মনে আছে আমাদের নাজমা নানী ছিলেন খুব ফর্সা। প্রায় নীরক্ত রকমের ফর্সা। সেই ফর্সা মুখে পানের রসে লাল ঠোঁট একেবারে জলজ ফুলের মতন ভেসে থাকতো। নাজমা নানী যেখানে যেতেন সঙ্গে যেত চমনবাহারের মেঘ, তাঁর চারদিক সুবাসিত করে রাখতো। নাজমা নানীকে ‘নাজমা নানী’ ডাকলে খুব ক্ষিপ্ত হয়ে বলতেন- খবরদার, আমাকে মন্টি আপা ডাকবি।”
তো মন্টি আপা ‘ছায়াছন্দ’ শুরু হলেই সবাইকে চুপ করিয়ে দিতেন, চোখ রাঙিয়ে বলতেন- একটা শব্দ না।’ আর প্রায় উপাসনার মতন আগ্রহে শুনতেন ‘জীবন আঁধারে পেয়েছি তোমারে চিরদিন পাশে থেক বন্ধু’ (রাজ্জাক আর শাবানা একে অন্যের ঘাড়ে-পিঠে অদৃশ্য তেলমালিশের ভঙ্গী করেই চলেছেন, শাবানা কলাগাছের ব্যাকগ্রাউন্ডে আঁচল মেলে নাচছেন), মন্টি আপার চোখ চুম্বকের মতন টেনে রেখেছে বিটিভি, লিপসিং করছেন তিনিও, একবার গেয়েও ফেলছেন। গান শেষ হলে চোখের পাতা বন্ধ করে রেখেছেন একটুখানি। ধবধবে চোখের পাতায় শিরাগুলি বেগুনি আভাময়।
সেই ছায়াছায়া শোবার ঘরের খাটে বসে দেখা ‘ছায়াছন্দ’, আহা ঘরের ভিতর হাত অর্ধবৃত্তাকারে মেলে ঘুরছেন ববিতা, ববিতা-টাইপ কলার তোলা সিল্ক ব্লাউজ-শিফন শাড়ি-পরচুলার খোঁপা-অসহ্য দাঁতে নখ খোঁটার সলজ্জভাব আর কি আবদার ‘ইশারায় শিস দিয়ে আমাকে ডেকো না’, ঘরের ভিতর এক লাফ মেরে ঢুকে গেলেন জাম্বু, টেকো কপালে স্কচটেপ দিয়ে লাল প্লাস্টিকের চকচকে ‘সাপের মনি’ সাঁটা, নেচে গেলেন পদ্মাবতী বেদেনি, নাও বেয়ে ইভটিজিং করে চলে গেলেন ফারুক, ‘আলোমতি’ ছাগলছানা কোলে একা ঘরে থাকার বেদনায় কাতর, এইবার টেলি সামাদের ‘ডেগের ভিতরে’ অনবদ্য ডাইল আর চাউল মিশে যাচ্ছে। একঝলক খান আতা, তাঁর দর্পিত মুখ আর গ্রীবা আর খাঁচা ভাঙবার আকুলতা। রওশন জামিলের ‘আমার গুষ্টি আমার খাও/ আমারে কও ম্যাও’… মন্টি আপা পৌত্তলিকের মনোযোগে দেখে চলেছেন- যার নাম সিনেমা। সঙ্গে কোললগ্ন আমি এবং আমরা, মেঝেয় সারিবদ্ধ মহামাতৃকূল বুয়ারা এবং দুপুরের খাওয়ার পর আইঢাই গড়ানো খালারা।
আমাদের বাড়িটার নিচতলায় কারা যেন প্রতিদিন তিনচারটা গান বাজাতো বারবার, ‘একটা গান লিখো আমার জন্য’, ‘আমার বলার কিছু ছিল না’, ‘বড় সাধ জাগে’, ‘আশা ছিল ভালবাসা ছিল’ আর ঝাঁঝাঁ রৌদ্রের দুপুর জুড়ে- ‘এই রাত তোমার আমার’, বাজতেই থাকতো।
