আমার মতন পাঠকের আদৌ সাহিত্যনির্ভর সিনেমা দেখা উচিত কিনা, এই নিয়ে আমার দ্বিধা আছে, যার মনে ‘আরন্যক’ এর চাঁদ ডোবা অন্ধকারের নিঁখুত ছবি আছে, যার চোখে মানিকের ‘শ্যামা’র (জননী- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)কিংবা ‘গ্যাটস্বী’র (দ্য গ্রেট গ্যাটস্বী- স্কট ফিটজেরাল্ড) মুখ একেবারে ভাসে, সিনেমার স্কারলেট ও’হারার (গন উইথ দ্য উইন্ড- মার্গারেট মিচেল) জামার লেস এর রঙ বইয়ের সাথে মিললে যে খুশি হয়ে ওঠে, সেইসবের সাথে না মিললে যে বিষনয়নে অমিলগুলি দ্যাখে। অতএব, সাধারণতঃ আমি যে বইটা পড়েছি, তার চিত্ররূপ দেখতে বসিনা, আমার বড় কোঁদল শুরু হয় ডিরেক্টরের সাথে।
সে আমি দেখবোনা দেখবোনা করে বসে বসে ‘সমাপ্তি’ দেখে ফেললাম। রবিঠাকুরের ছোটগল্প, সত্যজিত রায়ের স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি।
‘সমাপ্তি’ আমার খুব প্রিয় ছোটগল্প। শেষদৃশ্যে যে আসলে মৃণ্ময়ীই অন্ধকার ঘরে অপূর্বকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়- এটা বুঝে অল্পবয়েসে বেশ রোমাঞ্চ হয়েছিল আমার মনে আছে।ঘোর শ্রাবণমাসে গল্পের শুরু।আমার মনে আছে এই যূগল লুকিয়ে মৃণ্ময়ীর বাপের কর্মক্ষেত্রে যাবার সময় নদীর একটা বর্ণনা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ- “কী মুক্তি, কী আনন্দ। দুইধারে কত গ্রাম, বাজার, শস্যক্ষেত্র, বন”। আর তার ভেতর দিয়ে শিশুর মত উৎসাহী স্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে অপূর্ব তিলের নৌকাকে তিসির নৌকা, পাঁচবেড়েকে রায়নগর আর মুন্সেফের আদালতকে জমিদারি কাছারি হিসেবে চিনিয়ে দিচ্ছে। সিনেমায় সেই নদীপথে যাত্রা নাই, সেই কুশীগঞ্জের বাপের কাছে যাওয়া নাই, সেই দু’দিনের খেলাঘর না থাকলে স্বামী মৃন্ময়ীর কাছে সহনীয় হয়ে ওঠে কী করে!
প্রথমেই আমি হোঁচট খাই, অপূর্বর নাম অমূল্য কেন? যে অপূর্ব মৃন্ময়ীকে বিয়ের জন্যে পছন্দ করেছিল বলে গাঁয়ের লোকে তার নাম দিয়েছিল ‘অপূর্ব-পছন্দ’ তার অমূল্য হয়ে লাভ কী? (‘নষ্টনীড়’এর চারুবালা যখন সত্যজিতের হাতে চারুলতা হয়েছিল, নাহয় তার একখানা ওজর ছিল-যে, দু’খানা নামের রূপকল্প আলাদা।)
সমাপ্তির পটভূমি লিখতে গিয়ে যদ্দুর মনে পড়ে, রবীন্দ্রনাথ একটি কোঁকড়াচুলের সবল-পরিপুষ্ট মেয়ের কথা লিখেছেন- ঘাটের রমনীরা নিত্যিদিন তার দস্যিপনার গল্প করতো- একদিন সকলকে আশংকা আর মঙ্গলভাবনায় ভাসিয়ে মেয়েটি শ্বশুরবাড়ি চলে যায়- ঘাটের মেয়েরা ভাবতে বসে- চিরস্বাধীনা সেই মেয়েটি সংসারের পীড়া সইতে পারবে তো! যে দেশে ব্যাধ নাই, বিপদ নাই, সেদেশের সরল হরিণশিশুর জায়গায় অপর্ণা দাশগুপ্তকে অনেক বেশী চর্চ্চিত লাগে, অনেক বেশী ফিল্টার্ড।
ছবিখানা সত্যজিতের বলেই হয়তো গভীর মনোযোগিতার ডিটেইল বারবার আমাদের চোখ কেড়ে নেয়, আমরা সাগ্রহে দেখি মৃন্ময়ী রুষ্ট মুখে ‘পতির পূণ্যে সতীর পূণ্য’ সেলাই করছে, বালিকা বধূর গায়ে সেকালের সোনালী চক্র দেয়া বেনারসী আর মুক্তোর কান, দেখতে পাই রাতের নদীর পাড় ধরে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলা রানার, তার হাতে বর্শা- পায়ে ঘুঙুর।
