বুদ্ধদেব বসুর জন্মশতবর্ষ : অন্য মূল্যায়ন

তাঁর জন্মশতবর্ষে এসে উত্তরসূরিদের এ কথা স্বীকার করা প্রয়োজন, বুদ্ধদেব বসুর ঋণ শোধ করার যোগ্যতা এককভাবে আমরা এখনো খুব বেশি অর্জন করতে পারিনি। কারণ তিনি বাংলা কবিতার এমন এক আশ্চর্য চিরনতুন শিক্ষক, যার কাছ থেকে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন আমাদের খুব সহজে ফুরোবে না। বাংলাদেশে কবির সংখ্যা চিরকালই বেশি, উত্তম কবির সংখ্যাও সুপ্রচুর। অথচ কবিতার খাঁটি শিক্ষকের সংখ্যা নগণ্য। এর কারণ হয়তো এই, কবিরা তাদের পাঠ, দেখা, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যা কিছু অর্জন করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কেবল তাদের কবিতার ভেতর দিয়েই প্রকাশ করেন। ক্বদাচিৎ গদ্যচর্চা করলেও, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, তাদের মধ্যে কবিতার মতো সমান বা তীব্র সাধনা খুব কম ক্ষেত্রেই দৃষ্টিগোচর। কিংবা কবির গদ্য হয়তো অনেক ক্ষেত্রে তার চিন্তার সেই অবশেষ, যা তিনি কবিতায় প্রকাশ করতে পারেন না বলে গদ্যের আশ্রয় নেন। অথবা সেগুলো হয়তো উপলরক্ষের লেখা।

কিন্তু কবি বুদ্ধদেব বসুর শিল্পচর্চার অপরাপর মাধ্যমও যে সমান তীব্র এর প্রকৃষ্ট প্রামাণ্য তার প্রবন্ধ ও অনুবাদসকল। তিনি তার কবিতার সমান তাড়না নিয়েই অসামান্য সব গদ্য লিখেছেন এবং অসম্ভব সুন্দর বহু অনুবাদ করেছেন। আমরা যখন তার অনুবাদে বোদলেয়ারের বিস্ময়কর সব পঙ্ক্তিগুচ্ছ পাঠ করি :

বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালোবাসো তুমি?
আমি ভালোবাসি মেঘ…চলিষ্ণু মেঘ…ঐ উঁচুতে… ঐ উঁচুতে…
আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল!
অথবা,
আক্ষেপ, আক্ষেপ শুধু! সময়ের খাদ্য এ-জীবন,
যে-গুপ্ত শত্রুর দাঁতে আমাদের জীবনের ক্ষয়
বাড়ায় বিক্রম তার আমাদেরই রক্তের তর্পণ।

কিংবা হ্যেল্ডার্লিন থেকে :
তবে এসো, মধুর, কোমল সুপ্তি! হৃদয়ের অভিলাষ
অত্যধিক, অসম্ভব। কিন্তু শেষে, হে যৌবন, অস্থির, স্বপ্নিল,
তুমিও হারাবে তাপ, আর ধীরে বার্ধক্য আমাকে
দেবে শান্তি, সান্ত্বনা, বিরাম।

কিংবা রিলকে থেকে :

পাতা ঝরে, পাতা ঝরে, শূন্য থেকে ঝ`রে প`ড়ে যায়,
যেন দূর আকাশে বিশীর্ণ হ`লো অনেক বাগান;
এমন ভঙ্গিতে ঝরে, প্রত্যাখ্যানে যেন প্রতিশ্রুত।
এবং পৃথিবী ঝরে প্রতি রাত্রে গতিপথচ্যুত,
নত্রশৃঙ্খল ছিঁড়ে– নিঃসঙ্গতায়।

আমরাও ঝ`রে যাই। এই হাত– তাও পড়ে ঝ`রে।
দ্যাখো অন্য সকলেরে : সকলেই এর অংশীদার।

কিংবা পাস্তারনাক থেকে :

তোমার কঠিন পণ ভালোবাসি আমি,
আমার ভূমিকার অভিনয়ে আছি সম্মত।
কিন্তু এবার এক ভিন্ন পালা শুরু হ`লো;
এই একবারের মতো দাও আমাকে নিষ্কৃতি।

কিন্তু অঙ্কগুলির পারম্পর্য অনড়
আর পথের শেষ আমাকে মুক্তি দেবে না;
নিঃসঙ্গ আমি; সব ডুবে গেলো ধর্মান্ধের শঠতায়।
মাঠ পেরোনোর মতো সহজ নয় বেঁচে থাকা।

