আমি একজন মেটাফিজিশিয়ান। মূর্তের ওপর কাজ করি। পাপময় ক্যাথলিক বিশ্বকে দৃশ্যগোচর, স্পর্শগ্রাহ্য আর গন্ধবহ রূপ দিতে চাই। ধর্মশাস্ত্রবেত্তারা পাপী সম্বন্ধে আমাদের বিমূর্ত ধারণা দেন মাত্র। আমার কাজ তার সঙ্গে রক্তমাংস লাগানো।
উপরোক্ত কথাগুলো পারী রিভিউ পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বয়ান করেন। এই হচ্ছেন মোরিয়াক। গড়পড়তা ফরাসি ঔপন্যাসিকদের থেকে একেবারেই আলাদা। নিজেকে একজন ক্যাথলিক হিসাবে সবসময় দাবি করেন। সবাই তা জানে। কিন্তু তাঁর উপন্যাস যে-কোনো আধুনিকের চাইতেও আধুনিক। একটা সময় তিনি লেখা শুরু করবার আগে নাকি ঘণ্টাখানেক বাইবেল পড়তেন, তিনি ভাবতেন এতে গদ্য ভাল হবে। কিন্তু পরে তিনি মত বদলান যে বাইবেলের গদ্য সবধরনের লেখার জন্য উপযুক্ত নয়। তাঁর যে বইটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই সেটার নাম “ডেজার্ট অব লাভ” (Le Désert de l’amour)। ফরাসি থেকে এটি ইংরেজী অনুবাদ করেন জন মরিস । প্রকাশক ম্যাকমিলান।
পিতাপুত্র একই নারীর প্রেমে পড়েছে। এরকম সফল উপন্যাস খুব বেশি নাই বিশ্ব সাহিত্যে। ফরাসি উপন্যাসিক ফ্রাঁসোয়া মোরিয়াকের এই উপন্যাসটি এই ধরনের একটি সফল উপন্যাস বলা যায়। এ উপন্যাসে নায়িকা মারিয়া ক্রস মসিয়ে ভিক্তর লারুসেলের রক্ষিতা। তার ছেলের অসুখ হলে ডাক পড়ে শহরের জাদরেল ডাক্তার মঁসিয়ে কোরেজের। ছেলেটাকে অবশ্য শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারেনা ডাক্তার। ফলে মাঝে মাঝে মারিয়াকে দেখতে আসতেন ডাক্তার। মারিয়া ছিল অদ্ভুত রূপসী আর সাক্ষাত প্রেম দেবী যেন। ধীরে ধীরে কোরেজ প্রেমে পড়ে মারিয়ার। মারিয়ার দিক দিয়ে অবশ্য ব্যাপারটা অন্য রকম। ডাক্তার আসলে সমাজে তার সম্মান বাড়ে এই তার পাওয়া। এমনিতে সে মনে মনে বিরক্ত হয়। কেননা ততদিনে স্পস্ট হয়ে যায় কেন ডাক্তার ঘনঘন তার কাছে আসে। ইতিমধ্যে মারিয়ার সাথে পরিচয় হয় ডাক্তারের ছেলে রেমন্ডের ঘটনা মোড় নেয় অন্য দিকে। রেমন্ড স্কুলের ছাত্র। টগবগে রক্ত। একদিন মারিয়াকে বিছানায় টানলে তাকে বাড়ী থেকে বের করে দেয় মারিয়া। রেমন্ডের জীবনে এটা ছিল প্রথম ব্যর্থতা কোনো নারীর কাছে। রেমন্ড বুঝতে পারে তার পিতা কেন এত অসুখি। রেমন্ড বোর্দো ছেড়ে পাড়ি জমায় পারিতে। এদিকে লারুসেল মারিয়া ক্রসকে বিয়ে করে পারিতে নিয়ে যায়। লারুসেল অসুস্থ হয়ে পড়লে মারিয়া চিঠি লিখে ডাক্তারকে নিয়ে যায় পারিতে। এক অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তি আছে এ উপন্যাসে। শেষে ডাক্তার এবং রেমন্ড দুজনই বুঝতে পারে না পাওয়াটাই প্রেম। মোটামুটি এই হচ্ছে বইটার কাহিনী।
