কবি শামসুর রাহমানের মৃত্যুর পর কলকাতা থেকে প্রকাশিত দ্বি-মাসিক “পথিকৃৎ”-এর পক্ষ থেকে প্রয়াত কবির উপর একটি বিশ্লেষণধর্মী লেখা ছাপাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। লেখাটি চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল – বাসদ-এর আহ্বায়ক কমরেড খালেকুজ্জামানের কাছে। কমরেড জামান-কৃত কবির মূল্যায়নটি পড়তে হলে এই লিংক থেকে ডাউনলোড করে নিন। সুন্দরভাবে টাইপ করা তথ্যসমৃদ্ধ মূল্যায়নটি পড়ে আমার মনে কিছু প্রশ্ন জেগেছে, যে কারণে এই ব্লগ লেখা। শুরুতে বুঝতে পারিনি যে লেখাটি এত দীর্ঘ হয়ে যাবে; তাই পাঠকের কাছে অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তাঁদের অনেকটা সময় নিয়ে নেয়ার জন্য।
আমার জানা নেই কমরেড খালেকুজ্জামানের সাহিত্য সমালোচনার কোনো প্রশিক্ষণলব্ধ যোগ্যতা (যেমন: সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রি), কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতা (যেমন: দীর্ঘদিন কোনো পত্রিকার সাহিত্য পাতা সম্পাদনার সাথে সম্পৃক্ততা), কিংবা একজন সাহিত্যিক বা সাহিত্য সমালোচক হিসেবে সর্বজনগ্রাহ্যতা আছে কিনা। ধরে নিতে হচ্ছে, এই তিন দলের অন্তত যে-কোনো একটির মধ্যে তিনি পড়েন; আর তা নাহলে কেনই-বা “পথিকৃৎ” নামের এই সাহিত্য পত্রিকাটি তাঁর কাছেই কবি শামসুর রাহমানের মূল্যায়ন চাইবে ? আর যদি তিনি এই তিনটি দলের কোনোটির ভেতরই না পড়েন, তখন পুরো বিষয়টিকেই একটু অন্যভাবে দেখার অবকাশ থাকে বৈকি। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, “পথিকৃৎ” পত্রিকার এই মূল্যায়ন চাওয়ার বিষয়টিও কিছুটা কৌতূহলোদ্দীপক। কেন একটি সাহিত্য পত্রিকা একজন অসাহিত্যিকের কাছ থেকে শামসুর রাহমানের মূল্যায়ন চাইবে, সে বিষয়টা আমার এবং আরো অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। একজন কবি, তা-ও শামসুর রাহমানের মাপের একজন কবি কোনো দেশ, কাল বা সীমানার মধ্যে আবদ্ধ থাকেন না; কোনো দল বা মতাদর্শের মধ্যে তো নয়ই। তাঁর মতো কবিরা পৃথিবীর সম্পদ। তাঁকে নিয়ে মূল্যায়নধর্মী কাজ দাঁড় করানোর মতো প্রয়োজনীয় মাল-মশলা-তথ্যাদি পশ্চিমবঙ্গে দুর্লভ নয়। আমার জানা মতে, পশ্চিমবঙ্গে শামসুর রাহমানের প্রায় সমস্ত কবিতার বই-ই পাওয়া যায়। “পথিকৃৎ” পত্রিকা যদি নিউ ইয়র্ক কিংবা ব্রাসেলসের হতো, তাহলেও কথা ছিল। এও ধরে নিতে পারি যে, “পথিকৃৎ”-এর সদস্যরা পড়তে লিখতে পারেন এবং সাহিত্য বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহ-ও ধারণ করেন। সুতরাং এত কিছু থাকতে কেন যে তারা জনৈক অসাহিত্যিক রাজনৈতিক নেতার মতামত জানতে এত আগ্রহী হলেন, সে বিষয়ে যত ভাবি, ততই বিস্মিত হই।
যাই হোক, মূল্যায়নটিকে একটু কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করা যাক। আলোচনার সুবিধার্থে ব্লগপোস্টটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করে নিচ্ছি। প্রথমভাগের আলোচনাটি কমরেড জামানের মূল্যায়নটির সুনির্দিষ্ট বক্তব্যনির্ভর, পাঠকের সুবিধার্থে মূল্যায়নটির কিছু কিছু অংশ সেখানে সরাসরি উদ্ধৃত। পাশাপাশি, যেখানে প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। দ্বিতীয় অংশটি বৃহত্তর দৃশ্যপট নিয়ে, যেখানে চেষ্টা করেছি সমাজতান্ত্রিক দল এবং আদর্শকে ঘিরে আবর্তিত “পার্টি সাহিত্যে”র ধারণা এবং আনুষঙ্গিক কিছু বিষয়ের ওপর আলোকপাত করার।
এক.
