বাংলাদেশকে যদি রাজনৈতিক মুসলমানের মন শাসন করে তবে সেই হারের মধ্যে বেঁচে থাকার ঔদ্ধত্য দেখিয়ে যেতেই হবে যতদিন বেঁচে থাকবে বাংলাদেশের মুক্তবুদ্ধি, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতির পথের সংস্কৃতি।[...]

তার পা পেছনে। দেশ সারা পৃথিবী। অর্থনীতি, প্রতিদিনের প্রয়োজনে মুক্তবাজারের বিনিয়োগ ব্যবসা লভ্যাংশ তার খুবই পছন্দের । প্রযুক্তি, আল্লাহ ও সৎমানুষের শাসনে তার বিশ্বাস। তাকে ঘিরেই জেহাদি জঙ্গির কাছ থেকে ফিরতে চায় – ভারত, চীন, ইউরোপ, রাশিয়া ও আমেরিকা। এই চাওয়ার সাথে বাংলাদেশকে মেলানো যায় না। তুরস্ক, মালেশিয়া, সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্যের তেলওয়ালা দেশগুলো, মিশর, মরক্কো, আলজিরিয়া, মধ্য এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলো, সুদান, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া… এরকম আরো আরো মুসলিম দেশের কোনো একটির সাথে বাংলাদেশের কোনো মিল নেই। কিন্তু কোনো মিল না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে যদি রাজনৈতিক মুসলমানের মন শাসন করে তবে সেই হারের মধ্যে বেঁচে থাকার ঔদ্ধত্য দেখিয়ে যেতেই হবে যতদিন বেঁচে থাকবে বাংলাদেশের মুক্তবুদ্ধি, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতির পথের সংস্কৃতি।

জামাতের মধ্যে এবং আরো বড় করে দেখলে বিএনপির মধ্যে ও আরো দুঃখজনক রূপটি দেখতে হলে আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক মুসলমানের মনের অস্তিত্ব কড়িকোমলে প্রোথিত। আমাদের কোনো সম্ভাবনা নেই – এই রাজনৈতিক ইসলামের ‘মেইনস্ট্রিম’ আমাদের মধ্যে আছেই – সেই পথের সবকিছু আমাদের দেশে তৈরি হয়েই আছে। চারপাশের এই ‘মেইনস্ট্রিম’কে যখন দেখি, তখন সবচেয়ে করুণ যেছবি দেখি তা হল মানচিত্র ভূগোল বলে যে কিছু আছে – ইতিহাস তো বাদই দিলাম, কারণ কারো কারো মতে তাতো মৃত – তা মনেই হয় না। একেক জন আল্লাহ প্রেরিত বঙ্গসন্তান, আর এতোই বেশি তিনি এঅঞ্চলে পাঠিয়েছেন, যাদের আবার তার ইচ্ছায় কৈশোরযৌবনকালে নারীপুরুষনির্বিশেষে পাচারবাস ঘটে। কিন্তু এরাই সব ভুলে কথিত অকথিত কোরান ও সুন্নার আলোকে সর্বঘটে আল্লার শাসন কায়েম করতে চাইছে। এদের মধ্যে জেহাদি যারা তাদের এখন সরিয়ে নেয়া হয়েছে ‘মেইনস্ট্রিম’এর রাজনীতির নামে ও অর্থনৈতিক শক্তিতে এবং ইসলামিক ন্যায়ের ইউটোপিয়ায় এখন এরা ‘আশরাফুল মাকলুকাত’ বা ইসলামি ‘হোমো সেপিয়েন্স’ হয়ে উঠেছে।

কিন্তু বাংলাদেশে যদি একটি কাজ করা যায়, যদি যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা যায়, যদি সত্যিই তা সম্ভব হয়, তাহলে এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক মুসলমানের মনে একটা বড় ধরনের আঘাত আমরা হানতে পারব। সেআঘাত শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বরাজনীতিতেও তার প্রভাব ফেলবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের সাথে পৃথিবীর আর কোনো মুসলমান দেশকে কেউ মেলাতে পারবে না, সেই দেশ বেতাল হয়েও যদি রাজনৈতিক মুসলমানের মনে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের আঘাত হানতে পারে, তবে সেই প্রতিশোধ প্রতিরোধ হয়েই রাজনৈতিক মুসলমানের মনের ওপর ও রাজনৈতিক ইসলামের ‘মেইনস্ট্রিম’এর ওপর এক দীর্ঘস্থায়ী পদচিহ্নের ছাপ রেখে যাবে।

