কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশে মুক্তিসংগ্রামের সেই মূলনীতিগুলো কেমন করে বাস্তবায়িত হবে সেটাই হয়ে উঠলো নতুন সংগ্রাম। রাষ্ট্রীয়ভাবে, সাংবিধানিকভাবে সে সব মূলনীতির বাস্তবায়নই শুধু নয়, এবারের এই সংগ্রামের আসল পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ালো সেই চেতনায় পরের প্রজন্মকে দীক্ষিত করে তোলা [..]

দৈনিক বাংলা, ২১ জানুয়ারী ১৯৭২

বৈষম্যের বিরুদ্ধে, সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে একত্র হয়ে একটা পুরো জাতি মুক্তিযুদ্ধ তো করলো। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে বিজয়ও অর্জন করলো। কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশে মুক্তিসংগ্রামের সেই মূলনীতিগুলো কেমন করে বাস্তবায়িত হবে সেটাই হয়ে উঠলো নতুন সংগ্রাম। রাষ্ট্রীয়ভাবে, সাংবিধানিকভাবে সে সব মূলনীতির বাস্তবায়নই শুধু নয়, এবারের এই সংগ্রামের আসল পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ালো সেই চেতনায় পরের প্রজন্মকে দীক্ষিত করে তোলা। তারই চেষ্টায় কলম হাতে তুলে নিয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন দেশের লেখক বুদ্ধিজীবিরা। ‘নতুন করে গড়ব এদেশ’ শিরোনামে ছোটোদের উদ্দেশ্যে নিচের এই লেখাটি লিখেছিলেন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ছাপা হয়েছিল দৈনিক বাংলা পত্রিকায় ছোটোদের ‘সাত ভাই চম্পা’ পাতায়। তাত্ত্বিকভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘গণতন্ত্র’, কিংবা ‘সমাজতন্ত্র’ কথাগুলো এখানে যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তা কারও কারও কাছে হয়তো কিছুটা সরলীকৃত বা খন্ডিত মনে হবে। হতেই পারে, আমারও মনে  হয়েছে। তবে শুরুর ভাবনাগুলো জানার আগ্রহ থেকেই লেখাটি হুবহু (তখনকার বানান রীতি ও মুদ্রণপ্রমাদসহ) উপস্থাপন করা হল নিচে।

 

নতুন করে গড়ব এদেশ
– মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান

ছোট বন্ধুরা, আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। তোমরা এর মধ্যেই বড়দের কাছে শুনেছ, নিজেরাও জেনেছ : কিভাবে আমরা এই স্বাধীনতা পেয়েছি। তোমরা শুনেছ, এই স্বাধীনতা লাভের জন্য লক্ষ লক্ষ শহীদ জীবন দিয়েছেন, মুক্তি বাহিনীর অসীম সাহসী বীর ভাইরা মরণপণ লড়েছেন; আমাদের নেতারা কত বিপদের ঝুকি নিয়ে দেশ দেশান্ত পাড়ি দিয়েছেন; আমাদের জ্ঞানীগুণিরা দেশে দেশে জনমত গড়েছেন, বিদেশী কত বন্ধু আমাদের কথা সবাইকে জানিয়েছেন এবং দেশের সকল মানুষ শত অত্যাচারেও হার মানেনি। এসো আজ আমরা আমাদের লক্ষ লক্ষ শহীদের উদ্দেশে আমাদের শ্রদ্ধা জানাই, কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানাই আমাদের মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের; কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই মিত্রবাহিনী–ভারতীয় বীর সেনানীদের, অভিনন্দিত করি আমাদের নেতাদের, জ্ঞানীগুণিদের ও বীর দেশবাসী সকলকে।