অপূর্ব এবং মৃন্ময়ীর কথোপকথনও সত্যজিত আমূল বদলে দিয়েছেন (“যদি বল, পুরাতন এই কথাগুলো-/আমিও যে পুরাতন সেটা নাহি ভুলো”…রবীন্দ্রনাথ) , তাতে মহাকবির আশ্চর্য কাব্যময়তা হারিয়ে গেছে, মৃন্ময়ীর কৈশোর তার জেদ বজায় রেখেছে কিন্তু স্বচ্ছতা হারিয়েছে, উৎসুক-প্রেমার্থী যুবক স্বামীটি পরিণত হয়েছে আরেকখানা ‘পদি-পিসী’তে, সে মৃন্ময়ীকে সামাজিক শিক্ষা দিতে শুরু করেছে।গল্পের অপূর্ব মৃন্ময়ীকে ভূলুন্ঠিত দেখে সস্নেহে ডাকে- জানায়- রাখাল তার সাথে খেলতে এসেছে, আর সিনেমার অমূল্য মৃন্ময়ীকে আছড়ে ফেলা বইগুলি উঠিয়ে রাখতে আদেশ করে। এখানে একটিও সূত্র নেই যাকে অবলম্বন করে কিশোরী বধূ অনবধানে ভেবে নিতে পারে, স্বামী তার মিত্র, সকল প্রতিকূল সামাজিক হৃদয়হীনতার ভিতর স্বামীর হৃদয় তার সহায়-তার চেনা রথতলা।
ভিক্টোরিয়ান রবীন্দ্রনাথ অনেকদিনের হাস্যবাধায় অসম্পন্ন চুম্বনের চেষ্টাকে চোখের জলে ভেসে হলেও পরিপ্লুত হতে দিয়েছিলেন, রক্ষণশীল সত্যজিত সেদিক মাড়াননি। সদ্যবিবাহিতা মৃন্ময়ীর অসম্ভব প্রতিক্রিয়া দেখে একপর্যায়ে হঠাৎ করে মনে হয়, এর নির্দেশক ফেমিনিজমের অঙ্কুরোদগম ও বিস্ফার দেখেছেন, কিন্তু শেষ অব্দি সে গলবস্ত্র হয়ে স্বামীকে প্রণাম করে (কোথায় গলা জড়িয়ে চুমু খাওয়া আর কোথায় গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম!)।
রবীন্দ্রনাথের মৃন্ময়ী কোলকাতায় চলে আসে স্বামীর সাথে দেখা হবার আশায়, প্রিয়কে চাইবার এবং প্রিয়জন অব্দি পৌঁছবার মানবিক অধিকারচর্চ্চা থেকে সেকালেও রবীন্দ্রনাথ তাকে বঞ্চিত করেননি। সত্যজিতের মৃন্ময়ী গাছে চড়তে দড় বটে, সে থাকে শালগ্রামশিলার মতন স্থানু, স্বামী স্বয়ং মায়ের অসুখের খবর পেয়ে গ্রামে ফেরত আসেন। রবীন্দ্রনাথের মৃণ্ময়ী বেদনায়-প্রেমে-একান্তে নারী হয়ে ওঠে, সত্যজিতের মৃন্ময়ীও নারী হয়ে ওঠে, কিন্তু এ ‘সামাজিক’ নারী, এতদিনে তার পায়ে লোহার জুতো ঠিকঠাকমতন ঢোকে। এ যেন দুষ্ট গরুর আপন মর্জিতে গোয়ালের দড়ি পরবার গল্প, নারীর আত্ম-আবিষ্কারের স্বগতঃ প্রক্রিয়া এবং নিজের ভিতর প্রেম আবিষ্কার করবার পীড়া দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে আন্তরিক ছবি এঁকেছিলেন তা ছাঁটাই-বাছাই এর ঘোরে কাটা পড়েছে, মাঝ থেকে মরতে হয়েছে চরকী নামের একটা কাঠবেড়ালিকে(রবীন্দ্রনাথের মৃন্ময়ীর ব্যথার উপলব্ধি জাগ্রত হয়- যে ব্যথা কৈশোর থেকে যৌবনকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়, সত্যজিতের মৃন্ময়ীর ব্যথার ব্যাপ্তি নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়, মনে হয় তার কৈশোর এক্ চরকীর বদলে আরেক চরকী পেয়েছে কেবল!)।
এইখানে অনেক কথা থাকে, লেখক যেমন সার্বভৌম, নির্দেশকও তেমনি বটেন। একের স্বরাজ মেনে নিলে অন্যেরটা মানতে দোষ কী? ‘ইংলিশ পেশেন্ট’ উপন্যাস হিসেবে যেমন, সিনেমা হিসেবে তার থেকে ভীষণভাবে আলাদা নয় কী? সবিনয়ে জানাই, এ কেবল মুগ্ধপাঠকের জবানি ধরে নিন, ট্রান্সক্রিয়েশন-তার ব্যাকরণ-তার সীমানা-তার আর্ষপ্রয়োগ বিষয়ে বিশদ আলোচনা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়।
