এই সংবিধান হল সেই দলিল যেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা। কথাটা আমরা ভুলে যাই, বা ভুলে যেতে বসেছি। আর আমাদের এই ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেয় যারা নেবার। এজন্যই সর্বস্তরে সংবিধান দিবস উদযাপন জরুরী। ক্ষমতাসীনরা না করলেও আমাদের অন্তত করা উচিত। কারণ এই দিনটি আমাদেরই দিন। আমরা মানে জনগণ।

সংবিধান

গতকাল ছিল ৪ নভেম্বর। আমাদের সংবিধান দিবস। প্রতি বছরের মতো এবারও এলো, প্রায় নিরবেই চলেও গেল দিনটি। ব্যাপকভাবে বিস্মৃত, রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলিত এই একটি দিন। ১৯৭২ সালের এই দিনে জাতীয় সংসদে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়েছিল। এর পর দিনটির কথা আমরা প্রায় সবাই একরকম ভুলেই গিয়েছি, রাষ্ট্রীয়ভাবে এই দিনটিকে উদযাপনের কথা আমাদের কারোই মনে থাকে না!

স্বাধীনতা সংগ্রাম, এতো আত্মত্যাগ, এতো রক্তপাত – সে তো ‘সংবিধান’ নামের এই দলিলটি হাতে পাওয়ার জন্যই। যে দলিলটির মাধ্যমে স্বাধীন জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজস্ব সীমানায় নিজেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি। আমাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার (right to self-determination) এর মূর্ত প্রতিফলন এই দলিল।

এই দিনটির তাৎপর্য্য অন্য যে কোনো দিন উদযাপনের চেয়ে কোনো অংশে কম না। বরং আমার বিবেচনায় এই দিনটির তাৎপর্য্য আমাদের অন্য আর সব রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত দিনের চেয়ে হয়তো বেশীই। কারণ, এই দিনটির সঠিক উদযাপন – প্রতি বছর আমাদের মনে করিয়ে দিতে পারে এই সংবিধানের শরীরে ধারণ করা সবচেয়ে জরুরী কথাগুলো। যেখানে আরও অনেক বিষয়ের পাশাপাশি বলা রয়েছে:

– স্বাধীনতার সংগ্রাম, আর তা অর্জনের পথে আমাদের জনগণের ঐতিহাসিক ত্যাগ স্বীকারের কথা।
– এই ভূখন্ডের মানুষদের মৌলিক অধিকারগুলোর কথা।
– আমাদের রাষ্ট্রটি কি কি মৌল নীতি দ্বারা পরিচালিত হবে বা হওয়া উচিত, সেই স্বপ্ন আর উপলদ্ধিগুলোর কথা।
– যারা এই দেশটির বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষমতায় থেকে শাসন করবেন, তাদের দায়বদ্ধতা আর জবাবদিহিতার কথা।
– সারা বিশ্বের দরবারে আমরা কি কি নীতির ভিত্তিতে নিজেদের তুলে ধরবো সেকথা।
– আমাদের অতীত, ঐতিহ্যের প্রতি এই রাষ্ট্রের এবং সম্মিলিতভাবে আমাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে সেকথা।

সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল – এই সংবিধান হল সেই দলিল যেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা। যেখানে ঘোষণা করা হয়েছে – এই সংবিধান হল ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি’ [অনুচ্ছেদ ৭(২)]। বলা আছে – ‘এই প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’। বলা আছে – শুধু এই জনগণের হয়েই এই সংবিধানের সব ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রয়োগ কার্যকর হবে [অনুচ্ছেদ ৭(১)]।

এই কথাগুলোই আমরা ভুলে যাই, বা ভুলে যেতে বসেছি। আর আমাদের এই ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেয় যারা নেবার।

এজন্যই সর্বস্তরে দিনটির উদযাপন জরুরী। রাষ্ট্র বা ক্ষমতাসীনরা যদি আনুষ্ঠানিকভাবে এই দিনটি উদযাপন নাও করে, আমাদের অন্তত করা উচিত। কারণ এই দিনটি আমাদেরই দিন। আমরা মানে জনগণ।

(ফেসবুক স্ট্যাটাস লিন্ক)

*সহ-ব্লগার মাসুদ করিম দিনটির কথা মনে করিয়ে দিলেন টুইটারে। অশেষ কৃতজ্ঞতা সে জন্য।

