টেলিভিশনে ওই দৃশ্য অনেকেই দেখেছেন,- প্রবীণ রাজনীতিক আবদুল জলিল সংসদে বক্তৃতা দিতে গিয়ে কাঁদছেন। আমার টিভি দেখা হয় না, আমি শুনেছি এবং সংবাদ পড়েছি (বিডি নিউজ টুয়েন্টি ফোর, ২৯ জানুয়ারি)। কাঁদতে কাঁদতে তিনি তার সদ্য কারানির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন, ডিজিএফআই-এর দোর্দণ্ড প্রতাপ সম্পর্কে আর তাঁর অবর্ণনীয় মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। এসব ঘটনা এমন যে তা কখনও পুরোপুরি বর্ণনা করা যায় না, শ্রোতাদের খানিকটা অনুমানও করে নিতে হয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আবদুল জলিল যখন কাঁদছিলেন তখন তাঁকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে কোনও দলীয় নেতা এগিয়ে যাননি, সহানুভূতির কথা শোনাননি। স্পীকারের বাম দিকের আসন থেকে উঠে গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন। বোধহয় আওয়ামী লীগ সাংসদদের কেউই ঝুঁকি নিতে চাননি।

ঝুঁকি,- হয়তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি! যদিও শেখ হাসিনা নিজে ওই সময় ছিলেন না সংসদে।

সকলের কাছেই আমাদের অনুরোধ থাকবে, এ ঘটনাটি বিবেচনা করে দেখবার। সংসদীয় গণতন্ত্রে মন্ত্রিসভা গঠনে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাই মুখ্য; সেদিক থেকে খুবই স্বাভাবিক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন এমন ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভায় রাখবেন। এ ব্যাপারে আমরা আপাতত এটুকুই বলতে পারি, শেখ হাসিনা তাঁর অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ, পরীক্ষিত, অনুগত প্রবীণ ও তরুণদের বেছে নিয়েছেন তাঁর মন্ত্রিপরিষদ গঠন করতে গিয়ে। এখনও অনেকে পাইপলাইনে, অপেক্ষা করছেন মন্ত্রিত্বের জন্যে। আবদুল জলিল অবশ্য সেই তালিকায় নেই, সেটা তিনি নিজেও জানেন। মজার ব্যাপার হলো, তিনি যে-সময়ে ডিজিএফআই-এর কর্মসীমানা নির্ধারণ করে দেয়ার কথা বলেছেন, সে-সময়েই সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল মইন উদ্দিন আহমেদ একটা মোটাসোটা বই লিখে তাঁর সামরিক জীবনের স্মৃতিচারণ করেছেন। প্রজাতন্ত্রের একজন সরকারি সামরিক কর্মকর্তা তাঁর চাকরি জীবনের স্পর্শকাতর বিষয়গুলি নিয়ে চাকরিরত অবস্থাতেই জনসমক্ষে লেখালেখি করতে পারেন কি না, সে প্রশ্নের উত্তর জানা আছে আমাদের। তাই রাজনীতিতে ডিজিএফআই-এর হস্তক্ষেপ বন্ধ করার জন্যে আবদুল জলিলের ওই কান্নাসিক্ত দাবি আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে যে পূরণ করা সম্ভব হবে না, সেটিও আমরা বুঝতে পারি।

আওয়ামী লীগ সরকার এর মধ্যে কৃষকদের জন্যে ইতিবাচক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, দ্রব্যমূল্য কমানোর জন্যেও চেষ্টা চালাচ্ছে, সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে একটি প্রস্তাবও গত ২৯ জানুয়ারি বৃহষ্পতিবার সংসদে অনুমোদন পেয়েছে এবং এ ব্যাপারে সরকার পদক্ষেপ নিতে চলেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন কয়েকদিন আগে বলেছেন – ‘যুদ্ধাপরাধীরা যাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে’ এবং ‘বর্তমান সরকারের মেয়াদকালের মধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পূর্ণ করা হবে’ (ইত্তেফাক, ৩১ জানুয়ারি)। কিন্তু এর পাশাপাশি এমন অনেক দৃষ্টান্তও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তৈরি করেছেন, যা মানুষকে শঙ্কিত করে তুলেছে।

একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে কোনও কোনও পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেছিলেন, ‘সামনে যে-দলই সরকার গঠন করুক, তাকে বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদের তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে র প্রণীত কিছু এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার তারই মাঠ পর্যায়ের কাজ সম্পূর্ণ করেছেন। প্রথমে তারা এ কাজটির জন্যে বেছে নিয়েছিলেন ড. ইউনূস ও কোরেশীর মতো ব্যক্তিদের। কিন্তু তাতে কাজ হবে না বুঝতে পেরে অ্যাবাউট টার্ন করেছেন হাসিনা ও খালেদার কাছে।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই মাঠ পর্যায়ের কাজ করতে তখন কি ডিজিএফআই কি সুশীল সমাজ উভয়েই পাল্লা দিয়েছিল। তার পরের কথাও জানা আমাদের। হাসিনা ও খালেদার, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ঘোড়দৌড়ে জয় হয়েছে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা আগে থেকেই বলে আসছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রমকে তারা বৈধতা দেবেন। এখন তাদের বৈধতা দেয়ার পালা, এখন তাদের বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অপ্রকাশিত সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার পালা। কী আছে এরকম সব পরিকল্পনার মধ্যে? মনে হয় না, গলা তুলে বলার প্রয়োজন আছে। আমাদের সকলের চোখ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুর ওপর নিবদ্ধ, মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টি তখন তৎপর হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সঙ্গে “টিফা” চুক্তি সম্পাদন করতে।

সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী দেশগুলি আগেই বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ধারণাকে অনেক কাটছাট করে ফেলেছে এবং এ কারণে ধর্মীয় রাজনীতি তাদের কাছে আর আপত্তিকর মনে হয় না। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কখনও তাই আপত্তিকর মনে হয় না। বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, বাংলাদেশে সফররত মার্কিন কর্মকর্তা ও প্রতিনিধিরা এবং মার্কিন কূটনীতিকরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-র পর যে দলটির সঙ্গে বৈঠক করে সে দলটি হলো জামায়াতে ইসলামীঁ। বিশ্বের দেশে দেশে মৌলবাদী দলগুলির উত্থানের পেছনে, তালেবান থেকে আল কায়েদা উত্থানের পেছনে এই দেশটির ভূমিকা কারও অজানা নেই।

কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যু চাঙ্গা হয়ে ওঠার পর জামায়াতে ইসলামীর এরকম নাজুক পরিস্থিতিতে তাদের পুরানো মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি না বলছে, ‘এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার!’ অন্য দেশের ব্যাপারে নাক গলাতে ওস্তাদ যুক্তরাষ্ট্রের এই বক্তব্যের চেয়ে সেরা কৌতূক আর কী হতে পারে! আর শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন, জামায়াতে ইসলামীর আরেক মিত্র সৌদী আরবকেও কোনও রকম আওয়াজ দিতে দেখা যাচ্ছে না; বরং সৌদী রাষ্ট্রদূত বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার পর (আমাদের সময়, ২৮ জানুয়ারি) বিএনপির মুখপাত্র মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে বলতে শোনা যাচ্ছে, বিএনপিও চায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হোক! বেগম জিয়ার পররাষ্ট্রবিষয়ক মুখপাত্র শমসের মোবিন চৌধুরী অবশ্য বলেছেন, সৌদী রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে নাকি খালেদা জিয়ার জনশক্তি রপ্তানী নিয়ে কথা হয়েছে! দেশের এইরকম এক পরিস্থিতিতে সৌদী রাষ্ট্রদূত যে কেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দ্বি-রাষ্ট্রীয় স্বার্থ তথা জনশক্তি রপ্তানী নিয়ে কথা বলতে গেছেন, তা আমাদের পক্ষে বোঝা খুবই কঠিন। তবে দেখা যাচ্ছে তার পরপরই বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বলছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে আমরা নীতিগতভাবে সমর্থন করি। তবে রাজনৈতিকভাবে নয়, সত্যিকার অর্থে বিচার করা হলে আমরা এর বিরুদ্ধে নই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এখন কারো আপত্তি থাকারও কথা নয়। . . . রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এ বিচার যাতে না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মোট কথা বিচার কী প্রক্রিয়ায় এবং কী পদ্ধতিতে হবে, তা আগে জানতে হবে। তারপর এ ব্যাপারে সঠিক মন্তব্য করা যাবে (ইত্তেফাক, ৩১ জানুয়ারি)।’ লক্ষ্য করুন, দেলোয়ার হোসেন বলছেন, ‘এখন কারো আপত্তি থাকার কথা নয়।’ তো গত কয়েকমাসের মধ্যে অবস্থার কী এমন পরিবর্তন ঘটেছে যে বিএনপি-র আর আপত্তি নেই? আবার বিচার প্রক্রিয়ার কথাই বা তারা বার বার জোর দিয়ে বলছে কেন? বিএনপি-র এই অবস্থান জামায়াতে ইসলামীকে হতভম্ব করেছে। অবশ্য তার আগে থেকেই জামায়াতে ইসলামীর গলার স্বর করুণ হয়ে আসছিলো। যেমন, নিজামী বলছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরোধিতা করা জামায়াতের রাজনৈতিক ভুল ছিল’, আর এখন একটি ইংরেজি দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের অবস্থান নিয়ে ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে’। তবে জামায়াতে ইসলামী সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী হতভম্ব হয়ে গেলেও জোরেশোরে বলছে যে, ‘বিচারের জন্যে তারা প্রস্তুত এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বিচার করা হোক।’ এ ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম তো বলা চলে দৈনিকই কোনও না কোনও প্রতিবেদন বা কলাম ছাপিয়ে চলেছে। একই সময়ে দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে জাতিসংঘের সাহায্য চাইছেন এবং একই ঢাক পেটাচ্ছেন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের প্রধান সমন্বয়কারী অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা হারুনর রশিদ।

তা হলে কি আমাদের ধরে নিতে হবে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে ‘যুদ্ধাপরাধী গ্রহণযোগ্যকরণ প্রকল্প’ হাতে নিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ আসলে সেটিকেই বাস্তবায়ন করতে চলেছে জাতিসংঘের মধ্যস্থতাতে? কথিত ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়ে তোলার জন্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সুশীল সমাজ যে বিরোধনিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তারই উপসংহার টানতে চলেছে আওয়ামী লীগ সরকার এ উদ্যোগ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে?

আর এসব যখন ঘটছে, তখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টি বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করছেন এবং বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে নাকি টিফাকে বেশ লাভজনক মনে হচ্ছে আজকাল!

আমরা জানি না, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে, তার মন্ত্রিপরিষদের কাছে টিফা চুক্তি করার জন্যে কারা ওকালতি করছেন। ইতিমধ্যেই কয়েকজন উপদেষ্টা নিয়োগ করার মধ্যে দিয়ে শেখ হাসিনা নিজের চারপাশে একটি ব্যুহ রচনা করে ফেলেছেন। গত পাঁচ বছর সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে যেমন ছিলেন তার সন্তান তারেক রহমান, তেমনি বিরোধী দলীয় শেখ হাসিনার সঙ্গেও ছিলেন উপদেষ্টা হিসেবে সজীব ওয়াজেদ জয়। যদিও শেখ হাসিনা বিরোধী দলীয় নেত্রী হওয়াতেই হয়তো তা আমাদের চোখে পড়েনি, তবে এখন এই উপদেষ্টা জয়কে অনেক সচল দেখা যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরও উপদেষ্টা আছেন। আছেন সাবেক আমলা এইচ টি ইমাম, ড. মশিয়ুর রহমান, মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকি, ডা. মোদাচ্ছের আলী, ড. আলাউদ্দিন আহমদ। তা ছাড়া সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদের যেমন ড. তামিম ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর রয়েছেন তেমনি এক ড. তৌফিক-ই-এলাহীঁ। এরপর বোধকরি বলার আর অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের তেল-গ্যাস-সমুদ্র বন্দর নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে-এজেন্ডা ছিল, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সেটা থেকেও পিছপা হবে না, বরং এগিয়ে যাবে ফখরুদ্দীনের ওই ঝাণ্ডা হাতে।

