আমার মতন পাঠকের আদৌ সাহিত্যনির্ভর সিনেমা দেখা উচিত কিনা, এই নিয়ে আমার দ্বিধা আছে [..]

আমার মতন পাঠকের আদৌ সাহিত্যনির্ভর সিনেমা দেখা উচিত কিনা, এই নিয়ে আমার দ্বিধা আছে, যার মনে ‘আরন্যক’ এর চাঁদ ডোবা অন্ধকারের নিঁখুত ছবি আছে, যার চোখে মানিকের ‘শ্যামা’র (জননী- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)কিংবা ‘গ্যাটস্বী’র (দ্য গ্রেট গ্যাটস্বী- স্কট ফিটজেরাল্ড) মুখ একেবারে ভাসে, সিনেমার স্কারলেট ও’হারার (গন উইথ দ্য উইন্ড- মার্গারেট মিচেল) জামার লেস এর রঙ বইয়ের সাথে মিললে যে খুশি হয়ে ওঠে, সেইসবের সাথে না মিললে যে বিষনয়নে অমিলগুলি দ্যাখে। অতএব, সাধারণতঃ আমি যে বইটা পড়েছি, তার চিত্ররূপ দেখতে বসিনা, আমার বড় কোঁদল শুরু হয় ডিরেক্টরের সাথে।

সে আমি দেখবোনা দেখবোনা করে বসে বসে ‘সমাপ্তি’ দেখে ফেললাম। রবিঠাকুরের ছোটগল্প, সত্যজিত রায়ের স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি।
‘সমাপ্তি’ আমার খুব প্রিয় ছোটগল্প। শেষদৃশ্যে যে আসলে মৃণ্ময়ীই অন্ধকার ঘরে অপূর্বকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়- এটা বুঝে অল্পবয়েসে বেশ রোমাঞ্চ হয়েছিল আমার মনে আছে।ঘোর শ্রাবণমাসে গল্পের শুরু।আমার মনে আছে এই যূগল লুকিয়ে মৃণ্ময়ীর বাপের কর্মক্ষেত্রে যাবার সময় নদীর একটা বর্ণনা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ- “কী মুক্তি, কী আনন্দ। দুইধারে কত গ্রাম, বাজার, শস্যক্ষেত্র, বন”। আর তার ভেতর দিয়ে শিশুর মত উৎসাহী স্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে অপূর্ব তিলের নৌকাকে তিসির নৌকা, পাঁচবেড়েকে রায়নগর আর মুন্সেফের আদালতকে জমিদারি কাছারি হিসেবে চিনিয়ে দিচ্ছে। সিনেমায় সেই নদীপথে যাত্রা নাই, সেই কুশীগঞ্জের বাপের কাছে যাওয়া নাই, সেই দু’দিনের খেলাঘর না থাকলে স্বামী মৃন্ময়ীর কাছে সহনীয় হয়ে ওঠে কী করে!

প্রথমেই আমি হোঁচট খাই, অপূর্বর নাম অমূল্য কেন? যে অপূর্ব মৃন্ময়ীকে বিয়ের জন্যে পছন্দ করেছিল বলে গাঁয়ের লোকে তার নাম দিয়েছিল ‘অপূর্ব-পছন্দ’ তার অমূল্য হয়ে লাভ কী? (‘নষ্টনীড়’এর চারুবালা যখন সত্যজিতের হাতে চারুলতা হয়েছিল, নাহয় তার একখানা ওজর ছিল-যে, দু’খানা নামের রূপকল্প আলাদা।)

