[...] ব্যথার সীমা দিয়ে এইভাবে দেশও চেনা যায়, বাংলা নামের দেশ, বাংলাদেশ। এই এত্তটুকুন নাম, অর্ধশতকও হয়নি তার স্বাধীনতালাভের, এত্তটুকুন দেশ (ফুলবাতাসা-পালের নাও-তেঁতুলতলা-শাপলাপুকুরের দেশ), কিন্তু হাজার মাইল দূরের কত ছেলেমেয়েদের মনে চুপচাপ বসে থাকে এই দেশ। আওয়াজ করে না, নড়াচড়াও না, শুধু মাঝে মাঝে ভিতরে মুচড়ে দেয় ব্যথার সীমানা, আমরা বুঝতে পারি ঐ যে আমার দেশ, ঐ যে আমার দেশের ইতিহাস, ভয়াল গণহত্যার আর গণধর্ষণের এবং তারপর আবার উঠে দাঁড়ানোর। [...]

আমার ছোট্ট ছেলে জন্মাবার পর জীবনের একপর্যায় থেকে নিজের শরীরের নানান অংশ নিজেই টেনে ব্যথা পেয়ে চিৎকার দিত, এমন করে সে চিনেছিল নিজের শরীরের সীমা। কোথায় লাগলে নিজের শরীরে বাজে এমন করে। এইভাবে মানবশিশু হাতড়ে হাতড়ে ব্যথার সীমানা দিয়ে নিজের আকার আবিষ্কার করে সেটা দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম আমি।

ব্যথার সীমা দিয়ে এইভাবে দেশও চেনা যায়, বাংলা নামের দেশ, বাংলাদেশ। এই এত্তটুকুন নাম, অর্ধশতকও হয়নি তার স্বাধীনতালাভের, এত্তটুকুন দেশ (ফুলবাতাসা-পালের নাও-তেঁতুলতলা-শাপলাপুকুরের দেশ), কিন্তু হাজার মাইল দূরের কত ছেলেমেয়েদের মনে চুপচাপ বসে থাকে এই দেশ। আওয়াজ করে না, নড়াচড়াও না, শুধু মাঝে মাঝে ভিতরে মুচড়ে দেয় ব্যথার সীমানা, আমরা বুঝতে পারি ঐ যে আমার দেশ, ঐ যে আমার দেশের ইতিহাস, ভয়াল গণহত্যার আর গণধর্ষণের এবং তারপর আবার উঠে দাঁড়ানোর।

কমলা কালেকটিভের ‘বীরাঙ্গনা’ দেখতে গিয়েছিলাম, মরিয়মের গল্প, পরে খুশি-মায়া-মেহেরের গল্প, আরো পরে কালো পর্দা জুড়ে এক এক করে ফুটে ওঠা টকটকে লাল হরফে বীরাঙ্গনাদের নাম, বাহাতুন-জয়গুন-শামসুন্নাহার-রাজুবালা-গুরুদাসীদের নাম… সেই নামগুলোই বিধুর গল্প। আহা, পানির নিচে জোঁকের—জলজ ফুলের মৃণালের—মাছের ভাই ভাই হয়ে নাক ভাসিয়ে থাকা গর্ভিণী নারীর গল্প। শুকনো পুকুরে লুকাবার চেষ্টা করা নারীর গল্প। মায়ের গায়ে আগরবাতির মিষ্টি গন্ধ শোঁকা মেয়েশিশুর গল্প। তেঁতুলগাছে উঠে দুরন্তপনা করতে গিয়ে প্রেম আবিষ্কার করা কিশোরীর গল্প, মাথায় চালের বস্তা আর কাঁখে শিশুসন্তান নিয়ে ভারতে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করা নারীর গল্প। লোককাহিনীর রাজকন্যা কমলার শুষ্ক সরোবরে জল আনতে গিয়ে আত্মাহুতি দেবার গল্প।