এককালের মুক্তিযোদ্ধা তৌফিক-ই-এলাহী সামরিক জান্তা এরশাদের শাসনামলের ক্ষমতাধর সচিব ছিলেন এবং তাঁর ক্ষমতা চর্চা আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় শাসনপর্বেও (১৯৯৬-২০০১) অব্যাহত থাকে। মাগুরছড়া গ্যাস দুর্ঘটনার পর সরকারি তদন্ত কমিটির দেয়া রিপোর্টটি দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী মার্কিন তেল কোম্পানি অক্সিডেন্টালের বিপক্ষে যাওয়ায় তিনি তার আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার জোরে তা অকার্যকর করে রাখেন। গণ আন্দোলনের চাপে সংসদীয় কমিটি গঠিত হলে সে কমিটিকেও উপেক্ষা করেন তিনি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি তখন এ নিয়ে আলোচনার জন্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ওই রিপোর্ট চাইলে সে দাবি অগ্রাহ্য করেন তিনি। প্রতিবাদে সংসদীয় কমিটির কয়েক সদস্য ওয়াক আউট করলেও ড. তৌফিক তাঁর খুঁটির জোরে বুক চিতিয়ে জ্বালানি সচিবের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। প্রথমে অক্সিডেন্টাল এবং পরবর্তী সময়ে ইউনোকলের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে সব কিছুই করেছেন তিনি। একজন মানুষ মুক্তিযোদ্ধা হলেই যে তিনি সারা জীবন দেশের স্বার্থ রক্ষা করবেন, এ কথা দিব্যি দিয়ে বলা যায় না; এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই আমলা।

তৌফিক-ই-এলাহীর ওই সময়ের ভূমিকা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের বিগত শাসনামলের একজন মন্ত্রী জানিয়েছেন, মিটিংয়ে জ্বালানি সচিবের কাছে মাগুরছড়ার তদন্ত কমিটির তদন্ত রিপোর্ট চাইলে তিনি প্রথমে সেটি নিয়ে আসতে ভুলে গেছেন বলে জানান। এতে সংসদীয় কমিটির সবাই উত্তেজিত হয়ে তাকে রিপোর্টটি নিয়ে আসতে বললে তিনি জানান, ‘স্যরি, রিপোর্টটি গোপনীয় এবং তা কাউকে দেখানো সম্ভব নয়।’ বুঝুন অবস্থা! সংসদীয় কমিটিকে একজন আমলা বলছেন, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা বজায় রাখার স্বার্থে তদন্ত রিপোর্ট দেখানো যাবে না!

অথচ জোট সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতেই খুঁজে পাওয়া যায় এ রিপোর্টটিকে। তখন জানা যায়, রিপোর্টটি ধামাচাপা দিয়েছিলেন জ্বালানি সচিব ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান দুজন মিলে। তারপর ড. হোসেন মনসুর পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিলে রুমের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় রিপোর্টটিকে। সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেনের কাছে তখন সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেন তদন্ত রিপোর্টের কথা। ভদ্রলোকের আবার সাংবাদিকদের মতো জানা ছিল না যে রিপোর্টটি খুঁজে পাওয়া গেছে। তিনি তাই প্রথমে আকাশ থেকে পড়েন, নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করেন, তারপর তার রুম থেকেই ওটা পাওয়া গেছে জানালে বলে ওঠেন, ‘আমি দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পর রুম থেকে কী পাওয়া গেল না গেল সেটা তো আমার জানার কথা নয় (বিস্তারিত জানার জন্যে পড়ুন : ‘বাংলাদেশের খনিজসম্পদ ও জাতীয় স্বার্থ’ গ্রন্থের ‘মাগুরছড়া অগ্নিকাণ্ড, ক্ষতিপূরণ কি পাবে বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন)। তদন্ত রিপোর্টটি খুঁজে পাওয়াতে বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব হয় চার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করা। এই সুযোগে আমরা ধন্যবাদ জানাই তখনকার যুগ্ম সচিব মাহাফুজুর রহমানকে, যার নেতৃত্বে তদন্ত কমিটিটি গঠিত হয়েছিল এবং যিনি দেশের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছিলেন। কামনা করি, ভবিষ্যতেও তিনি প্রতিটি ক্ষেত্রে একই ভূমিকা রাখবেন এবং ড. তৌফিক-ই-এলাহী বীর বিক্রমের মতো একটা মুক্তিযুদ্ধ করেই ক্লান্ত হয়ে পড়বেন না।