রায়হান রশিদ

জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।

৪ comments

  1. মাসুদ করিম - ৬ নভেম্বর ২০১৫ (৮:৫৮ পূর্বাহ্ণ)

    হাবিবুর রহমানের ‘বাংলাদেশের তারিখ’ খুলে দেখি ওই একই দিন এটাও ঘোষণা করা হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে সংবিধান চালু হবে এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা হল ৭ মার্চ ১৯৭৩এ বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণাও এদিন দেয়া হয়। গণপ্রজাতন্ত্রের জন্য এমন তাৎপর্যের দিন আমরা ভুলে বসে আছি। আরো একটি অসাধারণ তথ্য পেলাম ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭২এ বঙ্গভবনে সংবিধান মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার পুনরায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছিল।

  2. অবিশ্রুত - ৮ ডিসেম্বর ২০১৫ (২:১৭ পূর্বাহ্ণ)

    বাঙলার পাঠশালা আয়োজিত বাংলাদেশ সংবিধান প্রথম সম্মাননা স্মারক ২০১৫ প্রাপ্তি উপলক্ষে গত ৪ অগ্রহায়ণ ১৪২২/ ১৮ নভেম্বর ২০১৫ বুধবার ‘আমাদের সংবিধান, স্বাধীনতার লক্ষ্য এবং চার দশকের অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক স্বাগত ভাষণ দেন কামাল হোসেন (ডক্টর, সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, প্রাক্তন আইন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাংলাদেশ সংবিধান (১৯৭২) রচনা ও প্রণয়ন কমিটির সভাপতি)।
    এ বক্তব্যে (বক্তব্যটি বুকলেট আকারে বাঙলার পাঠশালা থেকে প্রকাশিত হয়েছে) কামাল হোসেন বলেছেন :

    কিন্তু বিচ্যুতির ফলে দেশে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সৌভাগ্যবান যে জনগণের লাগাতার প্রচেষ্টা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংকট নিরসনে সমর্থ হয়েছি। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে জনগণের ঐকমত্যকে কার্যকর করা হয়। সেটা কিভাবে কার্যকর করা হয়েছে, তা সংবিধানের একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ সংশোধনীতে দেখা যায়।
    ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলনের ফলে তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং একজন গ্রহণযোগ্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সংবিধানের একাদশ সংশোধনীকে অনুসরণ করে দ্বাদশতম সংশোধনীর মাধ্যমে বিরাজমান সংকটের নিরসন হয়। একই অভিজ্ঞতা ১৯৯৬ সালের সংকট এড়াতে আমাদের সাহায্য করে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচনে জনগণের স্বত:স্ফূর্ত অংশ গ্রহণ ছিলো না। জনগণ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের বিধান তৈরি হয়। ২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার কারণে দেশ তৃতীয়বারের মত সংকটে পতিত হওয়ার হুমকি তৈরি হয়। ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি তত্ত্বাবধায়ক প্রধান উপদেষ্টার পদ ত্যাগ করে একজন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক প্রধান উপদেষ্টার নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে এই সংকটও এড়ানো সম্ভব হয়েছিলো।

    অর্থাৎ এই বক্তব্য অনুযায়ী, সংবিধানবিশেষজ্ঞ কামাল হোসেনের মতে, দেশে প্রথম সাংবিধানিক সংকট দেখা দেয় ১৯৯০ সালে। সংবিধানের একাদশতম সংশোধনীকে অনুসরণ করে দ্বাদশতম সংশোধনীর মাধ্যমে তা নিরসন করা হয়। দ্বিতীয় সংকট দেখা দেয় ১৯৯৬ সালে বিএনপির শাসনামলে, ত্রয়োদশতম সংশোধনীর মাধ্যমে তা নিরসন হয়। তৃতীয় সংকট দেখা দেয় ২০০৭ সালে, যার সমাধান হয় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু’বছরের শাসনামলের পর ২০০৮ সালের নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে।
    সংবিধান, সাংবিধানিক সংকট বোঝা খুবই কঠিন। শুধু সামান্য কৌতূহল, তা হলে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারিতে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন কি কোনো সাংবিধানিক সংকট নয়? এটিকে কি তা হলে সাংবিধানিক উত্তরণ বলতে হবে? সংবিধানবিশেষজ্ঞরা ঝেড়ে কাশুন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মম হত্যার মাধ্যমে সংবিধান, সংসদ স্থগিত ও সামরিক শাসন প্রবর্তন কি কোনো সাংবিধানিক সংকট নয়? ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল কি কোনো সাংবিধানিক সংকটও নয়? পুরো বক্তব্যে তিনি একবারও পঞ্চম সংশোধনীর কথা বলেননি, যা আমাদের সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করেছে (নাকি আমিই খুঁজে পাইনি!)। কামাল হোসেন নিঃসন্দেহে বিশেষজ্ঞ মানুষ, তিনি যখন এগুলোকে সাংবিধানিক সংকট মনে করেন না তা হলে হয়তো সত্যিই এগুলো সাংবিধানিক সংকট নয়। না কি আমার মতো আমজনতার আর কামাল হোসেনদের সংবিধানভাবনায় দুস্তর ব্যবধান?