তখন এইসব অসামান্য ও সপ্রাণ পঙ্ক্তিগুচ্ছ আমাদের এমনভাবে আচ্ছন্ন, প্লাবিত, মুগ্ধ করে যে, মনে হয় কোথায় অনুবাদ, কোথায় বোদলেয়ার, হ্যেল্ডার্লিন, রিলকে বা পাস্তারনাক– এ যেন কবি বুদ্ধদেব বসুরই এক অন্তর্গত প্রগাঢ় স্বর। এর কারণ সম্ভবত একটাই, বুদ্ধদেব অনুবাদেও তার কবির চৈতন্যকেই বহাল রেখেছেন। নিজের কবিতার জন্য তিনি যে অপত্য স্নেহ লালন করেন, অন্য ভাষার, সুদূরের, অন্য সময়ের কবির কবিতার প্রতিও একই মমত্ব পোষণ করেন। আর এটা বড় পষ্টভাবেই অনুভব করা যায় তার করা অনুবাদ বইগুলির ভূমিকাসকল পাঠ করলে (যেমন : কালিদাস, বোদলেয়ার, হোল্ডারলিন, রিলকে)। এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলা জরুরি, বুদ্ধদেব বসু যে সময়ের কবির কবিতাই অনুবাদ করুন না, কবিতার বিষয়মূলকে অক্ষুন্ন বা অ-ব্যাহত রেখেও, তিনি বাংলায় এর রূপ দিয়েছেন তার সমকালীন ও নিজস্ব কাব্যভাষায়। ফলে, তার কবিতা ও অনুবাদ হয়ে উঠেছে অনেকটা সমার্থবোধক। এ প্রসঙ্গে তার নিজেরই এক ধরনের স্বীকারোক্তি রয়েছে কোনো এক গদ্যে, যেখানে তিনি বলেছেন, যখন দিনের পর দিন কবিতা লিখতে পারতেন না, তখন, তার স্বভাবজাত সৃষ্টিতাড়না, অনুসন্ধান ও পাঠস্বভাবহেতু, ভিনভাষী কবিদের কবিতার রস আস্বাদন করতেন এবং কখনো-সখনো অনুবাদ করতেন। এগুলোও অনেকটা তার নিজস্ব কাব্যবন্ধ্যাকালেরই সৃষ্টি, কিন্তু এগুলোর উৎস আর অজ্ঞাত বা অদৃশ্য বহুমাত্রিক উপাদান নয়, বরং তার পূর্বজ ভিনভাষী কবিদেরই সৃষ্টি। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কোনো কোনো একচক্ষু অধ্যাপক-সমালোচক মনে করেন, তার নিজের কবিতাও নাকি অনেকাংশে এসব কবিতারই অবশেষমাত্র। তবে এমত ধারণার নেপথ্যে বুদ্ধদেব নিজেও খানিকটা দায়ী। কারণ, তিনি অনুবাদেও এত বেশি নিখুঁত, সযত্ন, সহৃদয় আর বাঙালি যে, যদি ওইসব কবির নিজদেশী উপাদান, চরিত্র ও পুরাণকে তিনি যথাযথ ব্যবহার না করতেন তাহলে অনেক ক্ষেত্রে এগুলোকেও তার নিজের কবিতা বলেই চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু যেহেতু আমরা এখনো পর্যন্ত পশ্চিমকেই উন্নত ও শ্রেষ্ঠতর বলে ভাবি, তাই আমাদের অজান্তেই বুদ্ধদেবকে ছোট করে দেখি। তার সৃষ্টিশীলতা, নিষ্ঠা ও সততার কথা আমাদের মনেই থাকে না। অথচ তিনি তার প্রতিটি অনুবাদ-বইয়ে যেভাবে ভূমিকা ও টীকাভাষ্য দিয়েছেন, সেগুলোর জন্য যে ধরনের মেধা ও শ্রম তাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে, তার দিকে নজর দিলেই টের পাওয়া যায় তাকে কী অসাধ্যসাধন করতে হয়েছে। তবে প্রভাবের কথা বলতে হলে এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, তিনি ঋণ কেবল পশ্চিম থেকেই নেননি, তার মতো সর্বভূক শিল্পসাধক আধুনিক-প্রাচীন, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সবখান থেকেই তার অন্তর্জগৎ সমৃদ্ধ করেছেন। সেক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ও বৈশ্বিক বাস্তবতার কারণেই ইউরোপ থেকে তার গ্রহণের পরিমাণটা বেশি। কিন্তু এই কূপমণ্ডুক জাতির ক্ষেত্রে তার যে ভূমিকা তা হলো তিনি নিজেকেই কেবল ঋদ্ধ করেননি, নিজ ভাষায় নিজ জাতির জন্য সেগুলো আমৃত্যু দু হাতে অকৃপণভাবে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। এবং নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছেন বাংলা কবিতার প্রগাঢ় শিক্ষক। কারণ বুদ্ধদেব বসুর ব্যাপারটা এমন নয় যে, তিনি মাস্টারির দায়িত্ব নিয়ে জাতিকে উদ্ধারের মিশন গ্রহণ করেছিলেন (যদিও তিনি পেশাগতভাবেও জীবনের অনেকটা সময় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক! বরং বলা উচিত, ভারতবর্ষে একাডেমিকভাবে তুলনামূলক সাহিত্যচর্চার সূচনা হয়েছে তারই নেতৃত্বে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে)।
আসলে তার এই শিক্ষক হওয়ার ব্যাপারটিও ছিল অনেকটা প্রাকৃতিক ঘটনার মতো। `প্রাকৃতিক’ এই অর্থে যে, প্রকৃতির যে সূত্রে তিনি কবি, সে অর্থেই তিনি কবিতারও শিক্ষক। এ দায়িত্ব তাকে কেউ অর্পণ করেনি, কিংবা তিনি যে শিক্ষকতা করছেন এই মাস্টারি-মনোভাব নিয়েও তিনি কবিতার শিক্ষকতা করতে নামেননি। বরং বিশ্বকবিতার বিস্তীর্ণ সমুদ্রে তার যে স্বভাবজাত স্নান ও ডুব দেওয়া এবং সেখান থেকে তার যে নিবিড় আহরণ, এবং পরবর্তীকালে উত্তরপুরুষের জন্য সহৃদয়হৃদয়সংবাদী করে উপস্থাপনার যে দৃষ্টিভঙ্গি, এটিই তাকে পরিণত করেছে এক গভীরতর শিক্ষকে।

কবিতা যে কেবল ভাব দিয়ে রচিত হয় না, একটি কবিতার কবিতা হয়ে উঠার জন্য যে অনেকগুলো অভাব মেটাতে হয়, এ কথাটি এই একুশ শতকে এসেও অনেকে বুঝতে চান না। আবার কবিতার জন্য যে শিক্ষা ও দীক্ষা প্রয়োজন এটিও কবি ও পাঠক উভয়েই বিস্মৃত হয়ে পড়েন। শিল্পকলার অপরাপর মাধ্যম যেমন : সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা ইত্যাদির ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও লেখালেখির, কবিতার স্কুল আমাদের দেশে ছিল না কোনোকালে। কিন্তু স্কুল থাক বা না থাক, না থাক প্রশিক্ষণশালা, যে জাতির রবীন্দ্রনাথ আছে, যার মধ্যে অতীত ও আগামীর অপূর্ব মিলন ঘটেছে, যিনি শুধু শিল্প-সাহিত্য-চিন্তার এক গভীর সমুদ্র ছিলেন না, বরং স্বজাতির জন্য খুব সহজ করে সেসব উপস্থাপনও করে গেছেন, সেখানে কোনো স্কুলের দরকারও তো হয় না। সেগুলো একটু কষ্ট করে আগ্রহ নিয়ে পাঠ করলেই তো হয়ে যায়। এর বাইরে প্রাচীন-নতুন অপরাপর জ্ঞান-চিন্তা-তত্ত্ব তো আছেই। আমাদের দুর্ভাগ্য, এখনো সে অজ্ঞানতার আঁধার গেল না। আশ্চর্য ব্যাপারটা হলো, এই আক্ষেপ প্রায় সত্তর বছর আগে (১৯৩৮ সালে) বুদ্ধদেব বসু তার এক লেখায় যেভাবে করেছেন, আজও প্রায় একই ভাষায় আমাদেরও আক্ষেপটা করতে হয় (দ্রষ্টব্য : `লেখার ইস্কুল’, কালের পুতুল)। এবং এর ফল এই যে, বুদ্ধদেব বসুর মতো দ্রষ্টা-শিক্ষকের কাছে আমাদের ঋণ ক্রমাগত বেড়ে চলে।