আগেই একটা লেখায় বলেছি, আমাদের নানাবাড়িতে ভিসিপি চলবার সময়ে প্রতিবেশীরা দঙ্গল বেঁধে ভেঙে পড়তেন, যেমন সবাই পড়তো (তখন আমরা জরিদার হেয়ারক্লিপ দেই চুলে। তখন টিভোলি নামের একটা দোকান ছিল বোধ করি শাহবাগে।), আর আমরা ছোটরা ঢুকে পড়তাম খাওয়ার টেবিলের তলায়, ঐখানে বসে হাঁ করে সিনেমা দেখতাম। ধর্মেন্দ্রর ঢিসুম ঢিসুম, শত্রুঘ্ন সিনহা কার উপর যে এত রেগে থাকতেন, অনিতা রাজ কুতুব মিনারের সামনে গোলাপফুল কানে গুঁজে গাইছেন- আও মিল যায়ে হম্ সুগন্ধ্ অওর সুমন্ কি তারহা’… জয়া প্রদা অফহোয়াইট ভারি শাড়ির সাথে মুক্তার দুল পরে নাচছেন, শ্রীদেবীর বা রেখার জরির ঝালর মোড়া কাঁচুলি দেখানো মাত্র ছোটমামা টেবিলের তলায় উঁকি দিয়ে হেঁকে বলছেন- পোলাপান, চক্ষু বন্ধ কর্”! অমিতাভ বচ্চন কোনো মুভিতে মারা গেলে আমার কান্না দ্যাখে কে, মামা মুভি শেষ হলে আবার টেনে দিয়ে অমিতাভের নাচগানের অংশ দেখিয়ে আমাকে বলতেন- দ্যাখ, বাঁইচা আছে, মরে নাই, কেমন ফাল পাড়তাসে”… অমিতাভ বচ্চন অ্যালাইভ এন্ড কিকিং দেখে শান্তি হতো আমার। পৃথিবী তাহলে ঠিকমতন চলবে।
‘দূরদেশ’ এর গান সারাদিন ভাঁজতো আমার খালাত বোন, আমাদের উৎসাহের অবধি ছিল না সার্কভুক্ত দেশগুলির সিনেমা যখন দেখানো হতো। পাকিস্তানের ‘সুহাগান’(কারা যেন আমাকে কাকে দেখিয়ে হিসহিস করে উঠতো- ঐ যে জেবা, ঐ যে জেবা) আর ভারতীয় বাংলা ছবি- অব্যর্থ উত্তম-সুচিত্রা… মানেই আম্মা সেদিন রান্নার পাট চুকিয়ে ফেলবেন বেলাবেলি। আমরা গাইব ‘এমন বন্ধু আর কে আছে/ তোমার মতো সিস্টার’।
আমার সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্তগুলি হয়তো তখন থেকেই সিনেমার মুহূর্ত।
‘মুভি অফ দ্য উইক’ দেখতে বসেছি, আব্বা হয়তো এখুনি বিদায় করবেন না টিভির সামনে থেকে, কারণ আব্বা ঘুমাচ্ছেন। আম্মা হয়তো ছবির একমাত্র প্রেমের দৃশ্যেই ফ্রিজ খুলে আনাজ বের করতে এসে ধমকে উঠবেন না, কারণ আম্মা সেলাইমেশিনের সামনে। সেই সময়টুকুতে আমার সামনে খুলে যেত সিংহদরজা, রাজপ্রাসাদের বা টাকশালের, ভেতরে খালি ঝমঝম করছে অসামান্য মুহূর্তগুলির মোহর। অনাথ জো’ন ফন্টেইন ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞেস করছে্ন- আপনার তাহলে সেক্রেটারি চাই?” শেভ সেরে মুখ মুছতে মুছতে লরেন্স অলিভিয়ের বলছেন- ওরে হাঁদা, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইছি”, সে এক চেহারা হয়েছিল জো’ন ফন্টেইনের। আশায়-আশঙ্কায় তিরতির করে একটা আলো কাঁপছে তাঁর মুখে। ‘রেবেকা’য় আশ্চর্য এই যে, কোত্থাও এই অনাথা মেয়েটির নাম নেই, একটি বারের জন্যেও তার নাম উচ্চারিত হয়না, ড্যাফনি দুমরিয়্যর তাঁকে নাম দেন নাই, এমনকি মিসেস ডেউইন্টারের নামে যখন ফোন আসে সে মেয়েটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বলে বসে- তিনি মারা গেছেন,” যেন মৃত্যুর পরও পরম প্রতাপে তাঁকে একরকম নামগোত্রহীন মার্জিনে ঠেলে রেখেছে রূপগরবিনী (মৃত) রেবেকা, স্বামীর প্রথমা পত্নী। রেবেকার আদ্যক্ষর সেলাই করা (রুমালে-বালিশের ওয়াড়ে) দেখলে মেয়েটি থতমত খেয়ে যায়। দেরাজে রেবেকার লেসের রাতপোশাক তাকে প্রথমা পত্নীর সাথে তার স্বামীর অন্তরঙ্গ জীবনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