  3. মাসুদ করিম - ৫ নভেম্বর ২০২০ (৩:২০ পূর্বাহ্ণ)

    জাতীয় জীবনে ৪ নভেম্বর

    আমরা, বাংলাদেশের জনগণ রাষ্ট্রীয় বা জাতীয়ভাবে কতোগুলো দিবস পালন করি। এর মধ্যে একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬ শে মার্চ জাতীয় ও স্বাধীনতা দিবস, ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম দিবস, ১৫ই অগাস্ট ‘জাতীয় শোক দিবস’, ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস অন্যতম। সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নেওয় হয়েছে ৭ই মার্চ-কে ‘ঐতিহাসিক দিবস’ হিসেবে পালন করার।

    এছাড়াও জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ঘোষিত বিভিন্ন দিবসসহ জাতীয়ভাবে নারী দিবস, যুব দিবস, সমবায় দিবস সহ বিভিন্ন দিবস পালন করা হয়। আমাদের জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন ৪ নভেম্বর কেটে যায় নিরবে-কোন ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া। ৪ নভেম্বর ১৯৭২ গণপরিষদে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ‘সংবিধান বিল’ হিসেবে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সাংবিধানিক ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লাগাতার সংগ্রাম করেছে। দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সর্বপোরি নয় মাসের একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ, মা-বোনদের সম্ভ্রম বিসর্জনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন একটি অনন্য ও ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ছিল।

    পাকিস্তান সৃষ্টির পর সংবিধান তৈরিতে সময় লেগেছিল প্রায় আট বছর। ওই সংবিধান তৈরির পরপরই অব্যাহত সামরিক শাসন মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রকে একটি জংলী-বর্বর রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল, যেখানে সাংবিধানিক এবং আইনের শাসন ছিল অনুপস্থিত। ২২ মার্চ ১৯৭২ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক Constitutent Assembly of Bangladesh Order, 1972 জারি করা হয়। রাষ্ট্রপতির ওই আদেশ বলে ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’। গণপরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৪০৪ জন। বহিস্কৃত ও পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য পোষণকারী সদস্যরা গণপরিষদের সদস্য পদ লাভে অযোগ্য ছিলেন।

    গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১০ এপ্রিল, ১৯৭২। গণপরিষদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার মনোনীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব অনুযায়ী গণপরিষদের প্রবীনতম সদস্য মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ-এর সভাপতিত্বে গণপরিষদের কার্যক্রম শুরু হয়। মাওলানা তর্কবাগীশ সভাপতির আসনে গ্রহণ করে প্রথমে নিজেই নিজের শপথ বাক্য পাঠ করেন এবং পরবর্তীতে পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের শপথ পাঠ করান। একই অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামের সমর্থনে শাহ আব্দুল হামিদ (এন ই-৫, রংপুর) স্পিকার ও তাজউদ্দীন আহমদের প্রস্তাবে এবং মনসুর আলীর সমর্থনে মুহাম্মদুল্লাহ (পি ই-২৭৫, নোয়াখালী) ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন।

    পরদিন ১১ এপ্রিল গণপরিষদের অধিবেশনে মনসুর আলী বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করার উদ্দেশ্যে একটি প্রস্তাব করেন। সেই প্রস্তাবে ছিল, ‘গণপরিষদের ৩৪ জন সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত খসড়া প্রণয়ন কমিটি- যার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. কামাল হোসেন’। প্রস্তাবটি উত্থাপন করলে তা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জুনের মধ্যে কমিটি বিল আকারে একটি খসড়া শাসনতন্ত্রসহ রিপোর্ট পেশ করার কথা থাকলেও কমিটির পক্ষে সভাপতি কামাল হোসেন ১২ অক্টোবর ১৯৭২ ‘সংবিধান বিল’ গণপরিষদে উত্থাপন করেন।