কমরেড খালেকুজ্জামান তাঁর নিবন্ধের এক জায়গায় লিখেছেন:
বিনীত, মার্জিত, মৃদুভাষী কবি শামসুর রাহমান বিশ্বাস করতেন ‘কবিতা মানুষের মনকে পরিশীলিত করে।’ এটা ঠিক যে কবিতার ছন্দ মানুষের মনকে দোলায়িত করে। কিন্তু কবিতার গাঁথুনির মধ্যে যে কাব্যভাব লুকিয়ে থাকে এবং যে ভাব-চেতনা পাঠক শ্রোতাদের মনে আবেগ-আবেশ, অনুভূতি-প্রেরণা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সুরের দ্যোতনা সৃষ্টি করে – শ্রেণীতে ভাগ করা সমাজে কবি কিংবা পাঠক কেউ-ই কাব্যভাবের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ওই শ্রেণীপ্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেন না। এ বিষয়ের সঠিক উপলব্ধি যে খুব জরুরি তাঁর লেখায় সেটি তেমন তীক্ষ্ণভাবে ফুটে ওঠেনি। [গুরুত্বারোপ লেখকের]
আধুনিক কবি হিসেবে শামসুর রাহমানের কবিতা যে ছন্দনির্ভর নয়, সে কথা না-ই বা তুললাম। [১৮ নং মন্তব্যের বিপরীতে লেখকের প্রত্যুত্তর দ্রষ্টব্য]। আর আধুনিক কবিতার পাঠকের কাছে কবিতার আবেদনের পেছনে যে ছন্দই প্রধান নয়, কমরেড খালেকুজ্জামানের মতো একজন বোদ্ধা পাঠককে সেটি মনে করিয়ে দেয়া হয়তো একটু ধৃষ্টতাই হয়ে যাবে। সুতরাং সে চেষ্টাও করবো না। কিন্তু যে বিষয়টা আমাদের অবাক করে, তা হল, একজন ক্ষমতাবান কবি হিসেবে শামসুর রাহমানের মানব মনোজগতে অবদান কমরেড জামানের কাছে যথেষ্ট নয়। কারণ, তিনি মনে করেন কাব্যভাবনার অন্তরালে শামসুর রাহমানের বুকের খাঁচায় শেষ পর্যন্ত একটি বুর্জোয়া-হৃদয়ই স্পন্দিত হয়।
অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, বন্ধুমহলের সমাজতন্ত্রীদের কাছে এই “শ্রেণীপ্রভাব” শব্দটি খুব প্রিয়। এটি তাঁরা প্রায়শই একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। তাঁদের অমোঘ বিচারে কখন যে কে শ্রেণীদোষে দুষ্ট হয়ে যাবেন, সেটা বলা খুব মুশকিল। তাত্ত্বিক নই, সুতরাং আমার কাছে পুরো বিষয়টিই একটু গোলমেলে ও ধোঁয়াটে ঠেকে বৈকি। যাই হোক, যখন দেখি কবি শামসুর রাহমানের মত মানুষও কোনো কোনো মূল্যায়নকারীর রায়ে শ্রেণীদোষে দুষ্ট হন তখন স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে — কী এই “শ্রেণীপ্রভাব” ? কিসের ভিত্তিতে এর নিরূপণ হয়? যিনি রায় দিচ্ছেন, তিনি নিজে কোন শ্রেণীর মাঝে দাঁড়িয়ে কোন অধিকার বলে দিচ্ছেন সে রায় ? তাতে কতটা বস্তুনিষ্ঠতা আর কতটাই-বা গোঁড়ামিপ্রসূত পক্ষপাতদুষ্টতা? কতটা আদর্শের তাগিদ আর কতটা দলীয়কর্মী ও অনুসারীদের মন মানস নিয়ন্ত্রণের ধান্দাবাজি ? কতটা সততা আর কতটা ফন্দিবাজি ?
