই দু’টো চলে হাত ধরাধরি করে, সেটা মনে হয় আমরা সকলেই জানি ও মানি। আর এটা তো বলাই বাহুল্য যে গত দু’বছরে দুদকের কার্যক্রম নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক অভিযোগই উঠেছে। যেমন: দক্ষতার অভাব, তদন্ত প্রক্রিয়ায় due process এর অভাব, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দুদকের ক্ষমতার অপব্যবহার, তদন্ত হেফাজতে নির্যাতন, মামলাগুলোতে অত্যন্ত সাধারণ/মৌলিক পর্যায়ের ত্রুটিবিচ্যুতি ইত্যাদি। এই সব ত্রুটি বিচ্যুতি ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত ছিল, তা বিধাতাই জানেন। এর প্রত্যক্ষ ফলাফল আমরা দেখেছি দুর্নীতি দমন মামলাগুলোর বেহাল অবস্থার মধ্য দিয়ে, এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় থেকেই। এখন ১৩ কোটি টাকা যদি দুদক এর আইনজীবিদের পেছনে অযথা অপচয় করার অভিযোগ উঠে থাকে, আমরা জনগণ তো স্বাভাবিকভাবেই দুদকের মামলাঘটিত কর্মকান্ডের বিস্তারিত “রিপোর্ট কার্ড” দেখতে চাইতেই পারি। যদি জনগণ জানতে চায় এত টাকা ব্যয় করার পরও দুদকের কর্মকান্ড কেন ও কিভাবে অশ্বডিম্ব প্রসব করলো, তাহলে সেটা কি খুব অন্যায্য জিজ্ঞাসা হবে? আমি বিশ্বাস করি না দুদক প্রধানকে আইন সেই সব প্রশ্নের উত্তর প্রদান থেকে দায়মুক্তি দিয়েছে।
৬.
দুদকের আর্থিক স্বাধীনতার বিপরীতে আরেকটি বিষয়ও দুদক আইনে স্পষ্টভাবে বলা রয়েছে। দুদক আইন ২০০৪ এর ধারা-২৫(২) এ কম্পট্রোলার এবং অডিটর জেনারেলকে দুদকের ব্যায় সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশ্ন এবং হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা দেয়া আছে। বলা আছে:
আবার অন্য দিকে সংসদের Standing Committee on Public Accounts কে (পক্ষান্তরে জাতীয় সংসদকে) ক্ষমতা দেয়া রয়েছে উপরোক্ত কম্পট্রোলার এবং অডিটর জেনারেল কর্তৃক পেশকৃত যাবতীয় হিসাব প্রতিবেদনকে নিরীক্ষন করার যতক্ষণ পর্যন্ত না সংসদীয় কমিটি সে সব বিষয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয় [অনুচ্ছেদ-২৩৩; সংসদীয় কার্যবিধি]। অনুচ্ছেদটিতে বলা হয়েছে:
সুতরাং, এই দু’টো আইনের বিধান পর্যালোচনার পর, যুক্তির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী এটি স্পষ্ট যে সংসদীয় কমিটির অধিকার রয়েছে দুদকের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার, এবং (কার্যবিধির অনুচ্ছেদ-২৩৩ অনুযায়ী) এটি কমিটির আইন প্রদত্ত দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আর্থিক জবাবদিহিতা বিষয়ে সমীকরণটি এরকম:
তবে এখানে উল্লেখ্য, ব্যক্তিগতভাবে আমি হয়তো কিছুটা স্বস্তি অনুভব করতাম যদি দুদক প্রধানকে পাঠানো তলবটি Public Undertaking Committee’র পরিবর্তে Public Accounts Committee’র পক্ষ থেকে পাঠানো হত। তাতে মনে হয় না বিতর্কের আর কোন অবকাশ থাকতো।
৭.