    বঙ্গবন্ধু এ উপলক্ষে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, ‘দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা যায় না, দশ মাসের মধ্যে কোন দেশ শাসনতন্ত্র দিতে পেরেছে। আমি নিশ্চই মোবারকবাদ জানাবো শাসনতন্ত্র কমিটির সদস্যদেরকে। মোবারকবাদ জানাবো বাংলার জনসাধারনকে। রক্তে লেখা এই শাসনতন্ত্র। যাঁরা আজ অন্য কথা বলেন বা চিন্তা করেন, তাঁদের বোঝা উচিত যে, এ শাসনতন্ত্র আলোচনা আজ থেকে শুরু হয় নাই। অনেকে যাঁরা বক্তৃতা করেন, তাঁদের জন্মের আগের থেকে তা শুরু হয়েছে এবং এ জন্য অনেক আন্দোলন করতে হয়েছে। অনেক রক্ত দিতে হয়েছে। এই শাসনতন্ত্রের আলোচনা হতে হতে শাসনতন্ত্র কী হবে তার উপরে ভোটের মাধ্যমে, শতকরা ৯৮ জন লোক তাঁদের ভোট আওয়ামী লীগকে দিয়েছেন। শাসনতন্ত্র দেওয়ার অধিকার আওয়ামী লীগের রয়েছে। . . . । শাসনতন্ত্র ছাড়া কোন দেশ- তার অর্থ হল মাঝি বিহীন নৌকা, হাল বিহীন নৌকা। শাসনতন্ত্রে মানুষের অধিকার থাকবে, শাসনতন্ত্রে মানুষের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে কর্তব্যও থাকবে। এখানে চলতে পারে না। শাসনতন্ত্রে জনগণের অধিকার থাকবে, কর্তব্যও থাকবে। এবং যতদূর সম্ভব, যে শাসনতন্ত্র পেশ করা হয়েছে, সেটা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে থাকবে, সে সম্বন্ধে আমার কোন সন্দেহ নেই। আমাদের আদর্শ পরিষ্কার হয়ে রয়েছে। এই পরিষ্কার আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এবং সে আদর্শের ভিত্তিতে এদেশ চলবে। জাতীয়তাবাদ-বাঙালি জাতীয়তাবাদ-এই বাঙালি জাতীয়তাবাদে চলবে বাংলাদেশ। বাংলার কৃষ্টি, বাংলার ঐতিহ্য, বাংলার আকাশ-বাতাস, বাঙালির রক্ত দিয়ে বাংলার জাতীয়তাবাদ। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, জনসাধারণের ভোটের অধিকার বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি সমাজতন্ত্রে, যেখানে শোষণহীন সমাজ থাকবে। শোষক-শ্রেণী আর কোনদিন দেশের মানুষকে শোষণ করতে পারবে না।. . . । আর হবে ধর্মনিরপেক্ষতা। . . . । এই চারটি আদর্শের ভিত্তিতে বাংলার শাসনতন্ত্র তৈরি হবে। এটা জনগণ চায়, জনগণ এটা বিশ্বাস করে। জনগণ এই জন্য সংগ্রাম করেছে। লক্ষ লক্ষ লোক এই জন্য জীবন দিয়েছে। এই আদর্শ নিয়েই বাংলার নতুন সমাজ গড়ে উঠবে’।

    সংবিধান বিল উত্থাপিত হওয়ার পর সর্বমোট ১৭টি অধিবেশনে বিভিন্ন সংশোধনী প্রস্তাবসহ বিলটির উপর আলোচনার পর ৪ নভেম্বর ১৯৭২ গণপরিষদের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।