অপর এক স্থানে কমরেড খালেকুজ্জামান লিখেছেন:
(শামসুর রাহমান) বলতেন, “আমি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাস করি, আর ব্যক্তির বিকাশ, তার সৃজনশীল বিকাশের প্রতিও আমি বিশ্বাসী, এবং এ পৃথিবীর সব মানুষের কল্যাণ হোক এবং মানুষ প্রগতির দিকে এগিয়ে যাক — এ বিশ্বাস আমার আছে।” তিনি আরও বলেছেন, “আমি তেমন একটি সমাজে স্বস্তি বোধ করবো যেখানে মানুষকে অনাহারে থাকতে হবে না, মানুষের পরার কাপড় থাকবে, খাবারের নিশ্চয়তা থাকবে এবং তার ব্যাক্তিত্ব ক্ষুণ্ন হবে না – এরকম সমাজে আমি থাকতে পছন্দ করবো যে সমাজ শোষণহীন এবং যেখানে দারিদ্র্যের নিপীড়নে মানুষ মারা যাবে না, এবং তার ব্যক্তিসত্তাটা ক্ষুণ্ন হবে না।” কবির এই সুন্দর চাওয়টা মহৎ। কিন্তু এ নিয়মশাসিত জগতে নিয়মের অনুশাসনের বাইরে কোন কামনা তা যত মহৎই হোক – বাস্তবে রূপ নেবার কোন পথ নেই। [গুরুত্বারোপ লেখকের]
মূল্যায়নকারীকে ধন্যবাদ জানাতে হচ্ছে শামসুর রাহমানের উক্তিটি তুলে ধরার জন্য। ব্যক্তি শামসুর রাহমানের সাধারণ মানুষের প্রতি অকপট ভালোবাসাই স্পষ্ট হয় এতে। এতে একদিকে যেমন অভুক্ত বস্ত্রহীন মানুষের জন্য প্রকাশ পেয়েছে কবির শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, তেমনি রয়েছে তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ কামনা করার মতো যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও মানবতাবোধ, যা দিন দিন বিরল থেকে বিরলতর হয়ে উঠছে এদেশের সৃজনশীল মানুষদের মধ্যে; একালের লেখকদের মধ্যে তো বটেই।
আজ বাংলাদেশের চরম দুর্দিনের কথাটাই ধরা যাক। সরকারের অব্যবস্থার কারণে সাধারণ মানুষ নিত্য-প্রয়োজনীয় চাল ডালটুকু পর্যন্ত কিনতে পারছে না। ছোট্ট শিশুরা স্কুল ফেলে চালের জন্য লাইনে; দিনমজুর তার জীবিকা ফেলে রেখে খাবারের জন্য লাইনে — যদি সস্তায় দু’মুঠো অন্ন জোটে (একেবারে আক্ষরিক অর্থেই), সে আশায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, এমন দিনে কবি হয়তো চুপ থাকতে পারতেন না; যেমনটি তিনি থাকেননি তাঁর সারাজীবন। দুঃখের বিষয় হল, এমন দুর্দিনে কমরেড খালেকুজ্জামান কিংবা তাঁর দলের পক্ষ থেকে দেশবাসীর পাশে অর্থবহভাবে দাঁড়ানোর কোনো লক্ষণ আমাদের চোখে পড়েনি। উল্টো তাঁদের দেখেছি এই সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ জুগিয়ে যেতে গত দেড়টি বছর ধরে। (এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত একটা পোস্ট লিখবো সময় পেলে)। তাঁর দলের অনেকেই শুনি আজ খুশিতে আত্মহারা — কারণ, বুর্জোয়ারা নাকি এ যাত্রায় বাকি বুর্জোয়াদের কেটে-ছেঁটে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে এবং এতে করে নাকি তাঁদের দলের খুব লাভ হচ্ছে – কারণ, বিভিন্ন জেলায় নাকি আজ হাজার হাজার নতুন কর্মী বাসদে নাম লেখাচ্ছে। সে কর্মীদের আদর্শিক চেতনার মান, কিংবা স্থিরতা কতটুকু, সে প্রশ্ন না হয় না-ই বা তুললাম। আসল ঘটনা কী ঘটছে সেখানে, তা দলের নেতা কমরেড জামান নিশ্চয়ই জানেন; আমারাও যে তা কম-বেশি জানি না তা কিন্তু নয়। আর এই নীরবতা এবং সেনা সমর্থনের রহস্য যে সাধারণ মানুষ অনুমান করতে পারে না, তাও নয়। কারো মতে এটা ক্ষমতার লোভ। আবার কেউ মনে করেন এটা দলের দিক থেকে হঠাৎ উপলব্ধি, যে, এ যাত্রায় কোরেশীদের সাথে লেগে থাকতে পারলে ভাগ্যের ফেরে ক্ষমতার শিকেটা ছিঁড়ে তার কিছু ভাগ পাওয়া গেলেও যেতে পারে। [‘আঁতাত’ এবং ‘কোরেশী’ বিষয়ে লেখকের মন্তব্য-প্রত্যুত্তর ৭ এবং ৪৩ দ্রষ্টব্য; আরো দেখুন ৩৪, ৩৮-৪০ এর বিপরীতে লেখকের প্রত্যুত্তর]।
আরেক স্থানে খালেকুজ্জামান লিখেছেন:
