মীনার পাল্টা প্রশ্ন

মীনাকে নিয়ে লিখব ভাবছি। ওর নাম মীনা। আমার বাসার কাজের মেয়ে। হ্যাঁ, "কাজের মেয়ে" ! ক্ষমা করবেন। গতানুগতিক ও বিশ্রী শোনালেও আমি এর চেয়ে আর ভাল বর্ণনা খুঁজে পাচ্ছি না। সে বর্ণনার সাথে আমার শ্রেণী অবস্থান বেরিয়ে আসছে । তা বেরিয়ে আসুক, আমি তা রাখঢাক করবো না। [...]

              মীনাকে নিয়ে লিখব ভাবছি। মীনা আমার বাসার কাজের মেয়ে। হ্যাঁ, “কাজের মেয়ে” ! ক্ষমা করবেন। গতানুগতিক ও বিশ্রী শোনালেও আমি এর চেয়ে আর ভাল বর্ণনা খুঁজে পাচ্ছি না। সে বর্ণনার সাথে আমার শ্রেণী অবস্থাও হয়তবা বেরিয়ে আসছে । তা বেরিয়ে আসুক, আমি তা রাখঢাক করবো না। আমি বড় লোকের ছেলে, তবে নিজে বড় লোক না হয়ে হয়েছি শিক্ষক। দর্শন, গণিত, বিজ্ঞান, যুক্তি আরো যত হাবিজাবী; আর সে হাবিজাবীর নিরেট প্রতিফলন হচ্ছে আমার অনেক বই আর কাগজ পত্র। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন একটি পড়ার রুম, এবং সে সময় প্রথমবারের মত আমি একটি পড়ার রুম পেলাম। আমার একটি মাত্র মেয়ে — নয় দশ বছরের হবে — এবং দুর্ভাগ্য ক্রমে সে মেয়েটি অসুস্থ — ভয়ানক মস্তিষ্ক ব্যাধিতে সে ভুগছে। প্রয়োজনের তুলনায় আমার আয় অনেক কম; আমার স্ত্রীকেও চাকুরী করতে হয়। যুক্তিটি মনে হয় আর বিশদ করার প্রয়োজন নেই। আমাদের, মদ্দা কথা, একটি কাজের মেয়ে প্রয়োজন — একটি “মীনা”র প্রয়োজন।

              কাজের মেয়ে পাওয়া কিন্তু অত সহজ নয়। আম্মাকে যোগানের জন্য জানান দিলাম। আম্মা, সৌভাগ্যক্রমে, সেদিক দিয়ে ভালো যোগানকারী। তাঁর স্বফলতার চাবি হচ্ছে আব্দুল, আম্মার দারোয়ান। আর আব্দুল, সে আর এক চরিত্র: বর্ষি দিয়ে মাছ ধরার মত সে কাজের মেয়ে ধরে আনে। তার একটি পদ্ধতি হচ্ছে: বাড়ির গেইটের সামনে সে বসে থাকবে — হাঁটু ভেঙ্গে, দুই পায়ের পাতার উপর ভর করে; মুখে একটি চাপা দুষ্ট হাসি; পরনে লুঙ্গি, সাদা খাটো পান্জাবী, মাথায় টুপি; বয়সে সে পঞ্চাশোর্ধ। কোন ক্রমে গেইটের সামনে সে কোন গরীব বা ফকীর মেয়ে বা মহিলাকে দেখলে সে আস্তে করে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় : “কাম্ কোরবি নি ” ? অনেক সময়, হয়ত বেশীর ভাগ সময়, তার প্রশ্নের প্রতিক্রীয়া হয় একটি কটমটে চাহনি। আব্দুল তখন তার চাপা হাসিটি আর একটু খোলাসা করে, আরও মিষ্ট হতে চেষ্টা করে, নরম সুরে বলবে : “বাসাত্ কাম্ কোরবি নি”?   বাস!   আব্দুল কাজের মেয়ে পেয়ে যায়।

