ছোটবেলায় পড়েছি এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজে গরু আর শূকরের চর্বি মেশানোর ফলে সেপাইদের ভিতরে দারুণ অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে — সংনমিত বায়ুতে ফুলকি জ্বেলে দিলে যা হয় তাই হয় এর পর। সিপাহী বিপ্লব শুরু হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লালমুখো সাহেবদের নিয়ে দেখানো যাত্রা দেখতাম বিটিভিতে, সম্ভবতঃ ‘নীল দর্পণ’ দেখাত ‘নিবেদন’ নামের একটা অনুষ্ঠানে, সেখানে চরিত্রহীন প্রজাশোষকের ভূমিকায় আরিফুল হক হারমোনিয়াম বাজিয়ে চোখ নাচিয়ে গাইতেন — “আমি ও-পাড়াতে যাব না লো সই!” আমার স্মৃতিশক্তি আমার সাথে হঠকারিতাও করতে পারে। নাটক দেখতাম সিপাহী বিপ্লবের উপরে — সেপাইরা দিল্লির সম্রাটকে ভারতেশ্বর ধরে নিয়ে শুকনো রুটির উপরে খোদাই করছে তাদের ইস্তাহার — “হাল্কে খুদা/ মুলকে বাদশাহ/ হুকুমতে সিপাহী…”, এর পরে নিজেকে ধুলি-তস্য ধুলি ভেবে অশ্রুপাত করে করে বাহাদুরশাহ জাফরের নির্বাসন, দিল্লির প্রবেশমুখে তাঁর বংশধরদের হত্যা। ভিক্টোরিয়া পার্কের গাছে গাছে ঝুলিয়ে রাখা সেপাইদের মৃতদেহ। লালবাগ কেল্লার পুকুরে সেপাইদের দেহ ফেলে দেয়া। আমাদের দুইভাইবোনের গলা রোষে-নোনাজলে ফুলে উঠতো।
পরে আরেকটু পড়বার পরে জানলাম, ভারতবর্ষ — যা গভীর মমতার আর দারুণ নিষ্ঠুরতার, যা গাঢ় রঙের (শাড়ি-চুড়ি-ঘুড়ি) আর অজস্র শব্দের (ঝিঁঝি-ব্যাঙ-শেয়াল-গোবাঘা-কর্তাল-খোল-পাখোয়াজ-ঢোল-উলু), তার সকলি চড়া সুরে বাঁধা — তার মানুষের অপত্যস্নেহ — তার মানুষের রক্তপিপাসা। কোম্পানি আমলে এ অঞ্চলের মানুষ একে একে দেখতে থাকে সহমরণ ও অনুমরণ রদ — বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ করা — ঠগীদের নরবলি বন্ধ করা — অপুত্রকের পোষ্যসন্তানের অধিকার বাতিল — এমনকী তার বিস্ফারিত চক্ষুর সামনে চিরপূজ্য ব্রাহ্মণকেও ফাঁসি দেওয়া গেল সর্বসমক্ষে (মহারাজা নন্দকুমার)। এইসব ভারতবর্ষের মানুষকে বিচলিত করেছে — তাদের যা নিজস্ব — যা আপনার, তা পরস্য পর এসে বদলে দেবে একের পর এক, এটা সাধারণ লোকের সয় নাই। সিপাহী বিপ্লব সেই অসহিষ্ণুতার চরম প্রকাশ।
আর এইমাত্র জানলাম, কোম্পানি আমলে ভারতীয়দের সাথে জন সাহেবদের যথেষ্ট মাখামাখি ছিল। বিয়ে ছিল। প্রণয় ছিল। এমনকী বর্ণশঙ্কর সন্তানজন্ম উপলক্ষ্যে কোম্পানি অর্থ-উপহারও দিত। সাহেবরা হুঁকাবর্দারদের সেজে দেয়া হুঁকা নিয়েছিল, নাচঘরের বিলাস নিয়েছিল, নিয়েছিল বহুগমন ও জেনানা, উল্কি নিয়েছিল, ভাষা নিয়েছিল, রেজিমেন্টের নানান