সুজন কর্ণধার বদিউল আলম মজুমদার সংসদীয় কমিটির ভূমিকাকে একীভূত “জজ, প্রসিকিউটর ও জুরির” ভূমিকা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে সমালোচনা করেছেন (এ বি এম মূসাকে উদ্ধৃত করে)। এখানে বদিউল মজুমদারের ধারণাগত বিভ্রান্তিটি চোখে পড়ার মত। সংসদীয় কমিটি কোন বিচারিক প্রতিষ্ঠান না। দেশে দেশে এই জাতীয় কমিটিগুলো মূলতঃ প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনসমক্ষে মুক্ত তদন্তের কাজটি সম্পন্ন করে থাকে, যার উদ্দেশ্যই থাকে: সত্য উদঘাটন এবং জনগণকে অবহিতকরণ। এ ধরণের কমিটির রায় দেয়া (judgement অর্থে) কিংবা শাস্তি দেয়ার মত কোন Executive ক্ষমতা নেই, কেবলমাত্র উপদেশ কিংবা সুপারিশ পেশ করা ছাড়া। সুতরাং, ন্যাচারাল জাস্টিস এর ধারণা থেকে উদ্ভুত “জাজ জুরি প্রসিকিউটর” তুলনাটির প্রয়োগ এখানে প্রাসঙ্গিক বলে আমি মনে করি না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই বিতর্কে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মলয় ভৌমিকের অবস্থানটা আমার কাছে অনেক বেশী যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়েছে, সেটিও পড়ে নেয়া যেতে পারে এখান থেকে।
৮.
সাবেক দুদক প্রধানের স্বাধীনতাজাত সুরক্ষার কথাটি বারবার বলা হচ্ছে। পদে আসীন থাকা অবস্থায় সেটির কিছু যৌক্তিকতা থাকলেও থাকতে পারতো। কিন্তু পদত্যাগ করার পর দেশের আর দশজন সাধারণ নাগরিকের একজন হিসেবে সেই সুরক্ষা তাঁর রয়েছে কিনা সেটি অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ। এই বিষয়ে কয়েকদিন আগে অন্য একটি আভ্যন্তরীন প্লাটফর্মের ইমেইল গ্রুপে আমার দেয়া একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করছি (সময়াভাবে অনুবাদ করা গেলনা বলে অগ্রীম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি):
ধন্যবাদ।
রায়হান রশিদ - ৭ মে ২০০৯ (১:৪৯ পূর্বাহ্ণ)
এই আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে সিসিবি ব্লগেও একটি আলোচনা শুরু হয়েছে। এখানে দেখুন। পড়ার আহ্বান থাকলো।
মুক্তাঙ্গন - ৮ মে ২০০৯ (৩:২৩ অপরাহ্ণ)
সিসিবি’র এই প্রতিপোস্টটি আলোচনার সুবিধার্থে তুলে দেয়া হল:
——–
দুদকের দুঃসাহসের সমর্থনে আরো এক কিস্তি
লিখেছেনঃ সানাউল্লাহ (৭৪ – ৮০) | মঙ্গল, ৫/০৫/০৯ – ১২:১৫ পূর্বাহ্ন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুর্নীতি দমনের নামে কাউকে নাজেহাল বা হয়রানি করা দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজ নয়। ইতোপূর্বে যা হয়েছে তা যেন না হয়। দুর্নীতির নামে অন্যায়ভাবে, অযাচিতভাবে কাউকে যেন হয়রানি করা না হয়।
এটা গতকাল সোমবারের একটা খবর। মন্ত্রিসভার বৈঠকে শেখ হাসিনা এমন মন্তব্য করেছেন বলে তার প্রেস সচিব সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। এ নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাবো না। কেউ যদি প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মামলা করা বা তদন্ত করা বা তাদের জেলে পোরার ব্যবস্থা করাকে তিনি নাজেহাল বা হয়রানি মনে করেন কিনা; তার উত্তরে তিনি কি বলবেন জানিনা। আমি অবশ্য শেখ হাসিনার বক্তব্যের সঙ্গে একমত নই। সেটা আমার আগের লেখায় রায়হান রশিদের মন্তব্যের জবাব দেওয়ার সুযোগ নিয়ে প্রকাশ করছি।
দুদক সম্পর্কে মুক্তাঙ্গনে রায়হান রশিদের মন্তব্য বেশ দেরিতে পড়লাম। আসলে এই বিষয়ে তার আর আমার অবস্থান পরস্পরবিরোধী। আমি আমার যুক্তিগুলো এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের দুঃসাহস দেখতে চাই শিরোনামে মূল লেখায় এবং ওই পোস্টে নানা মন্তব্যে প্রকাশ করেছি। আমি সেখানে বলেছি, দুদকের মতোই স্বাধীন প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক। তাদের আর্থিক জবাবদিহিতা যদি মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক আর কাজের জবাবদিহিতা যদি আদালত ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নিশ্চিত করে, তাহলে দুদককে কেন সংসদীয় কমিটির কাছে জবাবদিহি হতে হবে?
