এই বিজয় দিবসে যখন আমাদের অনেকেরই মনে পড়ছে, গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদরা একাত্তরে কে কোথায় ছিলেন, তখন আমরা কি পারি সেই তালিকায় আরও একটি নাম জুড়তে? আমরা কি পারি খোঁজ করতে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অন্যতম প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগ ও বিবিধ বামদলের সঙ্গে মহাজোট গঠনকারী জাতীয় পার্টির নেতা এবং স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা, জনগণের আন্দোলনে পদচ্যুত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ তখন কোথায় ছিলেন?
কাগজপত্র বলে, হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ তখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে ছিলেন। কিন্তু এমন নয় যে, বাংলাদেশের আরও অনেক সামরিক কর্মকর্তাদের মতো তিনি বন্দী ছিলেন। যুদ্ধ শুরুর সময় তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন, কিন্তু যুদ্ধে যোগ না দিয়ে তিনি এপ্রিলের প্রথম দিকে পাকিস্তানে পাড়ি জমান। সেপ্টেম্বর মাসে আবারও বাংলাদেশে আসেন তিনি, অসুস্থ বাবাকে দেখতে। তাহের কিংবা খালেদের মতো পাকিস্তান থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার মনোবাসনা এরশাদের স্বপ্নেও জাগেনি। পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার জন্যে খুবই সক্রিয় ছিলেন ওই সময়ে হুসেইন এরশাদ,- এতই সক্রিয় যে মুক্তিযুদ্ধের তুঙ্গ মুহূর্তে যখন বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কমান্ড মরণপণ লড়াই শুরু করেছে, তখন এরশাদের অধিনায়কত্বে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল পাকিস্তানের হয়ে পাল্টা আক্রমণে অংশগ্রহণ করে। পরে পাকিস্তান যখন ১৯৭২ সালে আটকে পড়া বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ও সৈনিকদের বিচার করার জন্যে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তখন এরশাদকে নিযুক্ত করা হয় সেটির চেয়ারম্যান হিসেবে। কতজন নিরীহ বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা শাস্তি পেয়েছেন তাঁর ট্রাইব্যুনাল থেকে? কতজনকে মগজ ধোলাই করা হয়েছে ওই সময়ে? আমাদের জানা নেই সেই তথ্য। তবে পরে বাংলাদেশ আটকে পড়া সামরিক কর্মকর্তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিলে এরশাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কী এক অদৃশ্য কারণে এই এরশাদও আটকে পড়া সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তারপর চতুর এরশাদ বঙ্গভবনে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে যান তখনকার প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা রিয়াউদ্দিন মিয়া ভোলাকে নিয়ে। ভোলা মিয়া তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি শেখ মুজিবের পা ধরে চাকরি ফিরে পাওয়ার জন্যে আবেদন জানাতে থাকেন। আর ভোলা মিয়াও শেখ মুজিবকে বলেন, ‘আমার ভাগনের চাকরিটা না থাকলে ¯^vaxbZv যুদ্ধ করে কী লাভ হলো!’ অতএব ভোলা মিয়ার যাতে একটু লাভ হয় শেখ মুজিব সেই ব্যবস্থা করেন, তাঁর মহানুভবতার কারণে এই বিষাক্ত সাপটি সামরিক বাহিনীতে চাকরি ফিরে পান।
এখন, আমাদের প্রশ্ন, এরশাদ কি যুদ্ধাপরাধী নন? তিনিও তো পাকিস্তানী খান সেনাদের সাহায্য করেছেন, তাদের হয়ে যুদ্ধ করেছেন, তার নির্দেশে নিক্ষিপ্ত গুলিতে মারা গেছেন কোনও না কোনও যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধা। যে-অপরাধ জামায়াতে ইসলামী, তাদের সংগঠন ইসলামী ছাত্রশক্তি ও অন্যান্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলি ও সেসবের নেতা-কর্মীরা তখন করেছিল, তাদের সঙ্গে এরশাদের তফাৎ শুধু এ টুকুই, তিনি তখন কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। কিন্তু