এর মানে এই নয় যে, আমরা বুদ্ধদেব বসুদের পর আর এগোইনি। বরং বাংলা কবিতা আরো বহু দূর বিস্তৃত হয়েছে। তার অনেক শাখা-প্রশাখা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই যে অগ্রগতি (যদিও তা প্রশ্নাতীত নয়, এবং আমাদের কবিতা, বিশেষত তিরিশ ও এর পরবর্তী মূলধারার কবিতায় পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ নিয়ে যে বিতর্ক, তার কথা মনে রেখেও), তার নেপথ্যে যদি কাউকে যথাযথ শিক্ষকের অভিধা দিতে হয়, তাহলে তা নিশ্চিতভাবেই দিতে হবে বুদ্ধদেব বসুকে। রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কবিতাকে যেমন নতুন সম্ভাবনায়, চিন্তায়, ভাষায় আরো উত্তুঙ্গতায় পৌঁছে দিয়ে জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতার নতুন দরোজা খুলে দিয়েছেন, আর সেই দরোজায় তার সমসাময়িক ও উত্তরকালের কবি-সমালোচক-পাঠকের অবাধ প্রবেশ করার জন্য যিনি সবচে বেশি জীবনপাত করেছেন তিনি বুদ্ধদেব বসু। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে দেড় দশক আগে উচ্চারিত বাংলা কবিতার নীরব সাধক পঞ্চাশের দশকের কবি আজীজুল হকের একটি মৌখিক উক্তি : তিরিশের কবিতা যে আজকের বাংলা কবিতার মূলধারা, তা যতটা সে সময়ের কবিদের কবিতার জন্য, ততটাই এর সপক্ষে বুদ্ধদেব বসুর মতো কবি-গদ্যকারদের নিরন্তর গদ্যরচনার জন্য।
আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ করি, যখন এমনকি রবীন্দ্রনাথও ঠিক তাঁর প্রতিভা বুঝে উঠতে পারেননি, বরং তার কবিতা সম্পর্কে দায়সারাভাবে বললেন `তোমার কবিতায় তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে’, `শব্দ নিয়ে এত জবরদস্তি করো কেন বুঝিনে’, তখন তরুণ বুদ্ধদেব বসুই প্রাথমিক জীবনানন্দকে গভীরভাবে আবিষ্কার করলেন এবং জীবনানন্দের বহু সাহিত্যশত্রুর বিরুদ্ধে প্রায় একাকী কলম চালিয়ে তাকে সাহিত্য-অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা করেছেন। `প্রাথমিক জীবনানন্দ’, কারণ, বুদ্ধদেব বসু, পরিণত জীবনানন্দ দাশকে কখনো কখনো ভুল পাঠ করেছেন, বিশেষত, বুদ্ধদেব ধূসর পাণ্ডুলিপি-বনলতা সেন পরবর্তী জীবনানন্দর ওপর অজ্ঞাত কারণে খুব নাখোশ হয়েছিলেন এবং জীবনানন্দকে রীতিমতো আক্রমণ করে লিখেছেন। তবে পরবর্তী সময়ে আবার তিনি তার আস্থা ফিরে পেয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষণিক এই ভ্রান্তির কারণে তার অবদান খাটো হয়ে যায় না, কেননা, জীবনানন্দ দাশের জন্য তার যে একক শ্রম, তা এখনো অনেক জীবনানন্দ-গবেষকের চেয়েও বেশি এবং জীবনানন্দর কবিতার ক্ষেত্রে তার অনেক বিশ্লেষণ চিরন্তনতার মাত্রা পেয়ে গেছে।

একইভাবে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তার বহুমাত্রিক ও আবিষ্কারধর্মী নানা মূল্যায়ন অনেক ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব। তিনি যে বললেন,

`বাংলা সাহিত্যে আদিগন্ত ব্যাপ্ত হ`য়ে আছেন তিনি, বাংলা ভাষার রক্তে-মাংসে মিশে আছেন; তাঁর কাছে ঋণী হবার জন্য এমনকি তাঁকে অধ্যয়নেরও আর প্রয়োজন নেই তেমন, সেই ঋণ স্বতঃসিদ্ধ ব`লেই ধরা যেতে পারে– শুধু আজকের দিনের নয়, যুগে-যুগে বাংলা ভাষার যে-কোনো লেখকেরই পক্ষে। আর যেখানে প্রত্যভাবে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘ`টে যাবে, সেখানেও, সুখের বিষয়, সম্মোহনের আশঙ্কা আর নেই; রবীন্দ্রনাথের উপযোগিতা, ব্যবহার্যতা ক্রমশই বিস্তৃত হ`য়ে, বিচিত্র হ`য়ে প্রকাশ পাবে বাংলা সাহিত্যে।’
[`রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক`, সাহিত্যচর্চা]

এই উক্তির মধ্যে ভক্তির চেয়ে পাঠ বেশি, আবেগের চেয়ে দূরদৃষ্টি বেশি। বুদ্ধদেব ১৯৫২ সালে এই উক্তি করার পর আরো পঞ্চান্ন বছর কেটে গেছে। এখন রবীন্দ্রনাথ ক্রমশই আমাদের রক্তের গভীরের জিনিস হয়ে উঠেছেন, তাকে ছাড়া আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির কোনো কিছুই আর চলে না, যেমন করে বাতাস অদৃশ্য হলেও তাকে আমাদের অস্তিত্বের জন্যই প্রতিটি মুহূর্তে প্রয়োজন হয়।

বুদ্ধদেবের ভাষার এমন এক মাধুর্য আছে, আছে এমন এক পেলবতা আর অক্ষরবৃত্তিক গতি, এর মোহ কাটানো বড় মুশকিল। যদিও অনেক সমালোচক তার ভাষার কমনীয়তা ও রমণীয়তা নিয়ে বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন, কিন্তু তারা বোধহয় এই কথাটি ভুলে যান যে, এই ভাষার গুণেই তিনি আমাদের প্রতি শিক্ষকতাটি প্রকৃষ্টভাবে করতে পেরেছেন। কারণ, ভাষার এই গুণটি তার না থাকলে আমাদের বঞ্চনার পরিমাণ বৃদ্ধি ছাড়া কমত না এবং তার ভাষার স্বাদই আমাদের এমন এক জগতে নিয়ে যায়, যা ছাড়া ওই বিষয়গুলোতে হয়তো আমাদের আগ্রহই জন্মাতো না।
খটখটে পাণ্ডিত্য জিনিসটি হয়তো বুদ্ধদেব বসুর ধাতে কখনোই সইত না। তাই বিষয় যত কঠিনই হোক, বোঝা ও অনুভব করার গুণে সেগুলো তার ভাষায় বাংলাদেশের জল-হাওয়া-মাটির মতোই সহজ ও সজল হয়ে প্রকাশিত হতো, এই মাটির সন্তান হওয়ার কারণে স্বভাবেও আসলে তিনি ছিলেন এমনটিই। এর একটি চমৎকার উদাহরণ, ১৯৫২ সালে রচিত তার একটি বিশ্লেষণী ও আত্মউপলব্ধিমূলক গদ্য `হেমন্ত’ (সঙ্গ-নিঃসঙ্গতা : রবীন্দ্রনাথ)। লেখাটিতে আমরা দেখি, বাংলার একটি অবহেলিত ঋতু বিষয়ে লিখতে গিয়ে তিনি লিখেছেন বাংলার ঋতুগুলোরই সজীব ইতিহাস। পাশাপাশি ঋতুটিকে ঘিরে তিনি প্রাচ্য-পাশ্চাত্যর প্রকৃতি-সমাজ-সাহিত্যের এক তুলনামূলক বয়ানও হাজির করেন তার অনবদ্য ভাষায় এবং ক্রমাগত নিজেকে খন্ডন করতে করতে তিনি পৌঁছতে চান এই সত্যে যে, হেমন্ত নিয়ে তিনি এতকাল যে মনোভাব পোষণ করেছেন, তা ছিল একপেশে ও খন্ডিত। এই মধ্যবয়সে এসে তিনি এর সত্যিকার রূপ সন্দর্শন করলেন।

