চোখ দিয়ে আমি প্রথম কী দেখেছি? তা মনে থাকবার কোনো কারণ নাই। আম্মার সাথে ছোট্টবেলায় ফকিরাপুলের একটা দোকানের ভোজ্যতেল কিনবার সময় তেলচিটচিটে হটপেটিস-এর উপর হলুদ আলো থেকে শুরু করে প্রিয়মানুষের মুখে ফুটিফুটি লজ্জা… সদ্যজন্মানো সন্তানের হাতগুলিতে অযথাই অপূর্ব সব ভাঁজ… আষাঢ়মাসের লটকানরঙ মেঘ… রাতের আকাশে অসীম পর্যন্ত তারার নীহার… এইসবকিছু দেখতে দেবার জন্যে আমি আমার চোখের কাছে ঋণী (পদার্থবিদ্যার বই আমাদের জানিয়েছিল, সুস্থ মানুষের দৃষ্টিসীমা নাকি অসীম)। অপাংক্তেয় জিনিস থেকে শুরু করে জীবন-ধন্য-করা জিনিস অব্দি সবই এই চোখ দিয়ে দেখা। মনের দিকে যাওয়া। বুদ্ধির ভিতরে তার বিশ্লেষণ। ধারণক্ষমতার ভিতর তার পরিস্রবণ।
আমার চোখ আমার সম্পদ। আমার বাকি শরীরটাও তাই, আমার ঈশ্বরদত্ত উপহার। আমার পৃথিবীর সকল দান গ্রহণের যন্ত্র। এই মানবশরীর আমার সার্বভৌম নিজ ভূখণ্ড। কত না যত্নে অ্যামনিওটিক ফ্লুইডের অন্ধকার সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে এই শরীর পলে পলে তৈরি হয়েছে। এর উপর আমার অধিকার সর্বোচ্চ। সৌদি টিভি প্রেজেন্টার রানিয়া আল বা’জ-এর শরীরের উপর যেমন তাঁর অধিকার সর্বোচ্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুমানা মঞ্জুরের শরীরের উপর যেমন তাঁর অধিকার সর্বোচ্চ।
যে বা যারা এই অধিকার নষ্ট করেছে বা করে চলেছে বা করতে উদ্যত, তাদের জন্যে ব্যাবিলনের সম্রাট হাম্মুরাবি খ্রীস্টের জন্মেরও সতেরশ বছর আগে নিয়ম করে গেছেন, তুমি নিজের শস্যক্ষেতে সেচ দিতে গিয়ে অপরের শস্য নষ্ট করলে তার জন্যে দণ্ডিত হবে, তোমার নষ্টচোখের বিনিময় আরেকটি চোখ (বিনষ্টকারীর), তোমার উৎপাটিত দাঁতের বিনিময় আরেকখানা দাঁত (পীড়নকারীর)…
আমি ভাল কি মন্দ, আমি সৎ কি অসৎ, আমি সহিষ্ণু কি অসহনশীল — আমার অঙ্গহানির অধিকার কারো নেই। যে আমার রাজ্যে অনধিকারবলে প্রবেশ করবে, আমার ঈশ্বরের দানকে ভাঙবে, মচকাবে, মটকাবে, দলবে, সে যেন আমার দেশে আমার পরিবারের সামনে আমার প্রতিবেশীর সামনে কোনো ওজর দেবার সাহস না পায়। শুনতে একরকম অমীমাংসিত নিরুচ্চারিত এবং উপেক্ষিত প্রার্থনার মতন শোনায় এই আশা। কেননা ছোটবেলা থেকে মেয়েশিশুরা সব দেশেই ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের কমবেশি প্রকাশ দেখে দেখে অভিজ্ঞ — নাওয়াল আল সাদায়ী-র দেশে তারা আপনজনের হাতে (মামা-চাচা-নানা-দাদা-খালু কে নয়) ধর্ষিত হয় আর বাকিজীবন ভয়ে থাকে এই পুষ্পদলনের ইতিহাস স্বামী আবিষ্কার করলে কী হবে, রানিয়া আল বা’জ-এর দেশে তারা বোনেরা মিলে রাতের আঁধারে রেডিও মন্টিকার্লোতে গান শুনে নাচে আর ধরা পড়ে বাপ-ভাইয়ের নিগ্রহের স্বীকার হয় — পয়সা না দিলে অপদার্থ স্বামীর ঘুষিতে ঘুষিতে ফেটে যায় রানিয়ার শ্রীময়ী মুখ। রুমানা মঞ্জুরের দেশ আরো এককাঠি সরেস। সেখানে লুকিয়ে রেডিও শুনে আমোদ পেতে হয় না। লুকিয়ে রাখতে হয় স্বামীর অনাচার-কদাচার-অসন্তোষ-গালিগালাজ-মারধোর, প্রকাশ করতে হয় শুধু স্বামীর ভালবাসার উপহার-উপচার-সুব্যবহারের নমুনা। নইলে ‘ভালো মেয়ে’ (অন্যায় যে সহে!) হওয়া যায় না, ‘অমায়িক’ হওয়া যায় না, বাঙালির সমাজ মেয়েদের খুশি হয়ে ঠকতে দেখতে ভালবাসে, প্রশ্ন না করে আড়ালে কেঁদে চোখ ফোলানো মেয়ে ভালবাসে, মেয়েদের অঙ্ক না জানাটা সেখানে এখনও রোমান্টিক।
একজন সুস্থ মানুষ বাকি জীবন প্রিয় সন্তানের বড় হতে থাকা পাকা হতে থাকা মুখ আর দেখবে না, সূর্যাস্তের আকাশ দেখবে না, বিদ্যার্জন করবার রাস্তা তার জন্যে আজ চূড়ান্ত বন্ধুর, আর আমরা এখনও অনেককে বলতে শুনছি, “নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে এমন ব্যবহারের, স্বামী হয়ে পরকীয়া কেমন করে সহ্য করবে?” আসলে আমরা তো বহুকাল ধরে অর্পিত সম্পত্তি (শত্রু সম্পত্তি) আইন বানিয়ে অন্যের স্থাবর সম্পত্তি গিলে খাওয়া জাত, আমরা অন্যের শরীরের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করবো কেমন করে?
কাকে আমাদের ঘৃণা ‘তৃণসম’ দহন করবে? যে পিশাচ স্ত্রীর দুইচোখ নষ্ট করে দেয়?
যে আত্ম-অসচেতন শিক্ষিত মহিলা দিনের পর দিন নির্দিষ্টসীমার শারীরিক-পীড়ন সহ্য করে?
যে বাপমা তাদের আদরনীয়া কন্যাকে সীমার ভিতরের নির্যাতন সহ্য করতে নিঃশব্দ সহযোগিতা করে (একটু আধটু হলে চেপে যাও, সয়ে যাও, এমন অনেক হয়?)?
যে পরিবার তার সদস্যকে তার ব্যাসের ভিতরেই নিজের রক্তে পিছলে পড়া থেকে বাঁচাতে অক্ষম?
যে সামাজিক প্রতিষ্ঠান একটি শিশুকে বছরের পর বছর মায়ের প্রতি বাপের নিষ্ঠুর অত্যাচার দেখতে বাধ্য করে?
যে সামাজিক কাঠামো ‘বিবাহবিচ্ছেদ’কে এমন একটি দানবে পরিণত করে রেখেছে, যার ভোগে অমূল্য জীবন চলে যায়, আহুতি দিতে হয় মানুষের প্রতি (নিজের প্রতিও) মানুষের মৌলিক সম্মানবোধকে?
২১ জুন, ২০১১