সমাপ্তির পটভূমি লিখতে গিয়ে যদ্দুর মনে পড়ে, রবীন্দ্রনাথ একটি কোঁকড়াচুলের সবল-পরিপুষ্ট মেয়ের কথা লিখেছেন- ঘাটের রমনীরা নিত্যিদিন তার দস্যিপনার গল্প করতো- একদিন সকলকে আশংকা আর মঙ্গলভাবনায় ভাসিয়ে মেয়েটি শ্বশুরবাড়ি চলে যায়- ঘাটের মেয়েরা ভাবতে বসে- চিরস্বাধীনা সেই মেয়েটি সংসারের পীড়া সইতে পারবে তো! যে দেশে ব্যাধ নাই, বিপদ নাই, সেদেশের সরল হরিণশিশুর জায়গায় অপর্ণা দাশগুপ্তকে অনেক বেশী চর্চ্চিত লাগে, অনেক বেশী ফিল্টার্ড।

ছবিখানা সত্যজিতের বলেই হয়তো গভীর মনোযোগিতার ডিটেইল বারবার আমাদের চোখ কেড়ে নেয়, আমরা সাগ্রহে দেখি মৃন্ময়ী রুষ্ট মুখে ‘পতির পূণ্যে সতীর পূণ্য’ সেলাই করছে, বালিকা বধূর গায়ে সেকালের সোনালী চক্র দেয়া বেনারসী আর মুক্তোর কান, দেখতে পাই রাতের নদীর পাড় ধরে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলা রানার, তার হাতে বর্শা- পায়ে ঘুঙুর।

অপূর্ব এবং মৃন্ময়ীর কথোপকথনও সত্যজিত আমূল বদলে দিয়েছেন (“যদি বল, পুরাতন এই কথাগুলো-/আমিও যে পুরাতন সেটা নাহি ভুলো”…রবীন্দ্রনাথ) , তাতে মহাকবির আশ্চর্য কাব্যময়তা হারিয়ে গেছে, মৃন্ময়ীর কৈশোর তার জেদ বজায় রেখেছে কিন্তু স্বচ্ছতা হারিয়েছে, উৎসুক-প্রেমার্থী যুবক স্বামীটি পরিণত হয়েছে আরেকখানা ‘পদি-পিসী’তে, সে মৃন্ময়ীকে সামাজিক শিক্ষা দিতে শুরু করেছে।গল্পের অপূর্ব মৃন্ময়ীকে ভূলুন্ঠিত দেখে সস্নেহে ডাকে- জানায়- রাখাল তার সাথে খেলতে এসেছে, আর সিনেমার অমূল্য মৃন্ময়ীকে আছড়ে ফেলা বইগুলি উঠিয়ে রাখতে আদেশ করে। এখানে একটিও সূত্র নেই যাকে অবলম্বন করে কিশোরী বধূ অনবধানে ভেবে নিতে পারে, স্বামী তার মিত্র, সকল প্রতিকূল সামাজিক হৃদয়হীনতার ভিতর স্বামীর হৃদয় তার সহায়-তার চেনা রথতলা।

