সাহিত্যচর্চায় ও প্রকাশনায় প্রতিভা ও সুরুচির স্বাক্ষর রেখেও শওকত ওসমান চৌধুরী যবনিকার আড়ালেই থেকে গেলেন আজীবন। [...]

রিমঝিম একটি কৈশোরক সংকলন; সম্পাদক ও প্রকাশক : শওকত ওসমান চৌধুরী, প্রকাশকাল : শ্রাবণ ১৩৭৭। সিগনেট প্রেস লি.-এ মুদ্রিত এই বর্ষাযাপিত সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯, শেরে বাঙলা ছাত্রাবাস, চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম থেকে। বৃষ্টিস্নাত শিউলিফুলে খচিত মনোরম প্রচ্ছদটি এঁকেছিলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী সবিহ্-উল আলম। মূল্য : পঞ্চাশ পয়সা। সে-সময়ের (১৯৭০) প্রেক্ষিতে এরকম রুচিশীল ও সুচিন্তিত সাহিত্যসংকলনের প্রকাশ অভিনন্দনযোগ্য, বলা যায়। সূচিপত্রে চোখ বোলালেই বোঝা যাবে, ষাট-সত্তরের দশকে বিকাশমান এমনকী প্রখ্যাত অনেকেরই রচনা পরম যত্নে ধারণ করে আছে প্রায় তিন ফর্মার এই সংকলন―চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হলেও এটি আঞ্চলিকতা বা গোষ্ঠীবদ্ধতার চর্চা করেনি; লেখকতালিকা দেখা যাক : নজরুল আব্বাস, দিলওয়ার, শেখ তোফাজ্জল হোসেন, সালেহ আহমদ, আলী ইমাম, শাহাদত হোসেন বুলবুল, মসউদ-উশ-শহীদ, মোসতাফা মহিউদ্দীন খসরু, খালেক বিন জয়েনউদ্দিন, মোরশেদ শফিউল হাসান, সিরাজুল উসলাম, প্রণত বড়ুয়া, বখতেয়ার হোসেন, আবদুল হাদী, শফিকুল ইসলাম, শামসুল করিম কয়েস, ইফতেখার হোসেন, ওয়াহিদুজ্জামান, মাহমুদ হক, রণজিৎ বরণ দেব, রোকেয়া খাতুন রুবী, শওকত ওসমান চৌধুরী, হাফিজউদ্দিন আহমদ, আলী আহসান কাজল, তানজিমা হক, মাসুদুজ্জামান। ভূজপুর ন্যাশনাল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন বাংলার শিক্ষক ও গবেষক চৌধুরী আহমদ ছফাকে (১৯৩০-২০০৮) একটি স্বাক্ষরিত রিমঝিম উপহার দিয়েছিলেন সম্পাদক শওকত ওসমান চৌধুরী। তিনি ছিলেন চৌধুরী আহমদ ছফার ছাত্র ও জ্ঞাতিসূত্রে ভ্রাতুষ্পুত্র। পরলোকগত মোহাম্মদ হোসেন চৌধুরী ও নুরনাহার বেগমের জ্যেষ্ঠ সন্তান শওকত ওসমান চৌধুরীর জন্ম চট্টগ্রামের ভূজপুর থানার আজিমপুর গ্রামে। চৌধুরী আহমদ ছফার মুখেই শুনেছি, ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র শওকত ওসমান চৌধুরী বাংলাদেশ ব্যাংক-এর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে উচ্চতর পদে কর্মরত ছিলেন, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত এবং ঢাকানিবাসী। ছাত্রাবস্থায় সাহিত্যচর্চায় যুক্ত থাকলেও পরবর্তীকালে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যান লেখালেখির জগৎ থেকে, অন্তত তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে দেখা যায় না কোথাও। নিজ গ্রামের সঙ্গেও বোধহয় তাঁর যোগাযোগ নেই দীর্ঘদিন ধরে। ভূজপুরেরই সন্তান অধ্যাপক রণজিৎ বরণ দেব ছিলেন শওকত ওসমান চৌধুরীর সহপাঠী; রিমঝিম-এ তাঁর একটি ছড়া তো আছেই, প্রকাশনা-সহযোগীদের মধ্যেও তিনি অন্যতম। আজিমপুর গ্রামের একটি দীর্ঘ সাহিত্যিক-ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। কালান্তরসাহিত্যে ফটিকছড়ির এক বিস্মৃত অধ্যায় (২০০১) গবেষণাগ্রন্থ ও বিষণ্ন বিকেল (২০০৬) কাব্যের স্রষ্টা চৌধুরী আহমদ ছফা ছাড়াও কবি ও জমিদার কাজী হাসমত আলী (জন্ম : ১৮৩২) বিদ্বৎসমাজে সুপ্রসিদ্ধ; তাঁর প্রকাশিত কাহিনিকাব্য চিনফগপুর সাহা (রচনাকাল : ১৮৫০) আবিষ্কার করেন…

শেখ ওঁদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বসালেন। এক এক করে পরিচয়ের পালা। সন্তোষদা বললেন, আমার বাড়ি ফরিদপুরের রাজবাড়ি। প্রবোধ সান্যাল বললেন, আমার বাড়ি ফরিদপুরে ছিল। নীরেন চক্রবর্তীও বললেন, আমার বাড়ি ছিল ফরিদপুর। শেখ বললেন, আমার বাড়ি কোথায় জানেন? বাংলাদেশে। [...]

১৯৭২ সাল। স্বাধীন দেশের প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ছাত্রলীগের আমন্ত্রণে ঢাকা এসেছেন কলকাতার সাহিত্যিক-সঙ্গীতশিল্পী-চলচ্চিত্রকার-সাংবাদিকগণ। এই সারস্বত পরিভ্রমণের একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়, মাসিক উল্টোরথ (বর্ষ ২১, সংখ্যা ১, চৈত্র, ১৮৯৪ শকাব্দ, মার্চ, ১৯৭২) পত্রিকায় ‘ঢাকার ডায়েরি’ (আখ্যাপত্রে অবশ্য ‘ঢাকা ডায়েরি’ মুদ্রিত) শিরোনামে। একই সংখ্যায় চলচ্চিত্রসাংবাদিক বিমল চক্রবর্তীও লিখেছেন ‘ঢাকা থেকে লিখছি’ নামে চিঠির আঙ্গিকে আরেকটি প্রতিবেদন; অসমাপ্ত এই প্রতিবেদনে স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের চলচ্চিত্রজগতের খানিকটা পরিচয় দিয়ে শেষাংশে তিনি লিখেছেন: বিকাশদা, আজ একুশে ফেব্রুয়ারী, মনের আবেগে কত কথাই তো এই চিঠিতে লিখে চলেছি। কলম আমার কিছুতেই থামতে চাইছে না। আজ আবার এই ঢাকায় বসেই স্বনামধন্য সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাও আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ধানমুণ্ডির বাসভবনে। সত্যজিৎবাবুর সঙ্গে আরো অনেকে এলেন। শহীদ দিবসে ঢাকার ছাত্রলীগ যাঁদের নিয়ন্ত্রিত [নিমন্ত্রিত?] করে এনেছিলেন তাঁরা প্রত্যেকে। নিয়ন্ত্রিতদের মধ্যে শুধু একজন ঢাকায় আসতে পারেন নি। তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। নির্ধারিত এই তারিখে কলকাতায় তার পারিবারিক কাজ ছিল বলে আসতে পারেন নি। আর সবাই এসেছেন। শ্যামল মিত্র, অমল মুখার্জী, সুমিত্রা মুখার্জী, বরুণ বক্সী ও আমাদের টুলু দাস। ওদের সঙ্গে করে নিয়ে এলেন ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক শেখ ফজলুল করিম সেলিম। সেলিম আবার বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে, এই তথ্য বঙ্গবন্ধুকে সেলিমের সম্বোধন থেকেই বুঝলাম―‘মামা, গান শুনবেন?’ শেখ সাহেবের সরল স্বীকারোক্তি, ‘কেন শুনব না? গানই যদি না শুনতে ইচ্ছে করে তবে তো আমি ইয়াহিয়া খান হয়ে যাব।’ একটুখানি হাসির গুঞ্জরণ। একে একে প্রত্যেকে একটি করে গান শোনালেন বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু সবার প্রশংসাতেই সমান পঞ্চমুখ। শ্যামল মিত্রকেই দেখলাম সবচেয়ে বেশী কথা বলতে। সত্যজিৎবাবু একরকম চুপচাপই ছিলেন। ফটোগ্রাফার টুলু দাস সত্যজিৎবাবুর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলাদা ছবি তুলতে চাইলেন। শেখসাহেব জবাব দিলেন, ‘আলাদা কেন, সবাই আসুন, গ্রুপ ছবি তুলি।’ তারপর চায়ের পালা। বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে সকলকে চা পরিবেশন করলেন। চায়ের আসরে ছাত্রলীগ সদস্য ও বাংলাদেশের নামী কণ্ঠশিল্পী অ্যাপেল মামুদ শেখসাহেবকে বললেন, ‘জানেন, পশ্চিম বাংলার এঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামের এই ন’মাস আমাদের জন্যে অনেক করেছেন।’ শেখসাহেব সোজাসুজি জবাব দিলেন, ‘আমি সব জানি। ওরা তোমাদের জন্যে যা করেছে সেই ঋণ তোমরা পিঠের চামড়া দিয়েও শোধ করতে পারবে না।’ শুনে অবাক হলাম। একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এই…

কুইনাইন-আবিষ্কারের তারিখ কারও মনে আছে কি? না থাকলেও ক্ষতি নেই কোনও, আজ ছাত্রহিতৈষী শিক্ষক কাজেম আলী মাস্টারের মৃত্যুদিবসে (১২ ফেব্রুয়ারি) অন্তত তাঁকে স্মরণ করা যাক একবার।

মোমেনের জবানবন্দী, মফিজন বা কোরবাণী-র মতো সংবেদনশীল গল্পের স্রষ্টা মাহবুব-উল আলম (১৮৯৮-১৯৮১) ইতিহাসমগ্ন ছিলেন আমৃত্যু। খণ্ডে-খণ্ডে তিনি যে-চট্টগ্রামের ইতিহাস (১৯৬৭) লিপিবদ্ধ করেছেন তার সপ্তম বা শেষ খণ্ডের ভূমিকায় বলেছেন : ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’-এর শেষ (সপ্তম) খণ্ডে ‘আমরা কতিপয় বিশিষ্ট পরিবার, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও আন্দোলন’-এর বিবরণ লিপিবদ্ধ করিতেছি। ইহার ফলে নিজেদের ইতিহাস জানিয়া লইয়া আত্ম-সম্বিৎ লাভে চট্টগ্রামবাসীদের সাহায্য হইবে, ইহাই আমাদের আশা। অধুনাবিলুপ্ত বইটির পৃষ্ঠাসজ্জা একটু অভিনব : ধারাবাহিকভাবে পৃষ্ঠাঙ্ক না দিয়ে প্রত্যেক অধ্যায়কে অ্যালবামের মতো সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে পরবর্তীকালে নতুন-নতুন তথ্য যুক্ত করে নিতে