    সংবিধান বিল গৃহীত হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, ‘জনাব স্পিকার সাহেব, আজই প্রথম সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তাদের শাসনতন্ত্র পেতে যাচ্ছে। বাংলার ইতিহাস বোধ হয় এই প্রথম যে বাঙালিরা তাদের নিজেদের শাসনতন্ত্র দিচ্ছে। বোধ হয় না- সত্যিই এই প্রথম যে, বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিরা জনগণের ভোটের মারফতে এসে তাঁদের দেশের জন্য শাসনতন্ত্র দিচ্ছেন। . . . । এই শাসনতন্ত্র শহীদের রক্ত দিয়ে লেখা। কোন দেশে কোন যুগে আজ পর্যন্ত এত বড় রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে এত তাড়াতাড়ি শাসনতন্ত্র দিতে পারে নাই। . . .। তাই মানুষের মৌলিক অধিকার যাতে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে, তারই জন্য আমাদের পার্টি এই শাসনতন্ত্র প্রদান করল। আশা করি, জনগণ এই শাসনতন্ত্র গ্রহণ করবেন এবং করেছেন। …। এই শাসনতন্ত্রের জন্য কত সংগ্রাম হয়েছে এই দেশে। . . . । শাসনতন্ত্র এমন একটা জিনিস, যার মধ্যে একটা আদর্শ, নীতি থাকে। সেই শাসনতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে আইন করতে হয়।. . . । এই মৌলিক আইন বিরোধী কোন আইন হতে পারবে না।. . . । এটা জনতার শাসনতন্ত্র।…। ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তাহলে আমার জীবন সার্থক হবে, শহীদের রক্তদান সার্থক হবে’।

    বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিষদের অধিবেশন মুলতবী করা হয় এবং ওই দিনটিকে ঠিক করা হয় সংবিধানে সদস্যদের স্বাক্ষর দানের জন্য। সংবিধান কবে থেকে কার্যকর হবে সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘জনাব স্পিকার সাহেব, আজ এই পরিষদে শাসনতন্ত্র পাশ হয়ে যাবে। কবে হতে এই শাসনতন্ত্র বলবৎ হবে, তা আমাদের ঠিক করতে হবে। আমি মনে করি, সেইদিন, যেদিন জল্লাদ বাহিনী রেসকোর্স-ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও আমাদের বন্ধু-রাষ্ট্রের মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পন করেছিল, সেই তারিখ। সেই ঐতিহাসিক ১৬ই ডিসেম্বর তারিখ থেকে আমাদের শাসনতন্ত্র কার্যকর করা হবে। সেই দিনের কথা রক্তের অক্ষরে লেখা আছে। স্পিকার সাহেব, সেই ইতিহাস আমরা রাখতে চাই’।

    ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭২ সংবিধানে গণপরিষদ সদস্যদের স্বাক্ষর দান উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ১৪ তারিখ স্পিকারের আমন্ত্রণে সংবিধানে সর্ব প্রথম স্বাক্ষর দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- প্রথমে সংবিধানের বাংলা এবং পরে ইংরেজি পাঠে। ১৫ তারিখ অনুষ্ঠানের শেষ সময় পর্যন্ত ৪ জন মাননীয় সদস্য- শ্রীমানবেন্দ্র নারায়ন লারমা, শ্রী সুরঞ্জিৎ সেন গুপ্ত, মোহাম্মদ আজিজার রহমান এবং মোহাম্মদ ইব্রাহীম সংবিধানে স্বাক্ষর করেননি। স্পিকার সাহেব অনুপস্থিত সদস্যদের স্বাক্ষর দানের জন্য ‘শেষ বারের’ মত নাম ধরে আহ্বান জানালে বঙ্গবন্ধু স্পিকারকে উদ্দেশ্যে করে বলেছিলেন, ‘আর যদি কেউ দস্তখত করার জন্য আসতে না পেরে থাকেন, তাতে কিছু আসে যায় না। আপনি পরেও তাঁদের দস্তখত নিতে পারেন। . . . । সেজন্য ‘শেষবারের মতো’ বললে কিছুটা অসুবিধা হয়। সেটা আপনার রুলিং হয়ে যায়। তাই আশা করি, আপনার রুলিং আপনি প্রত্যাহার করে আমার অনুরোধ মেনে নেবেন। প্রতি উত্তরে মাননীয় স্পিকার বলেছিলেন, ‘এই পরিষদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের বক্তব্য আমি অনুধাবন করলাম’।

    গণপরিষদের সিদ্ধান্ত ও অভিপ্রায় অনুযায়ী ১৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাত বারোটায় গণপরিষদের বিলুপ্তি ঘটে এবং রাত বারোটার পর অর্থাৎ ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭২ সংবিধান কার্যকর হয়। গণপরিষদ ভেঙ্গে যাওয়া উপলক্ষে বিদায়ী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘গণপরিষদের সদস্যরা তাঁদের কর্তব্য পালন করেছেন। তাঁরা দেশবাসীকে শাসনতন্ত্র দিয়েছেন এবং নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। শাসনতন্ত্র দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের বিলুপ্তি ঘোষণা করেছেন’।

