এস. সুকদেবের নাইন মান্থস টু ফ্রিডম

s-sukhdev-small2ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৃশ্যরূপ-এর দ্বিতীয় সংকলনে (১৪১১-১৪১২) আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত ১২টি প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে শাহাদুজ্জামানের একটি লেখা ছিল — “অচিন দেশের ডকুমেন্টারি”। সে প্রবন্ধে পড়েছিলাম:

অধিকাংশ ডকুমেন্টারিতেই নানা মাত্রায় মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটা উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে খানিকটা বিস্তারিতভাবে করেছেন এস শুকদেব তাঁর নাইন মান্থস টু ফ্রিডম-এ। ধারা বিবরণী, পত্রিকা কাটিং, বিভিন্ন জনের বক্তৃতা, সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ১৯৪৭-এর ভারত-পাকিস্তানের ভাগের পর থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়টিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভেতরকার বৈষম্য এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আধিপত্যের আবহটি তুলে ধরেছেন তিনি। ভাষা আন্দোলন, আয়ুব খানের মার্শাল ল ঘোষণা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, সত্তরের নির্বাচন ইত্যাদি প্রসঙ্গ উঠে এসেছে ডকুমেন্টারিটিতে। বেশ কিছু দুর্লভ ইমেজের ফুটেজ রয়েছে ডকুমেন্টারিটিতে।

গত বছর ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির ২৯ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রদর্শিত হয়েছিল এস. সুকদেবের এই প্রামাণ্যচিত্রটি। এটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭২ সালে। আজ তিন যুগ পরের বিজয় দিবসে চট্টগ্রামে সম্ভবত প্রথমবারের মতো ছবিটি প্রদর্শিত হলো।

আজ সন্ধ্যায় শহরের চেরাগি পাহাড়ের মোড়ে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর চট্টগ্রাম জেলা সংসদের উদ্যোগে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও গণসংগীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে চেরাগি পাহাড়ের মোড়ের আড্ডারুদের উদ্যোগে প্রদর্শিত হয় নাইন মান্থস টু ফ্রিডম

আঙ্গিকের দিক থেকে এ ছবিতে খুব যে বৈচিত্র্য আছে তা নয়। অন্তত এদিক থেকে জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড-এর সঙ্গে হয়তো এটি তুলনীয়ও নয়। তবে সুকদেবের ছবিটিকে অমূল্য করে তুলেছে নানা দুর্লভ ঐতিহাসিক তথ্য ও ফুটেজের সন্নিবেশ। বইয়ে পড়েছিলাম — আঁদ্রে মালরো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। আজ নাইন মান্থস টু ফ্রিডম-এ ওই ফরাসি মনীষীর স্বকণ্ঠেই শুনলাম তাঁর ওই আন্তরিক অভিপ্রায়ের কথা, ওই আকুতি ফুটে উঠতে দেখলাম তাঁর দেহভঙ্গিতে! জহির রায়হানেরও একটি সাক্ষাৎকার আছে এই ছবিতে।

এস. সুকদেবের আর কোনো ছবি আমি দেখিনি। মাত্র ৪৫ বছর ৫ মাস বেঁচেছিলেন এই ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক। জন্ম ১ অক্টোবর ১৯৩৩, দেরাদুনে। মৃত্যু নয়া দিল্লিতে, ১৯৭৯-র ১ মার্চ। গোটা দশেক ছবি বানিয়েছিলেন। এর অধিকাংশই বোধহয় প্রামাণ্যচিত্র। প্রথম ছবি অ্যান্ড মাইলস টু গো মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৫ সালে, আর তাঁর সর্বশেষ ছবি সাহিরা মুক্তি পায় তাঁর মৃত্যুর পর, ১৯৮০ সালে। ওই ছবিটির অন্যতর পরিচালক সম্পূরণ সিং (জন্ম ১৮ আগস্ট ১৯৩৬), যাঁকে আমরা চিনি গুলজার নামে।

এস. সুকদেব নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মলাভের ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ করে দিয়েছেন স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মকে। আজ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

রেজাউল করিম সুমন

একজন সামান্য পাঠক।

৪ comments

  1. অবিশ্রুত - ২০ ডিসেম্বর ২০০৮ (১১:২৫ অপরাহ্ণ)

    আপনার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি সুকদেবকে।

  2. প্রবীর পাল - ২০ ডিসেম্বর ২০০৮ (১১:২৬ অপরাহ্ণ)

    অত্যন্ত দরকারী এ পোস্টটির জন্য সুমনকে ধন্যবাদ জানাই। আমাদের মহান মুক্তিসংগ্রামের অনেক বিদেশী অনুরাগী ও সহযোদ্ধাদের ভেতর সুকদেবও একজন। তাঁকে বাঙালি জাতি কখনোই ভুলবে না।

  3. আহমেদ মুনির - ২০ ডিসেম্বর ২০০৮ (১১:২৬ অপরাহ্ণ)

    খুব ভালো লাগলো । মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এযাবৎ খুব ভালো ছবি নির্মিত হয়েছে কি?

  4. ইমতিয়ার - ২৫ ডিসেম্বর ২০০৮ (২:৫৮ অপরাহ্ণ)

    দৃশ্যরূপ-এর দ্বিতীয় সংকলনে শাহাদুজ্জামান-এর লেখাটিতে যেসব ডকুমেন্টারি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সেগুলি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শাহাদুজ্জামানের জন্যেও কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল বোধকরি। পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে, হয়তো অচিরেই সত্যকে যারা সহজভাবে নেয়ার ক্ষমতা হারিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে এই অভিযোগ শুনতে হবে যে, শাহাদুজ্জামান শেখ মুজিব ও জয়বাংলা-র ওকালতি করছেন! এমন একটি ঝুঁকিকে অতিক্রম করে একাত্তরের সময়েই নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রগুলিকে অবলম্বন করে সত্যকে নতুন করে আমাদের সামনে নিয়ে আসার জন্যে শাহাদুজ্জামানেরও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রাপ্য।
    কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ দায়ে পড়ে অংশ নিয়েছ; গণহত্যা শুরু না হলে এরা নাকি স্বাধীনতার পথে পা বাড়াতো না! এইভাবে একটি জনপদের জনগোষ্ঠীর জাগরণকে খুব সহজভাবে নাকচ করে দিতে চান তারা। ইতিহাসের অনিবার্য প্রয়োজনেই আমাদের উচিত সুখদেবসহ বিভিন্ন ঝুঁকি নেয়া মানুষদের নির্মিত এসব ডকুমেন্টারি সবার জন্যে অবমুক্ত করে দেয়া, যাতে সবাই প্রকৃত চিত্রের কাছাকাছি যেতে পারে।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.