অন্যদিকে আধুনিক বাংলা কবিতার ইউরোকেন্দ্রিকতা ও তিরিশি বিতর্কের অন্যতম অভিযুক্ত নায়ক বুদ্ধদেব বসু। তাকে আক্রমণ করা সহজ, কেননা এই তাত্ত্বিক লড়াইয়ের জন্য নানাভাবে তিনিই সবচেয়ে বেশি উপাদান আমাদের যোগান দিয়ে গেছেন। তাদের পাঁচ নায়কের মধ্যে, তিনিই সাহিত্যের সব শাখায় ছিলেন সবচেয়ে সক্রিয়। ফলে তাকে সবচেয়ে সহজে পাওয়া যায়। বুদ্ধদেব বসুরা যে আধুনিকতা বাংলা কবিতায় আমদানি করেছেন, তা ইউরোপীয় আধুনিকতা। তার যে সময় ও নগরচেতনা তারও কেন্দ্রে আছে ইউরোকেন্দ্রিকতা। রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে যাওয়ার নামে তারা দ্বারস্থ হয়েছেন পশ্চিমের কাছে এবং সেখানকার বহু উপাদান অবলীলায় বাংলা কবিতায় আমদানি করেছেন এই ভূগোলের মাটি-মানুষ-শেকড় ও ঐতিহ্যের কথা ভুলে গিয়ে। ফলে তিরিশ ও এর পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতা, হয়ে উঠেছে, বাংলা ভাষায় রচিত ইউরোপীয় কবিতা। অভিযোগ সঠিক হলেও এ উক্তি যেরকম মোটা দাগে উচ্চারিত হয়, ব্যাপারটা এত স্থূলভাবে দেখার মধ্যে একটু সমস্যা আছে। এই দায় কতটা তাদের, পরবর্তীকালের কবিরাই বা এ থেকে উত্তরণের জন্য কী করেছেন এবং এই সময়ের কবিতাই বা কতটা মোহমুক্ত ও শেকড়সংলগ্ন হতে পেরেছে, এসবেরও প্রকৃত বিচার করা কর্তব্য।

কিন্তু এই তত্ত্বজটিল প্রসঙ্গটি অন্যত্র আলোচনার জন্য তুলে রেখে এবং ইতিহাসের এই দায় থেকে তাদের মুক্তি না দিয়েও বুদ্ধদেব বসুর সপক্ষে কিছু সাধু কথা উচ্চারণ করা বাস্তবসঙ্গত ও ন্যায়োচিত।

বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রে উপনিবেশিত হওয়া অনেকটা নিয়তির মতো, যে নিয়তির আগ্রাসনে একদিন ইউরোপই ইউরোপের আগ্রাসনের শিকার হয়েছিল (যেমন : জার্মানদের মধ্য থেকে ইংরেজদের পত্তন, ফরাসি জাতির ইংল্যান্ড আগ্রাসন, ইংল্যান্ডের আয়ারল্যান্ড দখল। গ্রিক-রোমান সভ্যতার চিন্তা ও ভাষাগত আধিপত্য। আপাতত তোলা থাক অন্য মহাদেশে তাদের দখল-হত্যা-লুণ্ঠন এবং সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ভাষিক আধিপত্যর কথা।)। কিন্তু এতো সব নেতি উপাদানের পরও ইউরোপ থেকে তিনি যে শৈল্পিক-মানবিক গুণগুলো আত্মীকৃত করেছেন, সেগুলোর মূল্য না দিলেও বড় ধরনের অবিচার করা হবে। বুদ্ধদেব বসু অন্ধ ইউরোপপন্থি ছিলেন না, বরং গ্রহণ-বর্জনের মাত্রাজ্ঞান তার কী মাত্রার ছিল, তার জন্য তার মেঘদূত বইটির ভূমিকাই উৎকৃষ্ট সাী। পরন্তু শিল্পের স্বয়ম্ভুতা, যুক্তির বোধ ও তুলনামূলক বিশ্লেষণের যে তুলাদণ্ড তার প্রধান বৈশিষ্ট্য, সেজন্য ইউরোপীয় আধুনিকতার প্রতি তার আগ্রহকে আমরা বরং খানিকটা শ্রদ্ধা জানাতে পারি। কারণ, প্রত্যক্ষ উপনিবেশ লোপ পেলেও আমাদের মনোজগৎ এখনো পশ্চিমা উপনিবেশের দখলে। আজও মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা আমাদের যথেষ্ট কম ও নিজস্ব জ্ঞান-ঐতিহ্য-সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের চেতনবোধও পশ্চিম থেকেই আমদানিকৃত। যথেষ্ট পরিমাণ ইংরেজি জানা এবং ততটাই কম মাতৃভাষা জানা আমাদের শিক্ষা ও পাণ্ডিত্যর উচ্চ মানদণ্ড। অন্য ভাষার সাহিত্য ইংরেজি অনুবাদে পেলে আমরা যতটা উল্লসিত হই, সরাসরি বাংলায় অনুবাদ হলেও আমরা ততটা উৎসাহী হই না। পশ্চিমের ডিগ্রি এখনো মহার্ঘ্য ও পূজনীয় বস্তু। তাদের বহুমুখী আধিপত্য এখন বরং উপনিবেশ আমলের চেয়ে বহু গুণে বেশি। বুদ্ধদেব বসু বরং উপনিবেশকালের মানুষ হয়েও এতটা গদগদ ছিলেন না, বরং গ্রহণ-বর্জনের একটা নিজস্ব প্রক্রিয়া তার ছিল, যা পক্ষান্তরে স্বদেশ ও ভাষার পক্ষে অনেক অনুকূল ছিল। এ দিক থেকেও তিনি পরোক্ষভাবে আমাদের একজন অন্তর্গত শিক্ষক। অন্যদিকে উদারতা বুদ্ধদেব বসুর একটি বড় গুণ। যেটা যেমন ব্যক্তিগত, তেমনি শিল্পগত ক্ষেত্রেও। কারণ তিনি যেভাবে তার পূর্বসূরি বা সমসাময়িক কবিদেরই নয়, বরং উত্তরসূরি কবিদেরও ক্ষান্তিহীনভাবে মূল্যায়ন আলোচনা ও সমালোচনা করেছেন, এটা এখনকার দিনে খুব বিরল ঘটনা। বরং এখনো আমরা অনেক বেশি আত্মপর। মূল্যায়ন তো পরের কথা, সমকালীন সতীর্থদের পাঠ করতেও আমাদের অনেক অনীহা। এক্ষেত্রেও তিনি আমাদের জরুরি শিক্ষক।

রবীন্দ্রনাথের পর শিল্পের নানা মাধ্যমে এত সহজ ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ যেমন খুব কম লেখক করতে পেরেছেন, তেমনি নিরন্তর আত্মপাঠ-আত্মমূল্যায়ন-আত্মচেতনার মধ্য দিয়ে আমৃত্যু নবীন ও প্রবহমান থাকার ক্ষমতাও খুব কম লেখকেরই ছিল। রবীন্দ্র-পরবর্তীদের মধ্যে এক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুই সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব নেওয়ার বৈধ অধিকার রাখেন। অন্যদিকে, শুধু বাংলা কবিতার বিস্তার, বিকাশ ও বিশ্লেষণে তার যে সাধনা ও অবদান, এর জন্যই তিনি আমাদের চিরপূজনীয় হতে পারেন।

কিন্তু আমাদের বিস্মৃতিপ্রবণতার কারণেই হোক আর অজ্ঞানতা বা অমনোযোগের কারণেই হোক, তিনি আজও অনেকটাই অবহেলিতই রয়ে গেলেন। তাঁর জন্মের শতবর্ষ পরে এখন আমাদের সামনে এক সুবর্ণ সময় উপস্থিত হয়েছে তাকে ফিরে দেখার, মূল্যায়ন করার ও শ্রদ্ধা জানাবার। আর তা করা দরকার শাদা চোখে ও বাস্তবতার নিরিখে। কেবল ভক্তি বা বিরোধিতা দিয়ে বিচার করতে গেলে তা হবে আমাদের আত্মপ্রতারণারই আরেক প্রকাশ।

