মুক্তাঙ্গন ব্লগে পিলখানা ট্র্যাজেডি ও গণহত্যার প্রথম দিনেই আমরা পেয়েছি রায়হান রশিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা,- যা ঘটনার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও আশঙ্কা তুলে ধরেছিল। ঘটনা-পরম্পরায় লেখাটি আরও পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে এবং তাঁর প্রশ্ন ও আশঙ্কাগুলি আরও ইঙ্গিতময় হয়ে উঠেছে। অনেকেই এতে মন্তব্য করেছেন ও করবেন। বলা ভালো, এ লেখাটিও সেরকম মন্তব্যের পর্যায়ভুক্ত, রায়হান রশিদের চিন্তাঝড়েরই প্রতিক্রিয়া ও অনুষঙ্গ।
অবশ্য রায়হান রশিদের প্রথম প্রতিবেদনেই আমি একটি প্রতিক্রিয়া যুক্ত করেছিলাম। তখনও আমরা বেশ অন্ধকারে ছিলাম, তাই সে-প্রতিক্রিয়ার সূত্র ছিল এক অর্থে মিডিয়াপ্রভাবিত। সেখানে আমার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘এই ঘটনা সামরিক বাহিনী ও বিডিআর-এর মধ্যে যে নীরব দ্বন্দ্ব ছিল তাকে আরও সুস্পষ্ট করলো’। কিন্তু ঘটনাটি ষড়যন্ত্রের পর্যায়ভুক্ত হওয়ার কারণে এখন এ নীরব দ্বন্দ্বগুলিকে হয়তো অনেকেই আমলে নেবেন না। কেউ কেউ ব্লগে বিষয়টিকে ‘শ্রেণীসংগ্রাম’ বলে উল্লেখ করায় আমি বিস্ময়বোধক চিহ্ন ব্যবহার করেছিলাম তখন, রায়হান রশিদ, নীড়সন্ধানী এবং আরও দু’একজন এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছিলেন আরও স্পষ্টভাবে (একজন আমাকে জানালেন, যে বা যারা বিষয়টিকে শ্রেণীসংগ্রাম বলে উল্লেখ করেছিলেন, তাদের কাউকে না কি এখন আবার সামরিক বাহিনীর জনসংযোগ অধিদপ্তরের ভাষ্য লিখতে দেখা যাচ্ছে!)। প্রতিক্রিয়াটিতে আমি আরও লিখেছিলাম, ‘…অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করাও মূল কারণ হতে পারে — যাতে সাধারণ বিডিআর সদস্যদের অসন্তোষকে পুঁজি করা হয়েছে’।
এখন বিষয়টি আমাদের কাছে সুস্পষ্ট, এর লক্ষ্য ছিল অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা। তাই যে-দাবিগুলিকে প্রচারণায় নিয়ে এসে এই অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার চেষ্টা চালানো হয়েছিল, সেই দাবিগুলি সম্পর্কে আমাদের স্বচ্ছ হওয়া দরকার। এখন যেমনটি দেখা যাচ্ছে, — অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির লক্ষ্য থেকে দাবিগুলি তোলা হয়েছিল বলে এসব দাবিগুলিকে অনেকে অচ্ছুৎ ভাবতে শুরু করেছেন এবং তা ধামাচাপা পড়তে শুরু করেছে — দাবিগুলির এরকম পরিণতি আমি আশা করি না। দাবিগুলির ন্যায্যতা ও অন্যায্যতা আমাদের অবশ্যই খতিয়ে দেখা দরকার। প্রসঙ্গত বলি, এইসব দাবিদাওয়া সম্পর্কে আমারও পরিষ্কার ধারণা নেই। ছাড়া-ছাড়াভাবে এবং মিডিয়ার কল্যাণে যে-সব দফা কানে এসেছে সেগুলি হলো, বিডিআর-এ সামরিক কর্মকর্তাদের প্রেষণে নিয়োগ বন্ধ, শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বিডিআর সদস্যদের পাঠানোর ব্যবস্থা করা এবং অপারেশন ডালভাত কর্মসূচিতে দুর্নীতিপ্রসঙ্গ।
এর মধ্যে, গতকাল সংঘটিত হয়েছে পাকিস্তানে আর এক জঘন্য ঘটনা। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট টিমের খেলোয়ারদের ওপর চলেছে আক্রমণ। নিহত হয়েছেন ছয়জন পুলিশ অফিসারসহ আটজন। পিলখানার ট্র্যাজেডির তুলনায় নিঃসন্দেহে তেমন কিছুই নয়, কিন্তু উপমহাদেশে ধারাবাহিক সন্ত্রাসের বিবেচনায় এবং স্পর্শকাতর ক্রিকেট অঙ্গনকে সন্ত্রাসের মুখে ঠেলে দেয়ায় ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে। বেনজির ভুট্টোর হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে মুম্বাই সন্ত্রাস হয়ে উপমহাদেশে যে-সব ঘটনা ঘটছে তা এক অর্থে দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাস দমনে একটি আঞ্চলিক টাস্কফোর্স গঠনের অনিবার্যতাই তুলে ধরছে। আমার মনে হয়, বিডিআর-এর ঘটনাটিকেও সন্ত্রাসআক্রান্ত উপমহাদেশীয় পরিপ্রেক্ষিত থেকেও নিরীক্ষণ করা দরকার। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট টিমের উপর হামলাটি কি বাংলাদেশ থেকে সবার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার একটি তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ? সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য কি ধারাবাহিক সন্ত্রাস চালিয়ে প্রতিটি সন্ত্রাস ও গণহত্যার ঘটনার আলাদা তাৎপর্যটুকু বিনাশ করা? সকলকে ভেবে দেখার অনুরোধ রাখছি।
বিডিআর : ফিরে দেখা বা সংক্ষিপ্ত অতীত
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিডিআর সদস্যদের এক গৌরবময় ভূমিকা রয়েছে। এ বাহিনীর সদস্যদের প্রকৃত যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৭৯৫ সালে রামগড় লোকাল ব্যাটেলিয়ন নামে। পিলখানায় এদের সদর দফতর স্থাপিত হয় সেই ১৭৯৯ সালে, স্পেশাল রিজার্ভ কোম্পানি নামে। এলাকাটি, লেখাই বাহুল্য, তখন ছিল প্রতিকুল পরিবেশময়। রামগড় লোকাল ব্যাটেলিয়ন নামে এ বাহিনী কার্যকর ছিল ১৮৬১ সাল অবধি। ওই বছর এটি ফ্রন্টিয়ার গার্ডস নাম ধারণ করে এবং ১৮৯১ সাল অবধি মোট ত্রিশ বছর এই নামে দায়িত্ব পালন করে। ১৮৯১ সালে এ বাহিনীর নাম দেয়া হয় বেঙ্গল মিলিটারি পুলিশ, যার কার্যক্রম বিস্তৃত হয় মোট চারটি কোম্পানিতে অধিকতর উন্নততর সমরাস্ত্রসহ ঢাকা, দুমকা ও গ্যাঙ্কটক অঞ্চলগুলিতে। ১৯২০ সালে আবারও নতুন নামে পুনর্বিন্যস্ত হয় বাহিনীটি এবং মূল কার্যক্রম হয় সীমান্ত রক্ষা করা। ১৯২০ সাল থেকে ১৯৪৭-এর পূর্বাবধি এ বাহিনী পরিচিত ছিল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস নামে। ১৯৪৭-এ ভারত বিভক্তির পর এর নাম হয় ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট সংক্ষেপে ইপিআর। ১৯৫৮ সালে সীমান্ত রক্ষার পাশাপাশি এদের ওপর চোরাচালান রোধের দায়িত্বও দেয়া হয়। ক্রমান্বয়ে আন্ত:দেশীয় সম্পর্ক অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে বাহিনীটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৭১-এ ইপিআর তার গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে, পঁচিশে মার্চের কালো রাতেই প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়। সত্যিকার অর্থে, এরাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধগাথা রচনাকারী। ওই মধ্যরাতে সারা বাংলাদেশে অয়ারলেসের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে যে-বার্তা পাঠান তাতেও এর উল্লেখ রয়েছে, যতদূর মনে পড়ছে।
সংঘবদ্ধভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এই ইপিআর-এর কয়েক হাজার ট্রুপস নিয়ে স্বাধীনতার পর ৩ মার্চ ১৯৭২-এ শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার এক সপ্তাহ আগে যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ রাইফেলস, সংক্ষেপে বিডিআর-এর।
এই প্যারা-মিলিটারি বাহিনীটির প্রশাসনিক কার্যক্রম ও কর্মকর্তা পর্যায়ের কার্যক্রম মূলত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দিয়েই পালন করা হয়। বিডিআর-এর নিজস্ব অফিসার রয়েছে ২৫০ থেকে ৩০০র মতো, এবং এদের পদোন্নতি ঘটতে পারে সর্বোচ্চ লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদ অবধি। এ ছাড়া বিডিআর-এর রয়েছে ৪০ হাজারের মতো সাধারণ সদস্য।