আগের লেখায় এক মন্তব্যে আমি বলেছি : দুদকের আর্থিক স্বাধীনতা আইনে আছে। আর তার আর্থিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক। আইন প্রয়োগে অন্যায় বা ভুল করলে আদালতে তার বিচার আছে। দুদকের চেয়ারম্যান বা কমিশনার কারো বিরুদ্ধে কোনো অসদাচরণ বা দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে রাষ্ট্রপতি বিষয়টি তদন্ত বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে পাঠাতে পারেন। সুতরাং প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি হিসাবে দুদকের কোনো জবাবদিহিতা নেই, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। দুর্নীতি দমনে স্বাধীন এই প্রতিষ্ঠানটির জবাবদিহিতার বিষয়টি কোনোভাবেই সংসদীয় কমিটির হাতে যায় না বা যেতে পারে না। যেতে দেওয়াও উচিত হবে না। সেরকম কিছু হলে আমরা শেষ হয়ে যাবো।
দুদক সম্পর্কে রায়হান আমার লেখায় তার মন্তব্যে বলেছিল,
১) জবাবদিহিতার সংস্কৃতি এবং তার প্রয়োজনীয়তা যেটা মূল বিতর্ক থেকে অজান্তে বাইরে ছিটকে পড়ছে;
২) দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতার স্বরূপ নিয়ে সুধী মহলে বিভ্রান্তি;
৩) সাবেক দুদক প্রধানের জবাবদিহিতার দায়।
এক এক করে রায়হানের তোলা প্রশ্নের জবাব দিই। অবশ্যই আমি দুদকের কেউ না বা তার মুখপাত্র না। দুর্নীতির স্বরূপ আমরা এদেশে দেখেছি। দুর্নীতিবাজদের দাপটও কম দেখিনি। তাই এরকম একটা স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নিজের পুরো শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে চাই। আর সে কারণেই এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায়টা অনুভব করছি।
১) দুদক জবাবদিহিতায় নেই, এ নিয়ে এতোদিন বিতর্কের পরও যদি রায়হান তাই মনে করে তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই। এ বিষয়ে আমি এই লেখাতেও শুরুতেই আমার অবস্থান পরিস্কার করেছি।
২) দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিয়েও আমার মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি নেই। আমি বরং মনে করি একে আরো শক্তিশালী কিভাবে করা যাবে সেটা আলোচনা করা দরকার। ব্যক্তি হিসাবে দুদক প্রধান বা কোনো কমিশনার অসৎ হলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানে যদি দলীয় লোক বসে তাহলে কি করবো? দলীয় লোক যে নিয়োগকর্তা দলের প্রতি অনুগত হয় তা নিয়ে কোনো সন্দেহ আছে? সংসদীয় কমিটিও তো তারই পক্ষ নেবে! কারণ এখানেও ক্ষমতাসীন দল বা জোটের সংখ্যাগরিষ্টতা থাকে। আমি বরং মনে করি আমাদের জন্য বিপদ হচ্ছে দলীয়করণের সম্ভাবনা। ২০০৪ সালে বেগম খালেদা জিয়া বিচারপতি সুলতান হোসেন খানকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তার আমলে দুদকের ক্লীবত্ব (শব্দটা নিয়ে আমি নিজেও নিশ্চিত নই) আমরা দেখেছি। এখন দেখছি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাগুলো গায়েব করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দলীয় লোক বসালে এই কাজটা যে সহজ হবে সেটা বলাই বাহুল্য।