তাঁর আদর্শ যে ওই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শের মতোই ছিল, সে-প্রমাণ তিনি রেখেছেন সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর ওপর তার আস্থা ও আনুগত্য প্রকাশের মধ্যে দিয়ে এবং সংবিধানে রাষ্ট্র-ধর্ম বিলটি যুক্ত করার মধ্যে দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ যখন চলছিল, তখন মতিউর রহমান নিজামী ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর ওই সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশক্তির সভাপতি। তিনি তখন খুব বড় গলা করে বলতেন, পাকিস্তান একটি ভূখণ্ডের নাম নয়, একটি আদর্শের নাম। এই কথার তাৎপর্য বিশেষ করে এখন আমরা আরও ভালো করে বুঝতে পারি। তারা পরাজিত হয়েছেন একাত্তরে, তারপর কোনও না কোনওভাবে বাংলাদেশের ভৌগলিক অস্তিত্বের অনিবার্যতাও স্বীকার করেছেন, নতুন এই ভূখণ্ডের অস্তিত্ব মেনে নিয়েছেন; কিন্তু এবার তারা বাংলাদেশের কাঁধে ভর করেছেন পুরানো সেই রাষ্ট্রীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যে। এমনকি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও খুব বেশি দূরে বসবাস করেন না সেই আদর্শ থেকে। তাই তার পক্ষে খুব সহজেই সম্ভব হয় বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করা। তার এই অপকর্মের বিরুদ্ধে তখন সকলেই প্রতিবাদ করেছিল, একটি আহ্বান করা হয়েছিল। আট দল, পাঁচ দল এবং সাত দল সকলেই তখন ইসলামের অপব্যবহার করায় হরতাল করলেও জামায়াতে ইসলামীকে কিন্তু তখন ওই হরতালে খোদ বিএনপি-ও পাশে পায়নি।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে যুদ্ধাপরাধীর তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। তাতে সঙ্গতকারণেই ধর্মজ রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকের নাম রয়েছে। কিন্ত বিস্ময়ের ব্যাপার, এইসব তালিকায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নামটি বার বারই বাদ পড়ছে। তিনি যুদ্ধাপরাধী ছিলেন, তিনি স্বৈরাচারী ছিলেন, তিনি সামরিক বাহিনীকে অপব্যবহার করেছেন, তিনি সামরিকতন্ত্রকে সংবিধানসম্মত করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন; কিন্তু সেই তাকেই বার বার রাজনীতিতে, বিশেষ করে নির্বাচনের সময় অপরিহার্য মনে করা হচ্ছে!
দুই.
গত সপ্তাহে, অনেকেরই হয়তো এখন মনে নেই, খুব নিভৃতে স্বৈরাচার পতন ও গণতন্ত্র দিবস চলে গেছে ছয় ডিসেম্বরে| ১৯৯০ সালের এ দিনে পতন ঘটেছিল স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা এরশাদ সরকারের।
এই দিবসটি এখন একদিকে গৌরব ও বেদনার, অন্যদিকে আত্মদহনের। গৌরব ও বেদনার, কেননা একটি দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ ওইদিন একটি পরিণতিতে পৌঁছেছিল। সামরিকতন্ত্রের পতন ঘটেছিল। আর দিনটি পেয়েছিল একটি স্মারক দিবসের মর্যাদা। কিন্তু তারপর যত সময় গেছে, ততই তা হয়ে উঠেছে আত্মদহনের একদিন। কেননা কি বিএনপি, কি আওয়ামী লীগ উভয় দলই বার বার কাঙালপণা দেখিয়েছে, চেয়েছে ওই পতিত সামরিক জান্তার রাজনৈতিক সমর্থন। তাদের এই চাওয়া পাওয়া চরম এক স্থূলভাবে বার বার প্রকাশিত হয়েছে। এবং এবারের নির্বাচনেরও এর প্রকাশ ঘটেছে। এরশাদকে কমপক্ষে ছয় মাসের জন্যে রাষ্ট্রপতি বানানোর এক অলিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামী লীগ জোট গঠন করতে চেয়েছে জাতীয় পার্টির সঙ্গে। আসন বন্টনের জটিলতায় সেই জোট আপাতত ভেঙে গেছে, কিন্তু যে-কোনও মুহূর্তে তা জোড়াও লাগতে পারে। যারা আশি ও নব্বই দশকে আন্দোলন করেছেন, তারা জানেন এটি কত অবমাননার, কত বেদনার।