‘হাউন্ড অভ বাস্কারভিল’ সিনেমায় (পিটার কুশিং অভিনীত) রূপায়নের সময় স্টেপল্টনের স্ত্রীকে নির্দেশক কন্যা বানিয়ে দিয়েছিলেন। যিনি একবার মুগ্ধ হয়ে ‘হাউন্ড অভ বাস্কারভিল’ পড়েছেন, তিনি নিজের স্ত্রীকে বোন হিসেবে পরিচয় দেয়া স্টেপল্টনকে ভুলতে পারবার কথা নয়। স্ত্রীকে যে অবিবাহিতা সহোদরা এবং যৌন-টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে উদ্যত হয়, সে গভীর শঠতার বিবর থেকে উঠে আসা মানুষ, সকলকে দিয়ে এইরকম প্রতারণা সম্ভব নয়, এই অতলান্তিক অমানুষিকতাই তো স্টেপল্টনকে চিনিয়ে দেবার মূলমন্ত্র, উপন্যাসের ‘স্ত্রী’কে কন্যা বানিয়ে দিলে সেই মাত্রার হানি হয়।দুর্বৃত্ত তার আশ্চর্য দুষ্টবুদ্ধি ও হৃদয়হীনতার আবেদন হারায়।
গ্রানাডা প্রোডাকশন্স এর ‘শার্লক হোমস’ কে লোকে আজও ভুলতে পারেনা, তার কারণ জেরেমী ব্রেট এর অসম্ভব আনুগত্য, আর্থার কোনান ডয়েল এর ‘হোমস’ এর প্রতি।ব্রেট একখানা ডায়েরি রাখতেন, তাতে হোমসের চারিত্র লিখতেন বসে বসে, সম্ভাব্য চারিত্রিক লক্ষণও। এইখানে প্রশ্ন আসে, আমূল আনুগত্য দেখতে চাইলে বইটা পড়ে নিলেই হয়, সিনেমা দেখতে বসা কেন? সিনেমা মাধ্যম হিসেবে ভিন্ন, গল্পের জগতকে ত্রিমাত্রায় এনে দেয়, তাতেই তার প্রথম জাদু। লেখক যা নিঁখুত করে গড়েছেন, অজস্র পাঠক যাকে ভিত্তি করে অন্তর্গত বিভ্রমের জগত রচেছেন, তাকে এমন করে বদল করে দেয়া- যাতে মূলসুর বদলে যায়, তার আন্তর ঐশ্বর্য অপচিত হয়, তা কতটা উচিত? বার্নার্ড শ্লিংক এর ‘দ্য রীডার’ এ কেবল হ্যানা তার কিশোর প্রেমিককে বেড়াতে গিয়ে চাবুক মারেনা, এছাড়া বইখানা আক্ষরিকভাবেই অনুসরণ করে সিনেমাটা বানানো হয়েছে। এমনিতেই তো ভিসুয়াল মাধ্যমে উপন্যাসের কত কী বাদ পড়ে যায়, যেমন- হ্যানার কন্ঠায় সর্বদা কাচা কাপড়ের পরিষ্কার ঘ্রাণ পাওয়া যেত, দীর্ঘ কারাবাসের পর তার গায়ে কেবল বুড়োমানুষের গায়ের মনখারাপ করা গন্ধ পাওয়া যায়- এই ঘ্রাণের পৃথিবী শ্লিংকের নিজের, তা সিনেমায় অনুদিত হয়নি, সম্ভব নয়। আবার সিনেমায় যেমন করে চৌবাচ্চার জলের ধোঁয়া আর কলের কুলকুল দেখানো যায়, বন্ধ জানালার বাইরে ট্রেনের চলে যাবার আলো আর গর্জন অনুভব করা যায়- তা বইয়ের অভিজ্ঞতাকে আরেক মাত্রায় নিয়ে আসে।
প্রসঙ্গান্তরে আসি একটু, রবিশঙ্কর ‘বৈজু বাওরা’ সিনেমার গান প্রসঙ্গে বলেছিলেন- গানগুলি নওশাদ সাহাব সুর দিয়েছেন চমৎকার, সে গানগুলি ব্যবসাসফলও হয়েছে, কিন্তু আপনি কী ভাবতে পারেন, বেঠোফেন এর জীবনকে ভিত্তি করে রচিত সিনেমায় অন্যকোনো শিল্পীর রচিত সিম্ফনি বাজাচ্ছেন বেঠোফেন? তাহলে বৈজু বাওরা কেন নওশাদের সুরে গান করছেন? এইখানে ক্লাসিক এর প্রসঙ্গ আসে, ক্লাসিকের মর্যাদাবোধের প্রসঙ্গ আসে।
