নিচের এই দৃশ্যগুলো অসম্ভব এবং অলীক ছিলো বলেই আমাদের আজকে একটা দেশ আছে। অনেক কমতি, অনেক ঘাটতি, অনেক সীমাবদ্ধতা – তারপরও তো একটা দেশ, আমাদের দেশ! অথচ আমরা জানি – বহু তালেবর মানুষের পক্ষেই সময়ের সেই সন্ধিক্ষণে – বিদেশী বৃত্তির মোহ, উঁচু পদে চাকরীর অভ্যাস, ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ, গোলামীর মোহ, পরিবারের সদস্যদের চোখের জলের হাতছানি অনুযোগ উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি সেদিন। এর বিপরীতে নিচের এই মানুষগুলো, এবং তাদেরই মতো আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ সেদিন প্রচলিত বৃত্তের গন্ডি থেকে বেরিয়ে না আসলে কি হতে পারতো, এবার আসুন একটু কল্পনা করার চেষ্টা করি:
দৃশ্য এক:
———-
সকাল বেলা বঙ্গবন্ধু সু্যুট প্যান্ট জুতা পরে রেডি, বেগম মুজিব উনার টাই বেঁধে দিচ্ছেন। ভাবছেন – ছেলেমেয়েগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে, ওদের ভাল জায়গায় পড়াশোনা, ভাল জায়গায় বিয়ে-শাদী দিতে হলে, আরেকটু ভালো স্ট্যাটাস নিয়ে থাকতে হলে – আয় রোজগারটা আরেকটু না বাড়ালেই চলছে না! বারবার নার্ভাস হয়ে ঘড়ি দেখছেন বঙ্গবন্ধু, বড় সাহেবের সাথে মিটিংটা না দেরী হয়ে যায়, ক্যারিয়ারের জন্য আজকের মিটিংটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দৃশ্য দুই:
———
তাজউদ্দিন আহমেদ মাল্টি ন্যাশনাল কোনো কোম্পানীর একজিকিউটিভ – রিভলভিং চেয়ারে বসে পুত্র কন্যাদের ভবিষ্যত নির্বিঘ্ন করার কাজে রাত দিন খাটছেন।
দৃশ্য তিন:
———
আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ পাকা। বিমান বন্দরে ব্যাগ নিয়ে অপেক্ষা করছে রুমি, একটু পরেই ফ্লাইট, বিদায় জানাতে এসেছেন জাহানারা ইমাম, বলছেন – “বাবা তুই ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস, বাকিরা মরুক, তুই লেখাপড়া কর আর ক্যারিয়ার গোছা, সেটাই দরকারী!”
সেদিন সঠিক পথ আসলে কি ছিল সেটা বুঝতে আজ আমাদের কোনো সমস্যা হয় না। আজকে বাংলাদেশের মাটিতে ১৯৭১ এর চিহ্নিত অপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে অবধি একে আমরা গাল ভরে বলি “দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ”, বলি “অসমাপ্ত কাজ”। যদি তাই সত্য হয়ে থাকে তাহলে ৪১ বছর আগেকার মতো এখনও আজাদ-রুমিরা আবারও নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে চারপাশের নিম্ন-মাঝারী বৃত্তগুলো ভেঙ্গে। বিশ্বাস করতে চাই, বিশ্বাস রাখতে চাই।
রায়হান রশিদ
জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
মাসুদ করিম - ১৫ অক্টোবর ২০১২ (১:০৩ অপরাহ্ণ)
বৃত্ত ভাঙ্গবে? মনে হয় না। তার প্রধান কারণ এখানকার মানুষ ব্যক্তিই বোঝে না। তারা বোঝে কোনো মতে খেয়ে দেয়ে একে ওকে খোঁচা দিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে। ব্যক্তি বুঝলে ব্যক্তির উৎকর্ষকে বুঝলে সমষ্টির সাথে সমন্বয় অনেক সহজ হয়। এখানে মানুষ সমাজের অনেক দূরে পরিবারে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করে — নিজেদেরকে সামাজিক মিশুক আরো কতকিছু বলে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ায় — সত্যিকার অর্থে সে না বুঝে সমাজ না বুঝে বাস্তবতা, মূল সমস্যা সে যে ব্যক্তিকেই বুঝতে পারে না।
রায়হান রশিদ - ১৫ অক্টোবর ২০১২ (১১:২২ অপরাহ্ণ)
অসাধারণ বলেছেন। এভাবে ভাবিনি।
সুমিমা ইয়াসমিন - ১৬ অক্টোবর ২০১২ (১১:০০ পূর্বাহ্ণ)
আমরা হতাশ হতে চাই না। বিশ্বাসটা জিইয়ে রাখতে চাই…। সংখ্যায় হয়তো কমে এসেছে, তবে দেশের স্বার্থ নিয়ে ভাবছে, এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি।
রায়হান রশিদ - ২১ অক্টোবর ২০১২ (৩:৪২ অপরাহ্ণ)
তা তো বটেই, নাহলে এতো ঝড়-ঝাপটার মধ্যে এই দেশটা টিকে থাকতো না। কিন্তু যে মানুষগুলোর কথা বলছেন তারাও যে খুব শান্তিতে আছে তাও তো না।
একদিকে এই দেশে আবুলদের মতো চিহ্নিত অসতদেরকে যেমন ‘দেশপ্রেমিক’ সার্টিফিকেট দেয়া হয়, তেমনি আরেক দিকে মাসরুরুল হুদা সিরাজীর মতো মানুষদের পেছনে লেলিয়ে দেয়া হয় দূর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানকে। অথচ দেশটা টিকে আছে সিরাজীদের মতো মানুষের জন্যই।
সবুজ পাহাড়ের রাজা - ১৯ অক্টোবর ২০১২ (৪:১৩ পূর্বাহ্ণ)
এই দেশের কোন পরিবর্তন হবে না। মানুষ সব নষ্ট হয়ে গেছে। থাকার পরিবেশ নেই আর এই দেশে।—এমনটা ভেবে দেশ ছাড়ার চিন্তা করেছি। আর ছয়-সাত মাস পর দেশ ছেড়ে চলেও যাবো।
আপনার লেখায় রুমির কথা পড়ে, মায়ের একাত্তরের ডাইরীর কথা মনে পড়ল। নিজেকে অপাঙতেয় মনে হচ্ছে।
যতই নিজের অবস্থান থেকে দেশের জন্য, মানবতার জন্য কাজ করার চেষ্টা করি না কেন, রুমিদের তুলনায় তা নস্যি।
ব্যাক্তিস্বার্থের উপরে উঠতে পারলাম না মনে হয়।
রায়হান রশিদ - ২১ অক্টোবর ২০১২ (৩:৪৬ অপরাহ্ণ)
এটা নিশ্চয়ই আক্ষেপের কথা।