এবং জেহাদি ইসলামের মতো রাজনৈতিক ইসলামের পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকেও সবাইকে ফিরিয়ে আনতে না পারলেও, এটা একটা পথের শুরু হবে, যেপথ রাজনৈতিক মুসলমানের মনে একটা খটকা হয়ে থাকবে। রাজনৈতিক মুসলমানের মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হোক। চর্যাপদের বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের বাংলাদেশ হয়ে উঠুক। রাজনৈতিক মুসলমানের মন, রাজনৈতিক মুসলমান কাটা, রাজনৈতিক মন হয়ে উঠুক।

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

৭ comments

  1. নিজাম কুতুবী - ৫ জুলাই ২০১০ (৪:১৬ পূর্বাহ্ণ)

    ভাল লাগল। ধন্যবাদ

  2. নূপুর - ২৮ অক্টোবর ২০১০ (১:৫৬ পূর্বাহ্ণ)

    আপনার পর্যবেক্ষণ ভালো লাগলো মাসুদ ভাই।
    এবার অর্থনৈতিক মুসলমানের কথাও কিছু বলুন!

  3. মাসুদ করিম - ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১ (৬:৪৪ অপরাহ্ণ)

    সাম্প্রতিক আরব গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আরববিশ্ব ১৯৭৯ সালের ইরানের ‘ইসলামিক বিপ্লব’এর ধারনা থেকে বেরিয়ে এসেছে, ফরাসি মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ Olivier Roy এই গণজাগরণকে বলছেন ‘উত্তরইসলামি বিপ্লব’ আর এই জাগরণের নায়ক আরব তারুণ্যকে বলছেন ‘উত্তরইসলামি প্রজন্ম’।

    Look at those involved in the uprisings, and it is clear that we are dealing with a post-Islamist generation. For them, the great revolutionary movements of the 1970s and 1980s are ancient history, their parents’ affair. The members of this young generation aren’t interested in ideology: their slogans are pragmatic and concrete – “Erhal!” or “Go now!”. Unlike their predecessors in Algeria in the 1980s, they make no appeal to Islam; rather, they are rejecting corrupt dictatorships and calling for democracy. This is not to say that the demonstrators are secular; but they are operating in a secular political space, and they do not see in Islam an ideology capable of creating a better world.

    The same goes for other ideologies: they are nationalist (look at all the flag-waving) without advocating nationalism. Particularly striking is the abandonment of conspiracy theories. The United States and Israel – or France, in the case of Tunisia – are no longer identified as the cause of all the misery in the Arab world. The slogans of pan-Arabism have been largely absent, too, even if the copycat effect that brought Egyptians and Yemenis into the streets following the events in Tunis shows that the “Arab world” is a political reality.

    This generation is pluralist, undoubtedly because it is also individualist. Sociological studies show that it is better educated than previous generations, better informed, often with access to modern means of communication that allow individuals to connect with one another without the mediation of political parties – which in any case are banned. These young people know that Islamist regimes have become dictatorships; neither Iran nor Saudi Arabia holds any fascination for them. Indeed, those who have been demonstrating in Egypt are the same kinds of people as those who poured on to the streets to oppose Mahmoud Ahmadinejad in 2009. (For propaganda reasons, the regime in Tehran has declared its support for the opposition movement in Egypt, though this is little more than a settling of scores with Hosni Mubarak.) Many of them are religious believers, but they keep their faith separate from their political demands. In this sense, the movement is “secular”. Religious observance has been individualised.

    তাহলে ইসলামবাদীরা যারা ইসলামকে রাজনৈতিক আদর্শের রূপ দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে সমাজের সব সমস্যার সমাধানের কথা বলেছিল, ওরা কোথায় গেছে? লেথক বলছেন

    What of the Islamists, those who see in Islam a political ideology capable of solving all of society’s problems? They have not disappeared, but they have changed. The most radical of them have left to wage international jihad; they are in the desert with al-Qaeda in the Islamic Maghreb, in Pakistan or the suburbs of London. They have no social or political base. Indeed, global jihad is completely detached from social movements and national struggles. Al-Qaeda tries to present itself as the vanguard of the global Muslim “umma” in its battle against western oppression, but without success. Al-Qaeda recruits deracinated young jihadists who have cut themselves off entirely from their families and communities. It remains stuck in the logic of the “propaganda of the deed” and has never bothered to try to build political structures inside Muslim societies.

