একটা ব্যক্তিগত ইমেইল আমার চিন্তার আকাশটাকে আজ কদিন ধরে মেঘাচ্ছন্ন করে রেখেছে। মাঝে মাঝেই মনটা না দেখা সেই মেয়েটার পানে ছুটে যায় আর ভাবে কি করা যায়? মানুষ হিসেবে কি আমার কিছুই করার নেই?
একটি সাধারণ মেইল এসেছে পরিচিত একজনের কাছ থেকে। একটি মেয়ের বিয়ের জন্য সাহায্যের আবেদন জানিয়ে। মেয়েটি সে অর্থে সুশ্রী নয়, পড়াশোনা অনেক বেশি নয়, বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ। সম্প্রতি মেয়েটির বাবা ভাই অতি কষ্টে মেয়েটির জন্য একটি পাত্র যোগাড় করেছেন। পাত্রকে নগদ দুই লক্ষ টাকা, মেয়েটিকে আট ভরি সোনার গহনা আর চারশো বরযাত্রীকে দুই বেলা আপ্যায়ন করতে হবে এই শর্তে। অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে এ দুঃসাধ্য। কিন্তু তারা বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে এখন পয়সার সন্ধানে সব জায়গায় হত্যা দিচ্ছেন। চিঠিটিতে আরো একটি ছোট টীকা দেয়া ছিল, “মেয়েটি মাইনোরিটি গ্রুপের”। যিনি মেইলটি করেছেন তিনি জানেন, আমার টাকা পয়সা না থাকলেও আমি আমার ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে এদিক সেদিক বেড়িয়ে পরবো মেয়েটিকে সাহায্যের জন্যে। আর কিছু না পারলেও মানুষের দুয়ারে ধরনা দিয়ে পরে থাকতে পারি আর নিজে ছটফট করতে পারি।
কিন্তু যৌতুকের জন্য সাহায্য দিতে বিবেকের কাঁটায় বার বার বিঁধছে। তাহলেতো আমি যৌতুককে প্রশ্রয় দিচ্ছি। এ অন্যায়ে নিজেকে সামিল করতে পারি কি করে? সবকথা আমার নিজের ওপর টেনে ফেলা আমার চিরদিনের অভ্যাস। বারবার মনে হয়, আমার নিজের ছোটবোন হলে কি আমি এতে রাজী হতাম না বাঁধা দিতাম? আর এগুলো পেলেই যে পাত্র পক্ষ এখানে থামবে তার নিশ্চয়তা কি? আমার স্বাভাবিক বোকা বুদ্ধিও বলে এ শুধু শুরু এ কখনই শেষ নয়। যতোই গাছ নুইবে ততই তাকে আরো চাপা হইবে। পুলিশে খবর দিলে ধরিয়ে দিয়েও কি কিছু হবে? পাত্রতো কোন কাগজ়ে সই করেনি। এমনিতেই মেয়েটির বিয়ে হয় না পুলিশের নাম এরমধ্যে যুক্ত হলে বিয়ের সমস্যা আরো বাড়বে। একমাত্র উপায় মেয়েটির স্বাবলম্বী হওয়া। কিন্তু আমি কি করে অচেনা কাউকে সেটা বলতে পারি, তুমি এই জানোয়ারের কাছ থেকে পালাও, নিজে বাঁচো, পরিবারকে বাঁচাও। আবার ভাববে টাকা পয়সা দিবে না কিছু শুধু বড় বড় কথা। আমি ইমেইল প্রেরককে আমার মতামত জানাতেই সে তুরন্ত উত্তর দিল, আপা মাইনোরিটি কি করবেন, কন?