জো’ন ফন্টেইনকে নিরুপায় আবেগে প্রেমে পড়তে দেখেছি আরো দু’টি চলচ্চিত্রে। একটি ‘সাসপিশন’ (হিচককের), আরেকটি ‘লেটার্স ফ্রম অ্যান আননোন উওম্যান’। প্রথমটিতে ক্যারি গ্রান্ট তাঁকে যখন বারবার ‘মাঙ্কিফেস’ ডাকেন, ফন্টেইনের নাজুক মুখটা দেখবার মতন হয়- ঠিক প্রিয়নারীর যোগ্য সম্বোধন নয়, অথচ সেই ভিনেগারি রসবোধের ভিতরেও একরকম গভীর আত্মীয়তার সুর আছে। দ্বিতীয়টি রীতিমত হৃদয়বিদারক চলচ্চিত্র- ফন্টেইনের কম্পিত-কলেবর মূর্তি ছাড়া এই দু’টি চলচ্চিত্র চিন্তাই করতে পারিনা আমি। ফন্টেইনের ‘জেন এয়ার’ও আমার ভাললেগেছিল, গাঢ় রঙে আঁকা অরসন ওয়েলসের বিপরীতে একেবারে পাতলা লেস বিছানো ফিকে উপস্থিতি।
‘টু কিল আ মকিং বার্ড’ দেখে আমি যে কী বুঁদ হয়ে ছিলাম… হোমসিকনেস নাকি নস্টালজিয়া জাগিয়ে রাখে। পুরানো কাল এমন বস্তু (যেমন শৈশব), যার অনুরণন থাকে জীবনভর, ভেতরটা শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেলেও কোথায় যেন মানুষের একটু স্থান অবশিষ্ট থাকে, সেটুকু শ্যামল করে রাখে শৈশব। ‘মালগুড়ি ডেইজ’ দেখে তাই আমরা আমোদ পাই, ছেলেভুলানো ছড়া মনে থাকে প্রায় আজীবন, লুডুর বোর্ড আর ঘুঁটি দেখলে ভিতরটা নড়েচড়ে ওঠে- আর এই সিনেমাটায় তো শৈশব এমন করে উপস্থিত, যেন মনে হয় আরেকবার যাপন করা গেল। গরমকালের বারান্দার দোলনা, টানা গ্রীষ্মের ছুটিতে খালার বাড়ি বেড়াতে যাওয়া, কাজের লোক ক্যালপুর্নিয়ার হাতে দু’চারটা চড়চাপড় খাওয়া, সবচেয়ে ভয়ের জায়গায় বারবার ফিরে যাওয়ার তাড়নাবোধ করা…এইসব মিলে ‘টু কিল আ মকিং বার্ড’ আসলে একটা আশ্চর্য টাইমমেশিনে চড়ে শৈশবে ফিরে যাবার নাম। গ্রেগরি পেক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- অ্যাটিকাস ফিঞ্চ তাঁর সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র।” দেশ বলতে আমেরিকানরা যা ভাল বোঝে, যা সারবস্তু বোঝে, বা বলা ভাল বুঝতে চায় বা ভাবতে চায়, তার সবটুকু দিয়ে এই চরিত্রটা তৈরি। শুরু থেকে শেষ অব্দি দেখলে যে কেউ মনে মনে স্থানান্তরিত/কালান্তরিত হবেন।