এক্ষেত্রে শোষণমুক্ত কল্পনার রাজ্য তথা কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের অসার অসংগতিপূর্ণ ধারণার বদলে ইতিহাস নির্ধারিত বিজ্ঞানসম্মত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ভাবাদর্শের মাধ্যমে কীভাবে সত্যিকার মানবমুক্তি, শোষণমুক্তির পথ রচিত হয়ে আছে সে বিষয়ে শামসুর রাহমানের সঠিক উপলব্ধির ঘাটতির কারণে তিনি বর্তমান সময়ের দুঃখ-জ্বালা, শাসকশ্রেণীসহ সকল প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীর শোষণ-পীড়ন-নির্যাতনে ক্ষত-বিক্ষত হলেও, মানবিক প্রেমে-আবেগে নৈসর্গিক সৌন্দর্যে সকলকে উদ্বেলিত করতে পারলেও, সকল শোষণ-পীড়ন থেকে মুক্তির আরও সুন্দর ভবিষ্যতের সঠিক দিশা তুলে ধরতে অসমর্থ হয়েছেন। . . . যথার্থ গণমুক্তির জন্য বুর্জোয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণবিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা তাঁর উপলব্ধিতে ধরা পড়েনি। [গুরুত্বারোপ লেখকের]
কাউকে কোনো কাজে ব্যর্থ আখ্যা দেয়ার আগে যে বিষয়টা সর্বাগ্রে বিবেচ্য তা হল — সে কাজটা তার ওপর অর্পিত দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিনা। যতদূর বুঝি, জবাবদিহিতার ব্যাকরণে সেটাই হল প্রথম পাঠ। সুতরাং প্রশ্ন হল, ‘সুন্দর ভবিষ্যতের সঠিক দিশা’ তুলে ধরা কি কবি শামসুর রাহমানের নিয়মিত দায়িত্বের অংশ ছিল যে তাঁকে সে দায়িত্বে ব্যর্থতার জন্য দায়ী করা হচ্ছে আজ ? সবকিছু, এমনকি সমাজ পরিবর্তনের সঠিক ‘দিশা’-টুকুও যদি কবিকেই দিয়ে যেতে হয়, তাহলে কমরেড খালেকুজ্জামানের মতো বিচক্ষণ ও ত্যাগী নেতারা এবং তাঁদের বিপ্লবী দল কী করবে? এখানে মনে রাখতে হবে কমরেড জামানের দল বাসদের নেতাদের ভরণপোষণ থেকে শুরু করে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অর্থ আসে জনগণের কাছ থেকে, গণচাঁদার আকারে। সুতরাং অজান্তেই জনগণের ট্রাস্টির ভূমিকায় কমরেড খালেকুজ্জামান ও তাঁর দল অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন, প্রয়াত কবি শামসুর রাহমান নন। আর জনগণ থেকে অর্থ নিয়ে সেই ট্রাস্টির দায়িত্ব বাসদের মতো বড় একটি সমাজতান্ত্রিক দল গত দেড় বছরে কতটুকু পালন করেছে জনগণের দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়ে ‘সঠিক দিশা’ দেয়ার ক্ষেত্রে, তার বিচারও জনগণ সময়মতো করবে, সে বিশ্বাস আমাদের আছে। সুতরাং অন্যের দায়িত্বের মূল্যায়নের আগে নিজেদের দায়িত্বে অবহেলা বা ব্যর্থতাগুলো কি একটু খতিয়ে দেখার সময় আসেনি কমরেড খালেকুজ্জামানের মতো একজন তীক্ষ্ণধী মূল্যায়নকারীর ?
অনেকটা বলতে বাধ্য হচ্ছি, বাসদের মতো দলের “ইতিহাস নির্ধারিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ভাবাদর্শের” পথে চলার নমুনা যদি হয় স্বৈর-সামরিক সমর্থনপুষ্ট আমলানির্ভর সরকারের তাঁবেদারি — যে সরকার কিনা শুরু থেকেই জনবিরোধী, গণতন্ত্র ও রাজনীতি বিরোধী, রাজনৈতিক প্রক্রিয়াবিরোধী, মানবাধিকার বিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল, সংবিধানবিরোধী এবং সর্বোপরি উন্নয়নবিরোধী — তখন বুঝি আমাদের অবাক হবার ক্ষমতাও লোপ পায় ! জামান সাহেব এবং তাঁর দলের সমর্থনপুষ্ট এই সরকারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো এইমাত্র করলাম তার পক্ষে অগুনতি উদাহরণ দাঁড় করাতে পারি, নিকট অতীত থেকেই। যেমন: এই সরকার অজুত শ্রমিককে পথে বসিয়েছে; তাদের হাতে পাট ও গার্মেন্ট শ্রমিকদের নীপিড়ন-নির্যাতনের কথা না হয় বাদই দিলাম। এই সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতার টুঁটি চেপে ধরেছে (ডিজিএফআই কর্তৃক তাসনীম খলিলের উপর নির্যাতন, ইন্টারনেট, পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলোর উপর সরকারের খবরদারি)। এই সরকার মৌলবাদী শক্তির সাথে আপোস করেছে (আরিফের কার্টুন, নারীনীতি)। এই সরকার সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ন্যূনতম বাঁচার এবং জীবিকার অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে (মধুপুর বনের গারো নেতা চলেশ রিচিল হত্যা, পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘সাজেক’ -এ অনাচার, অলকেশ চাকমা এবং আরো চারজনের অপহরণ)। দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্য ও বিদ্যুৎ সংকট — সব মিলিয়ে এই সরকারের সময় মানুষের খেয়েপরে বেঁচে থাকাই এক কঠিন অস্তিত্বের সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। আর যে যতই মিথ্যা এবং আইনি তত্ত্বের প্রলেপ দেয়ার চেষ্টা করুক না কেন, এই সরকারের না আছে সাংবিধানিক বৈধতা, না আছে আইনের শাসন, মানবাধিকার এবং সংবিধানের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ। দেশের সাধারণ মানুষ মাত্রেই দেখেছেন হাই কোর্টের রায়গুলো কি বিচিত্র ফর্মুলায় সুপ্রীম কোর্টে গিয়ে একের পর এক উল্টে গেছে গত দেড়টি বছর। ইদানীং আবার তারেক জিয়াদের মতো বড় বড় দুর্নীতিবাজদের নিরাপদে বিদেশে পাচার করার জোর পাঁয়তারা চলছে। এ নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যেতে পারে। প্রশ্ন হল, বাসদের মতো দলটির কি এসব বিষয় অজানা ? আমার বিশ্বাস তাঁরা এ বিষয়গুলো আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকদের চেয়ে অনেক ভালো জানেন এবং বোঝেন। কে জানে, তাঁদের “ইতিহাস নির্ধারিত বিজ্ঞানসম্মত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ভাবাদর্শের” শিক্ষা হয়তো এভাবেই ‘জনগণের রাজনীতি’ চালিয়ে যাবার দিক নির্দেশনা দেয় আজকাল (যার মোদ্দা কথা সামরিক সরকারের তাঁবেদারি এবং জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা )। প্রয়াত কবি শামসুর রাহমান অন্তত, যতদূর জানি, জীবনে কোনোদিন জনগণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্বৈর সামরিক সরকারের তাঁবেদারি করেননি। সন্ত জন-এর গসপেল-এ একটি কথা আছে : let him who is without sin cast the first stone. সেই বিচারে কমরেড খালেকুজ্জামানের কতটুকু নৈতিক ঊর্ধ্বাবস্থান আছে কবি শামসুর রাহমানের সমাজ-রাজনৈতিক মানস বিচারের, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থাকে। আমি জানি, কমরেড জামানের নেতৃত্বাধীন বাসদের গত দেড় বছরের রাজনৈতিক ভূমিকার এই বয়ান কারো কারো কাছে প্রসঙ্গবহির্ভূত মনে হতে পারে। কিন্তু এই তুলনামূলক আলোচনাটির দরকার ছিল কবির রাজনৈতিক ভূমিকার মূল্যায়নকারীদের দলীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং স্বীয় অবস্থান আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য।
আরেকটা বিষয় না বললেই নয়। কবি শামসুর রাহমানের মতো একজন মানবতাবাদী সংবেদনশীল মানুষ যখন শোষণহীন সমাজের আবেগ ও স্বপ্নকে লালন করেন, তার মধ্যে একধরণের সারল্য এবং সততা থাকে। তাঁর নির্জলা চিন্তা এবং চাওয়ার মধ্যে আমাদের চেনাজানা বহু তত্ত্ববাগীশদের চর্চিত বাগাড়ম্বরি ভেক নেই। কে জানে, হয়তো সেটাই হয়েছে শামসুর রাহমানের মতো মানুষদের সবচাইতে বড় অপরাধ — যার জন্য তাঁর সহজসরল স্বপ্নগুলোও আজ আখ্যায়িত হয় “শোষণমুক্ত কল্পনার রাজ্য” কিংবা “কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের অসার অসংগতিপূর্ণ ধারণা” হিসেবে।
দুই.
অন্যদের কথা জানি না , তবে আমার কেন জানি মনে হয়, এই পুরো মূল্যায়নপ্রচেষ্টার মধ্যেই কোথায় যেন একধরণের ধৃষ্টতারও আভাস রয়েছে; সাধারণ শিষ্টাচারবোধের অভাব তো বলাই বাহুল্য। এ কারণেই জরুরি হয়ে পড়ে আরেকটু গভীর বিশ্লেষণ। সেই সঙ্গে খুঁজে দেখতে হয় পুরো ব্যাপারটার মধ্যে ধৃষ্টতার বাইরেও সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বদহজমজনিত কোনো জটিলতর রোগের লক্ষণ রয়েছে কিনা। ভেবে দেখতে হয় এর মধ্যে কোনো সাধারণ ছক বা প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি ঘটছে কিনা যা বহুদিন ধরে চলে আসা কোনো অচলায়তন কর্ম ও চিন্তাপদ্ধতিকে প্রতিফলিত করে। ভাবতে ভাবতে মনের কোণে কয়েকটি উদাহরণ ভেসে উঠল; তার কোনো কোনোটা নিকট অতীতের, কোনোটা অর্ধ শতকেরও বেশি আগের।
