‘গোরস্তান’ ও আনুষঙ্গিক

কিবরিয়ার অবয়বী ছবির মধ্যে আমাকে বিশেষভাবে টানে ‘গোরস্তান’ নামের একটি ছবি, যার উল্লেখ ইদানীংকার আলোচনায় চোখে পড়ে না। [...]

মোহাম্মদ কিবরিয়া (১ জানুয়ারি ১৯২৯, বীরভূম — ৭ জুন ২০১১, ঢাকা)

মোহাম্মদ কিবরিয়ার ছাত্রজীবনের ছবির কথা জানা যায় তাঁর নিজেরই মৌখিক স্মৃতিচারণ থেকে। ১৯৪৫ থেকে ’৫০-এর মধ্যে আঁকা ছবিতে নব্য-বঙ্গীয় শৈলী ও অণুচিত্রের অনুপ্রেরণার কথা তিনি বলেছেন। কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে বেরোনোর পর তাঁকে বিশেষভাবে ভাবিয়েছিল যামিনী রায় — কেবল তাঁর লোকচিত্র-অনুপ্রাণিত স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত ছবি নয়, পশ্চিমের উত্তর-অন্তর্মুদ্রাবাদী ধারায় আঁকা কিছু নিসর্গচিত্রও। কিবরিয়ার সঙ্গে আলাপচারিতার সূত্রে ঘনিষ্ঠজনেরা এসব কথা জেনেছেন; কিন্তু সেই আদিপর্বের কোনো ছবির প্রতিলিপি কোথাও পুনর্মুদ্রিত হতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

১৯৫৯ সালে চিত্রকলা ও ছাপচিত্রে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের জন্য জাপানে যাবার আগে পর্যন্ত যে আট-নয় বছর কিবরিয়া ঢাকায় কাটিয়েছেন, প্রথমে নওয়াবপুর স্কুলে এবং পরে জয়নুল আবেদিনের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ীভাবে ও ১৯৫৪ থেকে পাকাপাকিভাবে ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউটের শিক্ষক হিসেবে, সেই কালপর্বটিকেই অগত্যা তাঁর শিল্পীজীবনের প্রথম পর্ব হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়। এই পর্বের বহুল-আলোচিত ‘জলকেলি’, ‘পূর্ণিমা’, ‘চন্দ্রাহত ঘোড়া’ ইত্যাদি তৈলচিত্রে ঘনবাদী চিত্রশৈলীকে নিজের মতো করে, তাঁর ভাষায় ‘খুব হালকাভাবে’, ব্যবহার করেছেন কিবরিয়া।

১৯৬২-তে উচ্চশিক্ষা সমাপন শেষে দেশে ফেরার আগেই তাঁর ছবিতে পর্বান্তর ঘটে গেছে। বিখ্যাত জাপানি শিল্পী হিদেয়ো হাগিওয়ারা-র (১৯১৩–২০০৭) কাছে ছাপচিত্রে নিবিড় ও নতুনতর পাঠ গ্রহণ, সে-দেশের প্রকৃতি ও বিশেষত উদ্যানসজ্জা এবং সেইসঙ্গে অন্যান্য দৃশ্য-ও-মননগত অভিজ্ঞতার অভিঘাত তাঁর শিল্পভাবনায় গভীরভাবে পড়েছে। এ সময়ে আঁকা তাঁর বিমূর্ত শৈলীর ছবিগুলো তার সাক্ষ্যবহ। পরবর্তী পাঁচ দশক জুড়ে তাঁর খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশে বিমূর্ত ছবির অন্যতম পথিকৃৎ এবং এ-ধারার সবচেয়ে নিরীক্ষাপ্রবণ ও সফল শিল্পী হিসেবে।

