গতকাল ছিল ৪ নভেম্বর। আমাদের সংবিধান দিবস। প্রতি বছরের মতো এবারও এলো, প্রায় নিরবেই চলেও গেল দিনটি। ব্যাপকভাবে বিস্মৃত, রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলিত এই একটি দিন। ১৯৭২ সালের এই দিনে জাতীয় সংসদে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়েছিল। এর পর দিনটির কথা আমরা প্রায় সবাই একরকম ভুলেই গিয়েছি, রাষ্ট্রীয়ভাবে এই দিনটিকে উদযাপনের কথা আমাদের কারোই মনে থাকে না!
স্বাধীনতা সংগ্রাম, এতো আত্মত্যাগ, এতো রক্তপাত – সে তো ‘সংবিধান’ নামের এই দলিলটি হাতে পাওয়ার জন্যই। যে দলিলটির মাধ্যমে স্বাধীন জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজস্ব সীমানায় নিজেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি। আমাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার (right to self-determination) এর মূর্ত প্রতিফলন এই দলিল।
এই দিনটির তাৎপর্য্য অন্য যে কোনো দিন উদযাপনের চেয়ে কোনো অংশে কম না। বরং আমার বিবেচনায় এই দিনটির তাৎপর্য্য আমাদের অন্য আর সব রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত দিনের চেয়ে হয়তো বেশীই। কারণ, এই দিনটির সঠিক উদযাপন – প্রতি বছর আমাদের মনে করিয়ে দিতে পারে এই সংবিধানের শরীরে ধারণ করা সবচেয়ে জরুরী কথাগুলো। যেখানে আরও অনেক বিষয়ের পাশাপাশি বলা রয়েছে:
– স্বাধীনতার সংগ্রাম, আর তা অর্জনের পথে আমাদের জনগণের ঐতিহাসিক ত্যাগ স্বীকারের কথা।
– এই ভূখন্ডের মানুষদের মৌলিক অধিকারগুলোর কথা।
– আমাদের রাষ্ট্রটি কি কি মৌল নীতি দ্বারা পরিচালিত হবে বা হওয়া উচিত, সেই স্বপ্ন আর উপলদ্ধিগুলোর কথা।
– যারা এই দেশটির বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষমতায় থেকে শাসন করবেন, তাদের দায়বদ্ধতা আর জবাবদিহিতার কথা।
– সারা বিশ্বের দরবারে আমরা কি কি নীতির ভিত্তিতে নিজেদের তুলে ধরবো সেকথা।
– আমাদের অতীত, ঐতিহ্যের প্রতি এই রাষ্ট্রের এবং সম্মিলিতভাবে আমাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে সেকথা।
সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল – এই সংবিধান হল সেই দলিল যেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা। যেখানে ঘোষণা করা হয়েছে – এই সংবিধান হল ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি’ [অনুচ্ছেদ ৭(২)]। বলা আছে – ‘এই প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’। বলা আছে – শুধু এই জনগণের হয়েই এই সংবিধানের সব ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রয়োগ কার্যকর হবে [অনুচ্ছেদ ৭(১)]।
এই কথাগুলোই আমরা ভুলে যাই, বা ভুলে যেতে বসেছি। আর আমাদের এই ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেয় যারা নেবার।
এজন্যই সর্বস্তরে দিনটির উদযাপন জরুরী। রাষ্ট্র বা ক্ষমতাসীনরা যদি আনুষ্ঠানিকভাবে এই দিনটি উদযাপন নাও করে, আমাদের অন্তত করা উচিত। কারণ এই দিনটি আমাদেরই দিন। আমরা মানে জনগণ।
(ফেসবুক স্ট্যাটাস লিন্ক)
*সহ-ব্লগার মাসুদ করিম দিনটির কথা মনে করিয়ে দিলেন টুইটারে। অশেষ কৃতজ্ঞতা সে জন্য।
রায়হান রশিদ
জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৮ comments
মাসুদ করিম - ৬ নভেম্বর ২০১৫ (৮:৫৮ পূর্বাহ্ণ)
হাবিবুর রহমানের ‘বাংলাদেশের তারিখ’ খুলে দেখি ওই একই দিন এটাও ঘোষণা করা হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে সংবিধান চালু হবে এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা হল ৭ মার্চ ১৯৭৩এ বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণাও এদিন দেয়া হয়। গণপ্রজাতন্ত্রের জন্য এমন তাৎপর্যের দিন আমরা ভুলে বসে আছি। আরো একটি অসাধারণ তথ্য পেলাম ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭২এ বঙ্গভবনে সংবিধান মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার পুনরায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছিল।
অবিশ্রুত - ৮ ডিসেম্বর ২০১৫ (২:১৭ পূর্বাহ্ণ)
বাঙলার পাঠশালা আয়োজিত বাংলাদেশ সংবিধান প্রথম সম্মাননা স্মারক ২০১৫ প্রাপ্তি উপলক্ষে গত ৪ অগ্রহায়ণ ১৪২২/ ১৮ নভেম্বর ২০১৫ বুধবার ‘আমাদের সংবিধান, স্বাধীনতার লক্ষ্য এবং চার দশকের অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক স্বাগত ভাষণ দেন কামাল হোসেন (ডক্টর, সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, প্রাক্তন আইন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাংলাদেশ সংবিধান (১৯৭২) রচনা ও প্রণয়ন কমিটির সভাপতি)।
এ বক্তব্যে (বক্তব্যটি বুকলেট আকারে বাঙলার পাঠশালা থেকে প্রকাশিত হয়েছে) কামাল হোসেন বলেছেন :
অর্থাৎ এই বক্তব্য অনুযায়ী, সংবিধানবিশেষজ্ঞ কামাল হোসেনের মতে, দেশে প্রথম সাংবিধানিক সংকট দেখা দেয় ১৯৯০ সালে। সংবিধানের একাদশতম সংশোধনীকে অনুসরণ করে দ্বাদশতম সংশোধনীর মাধ্যমে তা নিরসন করা হয়। দ্বিতীয় সংকট দেখা দেয় ১৯৯৬ সালে বিএনপির শাসনামলে, ত্রয়োদশতম সংশোধনীর মাধ্যমে তা নিরসন হয়। তৃতীয় সংকট দেখা দেয় ২০০৭ সালে, যার সমাধান হয় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু’বছরের শাসনামলের পর ২০০৮ সালের নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে।
সংবিধান, সাংবিধানিক সংকট বোঝা খুবই কঠিন। শুধু সামান্য কৌতূহল, তা হলে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারিতে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন কি কোনো সাংবিধানিক সংকট নয়? এটিকে কি তা হলে সাংবিধানিক উত্তরণ বলতে হবে? সংবিধানবিশেষজ্ঞরা ঝেড়ে কাশুন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মম হত্যার মাধ্যমে সংবিধান, সংসদ স্থগিত ও সামরিক শাসন প্রবর্তন কি কোনো সাংবিধানিক সংকট নয়? ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল কি কোনো সাংবিধানিক সংকটও নয়? পুরো বক্তব্যে তিনি একবারও পঞ্চম সংশোধনীর কথা বলেননি, যা আমাদের সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করেছে (নাকি আমিই খুঁজে পাইনি!)। কামাল হোসেন নিঃসন্দেহে বিশেষজ্ঞ মানুষ, তিনি যখন এগুলোকে সাংবিধানিক সংকট মনে করেন না তা হলে হয়তো সত্যিই এগুলো সাংবিধানিক সংকট নয়। না কি আমার মতো আমজনতার আর কামাল হোসেনদের সংবিধানভাবনায় দুস্তর ব্যবধান?