শুধু এই মাগুরছড়া কেলেংকারীর সঙ্গে নয়, তৌফিক এলাহীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে নাইকোর স্বার্থ সংরক্ষণ করার। তার এক নিকটাত্মীয় নাইকোর ভাইস প্রেসিডেন্ট (দক্ষিণ এশিয়া) নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি চোখের পর্দা কেটে ফেলে নাইকোকে কাজ দেয়ার তৎপরতা শুরু করেন। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিব হওয়ায় এ ব্যাপারে কোনও অসুবিধা হয়নি তাঁর। জোট সরকারও কোনও অসুবিধা করতে পারে নি তাঁর, কেননা ব্যারিস্টার মওদুদের মতো আইনপাপী ব্যক্তি তাঁর ভায়রা।

এ হেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর জন্যে এখন সাফাই গাইতে শোনা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে। গত ২৮ জানুয়ারি বুধবার ওয়াশিংটন ডিসির জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (এসএআইএস) এবং যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল (ইউএসবিবিএসি)-এর এক সেমিনারের প্যানেলিস্ট হিসেবে কথা বলার সময় তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, তৌফিক-ই-এলাহীর মতো ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়ায় কোনও ভুল হয়নি। জয় আরও বলেছেন, ‘কেউ কেউ বলতে পারেন যে তৌফিক-ই-এলাহী বিতর্কিত, কিন্তু আরো অনেকেই আছেন যারা তা মনে করেন না (বিডি নিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম, ২৯ জানুয়ারি)।’ তৌফিক-ই-এলাহীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জয় মন্তব্য করেন, ‘বিশ্বাসযোগ্য কোন প্রমাণ ছাড়াই তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকে জেলে পুরেছিল আর আমার মা তাদেরই একজন।’ তৌফিক-ই-এলাহীর খুঁটির জোর এখন কোথায়, আশা করি তা বোঝা তেমন কঠিন নয়। এ-ও বোঝা কঠিন নয়, এরকম উপদেষ্টা থাকলে ডিজিটাল বাংলাদেশ নয়, বরং ডিজিটাল দুর্নীতিই জুটবে বাংলাদেশের জনগণের কপালে।

আওয়ামী লীগ সরকার এর মধ্যেই বিরোধী দল বিএনপিকে ডেপুটি স্পিকারের পদটি না দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে একটি সংকট তৈরি করেছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে জ্বালানি ও বাণিজ্য ক্ষেত্রেও তারা এরকম আরও সংকট তৈরির জন্ম দেবেন। নির্বাচনের আগে কেন আওয়ামী লীগ আরও একটি ডেপুটি স্পিকারের পদ সৃষ্টি করে তা বিরোধী দলকে দেয়ার কথা বলেনি, এই প্রশ্নের উত্তর আওয়ামী লীগের দেয়া উচিত। এরও একটি ব্যাখ্যা দেয়া উচিত, কেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিরোধী দলীয় সাংসদদের শপথ গ্রহণের সংবাদচিত্র প্রচার করা হয়নি। টিফা চুক্তির বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটি জানার পরও কেন বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টির সাথে কথা বলার পর অত উৎসাহ দেখিয়েছেন তারও ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