৩) সাবেক দুদক প্রধানের জবাবদিহিতার বিষয়টি আমার কাছে পরিস্কার নয়। তিনি কি দুর্নীতি করেছেন? অসদাচরণের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে? সাবেক দুদক প্রধান কি অন্যায় করেছেন সেটা রায়হান স্পষ্ট বললে জবাব দেওয়া সহজ হতো। িতিন বা দুদক কি কোনো সৎ লোকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন? এই বিষয়টি নিয়ে পরে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছি।
মুক্তাঙ্গনে রায়হান লিখেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুদক এর কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে নানা ধরণের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পরায়নতার অভিযোগ উঠেছে, এবং সে সব নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বিভিন্ন ব্লগে লেখাও হয়েছে গত দু’বছর। বিবেকবান মানুষদের মধ্যে এমন কে আছেন যিনি এই সব অভিযোগকে উড়িয়ে দিতে পারেন?
জবাবে আমি বলি, ব্লগে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা কেন এ নিয়ে পুরো ব্লগ প্রকাশ করা যেতে পারে। কিন্তু রায়হান বা আমি কি সেটাকেই গুরুত্ব দেবো, নাকি সত্যটা জানার চেষ্টা করবো? দুদক নিয়ে গত তিন সপ্তাহে যেসব লেখালেখি হয়েছে, তাতে যারা বিষয়গুলোর গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে, তাদের জানা থাকার কথা- দু’বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুদকের বাইরে আরো একাধিক কমিটি ও সংস্থা দুর্নীতি নিয়ে কাজ করেছে। মেজর জেনারেল (অব.) মতিনের টাস্কফোর্স এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা এদের অন্যতম। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পরায়ন কাজের সঙ্গে শেষোক্তরা জড়িত ছিল, দুদক নয়। একথা দুদক প্রধান দায়িত্বে থাকাকালে নানাভাবে প্রকাশ করেছেন। কথিত দুর্নীতিবাজদের তালিকার কোনোটি দুদক প্রকাশ করেনি। কোথা থেকে আসতো আমরা জানি। তিনি সেসবের বিরুদ্ধে লড়েছেন। যেটা সাধারণ ব্লগাররা জানে না। রায়হানের ভাষায় সুশীল সমাজের কুশীলবদের কেউ কেউ জানেন।
হ্যা হাসান মশহুদ চৌধুরীর চাপের মুখে এক সময় টাস্কফোর্স নিস্ক্রিয় হয়ে যায়। টাস্কফোর্স অনেক মামলার দায় দুদকের ওপর চাপাতে চেয়েছিল। কিন্তু হাসান মশহুদ দুদকের তদন্ত ছাড়া তাদের কোনো মামলা নিজেদের ঘাড়ে নেননি। নাইকো কেলেংকারি তদন্ত না করতে, কোকোর বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচার, ওয়ারিদ কেলেংকারি তদন্ত না করতে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার চাপ তিনি উপেক্ষা করেছেন। শেষ তিন মাসে মহাজোট সরকার দুদকের কাজে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে থাকে। যার এক পর্যায়ে তিনি পদত্যাগ করেন।