আশির দশকে যে ছেলেটি তরুণ ছিল, যে মেয়েটি তরুণী ছিল, হৃদয়ের সর্বস্ব দিয়ে তারা সামরিকতন্ত্রের পতন চেয়েছে, গণতন্ত্রের মুক্তি চেয়েছে। একাত্তরে তাদের পাকিস্তানি পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অবকাশ ছিল না। তারা তাই চেয়েছে সামরিকতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে একাত্তরের যুদ্ধের আকাঙক্ষাগুলিকে আবারও সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে পুনরুজ্জীবিত করতে; তারা চেয়েছে গণতন্ত্র, তারা চেয়েছিল সামরিকতন্ত্রের পতন, তারা চেয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা, তারা চেয়েছে ধর্মজ রাজনীতির অবসান।
এখন অবশ্য অনেকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্মনিরপেক্ষতার কোনও রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করা হয়নি। বলেন, যুদ্ধের পর বিভিন্ন সংবিধান ঘেটে বিদেশী প্রচারণায় এইসব যুক্ত করা হয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার জন্যে জামায়াতে ইসলামীর পত্রিকা দৈনিক সংগ্রাম-এ বার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে পাকবাহিনীর কাছে। পত্রিকাটির উপসম্পাদকীয়তে একবার লেখা হয়েছিল : ‘ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই এই সব ধর্ম নিরপেক্ষদের ধর্মবিরোধী অত্যাচার দেশবাসীকে সজাগ করে দিয়েছিল (ইতিহাস কথা বলে, দৈনিক সংগ্রাম, তিন জুলাই ১৯৭০)।’ পত্রিকাটিতে অবশ্য বলা হয়নি, সজাগ করে দেয়ার পরও কেন দেশবাসী তখন তাদের মতো ধর্মনিরপেক্ষতাবিরোধীদের ভোট দেয়নি। এদের নেতা মওদুদী আরও স্পষ্টভাবে একই অভিযোগ তুলে ধরেন ৬ জুন বিভিন্ন মুসলিম নেতা ও সংবাদপত্রে প্রচারের জন্যে পাঠানো স্মারকলিপিটিতে। তাতে তিনি লেখেন, বিচ্ছিন্নতাবাদের চক্রান্ত জোরদার করার জন্যে জনগণ শেখ মুজিবকে ভোট দেয়নি এবং তিনি এই পরিস্থিতির দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন বামপন্থীদের ওপরে। তিনি লেখেন, ‘আইয়ুব শাসন শেষ হবার পর নয়াযুগ শুরু হলে বামপন্থীদের পাকিস্তান খণ্ডবিখণ্ড করার চক্রান্ত গোপন থাকে না। তারা আঞ্চলিক ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি এবং উস্কানি দিয়ে দেশকে বিবদমান দু’টি অংশে পরিণত করে। শেখ মুজিবের দল গুণ্ডামি ও মারামারি করে নির্বাচনে জয়ী হয়। নির্বাচনের পর শেখ মুজিব ৬ দফার পক্ষে জোর প্রচার চালাতে থাকে।’
মওদুদীদের এইসব প্রলাপ থেকেই স্পষ্ট, বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার সংযোজন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার ফসল। আর সব সময়েই তারা এর বিরোধিতা করে আসছে। মুক্ত বাংলাদেশের সংবিধানে মাত্র সাড়ে চার বছর ছিল এই ধর্মনিরপেক্ষতার অস্তিত্ব। তারপর তার বিলোপ ঘটানো হয়েছে সামরিক পরোয়ানার মাধ্যমে। গণতন্ত্র অবশ্য তার আগেই বিদায় নিয়েছিল, সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বাকশাল গঠনের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন এসেছিল সেই সাংবিধানিক একনায়কত্বের চেয়েও অন্ধকার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের ছদ্দাবরণে, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে অন্ধকার সেই একনায়কত্বকে মৃত্যু পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী করতে সক্ষম হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। তারপর ক্ষমতায় এসেছিলেন জেনারেল এরশাদ, যার যুদ্ধাপরাধী চরিত্র বরাবরই অনালোচিত রয়ে গেছে।
