মোহাম্মদ কিবরিয়ার ছাত্রজীবনের ছবির কথা জানা যায় তাঁর নিজেরই মৌখিক স্মৃতিচারণ থেকে। ১৯৪৫ থেকে ’৫০-এর মধ্যে আঁকা ছবিতে নব্য-বঙ্গীয় শৈলী ও অণুচিত্রের অনুপ্রেরণার কথা তিনি বলেছেন। কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে বেরোনোর পর তাঁকে বিশেষভাবে ভাবিয়েছিল যামিনী রায় — কেবল তাঁর লোকচিত্র-অনুপ্রাণিত স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত ছবি নয়, পশ্চিমের উত্তর-অন্তর্মুদ্রাবাদী ধারায় আঁকা কিছু নিসর্গচিত্রও। কিবরিয়ার সঙ্গে আলাপচারিতার সূত্রে ঘনিষ্ঠজনেরা এসব কথা জেনেছেন; কিন্তু সেই আদিপর্বের কোনো ছবির প্রতিলিপি কোথাও পুনর্মুদ্রিত হতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
১৯৫৯ সালে চিত্রকলা ও ছাপচিত্রে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের জন্য জাপানে যাবার আগে পর্যন্ত যে আট-নয় বছর কিবরিয়া ঢাকায় কাটিয়েছেন, প্রথমে নওয়াবপুর স্কুলে এবং পরে জয়নুল আবেদিনের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ীভাবে ও ১৯৫৪ থেকে পাকাপাকিভাবে ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউটের শিক্ষক হিসেবে, সেই কালপর্বটিকেই অগত্যা তাঁর শিল্পীজীবনের প্রথম পর্ব হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়। এই পর্বের বহুল-আলোচিত ‘জলকেলি’, ‘পূর্ণিমা’, ‘চন্দ্রাহত ঘোড়া’ ইত্যাদি তৈলচিত্রে ঘনবাদী চিত্রশৈলীকে নিজের মতো করে, তাঁর ভাষায় ‘খুব হালকাভাবে’, ব্যবহার করেছেন কিবরিয়া।
১৯৬২-তে উচ্চশিক্ষা সমাপন শেষে দেশে ফেরার আগেই তাঁর ছবিতে পর্বান্তর ঘটে গেছে। বিখ্যাত জাপানি শিল্পী হিদেয়ো হাগিওয়ারা-র (১৯১৩–২০০৭) কাছে ছাপচিত্রে নিবিড় ও নতুনতর পাঠ গ্রহণ, সে-দেশের প্রকৃতি ও বিশেষত উদ্যানসজ্জা এবং সেইসঙ্গে অন্যান্য দৃশ্য-ও-মননগত অভিজ্ঞতার অভিঘাত তাঁর শিল্পভাবনায় গভীরভাবে পড়েছে। এ সময়ে আঁকা তাঁর বিমূর্ত শৈলীর ছবিগুলো তার সাক্ষ্যবহ। পরবর্তী পাঁচ দশক জুড়ে তাঁর খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশে বিমূর্ত ছবির অন্যতম পথিকৃৎ এবং এ-ধারার সবচেয়ে নিরীক্ষাপ্রবণ ও সফল শিল্পী হিসেবে।
পরিণত পর্বে (বলা ভালো, পর্বসমূহে) কিবরিয়ার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা তাঁর পরবর্তী কয়েক প্রজন্মের শিল্পীদের অনেককে বিমূর্ত শৈলীতে কাজ করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, এবং তারই সূত্রে এমনটাও বলা হয়েছে যে, তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র শিল্পী যাঁর বেশ ক’জন অনুসারী আছেন। অনুসারীই কেবল নয়, নিঃসন্দেহে অনুকারকও তৈরি হয়েছে তাঁর। কিন্তু তাঁর কাজের সত্যিকার উত্তরাধিকার দু-একজন বাদে অন্যরা ধারণ করতে পেরেছেন বলে মনে করা যায় না, বিশেষত যখন দেখি আমাদের বিমূর্ত ধারার অধিকাংশ শিল্পীই মনোনিবেশ করেছেন ছবির বহিরঙ্গে, এর অন্তর্কাঠামো তাঁদের তত ভাবায়নি। কখনো-সখনো ‘কিবরিয়া স্কুল’-এর চকিত উল্লেখ পাওয়া গেলেও এ সম্পর্কে কোনো বিশ্লেষণী আলোচনা আমরা এখনো বোধহয় পাইনি।