সোভিয়েত লেখক মিখাইল শলোখভ এর কথাই ধরা যাক, যিনি ১৯৬৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তাঁর কালজয়ী উপন্যাস “ধীরে বহে ডন”- এর জন্য। সারা পৃথিবী যখন তাঁর প্রতিভায় শ্রদ্ধাবনত, তাঁর নিজের দেশে তখন তিনি সম্মুখীন হয়েছেন একের পর এক হয়রানির। তাঁর অপরাধ হল : ডন নদীতীরের মানুষদের নিয়ে লেখা এ উপন্যাসের মূল চরিত্র “গ্রিগরি মেলেখভ” — যাকে শলোখভ সৃষ্টি করেছেন গভীর মমতা ও যত্ন নিয়ে — একজন অকমিউনিস্ট কসাক। কমিউনিস্ট পার্টির কর্তাব্যক্তিরা এতে অত্যন্ত নাখোশ হন। এর পেছনে তাঁরা শলোখভের সাম্যবাদী আদর্শের প্রতি নিষ্ঠার অভাব দেখতে পান। ফলতঃ জীবদ্দশায়ই তাঁর উপন্যাস সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের সেন্সরশিপের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে এমনও অপবাদ ছড়ানো হয়েছে যে পুরো উপন্যাসটিই শলোখভ আসলে অন্যের কাছ থেকে চুরি করেছেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যপার হল, কোনো এক স্থানীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিচালককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তাঁর লেখার সাহিত্যিক এবং আদর্শিক মান বিচার করে (!) তাঁর বিরুদ্ধে “প্রয়োজনীয়” ব্যবস্থা গ্রহণের। সব প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হয়েছে, তখন এমনকি শলোখভকে বিষ খাইয়ে হত্যা করারও চেষ্টা হয়েছে; হয়েছে শল্য চিকিৎসার সাজানো নাটকের মাধ্যমে অপারেশন টেবিলে হত্যার ষড়যন্ত্র; হয়েছে নিরাপত্তা-গোয়েন্দা সদস্যদের দিয়ে তাঁকে গ্রেফতারের সময় “পালানোর চেষ্টার অভিযোগ” তুলে গুলি করে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র। ভাগ্যক্রমে, কিছু উচ্চপদস্থ শুভানুধ্যায়ী (যাঁদের একজন ছিলেন যোসেফ স্তালিন) থাকাতে শলোখভ শেষ পর্যন্ত প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু এতো আজ কারো অজানা নয় যে সে সময়ের বাকি অজস্র লেখক-কবি-সাহিত্যিকদের সবার সেই সৌভাগ্য হয়নি। আদর্শিক শুদ্ধি অভিযানের নামে তাদেরকে দেয়া হয়েছে সাইবেরিয়ায় যাবজ্জীবন সশ্রম নির্বাসন, কারণ কর্তৃপক্ষের বিচারে তাদের লেখা যথেষ্ট “লাল” ছিল না। আগের কথায় ফিরে আসি। কোনোমতে প্রাণে বেঁচে গেলেও সারাজীবন শান্তি পাননি শলোখভ। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ধ্বজাধারী কিছু পার্টি কর্মকর্তা তাড়া করে ফিরেছে তাঁকে সোভিয়েত রাষ্ট্রের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত — যারা আদপে ছিল গোঁড়া, কূপমণ্ডুক, মৌলবাদী, এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সাহিত্যের মান বিচারের ক্ষমতা ও যোগ্যতাহীন। এসব দেখে মনে হয়, কবি শামসুর রাহমানের সাত পুরুষের ভাগ্য যে তিনি সোভিয়েত রাশিয়ায় জন্মাননি; সম্ভবত এটাও কবির পরম ভাগ্য — তিনি কোনো “সমাজতান্ত্রিক” বাংলাদেশে জন্মাননি যার রাষ্ট্রক্ষমতায় কমরেড জামানের মত মূল্যায়নকারীরা।
কাছের বন্ধুদের অনেকেই এ ধারার রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় কিছু জিনিস খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। পেছন ফিরে দেখলে এখন বুঝতে পারি, পরিচিত অনেকের মধ্যেই একচোখা “সমাজতান্ত্রিক মূল্যায়নের” এসব লক্ষণ কমবেশি সবসময়ই ছিল। অন্যান্য দলগুলোর কথা জানি না, তবে পরিচিতদের অনেকেই সদস্য ছিল কমরেড জামানের বাসদ ও এর ছাত্র সংগঠন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের। ওদের কাছ থেকেই শুনেছি কীভাবে দলের বিভিন্ন পাঠচক্র থেকে শুরু করে সাধারণ আলোচনায় এক ধরণের সীমিত এবং একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা চলে আসছিল বহুদিন ধরে। যেমন সাহিত্যের কথাই