মাসুদ করিম - ৫ নভেম্বর ২০২০ (৩:২০ পূর্বাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ১৯ নভেম্বর ২০২০ (২:০৩ অপরাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ৫ ডিসেম্বর ২০২৩ (৫:১২ অপরাহ্ণ)
হাতে লেখা সংবিধান কোথায়?
https://bangla.bdnews24.com/opinion/feature-analysis/4u1y9aiay9
কাদের হাতে, কীভাবে, কোন উপকরণে তৈরি হয়েছিল এটি; কোথায় আছে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের অনবদ্য আসল সেই দলিল— এসব বিষয়ে তথ্য অপ্রতুল এবং অস্পষ্ট।
বাংলাদেশের সংবিধান ছাপানো হয় দুটি ভাষায়; একটি বাংলায়, অপরটি ইংরেজিতে। বাজারে যে সংবিধান দেখতে পাওয়া যায় তা কম্পিউটারে টাইপের পর প্রেসে মুদ্রিত, অন্য আর দশটা গ্রন্থের মতোই। তবে শুরুতে কিন্তু এমনটা ছিল না। ১৯৭২ সালের প্রথম সংবিধানের সঙ্গে আজকের সংবিধানের অন্দর-বাহিরে বিস্তর ফারাক। একটি প্রস্তাবনা, ১১টি ভাগে বিভক্ত, ১৫৩টি অনুচ্ছেদ এবং ৪টি তফসিল লেখা হয়েছিল হাতে। কাদের হাতে, কীভাবে, কোন উপকরণে তৈরি হয়েছিল এটি; কোথায় আছে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের অনবদ্য আসল সেই দলিল— এসব বিষয়ে তথ্য অপ্রতুল এবং অস্পষ্ট। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে গোড়া থেকে শুরু করতে হয়। ফিরতে হয় পাঁচ দশক অতীতে।
১৯৭১ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের কাজ শুরু করে আইন মন্ত্রণালয়। ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল আইন মন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে গণপরিষদের ৩৪ সদস্যের সমন্বয়ে নির্বাচিত হয় খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি। বলা হয়, গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ এই সংবিধান দেশের সাংগঠনিক ভিত সুদৃঢ় করবে। কিন্তু এমন কর্তব্যকর্ম নির্ধারণের গুরুদায়িত্ব বর্তেছে যে গ্রন্থের উপর তার গড়নেও তো আভিজাত্য আর অভিনবত্বের ছাপ থাকা প্রয়োজন। সিদ্ধান্ত হয়, সংবিধান ছাপার অক্ষরে নয় বরং তা হবে ‘হাতে লেখা’। তাই দলিলটি গতানুগতিক বাংলা টাইপ করা হয়নি। তার বদলে একজন শিল্পী প্রাচীনকালের পুঁথির মতো পাণ্ডুলিপিটি আগে হাতে লিখেছেন এবং সঙ্গে নকশার অলঙ্করণ যোগ হয়েছে। এত সূচারু হাতের কাজের উদ্দেশ্য ছিল, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি। তাছাড়া সদ্য স্বাধীন একটি দেশের পরিচয়, শিল্পবোধ, রুচি এবং জাতির ইতিহাস এই শৈল্পিক কর্মের মধ্য দিয়ে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার চিন্তাও আমাদের পূর্বজদের ছিল। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের তত্ত্বাবধানে শিল্পীদের একটি দল গঠন করলেন। বাছাই করা পাঁচ জনের দলে ছিলেন লিপিকার এ কে এম আবদুর রউফ আর অঙ্গসজ্জায় হাশেম খান, নকশা আঁকায় সমরজিৎ রায় চৌধুরী, জুনাবুল ইসলাম ও আবুল বারক আলভী। সবাই তখন আর্ট কলেজের শিক্ষক। কেবল রউফ ছিলেন সাবেক শিক্ষার্থী এবং লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনে নিযুক্ত দ্বিতীয় সচিব।
হস্তলিপির কার্যক্রম বিস্তারিত বর্ণনার আগে বলে রাখা ভালো, সংবিধানের হাতে লেখা প্রকল্পে হস্তসাধিত ও যান্ত্রিক পদ্ধতির সমন্বয় ঘটেছে তাই গোটা প্রক্রিয়াটি কারিগরি কয়েকটি জটিল ভাগে বিভক্ত। সহজভাবে বোঝার স্বার্থে শুরুতেই ধাপগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া যাক:
(ক) সংবিধানের জন্য প্রণয়ন কমিটির খসড়াগুলো প্রথমে একজন ক্যালিগ্রাফার হুবহু হাতে লেখেন এবং সমান্তরালভাবে প্রতি পাতায় অলঙ্করণ জুড়ে দেয়া হয়। এভাবে সবগুলো পাতা হয়ে গেলে জন্ম হয় ক্যালিগ্রাফিক পাণ্ডুলিপির, যাকে মূল কপি বা ‘মাস্টারপিস’ বলা চলে। এই মাস্টারপিসে গণপরিষদ সদস্যদের সই ছিল না।
(খ) দ্বিতীয় ধাপের জন্য মাস্টারপিসের প্রতি পাতায় প্রথমে সাদাকালো নকশা বসানো হয়। এগুলো ছিল ছবি তুলে তারপর জোড়া দেয়া। রশিদ স্টুডিওতে তোলা ওইসব ছবির নকশাগুলো ছিল খালি। যেখানে শিল্পীরা রঙিন অলঙ্করণ করেন। পরের ধাপে প্রিন্টিং মেশিনের প্লেট তৈরির জন্য মাস্টারপিসের রঙিন পাতাগুলোকে অ্যানালগ ক্যামেরায় ছবি তোলা হয়। প্রতি পাতার ফিল্ম ডেভলপের পর আমরা একটি চিত্ররূপ বা ‘ফিল্ম কপি’ পাই। যেহেতু সংবিধানের অনেকগুলো কপি ছাপতে হবে তাই এই ব্যবস্থা। মাস্টারপিস স্পর্শকাতর হওয়ায় এই ফিল্ম কপি থেকে প্রথমে কয়েকটি গ্রন্থ সাধারণ কাগজে ছাপানো হয়; যাকে আমরা ‘প্রুফ কপি’ বলতে পারি। প্রুফ কপির মাধ্যমে সংবিধান একটি গ্রন্থের আকার ধারণ করল। তখনও এটি গণপরিষদে স্বাক্ষর হয়নি।