মনে আসে, বোধহয় দীলিপকুমার রায়কেই গায়কের গায়কী বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছিলেন (অবিকল মনে নেই বলে উদ্ধৃতি দেয়া গেলনা)। যা তাঁর সৃষ্টি, তা তাঁর মতন করেই সাধন-পালন করা উচিত, সে গান হোক আর গদ্য; যাঁর অন্যসৃষ্টির ইচ্ছা, তিনি যেন জন্ম দিয়ে গড়ে নেন।
মনে হয়, এই আপাতঃ-আত্মম্ভরিতার কারণ আছে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৯ comments
মুয়িন পার্ভেজ - ২৩ মার্চ ২০১০ (৩:৩৪ অপরাহ্ণ)
সাগুফতা, সুন্দর বিশ্লেষণের জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনার বিবরণ প’ড়ে সত্যজিৎ রায়ের ‘সমাপ্তি’ দেখার উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম সত্যি! নার্গিস আক্তারের নির্মীয়মাণ চলচ্চিত্র ‘অবুঝ বউ’-এর নায়িকাও ‘সমাপ্তি’-র মৃন্ময়ী — ‘ছাঁটাই-বাছাই এর ঘোরে কাটা পড়েছে’ কি না কিছু, দেখা যাবে।
মনে আছে, আমাদের গ্রামের খালপাড়ে ব’সে প্রথম পড়েছি ‘সমাপ্তি’ গল্পটি, সমবয়েসি জ্যাঠাতো ভাই আবদুল হাইয়ের সঙ্গে। সে চতুর্থ শ্রেণি থেকে চ’লে গিয়েছিল মাদ্রাসায়, পিতৃনির্দেশে, কিন্তু তার মন প’ড়ে থাকত ইস্কুলের বইখাতার দিকে। এখন সুদক্ষ হাফেজ হলেও তার বাংলাজ্ঞান চমৎকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত সুপুষ্ট গল্প সংকলন হাতে নিয়ে আমরা বসতাম খালপাড়ে; ‘সমাপ্তি’ ছাড়াও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘টোপ’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ বা নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘রস’ আস্বাদন ক’রে কেটে যেত দুপুর-বিকেল — চারটি গল্পেরই যে পটভূমি গ্রামবাংলা! ‘সমাপ্তি’র শেষদৃশ্যটি আমাদের মতো সদ্যযুবার পক্ষে ছিল ‘আকাশভরা সূর্যতারা’র চিরবিস্ময় :
Rashid Amin - ২৩ মার্চ ২০১০ (১০:২০ অপরাহ্ণ)
লেখাটি বেশ ভালো লাগলো। সাহিত্যের চিত্রায়ন নিয়ে চমত্কার একটি আলোচনা উস্কে দিতে পারে। বিভূতির পথের পাঁচালী পড়ে আমার প্রথম প্রশ্নটি জেগেছিল। মনে হচ্ছিল আমার কৈশোরের আত্মজীবনী পড়ছি। পথের পাঁচালী যেন প্রত্যেক বাঙালীর কৈশো্রের আত্মজীবনী, নিজের মতো করে কৈশো্রের স্মৃতির আকাশগুলোতে ভেসে বেড়ানো। সত্যজিৎ এর পথের পাঁচালী নিঃসন্দেহে অসাধারন সৃষ্টি। তবু উপন্যাসের চিত্রায়নে কিছু কথা থেকেই যায়। যেন দুই ভুবনের বাসিন্দা। সবচেয়ে হতাশ হয়েছি রবীন্দ্রনাথের পোষ্ট মাষ্টারের চিত্রায়ন দেখে। গল্পটি পাঠ করে মানসপটে যা ভেসে উঠেছিল তার যেন কিছুই পেলাম না। বিশেষ করে গল্পের শেষ সংলাপটি যা নাকি একটি বড় দার্শনিক সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে, তার কোন প্রতিফলনই পেলাম না, অর্থাৎ এই জগতে কে কাহার…………।
ব্লাডি সিভিলিয়ান - ২৪ মার্চ ২০১০ (১:৫৬ অপরাহ্ণ)
নিতান্তই অকারণ বিনয় মনে হচ্ছে, কারণ, পুরো পোস্ট জুড়ে আপনি সত্যজিতের সাহিত্যনির্ভর সৃষ্টি এবং তার অসারতা সম্পর্কে দারুণ তুলোধুনো করে গেছেন।
আপাতত একটা কথাই বলি।
‘চারুলতা’ বানানোর পর সত্যজিতের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগের মধ্যে একটা মূল অভিযোগ ছিল তিনি রবীন্দ্রনাথের গল্পের হুবহু চলচ্চিত্রায়ন বা চিত্রায়ন করেন নি। আপনার অভিযোগটাও একই রকমের।