এরশাদের শাসনামলের দিনগুলির কথা একবার চিন্তা করুন,- খুব অতীতের নয় সেইসব দিন; শিক্ষাভবনের দিকে যাচ্ছে ছাত্রমিছিল, কিন্তু টিয়ারগ্যাসের ধোঁয়ায়, গোলাগুলির ধোয়ায় ভরে যাচ্ছে ঢাকার আকাশ। চিন্তা করুন, মিছিলের ওপর ট্রাক তুলে দেয়া হচ্ছে, লুটিয়ে পড়ছে সেলিম-দেলোয়ার। তরুণদের তখন প্রিয় একটি উচ্চারণ ও দেয়াল লিখন ছিল, ‘আমরা সশস্ত্র হবো অজস্র মৃত্যুতে।’ মৃত্যুর মহাযজ্ঞে যোগ দিতে একটুও দ্বিধা ছিল না ওই সময়ের তরুণতরুণী কারও। দীর্ঘ প্রায় এক দশক ক্ষমতায় ছিল এই স্বৈরাচারী এরশাদ, কিন্তু একদিনও স্বস্তি পায়নি তারুণ্যের ওই আকাঙক্ষার কারণে। তারুণ্যের মধ্যে তখন আশাবাদ জেগে উঠেছিল, একাত্তরের পর অপূরিত ও বার বার খর্ব হয়ে যাওয়া প্রত্যাশাগুলি পূরণের মতো এক রাজনৈতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে ইতিবাচক ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করার, পূর্বপ্রজন্মের স্বপ্ন পূরণ করার।
কিন্তু ৩8তম বিজয় দিবসের এই প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দাবিদার দলগুলি এ কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চলেছেন? ˆ¯^ivPvi‡K তারা কোলে তুলে নিচ্ছেন না, বরং নির্মম সত্যি হলো, তারা চাইছেন স্বৈরাচারের কোলে উঠতে। তারা মধ্যযুগীয় চেতনার যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে কথা বলছেন বটে, কিন্তু নিজেরা সার ধরেছেন আধুনিক যুদ্ধাপরাধীর কৃপা পাওয়ার আশায়। যে-তারূণ্য নিজেদের অজস্র মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে তাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সশস্ত্র করে তুলেছিল, সেই তারুণ্যকে অবজ্ঞা, উপেক্ষা ও উপহাস করে চলেছে এইসব রাজনৈতিক দল। পাশাপাশি ভবিষ্যতের তারুণ্যও যাতে নিস্ক্রীয় থাকে সে-জন্যে সবখানে সাজানো হয়েছে ভোগবাদী জীবনের যাবতীয় আয়োজন, নেশাতুর জীবনের যাবতীয় আয়োজন। তরুণদের দুর্নীতির জুঁজু দেখিয়ে রাজনীতিবিমুখ করার অপচেষ্টা শুরু হয়েছে, যাতে নির্বিঘ্নে দেশের সম্পদ কর্পোরেট শক্তির কাছে তুলে দেয়া যায়। এই কাজের কাজীরা তারুণ্যের কাছে তাই পৌঁছে দিচ্ছে বিশ্ব-নাগরিকতার ধুঁয়া ও মোহ, যাতে তারুণ্য তার দেশপ্রেম হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে এবং কর্পোরেট-অংশীদারিত্বকেই জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ বলে মনে করে, কর্পোরেট-অংশীদারিত্বের সুবাদে কোনও না কোনওভাবে দেশ থেকে দেশে ঘুরে বেড়ানোটাই এখন হয়ে উঠেছে এদের কাছে বিশ্ব-নাগরিকতার সমার্থক।
কিন্তু তারা নিজেরাও জানেন না, এর মধ্যে দিয়ে নিজেদের সর্বাত্মক এক মৃত্যুর ক্ষেত্রই নতুন করে প্রস্তুত করতে চলেছে কর্পোরেটতন্ত্র। তারা মনে করছেন, কানসাট ও ফুলবাড়ির আন্দোলন বিচ্ছিন্ন ঘটনা, স্থানীয় ঘটনা। এসব আন্দোলনের সর্বস্তরস্পর্শী আবেদন এড়িয়ে যেতে চাইছে তারা। অস্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে তারা চাইছে এইসব আন্দোলনের চেতনাকে কবর দিতে। কিন্তু এসব আন্দোলনকে অরাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার যত চেষ্টাই চলুক, তরুণদের কাছে এর রাজনৈতিক দিক দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং এইভাবে রোপিত হচ্ছে নতুন এক রাজনৈতিক শক্তি,- যারা আবারও সশস্ত্র হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন অজস্র মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে।
এবারের বিজয় দিবসের প্রাক্কালে, সেই তরুণদের আমরা স্বাগত জানাই, কেননা তাদের মধ্যে দিয়েই আমরা অনুভব করছি নতুন এক সৃষ্টির আবাহন, আমরা শুনতে পাচ্ছি, যাকে নজরুলের ভাষায় বলা যায়,- ওই নতুনের কেতন ওড়ে, কালবোশেখির ঝড়…
আসুন, আমরা আবারও প্রস্তুতি নেই অজস্র মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সশস্ত্র হওয়ার,- যাতে এরশাদের মতো যুদ্ধাপরাধীদের, নিজামীর মতো যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত করা সম্ভব হয় এবং গড়ে তোলা যায় একাত্তরের স্বপ্নে পাওয়া বাংলাদেশটিকে।
১১ ডিসেম্বর ২০০৮

সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে… কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!