মহান উপন্যাসিক নিজে ছাড়া অন্য কারো ওপর নির্ভর করেন না। প্রুস্তের সংগে তার কোনো পূবর্সুরীর মিল নাই হয়তো উত্তরাধিকারীরও নাই। মহান উপন্যাসিক নিজস্ব ছাঁচ ভেংগে নেন, তিনিই তার একক ব্যবহারকারী। বালজাক বালজাকীয় উপন্যাসের স্রষ্টা, তার রচনাশৈলী কেবল বালজাকেরই উপযুক্ত। ধার করা রচনা শৈলী বাজে। নিজেদের বক্তব্য পেশ করার জন্য ফকনার থেকে হেমিংওয়ে পযর্ন্ত সব মার্কিন লেখক নিজস্ব শৈলীর ওপর নির্ভর করেছেন।
উপরোক্ত কথাগুলো তিনি বলেন এক সাক্ষাতকারে। কথাগুলো মোরিয়াকের নিজের সম্পর্কেও সত্য। মোরিয়াক ১৮৮৫ সালে বর্দোর এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মান। ১৯৫২ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৪ comments
রায়হান রশিদ - ৭ অক্টোবর ২০০৯ (৩:৪৫ পূর্বাহ্ণ)
ইংরেজীতে spoiler বলে একটা কথা আছে। কোন উপন্যাস বা সিনেমার কাহিনী পাঠক-দর্শকদের আভাসে ইঙ্গিতে আগে থেকে জানিয়ে দেয়াই যার মূল উদ্দেশ্য। এতে যিনি জানান তার কি প্রতিপত্তি বা হর্ষলাভ হয় জানি না, তবে যাকে জানান তার অপূরণীয় ক্ষতি হয়। কারণ, তিনি চিরতরে বঞ্চিত হন সেই সৃষ্টিটির পূর্ণ আনন্দ আস্বাদনের সুযোগ থেকে।
এ কারণে, এই পোস্টটির উদ্দেশ্য আমার কাছে একেবারেই স্পষ্ট হলো না। জাহেদ সরওয়ার নিজে হয়তো আরও ভাল বলতে পারবেন। তবে এ ধরণের পোস্টের সাথে ‘Spoiler Alert’ জাতীয় কোন অগ্রীম সতর্কতামূলক ট্যাগ যুক্ত করা যায় কিনা, মডারেটরদের ভেবে দেখা উচিত।
মোহাম্মদ মুনিম - ৭ অক্টোবর ২০০৯ (৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ)
জাহেদ সরওয়ার অনেকদিন থেকেই বিভিন্ন লেখক এবং তাঁদের সাহিত্যকর্মের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। এ কারণে তাঁর ধন্যবাদ প্রাপ্য। ইন্টারনেটে খুঁজলে সমস্ত ক্ল্যাসিক সাহিত্যকর্ম এবং লেখকদের জীবনী পাওয়া যাবে। কিন্তু এতো লম্বা লিস্ট খুঁজে বই পড়ার সময় তো আমাদের নেই। জাহেদ যে কষ্ট করে পোস্টগুলো লিখে আমাদের একেকজনের কাজের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, তাতে আমাদেরও আগ্রহ বাড়ছে। আমিতো আনাতোল ফ্রাঁসের লেখাটা প্রায় পুরোটা পড়েই ফেললাম। ক্ল্যাসিক সাহিত্য তো আর রোমাঞ্চ উপন্যাস নয়, শেষে কি হলো তাতে কি আসলো গেলো, পড়াতেই তো আনন্দ। বাংলা ভাষাতে তো পৃথিবীর অনেক সাহিত্যকর্মের ভালো অনুবাদ আছে। জাহেদ সরওয়ারের পোস্টগুলো পড়ে যদি ছোট একটা পাঠক শ্রেণী তৈরী হয়, সেটা তো অনেক বড় পাওয়া।
রায়হান রশিদ - ৭ অক্টোবর ২০০৯ (৭:২২ পূর্বাহ্ণ)
@ মোহাম্মদ মুনিম,
একমত হতে পারলাম না। কারও লেখার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া আর spoiler কিন্তু একই জিনিস না। আর কোন উপন্যাসের বা কোন লেখকের কাজের ব্যাপারে জানতে আমরা সবাই নিঃসন্দেহে আগ্রহী। কিন্তু সেখানে পাত্র-পাত্রীর আবেগগুলো আর উপলদ্ধিগুলোও আগে থেকে জেনে যাওয়া কি আসলেই খুব জরুরী?