১৯৭৩ সালেও একবার বিডিআর-এ অসন্তোষের ঘটনা ঘটে। তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত মুজিব বাহিনীকে বিডিআর-এ আত্তীকৃত করতে চাইলে আপত্তি ওঠে। বিডিআর-এর এ অসন্তোষ নিয়ে সেসসময় আলোচনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তোফায়েল আহমেদের ওপর।
১৯৭৫ সাল থেকে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী নানা অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান, নানা উত্থান-পতনের পথ পাড়ি দিলেও বিডিআর ছিল সে-তুলনায় একেবারেই সংঘাতহীন বাহিনী, যদিও এ-বাহিনীটিরও রয়েছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা এবং সেই সুবাদে রাজনৈতিক চেতনা। বোধকরি এই রাজনৈতিক চেতনা তুলনীয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাধারণ কৃষক-মজুরের মুক্তির চেতনার সঙ্গে,- যাতে কোনও এলিটিস্ট দেশপ্রেমের বাতাবরণ নেই। সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে যেমনটি আমরা দেখেছি, পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক অফিসারদের আত্তীভূত করার মধ্যে দিয়ে খুনোখুনি ও সংঘাত (ভদ্রভাষায় ক্যু বা অভ্যুত্থান) অনিবার্য করে তোলা হয়েছে (বলা ভালো, আমি পাকিস্তান প্রত্যাগত বাঙালি সামরিক অফিসারদের দেশপ্রেমসম্পর্কে কোনও মন্তব্য করছি না বা প্রশ্ন তুলছি না; পৃথিবীর কোনও দেশেই যুদ্ধবন্দি সামরিক অফিসারদের পুনরায় মূল বাহিনীতে ফিরিয়ে নেয়ার উদাহরণ নেই- কেননা এতে বাহিনীর কাঠামোগত পদবিন্যাসে নানা ধরণের দ্বন্দ্ব ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট দেখা দেয়, যা যুদ্ধের চেয়েও বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে; তাই এ ধরণের যুদ্ধবন্দি সামরিক কর্মকর্তাদের অবসর দেয়া হয় অথবা অন্য কোথাও আত্তীভূত করা হয়; কিন্তু বাংলাদেশে করা হয় এর উল্টো, সামরিক বাহিনীতেই ফিরিয়ে নেয়া হয় তাদের সবাইকে), বিডিআর-এর ক্ষেত্রে সেরকম হওয়ার সুযোগ ছিল না।
কেন এই হত্যা ও ত্রাস?
১৯৭৩-এর সেই অসন্তোষের এতদিন পরে বিডিআর-এর মধ্যে এ-ধরণের ঘটনা, আমাদের চোখে যা আকস্মিকই বলা ভালো, ঘটার কারণ কি? রায়হান রশিদ এ প্রসঙ্গে ‘সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরণের সশস্ত্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে’ এ-রকম দু’টি ঘটনার কথা তুলে ধরেছেন। এর একটি দক্ষিণ এশিয়ায় জঙ্গি সন্ত্রাস দমনের লক্ষ্যে আঞ্চলিক টাস্কফোর্স গঠনের প্রচেষ্টা, আরেকটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধসমূহ বিচারের উদ্যোগ। এর সঙ্গে আমি আরও একটি বিষয় যুক্ত করতে চাই। সেটি হলো, সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অপতৎপরতা সম্পর্কিত ব্যাপক আলোচনা।
এ সময় কয়েকজন সাংসদ ও প্রাক্তণ মন্ত্রি-প্রতিমন্ত্রী, যারা সামরিক বাহিনী পরিচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ব্যাপক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন তারা তাদের ওপর সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন সংসদে দাঁড়িয়ে। এদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল সংসদে অসহায়ের মতো কেঁদেছিলেন এবং ডিজিএফআই-এর ভূমিকা সুনির্দিষ্ট করে দেয়ার জন্যে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরে জানা গিয়েছিল, আবদুল জলিল, মহিউদ্দিন খান আলমগীর ও ব্যারিস্টার মওদুদ এ ব্যাপারে মামলা করবেন। সংবাদপত্রে এরকম খবরও বের হয়েছিল আবদুল জলিল সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যে-মামলা করবেন, ব্যারিস্টার মওদুদ সে-মামলার আইনজীবী হবেন (!)। ওই সময় একদিন সরকারদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সংসদ-অফিসকক্ষে প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের দেড়ঘন্টা দীর্ঘ এক অনির্ধারিত বৈঠকের খবরও এসেছে বিভিন্ন সংবাদপত্রে। দুদক-এর চেয়ারম্যানের শীতলতা এই ঘটনাপ্রবাহে ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। সামরিক বাহিনীর অন্তত একটি অংশ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার যথেষ্ট কারণ রয়েছে সংসদ অধিবেশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে এ-রকম আলোচনা হওয়াতে। সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা, নির্যাতন ও দুর্নীতিসংক্রান্ত এ বিষয়টিকে আমি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে চাই বিশেষত নীড়সন্ধানীর এই বক্তব্যের কারণে : ‘কারা কারা এই ঘটনার সাথে জড়িত? শুধুই বিডিআর জওয়ান? সেনা অফিসারদের কেউ কি জড়িত থাকতে পারে না যারা ভিন্ন বিশ্বাসে লালিত? বাংলাদেশের জন্মে অবিশ্বাস করে তেমন মোনাফেক সেনা অফিসার কী নেই?’ আমি যা বলতে চাই, তা হলো, শুধু বাংলাদেশের জন্মে অবিশ্বাসী সামরিক অফিসাররাই নয়, সামরিকতন্ত্র ও রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর অংশীদারিত্বের দাবিদার সামরিক কর্মকর্তারাও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।
ঘটনাপরম্পরায় কিছু অবলোকন
এক. গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রায়হান রশিদের লেখার মন্তব্যে আমি প্রসঙ্গত লিখেছিলাম : ‘যতদূর জানি, বাংলাদেশের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ককে আমরা যত দুর্বল ভাবি তত দুর্বল নয়। গোয়েন্দা সংস্থা এ ঘটনার পূর্বাভাস দেয়নি,- এর অর্থ আসলে এই যে, তারা তথ্য গোপন করেছেন। কেন গোপন করেছেন, কোন মহল বা কোন দলের স্বার্থে করেছেন তা খতিয়ে দেখা দরকার।’
এখন গত ৩ মার্চের ইত্তেফাকের খবর থেকে জানা যাচ্ছে : ২ মার্চ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি এএসপি আবদুল কাহহার আকন্দসহ প্রায় অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। প্রাথমিক তদন্ত থেকে তারা ধারণা করছেন, এ ঘটনায় রাইফেল সিকিউরিটি ইউনিট (গোয়েন্দা ইউনিটের)-এর সিপাহী ও জেসিওরা জড়িত ছিল। ঘটনার দিন সাড়ে নয়টায় কেউ পোশাকপরিহিত অবস্থায় কেউ শাদা পোশাকে এ আক্রমণ চালায়। সাধারণত বিডিআর গোয়েন্দারা শাদা পোশাকে কার্যক্রম চালায়। গোয়েন্দা ইউনিটের পাঁচ কর্মকর্তার কেউ বেঁচে নেই বলে জানা গেছে। কিন্তু গোয়েন্দা ইউনিটের সেপাই ও জেসিওরা ঘটনার সময় বেঁচে থাকলেও তারা তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে তা অবহিত করেনি।’ এবং এ থেকেই ধারণা করা হচ্ছে গোয়েন্দা ইউনিটের সেপাই ও জেসিওরা তথ্য গোপন করেছেন; অর্থাৎ গোয়েন্দা সংস্থা দুর্বল নয়, বরং তারা নিজেরাই চক্রান্তের অংশ। যার ফলে আমাদের অনেকে বিস্মিত হয়ে বলছেন, এত বড় একটি ঘটনা ঘটলো, অথচ গোয়েন্দারা ধারণাই করতে পারলো না, গোয়েন্দা সংস্থা এত দুর্বল!