পরিণত পর্বে (বলা ভালো, পর্বসমূহে) কিবরিয়ার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা তাঁর পরবর্তী কয়েক প্রজন্মের শিল্পীদের অনেককে বিমূর্ত শৈলীতে কাজ করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, এবং তারই সূত্রে এমনটাও বলা হয়েছে যে, তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র শিল্পী যাঁর বেশ ক’জন অনুসারী আছেন। অনুসারীই কেবল নয়, নিঃসন্দেহে অনুকারকও তৈরি হয়েছে তাঁর। কিন্তু তাঁর কাজের সত্যিকার উত্তরাধিকার দু-একজন বাদে অন্যরা ধারণ করতে পেরেছেন বলে মনে করা যায় না, বিশেষত যখন দেখি আমাদের বিমূর্ত ধারার অধিকাংশ শিল্পীই মনোনিবেশ করেছেন ছবির বহিরঙ্গে, এর অন্তর্কাঠামো তাঁদের তত ভাবায়নি। কখনো-সখনো ‘কিবরিয়া স্কুল’-এর চকিত উল্লেখ পাওয়া গেলেও এ সম্পর্কে কোনো বিশ্লেষণী আলোচনা আমরা এখনো বোধহয় পাইনি।

কিবরিয়ার অবয়বী ছবির মধ্যে আমাকে বিশেষভাবে টানে ‘গোরস্তান’ নামের একটি ছবি, যার উল্লেখ ইদানীংকার আলোচনায় চোখে পড়ে না। প্রথম জাপানযাত্রার আগে আঁকা এই তৈলচিত্রের শাদাকালো প্রতিলিপি ছাপা হয়েছিল জালালউদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত কনটেম্পোরারি আর্টস ইন পাকিস্তান পত্রিকার প্রথম খণ্ড পঞ্চম সংখ্যায় (মে ১৯৬০) এবং তাঁরই লেখা আর্ট ইন পাকিস্তান গ্রন্থের দ্বিতীয় পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণে (১৯৬২, প্রথম সংস্করণ ১৯৫৪)। ১৯৬০-এর ৮ মে তারিখে করাচিতে শুরু-হওয়া পাকিস্তানের তৃতীয় জাতীয় শিল্পকলা প্রদর্শনীতে বিভিন্ন শিল্পীর যেসব ছবি দর্শক-সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল কিবরিয়ার ‘গোরস্তান’ তার অন্যতম। মার্কিন চিত্রকর শ্রীমতী এলেইন হ্যামিল্টন (১৯২০–২০১০) প্রথমোক্ত পত্রিকায় এই প্রদর্শনী নিয়ে পর্যালোচনায় ঢাকার শিল্পীদের কাজের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে লিখেছিলেন :

Mohd. Kibria’s Graveyard is one of the most interesting paintings in the group. Highly personal, the overall design elements of the circular disks and shapes keep two-dimensional space with myriads of tiny lights and bits of colour playing over the full surface of the painting. The figure somewhat seems out of place and rather dull in relation to the rest of the work.

মোহাম্মদ কিবরিয়া, 'গোরস্তান', তেলরং

গোরস্তানে জোড়া-কবরের পাশে নিঃসঙ্গ তরুণের অবয়ব চিত্রপটের সামগ্রিক কাঠামোর মধ্যে একটু বেখাপ্পা ঠেকেছে সমালোচকের দৃষ্টিতে। তবে আমার মনে হয়েছে, ছড়ানো-ছিটানো কবরগুলো ফেলে ছবির পুরোভূমির বামপ্রান্তে কবর দুটির পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা শাদাসিধে পোশাকের এই স্মৃতিভারাতুর দীর্ঘগ্রীব তরুণের সমগ্র শরীরে একাকিত্ব ও বিপন্নতার এবং পুরো ছবিতে মৃত্যুচেতনার যে আশ্চর্য অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে তার জুড়ি কিবরিয়ার অবয়বী ও নিরবয়ব ছবির মধ্যেও হয়তো-বা বিরল। শৈশবে পিতৃহারা ও তরুণবয়সে দেশান্তরী কিবরিয়ার ব্যক্তিগত জীবনস্মৃতিকেই কি উসকে দিয়েছিল ঢাকায় নিত্য-দেখা আজিমপুর গোরস্তান? কে জানে!