‘বিষয়: চলচ্চিত্র’ প্রবন্ধে তিনি এর একটা জবাব দিয়েছিলেন, যা আমার মনে হয় পড়া থাকলেও আবারো সবার একটু পড়া উচিত। তাহলে হয়তো আপনার নিচের প্রশ্নের মূল জবাবটা কিছুটা পেতে পারেন।
ধন্যবাদ।
অ.ট.:@ লেখক: বিরামচিহ্নের পরে স্পেস-বারে সম্ভব হলে একটিবার আঘাত করুন।
@ মুয়িন: ছবিটা না হয় একবার দেখেই নিলেন। খুব বেশি সময় লাগে না। তারপরই না হয় বিচার করলেন।
নীড় সন্ধানী - ২৫ মার্চ ২০১০ (১০:০৬ পূর্বাহ্ণ)
‘সমাপ্তি’ গল্পটা আগে পড়া থাকলে ‘সমাপ্তি’ ছবিটা দেখে একটু হোঁচট খেতেই হয়। সাহিত্যের প্রকাশ আর চলচ্চিত্রের প্রকাশের মধ্যে বরাবর একটা দুরত্ব থাকে। সাহিত্যকে হুবহু চলচ্চিত্রে রূপান্তর আদৌ সম্ভব না। অতো ডিটেলস চলচ্চিত্রে আনা সম্ভব নয়। আমার জানামতে কেউ পারেনি। সাহিত্যের স্থান চলচ্চিত্রের উর্ধ্বেই থেকে যায় বরাবর। তবে সত্যজিতের ছবিটা দেখার সময় রবিঠাকুরের সমাপ্তিকে ভুলে থাকতে পারলে বোধহয় মনোকষ্ট কম হতো। সত্যজিতের ছবিগুলো দেখার সময় আমি তাই করি। চলচ্চিত্রে ভাষাকেই খুঁজি তখন আমি, সাহিত্যের ভাষা নয়। লেখক এক কলমের খোচায় যে রূপক হাজির করতে পারে, চলচ্চিত্রকারের ক্যামেরায় সেই রূপক ধারন করা বেশ কঠিন।
তবে যে হোঁচট আপনি খেয়েছেন বা আমি খেয়েছি সেটিও উতরে যাবে যদি সমাপ্তির আরো নিকৃষ্ট সংস্করন দেখেন। আমি সত্যজিতের সমাপ্তিকে দেখে যেটুকু দুরত্ব মেপেছিলাম বাংলাদেশের এক নির্মাতার হাতে তৈরী একখানা ‘সমাপ্তি’ দেখে বমন উদ্রেক ঘটার পর সত্যজিতের সমাপ্তির বিচ্যুতিগুলোকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
আপনার চমৎকার রিভিউর জন্য অনেক ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ মুনিম - ২৬ মার্চ ২০১০ (১২:৪৫ পূর্বাহ্ণ)
সত্যজিৎ রায়তো সাহস দেখিয়ে চুমুর ব্যাপারটা দেখিয়েছেন, ঘরে বাইরে ছবিতে, তবে মুশকিল হয়েছে এর ফলে আমার চুমুর ব্যাপারটাই মনে আছে, আর কিছু নেই। বার তিনেক দেখেছি, কখন চুমু আসবে, কখন চুমু আসবে, এই ভাবনাতে অন্যান্য ব্যাপারগুলোতে মন দিতে পারিনি। সমাপ্তিতে চুমু দেখাননি বটে, তবে সশব্দে দরজা বন্ধ হয়ে গেল, সেটা দেখানো হয়েছে। অন্ধকারের চুমু কি ছবিতে দেখানো যায়? বাতি না জ্বললে তো ছবিই উঠবে না। মৃম্ময়ী বাতি জ্বালিয়ে চুমু দিলে তিনি কি সেটা দেখাতেন? রবীন্দ্রনাথের মৃম্ময়ীও সেটা করতো না। করলে সেটা আর মহৎ সাহিত্য থাকতো না।
গল্পটির একটা pivotal ব্যাপার ছিল, মৃম্ম্যয়ীর বালিকা থেকে নারী হয়ে ঊঠা। সেটা সত্যজিৎ দুটি ক্লোসআপেই দেখিয়েছেন, মৃম্ম্যয়ী পাশ ফিরে শুয়ে, তার মুখের ক্লোস আপ, বালিকা মৃম্ম্যয়ী, সে অন্যদিকে পাশ ফিরল, আরেক ক্লোস আপ, নারী মৃম্ম্যয়ী, সেই একই তের বছরের অপর্ণা সেন। মেকাপে কি সূক্ষ্ম পরিবর্তন করেছেন আর অপর্ণার ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনে কি পরিবর্তন আনতে বলেছেন, বুঝতে পারিনি। অপর্ণার প্রথম কাজ, একজন নবিশকে দিয়ে এই ব্যাপারটা করার মুরোদ কি খুব বেশী ডিরেক্টরের আছে?