Birangona-2

শো’র উদ্বোধন করতে গিয়ে স্বনামধন্য বৃটিশ-বাংলাদেশী নৃত্যশিল্পী আকরাম খান স্মরণ করেন মার্টিন লুথার কিং-এর অমোঘ বাণী — “দেয়ার কামস আ টাইম হোয়েন সাইলেন্স ইজ বিট্রেয়াল”, এর চেয়ে সংক্ষেপে বাঙালি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতাকে বোধহয় তুলে ধরা যায় না। বীরাঙ্গনারা ফিরে এসেছিলেন পাকবাহিনী ও তার দোসরদের পরিখা থেকে — ক্যাম্প থেকে, যেমন করে ফিরে এসেছিলেন যুদ্ধজয়ী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা। বীরাঙ্গনাদের কাউকে কাউকে তাঁদের পরিবার ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করেছিলেন — তাঁরা চলে গেছেন অজানার পথে—অচেনা গ্রামে—পতিতালয়ে, আর কাউকে কাউকে তাঁদের পরিবার গ্রহণ করেছিলেন একটিমাত্র শর্তে, সে শর্তের নাম নৈঃশব্দ্য। জন্মান্ধ যেমন আমৃত্যু অন্ধকার এক পৃথিবীতে সাঁতরে ফেরে, বীরাঙ্গনাদের অনেকে তেমনি এক অন্ধকার নৈঃশব্দ্যে সাঁতরে ফিরেছেন, তাঁদের মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁদের এই নিঃশব্দ শোকগাথা ফুরিয়ে যাবে। কোনো শিলালিপিতে লেখা থাকবে না, কোনো প্যাপিরাসে আঁকা থাকবে না, কোনো গণ-অধিবেশনে তাঁদের জন্যে নীরবতা পালিত হবে না, কোনো জীবতকালীন বা মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা তাঁদের জন্যে অপেক্ষায় থাকবে না।‘ধর্ষিত হওয়া গুরু অপরাধ, ধর্ষিত হয়েছি বলা গুরুতর অপরাধ’ এমন একটি অমানবিক মূল্যবোধ(!)কে জীবদ্দশায় স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় লালন করে একদিন তাঁরা প্রাকৃতিক মৃত্যুদণ্ডাদেশ বরণ করবেন।

এ গল্পের শুরু ট্রাকের কনভয়ের দৃশ্য দিয়ে, যে ট্রাকগুলি বোঝাই হয়ে আছে কোরবানির গরুর মতন মার্কা দেয়া ধর্ষিত নারীতে। গল্পের ভিতরে গান। শোলক। ছেলেভুলানিয়া কবিতা। ধর্ষিত নারীশিশুর চিৎকার। পালাতে না পেরে বস্তা বোঝাই চাল ছইছত্রাকার করে ফেলা নারীর লুণ্ঠন। আর মাঝে মাঝে এ যে সত্যিকারের জীবনের গল্প (যে জীবনে এমন অসম্ভব দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা সম্ভব, যে জীবনে সে অভিজ্ঞতার পর ফিরে আসা এমন বেদনাদায়কভাবে অসম্ভব) সেটা বোঝাতেই যেন জুড়ে দেয়া হয়েছে সত্যিকারের বীরাঙ্গনাদের সাক্ষাৎকারের ছেঁড়া ছেঁড়া অংশ, তাঁদের অতুল বিমর্ষ মুখ, সুদূর চোখ, চোখের সামনে সন্তানহত্যা দেখবার স্মৃতি, পরিবারের সকল সদস্যের সামনে ধর্ষিত হবার অকল্পনীয় অভিজ্ঞতা, গ্লানিকর সামাজিক লাঞ্ছনা(পরম্পরাক্রমে), ‘পাকমিলিটারির বউ’ নামে নিগৃহীত হবার যন্ত্রণা, আবার একটুখানি হাসিমাখা মুখের গান, ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ।

‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটি এঁদের দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হবার মাত্র ছ’দিনের মাথায়, ২২শে ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ, বাংলাদেশ সরকারের দ্বারা। এই নাম দেয়া, পুনর্বাসনের চেষ্টা, চিকিৎসাসেবা, মানসিক চিকিৎসাদান ইত্যাদি অনেক ক্ষুদে ক্ষুদে চেষ্টা ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত এই রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের চেয়ে অনেক সর্বব্যাপী যে সমাজ, যার পুঞ্জাক্ষি সর্বদিকে, সে সমাজের হাতে এই বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের এবং পুনরধিষ্ঠানের চেষ্টা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। সামাজিক নিগ্রহ তাঁদের তাড়া করেছে, তাঁদের সন্তান এবং সন্তানের সন্তানদেরও তাড়া করে ফিরছে, স্কুলে তাঁদের নাতিনাতনিদের অবজ্ঞা করে ডাকা হয় ‘বীরাঙ্গনার নাতিন’। তাঁরা জানেন মৃত্যুর পর তাঁদের মাটি দেবে বা শবদেহের সদ্গতি করবে শুধু তাঁদের আত্মীয়স্বজনরা। বীরাঙ্গনা শব্দটি কেবল ধর্ষণ এবং গণধর্ষণের সিনোনীম হয়ে রয়ে গেছে, এমন ভয়াল অভিজ্ঞতার পর উঠে দাঁড়ানো এবং আবার পৃথিবীর পথে হেঁটে বেড়ানোর নাম হয়নি। (হয়তো এ কারণেই একরকম হেলা মাখা, বিষন্ন মুখে লীসা শো-এর প্রথমাংশেই দর্শককে জানিয়ে দেন, বীরাঙ্গনা মানে ‘ব্রেভ উওম্যান’, শুধু নাম, শুধু উপাধি)। যেন বীরাঙ্গনা একটি আলাদা ট্রাইব, সে যেন আগে পরে আর কেউ ছিল না, মা নয়—স্ত্রী নয়—প্রেমিকা নয়—সন্তান নয়, যেন একটি অসম্ভব বেদনাদায়ক ও বিয়োগান্ত পরিচ্ছেদে মূকাভিনয় করা ছাড়া বীরাঙ্গনাদের আর কোনো ভূমিকা নেই। অথচ বারবার লীসা ভূলুণ্ঠিত হবার সময় দারুণ ভয়ে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়ার সময় মনে পড়ে যায় — এভাবে তো ভয়ের সময় আমিও পড়তাম, পরীক্ষার আগে, আমার মাও পড়তেন, আমাদের অসুখ করলে, নানীও পড়তেন কালবৈশাখীর সময়, বিপদের সময় সর্ব-অমঙ্গলহরকে এইভাবে কে না ডাকি! এই মেয়েরা তো আমাদের চিরপরিচিতা।

নাটকটির শেষাংশে নামভূমিকায় মরিয়ম (লীসা গাজী) শোনায় — সে ধর্ষিত হবার সময় ধর্ষক পাকিস্তানি মিলিটারির ভিতরে আসন্ন পরাজয়ের ভয় টের পায়, সামান্য শব্দে নাক স্ফূরিত হতে দেখে তাদের। উন্মাদিনীর হাসি হাসে মরিয়ম। এরপর একসময় তার হাত উঠে আসে আকাশে, সর্বশক্তি দিয়ে বলে ‘জয় বাংলা’, বাঙালির ওয়ার-ক্রাই, তার শক্তির ঐক্যের অমিত আস্ফালন, আবার বলে ‘জয় বাংলা’, তৃতীয়বার বলবার সময় তার হাত স্খলিত হয়ে আসে, ভেঙে আসে গলা। তখনি যেন জনান্তিকে কেউ তাকে জানিয়ে রেখেছে এই জয়ের, এই বিজয়োন্মাদনার ভাগ তাকে কেউ দেবে না। সে কখনো সেই ‘গ্লোরি’র সেই জয়ের অংশীদার হবে না, সে রেশমীসুতার কাজের অপর পিঠ, আছে কিন্তু নেই, তার জন্যে আড়ালের কদর্যতা, অকথ্য অবিচার।

Birangona-1

যিনি বা যাঁরা এই প্রডাকশনের মূল ভাষা হিসেবে ইংরেজি বেছে নিয়েছেন (এমনকি বীরাঙ্গনাদের জবানিতেও ইংরেজি সাবটাইটেল দেয়া আছে), তাঁদের শুভবুদ্ধি ও দূরদর্শিতাকে স্বাগত জানাই। এই শোকগাথা আন্তর্জাতিক দর্শকশ্রোতার কাছে পৌঁছবার জন্যে এই উদ্যোগ জরুরী ছিল। জরুরী ছিল শুরুতেই একেবারে ভেঙে একথা বলে দেয়া যে, বীরাঙ্গনা মানে ‘ব্রেভ উওম্যান’, সাহসী নারী, এঁরা সেটা করেছেন। আমাদের মনে রাখতেই হবে, যে নীরবতার অভিশাপ আমরা কুড়িয়েছি, তা মোচন করবার জন্যে এইভাবে বহুকিছু ভেঙে বলতে হবে আমাদের। বীরাঙ্গনা উপাধিটির সাথে জড়িত স্টিগমা ভাঙবার জন্যে আমাদের গোড়া থেকেই বলে দিতে হবে ২০০,০০০ থেকে ৪০০,০০০ বাংলাদেশী নারীদের উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরদের দুর্বিষহ অত্যাচারের মূল গল্প, এখানে ধোঁয়াশা চলবে না। এই শো সেই ধোঁয়াশা রাখেনি। নির্বিকার ইতিহাসকথনের চেষ্টা ছিল প্রবল।

এতদিন বীরাঙ্গনারা ছিলেন নথিপত্রের বিষয়, গবেষণার বিষয়, ইউটিউবে পাওয়া যাওয়া কিছু ফুটেজে স্তব্ধ কিছু মুখ যার সব কথা অন্যে বলে দিচ্ছে — এইবার বীরাঙ্গনারা ‘দুনিয়ার সবতেরে নিয়া দেখাও’ বলে কথা বলেছেন, রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে, আনন্দ-ক্ষোভ-আলিঙ্গন-করতালির মানুষ হিসেবে। সকল ট্যাবু ভেঙে এঁরা নিজেদের মুখ দেখিয়েছেন, দেখিয়েছেন এঁদের যন্ত্রণাদগ্ধ প্রাণ। এই দেখা দেওয়া এবং দেখা পাওয়াটা ভীষণ জরুরী ছিল, কাগজের পরিসংখ্যান নন এঁরা, এঁরা অদ্যাবধি জীবিত মানুষ।

নাটকের সাথে কোলাজ হিসেবে যেসব উপাদান এসেছে, (যেমন অ্যানিমেশনে মিথলজি, বীরাঙ্গনাদের ভিডিও ফুটেজ) সেগুলি অত্যন্ত সক্ষমভাবে স্ক্রিপ্টের কোনো কোনো শ্লথ জায়গাকে টানটান করে দিয়েছে, দুঃখের গাথা ব্যক্তিগত জীবনে যত সুদীর্ঘ, নাটকে সেটি এলে তা অতিনাটকীয় হয়ে ওঠে খুব দ্রুত। ফিজিক্যাল থিয়েটারের কাজ লীসার পুরোটাই বারবার নিংড়ে নিয়েছে বোঝা যায়।

নাটকটি দেখতে দেখতে একপর্যায়ে বছর আটেক আগে আমার দেখা ‘উইমেন অফ ট্রয়’-এর একটি অ্যাডাপ্টেশনের কথা মনে পড়ে গেল, হেকুবা-অ্যান্ড্রোমেকি সহ ট্রয়ের নারীরা সর্বনাশা এক পরিসমাপ্তির জন্যে অপেক্ষারত। বিষয়বস্তুর সামান্য মিলের জায়গাটিতে এসে নাটকটার কথা মনে পড়ে গেল, ফিজিক্যাল থিয়েটারের কিছু অসামান্য নমুনা আমি দেখেছিলাম সেখানে, কল্পিত দাঁড় টেনে টেনে জাহাজী সেনাদের আগমণ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, লুঠতরাজ। আমার মনে হয়েছে, এই শোতে ছায়া উপাদান হিসেবে যদি আরো কিছু মানুষ আসতেন এবং তাঁদের শারীরভঙ্গিমা নানা দৃশ্য এবং ক্রিয়া তৈরি করতো, সেটা আরো নাড়িয়ে দিতে পারতো। (আমদর্শক হিসেবে এ মন্তব্যকে ঝেড়ে ফেলা যেতে পারে।)

শেষে এসে সুচিত্রা মিত্রের সবল উদ্দীপনাময় ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ শুনে রক্ত নেচে ওঠে। সত্যি তো, আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলো রে।

লন্ডন ইস্ট, ইউ কে
২৩/০৩/২০১৪

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

4 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
4
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.