ক’দিন আগে ঘুম থেকে উঠেই দুঃসংবাদ। কবি জসীম উদ্দীনের বাগান আর নেই, সেখানে পাইলিং চলছে, ৭২ খানা অ্যাপার্টমেন্ট উঠবে সেখানে। আমার খালাতো বোন দুঃখ করে লিখেছে আর কোনো বৈশাখের ঝড়ের দিনে বস্তা ভরে ছেলেপুলেরা হৈ হৈ করে কাঁচা আম ভরে নিয়ে যাবে না, আর কোনোদিন টিয়ার ঝাঁক এসে ঠুকরে খাবে না পাকা কামরাঙা, শালিকের ঝগড়া শুনে কানে তালা লাগবে না।
এই বাগানের সাথে আমাদের সম্বন্ধ বহুদিনের। তখন আমার মেজখালা বিয়ে হয়ে মুখোমুখি বাড়িতে এসে উঠেছেন, সে বাড়ির কয়েকখানা কামরা ভর্তি বাঁধাইয়ের অপেক্ষারত ছাপা বই, মেঝে থেকে ছাদ অব্দি। সাহিত্যিক আকবর হোসেনের বাড়ি, সে বাড়িতে একদা সাহিত্য মজলিশ হতো, সে সভায় আসতেন জসীম উদ্দীন, আসতেন ফররুখ আহমদ। বাড়ির সামনে কয়েকটা আমগাছ, একটা সুবিশাল ব্যাসের গোল বারান্দা, সে বারান্দায় তেলের শিরচিহ্ন দেয়া আরামকেদারা। বাড়ির মেঝেগুলি সেকালের পেটেন্ট স্টোনের, অদ্ভুত মেদুর সবুজ তার রঙ। তেতলার ছাদে ফুটছে গরমকালের ফুল। রাত জেগে বিকম পরীক্ষার্থী মামারা পড়া মুখস্ত করছে আর শেষরাতে টয়লেটে যাবার সময় চোর ধরতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে পা ভেঙে ফেলছে, পরীক্ষা আর দেয়া হচ্ছে না। শীতকালের সন্ধ্যাবেলা বিজলিবাতির আলো জ্বালিয়ে খেলা হচ্ছে ব্যাডমিন্টন নয় ক্যারম। চাচা-ভাতিজা, মামা-ভাগনে মিলে ধুন্ধুমার ঝগড়া চলছে হারজিত নিয়ে। এ বারান্দা থেকে ঐ বারান্দায় চলছে মন দেয়া-নেয়া, তারই রেশ ঘুড়ি উড়ানো বিকালে, তারই সাগা চলছে মহররমের রুটি-হালুয়া বিতরণের মিষ্টি বেলায়।
দশ ভাইবোনের সেই সরগরম বাড়ির সামনেটায় জসীম উদ্দীনের বাগান, দিনমানেও অন্ধকার হয়ে থাকত। ভাতশালিকের চিৎকারে কানে তালা লেগে যেত সন্ধ্যাবেলা। দুপুরবেলা ছিল শুনসান। তখন ভেড়ামারার চাচীর লালচে ঝোলে টুপ্পুস হয়ে ফুলে ওঠা ভাজা ডিম দিয়ে ভাত খেয়ে আমরা সেই সবুজ মেঝেয় গড়াগড়ি দিয়ে ভাতঘুম দেয়ার চেষ্টা করতাম। গোল বারান্দার পাশের ঘরগুলি কী যে শীতল হয়ে থাকত, যেন স্বতঃবাষ্পীভবনক্ষম কলসের তলায় এসে শয্যা পেতেছি। (জলের ধারে শুলেম এসে শ্যামল তৃণাসনে), হাতে মাঝে মাঝে ঐ ঘরের বই থাকত, ‘কি পাইনি’, অথবা নিজের সংগ্রহের বিমল কর ‘বালিকা-বধূ’ — আপডাউন ট্রেনের শব্দ, চাঁদের আলোয় চিকচিকে রেল চলে যাওয়া, ডেঁপো বোনজামাইয়ের কাছ থেকে লব্ধ চুম্বনজ্ঞান, পেপারমিন্টের দানা — কি যে সুন্দর সে উপন্যাস। আমার একখানা টিডিকে ক্যাসেটে ছিল হিন্দিতে চিত্রায়িত ‘বালিকা-বধূ’র গান, “বড়ে আচ্ছে লাগতে হ্যায়, ইয়ে ধরতি ইয়ে নদীয়া ইয়ে র্যায়না অওর…অওর তুম!” এইসব কিছুর চালচিত্রে আছে তেল দিয়ে চুল আঁচড়ানো কাঁচুলি খুলে রাখা শালিকের সশব্দ প্রতিবেদন, কবির বাগানের।কোনটার নাম ভাতশালিক-ধানশালিক-গাঙশালিক-খয়েরি শালিক, ”কিয়ের এইসবই হইলো গিয়া গুইয়া-শালিক!” মামারা বলতো নাক কুঁচকে।