এখন আমার আশঙ্কা অন্যখানে। এই অবস্থা কি কেবল বিডিআর-এর গোয়েন্দা শাখাতেই? অন্যসব খানেও কি নয়? বিডিআর-রা ক্যু ঘটিয়েছিল বলে তাদের গোয়েন্দা শাখার ব্যাপারটি আমাদের নজরে এসেছে, কিন্তু ডিজিএফআই-সহ আর সব গোয়েন্দা সংস্থায় তথ্য গোপন করেছে এমন কারা রয়েছেন? আরও সহজ ভাষায় বললে, গোয়েন্দা সংস্থার সরকারের অনুগত থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলি সবসময় সরকারের অনুগত থাকে না। এই চরিত্রের কারণে অচিরেই এ-দেশে সামরিক বাহিনীর চেয়েও ডিজিএফআই শক্তিশালী হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে এবং তা যদি হয়, তা হবে চরম দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার। তাই সরকারের উচিত দ্রুত গোয়েন্দা সংস্থাগুলির সংস্কার করা, কর্তৃত্বে পরিবর্তন আনা এবং রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও সরকারের প্রতি বিশ্বস্ত ও দক্ষ কর্মকর্তাদের এসব সংস্থায় নিয়ে আসা।
দুই. ২৭ ফেব্রুয়ারির ওই মন্তব্যে আমি আরও লিখেছিলাম, ‘‘বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য ছিল, আমার ঘটনাপ্রবাহে যা মনে হয়, অসংখ্য সামরিক কর্মকর্তা হত্যার মধ্যে দিয়ে সেনাবাহিনীকে উত্তেজিত করা, বিডিআর-এর মতোই দ্বিধাবিভক্ত করা এবং একটি রক্তক্ষয়ী সংঘাতের সূচনা করা, যাতে নির্বাচিত সরকারের কাঠামোকে সঙ্গতকারণেই নড়বড় ও স্থবির হয়ে পড়ে। তাই সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, আওয়ামী লীগ সরকার আসলে বিডিআর বিদ্রোহ দমন করেনি, প্রকৃত অর্থে একটি সামরিক অভ্যুত্থানকেই দমন করেছে।’’
কিন্তু এখন ঘটনাপ্রবাহ যে-দিকে গড়াচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা এখনও দূর হয়নি। আপাতদৃষ্টিতে এ-ঘটনায় বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী স্থির থেকেছে; বাংলাদেশের মতো সামরিক অভ্যুত্থানপ্রবণ একটি দেশে তাদের এই ভূমিকা প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এখন যে-সব কথাবার্তা বলছেন এবং জামায়াতে ইসলামী নতুন করে যে-রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছে, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সামরিক কর্মকর্তাদের সর্বশেষ বৈঠকে যে-সব আপাতবিচ্ছিন্ন ও প্রচণ্ড ক্ষোভের ছলে উচ্চকিত গভীর রাজনৈতিক ভাষ্য আমরা শুনেছি বা সংবাদপত্রে পড়েছি, তা থেকেই পরিষ্কার, সামরিক বাহিনীর উপরিতল যত শান্তই মনে হোক না কেন তলদেশ তত শান্ত নয়। কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা সেদিনকার আলোচনায় ঘটনার রাজনৈতিক সমাধান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সাধারণ ক্ষমার সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজনের পদত্যাগ দাবি করেছেন, টকশোতে সামরিক বাহিনী প্রসঙ্গ আলোচনায় আসায় মিডিয়ার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেকে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার প্রশংসা করতে পারেন, তিনি যে-ভাবে সামরিক কর্মকর্তাদের মুখোমুখি হয়েছেন এবং তাদের এসব বক্তব্য হজম করে প্রতিত্তর দিয়েছেন তা প্রশংসারই দাবিদার; কিন্তু প্রশ্নকারী ক্ষোভপ্রকাশকারী ওইসব সামরিক কর্মকর্তারা মনে হয় না সেরকম ভাবছেন; তারা ভাবছেন আমরা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামনে কথা বলারই সুযোগ পাইনি, আর এই প্রধানমন্ত্রী এত সহজলভ্য যে অনেক কিছুই বলা সম্ভব।
এর ফলে যা হচ্ছে, দেশে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব থাকলেও তা ড. ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতোই সামরিক কর্তৃত্বাধীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অচিরেই একটি স্বেচ্ছা-বৃত্ত তৈরি করে নিতে পারেন এবং সামরিক বাহিনীকে অলিখিতভাবে জবাবদিহিতার উর্ধে তুলে দিতে পারেন, তাদের পরামর্শ অনুযায়ী একের পর এক পদক্ষেপ নিতে পারেন, সংসদ ও মিডিয়ায় সামরিক বাহিনী নিয়ে কথাবার্তা বলা বা লেখা ট্যাবু হয়ে যেতে পারে। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে আমরা খানিকটা হলেও তেমনই দেখতে পাচ্ছি। যেমন, প্রধানমন্ত্রী সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে ওই বৈঠকে তাৎক্ষণিকভাবে অপারেশন রেবেল হান্ট-এ সম্মতি দিয়েছেন, এই অপারেশন মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা হয়েছে; আর প্রধানমন্ত্রীকে সংসদে বলতে শোনা গেছে, ‘সকালে সেনা সদরে যে সব কথা শুনে এসেছি, এখানেও বিরোধীদের কথায় সেসবের প্রতিধ্বনি শুনলাম। (প্রথম আলো, ২ মার্চ)’। শুধু তাই নয়, দাবির মুখে সরকারি তদন্ত কমিটিকে ঢেলে সাজাতে হয়েছে। খালেদা জিয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর তুলছেন, কিন্তু নিজের পাশে নিয়ে বসে আছেন এমন একজন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে আরও আগে।
ঘটনা যেদিন ঘটে সেই বুধবারে বা বৃহষ্পতিবারে বিএনপির কাউকে পিলখানার আশপাশে দেখা যায়নি, অথচ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলগুলিও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে সেখানে গেছে। সংসদে ১ মার্চে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ভাষ্য অনুযায়ী (বোধকরি খালেদা জিয়া নিজেও তখন উপস্থিত ছিলেন) বুধবার সকাল ১০টায় খালেদা জিয়া কাচঘেরা গাড়িতে করে ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে চলে গেছেন। তারপর তাকে সন্ধ্যায় দেখা গেছে বনানীর দপ্তরে (প্রথম আলো, ২ মার্চ)। খালেদা জিয়ার ভাষ্যঅনুযায়ী, তিনি সারাদিন পার্টি অফিসে ছিলেন। সংসদেও বিএনপির ছিল খুব নমনীয় ভূমিকা, কথায় কথায় তারা ওয়াকআউট করেন, কিন্তু এ ঘটনায় আলোচনার দাবিতে ওয়াকআউট করেননি, বরং সরকারের কথা মেনে নিয়ে (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে বিবৃতি দেয়ার পর আলোচনা হবে) সংসদে সুবোধ বালকের মতো বসে থেকেছেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী থেকে শুরু করে সবাই। কিন্তু তারপরই তারা ঝাপিয়ে পড়েছেন, ভারতকে টেনে আনছেন, সাধারণ ক্ষমাকে ভুল বলছেন, বলছেন পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
খালেদা জিয়া তার সাম্প্রতিকতম এসব তৎপরতার মধ্যে দিয়ে,- এককথায় বলতে গেলে সামরিকতন্ত্রকেন্দ্রিক তাঁর পুরানো বলয়টি পুনর্নিমিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এখন শেখ হাসিনা যদি আগ বাড়িয়ে অপারেশন রেবেল হান্ট-এ বেসামরিক ব্যক্তিদের ধরবারও অনুমতি দেন এবং ঘটনাক্রমে ওই অপারেশনের আত্ততায় স্পর্শকাতর এক বা একাধিক রাজনৈতিক নেতা ধরা পড়েন, তা হলেও কি এ অপারেশনকে তিনি প্রশংসা করবেন?
আমাদের মনে আছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার আগে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে খালেদা জিয়া কী বলেছিলেন। তিনি তাঁর ওই ভাষণে বলেছিলেন : ‘জরুরি অবস্থার সময়ে আমি, আমার পরিবার, দল এবং দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ নানানভাবে অবিচারের শিকার হয়েছে। এই সময়ে সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ভূমিকা পালন করায় প্রতিপক্ষের এমন প্রচারণা রয়েছে যে, আমরা সরকার গঠন করতে পারলে তারা প্রতিহিংসার শিকার হতে পারেন। এ প্রসঙ্গে আমি সকলকে জানাতে চাই যে আমরা কখনো প্রতিশোধ-প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করি না। তাই, আমরা আমাদের কষ্টের প্রতিশোধ নেবো সশস্ত্র বাহিনীকে আরো শক্তিশালী, পেশাদার ও গণমুখী করার মাধ্যমে।’ কিন্তু তাঁর এ বক্তব্য অনেককে আরও ক্ষুব্ধ করেছিল। এখন ‘কষ্টের প্রতিশোধ’ নিতে কি খালেদা জিয়া নতুন কৌশল বেছে নিয়েছেন?