একজনের কথা না বললেই নয়। তিনি মার্লন ব্রান্ডো। ‘দ্য ওয়াইল্ড ওয়ান’ এ মার্লন ব্রান্ডোর শেষ হাসি আমি বহুবার রিপ্লে করে দেখেছি। একজন নির্লিপ্ত মানুষ, উগ্র বদরাগী মানুষ, ভ্রষ্ট মানুষ একটিবার মাত্র হাসে পুরো ছবিতে, আর সেই একটু হাসিতেই জন্মস্বাধীন একটা মানুষের বলিষ্ঠ মুখটা চেনা যায়। ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’এ মার্লন ব্রান্ডোর ইভা মারি সেইন্টের হাতের মেয়েলি হ্যান্ড গ্লাভস নিজের হাতে পরবার চেষ্টা আমি কোনোদিন ভুলব না। এ যেন একটা স্বপ্নচ্যূত মানুষের আরেকবার স্বপ্নে ঢুকবার চেষ্টা, আরেকবার ফিরে দেখা জীবনের কোমলতাগুলিকে। ইভা মারি সেইন্টের সাথে পায়রার টং দেখাবার সময় (ব্রান্ডোর) মুষ্টিযোদ্ধার বিকৃত মুখখানা আলোয় ভরে আসা ভুলবার নয়। ‘লাস্ট ট্যাংগো ইন প্যারিস’এও মরবার আগে রেলিঙ্ এর তলায় চুইংগাম লাগিয়ে দেয়া ব্রান্ডোকে ভোলা যায় না। স্ত্রীর প্রেমিক যখন ঝুলতে ঝুলতে পেট সমান রাখবার পদ্ধতি দেখাচ্ছে, তখন স্বামী ব্রান্ডোর একঝলক স্থির দৃষ্টি তীর্যক হতে হতে নির্ভান হতে হতে জানিয়ে যায় তার মনোভাব- ‘এই লোকটার ভিতর তার স্ত্রী কি দেখতে পেয়েছিল? কি কি?’ নির্বিকার যৌনতার জন্যে এই চলচ্চিত্রটি বহু সমালোচনার স্বীকার হয়েছে, কিন্তু যৌনতা ছাড়া এই মানুষদুটিকে এ নিষ্করুন জন অরন্যে নাম-দেশ-ফুল-ফলহীন জনশূণ্যতার দ্বীপে মুক্তি দেবে কে, তাদের গভীর জন্মযাতনাকে স্পর্শ করবে কে?
আচ্ছা, দৃষ্টি বদলাবার ক্ষমতা আরেকজনের ছিল, তাঁর নাম ক্যারি গ্রান্ট। ‘মিস্টার ব্ল্যান্ডিংস বিল্ডস হিজ ড্রিম হাউজ’ এ স্ত্রী তাঁকে সাধ করে আর্কিটেক্টের ডিজাইন করা লিভিং রুম দেখান, আর বলেন- এই দ্যাখো আমাদের সাথে কত মিল, কত আমেরিকান, কতটা ব্লুবেরি পাইটাইপ!” ক্যারি গ্রান্ট কেবল এক মুহূর্ত তাকান- কমিক টাইমিংএ সেই চাহনির কোনো তুলনা হয় না। ‘ফিলাডেলফিয়া স্টোরি’তে যখন তাঁর সামনেই জিমি স্টুয়ার্ট তাঁর প্রাক্তন স্ত্রীকে বিবাহপ্রস্তাব দেন, সেই মুহূর্তে একটা কালো বিদ্যুত খেলে যায় গ্রান্টের চোখে। হৃদয়বিদারণের এত দ্রুত এত নির্ভুল সংকেত আমি আর দেখিনাই। বেচারি ক্যারি গ্রান্ট, সমস্ত জীবন এত কঠিন সব জিনিস এত সহজ করে অভিনয় করে গেছেন যে লোকে একপর্যায়ে ভুলেই গেছে- এই কাজগুলি কঠিন ছিল।
মার্ক এন্থনিরূপী বার্টন দূরের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করছেন- ক্লিওপেট্রা আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে?” এর পর ঝাঁপ দিচ্ছেন একটি দীর্ঘ আত্মাহুতির প্রণালীতে। পরে ক্লিওপেট্রা তাঁকে যখন বলতে গেলেন- আমি ভেবেছি তুমি মরে গেছ”…মার্ক এন্থনি প্রায় কঁকিয়ে উঠে বলেন- “শোক কোর না, আমি মৃতই” কিংবা ‘একুয়াস’ এ বার্টনের গমগমে ঈষৎ কর্কশ গলায় হুইটম্যানের – “আই উইশ আই কুড টার্ন এন্ড লিভ উইথ এনিম্যালস”…বার্টন নাকি সমুদ্রে দাঁড়িয়ে গলার রেওয়াজ করতেন। নইলে এমন ঢেউ মাথায় করে কারো গলা ছুটে আসে নাকি?
