আমার তেরোমাসের ছেলেকে আমি ছোট্টবেলা থেকে বড় অত্যাচার করেছি,
১. সকালে ঘুম থেকে আমাকে লাথি দিয়ে জাগিয়ে দিলে শুনিয়েছি- “কাঁদতে আসিনি/খাওয়ার দাবী নিয়ে এসেছি”
২. খেয়েদেয়ে একটু বমি হলেই গেয়েছি- “দই চাই গো দই চাই/দই চাই গো”
৩. ন্যাপি বদলাবার আগে বাধাদানপর্বে গেয়েছি- “বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে/আমি যাই তারি দিনপঞ্জিকা লিখে”
৪. ন্যাপি পাল্টানোর সাথে সাথে- “হারে রে রে রে রে আমায় রাখবে ধরে কে রে”
৫. ঘুম পাড়াবার চেষ্টা দেখে এঁকেবেঁকে পালানোর চেষ্টা করলে – “তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি”
৬. কোলে নিয়ে রান্নার কড়াইয়ে খুন্তি নাড়তে নাড়তে গেয়েছি- “বেলা যায় বহিয়া দাও কহিয়া/কোন বনে যাব শিকারে”
সুবীর সেন-অনূপ-মানবেন্দ্র-সতীনাথ-শ্যামল মিত্র যেদিন যিনি আমার মাথায় ভর করেছেন, ছেলেটাকেও আমি শুনিয়েছি এন্তার। সে ফ্যালফ্যালে টলটলে চোখ মেলে প্রথমে খুব শুনতো, পরে অস্থির হয়ে ঘুমিয়ে পড়তো আর এখন মরিয়া হয়ে ‘বুথ সাহেবের বাচ্চাটা’ হয়ে এপিগ্লটিস তিরতির করে কাঁপিয়ে ঠা ঠা চিৎকার দিয়ে কাঁদে। সে যখন ন্যাদন্যাদে বাচ্চাটা কেবল, আমি খুব মেতেছিলাম আমাদের ছেলেভুলানো ছড়া নিয়ে, ভাত (‘দুধমাখা ভাত কাকে খায়’, ‘তাই তো খুকু রাগ করেছে ভাত খায়নি কাল’) আর বাল্যবিবাহ (‘খোকা যাবে শ্বশুরবাড়ি’, ‘হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে সোনামনির বিয়ে’, ‘বেড়া ভেঙে বউ পালালো শেয়াল মরে হেসে, বউ সাজবে কাল কি চড়বে সোনার পালকি’, ‘হাজার টাকার বউ এনেছি খাঁদা নাকের চূড়ো’, ‘এত ডাকি তবু কথা কয় না কেন বউ’) যেসব ছড়ার প্রতিপাদ্য…যেগুলি যেকোনো পুরোনো চিহ্নের মতোই আমি ভালবেসেছি।
কিন্তু দেখলাম আমি বড় একা, আমার মন্ত্রী নেই, উজির নেই, কোটাল নেই। আমার ছড়া আর গল্প শিশুমৃত্যুর ভারে ন্যুব্জ, বাল্যবিবাহের বেদনায় ম্যুহমান (বর আসবে এখনি/ নিয়ে যাবে তখনি/ভেবে কেন মরো/আপনি ভাবিয়া দেখ কার ঘর করো) সে না হয় বুঝলাম, আমাদের ছড়ার দুধভাত-আমসত্ত-কদলী-সয়দাবাদের ময়দা-কাশিমবাজারের ঘি এর পিছনে আমৃত্যু অর্ধাহার আর অনাহারের যে ছায়া (‘কখনো মাসী বলেন না যে খই-মোয়াটা ধর…কিসের মাসী কিসের পিসী কিসের বৃন্দাবন’), আমাদের ছড়ায় বিয়েই যে একমাত্র আমোদ-জামাই আদর যে সর্বোচ্চ আদর (‘সকল জামাই খেয়ে গেল মেজজামাই কই’) এইসবের পিছনে রয়েছে জাতের চারিত্র। আজ আমার কাল আলাদা বলে এইসব কালের চিহ্ন তো মোচন করা যাবে না। কিন্তু তা বলে আমার ছড়ার বইয়ে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকার মতন ছবি নেই কেন, ম্যাড়মেড়ে রঙ, অন্তবিহীন হাশেম খান আর র’নবীর একঘেঁয়ে-স্বপ্নবিবর্জিত অলঙ্করণ, আমার ছড়ার যা কিছু এনিমেশন আছে ইউটিউবে মানিকসিটিজি বা এরকম আরো কিছু লোকের কল্যাণে, সেগুলির ছেলেমেয়েরা আশ্চর্যভাবে আর্চিস কমিক্স এর বেটি বা রেজির মতন দেখতে, বিশ্রী রঙ লেপে দেয়া (যেন রঙিন করে দিলেই বাচ্চারা খায়) আর গানের সুর আর বাদ্যি শুনলে মনে হয় কখন শেষ হবে এই সশব্দ বর্নিল অত্যাচার।