পারেন ইতিহাসসন্ধানীরা, যদিও লেখকের সে-ইচ্ছে অপূর্ণই থেকে গেছে আজও। চট্টগ্রামের অনেক প্রসিদ্ধ পরিবারের সতথ্য বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক প্রায় নিঃসঙ্গ পরিশ্রমে; তথ্যবিশ্লেষণে হয়তো-বা সর্বত্র ইতিহাসপদ্ধতি অনুসৃত হয়নি, এমনকী বিভ্রান্তিও থাকতে পারে কোথাও-কোথাও, কিন্তু লেখকের কলম যে কাঠখোট্টা ছিল না তা স্বীকার করতেই হয়। বইটির দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের নাম ‘শেখ-এ-চাট্‌গাম কাযেম আলী’। কাজেম আলী হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ শিক্ষাব্রতী কাজেম আলী (১৮৫২-১৯২৬) সম্পর্কে মাহবুব-উল আলম লিখছেন : কাযেম আলী কিরূপে তাঁহার স্কুলে একটা পারিবারিক আবহাওয়া বজায় রাখিতেন সে সম্বন্ধে ঐ স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ভূপেন্দ্র কুমার রক্ষিত বলেন : তিনি প্রতিদিন স্কুলে আসিতেন না। তখন ১৯১৭ সাল। একদিন হঠাৎ স্কুলে আসিলেন। সে দিন আমাদের ইংরেজী-শিক্ষক স্কুলে আসেন নাই। তিনি বলিলেন : পড়া আমিই নিব। আমরা ভয়ে তটস্থ হইয়া গেলাম। পড়া ছিল ‘আলেকজাণ্ডার য়্যাণ্ড দি রবার।’ তিনি আমাদের ইংরেজীতে প্রশ্ন করিলেন : ফিলিপ কে ছিলেন? আমি ফস্ করিয়া উত্তর দিলাম : কিং অব ইণ্ডিয়া। তিনি ধমক দিয়া আবৃত্তি করিলেন : অব্ ইণ্ডিয়া? আমি থতমত খাইয়া শুদ্ধ করিলাম : কিং অব ম্যাসেডন। তিনি খপ্ করিয়া আমার একখানি হাত ধরিয়া ফেলিলেন। অতঃপর গর্জন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন : প্রথমে ইণ্ডিয়া বলেছিলে কেন? কিন্তু ইতিমধ্যে তিনি অনুভব করিলেন, আমার হাত বেশ গরম। তখন বলিলেন : তুমিত ম্যালেরিয়ায় ভুগ্‌ছ মনে হচ্ছে। অতঃপর শার্ট তুলিয়া পেটে হাত দিয়া বলিলেন : এই যে পিলে বেশ বড় হয়েছে। অতঃপর এইরূপ কথোপকথন হইল : : তুমি কার ছেলে? : আমার বাবার নাম যোগেশ চন্দ্র রক্ষিৎ। : কি করেন? : কলেক্টরীর কর্মচারী। : তুমি ছুটির আগে লাইব্রেরীতে আমার সঙ্গে…

পরাধীনতার প্রতি স্কটিশদের অনুরাগ দেখে মনে এল বুদ্ধদেব বসুর ‘অনাম্নী অঙ্গনা’র কথা; রানি অম্বিকার পরিচারিকা অঙ্গনাও চেয়েছিল এক বিহ্বল অথচ আত্মস্থ পরাধীনতার সুখ। [...]

পরাধীনতার প্রতি স্কটিশদের অনুরাগ দেখে মনে এল বুদ্ধদেব বসুর ‘অনাম্নী অঙ্গনা’র কথা; রানি অম্বিকার পরিচারিকা অঙ্গনাও চেয়েছিল এক বিহ্বল অথচ আত্মস্থ পরাধীনতার সুখ। ঋষি ব্যাসদেবের সঙ্গে নাটকীয় রাত্রিযাপনের পর তার জীবনে বা মননে আসে পর্বান্তর, যদিও শুরুতে সে মুক্তিই কামনা করেছিল : আমি চাই আমার আপন ঘর, আপন কাজ, আমার নিজের তেঁতুলতলার ছায়া। ―কিন্তু আমরা উত্তম দাসী, তাই অর্ধেকমাত্র