‘গোরস্তান’ নামের মূল ছবিটি এখন কোথায় সংরক্ষিত আছে আমি জানি না। অন্য অনেক সুপরিচিত ছবির হদিসও জানা নেই আমার মতো সাধারণ দর্শকদের। এমনকী তথ্যসন্ধানী গবেষকেরও জানবার উপায় নেই বিভিন্ন মাধ্যমে কিবরিয়ার ছবির সংখ্যা ঠিক কত। মৃত্যুর পর তাঁর ছবি নিয়ে এখন বহুকৌণিক আলোচনা হবে, গবেষণাও হবে; সেইসঙ্গে তাঁর একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্রপঞ্জি সংকলনের মাধ্যমেও নিবেদিত হতে পারে মোহাম্মদ কিবরিয়ার প্রতি উত্তরপ্রজন্মের শ্রদ্ধার্ঘ্য।

রেজাউল করিম সুমন

একজন সামান্য পাঠক।

৬ comments

  1. কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১৬ জুলাই ২০১১ (৭:০১ পূর্বাহ্ণ)

    শিল্পী কিবরিয়ার প্রতি যথার্থ সম্মানসূচক নিপুণ লেখা।
    সুমনকে শুভেচ্ছা।

  2. মাসুদ করিম - ১৬ জুলাই ২০১১ (১০:১১ পূর্বাহ্ণ)

    উত্তর-অন্তর্মুদ্রাবাদী ধারা

    ইউরোপীয় কোন ধারার বাংলা প্রতিশব্দ?

    ‘গোরস্তান’-এর সাদা কালো ছবি দেখে কিবরিয়ার সেই সময়ের রঙ-ভাবনার প্রবণতার দিক থেকে কি একটুও আঁচ করা সম্ভব কী রঙ ছিল ওই কবর দুটোয় ও তরুণের গায়ে? অথবা আদৌ ওই সময়ের কিবরিয়ার কোনো ছবির রঙিন ছাপাও কি কোথায় পাওয়া যায় আজ? আমার কাছে সমালোচকের ছবির তরুণটির অবয়বকে ‘ out of place’ লাগাটা পুরো ছবির ‘focus’কে অস্বীকার করার মতোই মনে হয়েছে — কিন্তু ‘dull’ লাগাটা যথার্থ মনে হয়েছে, এবং মনে হচ্ছে সমালোচকের প্রথমে ‘dull’ লাগাতেই তিনি ‘ out of place’ বলার মতো অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। ‘গোরস্তান’ ছবিটির মৃত্যু চেতনার প্রকাশকে (যদিও সাদা কালো ছবির জন্য আমরা দেখছি মৃত্যু চেতনার এক্স-রে) বাধাগ্রস্ত করছে ‘পটচিত্র’ ধর্মী ওই তরুণ ফিগার — তরুণের কাঁধটি বাস্তবানুগ হলে ওই ‘দীর্ঘগ্রীবা’ মৃত্যুর চেতনার প্রকাশে আরো আগ্রাসী হয়ে উঠত, এধরনের ছবিতে যামিনী রায়ের প্রভাব থাকা আমার কাছে ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়েছে।

    • রেজাউল করিম সুমন - ২১ জুলাই ২০১১ (৩:০৪ পূর্বাহ্ণ)


      উত্তর-অন্তর্মুদ্রাবাদ Post-Impressionism-এর বাংলা।


      কিবরিয়ার আঁকা ‘গোরস্তান’-এর সগোত্র দু-চারটি অবয়বী ছবির রঙিন প্রতিলিপি মুদ্রিত আছে তাঁকে নিয়ে শিল্পকলা একাডেমী থেকে ছাপা দ্বিভাষিক মনোগ্রাফটিতে কিংবা আধুনিক ঐতিহ্যের নয় শিল্পী-র মতো বইয়েও। ‘গোরস্তান’-এর রঙিন প্রতিলিপি দেখার সুযোগ আমার হয়নি। কালি ও কলম পত্রিকার সম্প্রতি-প্রকাশিত মোহাম্মদ কিবরিয়া সংখ্যায় (অষ্টম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা, শ্রাবণ ১৪১৮ : জুলাই ২০১১) এই ছবির যে-প্রতিলিপিটি ছাপা হয়েছে তা শাদাকালো নয়, সম্ভবত স্ক্যানিং বা মুদ্রণের গুণে এতে বর্ণাভা যুক্ত হয়েছে। (পোস্টে ব্যবহৃত ছবিটি এই সুযোগে পালটে দেয়া হলো।) মূল ছবির জোড়া-কবরে বা তরুণের অবয়বে কী রং ছিল কল্পনা করা মুশকিল, অন্তত আমার মতো অর্বাচীন দর্শকের পক্ষে। ছবিটি আপনাকেও ভাবিয়েছে জেনে ভালো লাগছে। ধন্যবাদ আপনার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও মতামত তুলে ধরার জন্য।

      বর্তমান রচনায় আমার বলবার কথা ছিল মূলত দুটি :
      (ক) কিবরিয়ার ‘গোরস্তান’ খুবই উল্লেখযোগ্য একটি ছবি, যার উল্লেখ ইদানীংকার আলোচনায় চোখে পড়ে না।
      (খ) শিল্পীর একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্রপঞ্জি তৈরি করা জরুরি।

      ‘গোরস্তান’ (বা ‘কবরস্থান’, ‘Graveyard’) ছবিটির প্রতি আমার বিশেষ পক্ষপাতের একটা ব্যক্তিগত মাত্রাও আছে — প্রথম-দেখাতেই এ ছবির সঙ্গে কোথায় যেন একটা যোগ তৈরি হয়ে গিয়েছিল গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানকে ঘিরে আমার বালকবয়সের গা-ছমছমে অভিজ্ঞতার।

      একটা অনুমানের কথা আগেই উল্লেখ করেছি :

      শৈশবে পিতৃহারা ও তরুণবয়সে দেশান্তরী কিবরিয়ার ব্যক্তিগত জীবনস্মৃতিকেই কি উসকে দিয়েছিল ঢাকায় নিত্য-দেখা আজিমপুর গোরস্তান? কে জানে!

      পূর্বোক্ত কিবরিয়া সংখ্যায় প্রকাশিত কয়েকজনের স্মৃতিচারণ থেকে এখন জানতে পারছি, পর পর কয়েকজন আত্মীয়ের মৃত্যু সে-সময়ে শিল্পীর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল।

      ‘আমার গুরু মোহাম্মদ কিবরিয়া’ লেখায় সমরজিৎ রায় চৌধুরী জানাচ্ছেন (পৃ ২৫) :

      সে-সময়ে প্রায়শই আবেদিন স্যার কিবরিয়া স্যারকে একাকিত্ব থেকে প্রফুল্ল রাখার জন্যে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন, গল্প করতেন এবং কখনো কখনো আমাকেও নিয়ে যেতেন। সে-সময়টায় তিনি পরপর অতি নিকটাত্মীয়ের বিয়োগব্যথায় ব্যথিত হয়েছেন। নীরবে তা বুক চেপে সহ্য করেছেন। আজীবন আত্মীয়-বিয়োগে কাতর হয়েছেন ঠিকই। তবে এর প্রকাশ ঘটেছে তাঁর চিত্রকলায়। চিত্রকলায় ধূসর কালো বা মলিন রং তাঁরই দুঃখের প্রতিধ্বনি।

      সৈয়দ শামসুল হকের ‘কিবরিয়া : মৃত্যুর নিপুণ শিল্প’ রচনায় শিল্পীর মৃত্যুবোধ প্রসঙ্গে আলোচনাক্রমে ‘গোরস্তান’ ছবির কথাও এসেছে, যদিও এর নামের উল্লেখ নেই (পৃ ৩৯) :