আমি বরং বিষ্মিত হয়েছি, উনি এভাবে হাল ছেড়ে দেওয়ায়। হয়তো ভেতরের বাস্তবতা উনি আমাদের চেয়ে ভালো জানেন। তাই পন্ডশ্রম করতে রাজি হননি।
আইনজীবীদের পেছনে দুদকের ১৩ কোটি টাকা ব্যয় নিয়ে রাজনীতিবিদদের মতো রায়হানও প্রশ্ন তুলেছ দেখে কিছুটা অবাক হয়েছি। দুদকের ওয়েবসাইটে মামলার পরিস্থিতি নিয়ে যে বিবরণ দেওয়া আছে তাও বেশ পুরনো। ২০০৮-এর ০১ সেপ্টেম্বর শেষ আপডেট করা হয়েছে। সেখানে ১,১৪৬টি (এক হাজার একশ ছেচল্লিশ) মামলার কথা আছে। এই হিসাবে এক একটা মামলায় গড়ে আইনজীবীর পেছনে ব্যয় =১,১৩,৪৩৮/- (এক লাখ তের হাজার চারশ আটত্রিশ) টাকা। হিসাবটা কি খুব অস্বাভাবিক মনে হয়? হয়তো কোনো মামলায় আইনজীবীর পেছনে দুদকের ব্যয় হয়েছে ১৫/২০ লাখ টাকা আবার কোনোটায় কয়েক হাজার। (আমি এই হিসাব ধারণার ওপর বলছি)। কিন্তু আমরা কি কখনো বের করতে পারবো বসুন্ধরার শাহ আলম বা বেক্সিমকোর সালমান তার মামলায় কতো টাকা ব্যয় করেছেন? তাদের মামলার পেছনে দুদক কি হাজার টাকার আইনজীবী নিয়োগ করলে ভালো করতো?
নিজেকে আমি বিবেকবানই মনে করি। ওয়ান-ইলাভেন যখন সামনে চলে এলো তখন এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প না পেয়ে তাকে সর্বতোভাবে সমর্থন করেছি। এ নিয়ে আমি অনুতপ্ত নই। পরিবর্তনের সূচনা হোক চেয়েছিলাম। হয়তো কারো কাছে মনে হতে পারে, কলাগাছের কাছে ফল হিসাবে আম চেয়েছিলাম। কিন্তু যারা তখন এর বিরোধীতা করেছিল তাদের স্বরূপ তো জানি। দলবাজরা আমাকে বা এরকম সবাইকে গালি দিয়েছে। সুশীল সমাজ শব্দটাকে গালির প্রতিশব্দ বানিয়েছে। তাতেও লজ্জা পাইনি। কারণ আমি তো অসৎ নই, আমার কোনো ব্যক্তিস্বার্থ ছিল না, নিজের কোনো প্রাপ্তিযোগ ছিল না বা সে আশায় অতীতেও থাকিনি, ভবিষ্যতেও থাকবো না। আমি কারো উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহৃত হইনি। নিজে যেটা ভালো মনে করেছি সেটাকে ভালো বলেছি, মন্দকে বলেছি মন্দ।
পরিবর্তন কিছুটা হচ্ছিল। কিন্তু ধরে রাখা গেল না। কেন গেল না সেটা একটা বড় শিক্ষা আমার জন্য, দেশের সবার জন্য। হয়তো আমরা পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত না। সে নিয়ে এখানে আর নয়, পৃথক লেখা হতে পারে।
মুক্তাঙ্গন - ৮ মে ২০০৯ (৩:২৬ অপরাহ্ণ)
সিসিবি’র এই প্রতিমন্তব্যটি আলোচনার সুবিধার্থে তুলে দেয়া হল।
——–
সানাউল্লাহ (৭৪ – ৮০) বলেছেন:
মে ৮, ২০০৯ , ১২:৩১ পূর্বাহ্ন
রায়হানের বক্তব্য : একজন বৃটিশ নাগরিক হিসেবে গ্যালাওয়ের কিন্তু মার্কিন সিনেটের মুখোমুখি হবার কোন আইনগত বাধ্যবাধকতা ছিল না, তবুও তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন। সেটি করে এক দিক থেকে তিনি যেমন নিজের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো খন্ডন করে অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন জনগণের সামনে, অন্য দিকে অভিযোগকারী মার্কিন সিনেট কমিটির অযোগ্যতা এবং অসদুদ্দেশ্যও উম্মোচন করেছিলেন বিশ্বের সামনে।
আমার বক্তব্য : জর্জ গ্যালাওয়ে একজন রাজনীতিক। তিনি এর মধ্য দিয়ে নিজের রাজনীতিকে বিশ্বের সামনে আনার সুযোগ নিয়েছিলেন। দুদক কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়। এর নির্বাহীরা জনপ্রতিনিধি নন। জনমতের দিকে তাকিয়ে বা জনতুষ্টির জন্য তারা কাজ করেন না। দুদক প্রধান সংসদীয় কমিটিতে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন বা সংসদীয় কমিটির স্বরূপ উম্মোচনে যুদ্ধে নেমেছেন; এটা কল্পনা করতেই বিষ্মিত হচ্ছি! এতোটা নিচে এই প্রতিষ্ঠানকে নামানো বোধ হয় ঠিক হবে না।
রায়হানের বক্তব্য : এডিবি’র মতামতের সাথে আমি একমত পোষণ করি।
আমার বক্তব্য : আমি দ্বিমত পোষণ করি। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ক্ষমতা যথেষ্ট স্পষ্ট। একে সক্রিয় করা হলেই কাজ হবে। এক্ষেত্রে এডিবির যুক্তি বরং আমার কাছে অস্বচ্ছ। এডিবি যে সিলেকশন কমিটির কথা বলছে তাকে নিয়োগ দেবে সরকার। তাহলে তো পুরো বিষয়টা সরকারের পছন্দ-অপছন্দের উপর চলে যাবে। সেটা কি যথার্থ হবে?
রায়হানের বক্তব্য : এটা ঠিক যে দুদকের ব্যয় সংক্রান্ত বিষয়ে কোন পূর্ব অনুমোদন লাভের দরকার নেই। কিন্তু কোন বিচারেই এটিও কিন্তু কোন absolute freedom না। এই স্বাধীনতাটুকু দেয়া হয়েছে কেবল দুদক এর কর্মকান্ডকে সহজতর করার লক্ষ্যেই। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে এটি দুদকের পক্ষে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় করার লাগামহীন লাইসেন্স। সে ধরণের লাইসেন্স দুদক প্রধান কেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির কোন পদধারীরই নেই বলে জানি, যদি আমার জানায় কোন ভুল না থাকে। জনগণের অর্থ অপচয়ের অভিযোগ যদি কারও বিরুদ্ধে ওঠে, সেখানে আইনের কোন ধারাই তাকে জবাবদিহিতার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয় না।
আমার বক্তব্য : কে বললো এটা লাগামহীন ব্যয়ের লাইসেন্স? অপচয় বা দুর্নীতির প্রশ্ন ওঠলে মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক আছে কি জন্য? ওই দপ্তর অডিট আপত্তি জানালে সেটা কতদূর যায় তা সম্ভবত তোমার জানা নেই। এটাকে কেন তোমার জবাবদিহিতা মনে হয় না, আমি জানি না। তোমার বক্তব্য পেলে বুঝতে পারবো। নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশনের আর্থিক জবাবদিহিতা তো এই দপ্তরই নিশ্চিত করে। তাহলে দুদকের বেলায় আপত্তি কেন?