    Because al-Qaeda tends to concentrate its activities in the west or aims at so-called western targets elsewhere, its actual impact is next to nil.
    It is a mistake, therefore, to link the re-Islam­isation that has taken place in the Arab world over the past 30 years with political radicalism. If Arab societies are more visibly Islamic than they were 30 or 40 years ago, what explains the absence of Islamic slogans from the current demonstrations? The paradox of Islamisation is that it has largely depoliticised Islam. Social and cultural re-Islamisation – the wearing of the hijab and niqab, an increase in the number of mosques, the proliferation of preachers and Muslim television channels – has happened without the intervention of militant Islamists and has in fact opened up a “religious market”, over which no one enjoys a monopoly. In short, the Islamists have lost the stranglehold on religious expression in the public sphere that they enjoyed in the 1980s.

    এই গণজাগরণের মধ্য দিয়ে যেপরিবর্তনের আশা আমরা করছি তার পথ হবে দীর্ঘ ও গোলযোগপূর্ণ। কিন্তু এটা নিশ্চিত ‘আরব-মুসলিম’ জগতের ইতিহাসবাহিত রাজনৈতিক পরিবর্তন হবেই,ওই জগতকে এক বিশেষ জগত হিসেবে দেখার দিন শেষ, জনজাগরণের যেস্বাভাবিক ঐতিহাসিক বিবর্তন তার পথে পা বাড়িয়েছে আরব-মুসলিম উত্তরইসলামি প্রজন্ম।

    The process of change will undoubtedly be long and chaotic, but one thing is certain: the age of Arab-Muslim exceptionalism is over. Recent events point to profound transformations in Arab societies which have been under way for some time, but which until now have been obscured by the distorting optic of western attitudes towards the Middle East. What the convulsions in Egypt and Tunisia show is that people in those countries have drawn the lessons of their own history. We have not finished with Islam, that is for sure, nor is liberal democracy the “end of history”, but we must at least learn to think of Islam in relation to an “Arabic-Muslim” culture that today is no longer closed in on itself – if it ever was.

    ফরাসি এই লেখাটির ইংরেজি লিন্ক এখানে

    তার মানে দাঁড়াচ্ছে আরব-মুসলিম সমাজেও রাজনৈতিক মুসলমানের মন থেকে মুসলমান আস্তে আস্তে দূরে সরছে এবং রাজনৈতিক মনের দিকে ওই সমাজেরও যাত্রা শুরু হয়েছে।

    • মাসুদ করিম - ৮ মার্চ ২০১১ (১:০৯ অপরাহ্ণ)

      সালমান রুশদি একে বলছেন An old fashion revolution যা চরিত্রে not a religious revolution, it is a secular revolution.

      One thing I would like to say about the question of religious fundamentalism is that I think we live in an extraordinary moment and I think it might just be worth saying a little bit about what’s going on in the Arab world right now. Because, I think, at its most optimistic (I know what is happening in Libya is terrible and there may be a lot more bloodshed before it is done) but it feels to me that this could be the moment at which the Islamic world moves beyond Islamism, moves beyond the politics of religion.

      if you look at what is happening in every single one of these countries, this is not a religious war: nobody is talking about Islam. In Tunisia or Egypt or Yemen or Jordon or Libya or Bahrain or wherever else it is happening… nobody has said that it is an Islamic revolution. It’s actually rather an old fashioned revolution. It’s about wanting a better economic life for their wife and their children and wanting more personal liberty. It is about democracy, freedom and jobs. And so it seems to me that this could be the moment at which these states which have been crippled by tyrants and religious fanatics begin to be able to reinvent themselves as modern states.

      And, you know, the West talks a great deal about freedom. Here are people trying to get their freedom. You know, they are not being given it by American tanks, they are really getting it for themselves. And I really hope we can support it, instead of worrying about the Muslim Brotherhood or this or that fanatic or bogeyman who is going to rise up to do terrible things. What we see is across the world people asking for freedom, fighting for it and are prepared to give up their lives for it.

      The religious fundamentalism thing is interesting because, you know, the Al Qaeda was born in the torture chambers of Mubarak. Ayman al-Zawahiri is Egyptian. He has spent the last 30 years demanding the fall of Mubarak, demanding an Islamic uprising to overthrow the Egyptian despot. Have we heard from Ayman al-Zawahiri? Haven’t heard a peep out of him. This is the revolution he has been asking for 30 years and it happens and he’s got nothing to say because it is not his revolution. This not a religious revolution, it is a secular revolution. And so he is a disappointed man. The tyrant he wanted to overthrow is overthrown, and he’s not happy.