একটা উপন্যাস তো কেবল গল্পই শুধু নয়। এটা এক ধরণের journey । সেখানে অন্য একজনের চোখ দিয়ে একটা পুরো যাপিত জীবনকে জানার সুযোগ হয়। আর সেই যাত্রাপথের বিভিন্ন বাঁক আর খানাখন্দগুলো আমার কাছে কিন্তু কোন অংশেই কম রোমাঞ্চকর মনে হয় না।
নতুন নতুন সাহিত্যকর্মের সাথে পরিচিত হতে চাই; কিন্তু এই রোমাঞ্চটুকু থেকে বঞ্চিত হতে চাই না কোন কিছুর বিনিময়েই। তাছাড়া, কোন সাহিত্যকর্মের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ারও নিশ্চয়ই স্বীকৃত-গ্রহণযোগ্য কিছু রীতি রয়েছে। সাধারণ জ্ঞান দিয়ে যতটুকু বুঝি তা হল – সেখানে এক ধরণের subtlety থাকাটা খুব জরুরী। পেঙ্গুইন থেকে শুরু করে বিশ্বখ্যাত প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজ গরজেই নানা সাহিত্যকর্মের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার কাজটুকু করে থাকে। লিটারেরি সাপলিমেন্টের পাতায় সমালোচকরাও সাহিত্যকর্ম তুলে ধরেন। কিন্তু সে সব তারা মনে হয় কিছু নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই করেন। আর এই অলিখিত নিয়মগুলো তো এক দিনে তৈরী হয়নি; নিশ্চয়ই কোনো যুক্তি রয়েছে সেগুলোর পেছনে।
একভাবে দেখলে সেটা একটা প্রয়োজনীয় কাজ। আপনার যেমন আগ্রহ বেড়েছে। জাহেদ সরওয়ারের পোস্ট পড়ে আমার কিন্তু আগ্রহ আরও কমে গিয়েছে মূল উপন্যাসটির ব্যাপারে। সে জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।
পোস্টের উপস্থাপনে লারুসেল-কোরেজ-মারিয়া-রেমন্ডের চতুর্ভূজ সম্পর্কের যে গল্প এর চেয়ে বেশী কিছু কিন্তু ‘পাঠক’ এই পোস্ট থেকে পাচ্ছেন না। বরং, হঠাত পড়লে এটাই মোরিয়াকের উপন্যাসের ‘সবটুকু’ বলে ভ্রম হতে পারে, কারণ, এতে আগ্রহ উদ্রেককারী ‘এর চেয়ে বেশী কিছু’র আশ্বাস বা ইঙ্গিত অনুপস্থিত (অনুমান করছি – মোরিয়াকের উপন্যাসে ‘এর চেয়েও বেশী কিছু’ নিশ্চয়ই ছিল)। সবিনয়ে বলি, অনেক পাঠক হয়তো এই ‘এর চেয়ে বেশী কিছু’-টাই খোঁজেন সাহিত্যালোচনায়, এবং পেলে আগ্রহী হন নিজের মূল্যবান সময় ব্যয় করে নতুন কোন লেখা পড়তে।
মোহাম্মদ মুনিম - ৭ অক্টোবর ২০০৯ (১১:২১ পূর্বাহ্ণ)
এই পোস্টটির দুর্বলতার সাথে অবশ্য আমি আপনার সাথে একমত। দ্যুরাজ এবং আনাতোল ফ্রাঁস বিষয়ক লেখাগুলোতেও উপন্যাসগুলোর কাহিনী বুঝতে বেশ সমস্যা হয়েছে। অবশ্য যেহেতু ইন্টারনেটে Wikipedia আর অন্যান্য সোর্স আছে, পোস্টগুলোর সূত্র ধরে বাড়তি তথ্য সহজেই জানা যায়। আমাজনে যেমন দ্যুরাজের উপন্যাসটির আরও কিছু রিভিউ আছে। উপন্যাসটি নিয়ে ছবিও হয়েছে, সেটারও ভালো রিভিও আছে। ফ্রাঁসের পুরো উপন্যাসটিই পাওয়া গেলো। জাহেদ সারওয়ার শুরুটাতো করলেন, নিজের ভালো লাগাটা তো শেয়ার করলেন, সেটাই অনেক কিছু। আমাদের কমেন্টগুলো জাহেদ সরওয়ার নিশ্চয় দেখছেন বা দেখবেন, তিনি কিছু বলবেন আশা করি। তাঁর কাছে একটা বিনীত অনুরোধ আছে বানান এবং উপন্যাসের চরিত্র গুলোর নামের ব্যাপারে। ফ্রাঁস বিষয়ক লেখাটিতে উপন্যাসটির নাম লেখা হয়েছিল ‘বনারদের অপরাধ’। আমি প্রথমে ভাবলাম উপন্যাসটি সম্ভবতঃ ‘বনার’ নামক কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের কালেক্টিভ অপরাধ নিয়ে। পোস্টটি পড়ার পরে আমি বুঝলাম ‘বনারদের’ শব্দটি মূলত ‘বোনার্ডের’। পোস্টগুলোতে সাহিত্য কর্মগুলোর মুল নাম (ইংরেজী, ফরাসী বা রূশ) রোমান হরফে দেয়া থাকলে পাঠকদের আরও সুবিধা হবারই কথা। আরও লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।