প্রিয় সুমন,
সেদিন বাতিঘর-এর সামনে দাঁড়িয়ে একান্ত আড্ডার ছলে প্রসঙ্গক্রমে আমার গ্রাম-জীবনের গল্প বলতে শুরু করেছিলাম। সেই স্মৃতিচারণ তোমার ভালো লেগেছিল। তুমি বলেছিলে : ‘এগুলি লিখছেন না কেন? এখন তো জানছি মাত্র আমরা তিনজন, আরো অনেকেই জানুক।’ আড্ডা থেকে বিদায় নেয়ার সময়েও তুমি বললে : ‘তাহলে আগামীকাল নৌকাবাইচ নিয়ে আপনার লেখাটা পাচ্ছি তো?’ তার পর থেকেই এখনও পর্যন্ত একটা তাড়না অনুভব করছি লেখার জন্য। কাগজ-কলম হাতে নিয়ে লিখতেও বসে গেলাম। কিন্তু কিছুতেই শুরু করতে পারছি না। ভাব, ভাষা, পটভূমি সবই আছে; কিন্তু মুশকিলে পড়েছি লেখাটার আঙ্গিক নিয়ে। কী লিখব? গল্প, প্রবন্ধ, নাকি স্মৃতিকথা? এরকম বিক্ষিপ্ত ভাবনার জটলায় আটকে রইলাম অনেকক্ষণ কাগজ-কলম হাতে সাদা কাগজের বুকে, নদীর চড়ায় আটকে-পড়া অসহায় নৌকার মাঝির মতো। হঠাৎই মনে হলো, চিঠির মতো করে লিখলে কেমন হয়! হ্যাঁ, চিঠিই হচ্ছে আমার নিজস্ব জায়গা। এখানে আমি কাগজ-কলম হাতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ, সাবলীল, এমনকী স্বাধীন। নদীতে যেমন জলচর মাছেরা।
চিঠি লেখার অভ্যাস আমার খুব ছোটবেলা থেকেই। মা-বাবার জবানীতে ছেলের কাছে, স্ত্রীর জবানীতে স্বামীর কাছে, প্রেমিকের জবানীতে প্রেমিকার কাছে — নানাজনের হয়ে বিচিত্র সব চিঠি বিচিত্র বিষয়ে লিখেছি। সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। তবে সে-প্রসঙ্গে এখন যাব না। এমনিতেই তুমি হয়তো এতক্ষণে ভাবতে শুরু করেছ, এ তো দেখছি সেই হাট-বাজারের street magician-দের ঐন্দ্রজালিক কথার চাতুর্য! সাপ দেখানোর কথা বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষকে কথার জালে আটকে রেখে তাবিজ-কবজ, মাদুলি বিক্রির ধোঁকাবাজি কৌশল। না, তোমার আর ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। এবার সরাসরি চলে যাই আমার সেই স্মৃতিকথায়।
তবে স্মৃতিকথা হলেও তার একটা শিরোনাম দিতে পারলে বোধহয় ভালো হয়। শিরোনামটা হতে পারে এরকম : ‘ভাদ্দুর মাসের ত্যারাব্যারা ও ইয়াদ আলীর খ্যাল্লা’। শব্দগুলি কেমন অদ্ভুত আর অপরিচিত মনে হচ্ছে না? তোমার কাছে অদ্ভুত লাগারই কথা। এগুলি আমাদের এলাকার একেবারে খাঁটি আঞ্চলিক কথ্যভাষার শব্দ। যা হোক, ভাদ্দুর মাসের অর্থ যে ভাদ্র মাস এটা নিশ্চয়ই বুঝেছ। কিন্তু ‘ত্যারাব্যারা’ ও ‘খ্যাল্লা’ শব্দের জট খুলতে শুধু অনুমানের উপর নির্ভর করে এগিয়ে যাওয়া তোমার পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে না। ত্যারাব্যারা হচ্ছে প্রতি বছর ভাদ্রমাসের ১৩ তারিখে নৌকা বাইচের একটা ঐতিহ্যবাহী আঞ্চলিক উৎসব। আর খ্যাল্লা হলো বিশেষ ধরনের বাইচের নৌকা। যে-নৌকাগুলি সাধারণত বাইচ ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার হয় না। সুমন, এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের যে-অঞ্চলে আমার জন্ম তার ভৌগোলিক অবস্থান টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানায় আন্দিবাড়ী গ্রামে। অজ পাড়াগাঁ বলতে যা বোঝায় ঠিক সে-রকমই একটি গ্রাম। এখনো সেখানে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে নাই। মানচিত্রের অবস্থানে এ এলাকাকে বলা চলে দক্ষিণ টাঙ্গাইল। যার সীমান্ত জেলা মানিকগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ। ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে এটা বেশ নিচু এলাকা।
আমার জন্ম থেকে শৈশব-কৈশোর হয়ে যৌবনেরও বেশ কিছুটা সময় পর্যন্ত অনেকগুলি ভাদ্রমাসই তো আমি দেখেছি। তার যে-কোনো একটি ভাদ্রমাসের কথা ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে হাওড়-বাঁওড়-নদী-খাল-বিল-ডোবায় ভরা এক বিস্তীর্ণ এলাকার ছবি। যার ফসলের ক্ষেত, রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ সবই তখন শাপলা-শালুক, শ্যাওলা আর জলজ উদ্ভিদে ভরা অথৈ পানির নীচে। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। বিশাল এ জলমগ্ন অঞ্চলের ছোট-বড় গ্রাম, পাড়া, বাড়ি যেন এক-একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম, এ পাড়া থেকে ও পাড়া, কখনো-বা এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি এবং হাট-বাজারে যাতায়াতের একমাত্র বাহন ছোট-বড় নানান ধরনের নৌকা। নৌকা বানানোর আর্থিক সামর্থ্য যাদের নেই তারা বানিয়ে নিত নিদেনপক্ষে কলাগাছের একটি ভেলা। এত পানি কোত্থেকে আসত? তোমরা তো বর্ষাকাল বলতে বৃষ্টি-বাদলের সময়কে বোঝ, আর আসলেও তো তা-ই। আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। কিন্তু আমাদের এই অঞ্চলের সংস্কৃতিতে বর্ষাকাল মানে মোটেই বৃষ্টি-বাদলের দিন নয়। এখানে বর্ষা মানে উত্তর থেকে প্রবল বেগে নেমে-আসা পাহাড়ি ঢল বা ঝর্নার স্রোত, গঙ্গা যমুনা ধলেশ্বরী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যা ঢুকে পড়ে দু-কূলের সব শাখানদী ও খাল দিয়ে এই নিচু এলাকায়। আর তখনই দিনে-রাতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় এর হাওড়, বাঁওড়, বিল-ঝিল এবং অবশেষে ফসলের ক্ষেত, পথ, ঘাট, মাঠ সবকিছুই। এটা শুরু হতো আষাঢ়ের শুরু থেকেই, স্থায়ী হতো আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত। আর এ কারণেই আমাদের এখানকার লোকেরা পুরা বছরকে বিশেষ দুইটি মৌসুমে চিহ্নিত করে। একটা হলো ‘উইন্যা মাস’ বা ‘উইন্যার সময়’, অন্যটি ‘বাইস্যা মাস’ বা ‘বাইস্যার সময়’। উইন্যা হলো শুকনো মৌসুম আর বাইস্যা হলো বর্ষা মৌসুম।
সুমন, আমি কি আবারও লাইন ছেড়ে চলে যেতে চাইছি? মানে, নৌকা বাইচের কথা তো এখনো …। আচ্ছা, তোমার কি জানা আছে হুমায়ূন আহমেদের কোনো একটা গল্প বা উপন্যাসের সেই পাগল চরিত্রের কথা, যে-পাগলটা কমলাপুর রেলস্টেশনে দাঁড়ানো ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করে উপদেশের ভঙ্গিতে বলেছিল — ‘বাবারা, লাইনে থাকিস’? তুমি নিশ্চয়ই আমাকে ওভাবে বলবে না। তাছাড়া আমার এ লেখার শুরুতেই এর উপর আমি একটা সীল মেরে রেখেছি। আমি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বা ভ্রমণকাহিনী এসবের কোনোটাই লিখছি না; লিখছি চিঠি। আমার প্রিয় বন্ধু হিসাবে তোমার কাছে। চিঠি হিসাবে এর নানা সীমাবদ্ধতা বা ভালোমন্দ লাগার ব্যাপারে যে-কোনো মতামত দিতে পার একমাত্র তুমি, অন্য কেউ নয়।
যা হোক, এই ভাদ্রমাসে কৃষিনির্ভর এ এলাকার মানুষের হাতে কোনো কাজ থাকত না। অবসর হিসাবে এখানকার মানুষ গৃহস্থালির নানা কাজকর্ম, বেড়ানো, আড্ডা, মাছধরা, খেলাধুলা, গানবাজনা, নৌকাবাইচ ইত্যাদি নিয়ে মেতে থাকত। শ্রাবণের মাঝামাঝি থেকে পুরো ভাদ্র মাস জুড়েই কোথাও-না-কোথাও চলত এই নৌকাবাইচের উৎসব। এই ‘ত্যারাব্যারা’ উৎসবটা এই এলাকার মানুষের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত প্রধান আকর্ষণীয় উৎসব। আষাঢ়ের শুরুতেই যখন খাল-বিলে বর্ষার নতুন পানি ঢুকতে শুরু করত তখন পানিতে ডোবানো নৌকাগুলোকে ডাঙায় তুলে ধুয়ে-মুছে মেরামত করা হতো। গাব-গোবর, আলকাতরা, মাইট্যা তেল ও রং লাগানো হতো এগুলোর গায়ে। শুকনো মাঠ বা অন্য কোনো অপেক্ষাকৃত বড় জায়গায় তোলা হতো এই বড় বড় বাইচের নৌকাগুলিকে। শ্রাবণ-ভাদ্র মূলত এই দুই মাসই এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা এবং অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে থাকত এই নৌকাজীবন। আমরা হাট-বাজারে বা স্কুলেও যেতাম এই নৌকা নিয়েই। শুধুমাত্র বিপরীত দিক থেকে চলাচলকারী নৌকা ছাড়া, পাশাপাশি চলা বা একই গন্তব্যে চলা দু-চারটি নৌকা একসাথে হলেই হলো, নিজেদের অজান্তেই শুরু হয়ে যেত অঘোষিত প্রতিযোগিতা, কে কার আগে যেতে পারে। কতবার কতদিন যে এ কারণে স্কুলে যাওয়ার সময় বইখাতা-কাপড়চোপড় ভিজিয়েছি! আর ইচ্ছে করে নৌকা ডোবানোর সেই দুরন্তপনায় ছিল আমাদের মতো গ্রামের কিশোরদের স্বভাবসুলভ দুষ্টামি আর এক ধরনের নিষ্ঠুর আনন্দের প্রকাশ। আমাদের এই এলাকার ২/৪/৫ গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা খ্যাল্লা ছিল কালসীপাড়ার ওহাদ আলীর খ্যাল্লা। তখন আমি বেশ ছোট, ওই খ্যাল্লার কোনো স্মৃতি আমার মনে নেই। তবে বড় হয়ে তার অনেক নামডাক শুনেছি। আমার স্মৃতিতে আজও যে-সব খ্যাল্লার রং, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, গতি, জয়-পরাজয়ের কথা অমলিন হয়ে আছে, তার মধ্যে কাঠুরীর বুদ্ধু মিয়ার খ্যাল্লা, কাকধোটু মিয়ার খ্যাল্লা, বাঙ্গুটিয়ার বাখেজ আলীর খ্যাল্লা, সেরেনার মাসুম আলীর খ্যাল্লা, পানান-এর মাজন ব্যাপারীর খ্যাল্লার নাম মনে পড়ছে; এ রকম নাম-না-জানা আরো অনেক খ্যাল্লার কথাই এখনও আমার মনে আছে। তবে জীবনে প্রথম আমি ‘বাইছ্যা’ হিসাবে যে-খ্যাল্লায় যাই সেটা ছিল আমাদের গ্রামের ইয়াদ আলীর খ্যাল্লা। সুমন, আমার মনে হয় এখানে তুমি ‘বাইছ্যা’ শব্দটার অর্থ নিয়ে আবারও ধন্দে পড়ে গেছ। ‘বাইছ্যা’ হলো বাইচের নৌকার বৈঠাধারী লোক। যারা বাইচ দিয়ে খ্যাল্লা চালায়।
এই ইয়াদ আলী ব্যাপারীর নামটা ইয়াদ আলী হিসাবে চাউর হতে থাকে তার এই খ্যাল্লা বানানোর পর থেকেই। তার ডাকনাম ছিল চিকা ব্যাপারী। এখনও অনেকেই চিকা ব্যাপারী বলেই ডাকে। মানুষের নাম হিসাবে চিকা একটা বিশ্রী নাম, তাই না? এই চিকা শব্দটা কিন্তু দেওয়াল-লিখনের প্রতিশব্দ চিকা নয়। এই চিকা হলো ইঁদুরের মতো দেখতে ‘ছুঁচো’ নামের ওই বিশ্রী প্রাণীটা। ঠিক কী কারণে যে ওই মানুষটার নাম চিকা হয়ে গিয়েছিল আমার জানা নেই। তবে এরকম নাম কিন্তু আমাদের বাংলা সংস্কৃতিতে প্রচুর আছে; আর এ ধরনের নামকরণের পেছনে প্রায় ক্ষেত্রেই কোনো-না-কোনো বাস্তব ঘটনার ভূমিকা থাকে।
যা হোক, ইয়াদ আলী ব্যাপারীর খ্যাল্লা ছিল সম্ভবত ৪০ হাত লম্বা। খ্যাল্লার দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে ২০ জন করে ৪০ জন বাইছ্যা বসত। এছাড়াও সামনে-পিছনের লম্বা গলুইয়ে ২ জন করে ৪ জন, হাল ধরত ২ জন, খ্যাল্লার মাঝখান বরাবর কাঠের তক্তার পাটাতনের উপর ৪/৫ হাত লম্বা বাঁশের লাঠি হাতে ৪/৫ জন, যাদের বলা হতো ‘ধামাইলদার’, আর একজন লোক থাকত ডুগরি বাজানোর বায়েন। তার মানে প্রায় ৫০/৫৫ জন বাছাই-করা লোকের সক্রিয় অংশগ্রহণে চলত এই খ্যাল্লা। ত্যারাব্যারার মূল উৎসবটা শুরু হতো বিকেলের দিকে। কিন্তু উৎসবের প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়ে যেত দিনের প্রথম ভাগ থেকেই। আমাদের গ্রাম এবং আশেপাশের অন্য গ্রামের নামকরা বাইছ্যাদের আগে থেকেই দাওয়াত দেওয়া হতো।
যে-বয়সে আমি প্রথম ইয়াদ আলী ব্যাপারীর খ্যাল্লার বাইছ্যা হিসাবে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাই আমার সেই বয়স ও যোগ্যতা খ্যাল্লা বাইচের বাইছ্যা হিসাবে একেবারেই অনুপযুক্ত ছিল। তখন আমার বয়স ১৪/১৫-র বেশি না। কিন্তু একটা বিশেষ কারণে আমি ওই সুযোগটা পেয়েছিলাম। দক্ষ বাইছ্যা হিসাবে সুনাম না থাকলেও সুন্দর হাতের লেখা, রঙিন কাগজ কেটে নকশা করে ঘর সাজানো, বিয়েবাড়ির গেট সাজানো থেকে শুরু করে পাড়ার ও গ্রামের চাচী-মামী-ভাবী-বোনদের শৌখিন সেলাইকাজের ফুল-পাখি-লতা-পাতার ডিজাইন এঁকে দিয়ে শিল্পী হিসেবে আমি ভালোই পরিচিতি পেয়েছিলাম। এজন্যই ইয়াদ আলীর খ্যাল্লা যখন রং করার কাজ চলছিল তখন আমার ডাক পড়েছিল সেই খ্যাল্লার গায়ে ইয়াদ আলী ব্যাপারীর নামটা সুন্দর করে লিখে দেওয়ার জন্য। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেই খ্যাল্লার সামনে গলুইয়ের ঠিক ২/৩ হাত পিছনে দুই পাশে সাদা এনামেল রঙের উপর বাংলা হরফে লিখেছিলাম — মোঃ ইয়াদ আলী ব্যাপারী, সাং : আন্দিবাড়ি, থানা : নাগরপর, জেলা : টাঙ্গাইল। এভাবেই ইয়াদ আলীর খ্যাল্লার বাইছ্যা হিসাবে আমার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছিল। কিন্তু আমার খুব শখ ছিল খ্যাল্লার পিছনের গলুইয়ের সবশেষের বাইছ্যার আসনটাতে বসার। বাইচের খ্যাল্লার এই আসনটি একটি সংরক্ষিত আসনের মতো। এখানে সাধারণত খ্যাল্লার মালিকদের ছেলেপুলে বা আত্মীয়স্বজনদের মধ্য থেকে কেউ একজন বসত। এখানে বসলে অন্য বাইছ্যাদের চেয়ে কিছুটা শারীরিক আয়েশ পাওয়া যেত, আর তাছাড়া এখানে কে বসেছে তা দুই পাশ থেকেই স্পষ্ট দেখা যেত। টকটকে লাল আর কালো রঙের মিশেলে লিলিয়ান কাপড়ের চাইনিজ কাটিং ফুলহাতা একটা শার্ট বানিয়েছিলাম, ত্যারাব্যারার দিন পরব বলে। তাই সেদিন সকালের দিকেই নতুন শার্টটা গায়ে চড়িয়ে চলে যাই ইয়াদ আলী ব্যাপারীর বাড়িতে। খ্যাল্লা তখন ঘাটে বাঁধা ছিল। লাল, কালো, সাদা, সবুজ, উজ্জ্বল নীল রঙের জ্যামিতিক নকশা খ্যাল্লার গায়ে সদ্য আঁকা হয়েছে। ইয়াদ আলীর ছোট ছেলে খোরশেদ বয়সে আমার চেয়ে ২/৩ বছরের বড় হবে। ওর সাথে খাতির জমিয়ে ওকে মানাতে পারলাম যে, পিছনের গলুইয়ের ওই সংরক্ষিত আসনটিতে আমিই বসব। খোরশেদ ও তার সমবয়সী অন্য ছেলেপুলেরা ব্যস্ত ছিল মোরগ জবাই নিয়ে। কারণ ত্যারাব্যারায় যাওয়ার আগে সবাইকে খিচুড়ি-মাংস দিয়ে ভরপেট খাওয়াতে হবে। সব খ্যাল্লা মালিকের বাড়িতেই একই আয়োজন থাকত সেদিন। খ্যাল্লায় তখনো কেউ ওঠে নাই, অথচ আমি গিয়ে অনেক আগে থেকেই দখল করে রেখেছি আমার সেই শখের আসনটি। আস্তে আস্তে ২/১ জন করে বাইছ্যা আসতে শুরু করেছে।
খ্যাল্লা বাইচের উন্মুক্ত জায়গাটাকে আমাদের স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় আড়ং। এই আড়ং ছিল আমাদের গ্রাম থেকে সোজা পশ্চিম দিকে দেড়/দুই মাইল লাগানো উত্তর-দক্ষিণে প্রায় মাইলখানেক লম্বা একটি বিলে। সুমন, তোমরা তো আবার বিল বলতে বসতবাড়ির ভিটামাটির বাইরের ফাঁকা জমিকেই বোঝ। ইয়াদ আলী ব্যাপারীর ঘাট থেকেই খ্যাল্লাটা বাইচ দিয়ে গেলে ওই আড়ং-এ পৌঁছাতে সময় লাগত বড় জোর ১০/১৫ মিনিট; কারণ এই দেড়/দুই মাইল দূরত্বের মাঝখানে আর কোনো গ্রাম বা বাড়িঘর নেই। পুরোটাই ফাঁকা। এরই মাঝে আছে ফসলি ক্ষেত-খামার, ছোট-বড় হাওড় বা ডোবা ও খাল-বিল। কিন্তু তার সবটাই ১০/১৫ হাত উঁচু পানির নীচে। মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্নভাবে আছে ২/১টা ডুবু-ডুবু সবুজ পাতার আমন ধানের ক্ষেত। আড়ং-এ যেতে সময় বেশি লাগত না, দূরত্বও ছিল কম, তাই ওখানে যাওয়ার আগে এই খ্যাল্লা নিয়ে হতো মজার এক ঐতিহ্যবাহী লোকজ আনুষ্ঠানিকতা। ইয়াদ আলীর পাড়া-প্রতিবেশী উঠতি বয়সের ছেলেপুলেরা সহ গ্রামের অন্যান্য বাইছ্যারা বৈঠা হাতে খ্যাল্লায় উঠত। ৫/৬ জনের একদল গান-বাজনা করার লোক উঠত, যাদের বলা হতো বয়াতি। খমক, বাইয়্যা, দোতরা, খঞ্জনি বাজিয়ে ওরা জারি-সারি গান গাইত। খ্যাল্লা চলার সময় বাইছ্যাদের হাতের বৈঠার গতি ও ছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করত ধামাইলদারের ধামাইল এবং ডুগরি বায়েনের ডুগরির ছন্দোময় শব্দ। সুমন, তুমি তো মনে হয় এখানেও আটকে আছো, ‘ধামাইলদার’ শব্দের জট খুলতে গিয়ে। ধামাইলদার হচ্ছে ওই ৪/৫ জনের দল যাদের হাতে থাকত ৪/৫ হাত লম্বা বাঁশের লাঠি। ডুগরি হচ্ছে অর্ধগোলাকৃতির বড় পেয়ালার মতো দেখতে মাটির পাত্র দিয়ে বানানো এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র। যার ছড়ানো মুখটা ছাগল, ভেড়া বা গরুর চামড়া দিয়ে বাঁধানো। শক্ত কাঠের ১ ফুট লম্বা দুইটা কাঠি দিয়ে একজন লোক দুই হাতে বাজাত এই ডুগরি। গুড়ুম গুড়ুম শব্দে কখনো ধীর লয়ে কখনো-বা দ্রুত লয়ে ছন্দ তুলে বাজত এই ডুগরি। ৪/৫ মাইল দূর থেকেও বাতাসে ভেসে আসত তার ছন্দোময় আওয়াজ। আমাদের গ্রামের কালু কবিরাজ, কেরু মুনসি, কোঠু মিয়া, রাষ্ট্র গোপাল বাঙ্গারফি, আরো কে কে যেন উঠেছিল ব্যাপারীর খ্যাল্লার সারিগানের বয়াতির দলে। খ্যাল্লা তখনো ইয়াদ আলীর ঘাটে বাঁধা। বাইছ্যাদের হাতে হাতে বৈঠা, বয়াতির দল বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ধীর লয়ে ধরেছে সারিগান। বাইছ্যাদের হাতের বৈঠা সারিগানের ছন্দে ছন্দে মাঝে মাঝে সমান তালে টোকা মেরে যাচ্ছে। খ্যাল্লার কাঠের পাটাতনে ছন্দ মেলাচ্ছে ডুগরি আর ধামাইলদারের ধামাইল। শুরু হয়েছে খ্যাল্লা বরণ অনুষ্ঠান। ইয়াদ আলীর খ্যাল্লার বর্ণনা, প্রশংসা, চারিত্রিক ক্যারিকেচার সারিগানের সুরে গেয়ে যাচ্ছে বয়াতির দল। তাদের সাথে সারিগানের স্থায়ী সুরের একটা পয়ারে আমরা সমস্বরে ঝংকার তুলে উচ্চারণ করছি — আহা-বেশ-বেশ-বেশ। ইয়াদ আলীর বাড়ির বউ-ঝি পাড়া-প্রতিবেশী ছেলে-বুড়ো সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে দেখছে এই মজার দৃশ্য। বাঁশের কুলা হাতে ইয়াদ আলীর স্ত্রী এগিয়ে এসেছে খ্যাল্লার সামনের গলুইয়ের কাছে। কুলায় আছে কিছু ধান, দুর্বাঘাস, নতুন একটি গামছা ও কিছু ধাতব ও কাগজি মুদ্রা। দু’হাতের অঞ্জলি ভরে ঘাটের পানি তুলে ধুয়ে দিল খ্যাল্লার গলুই। তারপর নতুন গামছাটা গলুইয়ে বেঁধে তিন আঙুলের মাথায় ধরা সামান্য ধান ও দুর্বাঘাস ছিটিয়ে মুদ্রাগুলি রেখে দিল গলুইয়ে। ঘাটে বাঁধা খ্যাল্লার রশিটা খুলে দেওয়ার সাথে সাথে আবার সবাই পর পর তিনবার সমস্বরে আওয়াজ তুলে ধ্বনি দিল — ‘আল্লা বলো, রসুল বলো, লায়-লাহা এল্লেলা…’। ছন্দ-তাল-লয়ে আওয়াজ তুলে ধীর গতিতে এগিয়ে চলল ইয়াদ আলীর খ্যাল্লা। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি, এ পাড়া থেকে ও পাড়া, এ গ্রাম থেকে ও গ্রামের বিভিন্ন ঘাটে ভিড়ে বরণের ফাঁকে ফাঁকে তুলে নিল আমন্ত্রিত চৌকস সব বাইছ্যাদের। বরণ পর্বের উপহার হিসাবে বেশির ভাগই উঠত নগদ টাকা-পয়সা। আমাদের চেয়ারম্যান বাড়ি ও অন্য ২/১ জন প্রভাবশালী লোকের ঘাটে ভিড়ে পেয়েছিল ৩/৪ টা পিতলের কলসি। বরণপর্ব শেষে দ্রুত লয়ের বাইচের তুফান তুলে খ্যাল্লা ফিরে এল ব্যাপারীর ঘাটে।
(সুমন, তুমি কি কখনো এ রকম নৌকা বাইচের লোক উৎসব স্বচক্ষে দেখেছ? সেদিন জাবের ভাইকে আমার এ লেখাটার কিছু অংশ পড়ে শোনাচ্ছিলাম। আন্তরিক আগ্রহ ও মনোযোগ দিয়েই সে আমার পড়া শুনছিল। হঠাৎ আমাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল : ‘এখন তো ভাদ্র মাস, যদি ওখানে যাই দেখা যাবে না?’ সুমন, আমি তার এই আগ্রহসূচক প্রশ্নের আশাব্যঞ্জক কোনো উত্তর দিতে পারি নাই। কেন পারি নাই সে-কথায় পরে আসছি।)
ব্যাপারীর ঘাটে খ্যাল্লা রেখে হৈ-হুল্ল্লোড় করে নেমে গেলাম সবাই। কিছুক্ষণ পরই শুরু হলো খাওয়া-দাওয়ার পর্ব। খাওয়া-দাওয়া শেষে আমন্ত্রিত সব বাইছ্যা ও অন্য লোকজনকে পান-তামাক-বিড়ি দিয়ে আপ্যায়নের মধ্য দিয়েই হয়ে গেল খানিকটা বিশ্রাম। দিনের সূর্য ততক্ষণে হেলে পড়েছে পশ্চিমে। চারিদিক থেকে ভেসে আসছে ডুগরি, ধামাইল, জারি-সারি ও গ্রামোফোন রেকর্ডে বাজানো গানের মিশ্র আওয়াজের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। এখন পুরো এলাকাটাই যেন মুক্ত আনন্দের উৎসবমুখর আড়ং। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে এসেছে কত বিচিত্র ধরনের বাইচের নৌকা, খ্যাল্লা, রঙে রঙিন পানসি, ছোট লঞ্চ। সং সেজে মুখোশ পরে নাচে-গানে মেতে নৌকা ভ্রমণের এমন বিচিত্র উৎসব আমার অভিজ্ঞতায় আর নাই। এই ত্যারাব্যারার দিন আর একটা মজার আনুষ্ঠানিকতা আমাদের ওখানে প্রচলিত ছিল। ওইদিন সবার ঘরে ঘরে তৈরি হতো তালের পিঠা।
বিচিত্র এ উৎসবের আনন্দযজ্ঞের সমগ্রতায় আমরাও এবার যুক্ত হতে চলেছি। শুরু হলো বাছাই-করা আমন্ত্রিত সব বাইছ্যাদের একে একে খ্যাল্লায় ওঠার পালা। বয়াতির দল, ধামাইলদার, ডুগরি বায়েন, হালের হাইল্যাদের নিয়ে খ্যাল্লা এবার পরিপূর্ণ। আমি বসেছি আমার সেই প্রত্যাশিত আসনেই। খ্যাল্লার হাল গুইরার ঠিক পিছনে গলুই বরাবর ৬/৭ ফুট উচ্চতার বাঁশের মাথায় পতপত করে উড়ছে লাল-সবুজ পতাকা। ব্যাপারীর ঘাট থেকে খ্যাল্লা ছেড়ে আসছে গজারি খালের মাঝখান বরাবর। এ-কাত ও-কাতে ক্রমাগত দুলছে খ্যাল্লা। এবার আবার সেই পর পর তিনবার ধ্বনি — আল্লা বলো, রসুল বলো…। বাইছ্যাদের চাঙা করার জন্য ধামাইলদারদের মধ্য থেকে একজন উচ্চ স্বরে হাঁক ছেড়ে বলে, ‘বাইছ্যাদের কি জোর আছে?’ বাইছ্যারা সবাই সমস্বরে চিৎকারে করে লম্বা টানে বলে, ‘আ-ছে –‘। আবার ধামাইলদার বলে, ‘যার জোর নাই তারে নিছে ট্যাংরা মাছে রে –। মারো জোরে –‘। বাইছ্যারা বলে, ‘হেঁইও’। ধামাইলদারদের হাতের লাঠি এবং এক পায়ের গোড়ালির সমান তালে আঘাত খ্যাল্লার পাটাতনে আওয়াজ তুলছে ধুরুম-ধুরুম-ধুরুম। একই তালে বাজে ডুগরির আওয়াজ গুড়ুম-গুড়ুম-গুড়ুম। সেই সাথে চলে বাইছ্যাদের হাতের বৈঠা। খ্যাল্লার সামনের গলুই গজারি খালের পানি দু’ভাগ করে দেয়, দু’পাশে ঢেউ তুলে ৪/৫ হাত শূন্যে পানি ছিটিয়ে এগিয়ে চলে খ্যাল্লা। সামনের বাইছ্যার মাথায় বাঁধা গামছার আঁচল, ধামাইলদারের বাবরি চুলের গোছা, হালের আগায় বাঁধা রঙিন রুমাল উড়ছে একই ছন্দের তালে। ব্যাপারীর ঘাট থেকে আঁকাবাঁকা গজারির খাল চোখের নিমিষে পেছনে ফেলে হাইল্যা খ্যাল্লার নিশানা ডানে ঘুরিয়ে তুলে দেয় ক্ষিরাই বিল বরাবর। এখান থেকে ওই দুই মাইল দূরে দেখা যাচ্ছে বারাপুষা গ্রামের বাঁশের সাঁকো। তার নীচে দিয়ে ঢুকে আমরা পৌঁছে যাব আড়ং-এ। সামনে-পিছে আশেপাশে সমান তালে ছুটে চলছে আরো অনেক ছোট-বড় নৌকা ও বাইচের খ্যাল্লা। সবাই সবার প্রতিদ্বন্দ্বী, কে কাকে ফেলে আগে যেতে পারে। দুই মাইল ফাঁকা জায়গায় যে যেখানে আছে সেখান থেকেই যেন শুরু হয়ে যায় প্রতিযোগিতা। কখনো পিছনের নৌকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে সামনের নৌকাগুলিকে, কখনো সামনের নৌকা পড়ে যাচ্ছে পিছনে। এ-পাশে ও-পাশের দর্শনার্থী নৌকা থেকে ভেসে আসছে জোরে করতালির আওয়াজ। এভাবে আগু-পিছু করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম আড়ং-এ। এবার শুরু হবে আসল খ্যাল্লা বাইচ। বয়াতিদের সহ অতিরিক্ত লোকজন নামিয়ে রাখা হলো অন্য একটি দর্শনার্থী নৌকায়। কারণ এখন শুধু থাকবে খ্যাল্লার দুই পাশে ২০ জন করে ৪০ জন, সামনে ও পিছনের গলুইতে ২ জন করে ৪ জন, হাল ধরবে ২ জন হাইল্ল্যা, ৫ জন ধামাইলদার এবং ১ জন ডুগরি বায়েন। মোটামুটি এই ৫০ জনের বহর। এবার শুরু হচ্ছে আবার সেই একই ছন্দ, একই আওয়াজ, তবে কিছুটা ধীর লয়ে। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা সেই বিশাল জলাভূমির উত্তর দিক বরাবর এগিয়ে চলেছি আমরা। খোঁজা হচ্ছে পছন্দসই সমপর্যায়ের প্রতিযোগী খ্যাল্লা। দক্ষিণ দিক থেকে দ্রুত লয়ে প্রাণপণ গতিতে পাশাপাশি ছুটে আসছে অনেকগুলি খ্যাল্লা। ওখানে আছে আমাদের ব্যাপারীর খ্যাল্লার সমান বঙ্গুটিয়ার বাখেজ আলীর খ্যাল্লা। হাইল্যার নিশানা বাড়িয়ে দেয় আমাদের খ্যাল্লার গতি। বাখেজের খ্যাল্লা চলে এসেছে আমাদের খ্যাল্লার প্রায় কাছাকাছি। এবার আবার সেই ধ্বনি, তুমুল ছন্দ, তুমুল আওয়াজ। কেউ কাহারে নাহি ছাড়ে! কখনো আমরা সামান্য আগে, কখনো বাখেজের খ্যাল্লা সামান্য আগে। দুইজন হাইল্যার হাইল ধরে শূন্যে লাফিয়ে এক একবার ‘হাইল কারানী’তে আমরা আবার চলে যাই বাখেজের খ্যাল্লার আগে। বিলের উত্তর দিকে শেষ প্রান্তে যাওয়ার আগেই গতি কমিয়ে হাইল্যা আবার খ্যাল্লা ঘুরিয়ে নেয় দক্ষিণমুখী করে।
এবার আবার শুরু — পাশাপাশি প্রায় ১৫/২০ টি খ্যাল্লা। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এবার শিব কাঠুরির বুদ্ধু মিয়ার খ্যাল্লা। চলছে সমান তালে। কোথায় যাচ্ছে কোনদিকে যাচ্ছে চোখ খুলে দেখতে পারছি না। চোখ-মুখ-কান সহ পুরো শরীরে ছিটকে আসছে বৈঠায় ছিটানো পানির ঝাপটা। সেচনি দিয়ে ঝপাৎ ঝপাৎ করে খ্যাল্লার পানি ফেলছে একজন। বিলের দুই তীরে দর্শনার্থী নৌকা থেকে বাজছে তুমুল করতালি। এগিয়ে চলেছি আমরা। কখনো আগে কখনো পিছনে করে চলে এসেছি প্রায় দক্ষিণ দিকের শেষ প্রান্তে। পুরো শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে, আর পারছিলাম না। ক্লান্ত আমরা সবাই। সুমন, বাইচের খ্যাল্লার বাইছ্যা হওয়ার সাধ সেদিন এই ত্যারাব্যারার উৎসবে সত্যিই মিটে গিয়েছিল।
তারপর আবার বয়াতিদের খ্যাল্লায় তুলে ক্লান্ত ধীর লয়ে বৈঠা চালিয়ে বিলের দুই তীর ঘেঁষে ঘুরে ঘুরে আমরাও দেখছিলাম ত্যারাব্যারার দৃশ্য। বিলের পূর্ব পাড় ঘেঁষে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা বারাপুষা ও ভাল কুটিয়া গ্রাম। গ্রামের বাড়িঘরের আনাচে-কানাচে ছেলেপুলে, বুড়ো, মেয়ে-বউ-ঝিরা সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে ত্যারাব্যারার দৃশ্য। কিশোর-কিশোরীরা ঘরের চালায়, খড়ের গাদায়, গাছের শাখায় বাদুড়-ঝোলা ঝুলে দেখছে এ দৃশ্য। ভাসমান দোকানি নৌকায় মিষ্টি, রসগোল্লা, জিলিপি, বাদাম, চানাচুর সহ হরেক রকমের মজাদার খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেছে। চলছে বেচাকেনা। জারি-সারি গান গেয়ে চলেছে কত বিচিত্র সাজের বয়াতির দল। চুড়ি, আলতা, ফিতা, লিপস্টিকের পসরা সাজিয়ে ঘুরছে বেদে নৌকার বহর।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। এবার বাড়ি ফেরার পালা। এখন আর সেই তুমুল বাইচ নয়। ধীর লয়ে চলছে বাইছ্যাদের ক্লান্ত বৈঠা; ডুগরির ছন্দে ধামাইলদারের ধামাইল, বয়াতির গান। সুমন, এই হলো সেই ভাদ্দুর মাসের ত্যারাব্যারা ও ইয়াদ আলীর খ্যাল্লার স্মৃতি। আচ্ছা ভালো কথা, কে জিতল? ও, কেউ না। ত্যারাব্যারার এই একটা বৈশিষ্ট্য, এখানে কেউ হারে না, কেউ জেতেও না। সবাই আনন্দ করে। মুক্ত আনন্দ।
আমি যে-সময়ের কথা এতক্ষণ লিখলাম সেটা খুব সম্ভবত ইংরেজি ৭৯/৮০ সালের কথা। আজ ২০০৮ সাল, ১৩ই ভাদ্র ১৪১৫ বঙ্গাব্দ। তার মানে ২৭/২৮ বছর আগের স্মৃতি। এখন মোবাইল ফোনের যুগ। ইচ্ছা করলেই যোগাযোগ করা যায় আমার সেই স্মৃতিঘেরা জন্মভিটার সাথে। জেনেছি, সেই ইয়াদ আলী ব্যাপারী এখনো জীবিত আছে। এই ভাদ্র মাসের ত্যারাব্যারার দিনে কী করছে ইয়াদ আলী ব্যাপারী? হয়তো মাঠের পাশে মান্নানের ওই ছোট্ট দোকানের সাথে ছাউনির নীচে বাঁশের বেঞ্চিতে বসে নাকের ডগায় পরা হাই পাওয়ারের পুরু লেন্সের চশমার ভিতর দিয়ে ঝাপসা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে পথের পানে। একদিন সেখান দিয়ে চলত আজকের এই তারিখে কত বাইচের খ্যাল্লা। আর আজ তারই চোখের সামনে দিয়ে দ্রুতগতিতে কালো ধোঁয়া ছেড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মোটর সাইকেল বা অন্য কিছু।
সুমন, চিঠিটা আজ এখানেই শেষ করতে চাইছি। তবে ভাদ্র মাসের ত্যারাব্যারার দিন এলেই মনে পড়ে আরো অনেক স্মৃতি। আজ এই মুহূর্তে আরো একটি মজার উৎসবের স্মৃতি চোখে ভাসছে। সেটা হলো ‘বেইরা ভাসানী’, তাও এই ভাদ্র মাসের ১৩ তারিখেই হয়। এখনো টিকে আছে। তবে তার কথা লিখব অন্য কোনো দিন, অন্য কোনো চিঠিতে।
ভালো থেকো।
ইতি
রেজাউল করিম
১৩ই ভাদ্র
১৪১৫ বঙ্গাব্দ
রেজাউল করিম
জ. ১৯৬৮। চট্টগ্রাম সরকারী চারুকলা কলেজ থেকে বি.এফ.এ.। বর্তমানে মুদ্রণ ব্যবসায়ী। শখ : পড়ালেখা, আঁকা, ভ্রমণ। ই-মেইল : rkreja@yahoo.com
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১১ comments
সৈয়দ তাজরুল হোসেন - ৩০ আগস্ট ২০০৮ (১০:১৮ পূর্বাহ্ণ)
রেজাউল করিমকে অনেক ধন্যবাদ, এই চমৎকার চিঠিটির জন্য । বাংলদেশের গ্রাম্য জীবন সম্পর্কে যাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে, আমার স্থির বিশ্বাস আপনার চিঠিটি পড়তে পড়তে নিজেদের অজান্তে তাদের বেশির ভাগই সেই সময়ে ফিরে গিয়েছেন । আমার বাল্যকালের বেশ কিছুটা সময় কেটেছে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে । নাম শুনেই বুঝতে পারছেন, গঞ্জ; জায়গাটি মোটামুটি শহর আর গ্রামের মাঝামঝি । তবে কুশিয়ারা নদীর তীরের ফেঞ্চুগঞ্জের জীবন ধারা শহরের নয়, কিছুটা গ্রাম ঘেসাই ছিল । সেখানেও মাঝে মধ্যে নৌকা বাইচ হতো, নানান উজ্জ্বল রঙে রাঙানো নৌকা, রং বেরঙ্গের কাগজ কেটে সাজানো নৌকা আর নদীর দু’কুল উপচানো উৎফুল্ল মানুষের ভীড় । আপনার চিঠি পড়তে পড়তে আরো রঙীন হয়ে ফিরে এলো সেই স্মৃতি । অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে । আপনার পরবর্তী চিঠির অপেক্ষায় থাকলাম, আশা করবো দীর্ঘ অপেক্ষায় রাখবেন না ।
সৈকত আচার্য - ৩০ আগস্ট ২০০৮ (১:১৪ অপরাহ্ণ)
@রেজাউল করিমঃ অসম্ভব সুন্দর বর্ননা। কোথাও ছেদ পড়ে নি। একেবারে নিঃখুত। স্মৃতির পাতা থেকে নেয়া কোন ঘটনার এমন প্রানবন্ত-সরল বর্ননা কোথাও পড়িনি । বহুদিন। অন্তরে অতৃপ্তি রয়ে গেল। পরবর্তী পর্বের জন্য। আপনার জন্য এই গানটি নির্বাচন করলাম ।
পার্থ সরকার - ৩১ আগস্ট ২০০৮ (৯:৫৯ পূর্বাহ্ণ)
চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই ধরনের প্রতিযোগিতা নেই। খুবই আগ্রহ ও কৌতুহল নিয়েই পড়লাম লেখাটা। রেজাউল করিমকে ধন্যবাদ। নদী ও খালের অভাব নেই চট্টগ্রামে, কিন্তু বাইচের যে নৌকা তা বোধহয় সেখানে দেখা যায় না, এখাকার মানুষ ছোট ছোট যে ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে খাল নদী পাড়ি দেয়, তা হল সাম্পান। যেকোন নদীঘাটে যাত্রীর অপেক্ষা করে মাঝিরা যখন তাদের নৌকাসুদ্ধ দোলে, তাও দৃশ্য হিসেবে মন্দ নয়। এই সাম্পানওয়ালাদের উপস্থিতি এখানার মানুষের জীবনে কত ব্যাপক, তা বোঝা যায়, আঞ্চলিক গানে তাদের বর্ণাঢ্য ও সাড়ম্বর উপস্থিতি দেখে। (ও রে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দিওয়ানা….) এখানে উৎসব নেই নৌকা নিয়ে কিন্তু আছে গান।
রায়হান রশিদ - ৩১ আগস্ট ২০০৮ (৩:০০ অপরাহ্ণ)
লেখক রেজাউল করিমকে ধন্যবাদ বর্ণনাসমৃদ্ধ এই অসাধারণ লেখাটির জন্য। কোনদিন নৌকাবাইচ সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য হয়নি; এখন অবশ্য আর তা মনে হচ্ছেনা। বেশ যেন দেখতে পাচ্ছি সব, মনের চোখ দিয়ে।
সেইসাথে ধন্যবাদ প্রাপ্য রেজাউল করিম সুমন এর, এই পোস্টের লেখকের সাথে আমাদের সবার পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য।
রেজাউল করিম সুমন - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৬:৪৭ অপরাহ্ণ)
এস.এম.এস. পাই, ই-মেইল পাই, কিন্তু চিঠি আর আজকাল পাই না। কাউকে লেখাও হয় না। রেজা ভাইয়ের লেখা “ভাদ্দুর মাসের চিঠি : ১” পেয়ে তাই আমার অন্যরকম অনুভূতি হয়েছিল। (বোকার মতো ভাবতে ইচ্ছে করছিল যে ওই চিঠি কেবল আমারই উদ্দেশে লেখা!)
চট্টগ্রাম শহরের একটি বইয়ের দোকানের (বাতিঘর) সামনে দাঁড়িয়ে চলতি ভাদ্র মাসের ২ কি ৩ তারিখে যখন তিনি নৌকাবাইচের গল্প শুরু করেছিলেন, বেশিদূর এগোবার আগেই তাঁকে থামিয়ে দিয়েছিলাম। অনুরোধ করেছিলাম, অল্প কয়েকজনকে না শুনিয়ে মুক্তাঙ্গন-এর পাঠক-লেখক সকলকেই যেন শোনান তাঁর ওই গল্প। তখনও ভাবতে পারিনি এমন অসামান্য একটা চিঠি পড়ার সুযোগ হবে আমাদের।
২
বছর কয়েক আগে মানিকগঞ্জের এক বন্ধুর মুখে শুনেছিলাম, সেখানকার কালীগঙ্গা নদীতে প্রতিবছর নৌকাবাইচ হয়। এখন আর মনে নেই তিনি ভাদ্রমাসের কথাই বলেছিলেন কি না। আমার দুর্ভাগ্য, সেই বিশেষ দিনটিতে যেতে পারিনি সেখানে। তবে কালীগঙ্গা নদীটিকে একবার দেখেছিলাম লোহার সেতুর উপর দাঁড়িয়ে, পরে আবারও দেখেছিলাম আলোকদার তোলা একগুচ্ছ অসামান্য ছবিতে। আলোকদার বাড়ি কালীগঙ্গারই তীরে।
৩
নৌকাবাইচের সূত্রে মনে পড়ছে মাস কয়েক আগে দূরদর্শন-এ দেখা একটা চলচ্চিত্রের কথাও। “নাগপাশ”, রাজেন তরফদারের ছবি। তাঁর “পালঙ্ক” নিয়ে মাঝেমধ্যে কথা হয়, কিন্তু “নাগপাশ”-এর কথা পরিচিত কারো মুখে শুনিনি। এ ছবি নিয়েই একটা স্বতন্ত্র পোস্ট লিখতে পারেন কেউ।
৪
রেজা ভাই, “বেইরা ভাসানী”-র কথা শুনব বলে আপনার পরবর্তী চিঠির অপেক্ষায় দিন গুনছি আমরা সবাই।
সান্ত্বনা - ১৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৩:৩৪ পূর্বাহ্ণ)
ত্যারাব্যারা কি এখনো হয় আপনাদের এলাকায়?
খ্যাল্লার পেছনের গলুইয়ের সংরক্ষিত আসনে বসে নৌকাবাইচ দেখতে ইচ্ছে করছে — আপনার লেখা পড়ার পর থেকেই। এই ইচ্ছেটা বোধ হয় অপূর্ণই থেকে যাবে।
রায়হান রশিদ - ৩১ মে ২০১০ (৮:৫৪ পূর্বাহ্ণ)
সেই কবে থেকে চাতকের মত বসে আছি এই পোস্টটির বাকি পর্বগুলো পড়বার আশায়। রেজা ভাই, আপনি বেঁচে আছেন তো? আশা করি ভাল আছেন।
বিনয়ভূষণ ধর - ৩ জুন ২০১০ (৮:৪৩ অপরাহ্ণ)
@রায়হান! রেজা ভাইয়ের সাথে আমাদের প্রায়ই চেরাগীতে দেখা হয়। উনি এখনো বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন…
রায়হান রশিদ - ৫ জুন ২০১০ (৯:৩৬ অপরাহ্ণ)
জেনে আশ্বস্ত হলাম বিনয়। আমাদের অনুরোধটুকু রেজা ভাইয়ের কাছে কি কোনভাবে পৌঁছে দেয়া সম্ভব? এমন জীবন্ত বর্ণনার লেখা সবসময় পড়া হয় না, তাই এ প্রতীক্ষা। অন্য কিছু না।
সাগুফতা শারমীন তানিয়া - ২ আগস্ট ২০১১ (১১:৪১ অপরাহ্ণ)
আরো পড়তে চাই, কি মিষ্টি লেখা!
মাসুদ করিম - ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ (৩:০১ অপরাহ্ণ)