ধরা যাক — দলের চোখে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে শরৎচন্দ্র অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ লেখক ছিলেন। কারণ, দু’জনেই পেটি বুর্জোয়া হলেও প্রথমজন দলের চোখে আপোসকামী ধারার প্রতিনিধি এবং পরের জন সংগ্রামী ধারার। এই পক্ষপাতের মূল কারণ হিসেবে শরৎচন্দ্রের “পথের দাবী” উপন্যাসটি প্রায়ই আলোচনায় আসতো, যেটির অবস্থান ছিল পার্টির সুপারিশকৃত পাঠ্যতালিকায় উপরের দিকে। যতদূর শুনি, সেই তালিকার কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি এতদিন পরও। প্রিয় পাঠক, আপনারা যদি উপন্যাসটি না পড়ে থাকেন, তবে অনুরোধ করব চট করে পড়ে নেবার। ছোট্ট একটি সূত্র দিচ্ছি — এক গেলাস মাসুদ রানা ( কাজী আনোয়ার হোসেনের “দূর্দান্ত দুঃসাহসী স্পাই,” যে কিনা “গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ দেশান্তরে”!), এক মুঠো কবির চৌধুরী (একই লেখকের সৃষ্ট পাগল বৈজ্ঞানিকের চরিত্র), সেইসাথে এক চিমটি বনহুর (রোমেনা আফাজের সৃষ্ট রমণীমোহন সেই দস্যুচরিত্র) - এই সবগুলো উপাদানকে যদি একপাত্রে মিশিয়ে নিতে পারেন তাহলে যে অদ্ভুত জগাখিচুড়িটি পাবেন সব মিলিয়ে তা “পথের দাবী”র মতো তথাকথিত এই সংগ্রামী উপন্যাসটির চেয়ে দূরবর্তী কিছু নয়। উপন্যাসটির মান কিংবা এতে সৃষ্ট চরিত্রগুলো নিয়ে আমি আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না। বিচিত্র এই সংমিশ্রণটির সাহিত্যিক গুণাগুণ বিচারের ভার আমি বরং বোদ্ধা পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি। সাহিত্য হিসেবে সাধারণ বিচারের পাশাপাশি এমনকি শরৎচন্দ্রেরও অন্যান্য লেখার বিপরীতে “পথের দাবী” উপন্যাসটির মান কী দাঁড়ায় তুলনামূলক বিচারে তাও বিবেচনা করার অনুরোধ ও আহ্বান রইলো পাঠকের প্রতি।
প্রশ্ন সেখানে নয়। প্রশ্ন হল, কোনো সাহিত্যে সমাজতন্ত্রের কথা কিংবা সশস্ত্র সংগ্রামের কথা থাকলেই কি তা উন্নত সাহিত্য হয়ে যায়? “গ্রহণযোগ্য” হয়ে যায়? আর সে সব না থাকলেই কি সে সাহিত্য “শ্রেণী সীমাবদ্ধতার” দোষে দুষ্ট হয়ে যায়? অসম্পূর্ণ হয়ে যায়? কে ঠিক করেছে সাহিত্য বিচারের এমন অদ্ভুত মাপকাঠি? একজন সাহিত্যিক যখন লেখেন তখন তিনি নিশ্চয়ই কোনো স্লোগান কিংবা মেনিফেস্টো সামনে রেখে লিখতে বসেন না। অতীতে যে-সব সাহিত্যিক সেভাবে লিখেছেন (যেমন করেছেন অনেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নে, বাধ্য হয়ে কিংবা আপোস করে), তাঁদের সাহিত্যকর্মটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবার আগে। এ বিষয়ে সততা, স্বতঃস্ফূর্ততা কিংবা সৃষ্টিমৌলিকতার বিষয়গুলোর কথা যদি বাদও দিই।
শামসুর রাহমানের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের চেতনার অভাবের কথা লিখেছেন কমরেড খালেকুজ্জামান। “পথের দাবী” উপন্যাসের সব্যসাচী’র চরিত্র কতখানি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ধারণ করে, কিংবা তাত্ত্বিক বিচারে লেখক শরৎচন্দ্রই বা কতখানি “সমাজ পরিবর্তনের দিশা” আমাদের দেন, কিংবা বর্তমান সমাজ প্রেক্ষাপটে শরৎ আদৌ প্রাসঙ্গিক কিনা, কই কমরেড জামান কিংবা তার দল তো কখনো সেসব বিষয়ে সমালোচনাধর্মী নিবন্ধ লেখেন না ! যে-কোনো সাহিত্যকে প্রথমে তো অন্তত সাহিত্যের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে হবে, তার পর তার তত্ত্ব বিচারের প্রশ্ন, নিতান্তই যদি করতে হয়। স্বীকার করে নিতে বাধা নেই — সাহিত্য বিচারের অধিকার হয়তো পাঠকমাত্রেরই কমবেশি রয়েছে। তবে বিচারের প্রশ্ন যখন ওঠে, তখন অনেকটা অবশ্যম্ভাবীভাবেই বিচারকের যোগ্যতাটাও বিবেচনার মধ্যে আনতে হয়।