রায়হানের বক্তব্য : আর্থিক জবাবদিহিতা বিষয়ে সমীকরণটি এরকম: সংসদীয় কমিটি > কম্পট্রোলার/অডিটর জেনারেল > দুদক
আমার বক্তব্য : মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটি দেখতে বা পরীক্ষা করতে পারে বলে দুদককে তোমার সংসদীয় কমিটির অধীন মনে হলো? সংবিধানের ১২৮ (৪) অনুচ্ছেদ কি বলে? সংবিধান বলছে : এই অনুচ্ছেদের (১) দফার অধীন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মহা হিসাব-নিরীক্ষককে অন্য কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণের অধীন করা হইবে না। আর (১) অনুচ্ছেদ বলছে : মহা হিসাব-নিরীক্ষক প্রজাতন্ত্রের সরকারি হিসাব এবং সকল আদালত, সরকারি কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারির সরকারি হিসাব নিরীক্ষা করিবেন ও অনুরূপ হিসাব সম্পর্কে রিপোর্ট দান করিবেন এবং সেই উদ্দেশ্যে তিনি কিম্বা সেই প্রয়োজনে তাঁহার দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত যে কোন ব্যক্তির দখলভুক্ত সকল নথি, বহি, রসিদ, দলিল, নগদ অর্থ, ষ্ট্যাম্প, জামিন, ভান্ডার বা অন্য প্রকার সরকারি সম্পত্তি পরীক্ষার অধিকারী হইবেন। অর্থাৎ মহা হিসাব-নিরীক্ষক নিজেও সংসদীয় কমিটির অধীন কোনো সংস্থা নন। কারণ সংসদ বা সংসদীয কমিটির হিসাবও মহা হিসাব-নিরীক্ষক দেখতে পারেন। এখানেই সংবিধান বা আইনে সংসদ বা কমিটিকেও মহা হিসাব-নিরীক্ষকের পরীক্ষা থেকে দায়মুক্তি দেয়নি।
আর সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির এ বিষয়ে ক্ষমতা কি? কার্যপ্রণালী বিধির ২৩৮ (খ) বিধি বলছে : সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্পর্কে মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কোন রিপোর্ট থাকিলে তাহা পরীক্ষা করা।
এ ব্যাপারে আমার কথা প্রথমত, দুদক কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়। আর দ্বিতীয়ত, যদি ধরেও নিই দুদক সরকারি প্রতিষ্ঠান তাহলেও সংসদীয় কমিটি শুধুই মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের প্রতিবেদন পরীক্ষা করতে পারবে- এর বেশি নয় কিছুতেই।
রায়হানের বক্তব্য : সাবেক দুদক প্রধানের স্বাধীনতাজাত সুরক্ষার কথাটি বারবার বলা হচ্ছে। পদে আসীন থাকা অবস্থায় সেটির কিছু যৌক্তিকতা থাকলেও থাকতে পারতো। কিন্তু পদত্যাগ করার পর দেশের আর দশজন সাধারণ নাগরিকের একজন হিসেবে সেই সুরক্ষা তাঁর রয়েছে কিনা সেটি অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ।
আমার বক্তব্য : দুদক প্রধানকে কি কারণে কমিটিতে তলব করা হচ্ছে? দুদক প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালনের জন্য? নাকি সাধারণ নাগরিক হিসাবে তার কোনো কাজের জন্য? রায়হান তোমাকে এখানে অযৌক্তিক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো কারণে ব্যক্তি হিসাবে হাসান মশহুদের প্রতি কোনো ক্ষোভ তোমার আছে। একজন রাষ্ট্রপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, বিচারপতি যে কারণে অবসর বা পদত্যাগের পর সাধারণ নাগরিক হয়েও তার দায়িত্ব পালনকালের কাজের জন্য আইনী সুরক্ষা পান; একই কারণে দুদক প্রধান বা কমিশনাররা সেই সুরক্ষা পাবেন। নইলে কোনো আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি এই দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হবেন না। এখানে ব্যক্তি প্রধান নয়, প্রতিষ্ঠানটা গুরুত্বপূর্ণ। বিচারপতি সুলতান হোসেন খানকে কোনো সংসদীয় কমিটি কি কখনো ডেকেছে? তিনি তো দুর্নীতি দমনে কিছুই করেননি মাসে মাসে বেতন নেওয়া ছাড়া।
এসব কারণেই মলয় ভৌমিকের লেখা বা যুক্তি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।
আপাততঃ এই থাক। তোমার বক্তব্য পেলে আমার যুক্তিগুলো তুলে ধরতে আরো সুবিধা হবে। সময়-সুযোগ করে জানিও।