      নাতিদীর্ঘ দেহ, ছিপছিপে, প্রায় শীর্ণ, চলতে গেলে পা যেন ঈষৎ টলোমলো, যেন ক্ষীণ একটা বাতাস উঠলেও ভেঙে পড়বেন। ছবিটা খুব মনে পড়ছে। চোখ ভিজে আসছে। চোখ ভিজে আসছে তাঁর একটি কথা মনে করে — অকালমৃত্যুর জন্য তাঁর গোপন অপেক্ষাটি যেদিন তাঁর মুখে শুনে উঠি। মৃত্যুভয়ের বিচলন নয়, বিষণ্ণতা ফুটে থাকতো কিবরিয়ার চোখেমুখে। বলেছিলেন, মনে পড়ে, তাঁর পরিবারে প্রায় সবারই নাকি অকালে মৃত্যু হয়েছে; বছর চল্লিশে না পৌঁছুতেই তাঁদের যাওয়া হয়ে ওঠে। কিবরিয়া বলতেন, তিনিও তাঁর পূর্বগণের মতোই অকালে চলে যাবার জন্যে তৈরি!

      জানি না, এ ছিল কিনা তাঁর কল্পনা-বিলাস, অথবা সত্যি সত্যি বংশগতির ভিত্তিতে একটা অনুমানমাত্র। সে যা-ই হোক, বিলাস বা অনুমান — তাঁর কাজে ছায়া ফেলেছিল। মনে পড়ে পঞ্চাশের দশকেই একটা চিত্র-প্রদর্শনী হয়েছিল — কোথায় মনে পড়ে না — তবে, ঢাকাতেই — অনেকের সঙ্গে কিবরিয়ার আঁকা একটা ছবি ছিল। একটু লম্বাটে পটে আঁকা জ্যোৎস্নার আলোছায়ার ভেতরে বন, আর সেই বনে একটি কবর।

      পরে, সেইসময়ে তাঁর স্কেচ খাতাতেও দেখেছি কবরের ছবি, কালো কালিতে আঁকা, কখনো পেনসিলে; সমুখ থেকে পেছনের দিকে লম্বমান কবরের পর কবর। কয়েকবার জিগ্যেসও করেছি, আপনার মাথা থেকে কবরগুলো সরিয়ে ফেলছেন না কেন? প্রতিবারই বলতেন, সরালে ওরা আবার যে আসে! রবীন্দ্রনাথের পঙক্তি আমার মনে পড়ে — কিবরিয়াকে স্মরণ করিয়ে দিই —

      শিশুকাল থেকে বিজড়িত পদে পদে এই বিভীষিকা —
      দুঃখের পরিহাস ভরা।
      ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি –
      মৃত্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে।

      তখন কিবরিয়া সেই বিষণ্ণ হাসিটুকু ফুটিয়ে বলতেন, ভয় পাই? না, তা ঠিক নয়। — তবে আঁকেন কেন? — ভয়টাকে জয় করতেই। কিবরিয়া বলতেন, ছবিই হয়তো আমার বেঁচে থাকার উপায়।

      কাইয়ুম চৌধুরী ‘পরম সুহৃদ কিবরিয়া’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় ‘গোরস্তান’ (বা ‘কবরস্থান’/ ‘কবর’, ‘Graveyard’) ছবির তরুণটিকে স্বয়ং কিবরিয়া বলে উল্লেখ করেছেন (পৃ ১৭) :

      কিবরিয়ার আঁকা একটি ছবি আমাদেরও বিষাদগ্রস্ত করে তুলেছিল। ছবিটির নাম ছিল ‘কবর’। অনেকগুলো কবরের সামনে দাঁড়ানো পাজামা-পাঞ্জাবি পরনে নতমুখ কিবরিয়া স্বয়ং। প্রশ্ন রেখেছিলাম, কেন এত বিষাদগ্রস্ত থাকেন? বিষাদমাখা দুটো চোখ তুলে ধীরলয়ে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমাদের পরিবারে সবাই স্বল্পায়ু। প্রতি বছরই খবর পেতাম, কেউ না কেউ চলে গেছেন।’