              মীনা নিশ্চয় আব্দুলের ধরা, তবে ঠিক কি ভাবে সে ধরা পরলো তা আমার জানা নেই। আম্মা আমাকে খবর দিল কাজের মেয়ে পাওয়া গেছে। বিকেল বেলায় আমি আম্মার বাসায় ছুটে গেলাম। মীনা’কে দেখলাম। এই লম্বা, বেশ কালো, কোঁকরান চুল, আর বডি-ফ্রেইমও ছোট নয়; নিঃসন্দেহে তাকে দিয়ে ম্যানিকিন বানানো যাবে। একটু পর আমার স্ত্রীও আসলো। মিনাকে তার ভালো লাগলো। তার ভালো লাগার একটি কারন হয়ত — মিনা অনেক লম্বা,তার থেকে তো বটেই।

              মীনা আমাকে ডাকে মামা, আর আমার স্ত্রীকে মামী। বয়স তার হয়ত ঊন্নিশ থেকে তেইশের ভিতর। সে বরিশাল থেকে। বেশ হাসতে পারে, সে সঙ্গে বকবকানি, আর একটু পাগলামো’তো আছেই। তার আগমনের পর আমার বাসার তেল আর পেঁয়াজের চাহিদা বেড়ে গেল। আমি বিরক্ত হতাম তার ঘন ঘন “মামা ফেঁয” শুনতে শুনতে। একদিন সে আমাকে ক্ষেপিয়ে দিল, এমন কি একটু ভয়’ও পেলাম। ঘটনাটি আমার পড়ার রুমে। “মামা, এই সব কিছু কি আপনি পড়েন” ? সমস্ত বই ও কাগজপত্রের দিকে নির্দেশ করে সে জিজ্ঞেস করলো। আমি কি উত্তর দিয়ে ছিলাম তা সঠিক মনে নেই। কিন্তু মিনার এর পরের প্রতিক্রিয়াটি আমার কাছে স্মরণীয়। “আচ্ছা মামা একটা মাশিশের কাঠি দিয়ে এ সবে আগুন লাগিয়ে দিলে কেমন হয়”? নিশ্চয় আমি খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম, তবে মনে হয় না আমার স্ত্রী থেকে কোন সমর্থন পেয়েছি বলে।

              একবার মীনা আমাকে তার গ্রামের পোস্টের ঠিকানা বলেছিল, সম্ভবত সে একটি চিঠি পাঠাতে চাচ্ছিল। ঠিকানাটি আর মনে নেই। খুব সম্ভব — এখন আবছা ভাবে যতটুকু মনে পরছে — তাদের বাড়ি নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যায় (কেন জানি “শহীদুল্লা” শব্দটা বার বার স্মরণে আসছে আমার)। সম্ভবত তার বাবা ছিল না, হয়ত ঢের আগে মারা গিয়েছিলেন বাবা। মা ছিল, আর একটি মামা ছিল। একটি বোনও ছিল মনে হয়। মা ভিক্ষা করতেন বা কোন সময়ে ভিক্ষা করেছিলেন। মামা মৌলভি, তাদেরকে পছন্দ করেন না, এবং পছন্দ না করার একটি কারন মীনার মা কেন ভিক্ষা করে। মিনা মামার উপর ক্ষিপ্ত। একদিন বাড়ি যাবে সে — মীনা স্বপ্ন দেখে। মামা’কে ধরবে সে।
        “মামাকে বলব: আপনারা যে গ্যানের কথা বলেন …”, শুরু হয় মীনার বকবকানি।
        “তোর মামা’তো কোরানের কথা বলে। তোর মামা হুজুর না?”, ওর বকবকানি আর শেষ করতে দিলাম না আমি।
        “তো কোরান মাইনচের গ্যান থেইক্ক্যা আইসে না।”, মীনা বল্ল।
        “তার মানে?”, আমার উৎসাহটা বেড়ে গেলো।
        “আল্লা কি কোরান ফাক্ মাইরা ফেলাইসে ?”, মীনা পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।

               মীনার পাল্টা প্রশ্নটি আমার এখনো কানে বাজে। তা অবশ্য ঠিক, প্রশ্ন ছিলনা, বরং ছিল একটি বিশ্বাস: কোরান আসমান থেকে ছুঁড়ে ফেলানো হয় নি, বরং তা মানুষের — মীনার ভাষায় — “গ্যান” থেকে আসা। এ বিশ্বাস একটি সাদা মাটা সাধারন বিশ্বাস, মীনার মত এক নিরক্ষর গরীব নারীর বিশ্বাস।