সৈকত হাবিব

কবি, সাংবাদিক।

১৫ comments

  1. প্রবীর পাল - ২০ নভেম্বর ২০০৮ (৪:১৩ পূর্বাহ্ণ)

    সৈকত হাবিব যথার্থই বলেছেন,
    বুদ্ধদেব বসু যে সময়ের কবির কবিতাই অনুবাদ করুন না, কবিতার বিষয়মূলকে অক্ষুন্ন বা অ-ব্যাহত রেখেও, তিনি বাংলায় এর রূপ দিয়েছেন তার সমকালীন ও নিজস্ব কাব্যভাষায়। ফলে, তার কবিতা ও অনুবাদ হয়ে উঠেছে অনেকটা সমার্থবোধক।
    চমৎকার সুদীর্ঘ আলোচনাটির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

    • saikat habib - ২২ নভেম্বর ২০০৮ (৮:৫৯ পূর্বাহ্ণ)

      প্রিয় প্রবীর, আপনার মন্তব্য পেয়ে খুব উদ্বুদ্ধ হলাম। এ লেখাটি বুদ্ধদেব সম্পর্কে আমার প্রাথমিক বিবেচনা। ভবিষ্যতে তাঁকে ঘিরে আরো বড় ভ্রমণের ইচ্ছা আছে। এক্ষেত্রে আপনার মতো মানুষের উৎসাহ আমার জন্য বড় প্রেরণা।
      আপনার কল্যাণ হউক।

  2. স্নিগ্ধা - ২১ নভেম্বর ২০০৮ (১:২৫ পূর্বাহ্ণ)

    বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে মুগ্ধতা কখনো কাটবে না, কাটুক সেটা চাইও না! আমি অবশ্য প্রথমতঃ তাঁর গদ্যের ভক্ত, কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান যে কতখানি তা যে কোন কবিতা পড়িয়েই জানেন! ‘কবিতা’ পত্রিকাটি তো নবীন কবিদের কাগুজে পাঠশালা ছিলো বলা যায়।

    অনেকদিন পর বু ব কে নিয়ে লেখা পড়ে খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ, সেজন্য!

    • saikat habib - ২২ নভেম্বর ২০০৮ (৯:২৭ পূর্বাহ্ণ)

      প্রিয় স্নিগ্ধা, আপনার স্নিগ্ধ মন্তব্য পড়ে খুব প্রাণিত হলাম। আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ।

  3. মাসুদ করিম - ২১ নভেম্বর ২০০৮ (১১:৫২ পূর্বাহ্ণ)

    “বাংলাদেশে কবির সংখ্যা চিরকালই বেশি, উত্তম কবির সংখ্যাও সুপ্রচুর।” ভেবে দেখুন আরেক বার, অতিশয়োক্তির চূড়ান্ত করেছেন।
    আগে ছিল এক গুরুদেব এবার আনলেন একজন শিক্ষক, বাংলার কবিরা শুধু কবি হিসেবে কখন চরম সম্মানিত হবেন?
    কিন্তু বুদ্ধদেব বসু বাংলার এক চিরকালের লেখক, একজন অনন্য শিল্পসাধক। তাকে নিয়ে আপনার অন্য মূল্যায়ন প্রচেষ্টার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

  4. saikat habib - ২২ নভেম্বর ২০০৮ (৯:৪৪ পূর্বাহ্ণ)

    শ্রদ্ধেয় মাসুদ করিম, আপনার বিবেচনাপ্রসূত মন্তব্যর জন্য ধন্যবাদ।
    যদি কিছু মনে না করেন, আমার `অতিশয়োক্তির চূড়ান্ত’ সম্পর্কে একটু খোলাসা করে বললে ব্যক্তিগতভাবে খুব উপকৃত হবো। কারণ, এক্ষেত্রে আমার অতিশয়োক্তি আছে বলে মনে হচ্ছে না।
    আপনার মন্তব্য : `আগে ছিল এক গুরুদেব এবার আনলেন একজন শিক্ষক, বাংলার কবিরা শুধু কবি হিসেবে কখন চরম সম্মানিত হবেন?’_ ঠিক পরিষ্কার হলো না। কারণ, রবীন্দ্রনাথ কবি হিসেবে সম্মানিত বলেই `গুরুদেব’ বলে পূজনীয়। আর বু ব নিজে কবি হওয়ার পাশাপাশি বাংলা কবিতার জন্য জীবনব্যাপী ভূমিকা পালনের কারণে আমার মতো নগণ্যর কাছে `কবিতার শিক্ষক’ হিসেবে শ্রদ্ধেয়।
    এখানে কবি হিসেবে চরম বা পরম মূল্যায়নের আলাদা কী মানদণ্ড আছে বা থাকা উচিত- বুঝতে পারছি না।
    আপনার মূল্যবান মতামতের মাধ্যমে নিজেকে ঋদ্ধ করতে চাই। পেলে কৃতজ্ঞ থাকব।

    • মাসুদ করিম - ৫ ডিসেম্বর ২০০৮ (৯:৫০ পূর্বাহ্ণ)

      আসলেই খুব দেরি হয়ে গেল। দু’একটা বই খোঁজার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু খুঁজে পেলাম না। একটি ফরাসী ভাষায় ‘Fleurs du mal’ আরেকটি সুনীলের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’। কারণ বলো অচেনা মানুষ অনুবাদটি সুনীলেরটি বেশ ভালো ও মূলানুগ ছিল বলেই আমার মনে হয়েছিল ৫-৭ বছর আগে। কেউ যদি সুনীলেরটি এখানে তুলে দিতে পারতেন, আমার জন্য সুবিধা হতো। বুদ্ধদেব বসুর একটি অসুবিধা ছিল, তিনি কোনোভাবেই ফরাসী দৈনন্দিন কথাবার্তার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। আর সুনীলের সুবিধা ছিল সে ফরাসী দেশে ফরাসীদের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর যা ছিল Baudelaire-এর কবিতার সাথে দার্শনিক অভিযোজনের ক্ষমতা ও চূড়ান্ত পরিশ্রমের অঙ্গীকার তার ছিটেফোঁটা সুনীলের তো নয়ই বাংলা কবিতায় আর কারো আছে কিনা আমার জানা নেই। অমঙ্গলবোধ যা Baudelaire-এর মূলসুর, তা বাংলায় একমাত্র বুদ্ধদেব বসুর হাতেই পরিণতি পেয়েছে। তাই বাংলায় Baudelaire-এর অনুবাদক বুদ্ধদেব বসু এবং এই অনুবাদ বাংলা সাহিত্যে মৌলিক সৃষ্টির মতোই প্রভাবশালী। বাংলা কবিতায় আর কেনো অনুবাদ এতো প্রভাব বিস্তার করেছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। এতো কিছুর পরও আমি তাকে কবিতার শিক্ষক বলতে চাই না, কারণ শিক্ষক শব্দের যে সুর আমার কানে বাজে সে সুরের সাথে কবিতার দূরত্ব এতোই বেশী যে দুটি শব্দ পাশাপাশি দেখতে পেয়েই আমি আতংক বোধ করেছি।