    দীর্ঘ রক্তাক্ত সংগ্রাম ও যুদ্ধের পেক্ষাপটে রচিত সংবিধান এর প্রস্তাবনার প্রথম স্তবক- ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি; এবং প্রস্তাবনার শেষ স্তবক- ‘এতদ্বারা আমাদের এই গণপরিষদ, অদ্য তেরশত উনষাট বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের আঠার তারিখ, মোতাবেক উনিশ শত বাহাত্তর খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসের চার তারিখ আমরা এই সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করিয়া সমবেতভাবে গ্রহণ করিলাম’।

    আমাদের সংবিধান- স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষার একটি অনন্য রাজনৈতিক দলিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে রকমারি বল্লমের অজস্র খোঁচায়। চেষ্টা করা হয়েছে সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূল চরিত্র পাল্টে দেওয়ার। সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ বিভিন্ন প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও বিভিন্ন রায় প্রদানের মাধ্যমে সচেষ্ট থেকেছে এবং আছে সংবিধানের মূল চরিত্র ও কাঠামোকে রক্ষা করতে।

    বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ ও লালনকারী সরকার ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা থাকায় ’৭২-এর সংবিধানে বহুলাংশে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত, লালন ও বিকশিত করার জন্য প্রয়োজন সংবিধানের সঠিক চর্চা ও লালন। আর সে লক্ষ্যেই ৪ নভেম্বর দিনটি জাতীয়ভাবে পালিত হতে পারে ‘সংবিধান দিবস’ হিসেবে। প্রতিবেশী দেশ ভারত (২৬ নভেম্বর), চীন (৪ ডিসেম্বর), ডেনমার্ক (৫ জুন), নরওয়ে (১৭ মে), কাজাকিস্তান (৩১ অগাস্ট), পোল্যান্ড (৩ মে), জাপান (৩ মার্চ), যুক্তরাষ্ট্র (১৭ সেপ্টেম্বর), কানাডা (১ জুলাই), জার্মানী (২৩ মে), বেলজিয়াম (২১ জুলাই), নেদারল্যান্ড (১৫ ডিসেম্বর), অষ্ট্রেলিয়া (৯ জুলাই), আর্জেন্টিনা (১ মে), ব্রাজিল (১৫ নভেম্বর), রাশিয়া (১২ ডিসেম্বর) সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সংবিধান গৃহীত বা কার্যকর হ’য়ার দিনটিকে ‘সংবিধান দিবস’ (constitution day) হিসেবে বিভিন্ন আঙ্গিকে পালন করে থাকে। কোন কোন দেশে ‘সংবিধান দিবস’-এ সরকারি ছুটি পালিত হয়। সংবিধান গৃহীত হওয়ার ৪৮ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে বটে, কিন্তু ‘সংবিধান দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি।

  4. মাসুদ করিম - ১৯ নভেম্বর ২০২০ (২:০৩ অপরাহ্ণ)

    বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতা বাদ: প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ অ্যাক্টিভিস্টদের

    মুজিববর্ষের বিশেষ অধিবেশনে সংসদে শোনানো জাতির পিতার ভাষণ থেকে কিছু অংশ বাদ দেওয়ার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন দুইজন অ্যাক্টিভিস্ট।

    বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ প্রসঙ্গে কিছু অংশ বাদ দিয়ে সংসদে শোনানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।

    সংসদে প্রচার করা ভাষণে বঙ্গবন্ধুর মূল বক্তৃতার কিছু অংশ যে বাদ পড়েছে, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও তা স্বীকার করেছেন। তবে তার ভাষ্য, সংসদ ওই ভাষণ সম্পাদনা করেনি, বেতার থেকে পাওয়া ভাষণটি হুবহু প্রচার করা হয়েছে।

    অন্যদিকে বেতার বলছে, আর্কাইভে যেভাবে আছে, সেই ভাষণটিই সংসদকে দেওয়া হয়েছে, সেখানে নতুন করে কিছু করা হয়নি।

    তাহলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের অডিও রেকর্ড থেকে কবে কখন কীভাবে ওই অংশটি বাদ দেওয়া হল, সে উত্তর মেলেনি।

    ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংসদে ওই ভাষণটি দিয়েছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সংসদে আনা সাধারণ প্রস্তাব গ্রহণের আগে গত ১৫ নভেম্বর সেই ভাষণটিই অধিবেশনে শোনানো হয়।

    কিন্তু সেখানে কিছু অংশ বাদ পড়ায় ১৬ নভেম্বর ফেইসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মাহবুবুর রহমান জালাল।

    তিনি লেখেন- “সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ (১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংসদে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য) এ এডিট !!!”

