প্রাত্যহিক / রেজাউল করিম সুমন

চারটে প্যারায় মুল কবিতাটি। প্রথম স্তবকে চারলাইন। দ্বিতীয় স্তবকে ছয় লাইন। তৃতীয় স্তবকে পাঁচ লাইন। এবং চতুর্থ স্তবকে তথা শেষ স্তবকে মাত্র দুটি লাইন। প্রথম যখন কবিতাটি পড়ে আনন্দ পাই তখন আমি ভাবতে চেয়েছি কবিতাটি কি কি কারণে আমাকে আনন্দ দিয়েছে। আর আমি বার বার পড়েছি এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে [...]

এইতো শোবার ঘর। অনুগ্র আলোর নীচে ঘুম,
পেছনে র্নদমা আর তার পাশে
ভেজা কালো মাটি-
বাদাম গাছের ছায়া , নতুন কবর।

প্রতি ভোরে আমিও নিজের কবর থেকে উঠে
মশারি গুছিয়ে রাখি, দাঁত মাজি,
ব্রেকফাষ্ট সারি …
পত্রিকার শিরোনামে দু’চোখ বুলিয়ে নেমে যাই
ছাগবিষ্ঠাময় সিঁড়ি বেয়ে সন্তর্পনে পাতালের দিকে!

বিকেলে অফিস ছুটি । যানজট। পায়ে হেঁটে
বন্ধুর বাসায় ।
ফিরে আসি রাত দশটায়
খাবার টেবিলে মাছি, আরশোলা,
ঠান্ডা পাউরুটি।

অনুগ্র আলোর নীচে আমার শোবার ঘর,
আবার সকালে বেঁচে উঠা।

…………………

প্রথম যখন কবিতাটি পড়ে আনন্দ পাই তখন আমি ভাবতে চেয়েছি কবিতাটি কি কি কারণে আমাকে আনন্দ দিয়েছে। আর আমি বার বার পড়েছি এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে । মনে হয়েছে তিনটে কারণে কবিতাটি আমাকে আনন্দিত করেছে। ১. বাহুল্যহীনতা, ২. প্রচলিত শব্দ ব্যবহার ৩. র্দশনকেন্দ্রিক স্থিরতা ও সামঞ্জস্যপূর্ণ গ্রন্থনা।

চারটে প্যারায় মুল কবিতাটি বিভক্ত। প্রথম স্তবকে চারলাইন। দ্বিতীয় স্তবকে ছয় লাইন। তৃতীয় স্তবকে পাঁচ লাইন। এবং চতুর্থ স্তবকে তথা শেষ স্তবকে মাত্র দুটি লাইন। আমার সবসময় মনে হয়েছে একজন কবি যখন একটা কবিতা লেখার জন্য তৈরী হয়েছেন তখন সে অনুপ্রেরণা কিংবা যে ঘটনার দ্বারা সে নিজের বোধের শব্দের জন্য কিংবা বাক্য তৈরীর জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন তখন সে সংকেতটা তার সমগ্র স্মৃতির ওপর প্রতিফলিত হয়। এবং হতে পারে পাঠকেরও । ফলে কোন লাইনে তার জীবনের কোন দৃশ্যটা তৈরী হচ্ছে সেটা সম্ভবত জানা কবির পক্ষেও দুঃসাধ্য। আমার মনে হয়না কবি দীর্ঘক্ষণ এই জটিল যন্ত্রনার মধ্যে থাকতে পারেন। হতে পারে এটা কোন উপন্যাসিকের ক্ষেত্রেও।

ফকনার একবার বলেছিলেন ‘লেখা হয়ে যাবার পর বইটা পাঠকের । পাঠক বইটার ভেতর নিজেকে পেলে সে সেটা গ্রহণ করে। আর এজন্য লেখকের সময়-জ্ঞানটা এত জরুরী; লেখককে আমি সবসময় পাঠকের চেয়ে সময় সম্পর্কে প্রাগ্রসর বলে মনে করি। এ জন্য তাকে তিনচোখা বলা যায়। যে কোনো বিপর্যয় যে কোনো সৌন্দর্য্য-চেতনা যে কোনো আঘাত সাধারণের বহু আগেই সে অনুভব করতে পারে । তা নাহলে লেখার জন্য যন্ত্রনাটা সে কোত্থেকে পাবে।