আজ আমাদের এ দেশ, স্বাধীন বাংলাদেশ, নতুন করে গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আমরা কেউ আলসেমি করব না, বসে থাকবো না – আমরা সব কিছু নতুন করে গড়ব। এই গড়ার ব্যাপারে আমাদের বাংলাদেশ সরকার যে মূলনীতি ঘোষণা করেছেন সেটা খুবই চমৎকার। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত আমাদের সরকার ঘোষণা করেছেন যে আমাদের রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে তিনটি : ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। কথাগুলো তোমাদের জন্যে বেশ কঠিন কিন্তু আস্তে আস্তে যদি বুঝতে চেষ্টা করো, তাহলে বুঝবে এগুলো কত সুন্দর কথা।

প্রথমটাই ধরা যাক : ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কি? তোমরা জানো আমাদের বাংলাদেশে নানা ধর্মের লোক আছে। তোমাদের স্কুলের কি পাড়ার বন্ধুদের কথাই ভাবো না কেন – তারা কি সবাই এক ধর্মের? মোটেই না। কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ, কেউ খৃস্টান। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা সবাই তো বন্ধু। মুসলমান, কি হিন্দু, কি বৌদ্ধ, কি খৃস্টান বলে তো আর বন্ধুত্ব কমে যায় না! কেন না সকলের সবচেয়ে বড় পরিচয় কি? বড় পরিচয় হচ্ছে : সকলেই মানুষ। বাংলাদেশে আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় : আমরা মানুষ, আমরা বাঙ্গালী। এই যে চিন্তা – এর মানেই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতার মানে হচ্ছে : এক ধর্মকে অন্য ধর্মের চেয়ে বড় করে না দেখা – সব ধর্মকে সম্মান করা। ধর্মনিরপেক্ষতা যাদের ভাল লাগে না তারা কেউ কেউ বলতে পারে যে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মকে বাদ দেয়া। কিন্তু তা মোটেও ঠিক নয়। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মকে বাদ দেয়া নয় – ধর্মান্ধতাকে বাদ দেয়া, গোঁড়ামীকে বাদ দেয়া। ধর্মের গোঁড়ামী যে কত খারাপ সে তো তোমরা এখন সকলেই জান। ধর্মের নামে বর্বর পাকিস্তানী সেনাপতিরা ও তাদের অনুচরেরা বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র নিরপরাধ মানুষকে খুন করেছে – পৃথিবীর ইতিহাসে তার তুলনা নেই। তাই ধর্মান্ধতা আমরা কেউ পছন্দ করি না। আমাদের রাষ্ট্রের এক মুলভিত্তি তাই ধর্মনিরপেক্ষতা – অর্থাৎ বাংলাদেশে সব ধর্মের সমান অধিকার। এটা গণতন্ত্রেরও শর্ত বটে।

দ্বিতীয় কথাটা হচ্ছে : গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের মানে হচ্ছে দেশ চালাবার কাজে সকল মানুষের মতের দাম দিতে হবে। ধরো তোমরা দশজন বন্ধু। দশজনের দশ রকমের ইচ্ছে হতে পারে। কেউ খেলতে চায়, কেউ বেড়াতে চায়, কেউ পড়তে চায়, কেউ ঘুমুতে চায়, কেউ চায় সাঁতার কাটতে, কারো ইচ্ছে মাছ ধরার – এভাবে এক এক জনের এক এক রকম ইচ্ছে হতে পারে। তা হলে কি হয়? যার যার খুশীমত চললে প্রত্যেকে আলাদা আলাদা হয়ে যায়, এক সঙ্গে আর থাকা যায় না। আর এক সঙ্গে না থাকলে বন্ধুত্বও থাকে না। এক সঙ্গে থাকতে হলে কি করা দরকার? একজন আর একজনের কথা শোনো – এক এক জনের এক এক মত থেকে একমতে পৌঁছানো এবং এক সঙ্গে কাজ করাই হচ্ছে গণতন্ত্রের আসল কথা। দেশের সকলের ভালর জন্যে – গণতন্ত্রে যারা বিশ্বাসী তারা কাজ করেন। গণতন্ত্রের মূলকথা হচ্ছে দেশের কাজে সব মানুষের সমান অধিকার।

