প্রতিরোধে একাত্তর – বাংলাদেশের নাগরিক ও একটিভিস্টদের ঘোষণা

[নিম্নলিখিত দশটি সংগঠনের পক্ষে এই ঘোষনাটি প্রকাশ করা হল]

আমরা, বাংলাদেশের নাগরিক এক্টিভিস্টগণ, গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি যে বাংলাদেশ বর্তমানে এক অভূতপূর্ব ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাইআগস্ট মাসে কথিত কোটা বিরোধী আন্দোলনের আড়ালে একটি পরিকল্পিত Color Revolution” সংঘটিত হয়যার ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতার চেতনায় গঠিত বাংলাদেশের অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। 

আমরা চরম বিস্ময় দুঃখের সাথে দেখছি, ২০২৪ এর আগস্ট মাস থেকে দেশ এক আত্মবিধ্বংসী পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হয়েছে। তরুণদের ইতিহাসবিমুখ একটি অংশ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মতো যুদ্ধাপরাধী দেশবিরোধী শক্তি এবং উগ্র মতাদর্শের অনুসারীরা একত্র হয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ঐতিহ্য চেতনাকে আঘাত করেছে। তারা শুধু বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাসভবন, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্যের ওপর হামলা চালিয়ে থেমে থাকেনি, বরং নিরবচ্ছিন্নভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমেদসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের অবদান অস্বীকার অবমাননা করে চলেছে। এই গোষ্ঠী মুক্তিযোদ্ধা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী এবং আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন, বাসভবনে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, এমনকি ধর্ষণ হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্য, সংখ্যালঘু মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতির সাথে জড়িত অনেকের বিরুদ্ধে করা হচ্ছে হয়রানিমূলক হত্যা মামলা গ্রেপ্তার।  

আমরা গভীর হতাশায় লক্ষ করছি, শান্তিতে নোবেলজয়ী . মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশী এসব কর্মকাণ্ডের লাগাম টেনে ধরেননি, বরং তার নেতৃত্বে মৌলবাদী উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো সমাজের সকল ক্ষেত্রে ক্ষমতায়িত হচ্ছে। 

একই ধারাবাহিকতায়, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ব্যক্তিবর্গের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চলমান বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে এবং এর কর্তৃত্ব জামায়াতে ইসলামী এর সমর্থক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। সম্প্রতি, ১৯৭১ রংপুরের আলবদর কমান্ডার, ১৪০০ মানুষ হত্যা অসংখ্য নারী ধর্ষণের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামী নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের রায় রিভিউ করে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনা শুধু বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের প্রতি চরম অবমাননাই নয়, বরং এটি বিশ্ব ইতিহাসেও এক নজিরবিহীন কলঙ্কময় দৃষ্টান্ত। 

এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের আইনজীবীদের প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ, ট্রাইব্যুনালের পূর্ববর্তী বিচারপতি প্রসিকিউশন টিমের বিরুদ্ধে হামলামামলা এবং শাহরিয়ার কবীরসহ বিচারপ্রার্থী এক্টিভিস্টদের উপর আইনি নিষ্পেষণএসবই ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তির হাতে ট্রাইব্যুনালের পূর্ববর্তী বিচারগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার একটি সুপরিকল্পিত ঘৃণিত উদ্যোগ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে অস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পুনর্লিখনের জন্য স্বাধীনতাবিরোধীরা যে ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র চালিয়ে এসেছে, এটি তারই একটি অংশ মাত্র। 

এই রায়ের পর শাহবাগে যুদ্ধাপরাধী এটিএম আজহারুল ইসলামকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে আমাদের জাতীয় ইতিহাসে আরেকটি কলংকজনক অধ্যায় সূচিত হয়েছে। যে শাহবাগ প্রাঙ্গণে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গণজাগরণ হয়েছিল, সেই প্রাঙ্গণ আজ কলুষিত হয়েছে দণ্ডিত ঘাতকের পদচারণায়। 

আমরা আরও লক্ষ করছি, এই সরকার তাদের তথাকথিত সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজকের ছাত্রনেতারা একটি ধর্মীয় পরিচয়কে গুরুত্ব দিয়ে একদিকে সমাজে ধর্মীয় উগ্রতা উস্কে দিচ্ছে, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত আমাদের বহুত্ববাদী পরিচয়কে মুছে দিতে উদ্যত হয়েছে। পাঁচই আগস্টের পর থেকে পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, তাদের উপাসনালয়, সম্পত্তি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ চালানো হয়েছে। উপরন্তু, তাদেরকে আওয়ামী লীগ সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করে এসব আঘাতকে ন্যায্যতা দেওয়ার যে অপচেষ্টা সরকার চালাচ্ছে, তা ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি বাহিনীর ঘৃণ্য অপপ্রয়াসকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি পদ থেকে অপসারণ করা হচ্ছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে অন্যায়ভাবে কারাবন্দি করা হয়েছে। একই সাথে সুফি ভাবধারার মাজার এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর হামলা এবং সেগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থানের নগ্ন প্রকাশ। আমাদের আশঙ্কা, এই সরকারের শাসনামলে ভিন্নমতের ওপর দমননিপীড়ন বন্ধ হবে না বরং সময়ের সাথে সাথে তা বাড়তে থাকবে। 

. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের বিচার বিভাগ উগ্রপন্থী ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের জামিনে মুক্তি দিচ্ছে, কখনো বা বিশেষ বিবেচনায় সকল দণ্ড প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফলে এই সকল জঙ্গীবাদী গোষ্ঠী আবার সংগঠিত হচ্ছে। অন্যদিকে, যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলেন, তাঁদের উপর চলছে অমানুষিক নির্যাতন, হুমকি, অপমান নির্বাসন। 

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলোএই অনির্বাচিত সরকার বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির গুটি বানানোর পথে এগোচ্ছে। মানবিক করিডোর এর নামে মায়ানমারের দিকে একটি বিপজ্জনক দরজা খুলে দেয়া হচ্ছে, যার চূড়ান্ত ফল হতে পারে আমাদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের বিপর্যয়। বিশ্বের ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছেএই মানবিক করিডোর ধারণাটির আড়ালে লুকিয়ে থাকে আগ্রাসন, বিভাজন ধ্বংস। 

আমরা এই অনির্বাচিত সরকারের সকল দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত, কর্মকাণ্ড এবং ষড়যন্ত্রমূলক ইতিহাসবিকৃতির প্রচেষ্টাকে ধিক্কার জানাই। আমরা এই সরকারকে ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করি। 

আমরা আবারো উচ্চারণ করছি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব আজ গভীর সংকটের মুখে। স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ বাঙালির যে আত্মত্যাগ তা বৃথা যেতে পারে না, বাংলার জনগণ সেটা হতে দিবে না।  

তাই আসুন, আমরা সকলে এক হয়ে সোচ্চার হই, সক্রিয় হই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গঠিত বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষায়। 

জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। 

ICSF, Global Justice Network, A Team, মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনো, The Crack Team, Preset 71, গেরিলা ১৯৭১, Crack Platoon, Rog Porichorja Kendro, বিজয়গাথা

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

0 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.