এ জায়গায় ধৈর্য রাখা মুশকিল। এটি একটি সামাজিক সমস্যা যেটা দক্ষিণ এশিয়াতে ক্যান্সার রূপে সমাজকে খাচ্ছে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে মারাত্মক রকমে এই রোগটি ছড়িয়ে আছে। উইপোকার মতো সমস্ত কাঠ খেয়ে নিচ্ছে। সর্বরকম মুখোশের আড়ালে আছে, সব শ্রেণীতে বিদ্যমান। কোথাও দুই লাখ টাকা রুপে, কোথাও আমেরিকা যাওয়ার গ্রীন কার্ড, কোথাও ব্যবসার অংশীদারিত্ব পাকা করা, কোথাও বা ফ্ল্যাট রূপ ধারণ করে। এর সাথে কেন ধর্মের কথা আসে? এ জায়গায় একজন সংখ্যাগুরুর পরিবারওতো সমান অসহায়। সংখ্যাগরিষ্ঠরা কি কন্যা দায়গ্রস্ত হন না? সৃষ্টির আদিকাল থেকে মেয়েরা শুধু মেয়েই। তাদের ধর্ম নেই, জাত নেই, সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু নেই। তারা পন্য। ইভ টিজিং কিংবা অন্যান্য অপমানে একজন রূমি, একজন শিউলি, একজন শাজনীন যখন মারা যান তখন ধর্মের তকমা কোন কাজেই আসে না। মেয়েরা এমন বস্তু যে তারা নিজ গৃহে থেকে বাবা ভাইয়ের সামনেও তাদের অসহায়ত্বের কারনে মারা যেতে পারেন, ধর্মকে পরিহাস করতে করতে।
যৌতুকের সমস্যা উপমহাদেশীয় সমস্যা, সামাজিক ব্যাধি যার সাথে “ধর্ম”কে যোগ করা বাতুলতা মাত্র। একজন মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খ্রীষ্টান পাত্র সমান পাষন্ড এ জায়গায়। অবস্থার সুযোগ নিতে কেউ পিছপা হয় না। আমি এই উত্তর দেয়ার পর আর কোন জবাব আসেনি। আমি জানি পছন্দ হওয়ার মতো কিছু হয়তো আমি বলিনি। কিন্তু আমার মনের সত্য থেকে আমি পিছু হটবো কেমন করে? এই ছেলেটি নিঃস্বার্থভাবে ঐ অসহায় পরিবারটিকে সাহায্য করতে নেমেছে, সেও ঠিক আছে। কিন্তু তার নিজের কাছে আগে নিজেকে পরিস্কার হতে হবে। সে কি একটি অসহায় পরিবারকে মানবিক কারনে সাহায্য করছে না একজন সংখ্যালঘু পরিবারকে করুণা করছে? সাহায্য আর করুণা আমার কাছে দুটো আলাদা ব্যাপার।
সুশীল সাজতে ইচ্ছে করে না। দু – পাঁচ হাজার টাকা সাহায্য দিয়ে মানসিক আনন্দ নিতে পারতাম কারো জন্য খুব বড় একটা কিছু করা হয়েছে এই ভেবে। আত্মপ্রসাদের ঢেকুর তুলে ঘুমাতেও যেতে পারতাম হয়তো। কিন্তু বার বার অদেখা অচেনা দুটো জল ভরা চোখ মনের ভিতটাকে দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি দূর থেকে বিনে পয়সার উপদেশ বিতরন করলাম ঠিক আছে কিন্তু মেয়েটার কি গতি হলো শেষ পর্যন্ত? ওর পরিবার কি সিদ্ধান্ত নিল? পারল এতো টাকার যোগাড় দিতে নাকি বিয়েটা ভেঙ্গে গেলো? মেয়েটা কিভাবে নিবে তার পরবর্তী জীবনটাকে। জানার কোন উপায় নেই কিন্তু অচেনা মেয়েটার কথা বড্ড জানতে ইচ্ছে করে।
তানবীরা
২৮.১২.০৯
তানবীরা
আমি নিজেকে কোনদিন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবিনি, মনের ভুলেও না। কখনো কখনো মনে হয়েছিলো যে আমার প্রয়োজন রয়েছে, এইমাত্র।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৮ comments
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ৩০ ডিসেম্বর ২০০৯ (৭:০৫ পূর্বাহ্ণ)
অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা প্রসঙ্গ আনলেন তানবীরা। যৌতুক আসলেই কী যে ভয়াবহ ক্ষত হয়ে আছে আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে। এর অবসান কবে যে হবে!
তানবীরা - ১ জানুয়ারি ২০১০ (৯:৪৪ অপরাহ্ণ)
সেটাই কবে হবে, কে জানে? কোনদিনও কি আসলে হবে? নাকি সময়ের সাথে সাথে শুধু “ফর্ম” পরিবর্তন হবে? কে জানে?