এর পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান দেখা যাক। প্রথম আলো (৩ মার্চ) জানাচ্ছে, ঘটনার পর ২৫ ফেব্রুয়ারি নিজামীর পক্ষ থেকে জামায়াতে ইসলামীর অফিসিয়াল প্যাডে তাদের প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি তাসনিম আলম স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা আশা করি, সরকার দ্রুততম সময়ের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে জাতিকে উদ্বেগমুক্ত করবেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকল মহল দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন বলে দেশবাসী আশা করে।’ পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি তাদের দেয়া বিবৃতিটি ছিল, ‘…২৫ তারিখ এক বিবৃতির মাধ্যমে আমি আশা করেছিলাম, সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ সংকটের সুষ্ঠু সমাধান করে দেশবাসীকে উদ্বেগমুক্ত করবেন। আমাদের ও দেশবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহল বিডিআর জওয়ানদের বিদ্রোহের কারণে সৃষ্ট সংকট আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে সমাধান করে দেশবাসীকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠামুক্ত করেছেন। ফলে আমরা ও দেশবাসী সকলেই স্বস্তিবোধ করছি। এ ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হলো জাতীয় ঐক্যই আমাদের মূল শক্তি। জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’ কিন্তু ২ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে নিজামী প্রশ্ন তুলেছেন, ‘হত্যাকারীদের সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করলেন কীভাবে? …সংকট নিরসনের বেসামরিক উদ্যোগ গ্রহণের যৌক্তিকতা কোথায়? সেনাবাহিনী প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও তাদের এ্যাকশনে যেতে দেয়া হলো না কেন? …হত্যার খবর জানার পরও প্রতিমন্ত্রী পর্যায়ের দলীয় লোকদের দিয়ে সংকট নিরসনের উদ্যোগ নেয়া হলো কোন যুক্তিতে?’ হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম খান ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি এরকম বিবৃতি দেয়ার কথা অস্বীকার করেন। দলের সাংসদ হামিদুর রহমান আযমও একই কথা বলেন।
অর্থাৎ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এ-ইস্যুটি নিয়ে একসঙ্গে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর জন্যে মাঠে নামছে এবং তাদের হাতে যেহেতু যুৎসই অন্য কোনও রাজনৈতিক ইস্যু নেই, সেহেতু ‘আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সামরিক বাহিনী আক্রান্ত’ ইস্যুটিকে কাজে লাগানোই হবে তাদের প্রধানতম রাজনৈতিক লক্ষ্য।
তিন. এ-ঘটনায় অনেক প্রশিক্ষিত সামরিক কর্মকর্তারা নিহত হয়েছেন। বিশেষত ব্যক্তি ও পরিবারের অবস্থানের দিক থেকে এ ক্ষতি সম্পূর্ণ অপূরণীয়। তাদের সমবেদনা জানানোর ভাষা আমাদের কারোরই জানা নেই। এই সমবেদনার, সহমর্মিতার পরও বলতে হয়, জরুরি অবস্থা অবসান হওয়ার পর ওই দু বছরে সামরিক বাহিনীর দায়বদ্ধতা নিয়ে যে-আলোচনা শুরু হয়েছিল, তার মৃত্যু ঘটলো এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে। শুধু তাই নয়, সংসদে ওই সময়ের অধ্যাদেশগুলি অনুমোদনের দুয়ারও বোধকরি খুলে গেল পুরোপুরি। দেখতে পাচ্ছি, সবাই এখন এত বিডিআরবিরোধী যে কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার দাবির মুখে বাহিনীটির নাম পাল্টে গেলেও আপত্তি করার মতো কেউ নেই। চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত একদল বিডিআর সদস্যের কারণে পুরো বাহিনীটিকেই ভিলেনে পরিণত করা হয়েছে। আমরা ভুলে গেছি, ৪০ হাজার বিডিআর সদস্যের বেশির ভাগই এ ঘটনার ভিলেন নয়, বরং ভিকটিম। প্রকৃত ভিলেন কারা, তা খুজেঁ বের করতে হলে নজর দিতে হবে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক গতিধারার দিকে, বিগত সাত বছর ব্যাপী বিডিআর-এর নিয়োগের দিকে ((এ ক্ষেত্রে রায়হান রশিদের দেয়া ‘কারা দায়ী’ শিরোনামের ইশারাগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ))।
সাধারণ বিডিআর সদস্যদের এই ‘ভিকটিমপ্রবণতা’ও কাজে লাগিয়েছে চক্রান্তকারীরা, তারা ‘আর্মি আসছে’ গুজব তুলে চেষ্টা করেছে শেষদিনে বাইরের আর সব বিডিআর ক্যাম্পে সংঘাত ছড়িয়ে দেয়ার। বিডিআর বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ুক, তাদের থামাতে সামরিক বাহিনী বেরিয়ে পড়ুক এবং এতগুলি সামরিক কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ক্ষোভে তারাও কোনও অঘটন ঘটাক – এটিই চেয়েছে চক্রান্তকারীরা। এ চক্রান্ত সফল হয়নি। কিন্তু আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বিডিআর-এর ওপর যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বাদেই সামরিক বাহিনীর আরও কর্তৃত্বপ্রবণ হয়ে ওঠার। রায়হান রশিদের ব্লগের প্রতিক্রিয়ায় সংযুক্ত এক লিংক-এর সুবাদে দেখতে পাচ্ছি, ফেইসবুকের ‘আই হেইট সাহারা অ্যান্ড নানক’ গ্রুপে একজন (সম্ভবত সামরিক কর্মকর্তা) জানিয়েছেন, ২০০২ সালের আগে বিডিআর-এ সামরিক বাহিনী থেকে প্রেষণে পাঠানো সামরিক কর্মকর্তারা ছিলেন গড়পড়তা মানের। তার মানে চারদলীয় জোট এসে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মানসম্মত হিসেবে বিবেচিত সামরিক কর্মকর্তার প্রেষণ বাড়িয়ে দেয়। মন্তব্যকারীর মতে, মানসম্মত সামরিক কর্মকর্তা নিযুক্তির ফলে (অর্থাৎ চারদলীয় প্রেষণব্যবস্থার কারণে) সীমান্তে চোরাচালানের ঘটনা অনেক কমে গেছে। তার ধারণা, চোরাচালান আর করতে না পেরে বিডিআর সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে মন্তব্য না করাই ভালো, কেননা এক শ্রেণীর সামরিক কর্মকর্তা আছেন যারা মনে করেন, কেবল তারাই এ দেশের প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও দুর্নীতিমুক্ত মানুষ! বাস্তবতা হলো আমরা দেখেছি চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনা ঘটে। যতদূর মনে পড়ে, তখন একটি সংবাদপত্রে পড়েছিলাম, গভীর সমুদ্রে অস্ত্রবাহী এ জাহাজটি ভারতীয় গোয়েন্দাদের নজরে আসে এবং তারা নিশ্চিত হওয়ার পর চারদলীয় সরকারকে তা অবগত করেন। কিন্তু চারদলীয় জোট সরকার এ-ব্যাপারে নিস্পৃহতা দেখালে ভারতের পক্ষ থেকে দ্রুত জানানো হয়, যদি বাংলাদেশ সরকার কোনও পদক্ষেপ না নেয় তা হলে তারা তাদের নিজস্ব সৈন্য পাঠিয়ে এটি আটক করতে বাধ্য হবে। কেবল তখনই সরকারের গোপন মহলের টনক নড়ে এবং তারা ট্রাক আটক করতে বাধ্য হন। উত্তর বঙ্গের সীমান্ত অঞ্চলেও এরকম অস্ত্রবাহী ট্রাক বিশেষ মহলের অসাবধানতার কারণে আটক হওয়ার ঘটনা ঘটে। এখন কেউ যদি মনে করেন, ছক অনুযায়ী এ ধরণের অস্ত্র পাচারের ঘটনা ঘটানোর উদ্দেশ্যেই বিডিআর-এ চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর থেকে একটি বিশেষ মহলের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রেষণে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা বাড়ানো হয়েছে এবং তারা বিডিআরদের ফেনসিডিল পাচারের মতো চুনোপুটির ব্যবসা করেননি, বরং অস্ত্র পাচারের মতো রুই কাতলার ব্যবসা করেছেন, তা হলে কি তা একেবারেই অমূলক হবে?