টিফা চুক্তি করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা চালাচ্ছে সেই ২০০৩ সাল থেকে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে বটে, টিফা কেবলই বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিষয়; কিন্ত বাংলাদেশকে এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে বড় ধরণের সব ছাড় দিতে হবে। রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকরা নন, বরং আমলাতন্ত্রের নীতিনির্ধারকরাই ক্ষমতাবান হয়ে উঠবেন এ চুক্তির মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশকে জ্বালানি সুবিধা দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে, কেননা পণ্য রফতানি নয়, বরং সেবা রফতানি করতে পারবে বাংলাদেশ আর এই ক্ষেত্রে জ্বালানিসেবা ছাড়া আর কিছুই দেয়ার নেই বাংলাদেশের।

আমরা দেখতে পাচ্ছি এর মধ্যেই উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী মিডিয়াতে তাঁর অনুগত সাংবাদিক বাহিনী তৈরির কাজে নেমে পড়েছেন। জোট সরকারের আমলে যেমন এশিয়া এনার্জির অর্থানুকুল্যে একটি সাংবাদিক চক্র গড়ে উঠেছিল, তারা অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করছিল আর তাদের পত্রিকায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের পক্ষে সংবাদ ও প্রতিবেদন পরিবেশন করছিল, সোজা কথায় এশিয়া এনার্জির পক্ষে দালালি করছিল, তৌফিক-ই-এলাহীরও এখন দরকার সেরকম একটি রিপোর্টার বাহিনীঁর। এর মধ্যে তিনি গত ২৯ জানুয়ারি বৃহষ্পতিবার পিআইবি মিলনায়তনে ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশ (এফইআরবি)-এর একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা উদ্বোধন করেছেন। অনুগত সাংবাদিক বানানোর লক্ষ্যে এটি তাঁর প্রথম পদক্ষেপ, যা হয়তো এই রিপোর্টারদেরও জানা নেই। আমরা সকল সাংবাদিককে অনুরোধ জানাচ্ছি এ-সম্পর্কে সতর্ক থাকতে এবং বিতর্কিত ব্যক্তিদের দিয়ে এ ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধন না করতে।

এটি খুবই আশার ব্যাপার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্যে সরকার উদ্যোগ নিতে চলেছেন; কিন্তু এরকম এক শুভ উদ্যোগের পাশাপাশি সরকার যদি যুদ্ধাপরাধী ইস্যুটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিংবা জাতিসংঘের হাতে ছেড়ে দেন তা হলে তা হবে শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেয়ার মতো ঘটনা। একইভাবে যদি তারা যুদ্ধাপরাধী বিচারের আনন্দে দেশবাসীকে মাতিয়ে রেখে দেশের জ্বালানী ও খনিজ খাতে এরকম সর্বনাশ ডেকে আনেন, বাণিজ্যখাতে স্বার্থের জলাঞ্জলি দেন, মিডিয়াকে বশে রাখতে চান এবং সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে কূটকৌশল বেছে নেন তা হলে তা দেশের জন্যে একই পরিণাম ডেকে আনবে। কোনও কোনও অবস্থান বা পদ শূন্য থাকাই ভালো। যেমন, চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানের তারুণ্যদীপ্ত দুর্নীতির জায়গাটি শূন্য থাকাই ভালো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়েরও (তাঁর নিজের বক্তব্য অনুযায়ী অবশ্য প্রধানমন্ত্রী নন, বরং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা তিনি) সতর্ক হওয়া প্রয়োজন এরকম সব সাফাই গাওয়ার আগে। তিনি তারেক রহমানের চেয়ে বেশি শিক্ষিত, লোকজনের সামনে এই গৌরব প্রকাশ করাটা (যেমনটি তিনি সেমিনারে করেছেন) খুবই দীনতার লক্ষণ। তা ছাড়া তাঁর জানা দরকার, ড. তৌফিক-ই-এলাহীর মতো মানুষ জনের হাত ধরে চললে আওয়ামী লীগ সরকার বড়জোর ডিজিটাল দুর্নীতির জন্ম দিতে পারবে, ডিজিটাল বাংলাদেশের নয়। দিন বদলাতে পারবেন না, পারবেন পুরানো দিনই আরও বিকৃতাকারে ফিরিয়ে আনতে। যা কারও কাম্য নয়।

২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯।

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

18 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
18
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.