kheyalimon - ৩০ ডিসেম্বর ২০০৯ (৩:৫০ অপরাহ্ণ)
একটি চমৎকার বিষয় তুলে এনেছেন। আমাদের সমাজে শুধু মাত্র আইন করে এর র্নিমূল সম্ভব নয় । চাই গন সচেতনতা সেই সাথে প্রতিটি পরিবার থেকে এর জোড়ালো প্রতিবাদ করা উচিৎ।
তানবীরা - ১ জানুয়ারি ২০১০ (৯:৪৬ অপরাহ্ণ)
মেয়েরা যতোদিন নিজেরা বেঁকে না বসবেন, ততোদিন হয়তো পরিবর্তন আসবে না। আইন করে অধিকার দেয়া যায় না, অধিকার আদায় করে নিতে হয়।
রায়হান রশিদ - ১ জানুয়ারি ২০১০ (৯:৫৪ অপরাহ্ণ)
আদর্শিক কিংবা নীতিগুলো অবস্থানগুলো ব্যক্তিজীবনেও প্রয়োগ করা আসলেই বলা যতোটা সহজ করা ততোটা নয়। আমি মোটামুটি নিশ্চিত এই একই দ্বন্দ্বে এখানকার প্রত্যেকেরই কখনো না কখনো পড়তে হয়েছে। অনেক ধন্যবাদ তানবীরা আপনার পোস্টের জন্য।
তানবীরা - ৪ জানুয়ারি ২০১০ (১:২০ পূর্বাহ্ণ)
আসলেই তাই, বলা আর করায় অনেক তফাৎ। কাছের লোকেরাও তাতে ভুল বুঝেন। ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার জন্য
সৈকত আচার্য্য - ২ জানুয়ারি ২০১০ (৯:৩৯ অপরাহ্ণ)
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এই মেয়েদের অসহায় পিতারা আবার যখন তার ছেলেকে বিয়ে করান, তখন প্রতিটা দাবীকৃত যৌতুক পাই পাই করে বুঝে নিতে ছাড়েন না। কি রকম অবিশ্বাস্য দ্বৈত সত্ত্বায় আমাদের বসবাস, ভেবে দেখুন। এই স্ববিরোধিতার সংস্কৃতি এবং এরকম নির্লজ্জ বৈপীরত্য আমাদের সমাজের অনেক গভীরে, আমাদের মননে-মগজে এবং আমাদের অস্থি-মজ্জায় মিশে আছে।
ছোট বেলায়, গ্রামে এবং শহরে বিয়ের অনুষ্টানে দেখতাম, বরযাত্রী না আসার আগে স্থানীয় আমন্ত্রিতদের খাওয়ার টেবিলে বসানো হচ্ছে না। বরযাত্রীরা আসতো সবসময়ই দেরী করে। যেন দিক বিজয়ী আলেকজান্ডারকে সাথে নিয়ে এসেছেন, এই ভাব নিয়ে তারা মেয়ের বাড়িতে ঢুকতো। শুরুতে গিয়েই খাওয়ার টেবিলে হামলে পড়ার পর তাদের প্রথম নজরটা পড়তো পাশে সাজিয়ে রাখা যৌতুক গুলোর দিকে। তাচ্ছিল্যের ভংগী নিয়ে তাকানো ছিল, একটা স্বাভাবিক নিয়ম। পাশে কণে পক্ষের একজন বিশ্বস্ত লোক কোন আলমারী ঠিক কি কাঠের তৈরী, মেট্রেসখানা কি পরিমান দামী এবং টেকসই, ড্রেসিং টেবিলটার আয়না বেলজিয়ান কিনা এসব ছাইপাশ বুঝাতে বুঝাতে ঘর্মক্লান্ত হয়ে পড়তো। খাবার টেবিলে এত রকম পদ করতে হয় যে, তা বাহুল্যের ও বেশী কিছু।
নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের জীবনে মেয়ে পাত্রস্থ করার বিষয়টি প্রায়শঃই হয়ে উঠে দুঃস্বপ্নের মতো। এই দুঃস্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকার দায়টা নিঃসন্দেহে সমাজের এবং সমাজ মানসিকতার। এটা যেমন ঠিক, সাথে সাথে এই দায় খানিকটা সেই মেয়ের গার্ডিয়ানদেরও নিতে হবে যারা আবার ছেলে পক্ষ হয়ে ঠিক একই মানসিকতা ও সংস্কৃতি লালন করছে, যুগের পর যুগ।
তানবীরা - ৪ জানুয়ারি ২০১০ (১:২৪ পূর্বাহ্ণ)
সেটাই ও ছাড়বে না তাই আমি ছাড়বো নাতে আছি আমরা সকলে। কাউকে যে শুরু করতে হবে সেটা কেনো যেনো কেউ বুঝতেই চায় না। আমার ধারনা যতোদিন বিয়ের ব্যাপারটা বাবা মায়ের ওপর থাকবে ততোদিন এটা পরিবর্তন হবে না। যখন পশ্চিমী ঢঙ্গে ছেলে মেয়েরা নিজেরা পছন্দ ও নিজেদের খরচে বিয়ে করবে তখন হয়তো পন প্রথা আসলেই কমবে। নইলে কাজীর গরু খাতায়ই থাকবে গোয়ালে আর আসবে না। সৈকত আপনাকে ধন্যবাদ, আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য।