জিমি স্টুয়ার্টের ‘স্পিরিট অভ সেইন্ট লুইস’ ভুলবার নয়, এক পর্যায়ে লিন্ডবার্গ আর একটা আটকে পড়া মাছি, এই হয়ে যায় পুরো মুভি, অথচ গল্পটা টানটান থাকে আদ্যোপান্ত। জিমি স্টুয়ার্ট যে আমার কি ভীষণ প্রিয়, ‘মিস্টার স্মিথ গোউজ টু টাউন’এর নাছোড়বান্দা সরল মানুষটার ফিলিবাস্টার এর সুযোগ নিয়ে মরিয়া হয়ে সততা প্রমাণের চেষ্টায় কথা বলে যাওয়া বলেই যাওয়া যতক্ষণ গলার আওয়াজ চলতে পারে… ‘হার্ভে’তে অশরীরি সাতফুটিয়া খরগোশের সাথে অবিরাম কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া মতিচ্ছন্ন মানুষটা… ‘রিয়ার উইন্ডো’র রানী-রানী গ্রেস কেলির অসহিষ্ণু প্রেমিকটা… ‘ভার্টিগো’র মৃত প্রেমিকার সকল চিহ্ন আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চাওয়া লোকটা… ‘ডেস্ট্রি রাইডস এগেইন’/ ‘দ্য ম্যান ফ্রম লারামী’/ ‘দ্য ম্যান হু শট লিবার্টি ভ্যালান্স’ এইসব চলচ্চিত্রের নিরুপায় ভালমানুষগুলি।
ইনগ্রিড বার্গম্যানে এসে আমি বরাবরই হারিয়ে ফেলি দিকচিহ্ন। ‘স্পেলবাউন্ড’ এর ডাক্তার মেয়েটা যখন লিভারওয়ার্স্ট উচ্চারণ করে তার অসামান্য সুইডিশ জিহ্বায়, যখন প্রথমদর্শনেই প্রেমে পড়ে যায় আরেক ডাক্তারের আর ভার্জিনিয়া উলফের গাছের মতন কাঁপে প্যাশনের ঢেউয়ে, যখন ‘গ্যাসলাইট’এ সে হাহা করে কেঁদে ওঠে, ‘ক্যাসাব্লাংকা’য় ইংগ্রিড বার্গম্যানের অশ্রু মাথা নাড়ার সাথে গাল থেকে এঁকেবেঁকে নেমে যায় তখন বাকি দুনিয়ার সাথে আমিও সবিস্ময়ে ভেবেছিলাম- এটা কি অভিনয়? গাল থেকে ঐরকম হাহাকারের তালে তালে অশ্রু এঁকেবেঁকে ঝরা কেমন করে অভিনয় হয়? মজার বিষয় হচ্ছে, বার্গম্যান আর বোগার্ট এই মুভি তৈরির সময়ে তেমন পরিচিত ছিলেন না, বোগার্ট তখন দারুন ঈর্ষাকাতর এক মহিলার স্বামী, ফলে সেটে বার্গম্যানকে জানবার সুযোগ হয়নি তাঁর। এই মুভির পর ক্রিটিকরা প্রায় সমবেত হয়ে আবিষ্কার করলেন বোগার্টের এবড়োখেবড়ো চেহারার যৌনটান আর আকর্ষণ। হামফ্রে বোগার্টকে এবিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন- বার্গম্যান কারোর দিকে ঐরকম এক আকাশ ভালবাসা নিয়ে তাকালে বিপরীতে যেই থাকুক, তাকেই আকর্ষণীয় দেখাবে”।
‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ এর স্কার্লেট ও’হারা, ‘বাইসাইকেল থিভ্স’ এর ছোট্ট ছেলেটার সাথে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা অ্যান্টোনিও, ‘ইল পোস্টিনো’ এর মারিও, ‘দ্য এল শেপড রুম’ এর জেইন, ‘দ্য নাইট অভ দ্য হান্টার’ এর রোমহর্ষক রেভারেন্ড হ্যারি পাওয়েল (রবার্ট মিশাম, পরে এর বাংলা হয় ‘কুহক’, অর্থগৃধ্নু মিশামের চরিত্র করেছিলেন উত্তমকুমার), ‘ইংলিশ পেশেন্ট’ এর আলমাশি, কত কত প্রিয় চরিত্রের সিমুলাক্রা আমার শেওলাধরা দেয়ালে।
উপমহাদেশে ফিরি। গুরু দত্তের ‘পিয়াসা’ আমার খুব প্রিয়, যেমন প্রিয় ‘সাহেব বিবি গোলাম’, গুরু দত্তের প্রলাপ এবং আত্মবিলাপকে স্বমূর্তি দিয়ে ‘পিয়াসা’ তৈরি। শাহির লুধিয়ানভীর অসামান্য লিরিক ‘ইয়ে ম্যাহলোঁ ইয়ে তখতোঁ ইয়ে তাজো কে দুনিয়া/ ইয়ে ইনসাঁকে দুশমন রাওয়াজোঁকি দুনিয়া/ ইয়ে দুনিয়া আগার মিল ভি যায়ে তো কেয়া হ্যায়’, কিংবা দিশেহারা গুরু দত্ত ভেবেই পাচ্ছেন না, কারা তারা যারা ভালবাসার বিপরীতে ভালবাসা পায়? শেষমেশ গুরু দত্ত আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেন না, শুধু চিরবন্ধু-চিরনির্ভর পতিতাপল্লীর মেয়ে ওয়াহিদাকে জিজ্ঞেস করেন- আমার সঙ্গে যাবে?” ‘সাহেব বিবি গোলাম’ এর মীনাকুমারীকে কে ভুলবে? তাঁর সাজ করতে করতে আর শাড়ির ফেরতা দিতে দিতে ‘পিয়া এইসো জিয়ামেঁ সামায়ে গায়ো রে’, তাঁর ধূপে শুকানো চুল, তাঁর দীর্ঘ দাঁড়ার চিরুনী গোঁজা খোঁপা…
বিমল রায়ের ‘বন্দিনী’ আমার প্রিয় ছিল, যাঁতা ঘুরাতে ঘুরাতে নাকিকান্নার মতন টানা সুরে কয়েদী মহিলার ‘আব কে বরষ ভেজ ভেইয়া কো বাবুল’ শুনলেই দারুন বিষন্নতায় মনে পড়ে যায় কেউ আসবার নেই, কারো কোথাও যাবার নেই। বিকেলের আলোয় ছায়া দীর্ঘ হতে থাকে, জেলখানার দাওয়ায় নুতন নিষ্কল বসে থাকেন। প্রাচীর থেকে প্রাচীরে হাঁক ওঠে টহলদারের- সব ঠিক হ্যায়’… সব ঠিক আছে, কেবল কনডেমড সেল এর গভীরে অফেরতযোগ্যভাবে একজন মানুষ জানছে- আরেকটা দিন ফুরালো, জেলের ডাক্তারের প্রস্তাব নুতন ফিরিয়ে দিয়েছেন, সেই প্রায়ান্ধকার দাওয়ায় বসে নুতন জানছেন- আরেকবার জীবনকে গ্রহণের সুযোগ হারালেন তিনি, ডাক্তার জেল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন…তাতে কি, সব ঠিক হ্যায়! দীর্ঘশ্বাসের মতন, আর্তনাদের মতন- প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, সব ঠিক হ্যায়!
বাকিটুকু আরেকদিন…
২৭ জুলাই, ২০১১
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
সকাল রয় - ১৬ আগস্ট ২০১১ (৫:৩৮ অপরাহ্ণ)
ব্যাপক লিখছেন
অনেক কিছু জানতে পারলাম।
লেখায় ফুটে উঠেছে পুরোনো কথামালা