      বিস্তারিত পড়ুন ও রুশদির ভাষ্যের ভিডিও দেখুন আউটলুক ব্লগে এখানে

  4. মাসুদ করিম - ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ (৩:৫৮ অপরাহ্ণ)

    কামাল লোহানী বলেছেন ঐক্যবদ্ধভাবে জামাতকে মোকাবেলার কথা।

    ঐক্যবদ্ধ হয়েই জামায়াতকে মোকাবেলা

    আমার কথা হল, জামায়াত তো এ দেশের দল নয়। আমরা ভুলে যাইনি একাত্তরের কথা। সে সময় ওরা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি গঠিত হোক এটা ওরা চায়নি। তাই এদেশের সাধারণ মানুষের ওপর নৃশংস আচরণ করতে পাকিস্তানি বাহিনিকে সর্বাত্মক সহায়তা করেছিল ওরা। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে কোটি মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করেছিল। কী অধিকার আছে জামায়াতের যে তারা এ দেশের মানুষের জীবন আবারও বিপর্যস্ত করে নিজেদের দাবির পক্ষে কথা বলবে? ওদের তো এ দেশে বাস করার অধিকারই নেই। একাত্তরের অপরাধের জন্য আরও আগেই শাস্তি প্রাপ্য ছিল ওদের।

    আমার মতে, বাহাত্তরেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা সম্পন্ন করা উচিত ছিল। তাহলে আজ তাদের যে ঔদ্ধত্য আমাদের সহ্য করতে হচ্ছে তা করতে হত না। এখন দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, প্রতিরোধ করতে হবে জামায়াতে ইসলামীকে।

    যে সব রাজনৈতিক দল জামায়াতের রাজনীতি পছন্দ করেন না বা সমর্থন করেন না, রাজনীতির সে শক্তিগুলো একতাবদ্ধ হয়ে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি প্রতিহত করতে পারে। অনেক রাজনৈতিক দল কৌশলে জামায়াত-বিরোধিতা করেন, সামনাসামনি জামায়াতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস করেন না, তাদের কথা বলছি না। যারা জামায়াতের সামনাসামনি বিরোধিতা করার সাহস রাখেন, তাদের একতাবদ্ধ হতে হবে। যারা রাজনৈতিকভাবে, আদর্শিকভাবে জামায়াতসহ সব ধরনের ধর্মান্ধতা ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরোধিতা করেন, তারা এখন এক হবেন- এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

    সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, জামায়াতের রাজনীতিকে আমি রাজনীতি মনে করি না। এটা হল সন্ত্রাসনীতি, জঙ্গীনীতি, মানুষ-হত্যার নীতি। এটা কোনো সুস্থধারার রাজনীতি নয়। এটা দেশের জনগণের দুর্ভোগ বাড়ানোর রাজনীতি। তাই সম্প্রতি দেশজুড়ে জামায়াতের চালানো তাণ্ডবে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।

    এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলব। পুলিশ নানা সমযে জামায়াতিদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। পুলিশের এ ব্যর্থতার কারণ আমি জানি না। অথচ অন্যা্ন্য রাজনৈতিক দল বা কোনো কোনো গ্রুপের আন্দোলনের সময় দেখেছি, পুলিশ বেশ শক্ত হাতে দমন করেছে তাদের, পিটিয়েছে। আর জামায়াতের বেলায় ঘটছে উল্টো ঘটনা। পুলিশ এখানে ব্যর্থতার সঙ্গে মার খাচ্ছে। এটা খুব আশ্চর্যজনক একটি বিষয় আমার কাছে। স্বস্তির বা শান্তির বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হলে জামায়াতকে শক্ত হাতেই প্রতিহত করতে হবে। কারণ এগুলো হচ্ছে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি।

    সম্প্রতি সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী একটি জাতীয় সম্মেলন করেছি আমরা। এটা একটা বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ। এখন দরকার সম্মিলিত উদ্যোগ। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটি মঞ্চ তৈরি করে সারা দেশব্যাপী একটি অভিযাত্রা তৈরি করতে হবে। আমরা যারা ওই জাতীয় সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তাদের সঙ্গে সমাজের আরও অন্যান্য অংশ যদি যুক্ত হয়, তাহলে এর জোর অনেক বেশি হবে।

    আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির তৎপরতা কিন্তু নতুন নয়। সবসময়ই এ শক্তি গণতন্ত্র, প্রগতিশীলতা ও মানবতার পক্ষের শক্তিকে পরাজিত করতে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থেকেছে। সময় পেলেই আঘাত করেছে সুস্থ ও আধুনিক চিন্তার মানুষকে। তাদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। তাই আসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য, সমাজতান্ত্রিক আদর্শে যদি আমরা সত্যিকারভাবেই আস্থা রাখি- তাহলে ওদের প্রতিহত করার বিকল্প নেই।

    আমি মনে করি সব ধরনের ধর্মীয় বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত। তবে একসময় আমি মনে করতাম যে জামায়াত বা এ রকম কিছু দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা উচিত। কিন্তু এখন আমার মনে হয়, এদের নিষিদ্ধ করা হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। কারণ তখন এরা আত্মগোপন করে ভেতরে ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করে সবল হয়ে উঠবে। তাই আমার মনে হয়, ওদের আপাতত নিষিদ্ধ করে নয়, রাজনীতি করতে দিয়েই প্রতিহত করতে হবে। ওদের যে সব গোপন আড্ডাখানা রয়েছে, সে সব জায়গায় প্রয়োজনে হানা দিয়ে ওদের গ্রেফতার করে দমন করতে হবে।

    তবে শুধু সরকার কেন, সমাজের সব শক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে। আজ সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী একটি মঞ্চ তৈরি হয়েছে, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কাজ করছে- সব ফোরাম থেকে একযোগে ওদের প্রতিহত করার জন্য কাজ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, ২০০৮ সালের নির্বাচনে তরুণ ভোটাররা জামায়াতের বিরুদ্ধে তাদের ম্যান্ডেট দিয়েছিলেন। সেই ভোটাররা কিন্তু এ চার বছরে আরও ম্যাচ্যুরিটি অর্জন করেছেন। তাদের চিন্তাভাবনা আরও প্রখর হয়েছে। আরেকবার তাদের সঙ্গে নিয়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে দমন করতে হবে।

    আমি মনে করি না যে, এদেশের জনগণের কাছে এ শক্তির বিরুদ্ধে আহ্বান জানালে জনগণ তা গ্রহণ করবেন না। আজকে যে মঞ্চটি আমরা তৈরি করেছি তাকে আরও বড় করে কাজ শুরু করতে হবে। আসলে এখন আমাদের সমস্যা হচ্ছে ওভাবে আহ্বান জানানোর মতো লোক নেই, তাই জামায়াতের বিরুদ্ধে শক্ত প্লাটফর্ম তৈরি হচ্ছে না।

    মনে রাখতে হবে যে, এখন জামায়াত রাজনীতি করছে নতুন রূপে, ক্যামোফ্লেজ তৈরি করে। এখন ওরা আর টুপি-দাঁড়ি পরে এ রাজনীতি করে না, আর সবার মতো্ই জিন্সের প্যান্ট আর গেঞ্জি পরে তারা। এভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে তারা জনগণের মধ্যে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে। তাই জনগণের মধ্যে যদি এ ব্যাপারে সচেতনতা থাকে, তার পাশের লোকটি কে বা কী তা জানবার চেষ্টা যদি থাকে, তাহলে তাদের চিহ্নিত করা যাবে। আজকে যদি পাড়ায়-মহল্লায় এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়, তাহলে মনে হয় না যে ওরা কোথাও গোপন আড্ডাখানা তৈরি করে কাজকর্ম চালাতে পারবে।

    আমাদের তরুণ প্রজন্মের খুব বড় কোনো অংশ যে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এটা আমি মনে করি না। হ্যাঁ, ওরা কিছুটা এগুতে পারছে জনগণের মধ্যেকার ধর্মীয় চেতনা ব্যবহার করে। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে যে ধর্মভীরুতা আছে, যে সরলতা আছে, সেটা ওদের জন্য একটি উর্বর ক্ষেত্র। আমরা তো সবসময় বলে এসেছি- ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কিন্তু ধর্মহীনতা নয়। ধর্মীয় বিশ্বাস প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব সম্পদ। কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো ধর্মীয় পরিচয় থাকতে পারে না। এটাই ধর্মনিরপেক্ষতার মূল কথা। কিন্তু ওরা অনেককে বিভ্রান্ত করছে এটা বলেই যে, জামাযাতে ইসলামীর রাজনীতিতে যুক্ত হলে ঐশীশক্তির প্রিয় হয়ে ওঠা যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