বিডিআর-এর ক্ষোভ-অসন্তোষ যাচাইয়ের প্রসঙ্গটি তাই চোরাচালান বন্ধ বা বন্ধ না-হওয়ার প্রসঙ্গের সঙ্গে আপাতত যুক্ত না করাই ভালো। তা ছাড়া এ-ঘটনার পর সাধারণ বিডিআর সদস্যরা এমনিতেই মনস্তাত্বিক সংকটে রয়েছেন, একটি মাস শেষ হয়েছে, হয়তো তারা বেতনও তুলতে পারেননি, তার ওপর সবাই যদি গোটা বাহিনীর ওপর দোষ চাপান তা হলে তা দীর্ঘস্থায়ী এক ক্ষতের সৃষ্টি করবে। এ দেশে সামরিক বাহিনীতে অনেক সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, হত্যা-খুন হয়েছে, (সম্প্রতি এ নিয়ে ‘সামরিক বাহিনীতে গণহত্যা’ শীর্ষক দীর্ঘ একটি ডকুমেন্টারিও হয়েছে) কেউ কিন্তু সে-জন্যে গোটা সামরিক বাহিনীকে দায়ী করতে যাননি। অথচ বিডিআর-এর ক্যু-এর জন্যে গোটা বাহিনীকেই অভিযুক্ত করা হচ্ছে। এরশাদ যেভাবে সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন, বিডিআর যদি বিদ্রোহই করে, তা হলে তাকে বাঁচিয়ে রাখার কোন দরকার নেই, কিছু সামরিক কর্মকর্তারা যেভাবে এর নাম পরিবর্তনকে সামনে নিয়ে এলেন, মন্ত্রীরা তা নিয়ে যত দ্রুত চিন্তা করলেন, এতটা দ্রুততা না দেখালেও চলতো। কেননা নাম পরিবর্তনের চেয়েও এই মুহূর্তে বরং আমাদের প্রয়োজন বিডিআর সদস্যদের মনোবল ফিরিয়ে আনা, বাহিনীটিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা,- যাতে তারা ভবিষ্যতে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে।
চার. এর বাইরেও কিছু প্রসঙ্গ রয়েছে। যেমন, শিক্ষাবিদ ও গবেষক মমতাজ লতিফের লেখা থেকে জানতে পারছি : ‘বিডিআর প্রধান শাকিল আহমেদ দীর্ঘদিন যাবত ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্টের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছিলেন এবং তাঁর গভীর বিশ্বাস ছিল, এই পন্থায় বাংলাদেশের বাণিজ্য দ্রুত উন্নতি করবে এবং বাংলাদেশ দ্রুত মাঝারি আয়ের দেশে পরিণত হতে পারবে। এ বিষয়ের ওপর তাঁর অনেক গবেষণাকর্মও রয়েছে। তিনি এ বিষয়ে নানা জায়গায় বক্তব্যও রেখেছিলেন। (জনকণ্ঠ, ৩ মার্চ)।’ শাকিল আহমেদ কেন টার্গেট হয়েছেন, তা বিবেচনার জন্যে এ তথ্যের সত্যতা-অসত্যতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আবার দৈনিক যুগান্তর-এ তাদের বরিশালপ্রতিনিধির পাঠানো রিপোর্ট থেকে জানতে পারছি, ‘বিডিআর-এর বিদ্রোহী ডিএডি তৌহিদ ছাত্রজীবনে বরিশাল বিএল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পড়ার সময় ইসলামী ছাত্রসংঘ নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তৌহিদের গ্রামের বাড়ি বরিশালের ঝালকাঠির নলছিটির নগর ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামে। (যুগান্তর, তিন মার্চ)।’ নয়া দিগন্তে আমরা দেখেছি, বিডিআর জওয়ান শহীদের নেতৃত্বে ‘বিদ্রোহপরিকল্পনা’র কেচ্ছা ফেঁদে প্রথম দিকে ডিএডি তৌহিদকে আড়াল করা হয়েছে। এইসব তথ্যগুলি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে, তা হলে ঘটনার জন্যে কারা দায়ী তা জানা কিছুটা হলেও সহজ হবে বোধকরি।
বাংলাদেশের সঙ্গে যেহেতু ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, তাই ঘটনাটিকে তাদের কোনও কোনও মিডিয়া থেকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা অস্বাভাবিক নয়। তবে ভারত সরকার এর মধ্যেই তাদের আনুষ্ঠানিক অবস্থান ঘোষণা করেছেন, যার সঙ্গে ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যমের ভূমিকার কোনও মিল নেই। অথচ বাংলাদেশে সেইসব গণমাধ্যমগুলিকে অবলম্বন করে নয়া দিগন্ত ও দৈনিক সংগ্রামের মতো পত্রিকাগুলি বাংলাদেশে ভারতের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর কাহিনী ছাপাচ্ছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাংবাদিক ডেকে বলেছেন, তিনি তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর জন্যে মামলা করতে চলেছেন। মামলা করার পর সাংবাদিক সম্মেলন ডাকলে বোধহয় আরও যৌক্তিক হতো। কেউ কি দয়া করে জানাবেন, তিনি সত্যিই মামলা করেছেন কি না? সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আরেকটি বিস্ময়, ভারতের মিডিয়া কী করে আগেই বিডিআর-এর ডিজি নিহত হওয়ার সংবাদ প্রচার করলো। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে যা দেখছি, পিলখানায় জিম্মি অনেকেই বাইরে এসএমএস করেছেন, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে ডিজির মোবাইলটি নাকি নিস্ক্রীয় হয়ে গেছে। এমনকি বিরোধী দলীয় নেত্রীও ‘ঘটনার তাৎপর্য অনুধাবন করে’ বাসা থেকে কালো কাচঘেরা গাড়িতে করে পার্টি অফিসে পৌছেঁ গেছেন। কাজেই সকাল এগারোটার মধ্যেই এ ধরনের সত্য খবর কিংবা গুজব খবর ঢাকার বা ভারতের গণমাধ্যমের কাছে পৌঁছানো অস্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশের মিডিয়া কি হত্যার খবর সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল, না কি তারা বিডিআরদের ক্ষোভ-অসন্তোষের ব্যাপারে বেশি উৎসাহিত হয়ে পড়েছিল (মধ্যবিত্ত মানুষ হওয়ায় ক্ষুব্ধ মানুষদের প্রতি আমাদের যে-সহজাত পক্ষপাতিত্ব থাকে তার কারণে)? এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার।
পাঁচ. সমরাস্ত্র ব্যবহারের বা সমরাস্ত্র নিয়ে গবেষণার যে-পরিসর উন্নত দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জন্যে বেধে দিয়েছে, তাতে একবাক্যে বলা চলে, যুদ্ধে জড়িয়ে মাত্র কয়েকঘন্টা টিকে থাকার মতো সামরিক সামর্থ্যও বাংলাদেশের নেই এবং সে সামর্থ্য অর্জন করার সুযোগও আমাদের খুব সীমিত। কাজেই আমাদের প্রতিরক্ষা পুরোপুরি নির্ভরশীল জনগণ থেকে শুরু করে আনসার, পুলিশ, বিডিআর ও সামরিক (তিন) বাহিনীর মনস্তাত্ত্বিক ও আদর্শিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর। আমাদের দ্রুত প্রয়োজন, এই দু:সময়ে সেদিকেই মনযোগী হওয়া।
চার মার্চ ২০০৯
অবিশ্রুত
সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে... কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১৭ comments
রায়হান রশিদ - ৪ মার্চ ২০০৯ (২:৪৭ অপরাহ্ণ)
পরিস্থিতি এখন দ্রুতই বদলাচ্ছে, যাকে আক্ষরিক অর্থেই বলা যায় fluid। তাই বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরের সাম্প্রতিক কর্মতৎপরতাগুলো নিয়ে পর্যালোচনা এবং বিশ্লেষণ খুব আবশ্যক ছিল। অবিশ্রুতকে অসংখ্য ধন্যবাদ সেই জরুরী কাজটিতে হাত দেয়ার জন্য। এর ওপর ভিত্তি করে আশা করছি গভীরতর বিশ্লেষণের পথ উন্মোচিত হবে।
এ বিষয়ে মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ ডিফেন্স স্টাফ কলেজের জন্য যে নিবন্ধটি লিখেছেন সেটির পিডিএফ কপি এখান থেকে ডাউনলোড করে নেয়া যাবে। লেখাটি সম্ভবত (ঠিক নিশ্চিত নই) BILIA (Bangladesh Institute of Law and International Affairs) জার্ণালেও দেয়া হয়েছিল, অন্তত টিভিতে ওয়ালিউর রহমানের সাক্ষাৎকার শুনে তাই মনে হল।
অবিশ্রুত - ৪ মার্চ ২০০৯ (৬:১৬ অপরাহ্ণ)