      এই ছবি আঁকার অনেকদিন পরেও আজিমপুর গোরস্তানের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকা ছিল শিল্পীর খুবই পরিচিত একটি মুদ্রা। ১৯৬৬-৬৭ ও তৎপরবর্তী সময়ের স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে আবুল মনসুর ‘আমাদের কিবরিয়া স্যার’ রচনায় লিখেছেন (পৃ ৫৩) :

      আমাদের সঙ্গেই তিনি হোস্টেলের একই তলায় থাকতেন। তবে কাছের হয়েও সুদূরের এত স্বল্পভাষী মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। মাঝে মাঝে তিনি বিকেলবেলা চেয়ার টেনে হোস্টেলের টানা বারান্দায় এসে বসতেন। আমাদের হোস্টেলের সামনে তখন ধুধু খোলা জায়গা পেরিয়ে আজিমপুর গোরস্তান দেখা যেত। সেদিকে তাকিয়ে একাকী চুপ করে বসে থাকতেন। মাঝে মাঝে আমরা পাশে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে আলাপ জমাবার চেষ্টা করতাম। তাঁর কাছে এটা-ওটা জানতে চাইতাম। তিনি খুব সংক্ষেপে কিছু বলে চুপ হয়ে যেতেন, আলাপ জমত না।

      • ব্লাডি সিভিলিয়ান - ২৫ জুলাই ২০১১ (৩:২৫ অপরাহ্ণ)

        বাঃ, এগুলো তো মূল লেখায় যোগ করার খুব প্রয়োজন ছিলো। আমারো অবশ্য মনে হয়েছে (শিল্পান্ধ হয়েও) ওই যুবক বোধহয় ছবির মূল সুরের একটু ব্যতিক্রম-ই।

        কিউবিজমের বাংলা কি ঘনবাদ না ঘনকবাদ?

        • রেজাউল করিম সুমন - ২৫ জুলাই ২০১১ (৭:২৫ অপরাহ্ণ)

          ভাই সিভিলিয়ান,

          অনেক কাল পর দেখা মিলল আপনার! ঠিক, কিউবিজম-এর বাংলা হিসেবে ‘ঘনবাদ’ বা ‘ঘনকবাদ’ই প্রচলিত। সুকুমার রায় অবশ্য এর বাংলা করেছিলেন ‘চতুষ্কোণবাদ’, তাঁর ‘শিল্পে অত্যুক্তি’ প্রবন্ধে (প্রবাসী, আশ্বিন ১৩২১)। একই লেখায় ফিউচারিজম-এরও বাংলা আছে — ‘ভবিষ্যবাদ’। তাঁর ‘ভারতীয় চিত্রকলা’ প্রবন্ধে (প্রবাসী, অগ্রহায়ণ ১৩১৭) ‘Impressionist’ শিল্পীদের প্রসঙ্গে এসেছে, তবে শব্দটার বাংলা করা হয়নি। ইম্প্রেশনিজম-এর বাংলা হিসেবে ‘অন্তর্মুদ্রাবাদ’-এর উল্লেখ পেয়েছি বাংলা একাডেমীর ইংরেজি-বাংলা অভিধানে।

          আর এই লেখার মন্তব্যের ঘরে উদ্ধৃত বক্তব্য মূল লেখায় সংযোজন করতে না পারার কারণ এটিও বেরিয়েছিল কালি ও কলম-এর মোহাম্মদ কিবরিয়া সংখ্যায়। ওই লেখাগুলো পড়েছি এই পোস্ট প্রকাশিত হয়ে যাবার পরে।

  3. রাজীব নন্দী - ১ ডিসেম্বর ২০১১ (১:৫৪ অপরাহ্ণ)

    পড়া শুরু করলাম।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.