    তাছাড়া তরুণদের সামান্য একটি অংশকে ওরা দলে টানতে পারছে কিছু বৈষয়িক সুবিধা দিযেও। ওদের লেখাপড়ার খরচ দেওয়া, ভালো চাকরির প্রলোভন দেওয়া, এমনকি বাসস্থান ইত্যাদির ব্যবস্থা করেও ওরা কিছু কিছু তরুণকে আকৃষ্ট করছে। ধর্মান্ধ রাজনীতি যারা করে তাদের তো পয়সার অভাব নেই। এন্তার টাকাপয়সা দিয়ে ওরা লোকজনকে পুষতেও পারে। এভাবে টাকাপয়সা আর ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে ওরা কাজ করছে।

    আমার ব্যক্তিগত মত হল যে, আমাদের জনগণের মধ্যে জামায়াতের খুব শক্ত শেকড় আছে এটা একেবারে ভুল একটি ধারণা। ২০০৮ সালের নির্বাচনের ফলাফল এর একটি বড় প্রমাণ। জামায়াতে ইসলামীকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। তা না হলে মতিউর রহমান নিযামীর মতো লোক নির্বাচনে প্রত্যাখ্যাত হয় কীভাবে? দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মতো লোকের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মামলায় মানুষ সাক্ষ্য দেয় কীভাবে?

    রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে ওরা এগুতে চাচ্ছে। প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী- সব ধরনের রাজনৈতিক দলই সত্যিকার অর্থে জনগণের কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসছে না। আজকে বিরোধী দল সংসদে যায় না। আবার ওরা সংসদে গেলে সরকারি দল কথা বলতে দেয় না। অথচ আমাদের দেশেই একসময় পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চেয়ার-ছোঁড়াছুড়িতে একজন ডেপুটি স্পিকার খুন পর্যন্ত হযেছেন। আমি বলছি না সংসদে তেমন নৃশংস কিছু হতে হবে। সংসদে দু’দল আলোচনা করবে, বিতর্ক করবে, সংসদ প্রাণবন্ত থাকবে এটাই তো গণতন্ত্রের নিয়ম। আমাকে সংসদে কথা বলতে দেওয়া হবে না বলে যে আমি ওখানে যাব না এটা তো হয় না। বিরোধী দল মনে রাখতে চায় না যে ওরাও সরকারের অংশ। সংসদে না গেলে এটা জনগণের ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে জনগণকে প্রতারিত করার শামিল। অথচ জনগণের টাকায় সব সুযোগ-সুবিধা ঠিকই নেয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর এসব পারস্পরিক হানাহানির সুযোগ নিয়েও জামায়াত বেশিদূর এগুতে পারেনি। তবে আমাদের সতর্ক হতে হবে।

    আজকে জামায়াত শিবিরকে দমনের জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনকেও বড় একটি ভূমিকা পালন করা উচিত। এ আন্দোলনটা কেমন যেন নিস্পৃহ ও দায়সারা গোছের হয়ে গেছে। একে এখন জোরেশোরে চালাতে হবে। একবারে গ্রামেগঞ্জে গিয়ে জনগণকে সব রকম অপশক্তির বিরুদ্ধে সজাগ করতে হবে। আমাদের নিজস্ব সংগ্রামের গানগুলো, গণসঙ্গীতগুলো দিয়ে জনগণের চেতনা নাড়া দেওয়া যায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন করে পুরনো গানগুলো বাঁধতে হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের নানা চক্রান্ত রয়েছে। পাশাপাশি দেশীয় চক্রান্তকারীরা এখনও সক্রিয় রয়েছে। এগুলোর ওপর গান তৈরি করা দরকার।

    মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক সংগ্রামের আগে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। সাংস্কৃতিক সংগ্রামই রাজনৈতিক সংগ্রামের ভিত্তি তৈরি করে, একে এগিয়ে দেয়। তাই এ সংগ্রাম শক্তিশালী হলে সব ধরনের ধর্মভিত্তিক শক্তি চিরতরে নির্মূল হবে।

  5. মাসুদ করিম - ২০ অক্টোবর ২০১৪ (৫:৫০ অপরাহ্ণ)

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.