      আর গুরুদেব শব্দটির মধ্যে ভক্তির যে ঘনঘটা, কাউকে পূজনীয় বলা আমার এতোই অপছন্দের, যে গুরুদেব সংকীর্তনের আশেপাশে বসবাস আমার চির অপছন্দের।

      এসবই আমার ব্যক্তিগত বিশেষত্ব, এবং একই ভাবে “বাংলাদেশে কবির সংখ্যা চিরকালই বেশি, উত্তম কবির সংখ্যাও সুপ্রচুর” এর সাথেও আমি মোটেই একমত নই। বাংলা কবিতার তো ভালো সংকলন নেই, যেসব আছে সেসবের কলেবর দেখলেই এর একটা আন্দাজ আমাদের হয়। আর বাংলা কবিতার কবির সংখ্যা প্রতিনিয়ত যে দুর্জনেরা কাকের সাথে তুলনা করেন, সে তুলনার মধ্যে কবিতার মান নিয়ে কিছুটা হলেও সত্যকথন লুকিয়ে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর বুদ্ধদেব বসু ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ দুজনই বড় মাপের গদ্যশিল্পী। আমাদের দেশে এমন প্রচুর কবি যারা গদ্য লিখতেই জানেন না, এই এতো বেশি কবিদের কাছ থেকে যে মোটেই সুপ্রচুর উত্তম কবিতা বের হতে পারে না, এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় এমন কোনো দৃস্টান্ত নেই যে কবি পরিচয় নিয়ে চলছেন ফিরছেন কিন্তু গদ্য লিখতে জানেন না। গদ্য সবারই লিখতে পারা উচিত, কেউ কেউ কবিতা লিখুক : আমি নিশ্চিত এভাবে কবির সংখ্যা বেশি না হয়েও ভালো কবিতার কবিতার সংখ্যা বাড়বে। আর বুদ্ধদেব বসু শিক্ষক না হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গুরুদেব না হয়ে যদি আমাদের কাছে এ বিষয়ে দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠেন তাহলেই তাদের সাহিত্যসৃষ্টি আমাদের জন্য রাজটিকার কাজ করবে।

      • saikat habib - ১৪ ডিসেম্বর ২০০৮ (১১:৫২ পূর্বাহ্ণ)

        প্রিয় মাসুদ করিম, অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যর জন্য। বিলম্ব কোনো সমস্যা নয়। অন্যদিকে বেশ কদিন আমিও ব্লগে না থাকায় গতকাল পড়ার সুযোগ পেয়েছি। বিলম্বিত জবাবের জন্য দুঃখিত।
        আপনার প্রথমাংশের আলোচনা পড়ে মনে হচ্ছে, আমি করেছি অতিশয়োক্তির চূড়ান্ত আর আপনি দেখিয়েছেন ভক্তির পরাকাষ্ঠা। কারণ, বুদ্ধদেবের বোদলেয়ার বিষয়ে আপনার যে উচ্ছ্বাস, তার মধ্যে আর যা-ই হোক, নিরপেক্ষ বিচার নেই। কারণ, বুদ্ধদেবের বোদলেয়ার অনুবাদ পড়লে, অমঙ্গলবোধ যা Baudelaire-এর মূলসুর, তা অনেকটা পাওয়া গেলেও, একে খুব রোমান্টিকতা-আচ্ছন্ন বলে মনে হয়। এর নেপথ্যর যে রাজনীতি-সমাজ-সময়ের সক্রিয়তা, কবি-বোদলেয়ারের বোধ নির্মাণের ক্ষেত্রে এর যে প্রত্যক্ষ অবদান, তার কোনো গভীর ইশারা বুদ্ধদেবের আলোচনায় নেই। ব্যাপারটা নিয়ে তিনি যে খুব ভেবেছেন, তাও মনে হয় হয় না। বরং বুদ্ধদেবের সবচে বড় অক্ষমতা এই যে, তিনি শিল্প-সাহিত্যকে কেবল কলাকৈবল্য কিংবা রোমান্টিক নান্দনিকতা দিয়ে ব্যাখ্যায় আমৃত্যু সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু তার আন্তরিকতা ও সততা ছিল প্রশ্নাতীত। এছাড়া আপনি বুদ্ধদেবের অনুবাদ সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, তা নানাভাবেই আমার নিবন্ধটিতে বলা আছে।
        প্রথম প্যারার শেষে আপনি লিখছেন, `এতো কিছুর পরও আমি তাকে কবিতার শিক্ষক বলতে চাই না, কারণ শিক্ষক শব্দের যে সুর আমার কানে বাজে সে সুরের সাথে কবিতার দূরত্ব এতোই বেশী যে দুটি শব্দ পাশাপাশি দেখতে পেয়েই আমি আতংক বোধ করেছি।’
        আমি জানি না, `শিক্ষক’ শব্দটার ব্যাপারে আপনার আপত্তির বিষয়টার সঙ্গে শৈশবের কোনো ঘটনা কিংবা ফ্রয়েডের ব্যাখ্যাযোগ্য কোনো বিষয় জড়িত কি না। কারণ, বুদ্ধদেব এমনিতে জীবনের একটা পর্যায়ে তো আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন শিক্ষক। এবং তার ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন নরেশ গুহ, মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, নবনীতা দেবসেনের মতো ব্হু বরেণ্য কবি-লেখক-অনুবাদক, যারা অকুণ্ঠচিত্তে বুদ্ধদেবের শিল্প-শিক্ষকের ভূমিকাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। এর পাশাপাশি তার বহুমাত্রিক লেখার মধ্য দিয়েও তিনি নানাভাবে কাজটি করে গেছেন বলে আমি মনে করি। এতে কেন আপনি আতঙ্ক বোধ করছেন, ব্যাখা করলে উপকৃত হবো।
        দ্বিতীয় প্যারায় আপনার আপত্তি `গুরুদেব’ সম্পর্কে। কিন্তু তৃতীয় প্যারার শুরুতে আবার লিখেছেন, `এসবই আমার ব্যক্তিগত বিশেষত্ব’। কোনো শব্দ সম্পর্কে আমাদের রুচি, পছন্দ বা বিবেচনা অনুযায়ী আপত্তি থাকা খুব স্বাভাবিক কিন্তু তাই বলে আমরা যদি ওই শব্দ অন্যরা ব্যবহার করলেও উষ্মা প্রকাশ করি, তাহলে এটা কি অনেকটা সেমি-ফ্যাসিবাদী আচরণ হয়ে যায় না? যদি উপযুক্ত যুক্তি না থাকে, তাহলে আমার অপছন্দ আমার ভেতরেই থাক না!
        যে দেশের ভাষায় তার মধ্যযুগেই শতাধিক প্রতিভাবান কবির নাম জানা যায়, এবং একুশ শতকের শুরুর দশকেও প্রায় শ তিনেক কবিকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হতে দেখা যায়, সে দেশে কবির সংখ্যা `সুপ্রচুর’ নয় তো কি অপ্রচুর মনে হয় আপনার? আর বাংলা ভাষায় এক রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দেরই এককভাবে এত ভালো ভালো কবিতা আছে যে, অন্যদের ব্যাপারে না ভাবলেও বোধহয় চলে। কবিতা-সংকলন মোটা কি চিকন- বিষয়টা এ দিয়ে বিচার করার নয়।
        আপনি যে লিখলেন : `আমাদের দেশে এমন প্রচুর কবি যারা গদ্য লিখতেই জানেন না, এই এতো বেশি কবিদের কাছ থেকে যে মোটেই সুপ্রচুর উত্তম কবিতা বের হতে পারে না, এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।’–আপনার এ কথার পক্ষে কী যুক্তি, জানালে খুশি হই। কারণ, সবিনয়ে জানাই, অসাধারণ কবি-গদ্যকার বুদ্ধদেব বসুরও কিন্তু রচনার তুলনায় ভালো কবিতার সংখ্যা অনেক কম। অন্যদিকে কবিকে কি কেউ দিব্যি দিয়েছে নাকি যে, তাকে গদ্য লিখতেই হবে? এর পরপরই আপনি লিখলেন: `পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় এমন কোনো দৃস্টান্ত নেই যে কবি পরিচয় নিয়ে চলছেন ফিরছেন কিন্তু গদ্য লিখতে জানেন না।’ কথাটি কি বাড়াবাড়ির মধ্যেও বাড়াবাড়ি নয়? এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কীসের ভিত্তিতে, জানলে পারলে আমার খানিকটা জ্ঞানবুদ্ধি বাড়বে বলে মনে হয়, ভবিষ্যতে কাজেও লাগাতে পারব খানিকটা।
        আপনার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নাই। কাজেই এ বিতর্ককেও ব্যক্তিগতভাবে না নেওয়ার অনুরোধ করি। বরং এ আলোচনার মধ্য থেকে একটা যথাযথ জায়গায় পৌঁছানোই আমার লক্ষ্য। নিশ্চয়ই আপনারও।
        আপনার সাহিত্যপ্রীতিকে সশ্রদ্ধ সালাম। ভালো থাকবেন।

  5. মাসুদ করিম - ৮ ডিসেম্বর ২০০৮ (৯:৫৫ পূর্বাহ্ণ)

    ডাকটিকেটে বুদ্ধদেব

    দেশের খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের ডাকটিকেটে স্থান দিয়ে তাঁদের সম্মান জানানোর রীতি প্রত্যেক দেশের মতো ভারতেরও আছে। ১৯৫২ সালে ‘সাধক ও কবি’ সিরিজের ছয়টি টিকেট দিয়ে ভারতের সাহিত্যিকদের নিয়ে ডাকটিকেট প্রকাশের সূত্রপাত। কবির, তুলসীদাস, মীরা, সুরদাস ও গালিবের সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথেরও ডাকটিকেট। এরপর বন্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন প্রমুখ বাঙালি সাহিত্যিকের টিকেট প্রকাশিত হয়। জ্ঞানপীঠ পুরষ্কারপ্রাপ্ত তারাশন্কর, বিষ্ণু দে ও আশাপূর্ণা দেবীর চিত্রসংবলিতও একটি টিকেট প্রকাশিত হয়। তালিকায় যোগ হলো কবি, সাহিত্যিক, সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু। তাঁর শততম জন্মদিনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ত্রিগুণা সেন প্রেক্ষাগৃহে প্রকাশিত হলো বুদ্ধদেব বসু স্মারক ডাকটিকেট। প্রকাশ করলেন লোকসভার স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। প্রথমদিনে প্রকাশিত বিশেষ খামে মুদ্রিত হয়েছে বুদ্ধদেব সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ ও তাঁর লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ’ কবিতাটি। খাম ও টিকেটটির নকশা করেছেন শঙ্খ সামন্ত।(‘আজকাল’ ৮ ডিসেম্বর ২০০৮)

    আমাদের দেশে কি এরকম একটা উদ্যোগ নেয়া যায় না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কি এরকম একটা প্রস্তাব আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের কাছে রাখতে পারে না? দুঃখজনকভাবে বাংলা একাডেমীর কথা তুলছি না।

    • saikat habib - ১৪ ডিসেম্বর ২০০৮ (১২:২০ অপরাহ্ণ)

      প্রিয় মাসুদ করিম,
      অনেক ধন্যবাদ আপনার সংবাদটি ও সুপারিশটির জন্য। জানি না, উল্লিখিত প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন এ ব্যাপারে কিছু করেছে কিনা। তবে যে তথ্যটা আপনাকে জানাতে পারি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ (বাচ্চু ভাই) ব্যক্তিগতভাবে বুদ্ধদেব-অনুরাগী। এবং এক অর্থে বুদ্ধদেবের আপনজন। কারণ, তিনি পুরানা পল্টনের স্থায়ী বাসিন্দা, যে পুরানা পল্টন ঘিরে আছে কবির অসামান্য স্মৃতি এবং তার নির্মাণপর্বের নিবিড় ইতিহাস।
      দুঃখের কথা কী বলব ভাই, ১৯৯৯ সালে নজরুল-জীবনানন্দ দুজনেরই ছিল জন্মশতবর্ষ। কিন্তু লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই, আমলা-কামলারা কী তোড়জোড় করেই না নজরুলের জন্য বছরব্যাপী নানা আয়োজন করলেন কিংবা আয়োজনের নামে টু-পাইস কামানোর ইতর সব আয়োজন করলেন। যার মাধ্যমে হয়তো বিদ্রোহী-নির্ভীক নজরুল অসম্মানিতই হলেন।
      অন্যদিকে জীবনানন্দকে ঘিরে সরকারি তরফে কোনো আয়োজন তো হয়ইনি, বেসরকারিভাবেও উল্লেখ করার মতো কিছুই হয়নি, দু-একটি দায়সারা অনুষ্ঠান আর প্রকাশনা ছাড়া। অথচ বাংলার প্রকৃতির আত্মাকে জীবনানন্দ ছাড়া আর কোন কবিই বা এত আত্মিকভাবে পাঠ করেছেন, ভালোবেসেছেন?
      কাজেই বুদ্ধদেবকে ঘিরে কী যে হবে বুঝতেই পারছেন।

    • মাসুদ করিম - ২৬ ডিসেম্বর ২০০৮ (৫:০৪ পূর্বাহ্ণ)

      প্রথমদিনে প্রকাশিত বিশেষ খামে মুদ্রিত হয়েছে বুদ্ধদেব সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ ও তাঁর লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ’ কবিতাটি।

      ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ আমার কাছে নেই, তবে ‘রবীন্দ্রনাথ’ কবিতাটি আছে, তাই কবিতাটি এখানে তুলে দিলাম।
      রবীন্দ্রনাথ

      ছিলে না বনের মৃগ, ঘাস, ফুল, মেঘের গহ্বরে
      রঙিন আলোর খেলা। এমনকি, বালক ছিলে না।
      তীক্ষ্ণ চোখ ঘিরে ছিলো সারাদিন, হাতের খেলনা
      ভারী হ’য়ে পড়ে গেছে হাত থেকে। তবু ছিলে অবসর ভ’রে

      তুমিও পাওনি দেখা নাপোলিতে নীলনয়নার।
      চিঠির উত্তর নেই। দেহ ছিলো আমাদেরই মতো।
      হয়তো ঘামাছি, মশা। প্রতিকুল বাতাসে প্রহত
      ভুলুণ্ঠিত ঘুড়ির আঁধার ঘন্টা। তবু ছিলে প্রতিযোগিতার