(গ) প্রুফ কপির শেষের দিকে সই করার পৃষ্ঠাগুলো ছিল না। কিছু সংশোধনের পর সেই পাতাগুলো এবং সই করার পৃষ্ঠাসমেত সবশেষে ‘ফার্স্ট কপি’ প্রস্তুত হয়। সিগনেচারের ফর্মাসহ ফার্স্ট কপি ছিল মলাটবদ্ধ। এই ফার্স্ট কপিতেই সই করেছিলেন গণপরিষদ সদস্যরা। অর্থাৎ লেখাগুলো ছবি থেকে ছাপানো কিন্তু সিগনেচারগুলো আসল। পরে এই ফার্স্ট কপি থেকেই মুদ্রিত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের পরবর্তী সংস্করণগুলো।
মাস্টারপিসের খোঁজে
আজকের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় যেখানে, সেখানেই ছিল অ্যাসেম্বলি ভবন। তারই একটি কক্ষে বসে শিল্পীদের পঞ্চপাণ্ডব জন্ম দিয়েছিলেন মাস্টারপিসের। আজকের দিনে অন্তর্জালের বদৌলতে আমরা চাইলেই দেখতে পারি, কেমন ছিল হাতে লেখা সংবিধান।
হস্তলিপি যে একটি শিল্প সেটা প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের সংবিধান। তবে বাংলাদেশই হাতে লেখা সংবিধানের প্রথম বা একমাত্র রাষ্ট্র নয়। এর আগেও অনেক দেশ তাদের সংবিধান হাতে লিখেছে। খুব বেশি দূরে যেতে হবে না ছাপাখানার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সংবিধান হাতে লেখার বড় উদাহরণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় হাতে লেখা সংবিধানের গিনেজ রেকর্ডও দেশটির দখলে। প্রায় তিনবছর লেগেছে এই মাস্টারপিস গড়তে। বাংলা সংবিধানের যেমন একজন লিপিকার ছিলেন অনুরূপ ভারতের সংবিধানে সেই দায়িত্ব পালন করেন প্রেমবিহারী রায়জাদা। এজন্য ৩৫৪টি নিব ও কলম ব্যবহার করেন তিনি। আমাদের যেমন জয়নুল তেমনি ভারতের সংবিধানের অঙ্গসজ্জা বা ইলাস্ট্রেশন করেছিলেন নন্দলাল বসুর নেতৃত্বে শান্তিনিকেতনের ছাত্র-শিক্ষকরা। তিন কেজি ৭৫০ গ্রামের ঐতিহাসিক ও অমূল্য সেই মাস্টারপিসটি সংরক্ষণের জন্য নেয়া হয় ঐতিহাসিক উদ্যোগ। দলিলে ব্যবহৃত কালি ও পার্চমেন্ট কাগজ যেন নষ্ট না হয় সেজন্য নাইট্রোজেন গ্যাস পূর্ণ একটি বাক্সে হাতে লেখা আসল সংবিধানটি সংরক্ষণ করেছে ভারতীয়রা।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে; তাহলে বাংলাদেশ কী করেছে? কোথায় আছে আমাদের ‘মাস্টারপিস’। কী দিয়ে, কোন কাগজে, কীভাবে লেখা হয়েছিল হাতে লেখা সংবিধানের বাক্যগুলো। কোথায় আমাদের অমূল্য লেখন উপকরণসমূহ? অন্যরা যেখানে এ ধরনের দলিল ও উপকরণকে সম্পদ হিসেবে ঘোষণা ও রক্ষা করছে সেখানে মুক্তিযোদ্ধা জাতি হিসেবে আমাদের ভূমিকা কী? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হাতে লেখা কমিটির সদস্যদের দ্বারস্থ হতে হয়।
হাতে লেখা কমিটির ৫ সদস্যের মধ্যে হাশেম খান ও আবুল বারক আলভী বেঁচে আছেন। তাদের দুজনের আলাদা সাক্ষাৎকার নিই ২০২৩ সালের শুরুতে। হাতে লেখার বিষয়টি যেহেতু সংবিধানের প্রাণ তাই স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল শিল্পীদ্বয়ের কাছে। কীভাবে বাছাই করা হয়েছিল সংবিধানের একক লিপিকার এ কে এম আবদুর রউফকে।
এ প্রসঙ্গে হাশেম খান ও আবুল বারক আলভীর উত্তর মিলে যায়। জানান, গোলাম সরোয়ার, কাইয়ুম চৌধুরী, প্রাণেশ মণ্ডলসহ কয়েকজনের হ্যান্ডরাইটিং প্রাথমিকভাবে যাচাই করা হয়। এঁদের সবারই নিজস্ব একটা স্টাইল ছিল যা লেখার মধ্য দিয়ে প্রকাশ হতো। কিন্তু সবার কাছে পাঠযোগ্য হয়, এমন পরিষ্কার ও ছাপার অক্ষরের কাছাকাছি ছিলেন কেবল রউফ। জয়নুল চেয়েছিলেন সংবিধানে যেন কারও লেখার স্টাইল বা প্রভাব না থাকে এবং সেটা যতটা সম্ভব গোটা গোটা হরফে লেখা হয়, এজন্যই আবদুর রউফকে লন্ডন থেকে উড়িয়ে এনেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, দেশে ভালো কালি-কলম-কাগজ ছিল না বলে রউফের প্রতি জয়নুলের নির্দেশ ছিল, তিনি যেন তার প্রিয় লেখন উপকরণ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলো অবশ্যই সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে; তাহলে বাংলাদেশ কী করেছে? কোথায় আছে আমাদের ‘মাস্টারপিস’। কী দিয়ে, কোন কাগজে, কীভাবে লেখা হয়েছিল হাতে লেখা সংবিধানের বাক্যগুলো। কোথায় আমাদের অমূল্য লেখন উপকরণসমূহ? অন্যরা যেখানে এ ধরনের দলিল ও উপকরণকে সম্পদ হিসেবে ঘোষণা ও রক্ষা করছে সেখানে মুক্তিযোদ্ধা জাতি হিসেবে আমাদের ভূমিকা কী? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হাতে লেখা কমিটির সদস্যদের দ্বারস্থ হতে হয়।