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, অন্যান্য সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রেও এধরণের দ্বৈতনীতির প্যাটার্ন লক্ষ করেছি পরিচিত অনেক সমাজতন্ত্রীর মধ্যে। প্রায়ই তাঁরা এরকম অদ্ভুত সরলীকৃত একধরণের তুলনা করে থাকেন কবি জীবনানন্দ দাশ ও সুকান্ত ভট্টাচার্যের মধ্যেও, এমনকি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যেও। সেসব ক্ষেত্রে কার বা কাদের ব্যপারে পার্টির পক্ষপাত একটু বেশি, তা বুদ্ধিমান পাঠক সহজেই অনুমান করতে পারেন। এখানে বলে রাখা দরকার — পার্টিকর্মীদের যদিও রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দ পড়তে সরাসরি নিষেধ করা হয় না কখনো, একধরণের অসম্পূর্ণ এবং ত্রুটিপূর্ণ মূল্যায়নের চশমা তাদের হাতে ঠিকই ধরিয়ে দেয়া হয় নানা পার্টি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। তদুপরি, পার্টির অভ্যন্তরে প্রতিটি কর্মীর ভেতর বাকি কমরেডদের কাছে সমালোচিত না হবার তাগিদ তো রয়েছেই; রয়েছে গ্রহণযোগ্যতা লাভের তাগিদ — পাছে তাদের আদর্শিক নিষ্ঠা নিয়ে অন্যরা প্রশ্ন তোলে! এসবের মাঝেই জন্ম নেয় “অন্তর্গত-সমালোচনা-বিমুখ” এক আত্মবিধ্বংসী সংস্কৃতির। কেউ আর তখন “অপ্রিয়” কিংবা কঠিন কোনো প্রশ্ন করতে চায় না। অতীতে যারা প্রশ্ন তুলেছে, তারা সবাই কালে কালে ছিটকে পড়েছে দলের পরিমণ্ডলের বাইরে; অনেক উদাহরণ আছে তার।
স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছেলেমেয়েরা “গণমুখী” সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির ঐতিহাসিক ন্যায়বিচারের দিকটির দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে দলটির কাছে আসে। অবক্ষয়ী রাজনীতির বিপরীতে নিবেদিতপ্রাণ সমাজতান্ত্রিক নেতাকর্মীদের আদর্শমুখী অতি-সাধারণ জীবনযাপনের দৃষ্টান্ত নিজের চোখে দেখে তাদের সেই প্রাথমিক আকর্ষণ বা মোহ পরিণত হয় শ্রদ্ধা ও নির্ভরতায়। পত্তন হয় এক ধরণের mentorship বা বুদ্ধিবৃত্তিক গুরুশিষ্যের সম্পর্কের। (আমি জানি বাসদের নেতারা এর সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন; তাঁরা দাবি করবেন এ সম্পর্কের ধরণ নিতান্তই যুক্তি ও আদর্শভিত্তিক)। আর তরুণ সে-সব পার্টিকর্মীদের অপরিপক্ব মনের ওপর যখন গোঁড়ামিনির্ভর আধাসত্য তাত্ত্বিক দিকনির্দেশনা চাপিয়ে দেয়া হয় শিল্প-সাহিত্য বিচারের অজুহাতে, তখন এর কি সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া হতে পারে তাদের সার্বিক মনন বিকাশে, সে নিশ্চয়ই বলে দেবার প্রয়োজন হয় না। আমার নিজের চারপাশেই অন্তত কয়েক ডজন উদাহরণ রয়েছে আজ — কেমন করে একের পর এক আদর্শবাদী বুদ্ধিমান সব তরুণ-তরুণীর মনমানসকে পঙ্গু করে দেয়ার আয়োজন চলেছে সেখানে (ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়), স্রেফ আদর্শের নামে। বিশ্বাস এবং নির্ভরতার অবস্থানে থাকা কেউ যখন কাউকে ভুল দিকনির্দেশনা দেয়, ভুল দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করতে শেখায়, মনোজগৎকে সীমাবদ্ধ করতে শেখায় — তখন তাকে কী বলে?
কার্ল মার্কসের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করবো। দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তথা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের জনক মার্কস-এঙ্গেলস আশা করেছিলেন, তাঁদের দর্শন পথ রচনা করবে এমনই এক মুক্তচিন্তার সংস্কৃতির, যার ভিত্তি হবে বিতর্ক গবেষণা এবং প্রতিটি বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারার মতো পরিবেশ। কিন্তু নিজের জীবদ্দশাতেই অত্যুৎসাহী অনেক কমিউনিস্ট নেতার তত্ত্বের প্রতি গোঁড়ামি ও কূপমণ্ডুক দৃষ্টিভঙ্গি দেখে হতাশ কার্ল মার্কস নিজেই বলতে বাধ্য হয়েছিলেন: “thank God, I am not a Marxist !” কমরেড খালেকুজ্জামানকৃত কবি শামসুর রাহমানের এই মূল্যায়নটি পড়ে আমার এ উক্তিটিই মনে পড়ে গেল।
[যুগপৎ প্রকাশ: ওয়ার্ডস এন্ড বাইটস | প্রাসঙ্গিক: ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩]