ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস (আইসিজে) নামের একটি বেশ ডাকসাইটে পুরোনো সংগঠনও তাদের বিবৃতি দিয়েছে অবশেষে (লিন্ক: http://bit.ly/19ls9Dk)। ‘মিরপুরের কসাই’ কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডাদেশে তারা ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন। বলেছে এই রায় এবং শাস্তি নাকি আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। বক্তব্যের পক্ষে জাতিসংঘের একটি দলিলের রেফারেন্সও তারা দিয়েছে, বাংলাদেশ যেটির পক্ষ। বলার অপেক্ষা রাখে না — রেফারেন্সটি ভুল, সেখানে যে বিধানটির উল্লেখ করা হয়েছে সেটির ব্যাখ্যাও ভুল। কেন এবং কিভাবে ভুল সে আলোচনায় এখন যাচ্ছি না, কারণ সে বিষয়ে একটি পৃথক লেখা প্রকাশিত হতে যাচ্ছে শীঘ্রই। বরং আসুন এই সংগঠনটিকে একটু চিনি।
আইসিজে নামের এই সংগঠনটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ১৯৭২ সালে একটি বিশাল রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। শিরোনাম ছিল: The Events in East Pakistan, 1971, A Legal Study। বুঝে না বুঝে, কিংবা ভালভাবে না পড়েই অনেককে দেখেছি এই রিপোর্টটিকেই মহার্ঘ্য কিছু একটা বলে ধরে নিতে। এক পর্যায়ে তো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নেতৃস্থানীয় মানুষদের মধ্যেই উক্ত রিপোর্টটি নিয়ে বিভ্রান্তি এমনই এক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে মুক্তিযুদ্ধের বিদেশী বন্ধুদের সম্মাননা প্রদানের সরকারের যে উদ্যোগ সেখানকার তালিকাতেও কিভাবে কারা যেন আইসিজে-র নামটিও ঢুকিয়ে দিয়েছিল — বন্ধু সংগঠন হিসেবে! বিষয়টি তখন জানতে পারার সাথে সাথেই আইসিএসএফ (International Crimes Strategy Forum) এর পক্ষ থেকে একটি জরুরী মেমো লিখে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের সবার কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল (মেমোটি এই লিন্ক থেকে পড়ে নেয়া যাবে: bit.ly/hFAcrS। সময়োচিত সে পদক্ষেপের ফলে একটা বড়ো ধরণের বিব্রতকর ঘটনা এড়ানো গিয়েছিল সে যাত্রায়।
যা বলছিলাম। আইসিজে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেই ১৯৭২ সালেই তাদের রিপোর্টে কি বলেছিল জানতে চান? তাহলে শুনুন, অনেকগুলোর মধ্যে মাত্র অল্প কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করছি:
(১) ইতিহাস বিকৃতি :
১৯৭১-এ গণহত্যার কথা আইসিজে স্বীকার করেছে ঠিকই, কিন্তু পাকবাহিনীর সুপরিকল্পিত বাঙালী নিধনযজ্ঞের সাথে বিচ্ছিন্ন আকারে ঘটিত বিহারীদের হত্যার পার্থক্য করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল আইসিজে। মুক্তিযোদ্ধাদের এবং সেইসাথে মুজিবনগর সরকারকেও একরকম দায়ী করে বসেছিল এই সংগঠনটি। আইসিজে-র ভাষায় — দু’পক্ষই অপরাধ করেছে।
(২) আন্তর্জাতিক আইনের অপব্যাখ্যা:
ঠিক এখনকার মতোই তখনও তারা ঝোলা থেকে বের করেছিল আন্তর্জাতিক আইনের কিছু বিধান। আর সে সব বিধানকে কেন্দ্র করে ফতোয়া দিয়েছিল – আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার আওয়ামী নেতৃত্বের নাকি কোনো অধিকার/এখতিয়ারই ছিল না স্বাধীনতা ঘোষণা করবার। এবং ঘোষিত সেই স্বাধীনতাকে ওরা বলেছিল ‘অবৈধ’। আইসিজে’র এই আইনী অপব্যাখ্যার ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে আইসিএসএফ এর মেমোতে, উপরের লিন্ক থেকে বিস্তারিত পড়ে নিতে পারেন।
(৩) একটি জাতির মুক্তির গৌরবময় সংগ্রামকে হীনভাবে উপস্থাপন:
আইসিজে তাদের সেই বিখ্যাত রিপোর্টে মুক্তিবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থাপন করেছে কিছু ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ insurgent হিসেবে। এ আর নতুন কি? রাজাকার-আলবদর থেকে শুরু করে পুরো পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিকযন্ত্রও তো একই কাজই করেছিল! এছাড়াও, পুরো স্বাধীনতা যুদ্ধকে ‘গৃহযুদ্ধ’ বলা তো আছেই! আইসিজে সম্ভবত প্রথম ডাকসাইটে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সংগঠন যেটি মুক্তিযুদ্ধকে তাদের আনুষ্ঠানিক রিপোর্টে ‘সিভিল ওয়্যার’ হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। মুক্তিযুদ্ধকে কেন আইনীভাবেও ‘সিভিল ওয়্যার’ বলা যাবে না, তা জানতে পড়ুন: http://bit.ly/16stlE5।
(৪) ভারতের সমালোচনা:
প্রতিবেশী দেশ ভারত কেন শরণার্থী ইস্যুতে এবং সামরিক ইস্যুতে স্বাধীন বাংলার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল তার জন্যও আইসিজে-র পক্ষ থেকে কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। গণহত্যা হতে দেখেও হাত পা গুটিয়ে না বসে থাকাটা ভারতের দিক থেকে বিশাল অন্যায় হয়ে গেছে — আইসিজে-র সেটাই মূল বক্তব্য!
সেই আইসিজে আজকে কাদের মোল্লার রায় নিয়েও আবারও নতুন করে আন্তর্জাতিক আইনের ভুলভাল ব্যাখ্যা দিয়ে নাকি-কান্না জুড়ে দেবে — সেটা কি খুব অবাক হবার মতো ঘটনা?
রায়হান রশিদ
জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৪ comments
নির্ঝর - ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৩ (১০:৫৯ অপরাহ্ণ)
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অফ জুরিস্টস এর রিপোর্টের লিঙ্ক : The Events in East Pakistan, 1971: A Legal Study
রায়হান রশিদ - ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩ (৮:৪৬ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ। পোস্টেও যুক্ত করছি।
রবিউল ইসলাম সবুজ - ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৩ (২:৩০ অপরাহ্ণ)
চার দশক ধরে এই ধরনের একখান Organization টিকে যায় কি করে??!!
আর যাতে জাত্সাপগুলো সুই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরুতে না পারে।
সর্বজনীন একটি প্লাট্ফরম থেকে প্রতি মুহূর্তে যদি প্রতিটি ছোবলের
খবর গণমানুষকে জানিয়ে দেয়া যেত, আমার দেশের মানুষ সচেতন হতে পারত,
প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারত প্রতি মুহূর্তে, অবলীলায়!
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও এর ঐতিহাসিক পটভূমি, বাঙালি জাতি ও এর রাজনৈতিক টাইমলাইন –
এ সংক্রান্ত কোনো মানসম্মত Archive আমাদের আছে কি? যার উপর বিদেশী যে-কেউ নির্ভর করতে
পারে সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাবার আশায়? না থাকলে, আজই কাজ শুরু করতে হবে।
রায়হান রশিদ - ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩ (৮:৪৪ পূর্বাহ্ণ)
অনলাইনেই সহজে এবং বিনামূল্যে দেখে নেয়া যায় এমন বেশ কিছু আর্কাইভ রয়েছে যেখান থেকে সার্বক্ষণিকভাবে টুইটারে, ইমেইলে এবং ব্যক্তিগত আলাপে দেশ বিদেশের সাংবাদিক এবং একাডেমিকরা উপকৃত হচ্ছেন। আইসিএসএফ এর নিজেরই দু’টো পৃথক দলিল এবং সংবাদপত্রের আর্কাইভ রয়েছে, এছাড়াও রয়েছে ভিডিও আর্কাইভ – যেখান থেকে ছয় দফা থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক দলিলগুলোর প্রায় প্রতিটিই ডাউনলোড করে নেয়া যাবে। এছাড়াও এ পর্যন্ত লেখা মান সম্মত অসংখ্য গবেষণা নিবন্ধ তো রয়েছেই। সবচেয়ে অথরিটেটিভ সূত্র যদি মানতে হয় তাহলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে এ পর্যন্ত দেয়া রায়গুলোও রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতিটি রায়েই ট্রাইবুনালের পক্ষ থেকে পুরো ইতিহাসের বয়ান লিপিবদ্ধ করে কেবল তারপরই অভিযুক্ত অপরাধীদের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ট্রাইবুনাল ইতিহাসের তথ্যগুলো সেখানে ‘জুডিশিয়াল নোটিশ’ আকারে গ্রহণ করেছে।
উপরোক্ত সূত্রগুলো আগ্রহীদের জন্য। তবে “মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমি” নিয়ে এখন আর কোনো গ্রহণযোগ্য বিতর্ক আছে বলে মনে করি না। খোদ জামায়াতে ইসলামীও ট্রাইবুনালে ঐতিহাসিক পটভূমি বিকৃত করার চেষ্টা করেনি। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের পরাজিত শক্তি যে বিতর্কটি জোরদার করতে এখন মনোনিবেশ করছে তা হল ১৯৭১ সালে অপরাধী পক্ষের ভূমিকা এবং সাফাই-ইতিহাস লেখার আয়োজন।
ধন্যবাদ।