হাতে লেখা কমিটির ৫ সদস্যের মধ্যে হাশেম খান ও আবুল বারক আলভী বেঁচে আছেন। তাদের দুজনের আলাদা সাক্ষাৎকার নিই ২০২৩ সালের শুরুতে। হাতে লেখার বিষয়টি যেহেতু সংবিধানের প্রাণ তাই স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল শিল্পীদ্বয়ের কাছে। কীভাবে বাছাই করা হয়েছিল সংবিধানের একক লিপিকার এ কে এম আবদুর রউফকে।
এ প্রসঙ্গে হাশেম খান ও আবুল বারক আলভীর উত্তর মিলে যায়। জানান, গোলাম সরোয়ার, কাইয়ুম চৌধুরী, প্রাণেশ মণ্ডলসহ কয়েকজনের হ্যান্ডরাইটিং প্রাথমিকভাবে যাচাই করা হয়। এঁদের সবারই নিজস্ব একটা স্টাইল ছিল যা লেখার মধ্য দিয়ে প্রকাশ হতো। কিন্তু সবার কাছে পাঠযোগ্য হয়, এমন পরিষ্কার ও ছাপার অক্ষরের কাছাকাছি ছিলেন কেবল রউফ। জয়নুল চেয়েছিলেন সংবিধানে যেন কারও লেখার স্টাইল বা প্রভাব না থাকে এবং সেটা যতটা সম্ভব গোটা গোটা হরফে লেখা হয়, এজন্যই আবদুর রউফকে লন্ডন থেকে উড়িয়ে এনেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, দেশে ভালো কালি-কলম-কাগজ ছিল না বলে রউফের প্রতি জয়নুলের নির্দেশ ছিল, তিনি যেন তার প্রিয় লেখন উপকরণ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলো অবশ্যই সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।
এর উত্তর লুকিয়ে ছিল সুদূর লন্ডনে। শিল্পী রউফ যখন ঢাকায় বসে সংবিধানটি হাতে লিখে দিচ্ছিলেন তখন হাজার মাইল দূরে বিলেতে তার পরিবার। বড় ছেলে রিয়াদ রউফের স্মৃতিতে আজও তাজা সেই ঘটনা। পঞ্চাশ বছর পর রিয়াদ তার বনানীর অফিসে শোনাচ্ছিলেন সেইসব দিনের কথা:
“বাবা লেখার জন্য সাথে করে কিছু কলম ও প্রয়োজনীয় ইনস্ট্রুমেন্ট লন্ডন থেকে নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশে। আমরা তখন ওখানে থাকতাম। আমি নিজে কলমগুলো বাবার কাছে দেখেছি। এর মধ্যে কলম ছাড়াও কাগজ, পেন্সিল, কাটিং ইনস্ট্রুমেন্ট, স্কেল, মাপজোকের কিছু সরঞ্জামও ছিল। আব্বার স্মৃতিমাখা সেই সময়ের দুটো কলম রেখে দিয়েছিলাম আমি। এমনকি দেশে ফিরে বুয়েটে স্থাপত্যবিদ্যা পড়ার সময় সেই কলম ব্যবহারও করেছি। এগুলো তখনকার সময়ের Rotring কোম্পানির Rapidograph পেন। এটিকে Tubular Point Drafting Pen বলা হয়ে থাকে। আব্বা এই দুটি কলম সংবিধান লেখার কাজে ব্যবহার করেছিলেন; কেননা লেখার দিকে তাকালে যে ফ্ল্যাট লাইন দেখা যায় তা মূলত এই কলমের দ্বারাই সম্ভব। আব্বা ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করেননি কেন তা কিছুটা অনুমান করতে পারি। তখনকার দিনের সাধারণ ফাউন্টেন পেনে কালি অনিয়ন্ত্রিত ছিল, কোথাও কম কোথাও বেশি পড়ে যেতে পারে। তাছাড়া ফাউন্টেন পেনের কালি কাগজ শুষে নেয় বেশি, এতে গোটা কাজটাই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। আব্বা যে ধরণের কাগজ ব্যবহার করেছিলেন সেখানে হয়তো এই ধরনের ড্রাফটিং পেন বেশি উপযোগী মনে করেছিলেন। তিনি ড্রাফটিং পেন দিয়েই লেখা নিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ত ছিলেন।”
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বৈচিত্র আনতে কিছু শিরোনাম মোটা ও বড় অক্ষরে লেখা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রিয়াদ রউফ জানান, শৈশবে তিনি বাবার কাছে নিবের মাথা কাটা এক ধরনের ফাউন্টেন পেন দেখেছেন। তাঁর ধারণা, মোটা হরফগুলো লিখতে সেই মাথা কাটা ঝরনা কলম ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে।
শুধু কালি-কলমই নয় সংবিধানের জন্য কাগজ ব্যবহারেও সর্বোচ্চ সতর্ক ছিলেন লিপিকার আবদুর রউফ। সঙ্গে এনেছিলেন কিছু বিদেশি কাগজ। সেসব কাগজের মধ্য থেকেই একটিকে তিনি এ দেশের আবহাওয়া ও পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী এবং মানসম্পন্ন হিসেবে বাছাই করেন। তার সেই কাগজকে আদর্শ নমুনা ধরে তিনি চাহিদাপত্র দিলেন। জানালেন কী পরিমাণ পেপার লাগতে পারে। শুরু হলো ফরমায়েশ মোতাবেক কাগজের সন্ধান। হাশেম খান সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে বলেন:
“আজকের মতো অফসেট পেপার সেকালে ছিল না। মজবুত, উজ্জ্বল ও কালি প্রতিরোধক কাগজ বলতে গেলে কেন্ট পেপার নামের বিলেতের একটা কাগজ ছিল। কিন্তু ঢাকায় বা কলকাতায় সেই কাগজ কোথায়! আর্ট পেপার কালি শুষে নেয় বেশি, অন্যদিকে পাতলা কাগজ শক্ত নয়। তাই রউফ ভাই নিজে যে কেন্ট পেপার সাথে এনেছিলেন সেই কাগজের সাথে নমুনা মিলিয়ে আমরা খুঁজতে লাগলাম। অনেক কাগজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে কেন্ট পেপারের কাছাকাছি চরিত্রের একটাকে পাওয়া গিয়েছিল কলকাতায়। কলকাতা থেকে সেই পেপার কিনে ট্রাকে বহন করে আনা হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। ব্যবহার হয় সংবিধান হাতে লেখার কাজে।”
কাগজে শুধু লেখাই হচ্ছিলো না, সমান তালে চলছিল অলঙ্করণ। নকশা অঙ্কনের জন্য প্রতিটি কাগজের চারপাশে আগে নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গায় পেন্সিল দিয়ে মার্জিন করে আলাদা করা হতো, সেই মার্জিনের ভেতর সংবিধানের লেখাগুলো রউফ লিপিবদ্ধ করছিলেন। এই শিল্পরূপ নির্ধারণ করেছিলেন খোদ জয়নুল আবেদিন।
শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লেখা এবং অঙ্কনের জন্য খুব সাধারণ কাগজ, কালি ও রং ব্যবহার ছাড়া উপায় ছিল না। ১৭ ইঞ্চি বাই ২৩ ইঞ্চি মাপের ডিমাই সাইজের কাগজের উপর নকশার কাজ করেছেন তাঁরা। কালি বা রংয়ের জন্য বিশেষ কোনো চাহিদা দেননি। যুদ্ধোত্তর বাজারে যা পাওয়া গেছে তাই দিয়েই করা হয় রঙিন অলঙ্করণগুলো। নকশায় কালো বা উজ্জ্বল রং এড়িয়ে গিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে হালকা রং ব্যবহারের। রং হিসেবে সস্তা পোস্টার কালার এক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে। আবুল বারক আলভী আজও মনে করতে পারেন, এ কাজের জন্য বাজার থেকে পেলিকেনের রং ও তুলি কিনেছিলেন।
গোটা সংবিধানটাই পরিণত হয়েছিল একটা ক্যানভাসে। নকশা হয়ে গেলে তাকে অঙ্গসজ্জায় রূপ দেয়াটা ছিল শিল্পীদের জন্যে বড় চ্যালেঞ্জ। নকশাকে সুশৃঙ্খল সারিতে সাজানোর কাজটি করেছিলেন শিল্পী হাশেম খান। খেয়াল করলে দেখা যায়, প্রতি পৃষ্ঠায় লেখা ও নকশার মধ্যে দুটো সরু লাইন টানা হয়েছে। হাশেম খান ব্যবহার করেছেন এক ধরনের ড্রয়িং ইনস্ট্রুমেন্ট যা “Crowquill” নিব নামে পরিচিত।
কাজের সুবিধার জন্য পৃষ্ঠার একদিকেই লেখা হয়েছে। সংবিধানের প্রতিটি অধ্যায়ের জন্য বৈশিষ্ট্য ও অর্থপূর্ণ আলাদা ডিজাইন লক্ষ্যণীয়। এছাড়া স্বতন্ত্র মোটা লাইনের নকশা আঁকা হয়েছিল প্রতি ভাগে। এগারোটি ভাগ ও তফসিলের প্রতিটির শেষে এসে জয়নুল নিজ হাতে স্কেচ করেছেন। এটাই ছিল মাস্টারপিসের কাজ। সংবিধানের মাস্টারপিসে কিন্তু সই করেননি গণপরিষদের সদস্যরা। কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে ফিল্ম প্রিন্ট কপি, প্রুফ কপির পর ফার্স্টকপি হাতে আসে। সেই ফার্স্ট কপিতেই স্বাক্ষর করেন সবাই। ফার্স্ট কপি চামড়ার মলাটে বাঁধাই করেন সৈয়দ শাহ আবু শফি।
সংবিধানের ফার্স্ট কপি নিয়ে ১৯৭২ সালের ১৩ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রীর বেইলি রোডের কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সবার একটি স্থিরচিত্র ধারণ করা হয়।
ফার্স্ট কপি নিয়ে যখন এত মাতামাতি তখন মাস্টারপিসটা কোথায় ছিল? উত্তরে স্বাধীনতা পদক পাওয়া শিল্পী হাশেম খান জানান:
“মাস্টারপিসটা সংরক্ষণ করার কথা থাকলেও আমরা পারিনি। ১৯৭২ সালেই ওটা ধ্বংস হয়ে গেছে। রউফ ভাইয়ের আসল লেখা ও আমাদের ইলাস্ট্রেশন শুধু ছাপা আকারে রয়ে গেছে। হাতে লেখা পূর্ণাঙ্গ কপি সংরক্ষণের কথা ভাবা হলেও কার্যত কোনো উদ্যোগ শিল্পীদের পক্ষে নেয়া সম্ভব হয়নি। যে ঘরে বসে সংবিধান হাতে লেখা হয়েছিল সেটা তিন মাস পর সংসদ সচিবালয় ফেরত নিয়ে নেয়। সেখানে থাকা শিল্পীদের কালি, কাগজ, কলম, ব্র্রাশসহ যাবতীয় সরঞ্জাম ও ব্যবহার্য সরঞ্জাম কোথায় সরিয়ে ফেলা হয় সেটা আর জানতে পারিনি। মাস্টারপিস তো দূরের কথা ফার্স্ট কপিটারই হদিস ছিল না। অনেক বছর পর এরশাদ সরকারের আমলে সংসদ সচিবালয়ের একজন সচিব টেলিফোনে আমাকে জানান যে, একটি ড্রয়ারে ফার্স্ট কপি খুঁজে পাওয়া গেছে, সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি। পরে আমি সেই কপিটি জাদুঘরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করি।”