খেলাধুলায় তারা নেটিভ সেপাইদের সাথে যোগ দিত, তাদের নিয়ে তারা দুর্গম জঙ্গলে শিকারে যেত। বৃষ্টির সময় নেটিভ সৈন্যরা তাদের সাহেবের তাঁবুতে ঢুকে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ত। এই মেলাবে-মিলিবে বন্ধ হবার মূলে ছিলেন মেমসাহেবরা (ক্ষীর-ননী-চিনি আর ভাল যাহা দুনিয়ায় তাই দিয়ে মেয়েগুলি তৈরি), সুয়েজ বেয়ে তারা যখন আসতে শুরু করলেন — সঙ্গে এলো জাতিভেদের কুটিরশিল্প, সঙ্গে এলো দুয়ার এঁটে দেবার স্বাভাবিক প্রবণতা আর নেটিভ নারী এবং তার গর্ভজাত সন্তানদের প্রতি ঘৃণা। ১৮৫০-এর মধ্যে এই ঘৃণার সর্বগ্রাসী রূপ স্বয়ম্প্রকাশ হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৫৭-এর সিপাহী বিপ্লব তার ফলাফল। কানপুরে বিবিগড়ের হত্যাকাণ্ড তার স্থায়ী ক্ষত। এরপর বৃটিশরাজ কোনোদিন তাদের জাতের গুমোর ভোলেনি, ভুলতেও দেয়নি, ভোলেনি প্রতিশোধ নেবার চিরজাগরূক স্পৃহাকেও (রেমেমবার কানপুর!)।
২৪ জানুয়ারি, ২০১১
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৪ comments
ইমতিয়ার - ২৯ জানুয়ারি ২০১১ (৮:২০ অপরাহ্ণ)
সিপাহী বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষে যে স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু, তার ভিত্তি যতটা না অসন্তোষ তারও বেশি ‘ধর্ম হারানোর’ ক্রোধ। এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজে গরু আর শূকরের চর্বি যদি না মেশানো হতো, তা হলে হয়তো মুসলিম আর হিন্দু সিপাইদের জেগে উঠতে আরও দেরি হতো-কিন্তু তাও অনেক ভালো ছিল। গরু আর শূকরের চর্বি আমাদের মাথার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার চর্বি জমিয়ে রেখে গেছে-১৯৭১-এর গণজাগরণ আর রক্তক্ষয়ও সেই চর্বির পাহাড়কে গলাতে পারেনি। এখনো তাই আমাদের শুনতে হয় মৌলবাদী বয়ান।
মোহাম্মদ মুনিম - ৩০ জানুয়ারি ২০১১ (১০:৫৭ অপরাহ্ণ)
উইকিপিডিয়াতে দেখলাম সুয়েজ প্রকল্প শেষ হ্য় ১৮৬৯ তে। সুতরাং মেমসাহেবদের ১৮৫৭ সালের আগে ‘সুয়েজ বেয়ে’ আসা সম্ভব ছিল না। মেমসাহেবরা ভারতবর্ষে আসার সাথে ভারতবর্ষে থাকা সাহেবদের জাত্যাভিমানের সম্পর্কের কথা জানা ছিল না। ব্রিটিশদের নামে জাত্যাভিমানের বদনাম থাকলেও তারা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে প্র্যাক্টিকাল জাতি। পরাজিত সিপাহী এবং ভারতীয় রাজপুত্রদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার পেছনে জাত্যাভিমান বা প্রতিশোধস্পৃহার চেয়ে ভারতীয়দের ভয় দেখানোর ব্যাপারটাই মুখ্য ছিল বলে মনে হয়।