সম্পূরক কিছু কথা :
এই ক্যু-এর সময় প্রতিরক্ষাকারী সদস্যদের হত্যার পাশাপাশি কয়েকজন বেসামরিক মানুষকেও হত্যা করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এ পর্যন্ত কোনও সংবাদমাধ্যম এদের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানায়নি।
বিডি নিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম থেকে আবু নোমান সজীব-এর সূত্র ধরে জানতে পারছি, এ ঘটনায় ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালের দিকেই মারা গেছেন একজন বৃদ্ধ নির্মাণশ্রমিক আমজাদ আলী, যার বয়স ছিল ৫২। সকালে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে স্ত্রী রাশিদা বের হয়ে যান কাজে। সন্ধ্যায় ফিরে এসে তিনি জানতে পারেন, তাঁর স্বামী মারা গেছেন।
ঘুম থেকে উঠে আমজাদ আলী বেরিয়েছিলেন হাজারীবাগের পাঁচ নাম্বার বিডিআর গেটের দিকে ওষুধ কিনে আনতে। তখনই মারা যান তিনি।
তাঁর লাশের সন্ধানে ছোট ছেলেকে নিয়ে তিনি ছুটে বেড়ান এক জায়গা থেকে অন্য জায়গাতে। শেষ পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে লাশ উদ্ধার করতে সক্ষম হন তিনি।
রাশিদা বেগমের পুরো পরিবার বাস করেন হাজারীবাগের রানা বেকারি লেন বস্তিতে দশ বাই আট ফুট আকারের এক ঘরে। এই ঘরটির মাসিক ভাড়া ১২০০ টাকা। তাঁর ছয় সন্তান। ময়মনসিংহে পরিবারসহ বাস করে সবচেয়ে বড় সন্তান। তারপরের জন, নাম মুসলিম, বাড়ির কাছেই মুদি দোকানে কাজ করে মাসিক মাত্র ২০০০ টাকায়। অন্যান্য সন্তানদের একজন বাবুর বয়স ১০, রবিনের বয়স ৫ আর পুতুলের বয়স ছয়। বলাই বাহুল্য, কাজ করার মতো বয়স হয়নি তাদের।
মেজো ছেলে মুসলিমের আয় করা ওই দু’হাজার টাকা আর রাশিদা বেগমের নিজের আয় করা দেড় হাজার টাকা দিয়ে চলে এই পুরো পরিবার। ঘর ভাড়া বাদ দেয়ার পর অবশিষ্ট দু’হাজার টাকাই তাদের পুরো মাসের খাওয়াদাওয়া, যাতায়াত, পোশাকআশাক, মেডিক্যাল ইত্যাদির জন্যে একমাত্র ভরসা।
মৃত স্বামীর লাশ নিয়ে আসার জন্যে, গ্রামে নিয়ে গিয়ে দাফনকাফন করানোর জন্যে রাশিদা বেগমকে নতুন করে ঋণ করতে হয়েছে ১০ হাজার টাকা।
রাশিদা বেগমের খোঁজ নিতে এগিয়ে যায়নি কেউ। সজীবের কাছে তিনি বলেছেন, ও বাবা, আমরা হলাম বস্তির গরিব মানুষ। আমরা বেঁচে আছি না মরে গেছি তার খবর নিতে আর কে আসবে বাবা?
এই নৃশংস হত্যার আর একজন বেসামরিক শিকার ১৪ বছরের কিশোর হৃদয় ব্যাপারী।
বাবা ৫০ বছরের রাজা মিয়া এবং ভাই জসিমকে শাকসব্জী বেচার কাজে সাহায্য করে সে। প্রতিদিনের মতো ওই বুধবারটিতেও সে সকাল বেলা উঠে বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে চলে গিয়েছিল কারওয়ান বাজারে। তাদের সঙ্গে সব্জি কিনে ভ্যানে তুলেছিল, ঘন্টাতিনেক ছেলেদর সঙ্গে থেকে চলে এসেছিলেন বাবা রাজা মিয়া বাড়িতে। ওদিকে সারাদিন কাজ করার পর উৎসুক কিশোর হৃদয় কী হয়েছে, কী ঘটছে তা জানার জন্যে এগিয়ে গিয়েছিল বিডিআর হেড কোয়ার্টার-এর প্রধান গেটের দিকে।
একটি বুলেট সোজা এসে লেগেছিল তার মাথাতে।
অনেক খুঁজে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে হৃদয়ের লাশ উদ্ধার করে তার বাবা। হৃদয়ের গায়ের লাল জামাটি চিনতে সাহায্য করে তাকে।
হৃদয়ের পরিবারেরও কেউ খোঁজ নিতে যায়নি।
আর একজন বেসামরিক নিহত মানুষ খন্দকার তারেক আজিজ সজীব। বিবিএ-র চতুর্থ বর্ষে পড়তেন তিনি পিপলস ইউনিভার্সিটিতে। সজীব নিহত হন চার নং বিডিআর গেটের উল্টো দিকে ২৫ ফেব্রুয়ারি বেলা তিনটার দিকে।
আরিফুর রহমান নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, একজন আহত পুলিশকে বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছেন সজীব।
একজন অবসরপ্রাপ্ত উপসচিব আ ন ম শামসুদ্দোহার পুত্র সজীব চেষ্টা চালাচ্ছিলেন একটি খণ্ডকালীন কাজের, যাতে তাঁর অবসরপ্রাপ্ত বাবার কষ্ট একটু কমে।
বাবার কষ্ট কমাতে পারেনি সজীব, বরং মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আরও বাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। সে ছিল তাঁর বাবামায়ের তিন সন্তানের দ্বিতীয় সন্তান।
দুঃখজনক ব্যাপার,- ঘটনার পর দিনচারেক পেরিয়ে যাওয়ার পরও আমরা এখনও বেসামরিক ক্ষতির দিকগুলি কিছুই জানি না। এরা কি ন্যুনতম সাহায্যটুকু পাওয়ারও অধিকার রাখেন না? এদের মৃত্যু যথেষ্ট এলিটিস্ট নয় বলে এরা উপেক্ষার পাত্র?
বাংলাদেশে যারা আছেন, তাদের কেউ কি কোনও ধরনের উদ্যোগ নেবেন দয়া করে এরকম বির্পযয়ের শিকার বেসামরিক পরিবারগুলির সাহায্যপ্রাপ্তির ব্যাপারে? আমরা আপনাদের পাশে আছি।
আর সবার প্রতি অনুরোধ থাকলো, এ ধরণের ঘটনা যখন যা জানতে পারবেন, আমাদেরও জানাবেন।
এই সংবাদটির মূল ইংরেজিতে এখানে পাওয়া যাবে।
আবু নোমান সজীবকে ধন্যবাদ, বিডি নিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কমের মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরেছেন বলে।
নীড় সন্ধানী - ৫ মার্চ ২০০৯ (৩:২১ পূর্বাহ্ণ)
আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাবো, বেসামরিক নিহতদের সম্পর্কে বিস্তারিত বলার জন্য। প্রতিটি মৃত্যু তার নিজ নিজ পরিবারের জন্য সমান বেদনাদায়ক। দুঃখজনক হলো সেনা অফিসারদের ভীড়ে এই মৃত্যুগুলো যেন হারিয়ে গেছে। এক জায়গায় বোধহয় লিখেছিলাম সেনা অফিসারদের মৃত্যুর জন্য তাদের যদি সরিষা পরিমান দায়ও থেকে থাকে, এই সিভিলিয়ান মৃত্যুগুলোর তাও নেই। তবু এরা সরকার বা মিডিয়ার মনোযোগ আকর্ষন করতে পারেনি।
ক্যাডেটকলেজ ব্লগ থেকে বেসামরিক নিহতদের মধ্যে নীচের পাঁচজনের নাম পেয়েছি। আরো থাকতে পারে। একজন রিকশাওয়ালাও থাকার কথা তালিকায়ঃ
১. তারেক আজিজ – মোহাম্মদপুরের পিপপলস ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ডেসটিনি গ্রুপে কাজ করে নোয়াখালিতে তার পরিবারের জন্য টাকা পাঠাতো।
২. আমজাদ আলী – বিডিআর হাসপাতালে ঔষধ আনতে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তার স্ত্রী রাশেদা অন্যের বাসায় রান্নার কাজ করে মাসে মাত্র ১,৮০০ টাকা উপার্জন করে
৩. হৃদয় হোসেন – মাত্র ১৩ বছর বয়সের এক সব্জি ফেরিওয়ালা। রাজা মিয়া ব্যাপারীর ৬ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। হৃদয়ের জন্য ইতিমধ্যে তাদের ৫০,০০০ টাকা খরচ হয়ে গেছে।
৪. কল্পনা – ১২ বছর বয়সের মেয়ে। কর্নেল মুজিবুল হকের বাসায় কাজ করতো।
৫. ফিরোজ
বিডিআর এর নন-কমিশন অফিসার ও সৈনিক
১. সুবেদার আবুল কাশেম
২. নায়েক সুবেদার বছির উদ্দিন
৩. ল্যান্স নায়েক মানিক
৪. সহকারী পরিচালক (এডি) খন্দকার আব্দুল আওয়াল
৫. সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম
এই নন-কমিশন অফিসার যারা প্রান দিয়েছে, তাদের জন্যও কোন ক্ষতিপূরন শুনিনি। এরা হয়তো মারা গেছে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দাড়াতে গিয়ে কিংবা অফিসারদের বাঁচাতে গিয়ে। জাতি কি এদের জন্য কাঁদবে না? সরকার এদের পরিবারের পাশে দাড়াবে না?