‘নুরু পুশি আয়েশা শফি সবাই এসেছে/ আমবাগিচার তলায় যেন তারা হেসেছে’র সেই আমবাগিচা, দাঁড়কাকের বাসা, ঝড়ের বাতাসের লুটোপুটি, জলকচু আর গাছ-আলুর লতা ছাওয়া মাটিতে নেউলের দৌড়, সন্ধ্যার আলোয় শ্রান্ত বাগান থেকে উঠে আসা দিনের উত্তাপের গন্ধ- এইসব নিয়ে যারা আমাদের শহরে আহাজারি করে, তারা ঠিক ‘আধুনিক’ নয়, ‘হালের’ নয়, রিয়্যালিটির সাথে তাদের সম্বন্ধ নেই।
আমরা জাতে দরিদ্র (শুধু দরিদ্র জাতি নই), আমাদের মানুষের পাশে কেউ নেই, সেই উছিলায় আমাদের নেউল-শালিক-টিয়াপাখি-আমগাছ-কামরাঙাগাছেরও কেউ নেই। (আমাদের একটিই শ্লোগান — মানুষ খেতে পায় না আর… পশুপাখি-গাছপালার প্রতি ভালবাসা দেখলেও আমরা সমস্বরে জোকার দিয়ে উঠি, মানুষ খেতে পায় না আর…অথচ যে হৃদয় অবোলা জীবের কান্না শুনতে পায় না, সে হৃদয় অপর অনাত্মীয় মানুষের কান্না শুনতে পাবে কি করে?) আমাদের ‘গা খানি তার শাওনমাসের যেমন তমাল তরু’ লেখা কবির, ‘হলদে হাওয়ার সুখ’ চেনানো কবির, ‘ধানের কাব্য’ আর ‘গানের কাব্য’ বুনে দেয়া কবির কেবল ওয়ারিশ ছাড়া কেউ নেই। কেউ নিবিড় মমতায় তাঁর এত আদরের এই বাগান সংরক্ষণ করবে না, কেউ কুসুমে কুসুমে রেখে যাওয়া চরণচিহ্ন নিয়ে বিচলিত নয়। না স্বজনরা না স্বদেশ। ক্লদ মোনের বাগান আজো ফুলে-ফসলে শস্যলক্ষ্মী হয়ে শত শত পর্যটকের মন ভোলায় — কোথায় তিনি বসতেন, কোথায় ছিল স্টুডিও, কোথায় ল্যাবার্নামের কুঞ্জ, কোথায় সারাবেলা ছিন্ন পাতার তরনী ভাসানো চিন্তায় আচ্ছন্ন করে দেয়া শাপলাপুকুর। “আমার বেদনা খুঁজো না আমার বুকে” সত্যি, এও সত্যি এইসব সংরক্ষিত বাগান প্রজন্মান্তরে জানিয়ে যায় — শিল্পীর এবং শিল্পভাবনার তুল্যমূল্য। এই গাছগুলি এই কুঞ্জছায়ার স্বপ্নমধুর মোহগুলি কেবল একজনের নয়, কেবল তাঁর বংশধরদের নয়, ‘চিরদহন দাহনপ্রিয় জন্মসহোদর’দের। দুর্ভাগ্য, আমরা বা আমাদের নির্বাচিত সরকার কেউই তা দেখতে পাই না, স্বীকারও করি না।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
ফকির কামরুল - ৩ মার্চ ২০১৪ (১১:৫৮ পূর্বাহ্ণ)
প্রসঙ্গটি মমতা দিয়ে তুলে আনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। তবে মূল ইস্যুটির আরো খানিকটা বর্ণনার প্রয়োজন বোধ করেছি। কবির সেই বাগানটি নিশ্চয়ই তাঁর অন্যান্য সম্পত্তির মতো উত্তরাধিকারীদের কাছে খন্ডিত হয়ে গেছে অথবা যাচ্ছে? কবির সন্তানেরা যদি কবিত্বের চেয়ে অর্থনীতি ভালো বোঝেন, তাহলেতো এমন কিছুই প্রত্যাশিত।
পল্লী কবির বিষয়ে খোদ ফরিদপুরেইতো যথেষ্ট আত্মার আত্মীয় থাকার কথা। সেখানে নিয়ম করে পল্লী মেলা হয় শুনেছি। দর্শনীয় স্হান হিসেবে এখনও কবির বাড়ী অন্যতম। এর বিরোধিতা করে কি কোন সামাজিক, কিংবা সাংস্কৃতিক সংগঠনই এগিয়ে আসার অবসর পেলনা?
রাষ্ট্রীয় নজরদারিত্বের সীমানা বড়। কবে সেখানকার কেউ এদিকে তাকাতে পারবেন, সে অপেক্ষায় না থেকে, এই ঐতিহ্য হত্যার চেষ্টাটি সম্পর্কে সরকারকে জানানো হয়েছে কি?
ভালো থাকবেন।