১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। তখনও যুদ্ধ শেষ হয়নি -- আনুষ্ঠানিকভাবে পরাজয় স্বীকার করেনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এদিন সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, দ্রুত মুক্তিযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটনকারী যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিত করার জন্য গণহত্যা তদন্ত কমিশন গঠন করা হবে। হাইকোর্টে কর্মরত অথবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অথবা সমপর্যায়ের একজন ব্যক্তি এ কমিশনের নেতৃত্ব দেবেন। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে আরো জানানো হলো, পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দালালদের অপরাধের কারণে যাঁদের ক্ষতি হয়েছে, কমিশন তাঁদের লিখিত ও মৌখিক সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি রিপোর্ট পেশ করবে। তখনো আমাদের নীতিনির্ধারক মুক্তিযোদ্ধারা জানতেন না, তাঁরা মূলত আরো একটি যুদ্ধ শুরু করতে চলেছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের যুদ্ধ -- ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। যুদ্ধের অবসান ঘটেছে, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পরাজয় মেনে নিয়ে আমাদের হাঁটুর নিচে অবনত হয়ে অস্ত্রসমর্পণ করেছে। স্বাধীন দেশের আকাশে-বাতাসে গুমরে মরছে স্বজনহারানো ক্ষুব্ধ মানুষের কান্না। সারা বাংলাদেশ তখন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই কবিতার পরিপ্রেক্ষিত : ‘আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই/ স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের চিতা আমি তুলবই।’ বিক্ষুব্ধ স্বজনহারানো ও ক্ষতিগ্রস্ত এই মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে এদিন এক বিবৃতিতে গণহত্যা তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনের দাবি জানালেন ২৪ জন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, শিল্পীসহ বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাঁরা হলেন বেগম সুফিয়া কামাল, সৈয়দ আলী আহসান, জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ নূরুদ্দীন, কে. জি. মুস্তাফা, বদরুদ্দীন উমর, কবীর চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, নজমুল করিম, দরফিকুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সমর দাস, এবিএম মূসা, কামাল লোহানী, ফয়েজ আহ্মদ, জাহেদুর রহিম, সৈয়দ আতিকুল্লাহ, নূরজাহান বেগম, লায়লা সামাদ, আবদুল গণি হাজারী, গোলাম রসুল, আলী আশরাফ, মনিরুজ্জামান, সৈয়দ আসাদুজ্জামান, এম এ খতিব। ১৬ জানুয়ারি ১৯৭২। অন্তর্ঘাত চালানোর গোপন জিঘাংসা নিয়ে ততদিনে গা-ঢাকা দিয়েছে পাকবাহিনীর সমর্থক বাহিনীগুলোর সদস্যরা -- যারা রাজনৈতিকভাবে মূলত জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের নেতাকর্মী। মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা, রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে এদিন মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার পর প্রেসনোটের মাধ্যমে ঘোষণা করা হলো, আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটনকারী এসব অপরাধীকে অচিরেই বিচারের আওতায় আনা হবে। প্রেসনোটে বলা হলো, ‘দালাল বা এ ধরনের অপরাধীদের দেখা পেলে তাদের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রেখে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অসামরিক পুলিশকে নির্দেশ…
...এ যুদ্ধেও আমাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী- যেমন ছিল একাত্তরে। ১৪ ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা লিখেছিলেন তার উপন্যাস ‘রাইফেল রোটি আওরাত’-এর শেষ বাক্য, ‘মাভৈঃ, ভয় নেই, রাত কেটে যাবে।’ তারপরই তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল আলবদর বাহিনী- তিনি আর ফিরে আসেননি, কিন্তু রাত পেরিয়ে ভোর এসেছিল, পরাজিত হয়েছিল পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহায়তাকারীরা। এ যুদ্ধেও আমাদের অনেক-অনেকবার বিব্রত হতে হবে এ রকম অপপ্রচারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাত কাটবেই, ন্যায়বিচার পাওয়ার হাসিকান্নায় উদ্বেলিত মানুষদের প্রশান্তিময় নতুন ভোর আসবেই...