    সেই ফেইসবুক পোস্টে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সেন্টার ফর বাংলাদেশ জেনোসাইড রিসার্চের প্রেসিডেন্ট জালাল।

    “বঙ্গবন্ধুর ভাষণ (১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংসদে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য) টির একটি বিশেষ বিষয়ে আলোচনার সময় এডিট করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি একটু দেখবেন।”

    সুইজারল্যান্ড প্রবাসী ব্লগার অমি রহমান পিয়ালও বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকটি ফেইসবুক পোস্টে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

    এর একটিতে তিনি লিখেছেন, “মানবিক ভুল বইলা একটা জিনিস আছে। বঙ্গবন্ধুর উপর বিশেষ অধিবেশনে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির উপর তার বক্তৃতা এডিট করা হইছে। ধর্ম নিরপেক্ষতার উপর তার ব্যাখ্যা বাদ দেয়া হইছে। মনে একটু দ্বিধা ছিলো এটা হয়তো ভুলে হইছে, ভুলে বাদ দিছে। কিন্তু যখন সংসদের অনুষ্ঠানের ভিডিও দেখলাম, মাথা নষ্ট অবস্থা!”

    পিয়াল বলছেন, অডিওর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যেসব ছবি ব্যবহার করে ওই ভিডিও তৈরি করা হয়েছে, তাতে তার মনে হয়েছে, ভাষণ থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রসঙ্গ ভুলক্রমে বাদ পড়েনি, সেটা ‘ইচ্ছাকৃত’।

    জাতির পিতার মূল ভাষণের কোন কোন অংশ ওই অডিও থেকে বাদ পড়েছে, তার বিস্তারিত আরেকটি ফেইসবুক পোস্টে তুলে ধরেছেন পিয়াল।

    ভাষণ থেকে কী বাদ পড়েছে?

    ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর তখনকার গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গ্রহণ করা হয়। সেই সংবিধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাষণে ব্যাখ্যা দেন জাতির পিতা। সেখানে তিনি রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

    গত ১৫ নভেম্বর সংসদে প্রচারিত অডিওতে মূলনীতির প্রথম তিনটি বিষয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য তুলে ধরা হলেও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে তার কথার একটি অংশ ছিল না। এছাড়া সমাজতন্ত্র নিয়ে তার বক্তব্যের একটি অংশও বাদ পড়েছে।

    সংসদে যে ভাষণ শোনানো হয়েছে, তা ৪৫ মিনেটের। তবে সংসদের রেকর্ডে যে লিখিত ভাষণ আছে, তা ‘এক ঘণ্টার মত’।

    প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রয়াত সংসদ সদস্য ও সাংবাদিক বেবী মওদুদের সম্পাদনায় আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৭২-৭৫)’ বইতে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের একটি অনুলিপি রয়েছে।

    সেই অনুলিপির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেছে, সংসদে বাজানো ভাষণে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বক্তব্যের বেশ খানিকটা নেই।

    ধর্মরিনেপক্ষতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণের অনুলিপিতে আছে-

    “তার পরে আসছে ধর্মনিরপেক্ষতা। জনাব স্পিকার সাহেব, ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না।

    “ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেওয়া ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না।

    “আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, পবিত্র ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি- ধর্মের নামে কি জুয়োচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যভিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আবি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।”

    সংসদে প্রচারিত ভাষণে যে অংশটি বাদ পড়েছে-

    “ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না।

    “ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেওয়া ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না।

    ওই ভাষণে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে ব্যাখ্যা করার আগে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রের আরেক মূলনীতি ‘সমাজতন্ত্র’ নিয়ে কথা বলেন।
    ভাষণের অনুলিপিতে সেই অংশটি এরকম-

    “তৃতীয়ত সোশ্যালিজম বা সমাজতন্ত্র। আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। এবং বিশ্বাস করি বলেই আমরা এগুলি জাতীয়করণ করেছি। যারা বলে থাকেন সমাজতন্ত্র হল না, সমাজতন্ত্র হল না, তাদের আগে বোঝা উচিত, সমাজতন্ত্র কী। সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েত রাশিয়ায় ৫০ বছর পার হয়ে গেল, অথচ এখনও তারা সমাজতন্ত্র বুঝতে পারে নাই। সমাজতন্ত্র গাছের ফল না- অমনি চেখে খাওয়া যায় না। সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুরও হয়। সেই পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো যায়।