ভিক্টোরিয়ান রবীন্দ্রনাথ অনেকদিনের হাস্যবাধায় অসম্পন্ন চুম্বনের চেষ্টাকে চোখের জলে ভেসে হলেও পরিপ্লুত হতে দিয়েছিলেন, রক্ষণশীল সত্যজিত সেদিক মাড়াননি। সদ্যবিবাহিতা মৃন্ময়ীর অসম্ভব প্রতিক্রিয়া দেখে একপর্যায়ে হঠাৎ করে মনে হয়, এর নির্দেশক ফেমিনিজমের অঙ্কুরোদগম ও বিস্ফার দেখেছেন, কিন্তু শেষ অব্দি সে গলবস্ত্র হয়ে স্বামীকে প্রণাম করে (কোথায় গলা জড়িয়ে চুমু খাওয়া আর কোথায় গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম!)।
রবীন্দ্রনাথের মৃন্ময়ী কোলকাতায় চলে আসে স্বামীর সাথে দেখা হবার আশায়, প্রিয়কে চাইবার এবং প্রিয়জন অব্দি পৌঁছবার মানবিক অধিকারচর্চ্চা থেকে সেকালেও রবীন্দ্রনাথ তাকে বঞ্চিত করেননি। সত্যজিতের মৃন্ময়ী গাছে চড়তে দড় বটে, সে থাকে শালগ্রামশিলার মতন স্থানু, স্বামী স্বয়ং মায়ের অসুখের খবর পেয়ে গ্রামে ফেরত আসেন। রবীন্দ্রনাথের মৃণ্ময়ী বেদনায়-প্রেমে-একান্তে নারী হয়ে ওঠে, সত্যজিতের মৃন্ময়ীও নারী হয়ে ওঠে, কিন্তু এ ‘সামাজিক’ নারী, এতদিনে তার পায়ে লোহার জুতো ঠিকঠাকমতন ঢোকে। এ যেন দুষ্ট গরুর আপন মর্জিতে গোয়ালের দড়ি পরবার গল্প, নারীর আত্ম-আবিষ্কারের স্বগতঃ প্রক্রিয়া এবং নিজের ভিতর প্রেম আবিষ্কার করবার পীড়া দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে আন্তরিক ছবি এঁকেছিলেন তা ছাঁটাই-বাছাই এর ঘোরে কাটা পড়েছে, মাঝ থেকে মরতে হয়েছে চরকী নামের একটা কাঠবেড়ালিকে(রবীন্দ্রনাথের মৃন্ময়ীর ব্যথার উপলব্ধি জাগ্রত হয়- যে ব্যথা কৈশোর থেকে যৌবনকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়, সত্যজিতের মৃন্ময়ীর ব্যথার ব্যাপ্তি নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়, মনে হয় তার কৈশোর এক্ চরকীর বদলে আরেক চরকী পেয়েছে কেবল!)।

এইখানে অনেক কথা থাকে, লেখক যেমন সার্বভৌম, নির্দেশকও তেমনি বটেন। একের স্বরাজ মেনে নিলে অন্যেরটা মানতে দোষ কী? ‘ইংলিশ পেশেন্ট’ উপন্যাস হিসেবে যেমন, সিনেমা হিসেবে তার থেকে ভীষণভাবে আলাদা নয় কী? সবিনয়ে জানাই, এ কেবল মুগ্ধপাঠকের জবানি ধরে নিন, ট্রান্সক্রিয়েশন-তার ব্যাকরণ-তার সীমানা-তার আর্ষপ্রয়োগ বিষয়ে বিশদ আলোচনা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়।
‘হাউন্ড অভ বাস্কারভিল’ সিনেমায় (পিটার কুশিং অভিনীত) রূপায়নের সময় স্টেপল্টনের স্ত্রীকে নির্দেশক কন্যা বানিয়ে দিয়েছিলেন। যিনি একবার মুগ্ধ হয়ে ‘হাউন্ড অভ বাস্কারভিল’ পড়েছেন, তিনি নিজের স্ত্রীকে বোন হিসেবে পরিচয় দেয়া স্টেপল্টনকে ভুলতে পারবার কথা নয়। স্ত্রীকে যে অবিবাহিতা সহোদরা এবং যৌন-টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে উদ্যত হয়, সে গভীর শঠতার বিবর থেকে উঠে আসা মানুষ, সকলকে দিয়ে এইরকম প্রতারণা সম্ভব নয়, এই অতলান্তিক অমানুষিকতাই তো স্টেপল্টনকে চিনিয়ে দেবার মূলমন্ত্র, উপন্যাসের ‘স্ত্রী’কে কন্যা বানিয়ে দিলে সেই মাত্রার হানি হয়।দুর্বৃত্ত তার আশ্চর্য দুষ্টবুদ্ধি ও হৃদয়হীনতার আবেদন হারায়।