সমাপ্তি নিয়ে বিটিভিতে নাটক হয়েছিল, আশির দশকের শেষে বা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, সে নাটকে অপুর্বের মা প্রচন্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, মৃম্ম্যয়ীর সাথে প্রথম দেখায় বললেন, “নাম কি?” মৃন্ময়ী বলল “কার নাম? আমার?” অপূর্বের মা বললেন “না, আমার”। সে নাটকে মৃন্ময়ী হয়েছিলেন, মেঘনা অথবা লুবনা নামের বছর পঁচিশের এক অভিনেত্রী, ব্যাপারটা তাই তেমন জমেনি।
বাংলা সিনেমা, মানে যেগুলোকে আমরা ‘ভালো’ বাংলা সিনেমা বলি, চিরকালই সাহিত্যনির্ভর, সেটা হয়েছে কোন মহান কারণে নয়, যে বইয়ের কাটতি বেশী, সেটা নিয়ে ছবি তৈরি করে ব্যাবসা করা। যে কারনে ষাটের আর সত্তরের দশকে গৃহবধুরা ‘ছবি’ দেখতেন না, ‘বই’ দেখতেন। যাই হোক, সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রের মুশকিলটা হয়েছে পাঠক বইটা পড়ে নিজের মত করে ব্যাপারটা দেখেন, ডিরেক্টরকেও বইটা পড়তে হয়, তিনি যা দেখেন সেভাবেই ছবিটা তৈরি করেন। পাঠক বইটা পড়ে যেভাবে দেখেন সেটা ছবিতে না দেখলেই অভিযোগ করেন, ডিরেক্টর বইটা বুঝতে পারেননি, বা বুঝলেও ব্যাপারটা পর্দায় আনতে পারেননি, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার মত গাধা পাঠক, যারা পড়ার জন্যই পড়ে, তাদের কথা আলাদা, ডিরেক্টর যা দেখান, সেভাবেই দেখে, যা বোঝান, সেভাবেই বোঝে। আমি সমাপ্তি পড়েছি বুয়েটের ক্লাস শুরুর আগে আগে, গল্পগুচ্ছের অংশ হিসাবে। পড়াটা কোন রবীন্দ্র প্রেম থেকে নয়, বুয়েটে ক্লাস শুরু হবে, ক্লাসের কোন মেয়ে যদি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলাপ শুরু করে, তখন তো মান থাকবে না, সেই ভয় থেকেই পড়া। স্কুলে কিছু ফরাসী সাহিত্য পড়েছি, আর তো কিছু পড়িনি। এতো চাপ নিয়ে হুড়মুড় করে পড়লে তো আর উনিশ শতকের গ্রাম বাংলার ব্যাপারটা দেখা হয় না, সেটা নিয়ে আমার তেমন কোন আগ্রহও নেই। তবে মৃম্ম্যয়ীর বাবা ঈশানের “সেই দ্বিগুণ নিরানন্দ সংকীর্ণ ঘরের মধ্যে ফিরিয়া গিয়া দিনের পর দিন, মাসের পর মাস নিয়মিত মাল ওজন করিতে লাগিল” এটা পড়ে ব্রিটীশদের উপরে খুব রাগ হয়েছিল।
সমাপ্তি দেখি বড় পর্দায়, বুয়েটের অডিটোরিয়ামে, সেই প্রথম ‘দেখা’, উনিশ শতকের গ্রাম বাংলা, শহুরে বাবু অপুর্বের (বা অমুল্যের) কাঁদায় আছড়ে পরে নাজেহাল হওয়া, অপুর্বের মা নিরুপমা (ডাক নাম খেঁদী), বালিকা মৃম্ম্যয়ীর বালিকা থেকে নারী হয়ে ঊঠা আর অপূর্বের পেলব বাবু থেকে শক্ত সমর্থ পুরুষ হয়ে ঊঠা। সত্যজিতের চোখেই দেখা, গুরু ‘মানিকদা’ যেভাবে দেখাবেন সেভাবেই দেখা।
অপুর্ব কেন অমুল্য হয়ে গেল, সত্যজিৎ এ ব্যাপারে কি ব্যাখ্যা দিয়েছেন? জানি না। সম্ভবত এই জন্য যে আমার মত গাধারা যাতে পথের পাঁচালী, অপরাজিত আর অপুর সংসারের অপুর্বের সাথে গুলিয়ে না ফেলি। রবীন্দ্রনাথ আর বিভুতিভুষন দুজনের নিজের নিজের অপু ছিল, সত্যজিত একসাথে দুটো অপু পোষাতে পারবেন না, তাই এই অপুর নামে পরিবর্তন হয়ে গেল। আর অপুর্বের মা সেকেলে ধরনের বৃদ্ধা, তিনি তাঁর ছেলেকে অপু বলছেন সেটা ঠিক মানায় না।
সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়ন কখনো মুল সাহিত্যকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না, এমন একটা ধারণা আছে। চলচ্চিত্রের পরিচালরাই বিনয় করে সেটা বলেন, আমি চেষ্টা করেছি মাত্র ফুটিয়ে তোলার, ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে একজন পরিচালক দেখেছি, অত ভদ্রতার ধার ধারেন না। তিনি হলেন নিয়ামত ভাই (শেখ নিয়ামত আলী)। কমলাপুর স্টেশনের কাছাকাছি এক ফ্ল্যাটে তাঁর নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসার। তিনটি মোটে ছবি করেছেন, সারা জীবন খেটেখুটে, এফডিসি ভাঙ্গাচোরা ল্যাবেই করেছেন। তাঁকে একদিন সাহস করে বললাম, সূর্য্য দীখল বাড়ি করে আপনাদের (তিনি এবং মশিউদ্দিন শাকের) এত নামডাক, মুল উপন্যাসিক আবু ইসহাকের তো তেমন নামডাক শোনা যায় না। তিনি তো টিভিতে একবার বলেছেন “স্রষ্টাকে কেউ মনে রাখে না”। নিয়ামত ভাই বললেন তুমি পড়েছ মূল উপন্যাসটা? আমি পড়িনি, বলাই বাহুল্য। তিনি বললেন সত্যি কথা বলতে কি সেটা এমন কিছু মহৎ উপন্যাস নয়। আমি আর শাকের মিলে সেটাকে ছবি বানিয়েছি ব্যাপক পরিশ্রম করে, কঙ্কালে মাংস লাগিয়ে মানুষ তৈরি করেছি।
সাগুফতা শারমীন তানিয়া - ২৯ মার্চ ২০১০ (৫:৫১ অপরাহ্ণ)
@ ব্লাডি সিভিলিয়ান, “আমার মতন পাঠকের আদৌ সাহিত্যনির্ভর সিনেমা দেখা উচিত কিনা, এই নিয়ে আমার দ্বিধা আছে,” বিনয়টা এখানে নয়, এখানে (সবিনয়ে জানাই, এ কেবল মুগ্ধপাঠকের জবানি ধরে নিন)।
@নীড় সন্ধানী, “চলচ্চিত্রের ভাষাকেই খুঁজি তখন আমি, সাহিত্যের ভাষা নয়”- ডেভিড লীন চার্লস ডিকেন্সের যতগুলি উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ করেছেন, তাতে চলচ্চিত্রের ভাষা তুমুলভাবে উপস্থিত। একটা ভীত কুকুরের কুঁই-কুঁই করে গুটিয়ে যাওয়া দেখিয়ে যেভাবে তিনি জানিয়েছেন- ঘরের ভিতর ন্যান্সীকে হত্যা করা হচ্ছে (অলিভার টুইস্ট), তা সিনেমার ইতিহাসে প্রায় অতুলনীয়। কিন্তু ডিকেন্স এবং তাঁর ‘আপন আঁধার’ এই অ্যাডাপ্টেশনগুলিতে সাংঘাতিকভাবে উপস্থিত। চলচ্চিত্রকার নিজের ছন্দে-ভাষায় গল্প বলে যান, তাতে ডিকেন্সের পরিচয় অঘা দর্শকের কাছেও গোপন থাকেনা, ডেভিড লীনকেও দিব্যি চেনা যায়।
লেখক রবার্ট হ্যারিসের ডায়েরীর একাংশে রোমান পোলানস্কি সম্পর্কে একটা অংশ আছে, তুলে দিলাম- “His (Roman Polanski’s) basic instinct, unlike that of most directors, is basically literary. He wants to keep as much of the novel as he can, and gets annoyed if I suggest cutting lines. How many times do I have to tell you? The novel is the screenplay! Don’t f*** with success!”
পিটার জ্যাকসন ‘দ্য লর্ড অভ দ্য রিংস’ তৈরী করবার সময় বারবার বইটা পড়বার জন্যে সেটে বিরতি নিতেন, এলফদের কুমারী কন্যার সাথে আরাগনের প্রেম কেবল তাঁর আমদানি, গল্পের অসম্ভব যুদ্ধ-দামামাকে সহনীয় করে তুলবার জন্যে, হয়তো তিনিও জেনেছেন- দ্য নভেল ইজ দ্য স্ক্রীনপ্লে।
@মোহাম্মদ মুনিম, মেঘনা অভিনীত সুবর্ণা নির্দেশিত সেই নাটকটা আমার দেখা হয়েছিল, কী অদ্ভূত, অপূর্বর মা প্রতিবেশীর মেয়ের নাম জিজ্ঞেস করছেন, আরো অদ্ভূত ছিল মৃন্ময়ী অপূর্বর জুতা ফেরত দিয়েছিল বড়শীতে বা কঞ্চিতে বিঁধিয়ে অপূর্বর নাকের ডগায় ঝুলাতে ঝুলাতে।
আর “পাঠক বইটা পড়ে যেভাবে দেখেন সেটা ছবিতে না দেখলেই অভিযোগ করেন, ডিরেক্টর বইটা বুঝতে পারেননি, বা বুঝলেও ব্যাপারটা পর্দায় আনতে পারেননি, ইত্যাদি ইত্যাদি।” এর জবাবে একটা পেইন্টিং এর কথা মনে পড়ে গেল, শ্যাগালের ‘ট্রায়াম্ফ অভ মিউজিক’, অডিটোরিয়ামের ঢাকনা খুলে গিয়ে একসময় একটি শূণ্যস্থানে গিয়ে পারফর্মার আর অডিয়েন্সের হৃদয় এসে মেশে, বিস্ফোরিত হয়।সেই জায়গাটায় আসতে পারলে পাঠক কোন্দল করেনা, প্রণত হয়।