পুরো কবিতাটা পড়ার পর আমরা প্রাত্যহিকতা সম্পর্কে নতুন এক অনুভব পাই। একজন নগর ক্লান্ত মানুষকেই দেখি যার জীবন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। জীবিত ও মৃত । তাই অনেক দিনের পুরনো, গতানুগতিক শোবার ঘরকে তার নতুন ভাবে আবিস্কার। ‘এইতো শোবার ঘর ‘ যেন নিজের ভেতরের আরেকজনকে আমরা পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি । এ কবিতা শুরু করতেই অন্য একটা কবিতার কথা মনে পড়ে যায় । সেটা হচ্ছে জসিমউদ্দিনের ‘কবর’‘এইখানে তোর দাদির কবর ‘ সেখানে দাদা নাতিকেই দেখাচ্ছিল । কিন্তু এখন সময় বদলে গেছে, মানুষ চিহ্নিত করেছে সলিচ্যুডকে। যেন সে নিজের লাজুক নিঃসঙ্গতাকে প্রবোধ দিচ্ছে এই তো শোবার ঘর। অনুগ্র আলোর নীচে ঘুম। এর পরের লাইন গুলোতে ‘নর্দমা’ ‘ভেজা কালোমাটি’, ‘বাদাম গাছ’ আর নতুন কবরের প্রতীক বাসস্থান-নাম্নী গোরস্তানকে বাঙ্ময় করে তোলে। প্রথম চার লাইন যেন শেষ চার লাইন। দ্বিতীয় স্তবক থেকে শুরু হচ্ছে যেন কাহিনী , ‘প্রতিভোরে আমিও নিজের কবর থেকে উঠি / মশারি গুছিয়ে রাখি, দাঁত মাজি/ ব্রেকফাষ্ট সারি … । এতক্ষণ পর হয়ত কবির ছলাকলার কিছুটা ইঙ্গিত আমরা পেতে শুরু করি । এতক্ষণ পর বুঝি সত্যি কেন তিনি আমাদের কাছে ‘নতুন কবর’-কে স্থাপন করেছিলেন। কারণ তিনি কিছুক্ষণ পরই নিজের কবর থেকে উঠতে যাচ্ছেন। বর্তমান দৃশ্যটি আমাদের আগের দৃশ্যটিকে উম্ভাসিত করে তোলে আর আগের দৃশ্যটি আমাদেরকে দাঁড় করায় সেই দার্শনিক প্রশ্নের মুখোমুখি। তিনি কেন নিজের বিছানাকে কবর বলছেন? তাহলে কি মানুষের জীবনকেও তিনি দুই ভাগে ভাগ করেছেন? জীবিত আর মৃত হিসাবে । তাহলে ঘুম কি স্বল্পকালীন মৃত্যু ? একই প্যারার পরের তিন লাইন আমাদেরকে দাঁড় করায় আরো রূঢ় অন্তর্গত সত্যের কাছে। তিনি বলছেন – না! বেচে থাকাটা মৃত্যুর চেয়ে দুঃসহ। পত্রিকার শিরোনামে দু’চোখ বুলিয়ে নেমে যাই/ ছাগবিষ্ঠাময় সিঁড়ি বেয়ে/ সন্তর্পনে পাতালের দিকে!

চলচ্চিত্রের প্রথমার্ধের জার্মান পরিচালক ফ্রিৎস লাংয়ের মেট্রোপলিস নামে একটা ছবি দেখেছিলাম । এ ছবির পটভূমি এমন এক নগরী যার দুটো অংশ। মাটির উপরে নগরের যে অংশ তাতে বাস করে বিত্তশালী ধনিক গোষ্ঠি, উচ্চ পদস্থ আমলাকুল আর বিলাস ব্যাসনে মত্ত ধনী যুব সমাজ। পাতালের যে অংশ, সেখানে দিনের আলো প্রবেশ করেনা, ইলেকট্রিকের আলো জ্বেলে কাজ করতে হয়। সেই অংশে বাস করে শ্রমিকরা। দীর্ঘ দিনের শোষণে তারা দাসে পরিণত হয়েছে।