এই ঘটনায় সিভিলিয়ান ও ননকমিশন্ড অফিসার যারা নিহত হয়েছে, সবার পরিবার ক্ষতিপুরনের দাবীদার। সদাশয় সরকারের কী সময় হবে এদিকে সামান্য মনোযোগ দেয়ার?
অবিশ্রুত - ৫ মার্চ ২০০৯ (১১:২২ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ নীড়সন্ধানী, আরও কয়েকজন অজানা মানুষকে তুলে আনার জন্যে। ক্যাডেট কলেজ ব্লগের তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারছি, আরও দু’জন সাধারণ বেসামরিক মানুষের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে।
এইসব সাধারণ বেসামরিক ও নন-কমিশনড কর্মকর্তাদের নিশ্চয়ই আমরা মনে রাখব।
রায়হান রশিদ ঠিকই বলেছেন, এইসব মৃত্যুকে কোলাটারাল ড্যামেজ বলা রীতিমতো অশ্লীলতাই।
ইমতিয়ার - ৪ মার্চ ২০০৯ (৭:৪৬ অপরাহ্ণ)
লেখাটিতে বিডিআর সদস্য শহীদের প্রসঙ্গ রয়েছে। সে বোধকরি ডিএডি তৌহিদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্যউৎস হতে পারে। কেননা ঘটনার দিন কয়েকজন বিদ্রোহী বলেছিল, তাদের নেতা ল্যান্স নায়েক শহীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। তিনি যে নির্দেশ দেবেন তারা সেটাই মানবে। এ প্রসঙ্গে দৈনিক ইত্তেফাকে পাঁচ মার্চ প্রকাশিত একটি খবর।
রায়হান রশিদ - ৫ মার্চ ২০০৯ (১২:১১ অপরাহ্ণ)
@ অবিশ্রুত
@ নীড় সন্ধানী
এই সব মৃত্যু নীরব, স্বীকৃতিহীন। ৯/১১ এর পর পরিবর্তিত বিশ্ব নৈতিকতার ডামাডোলে আমরা নতুন কিছু অশ্লীল শব্দমালার সাথে পরিচিত হয়েছি। ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ (collateral damage) তাদেরই একটি। কি নৈর্ব্যক্তিক নিরাপদ একটি কনসেপ্ট!
শুনছি, মৃতের পরিবারদের নাকি পোস্ট মর্টেম বাবদ কম পক্ষে আড়াই হাজার করে খরচ করতে হয়েছে। সেটা কি বৈধ সরকারী ফি নাকি কর্মকর্তার ফি, তা জানিনা। স্বজন গেছে, তাতে শবাগার কর্ণধারদের বয়েই গেল! যার গেছে, সে বুঝবে সে সব।
আর বিডিআর বিদ্রোহে যে সব জওয়ান প্রাণ দিয়েছেন, আমার অনুমান সে সব প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে কোন না কোন মহৎ বীরত্বের/ত্যাগের গল্প আছে। জানিনা কখন সেই সব শোনার ফুরসত মিলবে এই জাতির।
অবিশ্রুত - ৫ মার্চ ২০০৯ (১১:৫৪ অপরাহ্ণ)
১. এই ঘটনায় রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি, সাবেক সামরিক জান্তা এরশাদ এমনকি খালেদা জিয়াকেও টেক্কা মারার উদ্যোগ নিয়েছেন। এর মধ্যে গত তিন মার্চ তিনি আমাদের সময়-এ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সামরিক বাহিনীর সমর্থন থাকার কারণেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পেরেছে। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষমতাকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদরা কীভাবে দেখেন, তা অনুভব করার জন্যে এ মন্তব্যটুকুই যথেষ্ট। এর পাশাপাশি এরশাদ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউই বর্তমান পরিস্থিতিতে সঠিক ভূমিকা রাখছেন না বলে মন্তব্য করেছেন।
রাজনীতিকরা যেভাবে মন্তব্য করেছেন, তাতে দু’টি ধারা দেখতে পাচ্ছি।
একটি ধারা মনে করছে, এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সরকারকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্য নিয়ে।
বিপরীত ধারাটি মনে করছে, এই ঘটনা দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করার চক্রান্ত। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এ বিষয়টি সামনে নিয়ে আসার জন্যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে, এরশাদও এই ধারায় তাঁর রাজনৈতিক কথাবার্তা বলছেন।
এই ধারাটি পিলখানার ঘটনাকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি পর্যন্ত সম্প্রসারিত করতে কেন এত অনীহ? তারা বিষয়টিকে কেন কেবল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করার চক্রান্তের বৃত্তবন্দি করে রাখতে আগ্রহী? একটি দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র কি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের চক্রান্তের তুলনায় গুরুত্বহীন?
বিষয়টির দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
২. ছয় মার্চ-এর প্রথম আলোতে দেখুন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা আমিন আহমেদ চৌধুরী একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখেছেন। এতে তিনি ঘটনায় কারা জড়িত থাকতে পারে সে ধারণা দিতে গিয়ে যা লিখেছেন, তা রায়হান রশিদের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে বেশ খানিকটা মিলছে।
তবে তিনি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল (সশস্ত্র ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিচার) আইন ২০০৯ নামে একটি নতুন আইন অনুমোদনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন এবং এর একটি রূপরেখাও তুলে ধরেছেন।
নতুন একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টের কি প্রয়োজন আছে? মুক্তাঙ্গন ব্লগের যারা আইন বিশেষজ্ঞ তাদের এ ব্যাপারটিতে দৃষ্টি দিতে বলছি এবং বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করতে অনুরোধ জানাচ্ছি।
Minhaz - ৬ মার্চ ২০০৯ (৬:২১ অপরাহ্ণ)
সামরিক বাহিনী আমাদের কতো বড় হবে, নিয়মিত বাহিনী আদৌ থাকবে কী না, সীমান্ত রক্ষী এবং অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর সাথে এর সম্পর্ক কী হবে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় শীর্ষ কাঠামোতে সামরিক বাহিনীর কতোটুকু অংশীদারীত্ব থাকবে, বার্ষিক বা পঞ্চবার্ষিক বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের ভারসাম্য কেমন হবে, সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরা জনপ্রশাসনে (বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসসহ) আসতে পারবেন কী না- এসব বিষয় নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। এসব ক্ষেত্রে আমাদেরকে সনাতন চিনতায় আবদ্ধ না থেকে নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করতে হবে। আপেক্ষিক চিন্তা আমাদেরকে কূপমণ্ডুক করে রাখবে, সামনে এগোতে দেবে না। আমাদের রাষ্ট্রনেতাদেরকে স্থানীয় ও নিজস্ব পরিবেশ-পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাণিজ্য ইত্যাদির মধ্য থেকে অগ্রাধিকার বিবেচনার ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে।
ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে জরুরিভিত্তিতে অনেকগুলো বিষয়ের সাথে এ বিষয়গুলোকে বিবেচনায় রাখা আবশ্যক মনে করে কথাগুলো লেখা হলো।
রায়হান রশিদ - ৮ মার্চ ২০০৯ (২:৩৯ পূর্বাহ্ণ)
@ Minhaz
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নগুলো। যে কোন সংকটে যেমন অনেক ক্ষতি এবং ত্যাগের গল্প থাকে, তেমনি থাকে সে সংকটকে পুঁজি করে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা সুযোগ-সন্ধানীর দল। এধরনের সংকট আমাদের চিরচেনা পরিমণ্ডলকে আন্দোলিত করে, লন্ডভন্ড করে দেয়। কিন্তু এও তো সত্য যে এর ফলে যে অস্থিরতা তা আমাদের শক্তি জোগায় চিরচেনা পরিবেশকে (এর নিয়ম, প্রথা) নতুন করে নতুন ভাষায় প্রশ্ন করার। বুঝি এভাবেই সংকট সম্ভাবনার মুখ দেখায়।
এই প্রশ্নগুলো নিয়ে আমরা সবাই মিলে উত্তর খোঁজায় ব্রতী হতে পারি না? কেউ একজন কি শুরু করবেন? শুরুতে হয়তো আমাদের জানার অনেক ঘাটতি থাকবে। কিন্তু চলতে চলতেই না হয় জেনে নেব, সবাই মিলে। শুরু করাটা জরুরি।
আরমান রশিদ - ২৩ মার্চ ২০০৯ (৮:৩১ অপরাহ্ণ)
@রায়হান
আপাত দৃষ্টিতে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও ঘটনার পর থেকেই কেন জানি শুধু কর্নেল তাহেরের কথা মনে পড়ছে। তার কিছু কিছু কর্মকান্ড জাতীর কাছে তাকে বিতর্কিত/প্রশ্নবিদ্ধ করেছে ঠিকই কিন্তু তার সে সব কাজের পেছনের motive বা তার দেশপ্রেম আমার ধারনা এখনো প্রশ্নাতীত। জিয়ার উত্থানের পেছনে তার অবদানের কথা স্বরন করেই হয়তো আজকাল কিছু কিছু পত্রিকায় তাকে খাটো করে দেখাবার চেষ্টা চলছে তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না জিয়ার এইরূপ উত্থান তিনি নিজেও কখনো চাননি এবং সেই ভুলের মাসুল তাকে দিতে হয়েছিল নিজের জীবন দিয়ে। তার মৃত্যুর সাথে সাথে চীরতরে চাপা পড়ে গেছে working-army আর people’s-army র মত তার সেই স্বপ্নগুলি। এই স্বপ্নগুলি কি শুধুই কর্নেল তাহেরের?