              মীনাকে বলতে ইচ্ছে করে মুসা নাকি এক পাহাড়ে গিয়ে যেহোভা থেকে দশটি আদেশ (Ten Commandments) পান এবং সে আদেশ যেহোভা পাথরের মধ্যে আগুন দিয়ে (কিংবা যেহোভা নিজেই আগুন হয়ে) খোদায় করে দেন। মীনাকে বলতে ইচ্ছে করে যে যীশুরূপী ঈশ্বর বা যীশুর ঈশ্বর নাকি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লোককে যীশু সম্পর্কে উদ্বুদ্ধির (inspiration) মাধ্যমে জানিয়ে দেয়। আর সে উদ্বুদ্ধির ফসল হচ্ছে বাইবেল। মীনাকে আরো বলতে ইচ্ছে করে যে মুহাম্মদ যিনি নাকি আল্লহর বার্তাবাহক (রাসুল) তিনি আল্লাহর আরেক বার্তাবাহক জিব্রাইলের (যাকে কেন জানি রাসুল বলা হয় না) মারফত আল্লাহ থেকে কিছু বার্তা পান, এবং সে বার্তায় কে কোরান বলা হয়।

              মীনার পাল্টা প্রশ্নকে প্রশ্ন হিসাবে দেখা যাক। তা হলে ইহুদী, খৃষ্টান আর মুসলিম হয়ে তাকে আমি যে সব উত্তর দিতে চেষ্টা করেছি সে গুলিতে সে কি “ফাক্” বা “ছুঁড়ে মারা” দেখবে, না “ফাঁক” দেখবে?

শাহীন ইসলাম

I am an atheist-theist; atheist because I don't believe in a popular God (who is a "who", a person, having all those anthropomorphic attributes); theist because I disagree with Nietzsche when he declares: "God is dead" (here, I assume that Nietzsche took "God" as metaphysics or objectivity). I would rather side with Gandhi when he declares : "I knew that God is true; now, I know that Truth is God". I am a realist with respect to natural sciences, since I believe that there are some real things beneath the natural phenomena. But I am an anti-realist with respect to social sciences. I don't believe that there are some pre-given primary entities like "nations", "communities" and so on; hence notions like "patriotism", "sovereignty" make little sense to me. I remember Lalon's singing: "lalon koy jater ki rup, dekhlam na ei nojore". Yes, like Lalon, I must admit: I don't know what a nation is - or, at least - I haven't found its essence.

২ comments

  1. অবিশ্রুত - ২৭ এপ্রিল ২০০৯ (১০:৫৫ অপরাহ্ণ)

    আমরা স্বীকার করি বা না করি, প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব দর্শন আছে। জীবন থেকে সে সেই দর্শন আত্মস্থ করে। আপনার এই কাজের মেয়ে মীনা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
    সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার, মানুষ গুরু দীক্ষা যার
    সে কারণেই আমরা বোধহয় জ্ঞানকেও ফিরে ফিরে পাই নব নব রূপে। নাকি বলেন?

  2. রায়হান রশিদ - ২৮ এপ্রিল ২০০৯ (২:১০ অপরাহ্ণ)

    “আচ্ছা মামা একটা মাশিশের কাঠি দিয়ে এ সবে আগুন লাগিয়ে দিলে কেমন হয়”?

    আইডিয়াটা মন্দ না। অন্তত প্রতীকী অর্থেও তো তা করাই যেতে পারে, যদি সবাই রাজী থাকেন। সুকান্তকে মনে পড়ছে।

    “তো কোরান মাইনচের গ্যান থেইক্ক্যা আইসে না।”, মীনা বল্ল।
    “তার মানে?”, আমার উৎসাহটা বেড়ে গেলো।
    “আল্লা কি কোরান ফাক্ মাইরা ফেলাইসে ?”, মীনা পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।

    খুব আগ্রহ হচ্ছে জানতে মীনার এই বোধ এর প্রকৃত উৎস কি। জানতে চেয়েছিলেন?

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.