ইংরেজি ছেলেভুলানো ছড়ার একটা বহু পুরনো বই পেয়েছিলাম চ্যারিং ক্রস এর বইয়ের সুবর্ণ খনিতে। খনিশ্রমিকের মতন নেমে গেছিলাম সেই বইয়ের ধুলিমলিন পাতায়…ডিকেন্সিয়ান নভেলের চরিত্রের মতন চেহারার ড্রয়িং, হৃদয়হীন ওল্ড ওম্যান জুতোয় বাস করেন এগারোজন ছেলেপুলে সহ, “শি গেইভ দেম সাম ব্রথ উইদাউট এনি ব্রেড/ শি হুইপড দেম অল সাউন্ডলি এন্ড পুট দেম টু বেড”, ওয়ার্কহাউজের যূগের এই মনোভাব বদলেছে বলে এখন এই রাইমের শেষটুকু আলাদা, “শি গেইভ দেম সাম ব্রথ উইথ এ পিস অভ ব্রেড/ শি কিসড দেম অল ফন্ডলি এন্ড পুট দেম টু বেড” হয়েছে। বদলেছে “রক আ বাই বেবি”র শেষটাও। ছিল “হোয়েন দ্য বাও ব্রেকস দ্য ক্রেডল উইল ফল/ এন্ড ডাউন উইল কাম বেবি-ক্রেডল এন্ড অল”, সেটা হয়েছে “বাট মাদার উইল ক্যাচ ইউ ক্রেডল এন্ড অল”… পলিটিক্যালি কারেক্ট হবার রোগ এমনি প্রকট এখন, যে ‘বা বা ব্ল্যাক শিপ’কে এখন ‘বা বা বা শিপ’ গাওয়ানো হচ্ছে। আমার মনে আছে ছোট্টবেলায় যে পাই-বিক্রেতা সিম্পল সায়মনকে একটা পাই খেতে দেয়নি তাকে আমি দু’চক্ষে দেখতে পারতাম না। ‘রাইড আ কক হর্স’ এর ঘোড়ায় চড়া মহিলার ছবি ছিল আমার ভীষণ প্রিয়। প্রিয় ছিল সিং আ সং অভ সিক্স পেন্সের বিশাল পাইয়ের ভিতর ফুঁড়ে পাখশাট মেরে বেরিয়ে আসা বিশখানা কালো পাখি। আর খুব হাসতাম চিমসে ‘জ্যাক স্প্র্যাট’ আর তার ঢাউস বউয়ের ছবি দেখে। আমরা যখন স্কুলে “রিংগা রিংগা রোজেস/পকেট ফুল অভ পোজিস” গাইতাম তখন কে জানতো, এ গান লন্ডনের প্লেগের স্মারক। এমনি করে করে একটি দেশের ছেলেভুলানো ছড়া-গল্প তার জাতীয় চরিত্র-চারিত্র-সুখদুঃখ-পরিবেদনা এইসব বুকে করে বয়ে বেড়ায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
যা হোক, আদি বিলাপের বিষয়ে ফিরে আসি। আমার চোখ জুড়ানো বাংলা ছড়ার বই নেই- ভেবে দেখুন, ‘আগডুম বাগডুম’ দিয়ে কি চমৎকার একখানা বইই হতে পারে, হতে পারে ‘আমপাতা জোড়া জোড়া’ দিয়ে আস্ত একটা ছড়া-ছবির বই। আমার হাট্টিমাটিম টিমকে দেখলে ক্রিটাশাস যূগের প্রাণী মনে হয়, আমার ‘তাঁতীর বাড়ি ব্যাঙের বাসা’র সুর শুনলে মনে হয় ব্যাঙের ফোলা শরীরে পা দিয়ে চেপে ধরে কেউ সুর বের করেছে, আমার চোখে জলদস্যুর তাপ্পি পরা ‘কানা বগীর ছা’ দেখলে ননসেন্সের মজা না বুঝতে পারা বাঙালির ভাবনার দৈন্যে চোখে জল আসে, একরকমের সক্রোধ বিদ্রুপে সে জল চোখেই শুকিয়ে যায়। দেশে-বিদেশে-নিজভূমে-পরবাসে যত বাঙালি শিশু জন্মাচ্ছে, জন্মাবে, তাদের জন্যে আমরা আমাদের কোন সাজপোশাক তুলে রেখেছি উত্তরাধিকার হিসেবে পরিয়ে দেব বলে? শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ভালবাসা (মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র এখানে সহায় নয়, বরং ভেবে দেখলে বৈরী, তার শিশুদের নিয়ে ভাববার সময় কই?) দিয়ে কি এতগুলি শিশুকে ভাষা দেয়া সম্ভব? আর ভাষা তড়িচ্চালন করা না গেলে, গান-সুর-মর্ম-জাত সবই তো অপরিবাহিত রয়ে যাবে, তার কি হবে?
২৬ ডিসেম্বর, ২০১১