গ্রানাডা প্রোডাকশন্স এর ‘শার্লক হোমস’ কে লোকে আজও ভুলতে পারেনা, তার কারণ জেরেমী ব্রেট এর অসম্ভব আনুগত্য, আর্থার কোনান ডয়েল এর ‘হোমস’ এর প্রতি।ব্রেট একখানা ডায়েরি রাখতেন, তাতে হোমসের চারিত্র লিখতেন বসে বসে, সম্ভাব্য চারিত্রিক লক্ষণও। এইখানে প্রশ্ন আসে, আমূল আনুগত্য দেখতে চাইলে বইটা পড়ে নিলেই হয়, সিনেমা দেখতে বসা কেন? সিনেমা মাধ্যম হিসেবে ভিন্ন, গল্পের জগতকে ত্রিমাত্রায় এনে দেয়, তাতেই তার প্রথম জাদু। লেখক যা নিঁখুত করে গড়েছেন, অজস্র পাঠক যাকে ভিত্তি করে অন্তর্গত বিভ্রমের জগত রচেছেন, তাকে এমন করে বদল করে দেয়া- যাতে মূলসুর বদলে যায়, তার আন্তর ঐশ্বর্য অপচিত হয়, তা কতটা উচিত? বার্নার্ড শ্লিংক এর ‘দ্য রীডার’ এ কেবল হ্যানা তার কিশোর প্রেমিককে বেড়াতে গিয়ে চাবুক মারেনা, এছাড়া বইখানা আক্ষরিকভাবেই অনুসরণ করে সিনেমাটা বানানো হয়েছে। এমনিতেই তো ভিসুয়াল মাধ্যমে উপন্যাসের কত কী বাদ পড়ে যায়, যেমন- হ্যানার কন্ঠায় সর্বদা কাচা কাপড়ের পরিষ্কার ঘ্রাণ পাওয়া যেত, দীর্ঘ কারাবাসের পর তার গায়ে কেবল বুড়োমানুষের গায়ের মনখারাপ করা গন্ধ পাওয়া যায়- এই ঘ্রাণের পৃথিবী শ্লিংকের নিজের, তা সিনেমায় অনুদিত হয়নি, সম্ভব নয়। আবার সিনেমায় যেমন করে চৌবাচ্চার জলের ধোঁয়া আর কলের কুলকুল দেখানো যায়, বন্ধ জানালার বাইরে ট্রেনের চলে যাবার আলো আর গর্জন অনুভব করা যায়- তা বইয়ের অভিজ্ঞতাকে আরেক মাত্রায় নিয়ে আসে।

প্রসঙ্গান্তরে আসি একটু, রবিশঙ্কর ‘বৈজু বাওরা’ সিনেমার গান প্রসঙ্গে বলেছিলেন- গানগুলি নওশাদ সাহাব সুর দিয়েছেন চমৎকার, সে গানগুলি ব্যবসাসফলও হয়েছে, কিন্তু আপনি কী ভাবতে পারেন, বেঠোফেন এর জীবনকে ভিত্তি করে রচিত সিনেমায় অন্যকোনো শিল্পীর রচিত সিম্ফনি বাজাচ্ছেন বেঠোফেন? তাহলে বৈজু বাওরা কেন নওশাদের সুরে গান করছেন? এইখানে ক্লাসিক এর প্রসঙ্গ আসে, ক্লাসিকের মর্যাদাবোধের প্রসঙ্গ আসে।
মনে আসে, বোধহয় দীলিপকুমার রায়কেই গায়কের গায়কী বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছিলেন (অবিকল মনে নেই বলে উদ্ধৃতি দেয়া গেলনা)। যা তাঁর সৃষ্টি, তা তাঁর মতন করেই সাধন-পালন করা উচিত, সে গান হোক আর গদ্য; যাঁর অন্যসৃষ্টির ইচ্ছা, তিনি যেন জন্ম দিয়ে গড়ে নেন।
মনে হয়, এই আপাতঃ-আত্মম্ভরিতার কারণ আছে।

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

9 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
9
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.