তৃতীয় স্তবকের প্রথম লাইনের বিকেলে অফিস ছুটি থেকে এ তথ্য আমরা পাই যে এটা মেট্রোপলিস-এরই সেই কাহিনী। আধুনিক অফিস হচ্ছে সেই পাতাল। এখানে পত্রিকার শিরোনামে দুচোখ বুলিয়ে নেমে যাই’ লাইনটা দুই ধরণের তথ্য প্রদান করছে। প্রথমত সময়-শূন্যতার বিজ্ঞাপন। দ্বিতীয়ত গতানুগতিকতার ভার। তবে দ্বিতীয়টাই বাস্তবতার সাথে বেশী জড়িত। কয়েক মিনিট দেরিতেও হয়তো অফিসে পৌছানো যায়। কিন্তু বর্তমান সংবাদ পত্রগুলোতে আমরা কি পড়ি? নারী ধর্ষন, এসিড নিক্ষেপ, জবাই, রাজনৈতিক হত্যা, চাঁদাবাজি, মৌলবাদের উত্থান আর ক্ষমতাসীন সরকারের তথাকথিত উন্নয়নের জোয়ার। এইতো প্রতিদিন সংবাদ পত্রের ভাষ্য। সুতরাং কেবল শিরোনাম দেখলেই চলে হয়তো। এর পরের প্যারায় শীতলতা আরো মারাত্নক। একেবারে ভাবলেশহীন – বিকেলে অফিস ছুটি / যানজট / পায়ে হেঁটে / বন্ধুর বাসায় / ফিরে আসি রাত দশটায় / – এই তিন লাইন পড়েই অনুমান করা যায়। তৃতীয় বিশ্ব নামের এই মহানরক। প্রথম বিশ্ব অথবা দ্বিতীয় বিশ্বে সন্ধ্যায় কাজ শেষে লোকজন তাদের উজ্জিবীত করে পানশালায়, নাইট কাবে, লাইব্রেরীতে। যানজট, না হলে তিনি সম্ভবত অনেক আগেই বাসায় ঘুমিয়ে পড়তেন। আবার কবিতায় নাম অনুযায়ী তিনি সম্ভবত প্রত্যহ বন্ধুর বাসায় যান। এর পরের দু’লাইন আরো বেদনাজ্ঞাপক – খাবার টেবিলে মাছি, আরশোলা / ঠান্ডা পাউরুটি । জীবনের প্রতি উদাসীনতা অথবা অসহায়ত্ব অথবা বন্দীত্ব। সেই নিরুপায় মাছির মত, সেই আরশোলার মত অথবা সেই ঠান্ডা পাউরুটির মত আমাদের জীবন। আর এক যন্ত্রমানবের স্বীকারোক্তি যেন প্রথম লাইনকে আবার ক্যাসেটে বাজানো হচ্ছে – অনুগ্র আলোর নিচে আমার শোবার ঘর। আবার সকালে বেঁচে উঠা। এখানে কোন ক্লান্তি নাই, আছে অনিবার্যতা এবং তার নির্দয় স্বীকারোক্তি। কামুর আউসাইডার এর নায়কের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে কাফকার মেটামরফসিস-এর গ্রেগর সামসাকে।

সতের লাইনের এই কবিতাটা আগাগোড়া নির্মেদ, ঝরঝরে । জীবনানন্দ তছনছ করেন ঐতিহ্যের ভান্ডার, ইতিহাসের শব্দ, সুধিন্দ্রনাথ তদ্ভব-তৎসমে কবিতাকে করে তোলেন সুধীনিয়। কিন্তু এ যে একে বারে আটপৌরে, চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শব্দগুলো কি অবলীলায় গভীর দ্যোতনাময়। এ কবিতাটা যে কেউ পড়ে বুঝতে পারবে। এখানে কোন চালাকি নাই। কোন জটিলতা নাই, কেবল অন্তর্গত দার্শনিক জটিলতা ছাড়া। কবিতা নিয়ে ব্যাপক ভাবনার ফসল হিসাবে যে জটিলতার দান তা ভাঙ্গতে ইচ্ছে করেনা। মনে হয় ‘অনুগ্র আলোর নীচে ঘুম টুকুই কেবল বেঁচে থাকা। কিন্তু যে প্রাত্যহিকতার চলচ্চিত্র কবি আমাদের সম্মুখে দাঁড় করান, তাতে জীবিত থাকাটাই হচ্ছে মৃত্যু। আর ঘুম মানে বেঁচে থাকা। আর চলতি সময়ের প্রায় কবিতার মধ্যে কবিদের স্বেচ্ছাচারের এত বেশী ছড়াছড়ি যে কল্পনারও যে একটা সুষম গ্রন্থনা দরকার তার দিকে তারা চরম অবজ্ঞাত। জীবনানন্দ এত বেশী পর্যটন করেছেন, জোতির্বিদ্যা, রসায়ণ, ইতিহাস, দর্শন। কিন্তু জীবনানন্দের প্রত্যেক কবিতায় রয়েছে এক শিক্ষনীয় গ্রন্থণা। সে হিসাবে জীবনানন্দের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতা যখন একসাথে পড়া হয় তখন মনে হয় সমস্ত কবিতা মিলে আসলে জীবনানন্দ একটি কবিতাই লিখেছেন।

এখনব্দি এ কবির অন্য কোন কবিতা পড়ার সুযোগ হয় নাই। কেবল একজন কবিই জানেন এ জঙ্গলে একজন কবির নিয়তিতে কি বিভৎসতা লিপিবদ্ধ। কিন্তু সেতো ঝিনুক। কবির চামড়া কি নয় ঝিনুকের খোলসের মত দুর্ভেদ্য? আর বিষক্রিয়ার ফলে সে কি তৈরী করেনা মুক্তো ? সময়কে বুঝতে পারা একজন কবির অনেক বড় অর্জন। এই কবিতায় আবেগ নিয়ন্ত্রিত, সময় তীরবিদ্ধ। মেনে নেয়ার এবং তা প্রকাশের ভাষা ঋজু কিন্তু তীর্যক, প্রকাশ উচ্ছসিত নয় অনুরণিত।

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

6 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
6
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.