সাগুফতা শারমীন তানিয়া - ৩১ জানুয়ারি ২০১১ (৫:২৭ পূর্বাহ্ণ)
মোহাম্মদ মুনিম, ভিক্টোরিয়ান রুটে ভারতবর্ষ আসতে চার মাস লাগত, সমুদ্রপথে উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে, জিব্রাল্টার ছুঁয়ে, মরিশাস হয়ে ভারত মহাসাগরে আসা যেত। উনিশ শতকের মাঝামাঝি অব্দি জাহাজগুলি ভূমধ্যসাগর দিয়ে জিব্রাল্টার আর মাল্টা হয়ে আলেকজান্দ্রিয়াতে পৌঁছত। সেখান থেকে ট্রেনে করে কায়রো। সুয়েজএ এসে আরেকখানা জলযানে চেপে লোহিত সাগর হয়ে এডেন আসা যেত। পরে সুয়েজখাল ১৮৬৯ এ খুলে দেবার পরে একখানা জাহাজে করে তিন সপ্তাহে বম্বে আসা যেত।
রিচার্ড হোমস এবং ডেভিড গিলমোর জানাচ্ছেন যে, গভর্নর অভ বম্বের স্ত্রী লেডি ফকল্যান্ড ১৮৫০এ লিখছেন, জাহাজ ভরে ভরে প্রতি শীতকালে বিবাহযোগ্যা স্ত্রীলোক ইংলন্ড থেকে ভারতে আসছেন যা অবিবাহিত ইংরেজ যুবকদের আলোড়িত করছে, এই কার্গো অভ ইয়ং ড্যামসেলকে ডাকা হচ্ছে- মাছধরা জাহাজ।
ইমতিয়ারভাই, সাম্প্রদায়িকতার চর্বির প্রসঙ্গে সহমত।
মাসুদ করিম - ৩১ জানুয়ারি ২০১১ (২:১৭ অপরাহ্ণ)
মোগলদের নারীও তো আফগান পারস্য তুরস্ক থেকে আসত। আবার ভারতের নারীদের সাথেও তাদের ঘর বাঁধা চলত। কিন্তু মোগলদের একটা সুবিধা ছিল ভারতের সাথে তাদের রাজপথের যোগাযোগ ছিল, তাই নারীসঙ্গী সাথে করেও চলাচল করা যেত। কিন্তু সমুদ্রচারী ইংরেজের জন্য এই সুযোগ প্রথম দিকে ছিল না। তাকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ‘প্যাসেঞ্জার জাহাজ’ চালু করে নারীসঙ্গী নিয়ে চলাচল শুরু করতে হয়েছিল। আর সাহেবদের প্রতিষ্ঠার খবরে ম্যামদের আগমন একসময় মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু
এটা হয়ত একটা দিক মাত্র, শুধু এই নেটিভ সন্তানদের সাহেবদের প্রতি অপরিসীম ঘৃণার ফলেই সিপাহী বিপ্লব? কিজানি, এব্যাপারে জানা শোনা কম, উইকিপিডিয়ার Siege of Cawnpore একবার পড়ে দেখব সময় করে, আরো পড়তে হবে ১৮৫৭-এর বেশকিছু ইতিহাস। তবে এই যে
বিবিগড়ের হত্যাকাণ্ড ও তার প্রতিশোধে ব্রিটিশদের রুদ্ররূপ এটা আমার কাছে একটা জিনিস খুব পরিস্কার করে দিচ্ছে ‘পরিবার প্রথা’ ছাড়া পুরুষের নারী ও শিশুর প্রতি কোনো সহানুভূতি আজো যেমন নেই, কখনো ছিল না, এবং কখনো হবে কি না কে জানে? তাই হত্যাকাণ্ড ম্যাসাকারের এক বড় অংশ জুড়ে থাকে নারী ও শিশুরা। তাই ওই নেটিভ-ম্যাম ঈর্ষাটা নয়, কিসে হয় তৈরি, আমার মনে হয় নারী ও শিশুর প্রতি অত্যাচারের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় ‘বিপ্লব’ ও ‘বিপ্লব দমন’।