    “সেজন্য পহেলা স্টেপ, যাকে প্রথম স্টেপ বলা হয়, সেটা আমরা গ্রহণ করেছি- শোষণহীন সমাজ। আমাদের সমাজতন্ত্র মানে শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। এক এক দেশ এক এক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলছে। সমাজতন্ত্রের মূল কথা শোষণহীন সমাজ। সেই দেশের কী ক্লাইমেট, কী ধরনের অবস্থা, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা, সব কিছু বিবেচনা করে স্টেপ বাই স্টেপ এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে।

    “কিন্তু আমরা নয় মাসে যে পদক্ষেপগুলি নিয়েছি, তা আমার মনে হয়, দুনিয়ার কোনো দেশ, যারা বিপ্লবের মাধ্যমে সোশালিজম করেছে, তারাও আজ পর্যন্ত তা করতে পারে নাই। আমি চ্যালেঞ্জ করছি। কোনো কিছু করলে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয়ই। সেটা প্রসেসের মাধ্যমে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়।”

    এর মধ্যে শেষের প্যারাটি সংসদে প্রচারিত ভাষণ থেকে বাদ পড়েছে।

    বাদ পড়ল কীভাবে?

    স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বলেছেন, ভাষণ থেকে কিছু অংশ বাদ পড়ার বিষয়টি তারও নজরে এসেছে।

    বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এই ভাষণটি বাংলাদেশ বেতার থেকে সংগ্রহ করে হুবহু সম্প্রচার করা হয়েছে। আর কেবল ধর্ম নিরপেক্ষতার অংশ নয়। সংসদের প্রসিডিংসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়েছে, আরো ছোট ছোট কিছু বিষয় ভাষণের অডিওতে নেই।”

    তিনি বলেন, সংসদের যে লিখিত প্রসিডিংস, সেখানে জাতির পিতার ভাষণ এক ঘণ্টার মত। কিন্তু বেতার থেকে যে অডিও সংসদ পেয়েছে, সেটা ৪৫ মিনিটের একটু বেশি।

    “সংসদের ছাপানো প্রসিডিংসে যেটা আছে হার্ড কপি, সেটার মধ্যে যে কথাগুলো আছে, তার বেশ কিছু অডিও ভার্সনে নেই, এটা ঠিক।”

    এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক হোসনে আরা তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি খোঁজ নিয়েছি। আর্কাইভে থাকা জাতির পিতার ওই ভাষণ যেভাবে আছে সেভাবেই সংসদে পাঠানো হয়েছে। আর্কাইভে থাকা ওই রেকর্ডেই কিছু অংশ নেই।”

    তিনি বলেন, “সংসদে যেটা পাঠানো হয়েছে এবং আমাদের আর্কাইভে যেটা রয়েছে, দুটো একই। যা আমাদের কাছে আছে সেটাই সংসদে দেওয়া হয়েছে।”

    সংসদ সচিবালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সফট কপি চেয়ে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালককে চিঠি দেয় সংসদ সচিবালয়। পরে বেতার থেকে অডিও সরবরাহ করা হয়।

    বেতার থেকে কেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নেওয়া হল জানতে চাইলে সংসদ সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বর্তমান সংসদ ভবনে সংসদের কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগের অনেক কিছুই সংরিক্ষত নেই। পুরনো অনেক নথি সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে।

    “সেটা যে এখন হয়েছে তা নয়। পুরনো পার্লামেন্ট ভবন থেকে এখানে (১৯৮২ সালে) স্থানান্তরিত হওয়ার সময় হয়ত হয়েছে। কিংবা তারও আগে। তাছাড়া এক সময় সংসদে দেওয়া বক্তব্য রেকর্ড করে রাখা হলেও সেগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি। প্রসিডিংসে লেখার পর হয়তো আর সংরক্ষণ করা হয়নি। যেটা এখন ডিজিটালি করা হয়। লিখিত প্রসিডিংসগুলো আমাদের কাছে আছে। সেটা সঙ্কলনও করা হয়েছে।”

    ওই কর্মকর্তা জানান, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের জন্য সম্ভাব্য আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এই ভাষণটি বেতার থেকেই পাওয়া গেছে।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.