অবিশ্রুত - ১৭ এপ্রিল ২০০৯ (১:০৮ পূর্বাহ্ণ)
কর্নেল তাহেরের এই গণবাহিনীর ধারণা নিয়ে একটি আলাদা আলোচনার সূত্রপাত ঘটানোর জন্যে আপনাকে অনুরোধ করছি আরমান রশিদ। তিনি অথবা জাসদের পার্টি কী চেয়েছিলেন, তা আলোচিত হওয়া প্রয়োজন। সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠার পরও সামরিক বাহিনী কেন পুরানো ধাঁচের সামরিক বাহিনীই রয়ে গেল, সেটিও আমাদের প্রশ্ন।
তবে তাহেরের আরও একটি ধারণা আমাকে এটির চেয়েও নাড়া দেয় (কেননা গণবাহিনীর ধারণা বা জনগণকে নিয়ে প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলার ধারণা কম-বেশি অনেকেরই ছিল); আর সেটি হলো সোনার বাংলা গড়তে হলের ধারণা। বোধকরি ১৯৭৪-এর সালের দিককার সাপ্তাহিক বিচিত্রা-র কোনও এক ইস্যুতে লেখাটি পড়েছিলাম। নদীর গতিপথ পরিবর্তন না করে বরং নদীর তীরকে কেন্দ্র করে চাষ ও বাসস্থান ও নগর গড়ে তোলার ধারণা আমাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। এখন অবশ্য অনেক পরিবেশবাদীই নদী বাঁচানোর কথা বলেন; কিন্তু, সেই ১৯৭৪-এর দিকে একজন রাজনীতিক নদীমাতৃক এ দেশের অন্তর বুঝে সোনার বাংলা কীভাবে গড়া যায় সেই স্বপ্ন বয়ান করছেন, – চিন্তা করা যায়?
তুষার - ১৬ এপ্রিল ২০০৯ (৯:২৫ পূর্বাহ্ণ)
লেখাটা ভালো লেগেছে। আশাকরি এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করা হবে এবং BDR-এর যৌক্তিক দাবিগুলোও পূরণ করা হবে। BDR-এর নাম পরিবর্তনের কোনো দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা ধোয়া তুলসী পাতা না।
অবিশ্রুত - ১৭ এপ্রিল ২০০৯ (১:২০ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ তুষার।
বিডিআর-এর নাম পরিবর্তনের বিষয়ে এই ব্লগের আর একটি লেখার মন্তব্যপর্বে আমি আমার অবস্থান জানিয়েছি, দেখেছেন হয়তো। সেখানে লেখা হয়েছে, তা হলে তো দু’ দু’জন রাষ্ট্রপতির (যাদের একজন এ দেশের স্থপতি, মুক্তিআন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, যার সঙ্গে তাঁর পরিবারসদস্যদেরও হত্যা করা হয়েছে) রক্তের দাগ যাদের পোশাকে লেগে আছে, তাদের বাহিনীর নামও পাল্টানো উচিত ছিল।
এর মধ্যে ১২ জন বিডিআর সদস্য মারা যাওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে। এ মন্তব্য করা অবধি সর্বশেষ মৃত্যুর খবরটি প্রকাশ পেয়েছে গত ১৩ এপ্রিল। বিস্ময়কর হলেও সত্য, এইসব মৃত্যু নিয়ে কেউ কোনও প্রশ্নই তুলছেন না। এ ধরণের মৃত্যু সম্পর্কে প্রতিক্রিয়াহীনতার মধ্যে দিয়ে কি বড় ধরণের কোনও অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরও প্রতিক্রিয়াহীন থাকার অথবা থাকানোর পথ প্রশস্ত করা হচ্ছে না?
এসব মৃত্যুর পশ্চাৎ-কারণ কি প্রতিশোধস্পৃহা?
রায়হান রশিদ - ১৭ এপ্রিল ২০০৯ (৩:৩৩ পূর্বাহ্ণ)
@অবিশ্রুত#৯
ধন্যবাদ এই স্বল্পগোচর মৃত্যুগুলোর কথা তুলে ধরার জন্য। পত্রিকা পড়ে যতদূর জেনেছি, এর প্রতিটি ঘটনাই খুব রহস্যময়তায় আবৃত। হঠাত যেন বিডিআর সদস্যদের মধ্যে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার হিড়িক (নাকি মড়ক!) লেগে গেছে। এগুলো যদি কোন গোষ্ঠীর প্রতিশোধপরায়নতা কিংবা নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার প্রবণতা থেকে উদ্ভুত হয়ে থাকে, তাহলে যেটা লক্ষ্যনীয় সেটা হল – জড়িত ব্যক্তিরা (যদি কেউ থেকে থাকেন) এমনকি “কভার স্টোরী” তৈরীর ব্যাপারেও অত্যন্ত উদাসীন; এমনকি একরকম ড্যাম কেয়ারই বলা যায় তাদের। জানতে ইচ্ছে করে – এই ড্যাম কেয়ার মনোভাবের উৎস কি? কেন যেন মনে হচ্ছে সরকার এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর প্রতি এক ধরণের তোষণ নীতি অবলম্বন করে আসছে শুরু থেকেই। তাতে কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে বলে মনে হয়না। আর, একটা অন্যায়কে যে আরেকটা অন্যায় দিয়ে সংশোধন করা যায়না, তা কে না জানে!
Pingback: Arman Rashid | ঊদয়ের পথে শুনি কার বানী... | মুক্তাঙ্গন
মাসুদ করিম - ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১১ (২:০৩ অপরাহ্ণ)
গতকাল বিএনপি একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছে ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ড ২০০৯ — নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রে নিহতদের স্মরণে’ — এই ছিল শিরোনাম। সেখানে সেনাবাহিনীর প্রাক্তন প্রতিবেশী খালেদা জিয়া কিছু উদ্ধৃতিযোগ্য কথা বলেছেন তার কিছু কিছু আমি বোল্ড করে দিয়েছি।
এরমধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এই কথা যে, ১৯৭১ সালের ৯মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধেও জাতিকে ৫৭ জন অফিসার হারাতে হয়নি, তথ্যটি কি সত্য কিনা আমি জানি না, যদি সত্য হয় তাহলে তো আমরা ভাবব ত্রিশ লক্ষের মধ্যে বাংলাদেশের যুদ্ধরত সেনাবহিনীর ৫৭জন অফিসারও মারা যায়নি এতই যুদ্ধকৌশলী ছিল যুদ্ধরত সেনাবাহিনীর অফিসাররা, নাকি এটা ভাবব সেনা বাহিনীর অফিসাররা জওয়ানদের ওপর যুদ্ধের দায়িত্ব দিয়ে নিজেরা নিরাপদ বলয়ে জীবন কাটাচ্ছিলেন। সেনাবাহিনীর প্রাক্তন প্রতিবেশী খালেদা জিয়াই হয়তো এই বিষয়ে সবচেয়ে জ্ঞানী।
খবরের লিন্ক এখানে।
অবিশ্রুত - ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ (১০:০৭ অপরাহ্ণ)
ধারণাই করা যায়নি এর শেষে পিলখানার ট্র্যাজেডি জড়িয়ে আছে…