মোহাম্মদ মুনিম - ২৯ মার্চ ২০১০ (৭:৩৮ অপরাহ্ণ)
@সাগুফতা শারমীন তানিয়া
‘Triumph of music’ এর খবরের জন্য অনেক ধন্যবাদ। ব্যাপারটা কি তাহলে এমন যে শিল্প একটা fluid ব্যাপার, যেকোন শিল্পকেই music এ কনভার্ট করা যায়। একটা মহৎ সাহিত্যকর্মকে music এ কনভার্ট করে সেটাকে চিত্ররুপ দিতে পারলেই পাঠক আর ডিরেক্টরের মাঝে কোন্দলটা আর থাকে না।
ইমতিয়ার - ১ এপ্রিল ২০১০ (৪:২৪ পূর্বাহ্ণ)
ব্রোকেন এমব্রেসেস-এর শেষ দৃশ্যে মাতিওকে বলতে শুনেছিলাম :
কারণ বোধহয় এই, কোনও কোনও সৃষ্টির চেয়ে সৃষ্টির পরিভ্রমণটাই বড় হয়ে ওঠে। যদিও সব কথাই শেষ কথা নয়, শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে…
সাগুফতা শারমীন তানিয়া - ১ ফেব্রুয়ারি ২০১১ (৭:০৮ অপরাহ্ণ)
গতরাতে নীরদ সি চৌধুরীর লেখা পড়ছিলাম, তাঁর কিছু উক্তি উদ্ধৃতি দেবার লোভ সামলালামনা। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি ছোটগল্পকে তিনি সেরা মনে করেন, কঙ্কাল, একরাত্রি, জীবিত ও মৃত, মধ্যবর্তিনী, সমাপ্তি, মেঘ ও রৌদ্র, নিশীথে, মানভঞ্জন, অতিথি, মণিহার, দৃষ্টিদান, নষ্টনীড়। তাঁর মতে- এই বারোটি গল্পের মধ্যে আটটি বাংলার জলের সহিত সংশ্লিষ্ট, কতকগুলি জল ভিন্ন দাঁড়াইত না…
গোরাতে স্টীমারের উপরে বিনয়কে নিদ্রিত দেখে ললিতার প্রেমভাব জাগ্রত হয়, একটু একটু করে শিশিরসঞ্চারের মতন করে, নীরদবাবুর জবানিতে- আগেকার অসারহৃদয়া মৃন্ময়ীর মনে ভালবাসার আবির্ভাবের প্রতীকও সেই বাংলার নদী, বর্ষা ও মেঘ।
(এইবেলা মৃন্ময়ীর জলযাত্রা না দেখতে পেয়ে আমার কেন ক্ষুন্নিবৃত্তি হয় নি সেটা বুঝতে পাই।)
সমাপ্তি নামটা দিয়েই নীরদবাবু প্রশ্ন করেছেন- কিসের সমাপ্তি? (হাস্যবাধায় অসম্পূর্ণ চেষ্টার, নিশ্চয়ই)
আর বলছেন- গল্পের পুরা বিস্তার যাই হউক, উহার দীপ্ত শিখা একটি চুম্বনের ইতিহাস। একদিন উহা সমাপ্ত হয় নাই, অবশেষে গভীর অন্ধকারে সমাপ্ত হইয়াছিল। এই প্রসঙ্গে চুম্বন লইয়া আর একটি বিখ্যাত গল্পের কথা মনে হইবে। সেটি অন্ধকারে আরম্ভ হইয়াছিল, কিন্তু কখনই শেষ হয় নাই। সেই অসমাপ্ত এবং অসমাপ্য চুম্বনের জন্য লেফটেন্যন্ট রিয়াবোভিচের জীবন একটা অর্থহীন, লক্ষ্যহীন পরিহাসে পরিণত হইয়াছিল। সমাপ্তিতে সেই অসমাপ্ত চুম্বন সমাপ্তি লাভ করিয়া, যাহারই প্রাণ আছে তাহারই কাছে চির উচ্ছলিত সুখের উৎস হইয়া রহিয়াছে।
এইটে পড়ে এবং শেখভের দ্য কিস এর প্রসংগ আসায় কালকে অত্যন্ত আনন্দ পেয়েছি। আমার বড় প্রিয় গল্প। অন্ধকারে রিয়াবোভিচকে কে চুমু খেয়েছিল, সেই প্রশ্ন নিয়ে সে একটি মনোরম বিভ্রাটে এক বছর কাটিয়ে দেয়, একটি বছর একটি অন্ধকারের চুমুকে কেন্দ্রে রেখে নৃত্যপর হয়ে ঘুরে আসে। এই এক বছর পরে অকূস্থলে এসে তার মনে হয়- কেউ আসলেই কি তাকে চুমু খেয়েছিল? অফেরতযোগ্য অগম্য অতীতে কেউ যা হারায় তা কী কোনোভাবে আর পুনরাভিনীত হয়? সমাপ্তিতে কেন চুম্বন দেখানো হলো না এই হাহাকার করেছি, এটা বলার চেষ্টা করা হয়েছে- যা অনুচিত এবং ভুল হবে, চুম্বন কেন্দ্র করে যে গল্প- তার শাঁস কেড়ে নেয়া হলে তার কতটা বাকি থাকে তাই ছিল আমার জিজ্ঞাস্য। আর জলযাত্রার সজলতা কেড়ে নিলে যে এইসব গল্পের মূলচরিত্র বদলে যায়, শান বাঁধানো ভুঁইয়ে যে মৃন্ময়ীর প্রণয়োদ্গম সম্ভব নয়, সেটাও আমার অনেক আগে আরও কেউ বোধ করেছেন, সেটা জেনে বড় আনন্দ হলো।