অর্থাৎ জাদুঘরে যেটা আছে সেটা হাতে লেখা সংবিধানের ফার্স্ট কপি! কোনভাবেই মাস্টারপিস নয়। চলুন দেখা যাক বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেয়া জাদুঘরের তথ্য এক্ষেত্রে কী বলে।
নিকট অতীতে জাতীয় জাদুঘরের তথ্য আর দায়িত্বশীলদের বরাত দিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন ও প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছে। এরমধ্যে ইন্টারনেটে পাওয়া যায় আর কিছু মিলবে পত্রিকার আর্কাইভে। এসব লেখায় সবখানেই মোটামুটি একটি দাবি করা হয়— ‘হাতে লেখা সংবিধানটি জাদুঘরে সংরক্ষিত’। এ অবস্থায় যে কারও প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘হাতে লেখা’ বলতে এখানে কী বোঝানো হচ্ছে?
কেউ একে সংবিধানের প্রথম হাতে লেখা কপি বলছেন, কারও কাছে আবার হাতে লেখা সংকলন। কিন্তু এসব কোনো প্রতিবেদন বা লেখাতেই পরিষ্কার করে বলা নেই, যে কপিটি রাখা আছে সেটা আসল হাতে লেখা (মাস্টারপিস) কিনা। এই উত্তর দেয়ার বদলে ‘প্রথম মুদ্রিত কপি’ বা ‘সংকলন’ কিংবা ‘আংশিক সংবিধান’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এমন বাকচতুর ও অস্পষ্ট বিবরণ থেকে শিল্পীদের হাতে জন্ম নেয়া অমূল্য দলিলটির প্রকৃত অবস্থা ব্যাখা করে না বরং পাঠযোগ্যতায় প্রভাব ফেলে।
হাতে লেখা সংবিধানের প্রকৃত অবস্থা, অস্তিত্ব ও অবস্থান নিয়ে দুই শিল্পীর কথার সঙ্গে জাদুঘরের তথ্যের ভিন্নতা পাওয়া যায়। কোথায় কোন গ্যালারিতে বা কোন স্থানে রাখা আছে ‘হাতে লেখা’ সংবিধানটি, জানতে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। তথ্য অধিকার আইনে আবেদনের পর অবশেষে একটি চিঠিতে কর্তৃপক্ষ জানায়:
“ইতিহাস ও ধ্রুপদি শিল্পকলা বিভাগের নিয়ন্ত্রনাধীন স্টোরে শিল্পীগণের হাতে লেখা বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের ‘মূল কপিটি’ সংরক্ষিত আছে এবং গ্যালারিতে একটি অনুকৃতি উন্মুক্ত প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে”।
২৩ অক্টোবর ২০২৩, শিল্পী আবুল বারক আলভী ও আমাকে সেই দলিলটি দেখার আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে গিয়ে তিনটি জিনিস পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে শিল্পীদের দাবিই সঠিক। এটি মাস্টারপিস নয় বরং সেই ফার্স্ট কপি, যেখানে ছাপানো বইয়ের শেষভাগে দুই রংয়ের কালিতে গণপরিষদের সদস্যদের সইগুলো আছে। আমার পরীক্ষার বিষয় ছিল তিনটি; প্রথমত, দুই ধরনের তরল কালি ও ফাউন্টেন পেনে গণপরিষদ সদস্যরা সই করেছিলেন। ধারণা করা হয় সই করার দুটো কালিই ছিল স্থায়ী কিংবা ন্যূনতম জলনিরোধক তরল রং। আসল সিগনেচার ছাড়া পরের দিকে ছাপানো গ্রন্থে রংয়ের এসব তারতম্য বোঝা যাবে না। এছাড়া শেষ দিকে পেন্সিলের দাগকাটা ঘরসমেত কিছু অতিরিক্ত পৃষ্ঠা এবং চামড়ায় বাঁধানো মলাট ভালো করে পরীক্ষা করলে পার্থক্যটা ধরা যায়। হাশেম খানের পরামর্শে আরও কিছু বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ফার্স্ট কপি চিহ্নিত করা গেছে।
এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, হাতে লেখা সংবিধান বললে প্রথমেই মাথায় আসে এমন একটি দলিল যা কেউ হাতে লিখেছে। তাহলে আমি তো সেই হাতের লেখাটাই দেখতে চাইব। মোনালিসার ছবির মাস্টারপিস আর দোকান থেকে কেনা পোস্টার নিশ্চয়ই এক নয়। দুটোকেই হাতে আঁকা বলা যাবে কি? কাজেই মাস্টারপিসের কথা বলতেই আমার মতো অনেকেরই ছাপানো কিছুর কথা মনে আসে না। তারপরও ফার্স্ট কপিকে মাস্টারপিস হিসেবে দাবি করা হয়। কিন্তু যেখানে সব লেখা ছবির মতো ছাপানো আর শেষে কালি কলমের সই কখনোই শতভাগ লিখিত দলিল বা ‘প্রকৃত কপি’ হতে পারে না। একে ফার্স্ট কপি বলছেন শিল্পীরা। তাই ‘মূল কপি’ নামটি যথার্থ কিনা তা ভেবে দেখা দরকার।
মাসুদ করিম - ৪ নভেম্বর ২০২৪ (৩:৫৫ পূর্বাহ্ণ)
4 November: On this day in 1972, the Constituent Assembly adopted the first #constitution for the newly independent state called #Bangladesh.