নারী। তার সখি বলছে : যাঁরা বলেন দাসত্বের মতো দুঃখ নেই, তাঁরা সত্যবাদী। অকালপ্রয়াত রাজা বিচিত্রবীর্যের পত্নী অম্বিকা; ইতিপূর্বে ব্যাসদেবেরই ঔরসে তাঁর গর্ভে এসেছিলেন ধৃতরাষ্ট্র, কিন্তু তিনি জন্মান্ধ―রাজপুত্র বিকলাঙ্গ হলে অধিকার থাকে না সিংহাসনে। তাই শাশুড়ি সত্যবতী পুনরায় আহ্বান করেছেন ব্যাসদেবকে আর প্ররোচিত করতে চাইছেন পুত্রবধূকে। বিধবা অম্বিকার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে নারীসত্তার অপমানে যত নয়, তার চেয়ে বেশি ‘সেই রুক্ষ জটাজুট―দুর্গন্ধ―রক্তিম, ঘূর্ণিত লোচন’ তপস্বীর শয্যাশায়িনী হওয়ার আশঙ্কায়; তিনি চান অন্তত একজন কন্দর্পকান্তি ‘পরিশীলিত পুরুষ’। সত্যবতীকে তখন খুলে বলতে হয় প্রথম যৌবনের বৃত্তান্ত : ছিলেন তিনি ধীবরকন্যা, শূদ্রাণী; একদিন যমুনা নদীতে ঋষি পরাশরকে নৌকোয় পার করিয়ে দিতে গিয়েই বদলে গেল তাঁর জীবনের চরাচর। মুনি কামমোহিত হয়ে প্রার্থনা করলেন মৎস্যগন্ধার তনুশ্রী। মুনির বরে সত্যবতী পেলেন পুত্র ব্যাসদেবকে যিনি বিদ্যায় জগৎশ্রেষ্ঠ। শাশুড়ির প্রণোদনায় অম্বিকা সম্মত হলেও আশ্রয় নিলেন ছলনার। দাসী অঙ্গনা শুধু সুশ্রীই নয়, বিনীতা ও সুভাষিণী; তাকেই প্রস্তাব দিলেন একরাত্রির রাজেন্দ্রাণী হওয়ার জন্য, তাঁরই ছদ্মবেশে। বিনিময়ে অঙ্গনা পাবে প্রার্থিত স্বাধীনতা আর সেই তন্তুজীবী যুবাকে যে তার জন্য অপেক্ষমাণ। কিন্তু দাসী হলেও অঙ্গনা লোভী নয়, বরং ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগে বলেই সে ফিরিয়ে দেয় প্রতারণার প্রস্তাব, সবিনয়ে ব্যঙ্গ করতেও ছাড়ে না সে। রানির মুখে নিজের ব্যাজস্তুতি শুনেও তাই সে বলতে পারে, ‘আমার বিষয়ে আপনার উচ্চ ধারণায় আমি কৃতার্থ!’ অম্বিকা তখন বলেন ‘শান্ত, ঈষৎ বিষণ্ন স্বরে’ : কোনো নিন্দার অর্থে কথাটা আমি বলিনি; বরং আমি নিজেই লজ্জিত আমার ভীরুতা আমার ধর্মাচরণের অন্তরায় হচ্ছে ব’লে। আর হয়তো এই ধারণাও ভুল যে শূদ্রজন্ম অধম। মহৎ কর্মে পাত্রভেদ নেই, যে-কোনো ইন্ধনে অগ্নিশিখা সমান উজ্জ্বল। সত্যবতী যেভাবে সম্মতি আদায় করেন অনিচ্ছুক অম্বিকার, তেমনি অম্বিকাও উদ্দীপিত করে তোলেন কুমারী অঙ্গনার মন। ব্যাসদেবের সঙ্গে অঙ্গনার মিলনের পর, সকালবেলায়, অম্বিকা বেশ আগ্রহ…

এবার ইদের কয়েকটি দিন কাটিয়ে দিয়েছিলাম ‘মণির পাহাড়’-এ। ‘সোভিয়েত দেশের নানা জাতির রূপকথা’র বই, ফুটপাতে পেয়েছিলাম ২০০৫ সালে। বহুবার পড়লেও বছর খানেক বিরতির পর হাতে তুলে নিতেই সম্পূর্ণ নতুন হয়ে উঠল গল্পগুলো, যেন এইমাত্র কেউ সূর্যের বোন ইলিয়ানা কসিনজ্যানা কিংবা বুদ্ধিমতী রাখালকন্যা আনাইতের নাম বলল আমাকে! [...]