কিবরিয়ার অবয়বী ছবির মধ্যে আমাকে বিশেষভাবে টানে ‘গোরস্তান’ নামের একটি ছবি, যার উল্লেখ ইদানীংকার আলোচনায় চোখে পড়ে না। প্রথম জাপানযাত্রার আগে আঁকা এই তৈলচিত্রের শাদাকালো প্রতিলিপি ছাপা হয়েছিল জালালউদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত কনটেম্পোরারি আর্টস ইন পাকিস্তান পত্রিকার প্রথম খণ্ড পঞ্চম সংখ্যায় (মে ১৯৬০) এবং তাঁরই লেখা আর্ট ইন পাকিস্তান গ্রন্থের দ্বিতীয় পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণে (১৯৬২, প্রথম সংস্করণ ১৯৫৪)। ১৯৬০-এর ৮ মে তারিখে করাচিতে শুরু-হওয়া পাকিস্তানের তৃতীয় জাতীয় শিল্পকলা প্রদর্শনীতে বিভিন্ন শিল্পীর যেসব ছবি দর্শক-সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল কিবরিয়ার ‘গোরস্তান’ তার অন্যতম। মার্কিন চিত্রকর শ্রীমতী এলেইন হ্যামিল্টন (১৯২০–২০১০) প্রথমোক্ত পত্রিকায় এই প্রদর্শনী নিয়ে পর্যালোচনায় ঢাকার শিল্পীদের কাজের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে লিখেছিলেন :
Mohd. Kibria’s Graveyard is one of the most interesting paintings in the group. Highly personal, the overall design elements of the circular disks and shapes keep two-dimensional space with myriads of tiny lights and bits of colour playing over the full surface of the painting. The figure somewhat seems out of place and rather dull in relation to the rest of the work.
গোরস্তানে জোড়া-কবরের পাশে নিঃসঙ্গ তরুণের অবয়ব চিত্রপটের সামগ্রিক কাঠামোর মধ্যে একটু বেখাপ্পা ঠেকেছে সমালোচকের দৃষ্টিতে। তবে আমার মনে হয়েছে, ছড়ানো-ছিটানো কবরগুলো ফেলে ছবির পুরোভূমির বামপ্রান্তে কবর দুটির পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা শাদাসিধে পোশাকের এই স্মৃতিভারাতুর দীর্ঘগ্রীব তরুণের সমগ্র শরীরে একাকিত্ব ও বিপন্নতার এবং পুরো ছবিতে মৃত্যুচেতনার যে আশ্চর্য অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে তার জুড়ি কিবরিয়ার অবয়বী ও নিরবয়ব ছবির মধ্যেও হয়তো-বা বিরল। শৈশবে পিতৃহারা ও তরুণবয়সে দেশান্তরী কিবরিয়ার ব্যক্তিগত জীবনস্মৃতিকেই কি উসকে দিয়েছিল ঢাকায় নিত্য-দেখা আজিমপুর গোরস্তান? কে জানে!
‘গোরস্তান’ নামের মূল ছবিটি এখন কোথায় সংরক্ষিত আছে আমি জানি না। অন্য অনেক সুপরিচিত ছবির হদিসও জানা নেই আমার মতো সাধারণ দর্শকদের। এমনকী তথ্যসন্ধানী গবেষকেরও জানবার উপায় নেই বিভিন্ন মাধ্যমে কিবরিয়ার ছবির সংখ্যা ঠিক কত। মৃত্যুর পর তাঁর ছবি নিয়ে এখন বহুকৌণিক আলোচনা হবে, গবেষণাও হবে; সেইসঙ্গে তাঁর একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্রপঞ্জি সংকলনের মাধ্যমেও নিবেদিত হতে পারে মোহাম্মদ কিবরিয়ার প্রতি উত্তরপ্রজন্মের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
একজন সামান্য পাঠক।