      পরপারে, বিশ্রামে শুভ্রতাময়, যেন তুমি কখনো করোনি
      চেষ্টা, কিংবা যেন কলস গিয়েছে ভেসে, তুমি শুধু জল।
      যা পেয়েছি দু-দণ্ড তোমার কাছে, নিঃশব্দে, কেবল
      সন্ধ্যার নিবিড়তায় ব’সে থেকে, আজ তাকে নির্ঘুম যামিনী
      জ্বেলে দেয় কূট গ্রন্থে ভাবনার পাণ্ডুর অনলে,
      বাক্, অর্থ, সম্পর্কের হিংসুক দাঙ্গা শেষ হ’লে।
      ২১ এপ্রিল ১৯৫৫

  6. মাসুদ করিম - ২৬ ডিসেম্বর ২০০৮ (৪:৫৪ পূর্বাহ্ণ)

    প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নই বলে শিক্ষক শব্দটি, প্রকারান্তরে ‘স্যার’ শব্দটির প্রতি আমার স্বাভাবিক বিরাগ রয়েছে। আর একইভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নই, কিন্তু অন্য অর্থে শিক্ষিত বলে গুরুদেব শব্দটির প্রতিও আমার স্বাভাবিক বিরাগ রয়েছে। ফ্রয়েডের এখানে কিছু করবার নেই।

    একুশ শতকের শুরুর দশকেও প্রায় শ তিনেক কবিকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হতে দেখা যায়

    প্রকাশিত কবির সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে বলা যায় প্রকাশিত কবির সংখ্যা সুপ্রচুর। আচ্ছা যারাই মুদ্রিত ও প্রকাশিত, তারা কয়জন কবি? কয়টা কবিতা? এ ভাবনাটাও তো আমাদের ভাবতে হবে।

    আধা হয়ে মোটেই ভালো লাগল না। ব্যক্তিগত বিষেশত্ব প্রকাশ করা আধা-ফ্যাসিবাদ এটা সত্যিই জানা ছিল না।

    ব্যক্তিগত পরিচয় থাকা না থাকায় কিছু যায় আসে না। আমরা প্রত্যেকেই একেকটা প্রক্রিয়া। এক প্রক্রিয়ার সাথে আরেক প্রক্রিয়ার নিয়ত বোঝাপড়ার সম্ভাবনাই সম্পর্ক। সে সম্পর্ক ব্যক্তিগত ছাড়াও গড়ে ওঠে আবার ব্যক্তিগত ছাড়াও ভেঙ্গে যায়।

    অন্যদিকে কবিকে কি কেউ দিব্যি দিয়েছে নাকি যে, তাকে গদ্য লিখতেই হবে?

    এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্যকেই বৃথা মনে হচ্ছে। যিনি গদ্য লিখতে জানেন না তিনি আধুনিক ভাষা সম্বন্ধে কিছুই জানেন না, এবং ভাষা সম্বন্ধে কিছুই না জেনে কবিতা লেখা অসম্ভব হলেও মফস্বলী পদ্যসভার ও নাগরিক কবিতাপাতার তাতে কিছুই যায় আসে না।

    আর কলাকৈবল্যবাদী বুদ্ধদেব বসুকে আমার খুবই পছন্দ। এবং বাংলা সাহিত্যে সেই অর্থে আর কোনো কলাকৈবল্যবাদী খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে, একমাত্র কলাকৈবল্যবাদী হিসেবে, তিনি আমার আরো পছন্দের। এক পর্যায়ে তো মনেই হচ্ছিল তিনি Dandy হতে চান, কিন্তু Dandy’র বাঙ্গালি সংস্করণ বাবুবিলাসের প্রতি বিরাগবশত সে পথে যে পা বাড়াননি, তাতে তার রক্ষা আমাদেরও রক্ষা। ‘শার্ল বোদলেয়ার : তাঁর কবিতা’ ও ‘কালিদাসের মেঘদূত’ এ দুটি বই বাংলা ভাষার চিরকালের সম্পদ হয়ে গেছে। অনুবাদ কিন্তু কী আধুনিক। তার যে শুদ্ধ আধুনিকতা তা এ দুটি অনুবাদে তার মৌলিক কবিতার চেয়েও বেশি প্রকাশিত। রবীন্দ্র পরবর্তী পাঁচজন আধুনিক কবির মধ্যে প্রাঞ্জলতম আধুনিকতা তারই। জীবনানন্দ তো Phenomenon ( বাংলায় আরেক Phenomenon ছিলেন নজরুল, Phenomenon মানে ফুটবলে যেমন রোনালদো মারাদোনা, অনেকটা ফরাসি L’enfant terrible কী বলা যায় বাংলায় ‘বিস্ময় বালক’)। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, তিন ভিন্ন অর্থে এরা তিন দার্শনিক কবি। কিন্তু গভীরভাবে সেসময়কার কবিতার আধুনিক শুধুই একজন : কলাকৈবল্যবাদী, অবিরল পরিশ্রমী, সঙ্গহীনতায় সন্ধিলগ্ন, বুদ্ধদেব, শ্রমণ, বুদ্ধদেব বসু।

  7. স্নিগ্ধা - ২৬ ডিসেম্বর ২০০৮ (২:৩৯ অপরাহ্ণ)

    কলাকৈবল্যবাদী

    মানে কি? ইংরেজী প্রতিশব্দটা কেউ কি জানাবেন, একটু?

    • রণদীপম বসু - ২৬ ডিসেম্বর ২০০৮ (৭:৫৩ অপরাহ্ণ)

      ‘কলা’ মানে arts । ‘কৈবল্য’ অর্থ পরমাত্মভাব, অর্থাৎ একটা মতবাদের কাছে মাথা নত করে থাকা বা অনড়াবস্থা বুঝায়। সেক্ষেত্রে ‘কলাকৈবল্য’ অর্থ দাঁড়াচ্ছে ‘কেবল শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা’।
      নিশ্চয়ই আঁচ করে ফেলেছেন কী বলতে চাচ্ছি ! arts for art’s sake মতবাদে বিশ্বাসী ও আস্থাভাজন অনুসারীদেরকেই মনে হয় ‘কলাকৈবল্যবাদী’ বলা হয়ে থাকে।
      শিল্পের জন্য শিল্প। আমি কি সঠিক অর্থ বের করতে পারলাম ?

      (সাহিত্যের বাইরে আরেকটা অর্থ আছে আড্ডারুদের জন্য । সবকিছুতেই শিল্প বা ‘কলা কেবল বাদ’ পড়ে যায় যাদের তাদেরকেও কলাকৈবল্যবাদী বলা যায়। হা হা হা !)

      • স্নিগ্ধা - ২৬ ডিসেম্বর ২০০৮ (১০:৫৭ অপরাহ্ণ)

        ধন্যবাদ, রণদীপম বসু! খুব সম্ভবত আপনার ব্যাখাটাই ঠিক, তবে –

        এবং বাংলা সাহিত্যে সেই অর্থে আর কোনো কলাকৈবল্যবাদী খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে, একমাত্র কলাকৈবল্যবাদী হিসেবে, তিনি আমার আরো পছন্দের।

        এই অংশটুকু পড়ে আমি একটু সংশয়িত। বাংলা সাহিত্যে আর কেউই নেই যিনি arts for arts sake এ বিশ্বাসী?

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.