Although the current Interim Govt led by Professor Dr. Md. #Yunus has cancelled state observance of this day along with other days of historic significance, the #ICSF believes that it is an integral and inseparable part of our founding history which merits observance with due respect.
In fact, the recent debates and discussions surrounding potential amendments and/or repeal of the constitution has made this year’s constitution day more important than any since its adoption.
To that end, we have prepared a compilation of video messages from activists, academics and researchers on various aspects of the constitution, both historical and contemporary.
https://x.com/icsforum/status/1853152340053791004
সংবিধান: সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ | ৪ নভেম্বর | বাংলাদেশ সংবিধান দিবস | Bangladesh Constitution https://www.youtube.com/watch?v=lUWSvyjiHdA
মাসুদ করিম - ৯ নভেম্বর ২০২৪ (৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ)
সাংবিধানিক সংলাপ (পর্ব ১) | ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর | ড. রায়হান রশিদ | প্রজন্ম সংলাপ
YouTube video link: https://youtu.be/43CASx-AMJs?si=n7TfUp2BttPbH5fq
#constitution #Bangladesh #BangladeshCrisis #AllEyesOnBangladesh #DrYunus
ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর (https://facebook.com/BarristerTania/)
ড. রায়হান রশিদ (@rayhanrashid
)
Please subscribe to our YouTube Channel => https://youtube.com/@ICSForum
https://x.com/icsforum/status/1853649949835382874
মাসুদ করিম - ৯ নভেম্বর ২০২৪ (৫:৪১ পূর্বাহ্ণ)
বাংলাদেশের সংবিধান দিবস: ‘মুজিববাদী ফ্যাসিস্ট’ সংবিধানের প্রতি হাঁটুগাড়া শ্রদ্ধা!
শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
https://www.banglatribune.com/columns/871341/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%B8-%E2%80%98%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%80-%E0%A6%AB%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E2%80%99
আজ বাংলাদেশের সংবিধান দিবস। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে মূল সংবিধান গ্রহণ করা হয়েছিল বলে এই দিন সংবিধান দিবস হিসেবে পালিত হয়। ভাগ্য ভালো যে এই সংবিধানটি এখনও ‘খাড়া’ আছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সুশীল, সাবেক বিচারপতি ও কোনও কোনও বিভ্রান্ত বাম তাত্ত্বিক রব তুলেছেন যে বাংলাদেশের মূল সংবিধান ‘মুজিববাদী ফ্যাসিবাদ’ আক্রান্ত; ফলে সংবিধান পুনরায় লিখতে হবে অথবা এটি ফেলে দিয়ে আস্ত একখান নতুন সংবিধানের মুসাবিদা করতে হবে। যেন ‘মামুর বাড়ির আবদার’! অথবা ‘বাচ্চা পোলাপানের ইচিং-বিচিং খেলা’! ইচ্ছে হলো আর ৩০ লাখ শহীদ ও ৫ লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিলাম। তারপর বাংলাদেশ বিরোধী শক্তি, সুশীল ও বাম হঠকারীদের কথায় লিখে ফেললাম নতুন সংবিধান। যারা সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলছেন, তাদের কি এটা করার বৈধ এখতিয়ার আছে? তারা কি জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েছেন? তারা কি রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তি, শিক্ষক, আইনজীবী, কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ সব শ্রেণি-পেশা ও লিঙ্গের মানুষ, ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের মতামত নিয়েছেন? যদি না নিয়ে থাকেন, তাহলে সংবিধানের একটি অক্ষর স্পর্শ করার এখতিয়ারও তাদের নেই, পুনর্লিখন তো বহু বহু দূরের কল্পনা।
এত বড় একটা মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, যার তুলনা ইতিহাসে বিরল; সেই মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব, মুক্তিযুদ্ধের ফসল সংবিধান নিয়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় কুতর্ক তোলা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। কাতালোনিয়া, কাশ্মির, উত্তর আয়ারল্যান্ড, বেলুচিস্তান, কুর্দিস্তানসহ কত কত প্রদেশ বা স্থানের কত কত স্বাধীনতাকামী ধর্মীয় বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বছরের পর বছর সশস্ত্র সংগ্রাম করে এখনও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি; অথচ ৯ মাসের একটি জনযুদ্ধের মাধ্যমে প্রবল পরাক্রমশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা চাট্টিখানি বিষয় ছিল না। কেননা, পাকিস্তানের সমর্থনে তখন ছিল বৈশ্বিক মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সমর্থনও পায়নি। বিশ্বের ইতিহাসে বাঙালিদের এমন বিরল এক অর্জনকে আজ কৌশলে প্রশ্নবিদ্ধ করে অবান্তর করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে।
তবে ইতিহাস সাক্ষী, যারা মুক্তিযুদ্ধকে অবান্তর করার চেষ্টা করছেন, অল্প কিছু দিনের মধ্যে তারা নিজেরাই অবান্তর হয়ে যাবেন।
যারা সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলছেন, এটি করার বৈধ এখতিয়ার তাদের আছে কিনা, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। প্রশ্নটির জবাব পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের মূল সংবিধান কাদের দ্বারা এবং কী প্রক্রিয়ায় রচিত ও গৃহীত হয়েছিল, সেটি জানা দরকার। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬২টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত ৭টি মহিলা আসনসহ সর্বমোট ৩১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগরে আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৭টি। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের মোট ৩০০টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮ আসন লাভ করে। ফলে প্রাদেশিক পরিষদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১০টি আসনসহ আওয়ামী লীগরে দলীয় আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৮টি।