এবার ইদের কয়েকটি দিন কাটিয়ে দিয়েছিলাম ‘মণির পাহাড়’-এ। ‘সোভিয়েত দেশের নানা জাতির রূপকথা’র বই, ফুটপাতে পেয়েছিলাম ২০০৫ সালে। বহুবার পড়লেও বছর খানেক বিরতির পর হাতে তুলে নিতেই সম্পূর্ণ নতুন হয়ে উঠল গল্পগুলো, যেন এইমাত্র কেউ সূর্যের বোন ইলিয়ানা কসিনজ্যানা কিংবা বুদ্ধিমতী রাখালকন্যা আনাইতের নাম বলল আমাকে! নির্ভীক শিকারি বরোল্দই-মের্গেন গহিন বনে তার শিশুপুত্রকে টোপ বানিয়ে কীভাবে নাগসংহার করে বাঁচিয়ে দিল অসহায় মানুষদের, সেই রোমাঞ্চকর কাহিনিও যেন শুনিনি আগে, বা মটর-গড়গড়ির চোখধাঁধানো বীরত্বের কথা। পড়তে পড়তে মনে হয়, আহা, যদি সিভ্‌কা-বুর্কার মতো আমারও থাকত একটা আশ্চর্য পঙ্খিরাজ, তাহলে এই যানজটের শহরে হঠাৎ চিৎকার করে ডেকে আনতাম তাকে : সিভ্‌কা-বুর্কা যাদুকা লেড়কা চেকনাই ঘোড়া সামনে এসে দাঁড়া চাষিপুত্র ইভান তো আমারই মতো আমড়াকাঠের ঢেঁকি যার একমাত্র কাজ ছিল চুল্লির উপরের তাকে বসে বসে ব্যাঙের ছাতা-সেদ্ধ খাওয়া, অথচ সে দিব্যি ঘোড়া হাঁকিয়ে শূন্যে বারো খুঁটি ছাড়িয়ে উঠে রাজকন্যার ঠোঁটে চুমু খেয়ে এল! আবার কী তার নিঃস্পৃহতা, মুহূর্তেই স্বয়ম্বরসভা ছেড়ে ঘোড়াকে বিদায় দিয়ে বাড়ি ফিরল ব্যাঙের ছাতা কুড়িয়ে কুড়িয়ে! নানা স্বাদের আটত্রিশটি রূপকথা, নানা জাতির। পাতায়-পাতায় আছে রঙিন ছবি, প্রত্যেক গল্পের আখ্যাপত্রে চমৎকার অঙ্কন তো আছেই। মস্কোর ‘রাদুগা’ প্রকাশন-এর এই বই বেরিয়েছিল ননী ভৌমিক ও সুপ্রিয়া ঘোষের অনুবাদে, অরুণ সোমের সম্পাদনায়। বাঙালি রসমেজাজ বইটি এত নিপুণভাবে ধরে রাখতে পেরেছে যে মনেই হয় না অনুবাদ; ‘সিভ্‌কা-বুর্কা’ গল্প থেকেই পড়া যাক : ইভান ঘোড়াটার গলা চাপড়ে দিয়ে তাকে লাগাম পরাল, তারপর তার ডান কান দিয়ে উঠে বাঁ কান দিয়ে বেরিয়ে এল। আর কী আশ্চর্য! অমনি সে হয়ে গেল এক সুন্দর তরুণ : কী তার রূপ, সে রূপ বলার নয়, কওয়ার নয়, কলম দিয়ে লেখার নয়। ঘোড়ার পিঠে চড়ে রাজার প্রাসাদের দিকে রওনা হল ইভান। ছুটল ঘোড়া কদমে, কাঁপল মাটি সঘনে, পেরিয়ে গিরি কান্তার, মস্ত সে কি ঝাঁপ তার। অথবা, ‘বুড়ো শীত আর জোয়ান শীত’ গল্পে : জমিদারের কাছে উড়ে গিয়ে পেছনে লাগলে শীত : গালিচার নিচে গিয়ে ঢোকে, আস্তিনের মধ্যে সেঁধোয়, কলারের মধ্যে ঢোকে, নাকে গিয়ে কনকনায়। জোয়ান শীত বড়াই করে তার বাপ বুড়ো শীতের কাছে : দেখেছ আমি কেমন, দেখেছ আমার তেজ! আমার কাছে তুমি…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.