তৃতীয় কথাটা হচ্ছে সমাজতন্ত্র। দেশের সব মানুষের গণতন্ত্রের নামই সমাজতন্ত্র। অর্থাৎ দেশের সব মানুষ যখন দেশের সুযোগ-সুবিধা অধিকার সমানভাবে ভোগ করে, কেউ কারো চেয়ে বড়ছোট উঁচুনীচু থাকে না – তখনই দেশে সমাজতন্ত্র আসে। তোমার স্কুলের ছেলেদের কথাই ধরো। তারা কেউ খুব বড় লোক, কেউ মোটামুটি মাঝারি আর কেউবা খুব গরীব লোকের ছেলেমেয়ে। তারা নিজেরা কিন্তু কেউ বড় লোক গরীব লোক নয় – সকলেই ছাত্র, বন্ধু। তবু বড় লোকের ছেলে আর গরীব লোকের ছেলের তফাৎ ঠিকই বোঝা যায়। সমাজতন্ত্র হচ্ছে – এই তফাৎ ঘুচিয়ে দেয়া – সবাইকে এক করে ফেলা, যাতে কেউ বড়লোক আর কেউ গরীবলোক আর কেউ মাঝারি না হতে পারে – যাতে করে সবাই সমান – পরস্পরের ভাই হতে পারে। সুতরাং বুঝতে পারছো এটা কত মহান নীতি। আমাদের সরকার যে এই নীতি ঘোষণা করেছেন এটা নিশ্চয়ই খুব আনন্দের।

তোমাদের আমি খুব অল্প কথায় বাংলাদেশ সরকারের তিনটি মূলনীতি – ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা বললাম। এগুলো শুনতে যত সোজা – সত্যি সত্যি জীবনে প্রতিষ্ঠা করা তত সোজা নয়। বিশেষ করে অল্প কিছুদিন আগেও যখন এ দেশের বুকে ধর্মের গোঁড়ামী ও ভন্ডামির বিভীষিকাময় রাজত্ব চলেছে এবং গণতন্ত্রের কোন অস্তিত্বই ছিল না এখানে। তবু আমাদের আশায় বুক বেঁধে, এ দেশকে নতুন করে গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োগ করতে হবে। এবং দেশ গড়ার কাজে আমাদের সরকারের ঘোষিত তিনটি মূলনীতি – ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা আমরা যত বুঝতে পারব এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করব, ততই আমাদের মঙ্গল হবে।

(দৈনিক বাংলা, ২১ জানুয়ারী ১৯৭২)

রায়হান রশিদ

জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।

২ comments

  1. অবিশ্রুত - ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ (২:২০ পূর্বাহ্ণ)

    এরকম একটি লেখা পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে প্রচারাভিযান চালানো উচিত। এটি হলেও চলত, কিন্তু রাষ্ট্রের মূলনীতিবিষয়ক জটিলতায়, বিশেষত এতে সমাজতন্ত্রবিষয়ক আলোচনা থাকায়, সে প্রচারাভিযানে কাজ হবে না। যে দেশের পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘মন্দির’ শব্দ থাকায় পুরো লাইন (তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে) উধাও হয়ে যায়, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতাবিষয়ক আলোচনা যুক্ত করা নিয়েও হয়ত তালবাহানা চলবে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতাবিষয়ক সহজ লেখা যে লেখা সম্ভব, পাঠ্যক্রমে রাখা সম্ভব, সেই বোধোদয় অনেকেরই হবে। এবং প্রচারাভিযান ঠিক মতো চালানো হলে আগামী বছর তা যুক্ত করাও নিশ্চয়ই সম্ভব হবে।

    • রায়হান রশিদ - ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ (৯:০২ অপরাহ্ণ)

      আসলেই, এই জাতীয় লেখাগুলোই প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। অনেক ধন্যবাদ এই প্রস্তাবটির জন্য। এই বিষয়গুলো তো বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে বা ফেসবুক থেকে শেখার জিনিস না।

      বর্তমান পাঠ্যপুস্তকগুলোরও একটু ক্রিটিক্যাল বিশ্লেষণ দরকার, বই ধরে ধরে।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.