৭০-এর নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছিল ঐতিহাসিক ৬ দফার জন্য; যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল– তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও নাগরিক স্বাধিকার। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দলের নির্বাচিত সদস্যদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খানেরা তাদের সেনাবাহিনীর মাধ্যমে যখন জেনোসাইড শুরু করলো, তখন শুরু হলো বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে ১৯৭২ সালে জনগণের পক্ষ থেকে সংবিধান রচনার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হলো গণপরিষদের ওপর।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর এবং ১৭ জানুয়ারি যথাক্রমে পাকিস্তান জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে নির্বাচিত ৪৬৯ জন সদস্যের মধ্যে ৪০৩ জন এমএনএ এবং এমপিএ নিয়ে গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের গণপরিষদ, যেটি ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত অস্থায়ী সংসদ হিসেবে কার্যকর ছিল। ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যের সংবিধান রচনা কমিটি গঠন করা হয়।
এই কমিটির সদস্যরা একটি খসড়া সংবিধান তৈরি করেন, যেটির ওপর আলোচনা হয় এবং বেশ কয়েকটি সংশোধনী গ্রহণ করার পরে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত হয় বাংলাদেশের সংবিধান। ইতিহাসের এই বয়ানটি তুলে ধরার কারণ হলো, ১৯৭২ সালে যারা সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন তারা ছিলেন জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থনে সমর্থিত। দ্বিতীয়ত, এই সংবিধান প্রণয়ন করার জন্য ড. কামালের নেতৃত্বে আইনজীবী ও গণপরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি দক্ষ দল গঠন করা হয়েছিল। তৃতীয়ত, খসড়া সংবিধান নিয়ে গণপরিষদে পর্যাপ্ত আলোচনা হয়েছিল। ফলে, একটি সংবিধান প্রণয়নের জন্য জনগণের যে ম্যান্ডেট এবং আইনের যে পদ্ধতিগত শর্তগুলো পূরণ করতে হয়, সেগুলো বাংলাদেশের মূল সংবিধান প্রণয়নের সময় পূরণ হয়েছিল। এছাড়া মান ও বিষয়বস্তুর বিচারেও এটি ছিল একটি আদর্শ সংবিধান। এবার সংবিধানের বিষয়বস্তুর দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।
১৯৭২ সালের সংবিধানের মুখবন্ধের তৃতীয় অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, “আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা– যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য, ও স্বাধীনতা নিশ্চিত হইবে…”। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মুখবন্ধে যে কথা বলা হয়েছে, একটি রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে মহত্তর উদ্দেশ্য আর কি হতে পারে? বলা হয়েছে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হবে একটি শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল মানুষের জন্য আইনের শাসন থাকবে এবং সকলের মানবাধিকার নিশ্চিত হবে। আরও বলা হয়েছে ন্যায়বিচারের কথা, যে ন্যায়বিচার হবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক।
এখন কথা হচ্ছে, যেসব শিক্ষার্থী জুলাই-আগস্টে আন্দোলন করেছেন, তাদের মূল দাবি ছিল বিসিএস চাকরিতে বৈষম্য নিরসন। পরবর্তীতে সেই আন্দোলন সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন ঘটে সরকারের এবং রাষ্ট্র সংস্কারের গণ-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। বস্তুনিষ্ঠ বিচারে বাংলাদেশ সংবিধানের মুখবন্ধে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে, সেটি ভাষা আন্দোলন এবং ৬৯ থেকে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ৩টি গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার চেয়েও বড়; শুধু বিস্তৃতিতে নয়, চেতনা ও আদর্শের বিচারেও মহত্তর। ৭২ সালের মূল সংবিধানকে যারা ‘মুজিববাদী ফ্যাসিস্ট’ সংবিধান বলছেন, তাদের বেশিরভাগের সংবিধান সম্পর্কে কোনও পাঠ নেই; কেননা, তারা সংবিধান থেকে এর সমর্থনে কোনও অনুচ্ছেদ দেখাতে পারবেন না।
মূল সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে “জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সমতা, চিন্তা ও বাকস্বাধীনতা, সভা ও সমাবেশ করার অধিকার, ধর্ম পালনের অধিকার, সম্পত্তির মালিক হবার অধিকার, গ্রেপ্তার ও দণ্ড থেকে সুরক্ষা, সুবিচার পাওয়ার অধিকার। এই অধিকারগুলো ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাসহ ১৯৬৬ সালে গৃহীত দুটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত, মানুষের ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক চিন্তার ক্ষেত্রে এযাবৎ যেসব চিন্তা ও দর্শনের বিকাশ ঘটেছে তার নির্যাস লিপিবদ্ধ হয়েছে মূল সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির মধ্যে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি, গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা, মালিকানার নীতি, জাতীয় জীবনে নারীদের অংশগ্রহণ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন।
আমার মূল আপত্তিটি সংবিধানের পুনর্লিখনের ব্যাপারে, সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে নয়। ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারসহ শক্তিশালী গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য যে সংশোধনী দরকার, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সেটি করতে পারবেন। যাই হোক, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ‘মোটিভ’ নিয়ে যারা মূল সংবিধানকে ‘মুজিববাদী ফ্যাসিস্ট’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন, তাদের সঙ্গে প্রবলতরভাবে দ্বিমত করে বাংলাদেশের আদর্শ সংবিধানের প্রতি রইলো আমার হাঁটুগাড়া শ্রদ্ধা।